হাবশার বাদশার দরবারে কুরাইশ-দূতরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক অভিযোগ আরোপ করলো আর অনুরোধ জানালো যে, মুসলিমদের যেন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তারা এজন্যই এখানে মুসলিমদের আত্মীয় ও স্বজন কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে এসেছে। বেতরিক পাদরিরাও দূতদের কথায় সায় দিলো। সবার সব কথাবার্তা শ্রবণের পর সম্রাট নাজ্জাশি গভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিয়ে বললেন, ‘আলোচ্য বিষয়টির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের পূর্বে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করা কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন হবে না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে বিষয়টির খুঁটিনাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া তাঁর বিশেষ প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি মুসলিমদের আহ্বান জানালেন।
মুসলিমগণ আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ করে বিষয়ের খুঁটিনাটিসহ সকল কথা সম্রাট সমীপে পেশ করার জন্য উত্তম মানসিক প্রস্তুতিসহকারে সম্রাটের দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
সম্রাট নাজ্জাশি তাঁর দরবারে উপস্থিত মুসলিমদের লক্ষ করে বললেন, ‘যে ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে যুগ যুগ ধরে পূর্বপুরুষগণের বংশপরম্পরা সূত্রে চলে আসা ধর্ম তোমরা পরিত্যাগ করেছো এবং এমনকি আমাদের দেশে আশ্রিত হয়েও তোমরা আমাদের ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন রয়েছো, সে ধর্মটি কোন ধর্ম?’
প্রত্যুত্তরে মুসলিমদের মনোনীত মুখপাত্র হিসেবে জাফচর বিন আবু তালিব অকপটে বলে চললেন, ‘হে সম্রাট, আমরা ছিলাম অজ্ঞতা, অশ্লীলতা ও অনাচারের অন্ধকারে নিমজ্জিত দুষ্কর্মশীল এক জাতি। আমরা প্রতিমা পূজা করতাম, মৃত জীব-জানোয়ারের মাংস ভক্ষণ করতাম, নির্বিচারে ব্যভিচার ও অশ্লীলতায় লিপ্ত থাকতাম, আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করতাম, আমানতের খেয়ানত ও মানুষের হক পয়মাল করতাম এবং দুর্বলদের সহায়-সম্পদ গ্রাস করতাম; এমন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজজীবনে আমরা যখন মানবেতর জীবন যাপন করে আসছিলাম, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অনুগ্রহ করে আমাদের মাঝে এক রাসূল প্রেরণ করলেন; তাঁর বংশ-মর্যাদা, সততা, সহনশীলতা, সংযমশীলতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, পরোপকারিতা ইত্যাদি গুণাবলি এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পূর্ব থেকেই আমরা অবহিত ছিলাম। তিনি আমাদেরকে আহ্বান জানিয়ে বললেন যে, ‘সমগ্র বিশ্বজাহানের স্রষ্টা প্রতিপালক এক আল্লাহ ছাড়া আমরা আর কারো উপাসনা করবো না। বংশপরম্পরা সূত্রে এ যাবৎ আমরা যে সকল প্রস্তরমূর্তি বা প্রতিমা পূজা করে এসেছি, সেসব বর্জন করবো। অধিকন্তু মিথ্যা বর্জন করা, পাড়া-প্রতিবেশীগণের সাথে সদ্ব্যবহার করা, অশ্লীল অবৈধ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং রক্তপাত পরিহার করে চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তাছাড়া মহিলাদের উপর নির্যাতন চালানো কিংবা মহিলাদের অহেতুক অপবাদ দেোয়া থেকেও বিরত থাকার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা থেকে বিরত থাকার জন্যও তিনি পরামর্শ দেন। অধিকন্তু, নামায, রোযা এবং যাকাতের জন্যও তিনি আমাদের নির্দেশ প্রদান করেন।’
সম্রাট নাজ্জাশি বললেন, ‘সেই পয়গম্বর যা এনেছেন, তার কিছু অংশ তোমাদের কাছে আছে কি?’ হযরত জাফর বললেন, ‘জি, আছে। নাজ্জাশি বললেন, ‘তা হলে আমার সামনে পড়ে শোনাও।’ জাফর রাযিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর সমীপে নিবেদিত এবং আত্মা-সমাহিত অবস্থায় ভাবগদগদ চিত্তে সুরায়ে মরিয়মের প্রথম কয়েকটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন। নাজ্জাশি এতই মুগ্ধ হলেন যে, তাঁর চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়ে দাড়ি ভিজে গেলো। জাফরের তেলাওয়াত শ্রবণ করে নাজ্জাশির ধর্মীয় মন্ত্রণাদাতাগণও এতই ক্রন্দন করেছিলেন যে, ‘এ কালাম (বাণী) এবং সেই কালাম, যা ঈসা আলাইহিস সালামের নিকট অবতীর্ণ হয়েছিলো, উভয় কালামই এক উৎস হতে অবতীর্ণ হয়েছে।’
এরপর নাজ্জাশি আমর বিন আস এবং আব্দুল্লাহ বিন রবিআকে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা যে দূরভিসন্ধি নিয়ে আমার দরবারে আগমন করেছো, তা সঙ্গে নিয়েই দেশে ফিরে যাও। তোমাদের হাতে এদের সমর্পণ করার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। অধিকন্তু, এ ব্যাপারে এখানে কোন কূট-কৌশলেরও অবকাশ থাকবে না।’