(১): আধুনিক জীবনযাত্রার ঢঙই এমন, আমি যত আধুনিক জীবনের সাথে জুড়ব, ততই আখেরাতের চিন্তা থেকে দূরে সরতে থাকব। বস্তুবাদী জগত আমাকে ‘আসল হাকীকত’ ভুলিয়ে দেয়। আখেরাতই হল আসল হাকীকত। আল্লাহর সাথে সাক্ষাতই হল চূড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু আমরা তা থেকে গাফেল,
اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مُّعْرِضُونَ
মানুষের জন্য তাদের হিশেবের সময় কাছে এসে গেছে। অথচ তারা উদাসীনতায় বিমুখ হয়ে আছে (আম্বিয়া ১)।
(২): কুরআন কারীম বিভিন্নভাবে আখেরাতের কথা বলেছে। কেয়ামতের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছে। কুরআনে আখেরাতের কথা এত বেশিবার আলোচিত হয়েছে, এতবেশি ভঙ্গিতে আলোচিত হয়েছে, মানুষের পক্ষে কেয়ামতের আলোচনা সম্বলিত আয়াতগুলোর সঠিক পরিসংখ্যান বের করা অসম্ভব। একটু পরপরই কেয়ামতের আলোচনা। পরকালের আলোচনা। আখেরাতের আলোচনা। এসব কি এমনি এমনি? কোনও কারণ ছাড়াই?
(৩): কুরআন কারীমে আখেরাত বিষয়ক আয়াতগুলোতে বিভিন্ন দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কখনও কবর, কখনো কবর থেকে ওঠার অবস্থা, কখনও কেয়ামত মাঠের অবস্থা, কখনও আল্লাহর সামনে নতমস্তকে দাঁড়ানো অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
কিয়ামতচিত্র: ১
শিঙ্গাধ্বনির পর সবাই যে যার কবরগাহ থেকে উঠে আসবে। ভীত-বিহ্বল হয়ে। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য,
وَلَا تَحْسَبَنَّ اللَّهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ ۚ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيهِ الْأَبْصَارُ مُهْطِعِينَ مُقْنِعِي رُءُوسِهِمْ لَا يَرْتَدُّ إِلَيْهِمْ طَرْفُهُمْ ۖ وَأَفْئِدَتُهُمْ هَوَاءٌ
আপনি কিছুতেই মনে করবেন না জালিমগণ যা-কিছু করছে আল্লাহ সে সম্পর্কে বেখবর। তিনি তো তাদেরকে সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দিচ্ছেন, য দিন চক্ষুসমূহ থাকবে বিস্ফারিত। তারা মাথা উপর দিকে তুলে দৌড়তে থাকবে। তাদের দৃষ্টি পলক ফেলার জন্য ফিরে আসবে না। আর (ভীতি বিহ্বলতার কারণে) তাদের প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম করবে (ইবরাহীম ৪২-৪৩)।
(৪): আমাদের দৃষ্টি হবে বিস্ফারিত। মাথা উপর দিকে তুলে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াতে থাকব। বেদম ভয়ের চোটে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে যাবো। প্রচণ্ড শংকার কারণে, মনে হবে প্রাণপাখি আবার উড়ে যাবে। প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা।
কিয়ামত্রচিত্রঃ ২
কেয়ামতের দিন যে কী এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরী হবে, ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব। কুরআন কারীমের আয়াতের আশ্রয় নেয়াই শ্রেয়,
وَلَوْ تَرَىٰ إِذِ الْمُجْرِمُونَ نَاكِسُو رُءُوسِهِمْ عِندَ رَبِّهِمْ رَبَّنَا أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوقِنُونَ
এবং হায়! আপনি যদি সেই দৃশ্য দেখতেন, যখন অপরাধীরা নিজ প্রতিপালকের সামনে মাথা নুইয়ে (দাঁড়িয়ে) থাকবে (এবং বলবে!) হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা (এবার প্রকৃত বিষয়) দেখলাম ও শুনলাম। সুতরাং আমাদের পুনরায় (দুনিয়ায়) পাঠিয়ে দিন। তাহলে আমরা সৎকাজ করব। আমরা যথার্থ বিশ্বাসী হয়ে গিয়েছি (সাজদা ১২)।
(৫): একটু কল্পনা করে দেখতে পারি, আমি মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বিচার হচ্ছে। নানা অপরাধ বেরিয়ে আসছে। যেসব কেউ জানত না। থরথর করে কাঁপছি। দুই হাঁটু ভয়ে ঠকঠক করছে। বাঁচার আর কোনও আশা নেই। অনুনয় বিনয় করছি, আমাকে যেন আরেকবার পৃথিবীতে ফেরার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তা কি সম্ভব?
