بسم الله الرحمن الرحيم
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি পরিপূর্ণতার গুণাবলী দ্বারা অনুগ্রহ করেছেন এবং তাদের একের উপর অন্যের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন; যাতে তাদেরকে পরীক্ষা করা যায় সেসব বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে, যা থেকে তাদেরকে দেয়া হয়েছে; আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন হক ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই, তার রয়েছে বিরাট রাজত্ব, আর তিনি সুউচ্চ; আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে সর্বোত্তম চরিত্র ও সুন্দর কর্মের পরিপূর্ণতা বিধান করার জন্য; রাত-দিন আল্লাহ রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন তাঁর প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজনের প্রতি, তাঁর সাহাবীগণের প্রতি এবং তাঁদের সর্বোত্তম অনুসরণকারী তাবে‘য়ীগণের প্রতি …।
অতঃপর:
আল্লাহ তা‘আলা মহান রিসালাতের দায়িত্ব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অর্পণ করেছেন; আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ ٱللَّهُ أَعۡلَمُ حَيۡثُ يَجۡعَلُ رِسَالَتَهُۥۗ ﴾ [الانعام: ١٢٤] “আল্লাহ তাঁর রিসালাত কোথায় অর্পণ করবেন তা তিনিই ভাল জানেন”। – [ আল-আন‘আম: ১২৪ ]। তিনি তা এমন এক ব্যক্তির নিকট অর্পণ করেছেন, যাঁকে তিনি সৃষ্টিগত, চরিত্রগত (১) ও আকৃতি-প্রকৃতিগতভাবে পূর্ণতা দান করেছেন, যাতে তিনি এই মহান রিসালাতের দায়িত্ব বহন করতে পারেন; সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টিগত ও চরিত্রগতভাবে সবচেয়ে পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন।
প্রথম অধ্যায়
তাঁর সৃষ্টিগত গুণাবলী
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টিকে পরিপূর্ণ করেছেন, যেমন তাঁর শরীরের বর্ণনায় এসেছে যে, তাঁর শরীরের গঠন ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ সুদর্শন সুন্দর(২); সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের মধ্যে মধ্যম আকৃতির(৩) ছিলেন; তিনি খুব বেশি লম্বাও ছিলেন না, আবার বেঁটেও ছিলেন না(৪); তাঁর উভয় কাঁধের দূরত্ব ছিল অল্প বেশি(৫); তিনি ছিলেন স্থূলাকার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারী(৬), ভারসাম্যপূর্ণ; বিস্তৃত বুকের অধিকারী(৭); আর তিনি ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম চেহারার(৮) অধিকারী; তিনি ছিলেন দুধে আলতার মত ফর্সা উজ্জ্বল বর্ণের(৯); চেহারা গোলাকৃতির(১০); সাথে চিবুকদ্বয় ছিল সাবলীল(১১); চক্ষুদ্বয় ছিল গভীর কৃষ্ণতা বিশিষ্ট ডাগর ডাগর(১২); মনোরম ভ্রূ, যা উভয়ের মাঝে সংযোগ বিহীন(১৩); সরু নাক(১৪); সুন্দর মুখ(১৫); প্রশস্ত দাঁত, সামনের দাঁতগুলো উজ্জ্বল চকচকে(১৬); ঘন সুন্দর দাঁড়ি(১৭)।
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মারা যান, তখন তাঁর মাথা ও দাঁড়ির মধ্যে বিশটি চুলও সাদা ছিল না; আর তাও কিছু সাদা ছিল তাঁর নিম্ন ঠোঁটের নীচের ছোট দাঁড়িতে, আর কিছু ছিল কানপট্টিতে এবং মাথার মধ্যে ছিল সামান্য কয়টি(১৮); তাঁর মাথার চুল দুই কানের লতি থেকে দুই কাঁধের মাঝামাঝি পৌঁছে যেত(১৯); তিনি (কপালের উপর চুল) ঝুলিয়ে রাখতেন, অতঃপর তিনি তাকে সিঁথি কাটার দিকে পরিবর্তন করেন(২০); ফলে তিনি মাথার দুই পাশের মাঝ বরাবর সিঁথি কাটতেন।
টিকাঃ
(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٖ ٤ ﴾ [القلم: ٤]
“আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর রয়েছেন।” (সূরা আল-ক্বলম: ৪)।
আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন:
« فَإِنَّ خُلُقَ نَبِىِّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ الْقُرْآنَ » . ( رواه مسلم ) .
“কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র ছিল ‘আল-কুরআন’।” [মুসলিম, আস-সহীহ: মুসাফিরগণের সালাত ( صلاة المسافرين ) / ১৮, হাদিস নং- ৭৪৬, ১ / ৫১৩ ]।
আর বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:
« كان رسول الله صلى الله عليه و سلم أحسن الناس وجها و أحسن خُلقا » . ( رواه البخاري و مسلم ) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর চেহারা ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী।” [ বুখারী, আস-সহীহ: মানাকিব / ২৩, ৪ / ১৬৫; মুসলিম, আস-সহীহ: ফাদায়েল / ২৫, হাদিস নং- ২৩৩৭, ৪ / ১৮১৯ ]।
আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان رسول الله صلى الله عليه و سلم أحسن الناس خُلقا » . ( رواه مسلم ) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম চরিত্রের অধিকারী।” [মুসলিম, আস-সহীহ: ফাদায়েল / ১৩, হাদিস নং- ২৩১০, ৪ / ১৮০৫ ]।
(২) বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان النبي صلى الله عليه و سلم مربوعا , بعيد ما بين المنكبين , له شعر يبلغ شحمة أذنيه , رأيته في حلة حمراء , لم أر شيئا قط أحسن منه » . ( رواه البخاري )
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মধ্যম আকৃতির পুরুষ; তাঁর উভয় কাঁধের দূরত্ব ছিল অল্প বেশি; চুল ছিল কানের লতিকা পর্যন্ত লম্বিত; আমি তাঁকে লাল পোষাক পরিহিত অবস্থায় দেখেছি; তাঁর চেয়ে সুন্দর কিছু আমি কখনও দেখি নি।” [ বুখারী, আস-সহীহ: মানাকিব / ২৩, ৪ /১৬৫; মুসলিম, আস-সহীহ: ফাদায়েল / ২৫, হাদিস নং- ২৩৩৭, ৪ / ১৮১৮]।
জুরাইরী র. থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ তোফায়েল রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
«قُلْتُ: لَهُ أَرَأَيْتَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ؟ قَالَ: نَعَمْ , كَانَ أَبْيَضَ , مَلِيحَ الْوَجْهِ » . (رواه مسلم ) .
“আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, আপনি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন? তিনি বললেন: হ্যাঁ, তিনি ছিলেন ফর্সা, লাবণ্যময় চেহারার অধিকারী।” [মুসলিম, আস-সহীহ: ফাদায়েল / ২৮, হাদিস নং- ২৩৪০, ৪ / ১৮২০]।
আর উম্মে মা‘বাদ কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে:
« رَأَيْتُ رَجُلا ظَاهِرَ الْوَضَاءَةِ ، أَبْلَجَ الْوَجْهِ ، لَمْ تَعِبْهُ نُحْلَةٌ ، وَلَمْ تُزْرِ بِهِ صُقْلَةٌ ، وَسِيمٌ قَسِيمٌ … أَجْمَلُ النَّاسِ وَأبْهَاهُ مِنْ بَعِيدٍ , وَأَجْلاهُ وَأَحْسَنُهُ مِنْ قَرِيبٍ »
“আমি এক ব্যক্তিকে দেখেছি, যার অবস্থা হল- তিনি পরিষ্কার সুন্দর, উজ্জ্বল চেহারার অধিকারী, তিনি শীর্ণতার দোষে দুষ্ট নন; নিন্দিত নন ক্ষুদ্রতার অভিযোগে, উজ্জ্বল ফর্সা, হ্যাণ্ডসাম … সবচেয়ে সুন্দর মানুষ, দূর থেকে দেখতে তিনি সর্বাধিক দীপ্তিমান, আর কাছ থেকে দেখতে তিনি অতি উজ্জ্বল ও সুন্দর।”
(৩) হাদিসের মধ্যে তার ব্যখ্যা করা হয়েছে:
« لَيْسَ بِالطَّوِيلِ البائن , وَلاَ بِالْقَصِيرِ» .
তিনি খুব বেশি লম্বাও ছিলেন না, আবার বেঁটেও ছিলেন না। [ ফতহুল বারী: ৬ /৫৬৯ ]।
(৪) রবী‘আ ইবন আবি আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« سمعت أنس بن مالك يصف النبي صلى الله عليه و سلم قال: كان ربعة من القوم , ليس بالطويل , ولا بالقصير » . ( رواه البخاري )
“আমি আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের (শারীরিক) গুণাবলী বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন: “তিনি ছিলেন সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যম আকৃতির মানুষ; তিনি বেশি লম্বাও ছিলেন না, আবার বেঁটেও ছিলেন না ।” [ বুখারী, আস-সহীহ: মানাকিব / ২৩, ৪ /১৬৪]।
আর বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে:
« كان النبي صلى الله عليه و سلم مربوعا … » . ( رواه البخاري ) .
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মধ্যম আকৃতির পুরুষ …।” [ বুখারী, আস-সহীহ: মানাকিব / ২৩, ৪ /১৬৫]।
(৫) বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان النبي صلى الله عليه و سلم مربوعا , بعيد ما بين المنكبين … » . ( رواه البخاري ) .
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মধ্যম আকৃতির পুরুষ; তাঁর উভয় কাঁধের দূরত্ব ছিল অল্প বেশি; …।” [বুখারী, আস-সহীহ: মানাকিব / ২৩, ৪ /১৬৫]।
(৬) আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
« لم يكن النبي صلى الله عليه وسلم بالطويل ولا بالقصير، شثن الكفين ، والقدمين ، ضخم الرأس , ضخم الكراديس ، طويل المسرُبَةِ ، إِذا مشى تَكفَّا تكفِّيا . كأنما انحطّ من صبب . لم أر قبله ولا بعده مثله صلى الله عليه وسلم » . ( رواه الترمذي ) .
