পলাশীর যুদ্ধ বাংলার ইতিহাসের সর্বশেষ পরাজয়ের যুদ্ধ। পিঠ ঠেকাবার মতো দেয়ালটুকুও আর বাকি থাকে না এই যুদ্ধের পরে। এই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখে তাঁর নিকটবর্তী কিছু বিশ্বাসঘাতকেরা। কিন্তু নবাবের পরাজয়ের পেছনে বিশ্বাসঘাতকতা শেষ কথা হলেও এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল আরও আগ থেকে।
ইংরেজ কোম্পানির প্রতি প্রথম থেকেই তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলার তিক্ততা ছিল। এর সর্বজনবিদিত তিনটি কারণ ছিল—ইংরেজদের অতিরিক্ত দুর্গ নির্মাণ, ১৭১৭ সালে সম্রাট ফররুখ শিয়ারের দেওয়া দস্তকের অপব্যবহার এবং ৫৩ লাখ রুপির তহবিল আত্মসাত করে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া কৃষ্ণদাসকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি। এ সমস্যাগুলো নবাবের ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই ছিল। তিনি এগুলির আইনানুগ সমাধান চাচ্ছিলেন৷ কিন্তু ইংরেজরা সমাধানের পথে আসতে চাচ্ছিল না। তরুণ নবাব কোম্পানিকে অতিরিক্ত দুর্গ নির্মাণ বন্ধ, দস্তকের অপব্যবহারের অবসান এবং কৃষ্ণদাসকে ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু কোম্পানি নবাবের কোনো কথাতেই কর্ণপাত করেনি।
অন্যদিকে কোম্পানির কলকাতার কর্তাব্যক্তিরা এমন আচরণ করেন যে নবাবের প্রতি তাঁদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা পরিলক্ষিত হয় না। উপরন্তু তারা সিরাজউদ্দৌলার খালা ঘসেটি বেগমের পছন্দমতো সিংহাসনের অপর দাবিদার শওকত জংকে সমর্থন করতে থাকে। এভাবে নবাব এবং কোম্পানির মধ্যে আরেকটি বিবাদের সূত্রপাত হয়।
প্রথম দিকে নবাব তরিতগতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রমাণ দেন। তিনি তাঁর খালাকে গৃহবন্দী করে কলকাতা দখল করেন এবং তাঁর খালাতো ভাই শওকত জংকে পরাজিত করেন। নবাবের স্বল্পকালীন শাসনকালের মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে ভালো সময়, কিন্তু এখানেই তাঁর পতনের সূত্রপাত। পতনের সূচনা ঘটে মাদ্রাজ কাউন্সিল থেকে প্রেরিত কর্নেল ক্লাইভ এবং অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের দ্বারা কলকাতা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। নবাব কলকাতা পুনরুদ্ধারের এক সাহসী প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন এবং আলীনগরের অবমাননাকর চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির আওতায় কোম্পানি সব বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা ফিরে পায়, আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি লাভ করে, কলকাতাকে সুরক্ষিত করা এবং মুদ্রা তৈরি করার অধিকারও নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আসে। অতঃপর ইংরেজ কোম্পানি ফরাসিদের অধীনে থাকা চন্দননগর দখল করে।
এরপর নবাবের গুরুত্বপূর্ণ সভাসদ মীর জাফর, ইয়ার লতিফ খান, খাজা ওয়াজিদ এবং জগত শেঠ ও উমিচাঁদ সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা তাড়িত হয়েছিল। যেমন মীর জাফর প্রদেশের নবাব হওয়ার উদ্দেশ্যে, জগত শেঠ নতুন নবাবকে ঋণ দিতে অস্বীকার করায় তাকে যে অপমান করা হয় তার প্রতিশোধ নিতে, উমিচাঁদ তার ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধার জন্য এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর এ ষড়যন্ত্রকারীদের পেছনে ছিল বেশ কিছু প্রভাবশালী জমিদার। প্রদেশে এ ধরনের ষড়যন্ত্র কোনো নতুন বিষয় ছিল না, এ সময়ে নতুনত্ব ছিল এই যে, ষড়যন্ত্রকারীরা ইংরেজ কোম্পানিকে তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিদেশিদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যে ক্ষমতা তারা নিজেরা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল। বিদেশিদের সাহায্য না পেলেও অভ্যন্তরীণ শত্রুরা ক্ষমতা দখলের জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। চন্দননগর দখল করার পর ক্লাইভ ও ওয়াটসন মাদ্রাজে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল।
রাজদরবারে নবাবের আহ্বানে তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কেন ক্লাইভ ও ওয়াটসন তাদের মত পরিবর্তন করেছিল এবং পলাশীর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল?
ইতিহাসবিদগণ বলেন, সিরাজউদ্দৌলা আলীনগর চুক্তির ও চন্দননগর হারানোর পরও ফরাসিদের তার দরবারে আশ্রয় দিয়েছিল এবং ফরাসি জেনারেল বুশির কাছে সামরিক সহায়তা চেয়েছিল, যা ইংরেজদের আতঙ্কের কারণ ছিল। এ পরিস্থিতিতে তারা উপলব্ধি করে যে ক্ষমতাসীন নবাবকে আর বিশ্বাস করা যায় না, সুতরাং তার স্থানে এমন কাউকে বসাতে হবে, যাকে তারা বিশ্বাস করতে পারে। এভাবেই আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শত্রুরা নবাবের পরাজয় ত্বরান্বিত করার পটভূমি নির্মাণ করেছিল।
ইতিহাসে আরও চমৎকার ব্যাখ্যাও রয়ে গেছে। কেউ কেউ মনে করেন, সবই ধূর্ত ইংরেজদের সাজানো নাটক। যদিও মুর্শিদাবাদের কিছু সভাসদ সিরাজউদ্দৌলার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন, কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ক্লাইভ ও ওয়াটসন যখন মাদ্রাজ থেকে বাংলায় পৌঁছান তখন এখানে ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু একসময় তাঁরা মুর্শিদাবাদের বিদ্যমান পরিস্থিতির সুযোগে ষড়যন্ত্রের সিদ্ধান্ত নেন।
মূল ঘটনা যেটাই হোক, এরপর বাংলার আকাশে সেই দুর্যোগের ঘনঘটা আসে। ষড়যন্ত্র জিতে যায়। নবাব পরাজিত হন। ষড়যন্ত্র কিংবা ইংরেজ রাজত্বের ধূর্ততা, এসবের সঙ্গে যারাই জড়িত ছিলেন, ইতিহাস তাদেরকে কাপুরুষ বলেই চিহ্নিত করবে।
আবু জর
সূত্রঃ fateh24