হযরত ইউসুফ (আঃ) – ০১

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কে বলেন, الكريمُ بنُ الكريمِ بنِ الكريمِ بنِ الكريمِ يوسفُ بنُ يعقوبَ بنِ اسحاقَ بنِ ابراهيمَ عليهمُ السلامُ- ‘নিশ্চয়ই মর্যাদাবানের পুত্র মর্যাদাবান, তাঁর পুত্র মর্যাদাবান, তাঁর পুত্র মর্যাদাবান। তাঁরা হলেন ইবরাহীমের পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকূব ও তাঁর পুত্র ইউসুফ ‘আলাইহিমুস সালাম’ (তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক!)।[1]

নবীগণের মধ্যে হযরত ইউসুফ (আঃ) হ’লেন একমাত্র নবী, যাঁর পুরা কাহিনী একটি মাত্র সূরায় ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইউসুফ-এর ১১১টি আয়াতের মধ্যে ৩ থেকে ১০১ আয়াত পর্যন্ত ৯৯টি আয়াতে ইউসুফের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। এ ছাড়া অন্যত্র কেবল সূরা আন‘আম ৮৪ এবং সূরা মুমিন ৩৪ আয়াতে তাঁর নাম এসেছে।

সূরা নাযিলের কারণ :

সত্যনবী এবং শেষনবী জেনেও কপট ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রতি পদে পদে কষ্ট দিত এবং পরীক্ষা করার চেষ্টা করত। তাদের সমাজনেতা ও ধর্মনেতাদের কাজই ছিল সর্বদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা ও তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা। এ সময় মক্কায় কোন আহলে কিতাব বসবাস করত না এবং মক্কার লোকেরা ইউসুফ বা অন্য নবীদের সম্পর্কে কিছু জানতও না। ফলে মদীনার কুচক্রী ইহুদীদের একটি দল মক্কায় এসে একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করল যে, বলুন দেখি, কোন নবী শামে (সিরিয়ায়) ছিলেন। অতঃপর তার ছেলেকে সেখান থেকে মিসরে বহিষ্কার করা হয়। তাতে ঐ ব্যক্তি কেঁদে অন্ধ হয়ে যান? (এটি বানোয়াট কথা। কেননা কেবলমাত্র কেঁদে কারু চোখ অন্ধ হয় না এবং এটি নবীগণের মর্যাদার খেলাফ)। একথার জওয়াবে অতঃপর সূরা ইউসুফ পুরাটা একত্রে নাযিল হয়।[2] তাদের পন্ডিতেরা তওরাত-ইঞ্জীলে বর্ণিত উক্ত ঘটনা আগে থেকেই জানতো। তাওরাত-যবূর-ইনজীল সবই ছিল হিব্রু ভাষায় রচিত। আমাদের রাসূল নিজের ভাষাতেই লেখাপড়া জানতেন না, অন্যের ভাষা জানা তো দূরের কথা। ইহুদী নেতাদের সূক্ষ্ম পলিসি ছিল এই যে, উক্ত বিষয়ে উম্মী নবী মুহাম্মাদ-এর পক্ষে জবাব দেওয়া আদৌ সম্ভব হবে না। ফলে লোকদের মধ্যে তার নবুঅতের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হবে এবং তার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা যোরদার করা যাবে।

বস্ত্ততঃ তাদের প্রশ্নের উত্তরে ইউসুফ (আঃ) ও ইয়াকূব পরিবারের প্রকৃত ঘটনা ‘অহি’ মারফত ধারাবাহিকভাবে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বর্ণনা করে দেন। যা ছিল রাসূলের জন্য নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মু‘জেযা।[3] শুধু ইউসুফের ঘটনাই নয়, আদম থেকে ঈসা পর্যন্ত কুরআনে বর্ণিত বাকী ২৪ জন নবী ও তাঁদের কওমের ঘটনাবলী বর্ণনা ছিল শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য মু‘জেযা। কেননা তাঁদের কারু সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। তাদের সম্পর্কে লিখিত কোন বই-পত্র সে যুগে ছিল না। আর তিনি নিজে কারু কাছে কখনো লেখাপড়া শিখেননি। অথচ বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিগত যুগের শিক্ষণীয় ঘটনাবলী তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে উম্মতকে শুনিয়ে গেছেন কুরআনের মাধ্যমে। এগুলিই তাঁর নবুঅতের অন্যতম প্রধান দলীল ছিল। এরপরেও খাছ করে ইউসুফ (আঃ) ও তাঁর পিতা ইয়াকূব (আঃ)-এর পরিবারের ঘটনাবলী ছিল বিগত ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। যার প্রয়োজনীয় অংশগুলি গুছিয়ে একত্রিতভাবে উপস্থাপন করাই হ’ল সূরা ইউসুফের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য।

