একটানা দীর্ঘ দশটি বছর পর্যন্ত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের গোত্রসমূহকে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। আরবের এমন কোনো মজলিস ও সভা-সম্মেলন ছিলো না, যেখানে উপস্থিত হয়ে তিনি তাদেরকে সত্যের দাওয়াত দেননি। হজের মৌসুমে, উকাজের বাজারে, যিল-মাজাজে, ঘরে ঘরে গিয়ে লোকদেরকে সত্যের প্রতি আহ্বান করতে থাকে; কিন্তু তারা এর প্রতিউত্তরে নবীজিকে সর্বপ্রকার কষ্ট দিতে থাকে এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে থাকে। তারা বলতো, ‘প্রথমে নিজের গোত্রকে মুসলমান বানান, তারপর আমাদেরকে হেদায়েত করতে আসুন।’ এভাবে দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হয়ে যায়।
ওদিকে নবীজির এই বিরামহীন দাওয়াতের খবর তখন আর শুধু মক্কাতেই সীমাবদ্ধ নেই;—বাৎসরিক হজ, বিভিন্ন ব্যাবসায়িক উৎসব, মেলা এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজনে-আসা মক্কার বহিরাগতদের সূত্র ধরে ইসলামের খবর তখন পৌঁছে গেছে ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধে পর্যদুস্ত আরব-শহর ইয়াসরিবেও, যা পরবর্তী সময়ে মদিনাতুন্নবি নামে পরিচিতি লাভ করে। এদিকে ইসলামের জন্য নবীজির ত্যাগ-কষ্ট-ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরীক্ষারও প্রায় শেষ পর্ব চলছিলো। মহান আল্লাহ ইসলামের জন্য নবীজি ও সাহাবাদের এই উনুনে-পোড়া অসহ্য কালের প্রতিদান দেওয়ার ইচ্ছা করলেন;—ইসলামের প্রচার ও উন্নতিতেই সেই প্রতিদান সন্নিহিত ছিলো। নিজেদের শহরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে অতিষ্ঠ হয়ে মদিনার আউস গোত্রের কতিপয় লোক নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হলেন; উদ্দেশ্য—এই নব্য-প্রচারিত আদর্শের বরাত ধরে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা মদিনার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি লাঘব করা। মদিনা থেকে আগত লোকদের মধ্য হতে আসআদ ইবনে যুরারা এবং যাকওয়ান ইবনে আবদে কায়েস—এই দুই ব্যক্তি ওই বছর ইসলাম-গ্রহণে ধন্য হন।
এর পরবর্তী বছর আউস গোত্রেরই আরও কিছু লোক আগমন করেন, যাঁদের মধ্য হতে ছয় বা আটজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর সত্য বাণীর প্রচারে আমার সাহায্য করতে প্রস্তুত আছো?’ তাঁরা আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, বর্তমানে আমাদের পরস্পরের মধ্যে আউস ও খাযরাজ গোত্রের মাঝে গৃহযুদ্ধ চলছে। আপনি যদি এ সময়ে মদিনায় তাশরিফ নিয়ে যান, তাহলে আপনার হাতে বায়আতের ব্যাপারে সকলের ঐক্যমত হবে না। আপনি আপাতত এক বছরের জন্য এ সিদ্ধান্ত মুলতবি রাখুন। হতে পারে আমাদের পরস্পরে সন্ধি হয়ে যাবে এবং আউস ও খাযরাজ উভয় মিলে ইসলাম গ্রহণ করে নেবে। আগামী বছর আমরা আবার আপনার খেদমতে উপস্থিত হবো, তখন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে।’ অতঃপর তাঁরা সকলে মদীনায় ফিরে আসেন।
মদিনায় ইসলামের প্রসার ঘটুক—এটাই ছিল মহান আল্লাহর ইচ্ছা। সুতরাং ওই এক বছরের ভেতরেই আউস ও খাযরাজের অধিকাংশ ঝগড়া মীমাংসা হয়ে গেলো এবং ওয়াদামাফিক পরের বছর হজের মৌসুমে বারো জন লোক মক্কায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হলেন; যাঁদের মধ্যে দশজন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের আর দুইজন ছিলেন আউস গোত্রের। এঁদের মধ্য হতে যাঁরা বিগত বছর মুসলমান হননি, তাঁরাও এবার মুসলিম হয়ে গেলেন এবং সবাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতে বাইআত গ্রহণ করলেন।
এই বাইআত যেহেতু সর্বপ্রথম আকাবা নামক স্থানের নিকট সম্পন্ন হয়েছিলো, তাই এটাকে বাইয়াতে আকাবায়ে উলা বা আকাবার প্রথম বায়আত নামে অভিহিত করা হয়। এই বাইয়াতের ঘটনা ইসলামের বিস্তৃতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।