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম লম্বাও ছিলেন না, আবার বেঁটেও ছিলেন না; তাঁর দুই হাতের তালু ও দুই পায়ের তলা ছিল মাংসবহুল; মাথা ছিল বড় এবং অস্থিগ্রন্থিগুলো ছিল মোটা; বক্ষদেশ থেকে নাভি পর্যন্ত একটি সরু কেশ রেখা ছিল; যখন তিনি হাঁটতেন, তখন সামনের দিকে ঝুঁকে চলতেন, মনে হত যেন তিনি যমীনের নীচু অংশে অবতরণ করছেন। আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে ও পরে তাঁর মত(এত অধিক সুন্দর) আর কাউকে দেখিনি।” [ তিরমিযী, আস-সুনান: মানাকিব / ৮, হাদিস নং- ৩৬৩৭; ৫ / ৫৯৮। আর তিনি বলেছেন: এই হাদিসটি হাসান, সহীহ]।
” شثن “শব্দের অর্থ: হৃষ্টপুষ্ট আঙুলসমূহ। — [ কামূসুল মুহীত, মূল অক্ষর ” شثن “, পৃ. ১৫৯ ]।
” الكراديس “শব্দটি বহুবচন, একবচনে ” الكُردوسة ” যার অর্থ: এমন প্রত্যেক হাড়দ্বয়, যা একই গ্রন্থিতে মিলিত হয়েছে; প্রত্যেক মোটা গোশত বিশিষ্ট হাড়। — [ কামূসুল মুহীত, মূল অক্ষর ” الكردوسة ” ,পৃ. ৭৩৫ ]।
” المسربة “শব্দের অর্থ: বক্ষদেশ থেকে নাভি পর্যন্ত সরু কেশ রেখা। — [কামূসুল মুহীত, মূল অক্ষর” سرب ” , পৃ. ১২৪]।
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان النبي صلى الله عليه و سلم ضخم اليدين والقدمين , حسن الوجه , لم أر بعده ولا قبله مثله , وكان بسط الكفين » . ( رواه البخاري ) .
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই হাত ও দুই পা
ছিল মাংসবহুল; চেহারা ছিল সুন্দর; আমি তাঁর পরে ও তাঁর আগে তাঁর মত (এত অধিক
সুন্দর) আর কাউকে দেখিনি; আর তাঁর হাতের তালু ছিল প্রশস্ত।” [
বুখারী, আস-সহীহ: লিবাস (পোষাক-পরিচ্ছদ) / ৬৮, ৭ / ৫৮]।
(৭) হিন্দ ইবন আবি হালা রা. বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে, যখন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাবলী বর্ণনা করেন, তখন তিনি বলেন:
« كان رسول الله صلى الله عليه وسلم فخما مفخما , يتلألأ وجهه تلألأ القمر ليلة البدر، أطول من المربوع , وأقصر من المشذب ، عظيم الهامة ، رجل الشعر , إن انفرقت عقيقته فرقها وإلا فلا يجاوز شعره شحمة أذنيه. إذا هو وفره ، أزهر اللون ، واسع الجبين ، أزج الحواجب سوابغ فى غير قرن , بينهما عرق يدره الغضب ، أقنى العرنين , له نور يعلوه , يحسبه من لم يتأمله أشم ، كث اللحية , سهل الخدين , ضليع الفم ، مفلج الأسنان , دقيق المسربة ، كأن عنقه جيد دمية فى صفاء الفضة ، معتدل الخلق , بادن متماسك ، سواء البطن والصدر ، عريض الصدر ، بعيد ما بين المنكبين … » .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সম্মান ও মর্যাদার আধার; তাঁর চেহারা পূর্ণিমার রাতের চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর ন্যায় ঝলমল করত; তিনি মধ্যম আকৃতির চেয়ে দীর্ঘদেহী এবং অতিশয় দীর্ঘকায় ব্যক্তির চেয়ে খানিকটা খর্বকায় ছিলেন; তাঁর মাথা (তুলনামূলক) বড় এবং কেশরাজি কিছুটা কোঁকড়ানো ছিল; সহসা সিঁথি করা গেলে সিঁথি করতেন, নতুবা সিঁথি করতেন না; তিনি তাঁর কেশরাজিকে যখন ‘অপরা’ করতেন, তখন তা উভয় কানের লতি অতিক্রম করত; তাঁর বর্ণ অতি প্রাঞ্জল এবং ললাটের উভয় পার্শ্ব প্রশস্ততর ছিল; তাঁর ভ্রূযুগল বিমুক্ত বৃত্তাংশের ন্যায় বাঁকা, খুব সূক্ষ্ম ঘন চুল বিশিষ্ট ছিল; আর ঐ ভ্রূযুগলের মাঝে এমন একটি শিরা ছিল, যা রাগের সময় (অধিক রক্ত সঞ্চারিত হওয়ার ফলে) ভেসে উঠত (প্রকাশ পেত); তাঁর নাসিকা সুদীর্ঘ, অগ্রভাগ সরু ও মধ্যভাগ ন্যূজ্ব ছিল; তাঁর নাসিকায় এমন নূর (জ্যোতি) ছিল, যা নাকের উপর বিকীর্ণ হত; কেউ গভীর মনোযোগ সহকারে তাঁর নাকের প্রতি না তাকালে অত্যুন্নত নাসা মনে করত; তাঁর দাঁড়ি ছিল বিস্তীর্ণ ও খুব ঘন; গণ্ডদ্বয় মসৃণ এবং মুখমণ্ডল প্রশস্ত ছিল; সম্মুখের উপরের পাটির দু’টি দাঁত ও নীচের পাটির দু’টি দাঁত আলাদা ছিল— মিলিত ছিল না; বক্ষদেশ থেকে নাভি পর্যন্ত প্রলম্বিত চুলের রেখাটি ছিল সরু; তাঁর গ্রীবা (ঘাড়) যেন হাতির দাঁত দ্বারা নির্মিত মোতির গ্রীবা কিন্তু তার শুভ্রতা রৌপ্যের ন্যায়; তাঁর দেহের গঠন ছিল সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মাংসপেশী ছিল সূদৃঢ় মজবুত; তাঁর পেট ও বক্ষ ছিল (উচ্চতায়) সমান এবং বক্ষ ছিল প্রশস্ত; তাঁর এক কাঁধ থেকে অন্য কাঁধ অপেক্ষাকৃত দূরত্বে ছিল: …।”