সুন্দরতম কাহিনী :

অন্যান্য নবীদের কাহিনী কুরআনের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজন অনুসারে বিক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ইউসুফ নবীর ঘটনাবলী একত্রে সাজিয়ে একটি সূরাতে সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবতঃ সেকারণে এটিকে أَحْسَنُ الْقَصَصِ ‘সুন্দরতম কাহিনী’ বলা হয়েছে (ইউসুফ ১২/৩)। দ্বিতীয়তঃ এর মধ্যে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তা যেমনি অলৌকিক, তেমনি চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয়। তৃতীয়তঃ অন্যান্য নবীদের কাহিনীতে প্রধানতঃ উম্মতের অবাধ্যতা ও পরিণামে তাদের উপরে আপতিত গযবের কাহিনী এবং অন্যান্য উপদেশ ও হিকমত সমূহ প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনীতে রয়েছে দুনিয়ার তিক্ত বাস্তবতা এবং আল্লাহর উপরে অকুণ্ঠ নির্ভরতার সমন্বয়ে সৃষ্ট এক অতুলনীয় ও অভাবনীয় এক ট্রাজিক জীবন নাট্য। যা পাঠ করলে যেকোন বোদ্ধা পাঠকের জীবনে সৃষ্টি হবে সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা ও তাঁর নিকটে আত্মসমর্পণের এক অনুপম উদ্দীপনা।

আরবী ভাষায় কেন?

আল্লাহ বলেন, ‘আমরা একে আরবী কুরআন হিসাবে নাযিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার’ (ইউসুফ ১২/২)। এর অন্যতম কারণ ছিল এই যে, ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনী যারা জানতে চেয়েছিল, তারা ছিল আরবীয় ইহুদী এবং মক্কার কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ। তাই তাদের বোধগম্য হিসাবে আরবী ভাষায় উক্ত কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে এবং আরবীতেই সমগ্র কুরআন নাযিল করা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন ভাষাগর্বী আরবরা কুরআনের অপূর্ব ভাষাশৈলীর কাছে হার মেনেছে, অন্যদিকে তেমনি কিতাবধারী ইহুদী-নাছারা পন্ডিতেরা কুরআনের বিষয়বস্ত্ত ও বক্তব্য সমূহের সত্যতা ও সারবত্তা উপলব্ধি করে নিশ্চুপ হয়েছে।

কাহিনীর সার-সংক্ষেপ :

কাহিনীটি শৈশবে দেখা ইউসুফের একটি স্বপ্ন দিয়ে শুরু  হয়েছে এবং তার সমাপ্তি ঘটেছে উক্ত স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাঝখানের ২২/২৩ বছর মতান্তরে চল্লিশ বছর অনেকগুলি বিয়োগান্ত ও চমকপ্রদ ঘটনায় পূর্ণ। কাহিনী অনুযায়ী ইউসুফ শৈশবকালে স্বপ্ন দেখেন যে, ১১টি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্র তাকে সিজদা করছে। তিনি এই স্বপ্ন পিতা হযরত ইয়াকূবকে বললে তিনি তাকে সেটা গোপন রাখতে বলেন। কিন্তু তা ফাঁস হয়ে যায়। ফলে এটা তার সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি ভেবে সৎ ভাইয়েরা হিংসায় জ্বলে ওঠে এবং তারা তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করে। অতঃপর তারা তাকে জঙ্গলের একটি পরিত্যক্ত অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে। তিনদিন পরে পথহারা ব্যবসায়ী কাফেলার নিক্ষিপ্ত বালতিতে করে তিনি উপরে উঠে আসেন। পরে ঐ ব্যবসায়ীরা তাকে মিসরের রাজধানীতে বিক্রি করে দেয়। ভাগ্যক্রমে মিসরের অর্থ ও রাজস্ব মন্ত্রী ক্বিৎফীর (قطفير) তাকে খরিদ করে বাড়ীতে নিয়ে যান ক্রীতদাস হিসাবে। কয়েক বছরের মধ্যে যৌবনে পদার্পণকারী অনিন্দ্য সুন্দর ইউসুফের প্রতি মন্ত্রীর নিঃসন্তান স্ত্রী যুলায়খার আসক্তি জন্মে। ফলে শুরু হয় ইউসুফের জীবনে আরেক পরীক্ষা। একদিন যুলায়খা ইউসুফকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে কুপ্রস্তাব দেয়। তাতে ইউসুফ সম্মত না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলে পিছন থেকে যুলায়খা তার জামা টেনে ধরলে তা ছিঁড়ে যায়। দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই দু’জনে ধরা পড়ে যায় বাড়ীর মালিক ক্বিৎফীরের কাছে। পরে যুলায়খার সাজানো কথামতে নির্দোষ ইউসুফের জেল হয়। যুলায়খা ছিলেন মিসররাজ রাইয়ান ইবনু অলীদের ভাগিনেয়ী।[4]