কিয়ামতচিত্রঃ ৩
সেদিন চরম বিপর্যস্ত অবস্থা হবে। আল্লাহর ভয়ে জর্জরিত হয়ে একে অপরের দিকে চোরা দৃষ্টিতে থাকবে,
وَتَرَاهُمْ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا خَاشِعِينَ مِنَ الذُّلِّ يَنظُرُونَ مِن طَرْفٍ خَفِيٍّ ۗ
আপনি তাদেরকে দেখবেন, তাদেরকে জাহান্নামের সামনে এভাবে পেশ করা হবে যে, তারা অপমানে অবনত অবস্থায় অস্ফুট চোখে তাকাচ্ছে (শুরা ৪৫)।
(৬): আমি দুনিয়াতে কত সম্মানিত ছিলাম। লোকে আমাকে বড় সাহেব বলে ডাকত। বড় হুজুর বলে ডাকত। সেদিন সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে।
কিয়ামতচিত্রঃ ৪
একেকজন অপরাধীর চেহারা সেদিন কালো হয়ে যাবে। অমাবশ্যার ঘোর অমানিশা তাদের চেহারায় ছেয়ে যাবে,
وَالَّذِينَ كَسَبُوا السَّيِّئَاتِ جَزَاءُ سَيِّئَةٍ بِمِثْلِهَا وَتَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ ۖ مَّا لَهُم مِّنَ اللَّهِ مِنْ عَاصِمٍ ۖ كَأَنَّمَا أُغْشِيَتْ وُجُوهُهُمْ قِطَعًا مِّنَ اللَّيْلِ مُظْلِمًا ۚ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
আর যারা মন্দ কাজ করেছে, (তাদের) মন্দ কাজের বদলা অনুরূপ মন্দই হবে। লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে। আল্লাহ (-এর আযাব) হতে তাদের কোনও রক্ষাকর্তা থাকবে না। মনে হবে যেন তাদের মুখম-ল অন্ধকার রাতের টুকরা দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়েছে। তারা হবে জাহান্নামবাসী। তারা তাতে সর্বদা থাকবে (ইউনুস ২৭)।
(৭): কিয়ামতচিত্রঃ ৫
আরেকটা দৃশ্য কল্পনা করলে, অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়। সেদিন অপরাধীরা হাঁটু গেড়ে নতজানু হয়ে বসবে,
وَتَرَىٰ كُلَّ أُمَّةٍ جَاثِيَةً ۚ كُلُّ أُمَّةٍ تُدْعَىٰ إِلَىٰ كِتَابِهَا الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ مَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ هَٰذَا كِتَابُنَا يَنطِقُ عَلَيْكُم بِالْحَقِّ ۚ إِنَّا كُنَّا نَسْتَنسِخُ مَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
আর আপনি প্রত্যেক দলকে দেখবেন হাঁটু ভেঙে পড়ে আছে এবং প্রত্যেক দলকে তাদের আমলনামার দিকে ডাকা হবে (এবং বলা হবে,) আজ তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্মের বদলা দেওয়া হবে। এটা আমার (লিপিবদ্ধ করানো) দফতর, যা তোমাদের সম্পর্কে সত্য বলছে। তোমরা যা-কিছু করতে আমি তা সবই লিপিবদ্ধ করাতাম (জাসিয়া ২৮-২৯)।
(৮): কিয়ামতচিত্রঃ ৬
অবস্থা এমন শোচনীয় হবে, তাদের প্রাণ কণ্ঠনালীতে এসে যাবে। প্রায় যায় যায় অবস্থা,
وَأَنذِرْهُمْ يَوْمَ الْآزِفَةِ إِذِ الْقُلُوبُ لَدَى الْحَنَاجِرِ كَاظِمِينَ ۚ مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ
(হে রাসূল!) তাদেরকে সতর্ক করে দিন আসন্ন দিন সম্পর্কে, যখন বেদম কষ্টে মানুষের প্রাণ কণ্ঠাগত হয়ে যাবে। জালেমদের থাকবে না কোনও বন্ধু এবং কোনও সুপারিশকারী, যার কথা গ্রহণ করা হয় (মু’মিন ১৮)।