আর ‘তাবাকাতে ইবনে সা‘আদ’ (১ / ৪১৫) –এর মধ্যে আছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان رسول الله صلى الله عليه و سلم شثن القدمين والكفين , ضخم الساقين , عظيم الساعدين , ضخم المنكبين , بعيد ما بين المنكبين , رحب الصدر , رجل الرأس , أهدب العينين , حسن الفم » .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই হাতের তালু ও দুই পায়ের তলা ছিল মাংসবহুল; তাঁর পায়ের নলিযুগলও ছিল মাংসবহুল; বড় হাত বিশিষ্ট; মাংসবহুল কাঁধের অধিকারী; তাঁর উভয় কাঁধের দূরত্ব ছিল অল্প বেশি; প্রশস্ত বুকের অধিকারী; অতি কিঞ্চিত কোঁকড়ানো চুল বিশিষ্ট মাথার অধিকারী; লম্বা ভ্রূ বিশিষ্ট চোখ ও সুন্দর মুখের অধিকারী ।”
(৮) আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان النبي صلى الله عليه و سلم ضخم القدمين حسن الوجه لم أر بعده مثله» . ( رواه البخاري ) .
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই পা ছিল মাংসবহুল, চেহারা ছিল সুন্দর; আমি তাঁর পরে (এত অধিক সুন্দর) আর কাউকে দেখিনি।” [বুখারী, আস-সহীহ: লিবাস (পোষাক-পরিচ্ছদ) / ৬৮, ৭ / ৫৮]।
পূর্বে উল্লেখিত বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে:
« كان رسول الله صلى الله عليه و سلم أحسن الناس وجها … » . ( رواه البخاري ) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর চেহারার অধিকারী …।” [ বুখারী, আস-সহীহ: মানাকিব]
(৯) আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان ربعة من القوم ليس بالطويل ولا بالقصير , أزهر اللون , ليس بأبيض أمهق ولا آدم » . ( رواه البخاري ) .
“তিনি ছিলেন সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যম আকৃতির মানুষ; তিনি বেশি লম্বাও ছিলেন না, আবার বেঁটেও ছিলেন না; তিনি ছিলেন ফর্সা উজ্জ্বল বর্ণের; তিনি ধবধবে সাদা ছিলেন না, ছিলেন না খুব ধূসর বর্ণ।” [ বুখারী, আস-সহীহ: মানাকিব / ২৩, ৪ /১৬৪]।
মুসলিম র. এর এক বর্ণনার মধ্যে আছে:
« كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَزْهَرَ اللَّوْنِ كَأَنَّ عَرَقَهُ اللُّؤْلُؤُ » . ( رواه مسلم ) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ফর্সা উজ্জ্বল বর্ণের; তাঁর ঘাম যেন মুক্তা।” [ মুসলিম, আস-সহীহ: ফাযায়েল / ২১, হাদিস নং- ২৩৩০, ৪ / ১৮১৫]।
ইবনু হাজার র. ‘ফাতহুল বারী’ (৬ / ৫৬৯) –এর মধ্যে বলেন: ” أَزْهَرَ اللَّوْنِ “অর্থ: আলতা মিশানো সাদা পানীয়।
আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان رسول الله صلى الله عليه و سلم ليس بالطويل , ولا بالقصير , ضخم الرأس واللحية , شثن الكفين والقدمين , مشرب وجهه حمرة طويل المسربة … » . ( رواه أحمد )
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম লম্বাও ছিলেন না, আবার বেঁটেও ছিলেন না (তিনি মধ্যম আকৃতির ছিলেন); আর তিনি ছিলেন (তুলনামূলক) বড় মাথা ও দাঁড়ির অধিকারী; তাঁর দুই হাতের তালু ও দুই পায়ের তলা ছিল মাংসবহুল; তাঁর চেহারা ছিল লোহিতাভ শুভ্র প্রকৃতির; বক্ষদেশ থেকে নাভি পর্যন্ত একটি সরু কেশ রেখা ছিল; …।” [ ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ: ১ / ৯৬; হাকেম, আল-মুসতাদরাক: ২ / ৬০৬ এবং তিনি বলেন, এই হাদিসটির সনদ ইমাম মুসলিম র. এর শর্তের আলোকে সহীহ, তবে তারা তা বর্ণনা করেননি, আর ইমাম যাহাবীও তার মতকে সমর্থন করেছেন]।
(১০) জাবির ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَدْ شَمِطَ مُقَدَّمُ رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ , وَكَانَ إِذَا ادَّهَنَ لَمْ يَتَبَيَّنْ , وَإِذَا شَعِثَ رَأْسُهُ تَبَيَّنَ , وَكَانَ كَثِيرَ شَعْرِ اللِّحْيَةِ , فَقَالَ رَجُلٌ: وَجْهُهُ مِثْلُ السَّيْفِ ؟ قَالَ: لاَ , بَلْ كَانَ مِثْلَ الشَّمْسِ وَالْقَمَرِ , وَكَانَ مُسْتَدِيرًا » . ( رواه مسلم ) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল ও দাঁড়ির সম্মুখভাগ সাদা হয়ে গিয়েছিল। যখন তিনি তেল দিতেন, তখন (সাদা চুল) দেখা যেত না; আর যখন চুল এলোমেলো হত, তখন (শুভ্রতা) দেখা যেত। তাঁর দাঁড়ি খুব ঘন ছিল। এক ব্যক্তি বলল: তাঁর চেহারা মুবারক ছিল তলোয়ারের মত? জাবির রা. বললেন: না, তাঁর চেহারা মুবারক ছিল সূর্য ও চন্দ্রের মত (উজ্জ্বল) গোলাকার।” [ মুসলিম, আস-সহীহ: ফাযায়েল / ২৯, হাদিস নং- ২৩৪৪, ৪ / ১৮২৩]।
হাদিসে উল্লেখিত ” شَمِطَ “ শব্দের অর্থ: মাথার শুভ্রতা, যার সাথে কালো মিশ্রিত হয়। [কামূসুল মুহীত: মূলবর্ণ (شمط), পৃ. ৮৭০]।
আর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে:
« كان في الوجه تدوير أبيض مشرب » . ( رواه الترمذي ) .
“তাঁর চেহারা ছিল গোলাকৃতির; তাঁর রং ছিল লোহিতাভাব শুভ্র।” [তিরমিযী, আস-সুনান: মানাকিব / ৮, হাদিস নং-৩৬৩৮, ৫ / ৫৯৯; তিনি বলেন: এই হাদিসটি হাসান ও গরীব, তার সনদ মুত্তাসিল নয়]।
(১১) হিন্দ ইবন আবি হালা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে, যখন তিনি হাসান ইবন আলী রা. কে উদ্দেশ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাবলী বর্ণনা করেন:
« كث اللحية , سهل الخدين » .
“তাঁর দাঁড়ি ছিল ঘন, চিবুকদ্বয় ছিল সরল সাবলীল।”
(১২) শু‘বা র. থেকে বর্ণিত, তিনি সিমাক ইবন হারব র. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি জাবির ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলতে শুনেছি:
« كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ضَلِيعَ الْفَمِ , أَشْكَلَ الْعَيْنِ , مَنْهُوسَ الْعَقِبَيْنِ . قَالَ : قُلْتُ لِسِمَاكٍ : مَا ضَلِيعُ الْفَمِ ؟ قَالَ: عَظِيمُ الْفَمِ . قَالَ : قُلْتُ : مَا أَشْكَلُ الْعَيْنِ ؟ قَالَ: طَوِيلُ شَقِّ الْعَيْنِ . قَالَ: قُلْتُ : مَا مَنْهُوسُ الْعَقِبِ ؟ قَالَ : قَلِيلُ لَحْمِ الْعَقِبِ » . ( رواه مسلم ) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন প্রশস্ত মুখ, টানাটানা চোখ এবং সুষম গোড়ালী বিশিষ্ট। বর্ণনাকারী শু‘বা র. বলেন: আমি সিমাক র. কে জিজ্ঞাসা করলাম: প্রশস্ত মুখ কেমন? তিনি বললেন: বড় মুখ। শু‘বা র. বলেন: আমি বললাম: টানাটানা চোখ কেমন? তিনি বললেন: চোখ দু’টো দীঘল দীর্ঘ ডাগর। শু‘বা র. বলেন: আমি বললাম: সুষম গোড়ালী কেমন? তিনি বললেন: হালকা গোড়ালী।” [ মুসলিম, আস-সহীহ: ফাযায়েল / ২৭, হাদিস নং- ২৩৩৯, ৪ / ১৮২০; তিরমিযী, মানকিব / ১২, হাদিস নং- ৩৬৪৭, ৫ / ৬০৩]।
তবে أشكل العين (টানাটানা চোখ) এর ব্যাখ্যায় সিমাক যা বলেছেন, কাযী ইয়াদ তার বিরোধিতা করেছেন, তিনি বলেন, সিমাক এটা ভ্রমবশত বলেছে। এটা প্রকাশ্য ভুল। সঠিক হচ্ছে, যাতে আলেমগণ একমত, এবং আবু উবায়েদ ও অন্যান্য শব্দার্থবিদদের করা অর্থ, আর তা হচ্ছে, শুভ্র সাদা চোখে লালের আভা থাকা। দেখুন, সহীহ মুসলিম, ইমাম নাওয়াওয়ীর ব্যাখ্যাসহ, ১৫/৯৩।
আর জাবির ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان في ساقي رسول الله صلى الله عليه و سلم حموشة , وكان لا يضحك إلا تبسما , وكنت إذا نظرت إليه قلت : أكحل العينين وليس بأكحل » . ( رواه الترمذي )
