হুমায়ূন আহমেদ তার এক বইতে বলেছিল,“মৃতদেহ নিয়ে যে গাড়ি যায়, সেই গাড়ির দিকে সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে তাকায়। গাড়িতে একটা লাল নিশান উড়ে। লাল নিশান মানেই শব বহনকারী গাড়ি। তবে সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকালেও মৃতদেহের মুখ কেউ দেখতে চায় না। মৃতদেহ নিয়ে যারা যাচ্ছে তাদেরকে দেখতে চায়। মৃত মানুষ দেখে কি হবে? মৃত মানুষের কোন গল্প থাকে না। মানুষ গল্প চায়।”
হুমায়ুন আহমেদের কথা শতভাগ সত্যি কি না, আমি জানি না। তবে আজ আমি একটি গল্প বলবো। কোনো বানানো গল্প নয়, সত্যি গল্প। গল্পটা কার, তাঁর নামটা কি—এটা বলবো না। শুধুই গল্প।
যার গল্প বলছি—তিনি ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। পারস্যের ইস্পাহান নগর। গ্রামের নাম জাই। তাঁর বাবা ছিলেন জমিদার। এলাকার প্রধান জমিদার। বাবা তাঁকে অনেক ভালোবাসতেন। নিজের সকল ধন সম্পদের চেয়ে বেশি। এমনকি অনান্য সন্তানদের চেয়েও বেশি। সে ভালোবাসা এতোটাই বেশি ছিলো যে, তাঁকে বাড়ীতে আটকে রাখতেন। যেন তিনি কখনো হারিয়ে না যান। কখনো যেনো চোখের আড়াল না হন।
তাঁর বাবা ছিলেন অগ্নিপূজক। মাজূসি ধর্মের অনুসারী। তিনিও তাঁর বাবার ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের গ্রামে অগ্নিপূজকদের বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড ছিলো। সে অগ্নিকুণ্ডের প্রধান রক্ষক ছিলেন তাঁর বাবা। বাবার অবর্তমানে তাঁকে রক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। যেহেতু তিনি বাড়ীর বাইরে যেতে পারতেন না। তাই বাইরের আবহাওয়া সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিলো না।
ইতোমধ্যে তাঁর বাবা কয়েকটি প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন। তিনি (তাঁর বাবা) নিজেই নির্মাণ কাজের দেখাশোনা করতেন। একবার তাঁর বাবার প্রাসাদের বাইরের খামারে কিছু কাজ পড়ে যায়। তাই তাঁকে ডেকে বলেন—“ছেলে আমার! প্রাসাদের কাজে ব্যস্ত থাকায়, আমি খামারে যেতে পারছি না। তাই তুমি যাও। কর্মচারীদের অমুক অমুক কাজ করতে বলো। ওখানে আটকে থেকো না যেনো! তুমি আটকে থাকলে, তোমার দুশ্চিন্তায় আমি অন্য কাজে মন দিতে পারবো না।”
বাবার আদেশ পেয়ে তিনি খামারের উদ্দেশে বের হলেন। পথিমধ্যে ছিলো এক গির্জা। খ্রিষ্টানদের। তিনি গির্জার ভেতরে উঁকি দেন। ভেতর থেকে প্রার্থনার আওয়াজ শুনতে পান। বেশ আগ্রহ তিনি জিজ্ঞেস করেন—“এখানে কী হচ্ছে?”
তারা বলে—“এরা খ্রিষ্টান। প্রার্থনা করছে।”
ওদের কথাশুনে তিনি গির্জার ভেতরে প্রবেশ করেন। সেখানে বসে যান। প্রার্থনাকারীদের অবস্থা দেখে তিনি মুগ্ধ হন। এতোটাই মুগ্ধ হন যে, কোনদিক দিয়ে সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়—তিনি টেরই পান নি।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নেমে আসে। তাঁকে খোঁজার জন্যে চতুর্দিকে লোক পাঠানো হয়। জমিদার বাবার খুব আদরের সন্তান ছিলেন কি-না—তাই।
সন্ধ্যের পর তিনি প্রাসাদে ফিরে যান। সেদিন আর খামারে যাওয়া হয় নি তাঁর। তাঁর পিতা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, “কোথায় ছিলে (তুমি)? আমি কি তোমাকে কিছু বলিনি?’
