তাযকিয়া ও আত্মশুদ্ধি বিষয়ক পরচা
ভূমিকাঃ অন্তরের ১০টি রোগের চিকিৎসা করে অন্তরের ১০টি গুণ হাসিল করার নাম তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধি। যা শরী‘আতের দৃষ্টিতে ফরযে আইন এবং এর জন্যে কোন ইজাযত প্রাপ্ত শাইখের সাথে ইসলাহী সম্পর্ক করাও ফরযে আইন। বাইআত হওয়া ফরয বা ওয়াজিব নয় বরং এটা মুস্তাহাব, এর উপর আত্মশুদ্ধি নির্ভর করে না। আত্মশুদ্ধি অর্জন হলে সমস্ত জাহেরী গুনাহ বর্জন করা এবং জাহেরী ইবাদত-বন্দেগী করা সহজ হয়ে যায় এবং সেই বন্দেগীকে তাকওয়ার যিন্দেগী বা সুন্নতী যিন্দেগী বলে এবং সে ব্যক্তি তথন আল্লাহর ওলী হয় এবং তার হায়াতে তাইয়িবা তথা পবিত্র জীবন নসীব হয়। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে এ দৌলত নসীব করেন, আমীন।
প্রশংননীয় দশটি গুণের বর্ণনা
১. তাওবা
“তাওবা” শব্দের অর্থ হল ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, আর পরিভাষায় “তাওবা’ বলা হয় অতীত গুনাহের উপর লজ্জিত হওয়া, বর্তমানে সে গুনাহ বর্জন করা এবং ভবিষ্যতেও না করার ব্যাপারে দৃঢ় ইরাদা করা। এবং উক্ত কাজের কোন কাযা বা কাফফারা থাকলে তা করে নেয়া। এ তিনটি বিষয়ের সমষ্টিকেই “তাওবায়ে নাসূহা” বা পরিপূর্ণ তাওবা বলে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে আন্তরিকভাবে তাওবা কর। আশা করা যায় তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে যার তলদেশে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত হবে। (তাহরীম-৮)
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “গুনাহ থেকে তাওবাকারী ঐ ব্যক্তির ন্যায় হয়ে যায় যার কোন গুনাহ থাকে না।”
তাওবার ফযীলতে কুরআন শরীফের অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে এবং অনেক হাদীসেও এর ফযীলত এসেছে যেমন, (সূরা নূর ৩১, সূরা হুদ ৩, সূরা তাহরীম ৮, বুখারী হা: ৬৩০৭, ৬৩০৯, মুসলিম হা: ২৭৪৭, ২৭০২)
২. আল্লাহর ভয়
“খাওফ” বা ভয়ের প্রকৃত অর্থ হলঃ আসন্ন কোন কষ্টের আশংকা করা, অন্তরে বিষন্নতা ও জ্বালা পোড়া সৃষ্টি হওয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার সিফাতে জালালীর পরিচয় অর্জিত না হবে ততক্ষণ পযন্ত আল্লাহর ভয় অন্তরে সৃষ্টি হবে না। আর এ কথাটা মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করতে হবে যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক ছোট-বড় বস্তুর উপর এমনভাবে ক্ষমতাবান যে, মুহূর্তের মধ্যেই তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই করে ফেলতে পারেন। কোন মাখলূকের কোন প্রকার আপত্তি করারও কোন অধিকার নেই। এভাবে চিন্তা-ফিকির করলে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে। ইনশাআল্লাহ।
৩. যুহদ বা কৃচ্ছতা
“যুহদ” এর হাকীকত হলঃ দুনিয়ার মাল-সামানের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা এবং সেটা অর্জন করার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও সেদিকে মনোযোগ না দেয়া। কোটিপতিও যাহেদ হতে পারে যদি তার মাল দৌলতের প্রতি কোন আকর্ষণ না থাকে । আবার ফকিরও কোন কোন ক্ষেত্রে যাহেদ নাও হতে পারে।
“যুহদ” এর মূল হল ঐ নূর এবং ইলম যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার অন্তরে ঢালা হয়। যদ্দরূন বান্দার সীনা খুলে যায় এবং একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, দুনিয়ার সমস্ত সাজ-সজ্জা মাছির পাখার (ডানার) চেয়েও মূল্যহীন। আর আখেরাতের জীবনই আসল জীবন। যখন এই নূর হাসিল হয় তখন আখেরাতের মুকাবেলায় দুনিয়ার কোন মূল্যই থাকে না।
