হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা. এমন একজন সৌভাগ্যবান সাহাবী যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবী প্রেমের জীবন্ত ইতিহাস। মুসলমানদের মাঝে কে এমন আছে যে আবু আইয়ুব আনসারীকে চেনে না? আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের মাঝে তার ঘরকে নির্বাচন করেছিলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থানস্থল হিসেবে।
তার আসল নাম খালেদ ইবনে যায়েদ ইবনে কুলাইব। তিনি বনু নাজ্জার বংশোদ্ভুত। তার উপনাম আবু আইয়ুব। মদীনার আনসারদের একজন হওয়ার কারণে তাকে আনসারী বলা হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় পৌছলেন তখন মদীনার অধিবাসীরা তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে গ্রহণ করলেন। নবীজীকে কাছে পেয়ে তাদের হৃদয়ে যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। তারা তাদের গৃহের দরজা খুলে দিলেন যেন নবীজী তাতে সম্মানের সাথে অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু নবীজী মদীনার উপকণ্ঠে অবস্থিত কুবা নামক স্থানে চার দিন কাটালেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। তারপর তার উষ্ট্রীতে চড়ে সেখান থেকে রওয়ানা হলেন। মদীনার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগণ রাসূলের আগমন-পথে দাঁড়িয়ে গেলেন। প্রত্যেকের মনে একই বাসনা যে, তার ঘরে আল্লাহর রাসূলের মেহমানদারীর মর্যাদা সে অর্জন করবে। একের পর এক সরদার উষ্ট্রীর গতিরোধ করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিতে আমাদের নিকট অবস্থান করুন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাদের বললেন, উষ্ট্রীকে আপন গতিতে চলতে দাও। কেননা সে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত। উষ্ট্রীটি তার গন্তব্য পথে চলতে লাগল। কোনো বাড়ি অতিক্রম করলে সে বাড়ির বাসিন্দারা বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। আর পার্শ্ববতীদের অন্তরে আশার আলো প্রজ্জ্বলিত হয়। এমনিভাবে উষ্ট্রীটি চলছে। আর লোকেরা তার পিছু পিছু আসছে। সবাই সেই ভাগ্যবান ব্যক্তিকে দেখতে অধীর, যার ঘরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবস্থান করবেন। অবশেষে সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে উষ্ট্রীটি হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা.-এর বাড়ির সামনে একটি খালি জায়গায় দাঁড়াল এবং তারপর বসে পড়ল। নবীজীর আগমনে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা.-এর অন্তর আনন্দে ভরে গেল। তিনি ছুটে এসে অত্যন্ত আনন্দের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বাগত জানালেন। দু’হাতে তার আসবাবপত্র তুলে নিলেন। যেন তিনি দুনিয়ার সমুদয় সম্পদ তুলে নিলেন।
হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা.-এর বাড়িটি দোতলা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য তিনি দ্বিতীয় তলাটি খালি করে দিলেন। কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিচ তলাকে প্রাধান্য দিলেন। আবু আইয়ুব আনসারী তা অম্লান বদনে মেনে নিলেন এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পছন্দনীয় স্থানেই থাকার ব্যবস্থা করলেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আবু আইয়ুব আনসারী ও তার স্ত্রী দ্বিতীয় তলায় উঠলেন। দরজা বন্ধ করা মাত্রই আবু আইয়ুব আনসারী তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, হায়! আমরা এ কী করলাম?! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিচে থাকবেন আর আমরা তার উপরে থাকব? আমরা কি তাঁর উপর দিয়ে চলাফেরা করব? আমরা কি নবী ও ওহীর মাঝে থাকব? তাহলে তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাব! এজাতীয় নানা চিন্তায় স্বামী-স্ত্রী লজ্জিত ও হতবুদ্ধি হতে লাগলেন। কী করবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। দ্বিতীয় তলায় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরে নয় এমন দিকে সরে এলে তার হৃদয় কিছুটা শান্ত হল। সকালে আবু আইয়ুব আনসারী রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহর কসম করে বলছি, এ রাতে আমাদের দু’চোখের পাতা এক হয়নি। না আমার আর না উম্মে আইয়ুবের। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবু আইয়ুব! কেন? তিনি বললেন, আমাদের মনে হল আমরা এমন এক ঘরের দ্বিতলে অবস্থান করছি, যার নিচে আপনি রয়েছেন। আমরা যখন চলাফেরা করব আপনার উপর ধুলাবালি পড়বে। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, হে আবু আইয়ুব! বিষয়টি সহজভাবে নাও। আমাদের জন্য এটাই ভাল হবে যে, আমি নিচ তলায় থাকব। কেননা, আমার নিকট অনেক মানুষ আসা যাওয়া করবে। আবু আইয়ুব আনসারী বললেন, আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ মেনে নিলাম।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় সাত মাস যাবত তার ঘরে অবস্থান করলেন। তারপর মসজিদে নববী নির্মাণ পরিপূর্ণ হয়ে গেলে এবং মসজিদের পাশে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার পুণ্যাত্মা বিবিগণের জন্য যে কামরাগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল তিনি সেখানে চলে গেলেন।
হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা. মনোপ্রাণ ও হৃদয় দিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসতেন। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে এমন ভালোবাসতেন যে, এ নামটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখমন্ডলে আনন্দের আভা ফুটিয়ে তুলত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করতেন।
একদিনের ঘটনা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বর্ণনা করেন, দ্বিপ্রহরের প্রচন্ড উত্তাপে হযরত আবু বকর রা. মসজিদে নববীতে এলেন। হযরত ওমর রা. তাকে দেখে বললেন, হে আবু বকর! এ প্রচন্ড দ্বিপ্রহরে আপনি বাহিরে এলেন কেন? হযরত আবু বকর রা. বললেন, প্রচন্ড ক্ষুধার তাড়নায় বাহিরে বের হয়ে এলাম। তখন হযরত ওমর রা. বললেন, আল্লাহর কসম, আমিও ঐ একই কারণে বের হয়ে এসেছি। এমতাবস্থায় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি ঐ একই কারণে আমিও বের হয়ে এসেছি। আমার সাথে চল। তারা হাঁটতে হাঁটতে হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছলেন।
আবু আইয়ুব আনসারী প্রত্যহ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য কিছু খাবার রেখে দিতেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দিষ্ট সময়ে না এলে পরিবারের লোকজনকে তা খাইয়ে দিতেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সঙ্গীদ্বয় দরজায় পৌঁছলে উম্মে আইয়ুব তাদেরকে স্বাগত জানালেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু আইয়ুব কোথায়? নিকটেই এক খেজুর গাছ পরিচর্যা করছিলেন আবু আইয়ুব আনসারী রা.। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কণ্ঠ শুনেই তিনি ছুটে এসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সঙ্গীদ্বয়কে স্বাগত জানালেন এবং বলতে লাগলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটাতো আপনার আগমনের সাধারণ সময় নয়?
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি সত্য বলেছ। তারপর আবু আইয়ুব আনসারী রা. খেজুরবাগানে গেলেন এবং একটি খেজুরের কাঁদি কেটে আনলেন। তাতে পাকা, আধা পাকা ও কাঁচা খেজুর ছিল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিছু খেজুর পেরে আনলেই তো হতো। পুরো কাঁদি কেটে আনলে কেন? আবু আইয়ুব আনসারী রা. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি পাকা, আধা পাকা আর কাঁচা খেজুর খাবেন তাই কেটে আনলাম। আর আমি আপনার জন্য একটি বকরী যবেহ করে আনছি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি যবেহ করতে চাও তাহলে কিন্তু দুধের বকরী যবেহ করবে না। তিনি একটি বকরীর বাচ্চা যবেহ করলেন। উম্মে আইয়ুব মেহমানদের জন্য রুটি তৈরি করলেন। খাবার তৈরি হয়ে গেল। আবু আইয়ুব আনসারী রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সঙ্গীদ্বয়ের সামনে তা পরিবেশন করলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি গোস্তের টুকরা নিয়ে একটি রুটিতে রাখলেন এবং বললেন, হে আবু আইয়ুব! এটা নিয়ে ফাতেমার কাছে যাও, কারণ সে বেশ কিছু দিন যাবত এমন খাবার খায়নি।
সকলেই খেয়ে পরিতৃপ্ত হলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্রুসিক্ত হলেন। তিনি বললেন, যাঁর হাতে আমার জান তাঁর শপথ! এই সেই নিয়ামত, যার সম্পর্কে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে। সুতরাং এধরনের নিয়ামত খাওয়ার পূর্বে বিসমিল্লাহ বলবে। আর খেয়ে পরিতৃপ্ত হওয়ার পর এই দুআ পাঠ করবে-
اَلْحَمْدُ لِلهِ الذِّيْ هُوَ أَشْبَعَنَا وَأَنْعَمَ عَلَيْنَا فَأَفْضَلَ
মুহাম্মদ আবদুল আলীম
রমযান ১৪২৯ – সেপ্টেম্বর ২০০৮
মাসিক আলকাউসার