জাতীয়তাবাদ কথাটি ইংরেজী Nationalism এর অনুবাদ। যা Nation (জাতি) শব্দ হতে উদ্ভূত। আরবীতে قومية অর্থ জাতীয়তা । যা قوم (জাতি) শব্দ হতে উদ্ভূত।
একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা, শান্তি ও অগ্রগতি এবং বহির্বিশ্বে উজ্জল ভাবমূর্তি অনেকাংশে নির্ভর করে সে দেশের জাতি কতটা সুসংহত, স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত এবং ঐক্যের বাধনে সংঘবদ্ধ তার ওপর। তবে প্রশ্ন হল, এই জাতীয় সংহতি ও ঐক্যের ভিত্তি কী হবে? এই প্রশ্নের সমাধানকল্পে বিপরীতমুখী দুটি দর্শন বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
১.ইসলামী দর্শন।
২.গণতান্ত্রিক দর্শন।
ইসলামী দর্শন: জাতীয়তা বা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হল ধর্ম। এখানে বংশ, বর্ণ, ভাষা কিংবা ভৌগলিক সীমারেখার কোন ভূমিকা নেই। আর সত্য ধর্ম যেহেতু কেবল ইসলাম, এছাড়া বাকী সব অসার এবং মিথ্যা, কাজেই এই দৃষ্টিকোণ থেকে সারা বিশ্বের সত্যধর্মের অনুসারী মুসলমান হল এক জাতি এবং সমস্ত মিথ্যাধর্মের অনুসারী কাফের। চাই তারা হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ কিংবা ইসলাম ভিন্ন অন্য যে কোন ধর্মেরই হোক না কেন, এক জাতি।
এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
১. إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
অর্থ: প্রকৃতপক্ষে সকল মুসলমান ভাই ভাই ….। [সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১০]
২. هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ..
অর্থ: তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের ও কেউ মুমিন। তোমরা যা-কিছু কর আল্লাহ্ তা ভালভাবে দেখছেন। [সূরা তাগাবুন, আয়াত: ২]
৩. وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ.
অর্থ: আপনি বলেদিন, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তো সত্য এসে গেছে। এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনুক এবং যার ইচ্ছা কুফর অবলম্বন করুক …….। [সূরা কাহ্ফ, আয়াত: ২৯]
৪. ( عن النعمان بن بشير، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «المسلمون كرجل واحد، إن اشتكى عينه، اشتكى كله، وإن اشتكى، رأسه اشتكى كله (الصحيح للإمام مسلم رقم الحدىث:67 [
অর্থ: সকল মুসলমান এক ব্যক্তির ন্যায়। যদি তার চোখে ব্যথা অনুভূত হয়, তাহলে পুরা দেহে তা অনুভব হয় আর যদি মাথায় ব্যথা অনুভব হয়, তাহলে পুরা দেহে তা অনুভব হয় …। [সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৬৭]
৫. ( الكفر ملة واحدة….. (موطأ للامام مالك رقم الحديث:728
অর্থ: সমস্ত কাফের এক জাতি। [মুয়াত্তায়ে মালেক, হাদীস: ৭২৮]
পক্ষান্তরে গণতন্ত্রের দর্শন হল: ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হবে বংশ, ভাষা বা ভৌগলিক অবস্থান। এই দর্শন মতে প্রতিটি দেশ এক একটি জাতি, চাই সে দেশের নাগরিক যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন। বংশ, ভাষা ও ভৌগলিক সীমারেখার আলোকে জাতীয় ঐক্যের নির্ণয়ে গণতান্ত্রিক এই দর্শনই জাতীয়তাবাদ নামে প্রসিদ্ধ।
জাতীয়তাবাদ সংহতি না কি বিভক্তি?: গণতন্ত্রের দর্শন মতে যদি জাতীয় ঐক্যের মানদণ্ড নির্ণয় করা হয় ভৌগলিক অবস্থানকে, তবে এতে করে একই দেশের জেলা ও প্রদেশগুলো ধর্ম, বর্ণ কিংবা ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠবে এবং মানব জাতি ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে বৈরিতা ও সংকীর্ণতার আধারে হারিয়ে যাবে।
বস্তুত: ন্যাশনালিযম্ (Nationalism) বা জাতীয়তাবাদ এমন একটি থিওরি যা মুসলমানদেরকে শতধা বিভক্ত করে তাদের মেরুদণ্ড চিরতরে ভেঙ্গে দিয়েছে। ইসলাম এই দর্শনকে কোনভাবেই সমর্থন করে না। কেননা সমগ্র আদম সন্তান পরস্পরে ভাই ভাই এবং সারা পৃথিবীর মানবকুল একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আর এই ভ্রাতৃত্বের ভিত্তি হচ্ছে ঈমান ও ইসলাম। কেননা হযরত আদম আ. ছিলেন ঈমানদার এবং তাওহীদ ও একত্ববাদে বিশ্বাসী একজন পয়গম্বর। এর বিপরীতে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ছিন্ন করা এবং ভিন্ন জাতি বা দল সৃষ্টির ভিত্তি হচ্ছে কুফর। অতএব যে ব্যক্তি কাফের হয়ে গেল, সে এই মানবীয় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ছিন্ন করে দিল। কাজেই মানব জাতির মধ্যে দল বা উপদল সৃষ্টি শুধু ঈমান ও কুফরের ভিত্তিতেই হতে পারে। বর্ণ, ভাষা, গোত্র বা ভৌগলিক স্থানের মধ্য থেকে কোনটাই মানবীয় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে ছিন্ন করতে পারে না। একই পিতার সন্তান যদি বিভিন্ন শহরে বসবাস করে, কিংবা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে অথবা পরস্পরে গঠন আকৃতি ভিন্ন হয়; তাহলে তাদের এই বর্ণ, ভাষা ও স্থানের ভিন্নতা স্বত্বেও তারা পরস্পরে ভাই। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারে না।
তবে হ্যাঁ, আভিধানিক অর্থে দেশ বা গোত্রীয় বন্ধনের ভিত্তিতে জাতি শব্দের ব্যবহার করা যেতে পারে। কুরআনে কারীমেও এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আম্বিয়ায়ে কেরাম তাদের গোত্রীয় লোকদেরকে “ইয়া কওমী” বলে সম্বোধন করেছেন। অথচ তার গোত্রের লোকেরা কাফের ছিল। এতে বোঝা যায়, আভিধানিক অর্থে গোত্রীয় লোকদেরকে জাতি বলা যায়। তবে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি এর উপর রাখা যায় না।
মোট কথা, কুরআন হাদীসের ভাষায় জাতীয়তার ভিত্তি হল ধর্ম। গোটা বিশ্বে দুটি মাত্র জাতি, একটি মুসলিম অপরটি কাফের। শরী‘আতে উত্তরাধিকারের বিধানেও সমস্ত কাফের সম্প্রদায়কে এক জাতি আর মুসলমানদেরকে আরেক জাতি গণ্য করা হয়েছে। যদিও তারা এক মায়ের গর্ভজাত বা একই বাপের ঔরসজাত হোক না কেন। আজকের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন জাতীয়তাবাদ কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতা-বাদ যায় বলা হোক না কেন, তা সবই ইসলাম ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী। কোন মুসলমান তা সমর্থন করতে পারে না। কারণ তা দ্বীন ও ঈমানের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।