রূপকথায় অন্ধকূপের কথা আমরা সবাই শুনেছি। কিন্ত এই বাস্তব পৃথিবীতেই কিছু অন্ধকূপ আছে, যেখানে বন্দি মুসলিম রাজকন্যারা। ভুল দেখেননি, মুসলিম নারীদের আমরা রাজকন্যার মতই সম্মান করি, আগলে রাখি। এটি সেইসব রাজকন্যাদের দূর্দশার করুণ গল্প।
ইরাকে মুসলিম নারীদের গ্রেফতারের পর সাধারণত তিনটি জঘন্য পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। অপমান, নির্যাতন এবং সর্বশেষ ধর্ষণ।
আল-কাদিমিয়া কারাগারের একজন দক্ষ সামাজিক কর্মী এবং তিনজন ন্যাশনাল গার্ডের বর্ণনা অনুসারে প্রক্রিয়াটি হলো এরকম –
গ্রেফতার
নিরাপত্তা কর্মীদের রেইড এবং তল্লাশি অভিযানগুলোর মধ্য দিয়েই এই অত্যাচার শুরু হতো। সেকেন্ড ব্রিগেড টিম ৬ এর কমান্ডার মেজর জুমা আল মুসাবি, যার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকার পরও তাকে আমেরিকানরা এই পদে নিযুক্ত করে, তার নিজের ভাষায়,
“ইন্টেলিজেন্স থেকে রেইড অর্ডার আসলে আমরা প্রথমেই মদ খেয়ে পার্টি করে নিতাম। সবচেয়ে নিষ্ঠুর সৈনিকদের বেছে নেয়া হতো এই অভিযানগুলোর জন্য। সর্বপ্রথম যে কাজটা আমরা করতাম তা হলো বাড়ির পুরুষদের থেকে মহিলা আর শিশুদের আলাদা করে ফেলা। সোনা বা দামি কোন জিনিস থাকলে আমরা সেগুলো হাতিয়ে নিতাম। আমরা বাড়ির সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিতাম। তারপর আমরা তল্লাশির নাম করে মহিলাদের গায়ের বিভিন্ন অংশে হাত দিয়ে মজা করতাম। কেউ আপত্তি করলে আমরা বাড়ির পুরুষদের ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতাম। কোন মহিলা যদি দেখতে সুন্দর হতো, আমরা সেখানেই তাকে ধর্ষণ করতাম আর অস্ত্রশস্ত্র না পেলে চলে আসতাম। কিন্তু যদি কোন অস্ত্র পাওয়া যেত, আমরা বাড়ির সব পুরুষদের গ্রেফতার করে নিয়ে আসতাম। কোন পুরুষ না থাকলে আমরা বাড়ির মহিলাদের গ্রেফতার করতাম। আমাদের উপর এরকমই নির্দেশ ছিল।”
এধরনের জঘন্য অপকর্মের পর এসব নরকের কীটেরা অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে, তাদের ঘটানো কুকর্মের ঘটনা একে অন্যকে বলে বেড়াত। আল মুসাবি এবং তার সহকারি লেফটেন্যান্ট রাফিদ আদ দাররাজি (আরেকজন ক্রিমিনাল যাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আবু গারিব কারাগারে রাখা হয়েছিল কিন্তু আমেরিকানরা তাকে মুক্তি দিয়ে লেফটেন্যান্ট বানিয়ে দেয়) বর্ণিত আরো একটি ঘটনা,
“২০০৬ সালের জুলাই মাসে আমরা কাররাদা শহরের একজন কাপড় ব্যবসায়ীর বাড়ি তল্লাশির নির্দেশ পাই। রাত ১ টায় আমরা তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে তার স্ত্রী আর ১৭ বছরের ছেলেকে পাওয়া যায়। তল্লাশি চালিয়ে আমরা একটি রাইফেল খুঁজে পাই। আইন অনুসারে নিরাপত্তার জন্য এধরনের অস্ত্র রাখা বৈধ ছিল। কিন্তু আমরা মহিলাকে হুমকি দিই যে, তাকে ধর্ষণ করতে না দিলে আমরা তার ছেলেকে ধরে নিয়ে যাব। ছেলেটিকে পাশের রুমে আটকে রেখে একের পর এক সৈনিক তাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে, অন্যরা তখন বাড়িতে থাকা মূল্যবান জিনিস পত্র চুরি করে নিচ্ছিলো। এরপর আমরা আল দোরাতে অবস্হিত উম্ম আলার বিখ্যাত বেশ্যালয়ে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিই।”
তাদের ভাষ্যমতে,