(৯): আরও অসংখ্য আয়াতে কেয়ামতের বিভীষিকার বর্ণনা আছে। সেদিন মানুষ কেমন হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে, তার বর্ণনা আছে। আমার সময়ও শুরু হয়ে যেতে পারে। মালাকুল মাউত যে কোনও মুহূর্তে হাজির হয়ে যেতে পারে। তারপরই শুরু হবে আমার সেই সুনিশ্চিত যাত্রা।
সেদিন কখন আসবে? আল্লাহ ছাড়া কেউ তা বলতে পারে না। কুরআন কারীমে ছয়বার বলা হয়েছে, সেদিন আসবে আচানক (بَغْتَةً)।
حَتَّىٰ إِذَا جَاءَتْهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً
অবশেষে কিয়ামত যখন অকস্মাৎ তাদের সামনে এসে পড়বে (আনআম ৩১)।
لَا تَأْتِيكُمْ إِلَّا بَغْتَةً ۗ
তোমাদের নিকট তা (কেয়ামত) আসবে হঠাৎ করেই (আ‘রাফ ১৮৭)।
أَوْ تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ
অথবা সহসা তাদের উপর তাদের অজ্ঞাতসারে কিয়ামত আপতিত হবে? (ইউসুফ ১০৭)।
بَلْ تَأْتِيهِم بَغْتَةً فَتَبْهَتُهُمْ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ رَدَّهَا وَلَا هُمْ يُنظَرُونَ
বরং তা (অর্থাৎ জাহান্নামের আগুন) তাদের কাছে আসবে অতর্কিতভাবে এবং তাদেরকে হতভম্ব করে দেবে, ফলে না তারা তা হটাতে পারবে এবং না তাদেরকে কিছুমাত্র অবকাশ দেওয়া হবে (আম্বিয়া ৪০)।
আমার কি জানা আছে, কোন অবস্থায় এসে আযরাঈল আমাকে পাকড়াও করবে? আমি কেন সতর্ক থাকছি না?
(১০): পুরো কুরআন কারীম জুড়ে কেয়ামত আর কেয়ামতের আলোচনা। অন্য কোনও আসমানী কিতাবে এত বেশি পরকালের বর্ণনা নেই। কুরআন কারীমে বিস্তারিতভাবে আখেরাতের বর্ণনা আছে, জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা আছে। আযাব-গযবের কথা আছে। তাওরাত-ইনজীলে এভাবে নেই।
(১১): আল্লাহ তা‘আলা নিজের প্রশংসা করেছেন। কেন?
رَفِيعُ الدَّرَجَاتِ ذُو الْعَرْشِ يُلْقِي الرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ لِيُنذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ
তিনি সমুচ্চ মর্যাদার অধিকারী, আরশের অধিপতি। তিনি নিজ বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা নিজ হুকুমে রূহ (অর্থাৎ ওহী) নাযিল করেন। এই জন্যে যে, সে সাক্ষাৎ দিবস সম্পর্কে সতর্ক করবে (মু’মিন ১৫)।
(১২): নিজের প্রশংসা করেছেন, কারণ তিনি তার পছন্দের বান্দার উপর ওহী নাযিল করেন। যাতে সেই পছন্দের বান্দা (নবী বা রাসূল) শেষদিবস সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করতে পারে। তার মানে ওহীর অন্যতম উদ্দেশ্য হল, মানুষকে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে সতর্ক করা। আরও খোলাসা করে বলতে পারি, কুরআন নাযিলের অন্যতম উদ্দেশ্য হল, মানুষকে সতর্ক করা, আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের দিবস সম্পর্কে। আর আমরা এই বিষয়ে কত গাফিল।
(১৩): আমরা যখন কুরআন কারীম তিলাওয়াত করি, তখন কি আমার মনে একথা জাগরূক থাকে, এই কুরআন কেন নাযিল করা হয়েছে? আমার কাছে স্পষ্টভাবে কথাটা জানা থাকে, এই কুরআন নাযিল হয়েছে, আমাকে আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে। আখেরাতের স্মরণ সম্বলিত আয়াতগুলো কি আমাকে যথাযথভাবে আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়? নাকি কোনও রকম পড়েই সামনে চলে যাই?
