পান্ডুয়া।
রাত নেমেছে। নির্জন হয়ে গেছে শহরের পথঘাট। কুতুব শাহি মসজিদের প্রশস্ত চত্বরে একটানা বয়ে চলছে দখিনা বাতাস। এশার নামাজ শেষ হয়েছে অনেক আগে। হাতের কাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে লোকজন। সুফি দরবেশ নুর কুতুবুল আলমের খানকায়ও সবাই ঘুমাচ্ছে। শুধু দরবেশ একা জেগে আছেন। তাঁর চোখে ঘুম নেই। দুচোখে খেলা করছে দুশ্চিন্তা। নিজের জন্য তাঁর কোনো চিন্তা নেই। পরিবারের জন্যও না। তিনি চিন্তিত বাংলার মুসলমানদের জন্য। যে বিপদ আজ ধেয়ে এসেছে বাংলার মুসলমানদের উপর তা থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে ভাবছেন তিনি। হিন্দুত্ববাদী শক্তির হাতে আজ বাংলার মুসলমানরা নির্যাতিত। কদিন আগেই হত্যা করা হয়েছে বিখ্যাত দরবেশ বদরুল ইসলামকে। মহানন্দা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে মারা হয়েছে আরও অনেক সুফি-দরবেশকে (১)। রাজা গনেশের কালো থাবায় বাংলার মুসলমানরা ক্ষত-বিক্ষত। আদীনা মসজিদকে বানানো হয়েছে রাজার কাছারি। সেখানে থেমে গেছে আজানের ধ্বনি। স্থাপন করা হয়েছে পাথুরে মূর্তি (২)। নুর কুতুবুল আলম অজু করে এলেন। তিনি কিয়ামুল লাইলে দাঁড়াবেন। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সাহায্যকারী নেই। তাঁর কাছেই তিনি সাহায্য চাইবেন।
২.
সাম্রাজ্যের পতন একদিনে হয় না। সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির দিনগুলিতেই জন্ম নেয় ঘুণপোকা। আর তা ভেতর থেকে খেয়ে শেষ করে দেয় সাম্রাজ্যকে। বাংলার ইতিহাসে ইলিয়াস শাহি শাসনামল এক গৌরবজনক অধ্যায়। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা হাজি ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র বাংলার সুলতান হন। তিনি ছিলেন সমগ্র বাংলার সর্বপ্রথম সুলতান। তাঁর সময়কালেই এই অঞ্চলকে বাংগালাহ নামে অভিহিত করা হয়। একজন দক্ষ শাসক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। কিন্তু তিনি যে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নিজের অজান্তে নিজেই সেই রাজত্বের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন স্বাধীন সুলতান। ফলে দিল্লির সুলতানদের সাথে তাঁকে লড়তে হচ্ছিল। এসব লড়াইয়ে তিনি হিন্দুদের সাহায্য নেন। ফলে তাঁর সময়কালেই হিন্দুরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করে। তারা কেউ কেউ সেনাপতি ও উজিরের পদেও আসীন হয় (৩)। পরবর্তী ইলিয়াস শাহি সুলতানদের আমলেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। এমনকি বাংলার সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের শাসনামলেও দেখা যায় হিন্দুরা বাংলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে। এ সময় ভাতুড়িয়ার জমিদার গনেশ রাজদরবারে উচ্চপদ লাভ করেন।