“কোন মহিলাকে গ্রেফতারের পর আমাদের কাজ হলো নির্দিষ্ট জায়গায় তাকে পৌঁছে দেয়া। এসময়ও গাড়িতে সৈনিকেরা তাকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল গালাগালি করতে থাকে এবং তার শরীরের এমন কোন জায়গা বাকি থাকে না যেখানে হাত দেয়া হয় না। ইনভেস্টিগেশন সেলে আগে তার হাত-পা আর চোখ বেঁধে ধর্ষণ করা হয়, এরপর প্রশ্ন করা হয় তাকে কেন ধরে আনা হয়েছে বা তার বক্তব্য কি!! তথ্য না দিলে এসব ছবি প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। সাধারনত হেডকোয়ার্টারে পাঠানো ‘কেস’ প্রক্রিয়াধীন থাকাকালীন এক থেকে তিন মাস তাকে ঐ স্টেশনেই রাখা হয়। এই মাসগুলোতে ব্রিগেডে থাকা প্রত্যেক গোয়েন্দা এবং সৈনিক তাকে ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে তাকে শাব স্টেডিয়ামের আল তাসফিরাত কারাগার অথবা আল মুছানা এয়ারপোর্ট কারাগারে পাঠানো হয়। ভাগ্য খারাপ থাকলে বন্দিকে বাগদাদ অপারেশন হেডকোয়ার্টারের নিচে থাকা গ্রিন জোনে চিফ কমান্ডার মেজর জেনারেল আদনান আল মুসাবির অফিসে পাঠানো হয়। আল মালিকির কারাগারগুলোর মধ্যে এটি হলো সবচেয়ে খারাপ এবং ভয়ংকর।”
আল তাসফিরাত কারাগার
এটি হলো বন্দি জীবনের দ্বিতীয় ধাপ। সরকারে থাকা কিছু বিকৃত মানসিকতার সাইকপ্যাথ এই কারাগারগুলোর দায়িত্বে থাকে। আইন মন্ত্রণালয় নিযুক্ত এসব অফিসারদের ৪৫% হলো আল মাহদি মিলিশিয়ার সদস্য। ৩০% বদর অর্গানাইজেশন এবং বাকি ২৫% হলো সরকারের মদদপুষ্ট অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন গুলোর সদস্য।
এই লোকগুলোকে নিঃসন্দেহে বর্বর আখ্যা দেয়া যায়। তারা নির্যাতন, অপমান, বঞ্চনা আর জাতিগত বা রাজনৈতিক বৈষ্যমের ভয়ংকর সব পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। তারা ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ বাছবিচার করে না।
অধিকাংশ নারী বন্দিদেরই কোন মামলা বা অভিযোগ ছাড়াই এক থেকে ছয় বছর পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। আল তাসফিরাতে পুরুষ এবং মহিলা বন্দিদের উপর চালানো অমানবিক নির্মম নির্যাতনের উদাহরণ ভূরি ভূরি। প্রায়ই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, চীফ কমান্ডারের অফিস এবং ইরানি অফিসাররা এই কারাগারগুলো পরিদর্শন করতে আসতো। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্দিদের উপর নির্যাতন চালাতো। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক বন্দির মৃত্যু ঘটে।
২০০৮-২০১২ পর্যন্ত আল তাসফিরাত কারাগারে ২৫০ এরও বেশি বন্দির মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়, যার মধ্যে ১৭ জন নারী ছিল। একই সময়ের ভিতর আল মুছানায় ১২৫ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়। শুধু আল তাসফিরাতেই যে অত্যাচার চালানো হতো তা নয়, আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সব কারাগারেই এ ধরনের নির্যাতন চলতো। বিশেষত আল কাদিমিয়া কারাগার, কিশোর কারাগার, কুখ্যাত আবু গারিব কারাগার এবং আল মালিকির গুপ্ত বহু কারাগার যেগুলোতে মৃত বন্দিদের কোন রেকর্ডই রাখা হয় না।