জবাবে তিনি বলেন, “বাবা! আমি কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। যাদেরকে খ্রিষ্টান বলা হয়। তাদের উপাসনা ও প্রার্থনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই তারা কীভাবে কী করছে—তা দেখার জন্যে সেখানে বসে গিয়েছিলাম।”
পুত্রের মুখে এমন কথা শুনে পিতা কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন। এরপর বললেন, “প্রিয় বৎস! তোমার ও তোমার পিতৃপুরুষের দ্বীন—ওদের দ্বীনের চে’ উত্তম।”
তিনি বললেন, “না। আল্লাহর শপথ! আমাদের দ্বীন তাদের দ্বীনের চে’ উত্তম নয়। তারা এমন এক সম্প্রদায়—যারা আল্লাহর গোলামি করে। তাঁকে ডাকে এবং তাঁরই উপাসনা করে। আর আমরা! আমরা তো আগুনের উপাসনা করি। যা আমরা নিজের হাতে জ্বালাই, আর আমরা দেখভাল ছেড়ে দিলে তা নিভে যায়।”
পুত্রের মুখে এ কথা শুনে পিতা যারপরনাই বিস্মিত হলেন। পুত্রকে হারানোর ভয় তার মাথায় ভর করলো। তাই তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিলেন। তাঁর দু পায়ে শেকল লাগিয়ে দিলেন। একটি গৃহে বন্দী করে রাখলেন।
একদিন তিনি (পুত্র) খ্রিষ্টানদের কাছে একটি লোক পাঠালেন। উদ্দেশ্য—খ্রিষ্টানদের দ্বীনের উৎস সম্পর্কে জানা। তাঁর পাঠানো লোকটি এসে জবাব দিলো, “তাদের দ্বীনের উৎস শামে।”
তিনি লোকটিকে বললনে, “ওখান (শাম) থেকে লোক এলে আমাকে জানাবে।”
কিছুদিন পর শাম থেকে কিছু লোক পারস্যে আসে। এ খবর তাঁর কাছে পৌঁছে। তিনি সুযোগ খুঁজতে থাকেন পালিয়ে যাওয়ার। যখন শামের লোকজন তাদের কাজ শেষ করে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করে, তখন তিনি শেকল ভেঙে পালিয়ে গিয়ে—তাদের সাথে যোগদান করেন। সফর করতে করতে শামে পৌঁছান।
শামে পৌঁছে তিনি খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে জানার জন্যে জিজ্ঞেস করেন, “এ দ্বীনের সর্বোত্তম ব্যক্তি কে?”