অন্যূন সাত বছর জেল খাটার পর বাদশাহর এক স্বপ্নের ব্যাখ্যা দানের পুরস্কার স্বরূপ তাঁর মুক্তি হয়। পরে তিনি বাদশাহর অর্থ ও রাজস্ব মন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং বাদশাহর আনুকূল্যে তিনিই হন সমগ্র মিসরের একচ্ছত্র শাসক। ইতিমধ্যে ক্বিৎফীরের মৃত্যু হ’লে বাদশাহর উদ্যোগে বিধবা যুলায়খার সাথে তাঁর বিবাহ হয়।[5] বাদশাহর দেখা স্বপ্ন মোতাবেক মিসরে প্রথম সাত বছর ভাল ফসল হয় এবং পরের সাত বছর ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষের সময় সুদূর কেন‘আন থেকে তাঁর বিমাতা দশ ভাই তাঁর নিকটে খাদ্য সাহায্য নিতে এলে তিনি তাদের চিনতে পারেন। কিন্তু নিজ পরিচয় গোপন রাখেন। পরে তাঁর সহোদর একমাত্র ছোট ভাই বেনিয়ামীনকে আনা হ’লে তিনি তাদের সামনে নিজের পরিচয় দেন এবং নিজের ব্যবহৃত জামাটি ভাইদের মাধ্যমে পিতার নিকটে পাঠিয়ে দেন। বার্ধক্য তাড়িত অন্ধ পিতা ইয়াকূবের মুখের উপরে উক্ত জামা রেখে দেওয়ার সাথে সাথে তাঁর দু’চোখ খুলে যায়। অতঃপর ইউসুফের আবেদন ক্রমে তিনি সপরিবারে মিসর চলে আসেন। ইউসুফ তার ভাইদের ক্ষমা করে দেন। অতঃপর ১১ ভাই ও বাপ-মা তাঁর প্রতি সম্মানের সিজদা করেন। এভাবেই শৈশবে দেখা ইউসুফের স্বপ্ন সার্থক রূপ পায় (অবশ্য ইসলামী শরী‘আতে কারু প্রতি সম্মানের সিজদা নিষিদ্ধ)। সংক্ষেপে এটাই হ’ল ইউসুফ (আঃ) ও ইয়াকূব পরিবারের    ফিলিস্তীন হ’তে মিসরে হিজরতের কারণ ও প্রেক্ষাপট, যে বিষয়ে ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করেছিল মূলতঃ তাঁকে ঠকাবার জন্য।


[1]. বুখারী, মিশকাত হা/৪৮৯৪ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ১৩।
[2]. কুরতুবী, ইউসুফ ৭; ইবনু জারীর হা/১৮৭৮৬ ইবনু আববাস হ’তে।
[3]. উল্লেখ্য যে, ইউসুফ (আঃ)-এর চরিত্র বাইবেলে অত্যন্ত বিকৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে (দ্রঃ সুলায়মান মানছূরপুরী, রহমাতুললিল আলামীন ২/২৪৪-২৪৬।
[4]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়াল নিহায়াহ ১/১৯০।
[5]. আল-বিদায়াহ ১/১৯৬-১৯৭। তবে মানছূরপুরী বলেন, তাঁর বিবাহ ‘আসনাথ’ নাম্নী এক মহিলার সাথে হয়েছিল। -রাহমাতুললিল আলামীন ৩/১০৭। হ’তে পারে দু’জনেই তাঁর স্ত্রী ছিলেন।