একদিকে যখন এসব নিরপরাধ নারীপুরুষের উপর অত্যাচার চালানো হচ্ছিলো, অপরদিকে তখন মন্ত্রী এবং ভিআইপিদের সুপারিশে কুখ্যাত দাগী আসামিদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছিলো। এখানে শুধুমাত্র দুইজনের কথা তুলে ধরা হলো,
রাদিয়াহ কাদুম মুহসিন-
তিনি ছিলেন দাওয়া পার্টির একজন প্রভাবশালী মহিলা সদস্য। তাকে খোদ আল মালিকির নির্দেশে ছেড়ে দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে সর্ববৃহত্তম শিশুপাচারকারী দলকে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ ছিল। সাথে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, কিছু অফিসার এবং সরকারি কর্মকর্তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে সেসব ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেলিং এর অভিযোগ। আরও ছিল মাদক পাচার এবং সরকারি দলিল পাচারের অভিযোগ।
আদনান আবদুলজাহরা আল আরাযি-
তিনি ছিলেন মাহদি মিলিশিয়ার নেতা এবং অপরাধের ক্ষেত্রে ইরাকি ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত একটি গ্যাং এর প্রধান। ২০০৬ সালের অন্তর্গোত্র যুদ্ধে তার বাহিনীর হাতে নিহত হওয়া ৫০০০ মানুষের লাশ ইরানে পাচার করার সময় আমেরিকানরা তাকে গ্রেফতার করেছিল। এই লাশগুলো হিমশীতল গাড়িতে ইরানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো অঙ্গ বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে। তার বিরুদ্ধে আরও ছিল এন্টিক, বিস্ফোরক, অস্ত্র আর মাদক চোরাচালানের অভিযোগ।
বিচার
আসল ট্র্যাজেডি শুরু হয় আদালতে বিচার আরম্ভ হলে। গ্রেফতারের পর বন্দি – যদি এখনও বেঁচে থাকে – প্রহসনমূলক বিচার এবং কারাগারে থাকাকালীন নির্যাতনের ফলে শারীরিকভাবে আহত হয়ে দূর্বল এবং মানসিক দিক দিয়ে অসুস্থ পড়ে। তাদের এই দূর্বলতার সদ্ব্যবহার করা হয়।
ঐ কারাগারগুলোতে বিভিন্ন অপরাধে বন্দি থাকা মহিলাদের কাজে লাগানো হয়, এসব নিরপরাধ বন্দিদের কাছ থেকে তাদের ব্যক্তিগত নানা তথ্য সংগ্রহ করতে। তারা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখে, ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং ব্ল্যাকমেলিং করে অনেক গোপনীয় তথ্য জেনে নিতো। এরপর ঐ তথ্যগুলোই এসব হতভাগ্য নারীদের বিরুদ্ধে মামলায় ব্যবহার করা হতো!!
নারী বন্দিদের উপর চালানো নির্যাতনের বিভিন্ন পদ্ধতিঃ
১। শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার
কারারক্ষীরা তাদের আমেরিকান এবং ইরানি সুপারভাইজারদের কাছ থেকে শেখা বিভিন্ন পদ্ধতি বন্দিদের উপর প্রয়োগ করতো। এসবের মধ্যে আছে-
- বন্দিদের দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কাপড় ছাড়া নগ্ন থাকতে বাধ্য করা এবং এই অবস্থায় তাদের অপমান করা।
- লাঠি দিয়ে তাদের মারধোর করা বা পশ্চাৎদেশে লাথি দেয়া।
- শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে ইলেকট্রিক শক দেয়া।
- সব ধরনের যৌন উৎপীড়ন (এর বেশি কিছু লেখা সম্ভব নয়) ।
- মধ্যরাতের পর গার্ড এবং কর্মচারিদের দ্বারা উপর্যুপরি ধর্ষণ, প্রিজন ম্যানেজারের উপস্থিতিতেই (কারণ অধিকাংশ সময় তার রুমেই এই নির্যাতন চালানো হতো) ।
এই জঘন্য লোকগুলো দিনের পর দিন এসব অত্যাচার চালিয়েই ক্ষান্ত ছিল না, তারা প্রতিরক্ষা বা অন্যান্য বিভাগের অফিসারদের কারাগারে এসে নির্যাতন চালানোর আমন্ত্রণ জানাতো!
