মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে। ছোটদেরও ভুল হয়। বড়দেরও ভুল হয়। কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায়। তবে কারো ভুল বা অপরাধ হয়ে গেলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া অনেক বড় একটি গুণ। এ গুণের অধিকারী মানুষদের আল্লাহ ভালোবাসেন। আমাদের প্রিয়নবী ছিলেন এ গুণের অধিকারী।
আমাদের প্রিয়নবীর জীবনটা ছিল সুন্দর, চাঁদ থেকেও সুন্দর। সূর্য থেকেও উজ্জ্বল। ফুল থেকেও সুরভিত। সুন্দর সুন্দর গুণের আলোয় আলোকিত ছিল তাঁর জীবন! আমরা যদি নবীজীর সুন্দর সুন্দর গুণ নিজের জীবনে গ্রহণ করি তাহলে আমাদের জীবনও হবে সুন্দর ও আলোকিত।
নবীজীর সুন্দর জীবন থেকে আজ আমি তোমাদেরকে শোনাব নবীজীর ক্ষমার ঘটনা।
ইহুদিরা খুব দুষ্ট। এরা সবসময় নবীদেরকে কষ্ট দিয়েছে। ভালো কাজে বাধা দিয়েছে। ভালো মানুষদের রক্ত ঝরিয়েছে।
আমাদের প্রিয় নবীজীকেও এরা অনেক কষ্ট দিয়েছে। একবার এক ইহুদি জাদু করে বসল নবীজীকে। নবীজী তখন অনেক কষ্ট পেলেন। জাদু বলে কথা। বুঝতে পারছিলেন না কী হয়েছে। কেন এত কষ্ট হচ্ছে। কেন এমন এলোমেলো লাগছে। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তাই আল্লাহ তাআলা স্বপ্নের মাধ্যমে নবীজীকে সব জানিয়ে দিলেন।
নবীজী একদিন ঘুমাচ্ছিলেন। স্বপ্নে দেখেন, দুজন লোক এসে একজন বসল মাথার কাছে। আরেকজন পায়ের কাছে। এরপর তারা বলাবলি করতে লাগল-
: এ মানুষটির কী হয়েছে?
: তাঁকে জাদু করা হয়েছে।
: কে জাদু করেছে?
: বনী রুযাইকের লাবীদ ইবনে আ‘সাম নামে এক লোক।
: কোথায় জাদু করেছে?
: মাথা থেকে পড়ে যাওয়া চুল ও চিরুনির মাঝে।
: এখন সেটা কোথায় আছে?
: যারওয়ান কুপে।
নবীজী ঘুম থেকে উঠে সেখানে গেলেন। কুপটি দেখেই চিনতে পারলেন- এটাই স্বপ্নে আমাকে দেখানো হয়েছিল। কুপের নিচ থেকে বের করে আনা হল সেই চুল-চিরুনি। আর চুল-চিরুনির গিঁটগুলো খুলতেই নবীজী পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৬৩
জাদুর কারণে প্রিয় নবীজী ছয় মাস যাবত কষ্ট করছিলেন। যখন সুস্থ হলেন দুষ্ট ইহুদির কথা জেনেও তাকে কিছু বললেন না। ক্ষমা করে দিলেন। আমাদের নবীজী কত ভালো ছিলেন! যারা তাঁকে কষ্ট দিত তিনি তাদেরকেও ক্ষমা করে দিতেন।
নবীজীর ক্ষমার আরেকটা গল্প বলি। গল্পটা অনেক কষ্টের, চোখে পানি এসে যায়। ভেবে অবাক হবে তোমরা; নবীজী আমাদের জন্য কত কষ্ট করেছেন।
তখন নবীজী ছিলেন মক্কায়। মানুষদের আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতেন। ভালো হতে বলতেন। আলোর দিকে ডাকতেন। কেউ তার কথা শুনত, কেউ শুনত না। কেউ বুঝত, কেউ বুঝত না। কেউ আবার বুঝে-শুনেও না বোঝার ভান করত। কেউ কেউ আবার নবীজীকে কষ্ট দিত। খারাপ খারাপ কথা বলত। তবুও আমাদের নবীজী তাদের কিছু বলতেন না। নীরবে সব সহ্য করতেন।
এই বিপদে নবীজীর চাচা আবু তালেব পাশে ছিলেন। তিনি মক্কার গুণী মানুষ। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে। মান্য করে। তাই ভাতিজাকে কেউ কষ্ট দিতে এলে বাধা দিতেন। তিনি সামনে এসে দাঁড়ালে কেউ আর কিছু বলার সাহস পেত না। একদিন তার ছায়াও উঠে গেল। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। সাথে সাথে কাফেরদের অত্যাচারও বেড়ে গেল। এভাবে আর কয়দিন থাকা যায়। মক্কাবাসীরা সত্য কথা শুনতে চায় না। ন্যায়ের পথে চলতে চায় না। তাই ভাবলেন, অন্য কোথাও যাই। সেখানকার মানুষদের আল্লাহর পথে ডাকি। তাই তায়েফ গেলেন। মনে অনেক স্বপ্ন। তারা হয়ত শুনবে আল্লাহর কথা। সত্যের বাণী। অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে আসবে। সত্যের পথে চলবে। তিনি তায়েফের সাকীফ গোত্রে গেলেন। প্রথমে কথা বললেন আবদে ইয়ালীলসহ আরো কয়েকজন নেতৃস্থানীয় লোকের সাথে। কিন্তু তাদের কপাল ছিল মন্দ। আলোর ডাক পেয়েও ডুবে রইল অন্ধকারে। নবীজীর কথা শুনল না। নবীজীকে নিয়ে বিদ্রূপ করা শুরু করল। দুষ্টদের লেলিয়ে দিল নবীজীর পিছে। তারা খুব কষ্ট দিল নবীজীকে। পাথর মারল। ইঁট ছুড়ল, গালি দিল। নবীজীর রক্ত ঝরল। নবীজী অনেক কষ্ট পেলেন। ভিন্ন দেশে ভিন্ন পরিবেশে অপরিচিত মানুষের এমন আচরণ!