তারা একটি গির্জার দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “এই গির্জাবাসী বিশপ।”
তিনি গির্জায় পৌঁছান। বিশপের কাছে গিয়ে বলেন, “আমার একান্ত ইচ্ছে—আপনার সাথে এ গির্জায় থেকে আল্লাহর উপাসনা করবো। এবং আপনার কাছ থেকে উপকারী জ্ঞান শিখবো।”
বিশপ তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। তিনি বিশপের সাথে গির্জায় থাকতে লাগলেন। মানুষ বিশপকে ভালো মানুষ মনে করতো। কিন্তু বিশপ ছিল লোভী। বিশপ লোকদেরকে দান-খয়রাতের নির্দেশ দিতো, কিন্তু নিজে তা করতো না। লোকজন তার কাছে দানের টাকা প্রদান করলে, সে সেগুলো অভাবীদের না দিয়ে—নিজের কাছে রেখে দিতো। তিনি বিশপের এ অবস্থা থেকে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তাঁর মনে বিশপের প্রতি ঘৃণা জন্ম নিতে লাগলো।
কিছুদিন পর বিশপ মারা গেল। লোকজন বিশপকে দাফন করার জন্যে এলো। তিনি বললেন, “এ-তো একটি খারাপ লোক। সে তোমাদেরকে দান-খয়রাতে উদ্বুদ্ধ করতো। তোমাদের দানের টাকা নিজের কাছে জমা করে রাখতো, অভাবী মানুষকে দিতো না।”
তাঁর কথা শুনে লোকজন ক্ষেপে গেলো। তাদের দৃষ্টিতে যিনি মহৎ, তাকে তিনি মন্দ বলবেন—তা কী করে হয়? তাইতো তারা তাঁর কাছে প্রমাণ চাইলেন। তাদের কথা শুনে তিনি বললেন, “আমি তোমাদেরকে তার জমা করা সম্পদ বের করে দেখাচ্ছি।”
এ-বলে তিনি বিশপের লুকানো সাতটি পাত্র বের করে দেখালেন, যেখানে অনেক স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করা ছিলো। লোকজন এ-দৃশ্য দেখে তাদের ভুল বুঝতে পারলো। বিশপকে তারা দাফন না করে শূলিতে চরালো। এরপর পাথর নিক্ষেপ করতে লাগলো।
ঐ বিশপ মারা যাওয়ার পরে, আরেকজন বিশপ নিয়োগ দেয়া হলো। যিনি ছিলেন অধিক উত্তম, সৎ, দুনিয়া বিরাগী ও অধিক উপাসনাকারী। তিনি নতুন বিশপের ভক্তে পরিণত হলেন।
যখন নতুন বিশপ মারা যাচ্ছিলো, তখন তিনি তার শিয়রে বসলেন। বসে জিজ্ঞেস করলেন, “হে অমুক! আপনি দেখতে পাচ্ছেন, আল্লাহর ফয়সালা (মৃত্যু) আপনার সামনে হাজির। আল্লাহর শপথ! আমি আপনাকে সবকিছুর চে’ বেশি ভালোবেসেছি। (এখন) আমাকে কী কী কাজ করার আদেশ দিচ্ছেন? কার কাছে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন?”
নতুন বিশপ বললেন, “বৎস! আল্লাহর শপথ! আমি কেবল একজনকেই চিনি, তিনি মসুলে থাকেন। তার কাছে যাও। গেলে দেখবে—তার অবস্থাও আমার মতোই।”
নতুন বিশপ মারা যাওয়ার পর তিনি মসুলে এসে উপস্থিত হলেন। মসুলের বিশপকে তিনি তার ব্যাপারে জানান। সব শুনে বিশপ খুব খুশি হন। তিনি মসুলের বিশপের সাথে সময় কাটাতে থাকেন।
একমসয় মসুলের বিশপের জীবন ঘনিয়ে আসে। তিনি তাকে তা-ই বলেন, যা শামের বিশপকে বলেছিলেন। তার প্রশ্নের জবাবে মসুলের বিশপ বলেন, “বৎস! আল্লাহর শপথ! আমি কেবল একজনকেই চিনি, তিনি নাসীবাইন এলাকায় থাকেন। তার অবস্থাও আমার মতোই। তার কাছে যাও।”
মসুলের বিশপ মারা গেলে তিনি নাসীবাইন পৌঁছান। সেখানকার বিশপের সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। নাসীবাইনের বিশপ যখন জীবন সায়াহ্নে এসে পৌঁছান, তখন তিনি তাকেও একই কথা বলেন—যা অন্য বিশপদের বলেছিলেন।
তার কথা শুনে নাসীবাইনের বিশপ তাকে বাইজান্টাইন রাজ্যের আম্মূরিয়্যা এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন।
