হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্রে যেসব শর্ত লিপিবদ্ধ হয়েছিলো, মুসলমানরা তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সেগুলো পালন করে আসছিলেন। কিন্তু ৮ম হিজরিতে কুরাইশরা সেই সন্ধি ভঙ্গ করলো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন দূত পাঠিয়ে চুক্তিনামা নবায়নের জন্য কুরাইশদের সামনে কতিপয় শর্ত উপস্থাপন করলেন এবং শেষের দিকে লিখে দিলেন যে, এ শর্তগুলো তাদের মনঃপুত না হলে হুদাবিয়ার সন্ধি ভেঙে গিয়েছে বলে মনে করতে হবে। কুরাইশরা সন্ধি ভঙ্গের প্রস্তাবই গ্রহণ করলো।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু জিহাদের পূর্ণ প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন এবং অষ্টম হিজরির ১০ই রমজান মঙ্গলবার আসরের নামাযের পর দশ হাজার সাহাবার বিরাট এক বাহিনীকে সাথে নিয়ে মদিনা থেকে বের হলেন। মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছার পর হযরত খালেদ বিন ওলিদকে মুসলিম-বাহিনীর একটি অংশ সহ উপর দিকের রাস্তা দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করার জন্য প্রেরণ করলেন। তাদেরকে বলে দিলেন, ‘কেউ তোমাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত না হলে তোমরাও সংঘর্ষে লিপ্ত হবে না।’
এদিকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং অপর প্রান্তদিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং সাধারণ ঘোষণা দিলেন, ‘যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ। যে ব্যক্তি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে, সেও নিরাপদ।’
অবশ্য তিনি ১১ জন পুরুষ ৪ জন নারীর রক্ত ক্ষমা করেননি। কারণ, তাদের অস্তিত্বই ছিল যাবতীয় বিশৃঙ্খলার মূল; কিন্তু তারা সকলেই এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়লো। পরে তাদের অধিকাংশই মক্কা বিজয়ের পর মদিনায় পৌঁছে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিলে। ২০ই রমজান শুক্রবার নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফ সম্পন্ন করলেন। তখনো পর্যন্ত কাবাঘরের আশপাশে ৩৬০ টি মূর্তি যথারীতি বিরাজ করছিলো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতে একখণ্ড কাঠ ছিলো; তিনি একটি মূর্তির পাশ দিয়ে যেতেন আর কাঠটি দ্বারা সেদিকে ইঙ্গিত করতেন আর মূর্তিটি মুখ থুবড়ে পড়ে যেতো। তিনি তখন পাঠ করছিলেন—
তরজমা :সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত আর মিথ্যা অপসৃত হবারই।
তাওয়াফ সমাপ্ত করেনবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা শরিফের চাবি বাহক উসমান ইবনে তালহা শাইবির নিকট হতে কাবা ঘরের চাবি নিলেন এবং কাবা-অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। সেখান থেকে বের হয়ে মাকামে ইবরাহিমে নামায আদায় করলেন। নামায শেষে তিনি মসজিদে তাশরিফ নিয়ে গেলেন। আজ তিনি কুরাইশদের ব্যাপারে কি নির্দেশ জারি করেন, লোকজন গভীর উৎকণ্ঠায়সে অপেক্ষাই করছিলো। কিন্তু সকল দ্বিধা, সংশয় ও উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব-রহমত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমার সকল দিক থেকেস্বাধীন ও নিরাপদ।’ তারপর তিনি কাবাঘরের চাবিও তাদেরকে ফেরত দিয়েদিলেন।
আবু সুফিয়ান যিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে কুরাইশদের সর্বাপেক্ষা বড় নেতা ছিলেন এবং কুরাইশদের পরিচালিত প্রায় সবকটি যুদ্ধে তিনি প্রধান সেনাপতির ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে গোপনে মুসলিম-বাহিনীর সংবাদ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে মক্কা হতে বের হলে সাহাবারা তাকে গ্রেফতার করলেন। কিন্তু গ্রেফতারের পর রহমতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিতকরা হলে তাকে ক্ষমার নির্দেশ প্রদান করা হলো। নবীজির মহত্ত্ব ও উদারতার ফলশ্রুতিতে আবু সুফিয়ান সাথে সাথেই মুসলমান হয়ে গেলেন।
মক্কা বিজয়ের দিন এক ব্যক্তি হাঁপাতে হাঁপাতে কাঁপতে কাঁপতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলো। আপাদমস্তক করুণার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘শান্ত হও, আমি কোনো রাজা-বাদশা নই, একজন সাধারণ মায়ের সন্তান।’
মক্কা বিজয়ের পর ১৫দিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে অবস্থান করেন। এ সময় মদিনার আনসারগণ এ কথা ভেবে মনে কষ্ট পাচ্ছিলেন, এখন হয়তো নবীজি মক্কাতেই থেকে যাবেন আর আমরা তাঁর নিকট থেকে দূরে থেকে যাবো। কিন্তু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁদের এই সংশয় আঁচ করতে পারলেন, তখন তিনি বললেন, ‘এখন তো আমার জীবন-মরণ তোমাদেরই সাথে জড়িত।’
তথ্যসূত্র :আর-রাহিকুল মাখতুম, সফিউর রহমান মোবারকপুরি;সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, মুফতি শফি।