বিহারের বিখ্যাত সুফি মাওলানা মুজাফফর শামস বলখি সুলতানের কাছে লিখিত এক পত্রে তাঁকে সতর্ক করে লিখেন, ‘মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ তোমরা উম্মাহর বাইরে কারও সাথে মিত্রতা করো না।” তাফসিরে বলা হয়েছে, “মুমিনরা অবিশ্বাসী ও অপরিচিতদের উজির ও কর্মচারী নিয়োগ করবে না।” যদি মুমিনরা বলে তারা কাফেরদেরকে বন্ধু বানাচ্ছে না, বরং সুবিধার জন্য তারা এমন করছে, তাহলে বলব এতে কোনো সুবিধাই হয় না। বরং বিদ্রোহ ও গোলযোগই বাড়ে। অমুসলিমদের ছোটখাটো পদে নিয়োগ দেয়া যায়, কিন্তু তাদেরকে ওয়ালি বা গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়া যায় না। তাহলে তারা মুমিনদের উপর কতৃত্ব খাটাবে। দেখা যাচ্ছে অমুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে মুসলিমদের উপর কতৃত্ব খাটাচ্ছে। এমনটা হওয়া উচিত নয় (৪)।’
মাওলানা বলখির সতর্কবাণী কানে তোলেননি সুলতান। সুলতানকে সতর্ক করেছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু সুফি নুর কুতুবুল আলমও। বাল্যকালে দুজন একসাথে পড়াশোনা করেছিলেন কাজি হামিদুদ্দিন নাগোরির কাছে। বাল্যবন্ধুকে নানাভাবে সতর্ক করেছিলেন নুর কুতুবুল আলম। কিন্তু সুলতান সতর্ক হননি। নুর কুতুবুল আলমের ভাই আজম শাহ ছিলেন সুলতানের প্রধান উজির। তিনিও কর্ণপাত করেননি ভাইয়ের সতর্কবাণীতে। রাজত্বের বড় বড় পদ চলে যাচ্ছিল হিন্দুদের দখলে। তারা ক্রমেই হয়ে উঠছিল শক্তিশালী। সুলতান বুঝতেও পারেননি তিনি নিজেকে ও নিজের রাজত্বকে কতটা হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন। মাওলানা বলখি সুলতানকে যে সতর্কবাণী লিখেছিলেন তা বাস্তবায়িত হলো ৮১৩ হিজরিতে (১৪১০-১১ খ্রিষ্টাব্দ)। সে বছর নিহত হলেন সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ। তাঁকে হত্যা করেছিলেন তাঁরই একান্ত আস্থাভাজন রাজা গনেশ (৫)। পরবর্তী দিনগুলিতে বাংলার মুসলমানদের জন্য যিনি হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত বিভীষিকা।
৩.
গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইলিয়াস শাহি বংশের প্রতাপের যুগ শেষ হয়ে যায়। এরপর যে কজন সুলতান শাসন করেছেন তাঁরা ছিলেন মূলত রাজা গনেশের হাতের পুতুল। তাঁদের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ছিল না। গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের পর তাঁর ছেলে সাইফুদ্দিন হামজা শাহ ক্ষমতায় বসেন। দুবছর রাজত্ব করার পর ১৪১২ খ্রিষ্টাব্দে গনেশের ইশারায় ক্রীতদাস শিহাবুদ্দিনের হাতে তিনি নিহত হন।
রাজত্ব চলছিল গনেশের হাতের ইশারায়। কিন্তু তখনো তিনি নিজে সামনে আসেননি। হামজা শাহকে হত্যা করার পর তিনি শিহাবুদ্দিনকে সিংহাসনে বসান। তিন বছর পর , ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে গনেশের আদেশে তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ কয়েক মাস শাসন করেন। গনেশ তাঁকেও হত্যা করেন। গনেশ ততদিনে সর্বত্র নিজের লোকজন বসিয়ে ফেলেছেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই আর। আর অপেক্ষা নয়। আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে হত্যা করে গনেশ সিংহাসনে আসীন হলেন। নিজের নাম রাখলেন দনুজমর্দ্দনদেব। নিজের নামে মুদ্রা চালু করলেন (৬)।
৪.
ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটেছে। বাংলার মসনদে রাজা গনেশ। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো চলে গেছে হিন্দুদের দখলে। তাই শুরু থেকেই রাজা গনেশ ছিলেন বেপরোয়া। মুসলমানদের উপর চলতে থাকে নানা জুলুম-নির্যাতন। গনেশ চাচ্ছিলেন বাংলা থেকে ইসলামধর্ম সমূলে উৎখাত করতে। ঐতিহাসিক গোলাম হুসেন সলিম লিখেছেন, ‘একবার বিখ্যাত সুফি বদরুল ইসলাম রাজার সাথে দেখা করতে এলেন। তাঁকে বলা হলো রাজাকে সম্মান দেখাতে। তিনি বললেন, “ইসলামধর্ম মতে বিধর্মীকে সম্মান দেখানো যায় না। আর রাজা মুসলমানদের উপর অনেক অত্যাচার করছেন, তাই তাঁকে সম্মান দেখাব না।” রাজা এই কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর আদেশে বদরুল আলম ও তাঁর ভাইদেরকে হত্যা করা হয় (৭)।’
এরপর রাজার আদেশে অনেক আলেম ও সুফিকে মহানন্দা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। রাজা গনেশের প্রতি মুগ্ধ হিন্দু ঐতিহাসিক শ্রী সুখময় মুখোপাধ্যায়ও এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন (৮)।
গনেশের আদেশে ঐতিহাসিক আদীনা মসজিদকে বানানো হয় রাজার কাছারি। সেখানে স্থাপন করা হয় মূর্তি। রাজ্যের আকাশে মেঘের ঘনঘটা। নির্যাতিত মুসলিমদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে আকাশ-বাতাস। তাদের রক্ষার কেউ নেই। পাশে উড়িষ্যা, আসাম ও কামরুপে চলছে হিন্দু রাজত্ব। ইতিপূর্বে সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ তাদের সাথে লড়াই করেও দমন করতে পারেননি তাদের। ফলে বাহির থেকে সাহায্য আসারও সম্ভাবনা নেই। বাংলার মুসলিমরা যাত্রা শুরু করেছিল এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে।
৫.
গনেশের উপর আঘাতটা এলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। পান্ডুয়ার খানকাহর এক নিরীহ সৌম্যদর্শন সুফি সাধক নুর কুতুবুল আলম রাতারাতি হয়ে উঠলেন গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। দরবেশ আলাউল হকের ছেলে নুর কুতুবুল আলম সারাজীবন কাটিয়েছিলেন পড়াশোনা ও আধ্যাত্মিকতার সাধনা করে। বাল্যবন্ধু সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ তাঁকে প্রস্তাব করেছিলেন বিচারপতির পদ গ্রহণ করতে। কিন্তু সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। রাজদরবারের সাথে সবসময় বজায় রেখেছিলেন দূরত্ব।
কিন্তু বাংলার এই বিপদের সময় তিনি আর নীরব থাকলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এখনই তাঁকে কিছু করতে হবে। সেনাবাহিনী ও প্রশাসন চলে গেছে হিন্দুদের কতৃত্বে। তাদের দিক থেকে সাহায্য পাবার সুযোগ নেই। নিরস্ত্র মুসলিমরাও গনেশের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। সমাধান একটাই, জৌনপুরের শর্কি সালতানাতের দ্বারস্থ হওয়া।
৬.
নুর কুতুবুল আলমের খানকাহ। পান্ডুয়া।
নিজের কক্ষে বসে আছেন নুর কুতুবুল আলম। খাদেম কাগজ কলম দিয়ে গেছে। নুর কুতুবুল আলম পত্র লিখবেন সুলতান ইবরাহিম শর্কির কাছে। শেষবারের মতো মনে মনে পত্রের কথাগুলো সাজিয়ে নিচ্ছেন তিনি। খাদেমকে বলে দিলেন কেউ যেন বিরক্ত না করে। নুর কুতুবুল আলম লিখতে শুরু করলেন, ‘এই দেশের শাসনকর্তা কংস (গনেশ) একজন বিধর্মী। তিনি এখানে অত্যাচার ও রক্তপাত চালাচ্ছেন। অনেক আলেম ও সুফিকে হত্যা করেছেন। তিনি এই অঞ্চল থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করার চিন্তায় ব্যস্ত। যেকোনো মুসলমান রাষ্ট্রনায়কের কর্তব্য হলো মুসলমানদের সাহায্য করা। এইজন্য আমি আপনাকে এই পত্র লিখছি। এই দেশের বাসিন্দাদের উদ্ধারের জন্য এখানে আপনি আগমন করুন। মুসলমানদেরকে অত্যচারীর অত্যাচার থেকে রক্ষা করুন। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইতি নুর কুতুবুল আলম।’
একজন পত্রবাহকের হাতে চিঠি তুলে দিয়ে নুর কুতুবুল আলম বললেন, ‘দ্রুত এই পত্র সুলতান ইবরাহিম শর্কির হাতে পৌছে দাও (৯)।’
৭.