নাসীবাইনের বিশপকে দাফন করে তিনি আম্মূরিয়্যায় পৌঁছান। আম্মূরিয়্যার বিশপের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি কিছু অর্থ সম্পদ অর্জন করেন। ভেড়ার একটি ছোট্ট পাল ও কয়েকটি গাভীর মালিক বনে যান। যখন আম্মূরিয়্যার বিশপের মৃত্যু ঘনিয়ে আসে, তখন তিনি তার কাছেও নসীহাহ চান।
আম্মূরিয়্যার বিশপ বলেন, “বৎস! আল্লাহর শপথ! আমার মতো আর কোনো ব্যক্তি আছে বলে আমার জানা নেই, যার কাছে তুমি যেতে পারো। তবে সময় খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছে। আল-হারাম থেকে একজন নবী প্রেরণ করা হবে। অগ্নেয়শিলায় গঠিত দুই অঞ্চলের মাঝামাঝি এলাকায় তিনি হিজরত করবেন। যে অঞ্চলের মাটি হবে কিছুটা লবণাক্ত ও খেজুর গাছবহুল। তাঁর মধ্যে কিছু স্পষ্ট নিদর্শন থাকবে। তাঁর দু কাঁধের মধ্যে থাকবে নবুওয়াতের সীলমোহর। তিনি উপহার গ্রহণ করবেন, কিন্তু সাদাকাহ গ্রহণ করবেন না। সেই অঞ্চলে যাবার সামর্থ্য থাকলে—চলে যাও। কারণ তাঁর আগমনের সময় খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।”
কিছুদিন পর আরব ব্যবসায়ীদের একটি কাফেলার সাথে তাঁর দেখা হয়। তিনি তাদেরকে আরব ভূমিতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলেন। বিনিময়ে তাদেরকে তাঁর ভেড়া ও গাভীর পাল দেয়ার অঙ্গীকার করেন। ব্যবসায়ী কাফেলা তাঁর এ-প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। তিনি তাদেরকে তাঁর গবাদি পশুর পাল দিয়ে দেন। এরপর আরবের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
আল-কুরা উপত্যকায় এসে ব্যবসায়ী কাফেলা তাঁর সাথে গাদ্দারী করে। তারা তাঁকে দাস হিসেবে সেখানে বিক্রি করে দেয়। এক ইয়াহূদী তাঁকে কিনে নেয়। তিনি সেখানে খেজুর গাছ দেখতে পান। খেজুর গাছ থেকে তাঁর মনে খুশির ঢেউ উঠতে থাকে। তিনি মনে মনে ভাবতে থাকেন—এটাই হয়তো সেই দেশ!
ইয়াহূদীদের একটি গোত্র—বানূ কুরাইযা’র এক লোক তাঁকে কিনে নেয়। এরপর তাঁকে মদীনায় আনা হয়। মদীনায় পৌছেই তিনি বুঝতে পারেন—এটাই সে শহর, যার সম্পর্কে আম্মূরিয়্যার বিশপ তাঁকে বলেছিলেন। তিনি তাঁর মনিবের অধীনে দাসত্বের জীবন কাটাতে থাকেন। অপেক্ষা করতে থাকেন সে মাহেন্দ্রক্ষণের। কখন তাঁর সঙ্গে সেই মহাপুরুষের দেখা হবে, যার কথা বিশপ তাঁকে বলেছিলেন। কখন সেই মহাপুরুষের নিকট থেকে সত্যের বাণী শ্রবণ করবেন? কখন তাঁর দীর্ঘ সফরের সমাপ্তি হবে?
একদিন তিনি খেজুর বাগানে কাজ করছিলেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন—তাঁর মনিবের চাচাতো ভাই বলছে, “আল্লাহ বানূ কাইলা-কে শায়েস্তা করুন। আল্লাহর শপথ! তারা এখন মক্কা থেকে আগত এক ব্যক্তির চারপাশে জড়ো হয়েছে—কুবা-তে। তাদের ধারণা সে একজন নবী।”
এ-কথা শোনার পর তাঁর অন্তরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। শরীরে কাপুনি শুরু হয়। অন্যরকম শিহরনবোধ হয়। মনে মনে ভাবতে থাকেন—এ ব্যক্তিটাই কী সেই মহাপুরুষ? তাহলে কী তার প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে? তিনি কি সত্যের কাছে পৌঁছে গেছেন? এ চিন্তাগুলো তাঁর মনে এতোটাই ঢেউ খেলতে থাকে যে, তিনি গাছ থেকে পড়ে যাবার উপক্রম হন।
তিনি দ্রুত গাছ থেকে নেমে আসেন। এসে তাঁর মনিবের চাচাতো ভাইটিকে জিজ্ঞেস করেন, “কী সংবাদ? উনি কে?”