যুহদ এর ফলাফল হল: প্রয়োজন পরিমাণ দুনিয়ার উপর তুষ্ট হওয়া। যে পরিমাণ পাথেয় মুসাফির ব্যক্তির সফরের সময় প্রয়োজন হয় তার চেয়ে বেশীর পিছনে না পড়া।
৪. সবর বা ধৈর্য
“সবর” এর আসল অর্থ হল: কুপ্রবৃত্তির মুকাবেলায় আল্লাহ পাকের নির্দেশের উপর দৃঢ়তার সাথে জমে থাকা।
সবরের তিনটি স্তরঃ
১। উন্নন পর্যায়ের সবর হলঃ মনের খারাপ কামনা-বাসনা এবং কুপ্রবৃত্তিকে সমূলে উৎপাটিত করে এর উপর স্থায়িত্ব নসীব হওয়া।
২। সবরের নিকৃষ্ট স্তর হলঃ কুপ্রবৃত্তির প্রাবল্য থাকে আর কলব শয়তানী বাহিনীর কাঁধে ন্যস্ত হয়ে পড়ে।
৩। মধ্যম পর্যায়ের সবর হলঃ আল্লাহর বাহিনী ও শয়তানী বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলতে থাকে। কখনো এদর পাল্লা ভারী হয় আবার কখনো তাদের পাল্লা। কারো একতরফা জয়-পরাজয় হয় না। কুরআনে কারীমের ৭০টিরও বেশী স্থানে সবর এর কথা বলা হয়েছে।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন “সবর ঈমানের অর্ধেক এবং জান্নাতের খাযানাসমূহের মধ্যে একটি খাযানা। যে ব্যক্তি এগুণে গুনান্বিত হয় সে অনেক বড় সৌভাগ্যবান। রাত্রি জাগরণকারী এবং স্থায়ী রোযাদারের চেয়েও তার মর্যাদা বেশি।”
৫. শোকর বা কৃতজ্ঞতা
শোকরের হাকীকত বুঝতে হলে প্রথমে সেটাকে তিনটি অংশে বিভক্ত করতে হবে।
১। ইলম অর্থাৎ, নেয়ামত এবং নেয়ামত প্রদানকারী (আল্লাহ তা‘আলা) কে চেনা।
২। নেয়ামত প্রদানকারীর ঐ নেয়ামতের উপর এ জন্যে সন্তুষ্ট হওয়া যে, এটা আল্লাহ তা‘আলার দান।
৩। এবং আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত নেয়ামতকে তার সন্তুষ্টির কাজে ব্যবহার করা।
শোকরের ফযীলত বয়ান করে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: “যদি তোমরা (আমার নেয়ামতের) শোকর আদায় কর তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য নেয়ামত বাড়িয়ে দেব। আর যদি তোমরা নেয়ামত পেয়ে অকৃতজ্ঞ হও তাহলে (জেনে রেখ) আমার আযাব বড়ই কঠিন।” (সূরায়ে ইবরাহীম-৭)
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “খাদ্য ভক্ষণকারী কৃতজ্ঞ বান্দা ধৈর্যশীল রোযাদারের সমান।” (মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৯০৩৮)
৬. ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা
ইখলাসের অর্থ হল মুসলমান ব্যক্তির নিয়্যতের মধ্যে অন্য কিছুর মিশ্রণ না থাকা। ইখলাসের দুটি রুকন আছে। প্রথমতঃ নিয়্যত অর্থাৎ, একমাত্র আল্লাহকে রাযী খুশী করার জন্য আমল করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “সকল কাজের ভাল-মন্দ নিয়্যতের উপর নির্ভর করে।” (বুখারী হাদীস নং ১)
দ্বিতীয়তঃ সততা, আর এটাই ইখলাসের পূর্ণতা। আল্লাহ পাক বলেন তারাই প্রকৃত মুমিন বান্দা যারা তাদের অঙ্গীকারে সত্যবাদী। (সূরা আহযাব-২৩)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “যখন মানুষ সত্য কথা বলে এবং সত্যের অনুসন্ধানে থাকে তখন মহান আল্লাহর নিকট তার নাম সিদ্দীক লেখা হয়।” (বুখারী হাদীস নং ৬০৯৪)
৭. তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা
তাওয়াক্কুল দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐ বিশেষ হালত বা অবস্থা যা আল্লাহ তা‘আলাকে এককভাবে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং সমস্ত গুণের মধ্যে স্বতন্ত্র ও লা-শরীক মনে করার দ্বারা সৃষ্টি হয়। এরপর এই বিশেষ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পর এমন কাজ করা যার দ্বারা আল্লাহর প্রতি আস্থা প্রকাশ পায়। অতএব তাওয়াক্কুলের মোট ৩টি অংশ হলঃ
১। মারেফাত বা পরিচয়
২। হালাত বা বিশেষ অবস্থা
৩। আমল বা বিশেষ কার্যকলাপ
তাওয়াক্কুলের ফযীলত বয়ান করে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন তোমরা যদি সত্যিকার অর্থে মুমিন হও তাহলে এক আল্লাহর উপরই ভরসা করা। (সূরা মাইয়িদাহ-২৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: যদি তোমরা আল্লাহ তা‘আলার উপর যথার্থ তাওয়াক্কুল কর তাহলে এমনভাবে রিযিক প্রদান করা হবে যেমন পাখীদেরকে পৌঁছানো হয়। সকালে খালী পেটে বের হয়। বিকালে ভরপেটে ফিরে আসে। (তিরমিযী শরীফ হাদীস নং ২৩৪৯, মুসনাদে আহমদ-৩৭২)
৮. খোদাপ্রীতি
মুহব্বতের হাকীকত হল যেমন প্রতিটি সুস্বাদু জিনিস মানুষের প্রিয় হয়ে থাকে। আর প্রিয় হওয়ার অর্থ হলঃ মন সেদিকে আকৃষ্ট হয়। মনের এ আকর্ষণ যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখন তাকে “ইশক” বলে।
অতএব আল্লাহ তা‘আলার মুহব্বাত প্রতিটি ঈমানদার ব্যক্তির কাম্য হওয়া উচিৎ। যেহেতু মুহব্বাত করা হয় তিনটি কারণেঃ ১। ‘জামাল’ (সৌন্দর্য) ২। কামাল (গুণ) ৩। নাওয়াল (দান)। আর বলাই বাহুল্য যে, এ তিনটি বিষয় আল্লাহর মধ্যেই পরিপূর্ণ ভাবে পাওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: আর যারা সত্যিকার অর্থে আল্লাহ তা‘আলার উপর ঈমান আনে তারা তো তাঁকেই সর্বাধিক পরিমাণে ভালবাসে। (বাকারাঃ১৬৫)
অন্যত্র বলেছেন: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নেক বান্দাদেরকে ভালবাসেন আর তাঁর নেক বান্দারাও আল্লাহকে ভালবাসে। (সূরা মাইয়িদাহ আয়াত নং-৫৪)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মুহব্বাত সমস্ত জিনিস অপেক্ষা বেশী না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। (বুখারী শরীফ হাদীস নং-১৪)
৯. রেযা বিল কাযা বা আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা
মুসলমানদের শানে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেনঃ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। (সূরায়ে বাইয়্যিনাহ আয়াত-৮)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন তখন তাকে কোন মুসীবতে লিপ্ত করেন।” (তিরমিযী শরীফ হাদীস নং ২৪০১, মুসনাদে আহমদ-৫/২৩৬৯৭)
তখন যদি সে ধৈর্য্যের পরিচয় দেয় এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকে তবে তাকে নির্বাচিত করেন। এ মাকাম হাসিল হওয়ার পর বান্দার দুনিয়াবী কোন পেরেশানী থাকে না। এক হাদীসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ মুমিনের ব্যাপারটি বড় আশ্চর্যজনক কেননা তার সকল কাজই মঙ্গলময়। যদি কোন মুসীবতে নিপতিত হয় তাহলে ধৈয ধারণ করে যা তার জন্য মঙ্গলজনক। আর যদি কোন নেয়ামত প্রাপ্ত হয় তাহলে সপ্রশংস শোকর আদায় করে। (মুসলিম হাদীস নং-২৯৯৯)
১০. মৃত্যু চিন্তা যা তার জন্য মঙ্গলজনক
মৃত্যু বড় ভয়ানক জিনিস। আর মৃত্যুর পরের ঘটনাবলী তার চেয়েও বেশী ভয়াবহ। এজন্য বেশী বেশী মৃত্যুর স্মরণ করা উচিত। কেননা এর দ্বারা দুনিয়ার মুহব্বাত বিদূরিত হয়। এবং আখেরাতের ফিকির ও মুহব্বাত বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ প্রতিটি জীবকেই মরণের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। (আনকাবূতঃ ৫৭)
অন্যত্র বলেছেনঃ তোমরা যেখানেই থাকনা কেন মৃত্যু এসে তোমাদের নাগাল পাবেই। এমনকি তোমরা যদি কোন মযবুত দূর্গেও থাক। (সেখানেও মৃত্যু এসে হাযির হবে) (নিসা-৭৮)
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ তোমরা সমস্ত স্বাদ নিঃশেষকারী মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ কর। (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং-২/৭৯৪৪, তিরমিযি শরীফ-২৩১২)