নবীজী ফিরে এলেন তায়েফ থেকে। রক্তাক্ত দেহে জখমের কষ্ট। মনে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। তিনি তো তাদের কল্যাণের জন্যই তাদের কাছে গিয়েছেন। তাদেরকে আল্লাহর দিকে ডেকেছেন, ভালো পথে ডেকেছেন। কী অন্যায় ছিল তাঁর, যার কারণে তারা তাঁকে কষ্ট দিল, রক্ত ঝরাল?
নবীজী ঐ এলাকা থেকে দূরে এসে বিশ্রামের জন্য একটু বসলেন। হঠাৎ দেখলেন, নীল আকাশে একটি মেঘ কোমলভাবে নবীজীকে ছায়া দিচ্ছে। তপ্তরোদে শীতলতার স্পর্শ। প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। নবীজী চোখ তুলে তাকালেন উপরে। দেখেন মেঘ থেকে জিবরাঈল আ. ডেকে বলছেন- ‘আল্লাহ তাআলা আপনার সাথে আপনার সম্প্রদায়ের আচরণ ও কথোপকথন শুনেছেন এবং পাহাড়ের ফেরেস্তাকে পাঠিয়েছেন আপনার কাছে। তাদের ব্যাপারে যা খুশি আদেশ করতে পারেন তাকে।’
ঠিক তখনই পাহাড়ের ফেরেস্তা নবীজীকে সালাম দিয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! কী চান বলুন? আপনি ইচ্ছে করলে দু পাশের পাহাড় চাপা দিয়ে তাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারি। শত্রæকে শাস্তি দেয়ার কী সুবর্ণ সুযোগ! চাইলে মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে দুষ্ট মানুষগুলো। যারা নবীজীকে কষ্ট দিয়েছিল। রক্ত ঝরিয়েছিল। কিন্তু নবীজী কী উত্তর দিয়েছিলেন- শুনবে?
বলেছিলেন, ‘হয়ত আল্লাহ তাদের বংশধরদের মাঝে এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যারা শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না।’
-সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩২৩১; সীরাতে ইবনে হিশাম, ২/৬৭-৬৮
কত সুন্দর উত্তর! কত মমতাভরা মন! কত উজ্জ্বল আশার প্রদীপ! উম্মতের জন্য কত দরদ নবীজীর। যারা তাঁকে কষ্ট দিল তাদের জন্য কত দরদমাখা উত্তর- এরা ধ্বংস হয়ে গেলে তো ভবিষ্যত বংশধরের কেউ আল্লাহর ইবাদত করতে পারবে না। তারা আমায় কষ্ট দিয়েছে; তবুও বেঁচে থাকুক। হয়ত তাদের বংশধর, পরবর্তী প্রজন্ম ঈমান আনবে।
দেখেছ! আমাদের নবীজীর চিন্তা কত সুন্দর, কত মহান! মন কত উদার। আমরা এমন মহান নবীর উম্মত। আমাদেরও এমন উদার হতে হবে। সবাইকে ক্ষমা করা শিখতে হবে। মন হতে হবে স্বচ্ছ-শুভ্র। গোলাপের মত সুন্দর-সুরভিত।
মুহাম্মাদ শাহাদাত ছাকিব
যিলহজ্ব ১৪৩৯ – সেপ্টেম্বর ২০১৮
মাসিক আলকাউসার