সুলতান ইবরাহিম শর্কির দরবার।
নুর কুতুবুল আলমের পত্র এসে পৌঁছেছে তাঁর কাছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল। তাঁর রাজত্বের সীমানা বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত। দরবেশ তাঁকে অনুরোধ করছেন বাংলায় আক্রমণ করার জন্য। কাজটা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। সুলতান পরামর্শ চাইলেন কাজি শিহাবুদ্দিন জৌনপুরির কাছে।
‘আপনার এখুনি যাত্রা শুরু করা উচিত। একদিকে মুসলমানদের উপর নির্যাতনের প্রতিশোধ নিয়ে সওয়াব অর্জন করবেন অপরদিকে দরবেশ নুর কুতুবুল আলমের সাক্ষাতলাভে ধন্য হবেন।’–পরামর্শ দিলেন কাজি শিহাবুদ্দিন।
এরপর সুলতান পরামর্শ চাইলেন বিখ্যাত বুজুর্গ সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গির সিমনানির কাছে। জবাবি পত্রে শায়খ সিমনানি লিখলেন, ‘ধার্মিক রাজার জন্য মুসলমানদের রক্ষা করতে সেনাবাহিনী প্রেরণের চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। বাংলায় এখনো অনেক দরবেশ বসবাস করছেন, যদি তাঁদেরকে রক্ষা করা যায় তবে তা খুবই ভালো কাজ হবে।’
দুজন আলেমের পরামর্শ পেয়ে উজ্জীবিত হলেন সুলতান ইবরাহিম শর্কি। আদেশ দিলেন রণপ্রস্তুতির। যুদ্ধের ডংকা বেজে উঠল।
৮.
৮১৮ হিজরি। ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ।
বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাংলার দিকে ছুটে এলেন সুলতান ইবরাহিম শর্কি। পথে ত্রিহুতের রাজা শিবসিংহের সাথে এই বাহিনীর লড়াই হলো। শিবসিংহ পরাজিত ও বন্দী হন। সুলতানের বাহিনী আবার বাংলার পথে যাত্রা শুরু করে।
এদিকে গনেশ জেনে গেছেন নুর কুতুবুল আলমের পত্র পেয়ে সুলতান ইবরাহিম শর্কি এগিয়ে আসছেন বাংলার দিকে। পরাজিত হয়েছেন ত্রিহুতের রাজা। নিজের ক্ষমতা হারানোর ভয়ে শংকিত হয়ে ওঠেন গনেশ। দ্রুত ছুটে এলেন নুর কুতুবুল আলমের খানকাহয়।
দরবেশের সামনে সমর্পণ করলেন নিজেকে। কেঁদেকেটে ক্ষমা চাইলেন নিজের অপরাধের জন্য। ‘আমাকে ক্ষমা করুন। সুলতান ইবরাহিমকে বলুন তিনি যেন এখানে না আসেন।’–বললেন গনেশ।
‘আমি কোনো বিধর্মীর জন্য সুপারিশ করতে পারব না। তুমি অত্যাচারী। মুসলিমদের উপর নির্যাতন করছো। আমিই তাঁকে এখানে আসতে বলেছি।’–দৃঢ়কণ্ঠে বললেন নুর কুতুবুল আলম।
‘আপনি যে আদেশ করবেন আমি তা-ই মেনে নেবো।’–গনেশের কণ্ঠে আগের সেই প্রতাপ নেই। তাঁর কণ্ঠে খেলা করছে অসহায়ত্ব।
‘তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। তারপর আমি দেখব কী করা যায়।’–শেষ ফায়সালা জানালেন নুর কুতুবুল আলম।
৯.