এখানে ২০০৮ সালে আল কাদিমিয়া কারাগারে ঘটা একটি ঘটনার উল্লেখ করা হলো-
গ্রিন জোনে আল মালিকির একটি গুপ্ত কারাগারে এএ আল যাইদি নামের একজন প্রাক্তন পুলিশ কর্ণেল এবং বদর অর্গানাইজেশনের কর্মকর্তা বন্দি ছিলেন। আমেরিকানদের হাতে জর্ডান সীমান্তে তিনি তার স্ত্রীসহ ধরা পড়েছিলেন। তার স্ত্রীকে রাখা হয়েছিল আল কাদিমিয়ায়।
নতুন বছর উপলক্ষে কিছু গোয়েন্দা অফিসার মদ খেয়ে পার্টি করছিল। আল যাইদিকে তারা নিয়ে আসতে বলে। আল যাইদিকে উপস্থিত করা হলে একজন মাতাল অফিসার জানতে চায়, সে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলবে নাকি। এরপর আল কাদিমিয়ার প্রিজন ম্যানেজারকে ফোন করে তাদের দুইজনকে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। কথা শেষ হলে আল যাইদিকে ফেরত পাঠানো হয় এবং গোয়েন্দা অফিসার তার স্ত্রীকে বলে যে, তারা একটু পার্টি করতে চায়। অতএব সে এবং আরও পাঁচজন বন্দি যেন এক ঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুত থাকে। প্রিজন ম্যানেজার তাদের জন্য একটি রুমের ব্যবস্থা করে দেয় এবং সারারাত ধরে তাদের ধর্ষণ করা হয়। ‘পার্টি’ করার সময় তারা বলতে থাকে, “আল মালিকি জিন্দাবাদ – বাগদাদের চোর, মিথ্যাবাদী, বেশ্যার দালাল জিন্দাবাদ”।
২। বঞ্চনা
বঞ্চনা শব্দটি আসলে এখানে হাস্যকর। কারণ বন্দিরা ন্যূনতম অধিকার থেকেও অনেক দূরে ছিল। যেমন-
- পরিবারের সাথে দেখা করা, ফোন বা কোন ধরনের যোগাযোগ।
- স্বাস্থ্য সেবা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সামগ্রী।
- বৈধ আইনগত অধিকার এবং আইনজীবির নিয়োগ।
- কোন ধরনের ডিটারজেন্ট, জীবাণুনাশক এমনকি সূর্যের আলো!’
- কোন ধরনের অভিযোগ। অভিযোগ না করার জন্য হুমকি দেয়া হতো, যদি কেউ অভিযোগ করেই ফেলতো সেগুলো কোন পাত্তা পেত না।
৩। ব্ল্যাকমেলিং এবং ভীতি প্রদর্শন
নারী বন্দিদের প্রায়ই তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারের হুমকি দেয়া হতো। বাড়িতে একবার ফোন করার অনুমতির জন্য অনেক অর্থ ঘুষ দিয়ে বহু অনুনয় বিনয় করতে হতো। তবে কারো ঘুষ দেয়ার সামর্থ্য না থাকলে দেহ বিক্রয়ের অনুমতি ছিল!
এগুলো কিছু বর্ণনা মাত্র। শুধুমাত্র বাগদাদ শহরেই ৩০০০ হাজারের বেশি নারী, বন্দি আছে। কারাগারগুলোর প্রকৃত যন্ত্রণা শুধু তারাই ভালো জানে।
তথ্যসূত্র এবং ইরাকের কুখ্যাত আবু গারিব কারাগারসহ অন্যান্য কারাগারগুলোতে নারী, পুরুষ এবং শিশুদের উপর চালানো অত্যাচারের বিবরণ: