ইসলাম প্রচারের পথে নানা বাধা ও কুরাইশদের অত্যাচার

রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়া শুরু করতেই মক্কার কুরাইশরা ও প্রভাবশালী-মহল নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো। নবীজি যখন সাফা পাহাড়ে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং সেই দাওয়াতের সম্মোহন মানুষের মধ্যে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছিলো, সেই খবর মক্কায় চাউর হয়ে গেলো, তখনই কাফেররা তাদের অচল সমাজব্যবস্থার মুখে আসন্ন পদাঘাতের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো এবং সেই আশঙ্কা থেকে তারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের ছক আঁকতে শুরু করলো।

হজের সময় ছিলো আসন্ন। বৃহৎ হজ-কাফেলাকেই কাফেররা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করার উপায় হিসেবে বেছে নিলো। মক্কার অভ্যন্তরীণ সকল পথে তারা লোক নিয়োগ করে দিলো, যেন মক্কায় প্রবেশের আগেই কাফেলার লোকেরা মুহাম্মদের নামে নানা বিষবাক্য শুনে তাঁকে এড়িয়ে চলে এবং তাঁর কোনো কথায় যেন কান না দেয়। রটিয়ে দেওয়া হলো, শহরে এক পাগলের আবির্ভাব হয়েছে; কেউ বললো জাদুকর; কেউ বললো কবি; মোদ্দাকথা, সবার মনকে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার সব ব্যবস্থাই করা হলো।

রাসূলের মক্কি জীবনে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই, কাফেরদের এই বিরুদ্ধাচরণ কয়েকটি রূপে কদাকার ছিলো :

১. উপহাস, ঠাট্টা–তামাশা, ব্যঙ্গ–বিদ্রুপ, মিথ্যা প্রতিপন্নকরণ, অকারণ হাসাহাসি;
২. সত্যধর্মের বিরুদ্ধে জনমনে সংশয় ও সন্দেহের উসকানি এবং মিথ্যা ও ভ্রান্তি হিসেবে নবি মুহাম্মদের দাওয়াতকে কলঙ্কিতকরণ;
৩. অতীতকালের ঘটনাবলি ও উপাখ্যানসমূহ এবং কুরআন কারিমে বর্ণিত বিষয়াদির মধ্যে অর্থহীন বাগড়া বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে জনমনে ধাঁধার সৃষ্টি এবং মুক্ত চিন্তা–ভাবনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলতা;
৪. শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে অত্যাচার ও পীড়নের অমানবিক সকল উপায় ও কুটিল পন্থা অবলম্বন;
—কাফেরদের উৎপীড়ন ও নবদীক্ষিত মুসলিমদের বেদনার কথা, সাথে-সাথে কাফেরদের কর্মফল ও পরিণাম এবং মুসলিমদের জন্য আনন্দ-সংবাদ ও পুরস্কারের কথা কোরানেও নানা আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে; সেখানেও ফুটে উঠেছে রাসূলের বাধাগ্রস্ত আপদসঙ্কুল মক্কি জীবনের কথা।

মক্কার কাফেরদের অত্যাচার আর পীড়নের শিকার ছিলো ইসলাম ও মুহাম্মদ (সাঃ); তাই এই পীড়নের পথে কোনো অর্থনৈতিক সামাজিক বা বংশীয় পরিচয় প্রতিরোধ নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি, বরং ইসলাম ও মুহাম্মদের (সাঃ) সাথে যোগসাজশসদৃশ সকল বিষয়ই হয়ে উঠেছিলো মক্কার কাফেরদের সীমাহীন ষড়যন্ত্র ও কুটিলতার লক্ষ্যবস্তু। তারা দাস বেলালের উপর যেভাবে অমানুষিক জিঘাংসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তেমন ধনাঢ্য উসমানকেও দলিত করেছে অত্যাচারের পাশব খোঁচায়; ইয়াসির-পরিবার, জিন্নিরা, খাব্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখের সাথে সাথে আবু বকর, মুসআব বিন উমায়ের, তালহা এবং যোবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখও ছিলেন নানা অমানবিকতার শিকার। ইসলামকে তাঁরা প্রিয় করে তুলেছিলেন বলে পুরো পৃথিবীই যেন তাঁদের উপর হামলে পড়েছিলো; কিন্তু এ যে সাময়িকের, এ যে ক্ষণকালের, এ যে নিয়ে আসবে সুখময় অনন্য এক মহাকাল, তার টের তাঁরা অন্তর্জগতে পাচ্ছিলেন—তাই এইসব অত্যাচার, এইসব অমানবিকতা এবং এই মানবেতর কাল তাঁরা বরণ করে নিচ্ছিলেন সত্য আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে। এক মহাপৃথিবীর আসন্ন বিজয়-পদপাতের রণন শোনা যাচ্ছিলো…