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কদম মুবারকের গোছা (নলা) খানিকটা সরু গোছের ছিল; আর তিনি মুচকি হাসি ছাড়া হাসতেন না; আর আমি (বর্ণনাকারী) যখন তাঁর দিকে তাকাতাম, তখন আমি বলতাম: তিনি চোখ দু’টিতে সুরমার লাগিয়েছেন। অথচ তিনি (তখন) সুরমা লাগানো অবস্থায় ছিলেন না।”
[তিরমিযী, মানকিব / ১২, হাদিস নং- ৩৬৪৫, ৫ / ৬০৩ এবং তিনি বলেন: এই হাদিসটি হাসান, গরীব, অপর এক দৃষ্টিতে সহীহ]।
আর উম্মু মা‘বাদের হাদিসের মধ্যে আছে: « في عينه دعج » (তাঁর চক্ষু গভীর কালো); অচিরেই এর তথ্যসূত্র ও বিশুদ্ধতা নিয়ে কথা আসবে।
আর ” الدعج “শব্দের অর্থ: চোখ ও অন্যান্য বস্তুর মধ্যে গভীর কালো।
[শরহুস সুন্নাহ ( شرح السنة ): ১৩ / ২৬৭]।
আর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: « أدعج العينين , أهدب الأشفار » (তিনি ছিলেন গভীর কালো ডাগর চোখের অধিকারী; চোখের পাতার প্রান্তদেশের সাথে লম্বা ভ্রূ’র অধিকারী)। [তিরমিযী, আশ-শামায়েলুল মুহাম্মাদীয়া ( الشمائل المحمدية ), পরিচ্ছেদ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে যেসব বর্ণনা এসেছে ( باب ما جاء في خلق رسول الله صلى الله عليه و سلم رسول الله صلى الله عليه و سلم ), হাদিস নং- ৬, পৃ. ২০ ]।
(১৩) উম্মু মা‘বাদের হাদিসের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে: « أزجُّ أقرنُ » (চিকন ও ধনুকাকৃতির ভ্রূ, দুই ভ্রূ পরস্পর মিলিত); আর ” القرن “শব্দের অর্থ: দুই ভ্রূ’র মিলন বা সংযোগ।
আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাবলী বর্ণনায় তার বিপরীত বর্ণনা করেন হিন্দ ইবন আবি হালা রা.:
« أزج الحواجب , سوابغ فى غير قرن » .
“তাঁর ভ্রূযুগল বিমুক্ত বৃত্তাংশের ন্যায় বাঁকা, খুব সূক্ষ্ম ঘন চুল বিশিষ্ট ছিল।”
(১৪) বায়হাকী তাঁর ‘দালায়েলুন নবুয়াত’ ( دلائل النبوة ) নামক গ্রন্থের ২৪৮ পৃষ্ঠা’র মধ্যে বর্ণনা করেছেন। বাল‘য়াদাবীয়া’র জনৈক ব্যক্তি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাবলী বর্ণনা করেন, তিনি তাতে বলেন:
« … فإذا رجل حسن الجسم , عظيم الجبهة , دقيق الأنف , دقيق الحاجبين , وإذا من لدن نحره إلى سرته كالخيط الممدود شعره » .
“ … হঠাৎ দেখি এক ব্যক্তি, যার সুদর্শন শরীর, বড় কপাল, সরু নাক ও চিকন ভ্রূ; আরও দেখি তার বুকের উপরিভাগ থেকে নাভি পর্যন্ত প্রসারিত রেখার মত তার চুল।”
(১৫) পূর্বোক্ত জাবির ইবন সামুরা রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে:
« كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ضَلِيعَ الْفَمِ … قَالَ : قُلْتُ لِسِمَاكٍ : مَا ضَلِيعُ الْفَمِ ؟ قَالَ: عَظِيمُ الْفَمِ » . ( رواه مسلم ).
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন প্রশস্ত মুখের অধিকারী … বর্ণনাকারী শু‘বা র. বলেন: আমি সিমাক র. কে জিজ্ঞাসা করলাম: প্রশস্ত মুখ কেমন? তিনি বললেন: বড় মুখ।” [মুসলিম, আস-সহীহ: ফাযায়েল / ২৭, হাদিস নং- ২৩৩৯, ৪ / ১৮২০; তিরমিযী, মানকিব / ১২, হাদিস নং- ৩৬৪৭, ৫ / ৬০৩]।
তারা বলে: আরবগণ এর দ্বারা – অর্থাৎ ‘প্রশস্ত মুখ’ (ضَلِيعُ الْفَمِ) দ্বারা প্রশংসা করে এবং ‘ক্ষুদ্রাকার মুখ’ ( صغير الفم) বলে নিন্দা করে। আর সা‘লাবা “ ضَلِيعُ الْفَمِ “এর ব্যাখ্যায় ” واسع الفم “(প্রশস্ত মুখ) বলেছেন। আর ‘শামির’ [ইবন হামদুইয়াহ্] “ ضَلِيعُ الْفَمِ “এর ব্যাখ্যায় ” عظيم الأسنان “(বড় দাঁত) বলেছেন। [ইমাম নববীর ব্যাখ্যাসহ ‘সহীহ মুসলিম’: ১৫ / ৯৩]।
সা‘ঈদ ইবনুল মুসায়্যিব র. থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাবলী বর্ণনা করতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন:
« كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أسود اللحية , حسن الثغر» . ( رواه البيهقي ).