(১৪): আমরা যখন শেষদিনকে ভুলে, দুনিয়া নিয়ে মশগুল হয়ে পড়ি, তখন কিন্তু আমরা সাধারণ একটা দিনকে ভুলি না, আমি ভুলে থাকি এক ভয়ংকর দিনকে,
إِنَّ هَٰؤُلَاءِ يُحِبُّونَ الْعَاجِلَةَ وَيَذَرُونَ وَرَاءَهُمْ يَوْمًا ثَقِيلًا
তারা তো (দুনিয়ার) নগদ জিনিসকে ভালোবাসে এবং তাদের সামনে যে কঠিন দিন আসছে তাকে উপেক্ষা করছে (দাহর: ২৭)।
(১৫): এই যে বিভিন্ন আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, মানুষ সেই কঠিন দিনে, নির্বাক হয়ে যাবে, তাদের দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে যাবে, তাদের মাথা অবনত হয়ে যাবে, ভয়ে পাগলপারা হয়ে যাবে, হাঁটু গেড়ে নতজানু হয়ে বসে থাকবে। এর কারণ কি? কেন স্নায়ুগুলো জমাট বেঁধে যাবে? দৃষ্টি জমে যাবে?
এর কারণ নিঃসন্দেহে, আযাবের ভয় আর দুনিয়ার বুকে করে যাওয়া বদআমলের ফিরিস্তি। এই দু’টি বিষয় ছাড়া আরও একটি বিষয়ও আছে। তা হল, আল্লাহ তা‘আলার উপস্থিতি। সেদিন তিনি আবির্ভূত হবেন। সবাই তার উপস্থিতিতে ভয়ে সমীহে জড়সড় হয়ে পড়বে। কথা বন্ধ হয়ে যাবে, আল্লাহর বড়ত্ব বুঝতে পেরে, মহত্ব উপলব্ধি করতে পেরে। তিনি রহমান। সে ভয়ংকর দিনে সবার আওয়াজ ফিসফিসে হয়ে যাবে,
يَوْمَئِذٍ يَتَّبِعُونَ الدَّاعِيَ لَا عِوَجَ لَهُ ۖ وَخَشَعَتِ الْأَصْوَاتُ لِلرَّحْمَٰنِ فَلَا تَسْمَعُ إِلَّا هَمْسًا
সে দিন সকলে আহ্বানকারীর অনুসরণ করবে এমনভাবে যে, তার কাছে কোনও বক্রতা পরিদৃষ্ট হবে না এবং দয়াময় আল্লাহর সামনে সব আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে। ফলে আপনি পায়ের মৃদু আওয়াজ ছাড়া কিছুই শুনতে পাবেন না (তোয়াহা: ১০৮)।
(১৬): একটু পরেই আল্লাহ তা‘আলা বলছেন,
وَعَنَتِ الْوُجُوهُ لِلْحَيِّ الْقَيُّومِ ۖ وَقَدْ خَابَ مَنْ حَمَلَ ظُلْمًا
আল-হায়্যুল কায়্যুম (অর্থাৎ চিরঞ্জীব, নিয়ন্ত্রক, সেই সত্তার) সামনে সকল চেহারা নত হয়ে থাকবে। আর যে-কেউ জুলুমের ভার বহন করবে, সে-ই ব্যর্থকাম হবে (তোয়াহা: ১১১)।
(১৭): দুনিয়ার অন্ধ মোহে বুঁদ হয়ে গেলে, চোখের সামনে পর্দা পড়ে যায়। কোনও এক উপলক্ষ্যে, মানুষ যখন এই অন্ধকার পর্দা সরিয়ে, নিজের মাঝে ডুব দেয়, আল্লাহর সাথে সাক্ষাত বিষয়ে চিন্তা করে, তখন মানুষ নিজের মধ্যে আশ্চর্যরকমের প্রাণশক্তি অনুভব করে। ঈমানের নবধারা জলে অবগাহনের অনুভূতি জাগ্রত হয় তার মধ্যে। আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের চিন্তা মানে নতুন এক ঈমানি গোসল। এই গোসলে কলব থেকে যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা দূর হয়ে যায়। এই গোসলে কলবের অনেক বদ্ধ দুয়ার খুলে যায়। এতদিনকার অনেক জং ধরা দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে।