গনেশের মনে কী ছিল তা জানা যায় না। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, গৃহে ফিরে গনেশ রানীর সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করেন। রানী তাঁকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধা দেন। গনেশ আবার এলেন নুর কুতুবুল আলমের খানকায়। এবার তাঁর সাথে তাঁর বারো বছর বয়সী পুত্র যদু।
‘আমি বৃদ্ধ হয়েছি। রাজ্যশাসনের লোভ আর নেই। আমার এই পুত্রকে আপনি মুসলমান করে নিন। আমি তাঁর হাতে শাসনক্ষমতা তুলে দেবো।’–গনেশ প্রস্তাব দিলেন।
নুর কুতুবুল আলম নীরব রইলেন। তিনি ভেবে দেখলেন, অযথা রক্তপাতের বদলে যদি শান্তিপূর্ণভাবে সবকিছুর সমাধান হয় তাহলে তো ভালোই। তিনি গনেশের প্রস্তাব মেনে নিলেন। যদুকে কালেমা পড়িয়ে ইসলামধর্মে দীক্ষিত করা হলো। তাঁর নাম রাখা হলো জালালউদ্দিন। সেদিনই তাঁকে মসনদে বসানো হলো। পুরো বাংলায় তাঁর নামে খুতবা চালু হলো।
কাছাকাছি চলে এসেছেন ইবরাহিম শর্কি। নুর কুতুবুল আলম দেখা করলেন তাঁর সাথে। অনুরোধ করলেন ফিরে যেতে। ‘আপনিই তো আমাকে ডেকে এনেছেন।’–বিরক্তস্বরে বললেন সুলতান।
‘আমি যখন পত্র লিখেছিলাম তখন এক অত্যাচারী বিধর্মী মুসলমানদের নির্যাতন করছিল। কিন্তু আপনার আগমনের ভয় পেয়ে সে তার ছেলের হাতে শাসনক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে। তার ছেলে ইসলাম গ্রহণ করেছে। জিহাদ আবশ্যক কাফেরের বিরুদ্ধে, মুসলিমের বিরুদ্ধে নয়।’ শান্তকণ্ঠে বললেন নুর কুতুবুল আলম।
অসন্তুষ্ট সুলতান তাঁর বাহিনী নিয়ে ফিরে গেলেন জৌনপুরে।
১০.
সুলতানের বাহিনী ফিরে যেতেই আবার স্বরূপে আবির্ভূত হলেন গনেশ। তিনি নিজের ছেলের পদচ্যুতি ঘটালেন এবং নিজেই সিংহাসনে আরোহণ করলেন। ব্রাহ্মণদের পরামর্শমতে জালালউদ্দিনকে আবার হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু জালালউদ্দিন মনেপ্রাণে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর বিশ্বাসে অটল রইলেন। ফলে তাঁকে রাজার আদেশে বন্দী করা হয়।
মুসলমানদের উপর আবার শুরু হয় নির্যাতন। নুর কুতুবুল আলমের ছেলে শায়েখ আনোয়ারকে হত্যা করা হয়। নাতি শায়েখ জাহিদ বন্দী হন সোনারগাঁতে। নতুন এই বিপর্যয়ে নুর কুতুবুল আলম ছিলেন অনেকটাই অসহায়। বাংলা থেকে ফিরে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই ইবরাহিম শর্কি মারা যান। ফলে নুর কুতুবুল আলম তাঁর শক্তিশালী মিত্রকে হারান। এ সময় এক আত্মীয়ের কাছে লেখা পত্রে নুর কুতুবুল আলম লিখেন, ‘আমাদের সাহায্য আসার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নাই। এখন আমাদের উচিত সারারাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া (১০)।’
১১.
ইবরাহিম শর্কি ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর ইন্তেকাল করেন নুর কুতুবুল আলম। সময়টা ছিল ৮১৮ হিজরি (১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ)। নুর কুতুবুল আলমের মৃত্যুতে গনেশ আরও নিশ্চিন্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু বেশিদিন শাসন করা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। মাত্র চৌদ্দমাস পরেই তিনি নিহত হন। কারাগার থেকে জালালুদ্দিন পিতাকে হত্যার ছক এঁকেছিলেন (১১)।
পিতাকে হত্যার পর জালালউদ্দিন সাথে সাথেই ক্ষমতায় বসেননি। ক্ষমতায় বসেছিলেন তাঁর ভাই মহেন্দ্রদেব। জালালউদ্দিন শক্তি সঞ্চয় করছিলেন। দুই মাস পর ভাইকে সরিয়ে তিনি ক্ষমতায় বসেন। বাংলায় আবার মুসলিম শাসন ফিরে আসে। জালালউদ্দিন অভিহিত হন জালালউদ্দিন মুহাম্মাদ শাহ নামে।
সুশাসক হিসেবে জালালউদ্দিন নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি প্রশাসনকে ঢেলে সাজান। নুর কুতুবুল আলমের নাতি শায়েখ জাহিদকে সসম্মানে সোনারগাঁ থেকে ফিরিয়ে আনেন। ঐতিহাসিক ইবনে হাজার আসকালানি তাঁর প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘সুলতান জালালউদ্দিন একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবে রাজ্য শাসন করেন।’
১২.