তিনি দাস ছিলেন। তাই তাঁর মুখে একথা শুনে মনিবের চাচাতো ভাই রেগে যান। তাঁর গালে কষে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেন। ভ্রু কুঁচকে জবাব দেন, “এ দিয়ে তোমার কী? যাও! নিজের কাজে যাও।”
তিনি বললেন, “না। তেমন কিছু না। কেবল একটি সংবাদ শুনলাম। তাই জানতে চাইলাম—ঘটনাটি কী?”
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো। তাঁর কাজও শেষ হলো। তাঁর কাছে জমানো কিছু খেজুর ছিলো। সেগুলো হাতে করে রওনা হলেন। উদ্দেশ্য—সেই ব্যক্তিটির সাথে দেখা করা, যার কথা তাঁর মনিবের চাচাতো ভাই বলেছে।
তিনি সে মহাপুরুষের কাছে পৌঁছুলেন। এরপর বললেন, “শুনলাম—আপনি একজন ভালো মানুষ। আর আপনার সঙ্গে কিছু সাথি আছে, যারা এ এলাকায় অপরিচিত। আমার কাছে কিছু সাদাকাহ’র খেজুর আছে। মনে হলো এ অঞ্চলে আপনারাই হলেন এর হকদার। এই হলো খেজুর। এখান থেকে কিছু খান।”
তাঁর কথা শুনে সে মহাপুরুষ হাত গুটিয়ে নিলেন। খেজুরে হাত দিলেন না। খেলেনও না। তাঁর সাথিদের ডেকে বললেন, “তোমরা খাও।”
তিনি মনে মনে ভাবলেন—আম্মূরিয়্যার বিশপ তাঁকে মহাপুরুষের যেসব গুণাগুণ বলেছিলেন, তার একটা পাওয়া গেলো।
এই ভেবেই তিনি দ্রুত মনিবের বাড়ীতে ফিরে এলেন। কিছুক্ষণ পর আবারও সে মহাপুরুষের কাছে গেলেন। সাথে নিলেন—জমানো কিছু খাবার। মহাপুরুষের কাছে পৌঁছে তাঁর জমানো খাবার দিয়ে বললেন, “একটু আগে দেখলাম, আপনি সাদাকাহ’র জিনিস খান না। এটি উপহার। সাদাকাহ নয়।”
তাঁর কথা শুনে মহাপুরুষটি সে খাবার থেকে খেলেন এবং তাঁর সাথিদেরকেও দিলেন। এ-দৃশ্য দেখে তিনি ভাবলেন—আম্মূরিয়্যার বিশপের দেয়া, দুটো বৈশিষ্ট্য মিলে গেলো।
সেদিনকার মতো তিনি ফিরে এলেন।
এভাবে কিছুদিন কেটে গেলো। একদিন তিনি আবার সে মহাপুরুষের কাছে গেলেন। তিনি যখন মহাপুরুষের কাছে এলেন তখন দেখতে পেলেন, তিনি একটি লাশের পেছন পেছন যাচ্ছিলেন। তাঁর চারপাশে তাঁর সাথিরা।
তিনি মহাপুরুষের চারপাশে চক্কর দিতে লাগলেন। তাঁকে চক্কর দিতে দেখে সে মহাপুরুষ বুঝে ফেললেন যে, তিনি কী খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাই মহাপুরুষটি তাঁর গায়ের চাদর নামিয়ে ফেললেন।
তিনি দেখতে পেলেন—সে মহাপুরুষের দু কাঁধের মধ্যখানে সীলমোহর। যেমনটা আম্মূরিয়্যার বিশপ তাঁকে বলেছিলেন। তিনি কান্নায় ভেঙে পরেন। অবশ্যি এ কান্না দুঃখের কান্না নয়। এতোদিন পর যে তিনি সত্যকে খুঁজে পেয়েছেন, এ কান্না ছিলো তারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি তা খুঁজে পেয়েছেন—যা তিনি হন্নে হয়ে খুঁজেছেন। তিনি সে মহাপুরুষকে খুঁজে পেয়েছেন—যার জন্যে তিনি বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছেন।