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন কৃষ্ণ কালো দাঁড়ি ও সুন্দর মুখের অধিকারী।” [বায়হাকী, দালায়েলুন নবুয়াত ( دلائل النبوة ): পৃ. ২১৭]। আর পূর্বোক্ত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে: « أهدب العينين , حسن الفم » . [ তিনি ছিলেন লম্বা ভ্রূ বিশিষ্ট চোখ ও সুন্দর মুখের অধিকারী ]।
(১৬) আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْلَجَ الثَّنِيَّتَيْنِ , إِذَا تَكَلَّمَ رُئِيَ كَالنُّورِ يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ ثَنَايَاهُ » .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন (সামনে) প্রশস্ত দুই দাঁতের অধিকারী; যখন তিনি কথা বলতেন, তখন তাঁর দাঁতের মধ্য থেকে জ্যোতি বের হতে দেখা যায়।” [বাগবী, শরহুস সুন্নাহ ( شرح السنة ): ফাদায়েল / সিফাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাদিস নং- ৩৬৪৪, ১৩ / ২২৩; যে পদ্ধতিতে তিরমিযী র. ‘শামায়েল’ এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসে বর্ণিত, أفلج শব্দটি فلج থেকে উদ্ভূত। তার অর্থ, দু’ পায়ের মধ্যে দুরত্ব থাকা, ও দু’ দাতের মধ্যে ফাঁক থাকা, এটাকেই বলা হয়, أفلج الأسنان আল-কামূসুল মুহীত, পৃ. ২৫৮।
(১৭) পূর্বোক্ত জাবির ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে:
« كَانَ كثير شعر اللحية » .
(তিনি ছিলেন অধিক চুল বিশিষ্ট ঘন দাঁড়ির অধিকারী)।
আর আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে আছে:
« كان رسول الله صلى الله عليه و سلم ليس بالطويل ولا بالقصير ضخم الرأس واللحية … » . ( رواه أحمد ) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম লম্বাও ছিলেন না, আবার বেঁটেও ছিলেন না (তিনি মধ্যম আকৃতির ছিলেন); আর তিনি ছিলেন বড় মাথা ও দাঁড়ির অধিকারী।” [ ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ: ১ / ৯৬; হাকেম, আল-মুসতাদরাক: ২ / ৬০৬]।
আর উম্মু মা‘বাদের হাদিসের মধ্যে আছে: « و في لحيته كثاثة »
(তাঁর দাঁড়ির মধ্যে ঘনত্ব রয়েছে)।
আর পূর্বোক্ত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুক কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের মধ্যে রয়েছে:
« كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أسود اللحية » . ( رواه البيهقي ).
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন কৃষ্ণ কালো দাঁড়ির অধিকারী।”
[বায়হাকী, দালায়েলুন নবুয়াত ( دلائل النبوة ): পৃ. ২১৭]।
(১৮) আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
«كان ربعة من القوم ليس بالطويل ولا بالقصير , أزهر اللون ليس بأبيض أمهق ولا آدم , ليس بجعد قطط ولا سبط , رجل أنزل عليه وهو ابن أربعين , فلبث بمكة عشر سنين ينزل عليه , وبالمدينة عشر سنين , وقبض وليس في رأسه ولحيته عشرون شعرة بيضاء . قال ربيعة فرأيت شعرا من شعره فإذا هو أحمر , فسألت فقيل: احمر من الطيب » . ( رواه البخاري ).
“তিনি ছিলেন সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যম আকৃতির মানুষ; তিনি বেশি লম্বাও ছিলেন না, আবার বেঁটেও ছিলেন না; তিনি ছিলেন ফর্সা উজ্জ্বল বর্ণের; তিনি ধবধবে সাদা ছিলেন না, ছিলেন না খুব ধূসর বর্ণ। তাঁর চুল অতিরিক্ত কোঁকড়ানো ছিল না, আবার একেবারে সোজাও ছিল না। বরং কিছুটা কোকড়ানো। চল্লিশ বছর বয়সে তাঁর উপর ওহী নাযিল হয়, অতঃপর তিনি ওহী নাযিল অবস্থায় মক্কাতে দশ বছর এবং মদীনাতে দশ বছর অবস্থান করেন; আর তাঁর ইন্তিকাল হয় এমন অবস্থায় যে, তাঁর মাথায় ও দাঁড়িতে বিশটি চুলও সাদা ছিল না। রবী‘আহ্ রা. বলেন: অতঃপর আমি তাঁর চুলের মধ্য থেকে একটি লাল চুল দেখতে পেলাম, তারপর তাঁকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, অতঃপর জবাবে বলা হল: সুগন্ধি ব্যবহারের কারণে তা লাল হয়েছে।” [ বুখারী, আস-সহীহ: মানাকিব / ২৩, ৪ /১৬৪]।
আর ইমাম মুসলিম র. এর এক বর্ণনায় আছে, তিনি (আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন:
« وَلَمْ يَخْتَضِبْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّمَا كَانَ الْبَيَاضُ فِى عَنْفَقَتِهِ , وَفِى الصُّدْغَيْنِ , وَفِى الرَّأْسِ نَبْذٌ » . ( رواه مسلم ).
“আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কলপ দেননি। কিছু সাদা ছিল তাঁর নিম্ন ঠোঁটের নীচের ছোট দাঁড়িতে, আর কিছু ছিল কানপট্টিতে এবং মাথার মধ্যে ছিল কিছু।” [ মুসলিম, আস-সহীহ: ফাযায়েল / ২৯, হাদিস নং- ২৩৪১, ৪ / ১৮২১]।
(১৯) আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«كان يضرب شعر رأس النبي صلى الله عليه و سلم منكبيه » . ( رواه البخاري و مسلم)
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথার চুল দুই কাঁধের মাঝামাঝি ঝুলে থাকত।”
[বুখারী, আস-সহীহ: লিবাস (পোষাক-পরিচ্ছদ) / ৬৮, ৭ / ৫৮; মুসলিম, আস-সহীহ: ফাযায়েল / ২৬, হাদিস নং- ২৩৩৮, ৪ / ১৮১৯]।
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كَانَ شَعَرُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلَى أَنْصَافِ أُذُنَيْهِ » . ( رواه مسلم ).
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কেশ মুবারক কানের অর্ধেক পর্যন্ত ঝুলানো ছিল।” [মুসলিম, আস-সহীহ: ফাযায়েল / ২৬, হাদিস নং- ২৩৩৯, ৪ / ১৮১৯]।
বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« كان النبي صلى الله عليه و سلم مربوعا , بعيد ما بين المنكبين له شعر يبلغ شحمة أذنيه » . ( رواه البخاري ) .
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মধ্যম আকৃতির পুরুষ; তাঁর উভয় কাঁধের দূরত্ব ছিল অল্প বেশি; তাঁর মাথার চুল দুই কানের লতি পর্যন্ত পৌঁছাতো।” [বুখারী, আস-সহীহ: মানাকিব / ২৩, ৪ /১৬৫]।
আনাস রা. এর কথা- “তাঁর চুল দুই কানের লতি পর্যন্ত পৌঁছত” এবং তাঁর কথা “চুল দুই কাঁধের মাঝামাঝি ঝুলে থাকত” পরস্পর বিপরীত ও বিরোধপূর্ণ এবং তার জবাবে বলা হয়, তাঁর অধিকাংশ চুল ছিল তাঁর কানের লতি পর্যন্ত বিস্তৃত, আর তার থেকে যা প্রলম্বিত হয়, তা কাঁধ পর্যন্ত সংযুক্ত; অথবা তা দুই অবস্থাকেই শামিল করে। [ ফতহুল বারী: ৬ / ৫৭৩ ]।
(২০) আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«كَانَ أَهْلُ الْكِتَابِ يَسْدُلُونَ أَشْعَارَهُمْ , وَكَانَ الْمُشْرِكُونَ يَفْرُقُونَ رُءُوسَهُمْ , وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُحِبُّ مُوَافَقَةَ أَهْلِ الْكِتَابِ فِيمَا لَمْ يُؤْمَرْ بِهِ , فَسَدَلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم نَاصِيَتَهُ , ثُمَّ فَرَقَ بَعْدُ » . ( رواه مسلم ).
“আহলে কিতাবরা তাদের কেশ ঝুলিয়ে রাখত, আর মুশরিকরা সিঁথি কাটত। যে বিষযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কোনো আদেশ আসতো না, সে বিষয়ে তিনি আহলে কিতাবদের অনুসরণ করা পছন্দ করতেন; তাই তিনি তাঁর কেশ মুবারক ঝুলিয়ে রাখেন; কিন্তু পরবর্তী সময় তিনি সিঁথি কাটতেন।” [মুসলিম, আস-সহীহ: ফাযায়েল / ২৪, হাদিস নং- ২৩৩৬, ৪ / ১৮১৭ – ১৮১৮ ]।
কাযী ‘আইয়ায বলেন: ” سدل الشعر “অর্থ হল: চুল ঝুলিয়ে দেওয়া; তিনি বলেন: আলেমগণের মতে এখানে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কপালের উপর চুল ঝুলিয়ে দেওয়া এবং তাকে কপালের চুলের মত করে রেখে দেওয়া; বলা হয়:
” سدل شعره و ثوبه إذا أرسله و لم يضم جوانبه ”
তার চুল ও কাপড় ঝুলে গেছে, যখন সে তা ঝুলিয়ে দিয়েছে এবং তার প্রান্তসমূহ মিলিয়ে রাখে নি। আর فَرق মানে হল: চুলের এক অংশকে অপর অংশ থেকে পৃথক করা, অর্থাৎ সিঁথি কাটা; আলেমগণ বলেন: সিঁথি কাটা সুন্নাত, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করেছেন; তারা বলেন: পরিষ্কার কথা হল, তিনি ওহীর কারণেই তার (সিঁথি কাটার) দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন; এর দলিল হল তাঁর ( ইবনু ‘আব্বাস রা এর) কথা:
« أنه كَانَ يوافق أَهْلِ الْكِتَابِ فِيمَا لَمْ يُؤْمَرْ بِهِ » .
[তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমন বিষয়ে আহলে কিতাবদের অনুসরণ করতেন, যে বিষয়ে তাঁর প্রতি কোন আদেশ আসতো না]।
তাখরীজ ও বর্ধিত কলেবর করেছেন, ড. আহমাদ মু‘আয হাক্কী
অনুবাদ : মোঃ আমিনুল ইসলাম
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া