রাজা গনেশ যে কালোরাত্রির সূচনা করেছিলেন তাঁর ছেলে জালালউদ্দিনের হাতেই তার অবসান হয়। জালালউদ্দিনকে তৈরির পেছনে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন শায়েখ নুর কুতুবুল আলম। সারাজীবন তিনি ছিলেন খানকায় বসে থাকা নিমগ্ন সাধক। কিন্তু দেশ ও জাতির দুর্দিনে তিনি সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, সমাজ-বিচ্ছিন্ন আধ্যাত্মিকতার চর্চা কোনো ফল বয়ে আনে না। নুর কুতুবুল আলমের সঠিক সিদ্ধান্তের কারণেই সেদিন বাংলার মুসলমানরা রক্ষা পেয়েছিল।
ড এনামুল হক তাই লিখেছেন, ‘তাহার রাজনৈতিক চালবাজিতে সেবার বাংগালার মুসলমানরা যেরূপ আশ্চর্যভাবে রক্ষা পাইয়াছিল তাহার তুলনা বাংগালার মুসলিম ইতিহাসে তো নাই-ই এমনকি ভারতীয় মুসলিম ইতিহাসেও অতি বিরল(১২)।’
এম এ রহিম লিখেছেন, ‘নুর কুতুবুল আলম ছিলেন মুসলিম বাংলার ত্রাণকর্তা (১৩)।
টীকা
১। বাংলার ইতিহাস (১২০০-১৮৫৭), পৃ-৮১ – আবদুল করিম। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
২। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে আবিদ আলী খান মালদহী ব্রিটিশ সরকারের আদেশে গৌড় ও পান্ডুয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরী করেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, আদীনা মসজিদের সিঁড়ির ভাঙ্গা অংশে একটি সিংহের মাথা দেখা যায়। এছাড়া মেহরাবে ও মসজিদের অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন হিন্দু মূর্তি দেখা যায়। বিস্তারিত জানতে দেখুন, গৌড় ও পান্ডুয়ার স্মৃতিকথা, পৃ- ১৫৬ – আবিদ আলী খান মালদহী। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা।
৩। বাংলার ইতিহাস সুলতানী আমল, পৃ- ২১২ – আবদুল করিম। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
৪। প্রাগুক্ত, পৃ- ২১১
৫। বাংলার ইতিহাস (১২০০-১৮৫৭), পৃ-৭৬ – আবদুল করিম। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
৬। প্রাগুক্ত, পৃ-৭৮
৭। রিয়াযুস সালাতিন, পৃ- ৯০ – গোলাম হুসেন সলীম। দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা।
৮। বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর, পৃ-১০৯ – শ্রী সুখময় মুখোপাধ্যায়। ভারতী বুকস্টল, কলকাতা। আরেকজন হিন্দু ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার গনেশ সম্পর্কে লিখেছেন, পরমধর্মদ্বেষ হইতে রাজা গনেশ একেবারে মুক্ত হইতে পারেন নাই। দেখুন, বাংলাদেশের ইতিহাস, ২য় খন্ড, পৃ- ৬৩ – শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার। দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা।
৯। রিয়াযুস সালাতিন, পৃ- ৯১ – গোলাম হুসেন সলীম। দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা।
১০। বাংলার ইতিহাস সুলতানী আমল, পৃ-২২৫ – আবদুল করিম। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
১১। মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, পৃ-১৩২ – আশকার ইবনে শাইখ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা।
১২। বঙ্গে স্বূফী প্রভাব, পৃ-৭৬ – ড এনামুল হক। র্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা।
১৩। বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ১ম খন্ড, পৃ- ১০২ – এম এ রহিম। বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
ইমরান রাইহান
সূত্রঃ fateh24