(১৮): শেষদিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের কথা কলবে ‘হাযির-নাযির’ রাখার অন্যতম বড় ফায়েদা হল, কলব অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের দিকে ধাবিত হয় না। সবসময় আখেরাতে ফলপ্রসূ হবে এমন বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়। অপ্রয়োজনীয় দৃষ্টি, অপ্রয়োজনীয় শ্রবন, অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা, অপ্রয়োজনীয় ঘুম, অপ্রয়োজনীয় নেটবিচরণ কমে আসে। আল্লাহর সাক্ষাতচিন্তা মানুষকে শুধু মূল লক্ষ্যপানে ধাবিত করে।
(১৯): আল্লাহর সাক্ষাতের চিন্তা মানুষকে বড় বেশি কুরআন কারীমমুখী করে দেয়। আল্লাহমুখী মুমিন তার চিন্তাকে, তার ব্যক্তিত্বকে কুরআনের ছাঁচেই গড়ে তোলে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা সেই কঠিন দিনে, আমাদের যাবতীয় হিশেব গ্রহণ করবেন কুরআনেরই আলোকে,
كَذَٰلِكَ نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاءِ مَا قَدْ سَبَقَ ۚ وَقَدْ آتَيْنَاكَ مِن لَّدُنَّا ذِكْرًا مَّنْ أَعْرَضَ عَنْهُ فَإِنَّهُ يَحْمِلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وِزْرًا
(হে নবী!) আমি এভাবে অতীতে যা ঘটেছে তার কিছু সংবাদ আপনাকে অবহিত করি আর আমি আপনাকে আমার নিকট থেকে দান করেছি এক উপদেশবানী। যারা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, কিয়ামতের দিন তারা বহন করবে মস্ত বোঝা (তোয়াহা : ৯৯-১০০)।
(২০): আমরা আজ নবীজি সা.-এর শিক্ষাকে ভুলে গেছি। তার দাওয়াতকে অবহেলা করছি। এটা একদিন আমাদেরকে ভীষণ বিপদে ফেলে দিবে,
وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ فَعَمِيَتْ عَلَيْهِمُ الْأَنبَاءُ يَوْمَئِذٍ فَهُمْ لَا يَتَسَاءَلُونَ
এবং সেই দিন (-কে কিছুতেই ভুলো না) যখন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বলবেন, তোমর নবীগনকে কী উত্তর দিয়েছিলে? সে দিন যাবতীয় সংবাদ (যা তারা নিজেদের পক্ষ হতে তৈরি করত) বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে তারা একে অন্যকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে না (কাসাস ৬৫-৬৬)।
(২১): আধুনিক সমাজের অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি দিক হল, অনেক মুসলিমের চিন্তাজগত গড়ে ওঠে পাশ্চাত্যের বিকৃত চিন্তাভাবনা দ্বারা। ব্যাপারটা স্বচ্ছ সুপেয় ঝরনার পানি ত্যাগ করে, নালা-নর্দমার নোংরা জল পান করার মতো হয়ে যায় না? কুরআন ও সুন্নাহর চিন্তা বাদ দিয়ে পাশ্চাত্যের ভ্রান্ত চিন্তা গ্রহণ করাটাও এমনই।
(২২): শেষদিবসে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের চিন্তা মুমিনকে অনেক সুন্দর চিন্তা ও কর্ম উপহার দেয়। তাকে ভাবতে শেখায়, কিসে তার অপর মুসলিম ভাইয়ের দ্বীন ও দুনিয়ার উপকার হবে। তার সামনে থাকে আখেরাত। তাই অপর ভাইয়ের কল্যাণভাবনাও আখেরাতে লাভের চিন্তা থেকে আসে,
من نفَّسَ عن مؤمنٍ كُربةً من كُرَبِ الدنيا، نفَّسَ اللهُ عنه كُربةً من كُرَبِ يومِ القيامةِ . ومن يسّرَ على معسرٍ، يسّرَ اللهُ عليه في الدنيا والآخرةِ . ومن سترَ مسلمًا، ستره اللهُ في الدنيا والآخرةِ . واللهُ في عونِ العبدِ ما كان العبدُ في عونِ أخيه
যে ব্যক্তি দুনিয়াতে একজন মুমিনের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ আখেরাতে তার কষ্ট দূর করবেন। একজন নিঃসম্বল ব্যক্তিকে সম্বল যোগালে, আল্লাহও দুনিয়া-আখেরাতে তাকে সম্বল যোগাবেন। একজন মুসলিমের দোষত্রুটি গোপন রাখলে, আল্লাহ দুনিয়া-আখেরাতে তার দোষ ঢেকে রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে, আল্লাহও ততক্ষণ তাকে সাহায্য করতে থাকেন (আবু হুরায়রা রা.। মুসলিম ৭০২৮)।
(২৩): আমি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকে মনে রাখলে, আমি মুমিন ভাইদের প্রতি দয়ালু হব। তার দ্বীনের উন্নতির ফিকির করব। তার কুরআন শিক্ষা নিয়ে ভাবব। তার আমলি উন্নতি নিয়ে ভাবব। এমনকি জাগতিক শিক্ষা অর্জন করেও অপর মুমিন ভাইয়ের কাজে আসার প্রতি সচেষ্ট হব।
(২৪): শেষদিবসে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতচিন্তা, আমাকে মাযলুম ভাইদেরকে ভুলে থাকতে বাধা দেবে। আমাকে দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হতে প্রেরণা যোগাবে। আমি যত বেশি আল্লাহর সাক্ষাতচিন্তা নিজের মধ্যে জাগ্রত করব, ততবেশি আমার ভেতর থেকে দুনিয়া বের হয়ে যেতে থাকবে। মানুষের দৃষ্টিতে বিশাল কোনও দুনিয়াবি পদও আমার কাছে তুচ্ছ মনে হবে। আমাকে বেশি বেশি আল্লাহর পছন্দনীয় কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। মানুষের প্রশংসা-নিন্দা আমাকে খুব একটা প্ররোচিত বা বিচলিত করতে পারবে না।
(২৫): আমার চর্মচক্ষু আর মনশ্চক্ষু উভয়ের সামনে যখন শুধু আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের বিষয়টা থাকবে, তখন দুনিয়ার সবকিছুকেই তুচ্ছ বলে মনে হবে। সেদিন আমার অবস্থা কেমন হবে?
خَافِضَةٌ رَّافِعَةٌ
(কেয়ামত একদলকে) নিচু করবে, (আরেকদলকে) উুঁচ করবে (ওয়াকিয়া ৩)।
(২৬): যার সামনে আয়াতটা থাকবে, তার কাছে খ্যাতির মোহ, নেতৃত্বের মোহ ফিকে হয়ে যাবে। দুনিয়ার বাজার তার কাছে নগন্য হয়ে যাবে। তার দৃঢ় বিশ^াস জন্মাবে, চারপাশের চাকচিক্য, সবই ঠুনকো। পলকা। ভঙ্গুর। এসবের পেছনে আমার মহামূল্যবান সময় ব্যয় করা বৃথা। আমার বহুমূল্য হায়াত এসবের জন্যে ব্যয় করতে দেয়া হয়নি। মাস-বছর দূরের কথা, একটা মুহূর্তও এসবের পেছনে ব্যয় করা যৌক্তিক নয়।
(২৭): মানুষ কিভাবে যে আসমান যমীনের প্রতাপান্বিত শাসককে ভুলে, দুর্বল মাখলুকের পূজায় লিপ্ত হয়! এ এক রহস্য। আমার মধ্যে যখনই দুনিয়া হানা দেবে, আমাকে যখনই পাপ হাতছানি দিয়ে ডাকবে, আমি আয়াতাংশটুকু স্মরণে আনব,
آللَّهُ خَيْرٌ أَمَّا يُشْرِكُونَ
বল তো, আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, নাকি যাদেরকে তারা (আল্লাহর প্রভুত্বে) অংশীদার বানিয়েছে তারা? (নামল ৫৯)।
তাই তো, কে শ্রেষ্ঠ? আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ নাকি অন্য কেউ? কার পথ অনুসরণের জন্যে সেরা? আমার রবের নাকি অন্য কারও?