তিনি দ্রুত সে মহাপুরুষের কাছে যান। উপুড় হয়ে নবুওয়তের সীলমোহরে চুমো খান। তাঁর চোখ-মুখ ভিজে যেতে থাকে। হাত-পা অসম্ভব রকমভাবে কাপতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন—এ মহাপুরুষই হলেন সে; যার আগমনের কথা বিশপ তাঁকে জানিয়েছিলেন। ইনিই হলেন আল্লাহর রাসূল—মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
তাঁর কান্না দেখে আল্লাহর রাসূল ﷺ তাঁকে বলেন, “সালমান! এদিকে এসো।”
এই যা! বলেই ফেললাম—তাঁর নামটা। কি আর করার? আমি যার কাহিনী আপনাদের শুনাচ্ছি, তাঁর নাম সালমান। সালমান ফারিসী। যিনি সত্যকে আলিঙ্গন করার জন্যে—রাজকীয় জীবন পরিত্যাগ করেছেন। যিনি সত্যের স্বাদ আস্বাদন করার জন্যে—দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে। যিনি সত্যকে খুঁজতে খুঁজতে এতোটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। ক্লান্তি যাকে স্পর্শ করে নি। যিনি বিরতিহীন ছুটেছেন। ছুটেছেন সত্যের পথে।
একবার মানচিত্রটা হাতে নিন। এরপর দেখুন—কোথায় পারস্য, আর কোথায় মদীনা। কতোটা দূরত্ব—এই দুটি শহরের মধ্যে। আর সে সময়ে দ্রুতগামী যানবাহন ছিলো অপ্রতুল। গন্তব্য পথে ছিলো সীমাহীন প্রতিকূলতা।
আসলে সত্যিকার অর্থে যে সত্যকে খুঁজে বেড়ায়, শত প্রতিকূলতা তাঁকে দমাতে পারে না। কোনো ঝড়-ঝঞ্ঝা তাঁকে টলাতে পারে না। কোনো প্রতিবন্ধকতা তাঁর গতিকে রুদ্ধ করতে পারে না। সালমান ফারিসী ছিলেন—তাদেরই একজন। রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু।
রাসূলের ﷺ কাছে তিনি সব ঘটনা খুলে বললেন। রাসূল ﷺ তাঁর মনিবের সাথে সালমানের মুক্তির বিষয়ে কথা বললেন। বিশাল মুক্তিপণ দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনা হলো। এরপর থেকে মৃত্যু অবধি—তিনি সত্যের পথে ছিলেন।
মহান আল্লাহর জন্যে সমস্ত প্রশংসা, যিনি ছোট ছোট গল্পের মধ্যে—অনেক বড় বড় শিক্ষা রেখেছেন। সালমান ফারিসীর ঘটনাটা কি—তেমন একটি গল্প নয়?
এ গল্পে তাদের জন্যে শিক্ষা আছে, যারা সত্যিকার অর্থে সত্যকে খুঁজে বেড়ান।
তথ্যসূত্র :
ড. ইবরাহীম আলি, সীরাতুন নবি, পৃষ্ঠা : ৬০-৬৬; (মাকতাবাতুল বায়ান, প্রথম প্রকাশ, পহেলা রবিউল আওয়াল, ১৪৩৯ হিজরি)।