মুহাম্মদকে (সাঃ) নতুন আদর্শের প্রচার থেকে কোনোভাবেই ফেরানো যাচ্ছিলো না। তিনি তাঁর কাজে ও প্রচারে প্রতিনিয়ত আরও ব্যাপৃত হচ্ছিলেন। মক্কার কাফেররা আর কোনোভাবেই মুহাম্মদকে (সাঃ) সহ্য করতে পারছিলো না। কুরাইশ-গোত্রের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি একত্র হয়ে আবু তালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে আবু তালিব, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের দেব-দেবীকে গালিগালাজ করছে, আমাদের ধর্মের নিন্দা করছে, আমাদেরকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেকহীন মূর্খ বলছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণকে ধর্মভ্রষ্ট বলছে; অতএব, হয় আপনি তাকে এ জাতীয় কাজকর্ম থেকে বিরত রাখুন, নতুবা আমাদের এবং তার মধ্য থেকে আপনি দূরে সরে যান। কারণ, আপনিও আমাদের মতোই তার বক্তব্য মতে ভিন্নধর্মের অনুসারী। তার ব্যাপারে আমরাই আপনার জন্য যথেষ্ট হবো।’
জবাবে আবু তালিব অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাজে পাঁচরকম কথাবার্তা বলে তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিদায় করলেন। এ প্রেক্ষিতে তারা ফিরে চলে গেলো। এদিকে রাসূলুল্লাহ পূর্ণোদ্যমে তার প্রচারকাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। দ্বীনের দাওয়াত প্রচার করতে থাকলেন এবং সেদিকে লোকেদেরকে আহ্বান জানাতে থাকলেন।
এদিকে কুরাইশরাও বেশি দেরি করলো না, যখন দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাজ ও আল্লাহর পথে দাওয়াত পূর্ণামাত্রায় চালিয়ে যাচ্ছেনই, বরং তিনি তাঁর দাওয়াতি তৎপরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিরুপায় তারা পূর্বের চেয়ে আরো ক্রোধ ও গরম মেজাজ নিয়ে আবু তালিবের নিকট পুনরায় আগমন করলেন।
কুরাইশ-প্রধানগণ আবু তালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে আবু তালিব, আপনি আমাদের মাঝে মান-মর্যাদার অধিকারী একজন বয়স্ক ব্যক্তি। আমরা ইতোপূর্বে আপনার নিকট আবেদন করেছিলাম যে, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে আমাদের ধর্ম সম্পর্কে নিন্দাবাদ করা থেকে বিরত রাখুন, কিন্তু আপনি তা করেননি। আপনি মনে রাখবেন, আমরা এটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছি না যে, আমাদের পিতা পিতামহ এবং পূর্বপুরুষদের গালি-গালাজ করা হোক, আমাদের বিবেককে নির্বুদ্ধিতা বলে আখ্যায়িত করা হোক এবং আমাদের দেব-দেবীর নিন্দা করা হোক। আমরা আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি, হয় আপনি তাকে এসব থেকে নিবৃত্ত রাখুন, নচেৎ আমাদের দুই দলের মধ্যে এক দল ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতেই থাকবে।’
আবু তালিব বিচলিত বোধ করলেন। মুহাম্মদের (সাঃ) ব্যাপারে আতঙ্কগ্রস্ত হলেন। মুহাম্মদকে (সাঃ) ডেকে সব বললেন। দ্বিধা ও অনিচ্ছাভরা ব্যথা নিয়ে বললেন, ‘বাবা, একটু বিচার-বিবেচনা করে কাজ করো। যে ভার বহন করার শক্তি আমার নেই, সে ভার আমার উপর চাপিয়ে দিয়ো না।’ রাসূলুল্লাহ অসহায় ও বিপন্ন বোধ করলেন। ধারণা করলেন, বুঝিবা চাচাও তাঁর আর সঙ্গ দিতে পারবেন না; তবু অবিচল ভাষায় ব্যথামথিত কণ্ঠে বললেন, ‘চাচাজান, আল্লাহর শপথ, যদি এরা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে দেয় তবুও শাশ্বত এ মহাসত্য প্রচারসংক্রান্ত আমার কর্তব্য থেকে এক মুহুর্তের জন্যও আমি বিচ্যুত হব না। এ মহামহিম কার্যে হয় আল্লাহ আমাকে জয়যুক্ত করবেন, না হয় আমি ধ্বংস হয়ে যাবো। কিন্তু চাচাজান, আপনি অবশ্যই জানবেন যে, মুহাম্মাদ কখনোই এ কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবে না।’
স্বজাতীয় এবং স্বগোত্রীয় লোকজনদের নির্বুদ্ধিতা, হঠকারিতা এবং পাপাচারে ব্যথিত-হৃদয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নয়নযুগল বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। তিনি সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন যে, ভবিষ্যতের দিনগুলো তাঁর জন্য আরও কঠিন হবে এবং আরও ভয়াবহতা এবং কঠোরতার সঙ্গে মোকাবেলা করে চলতে হবে। তাঁর নয়নযুগলে অশ্রু কিন্তু অন্তর অদম্য সাহস ও অর্ণবসম প্রত্যয়ে ভরে উঠলো—এমন এক মানসিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তিনি চাচা আবু তালিবের সম্মুখ থেকে বেরিয়ে এলেন।
তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের এ অসহায়ত্ব ও মানসিক অশান্তিতে আবু তালিবের প্রাণ কেঁদে উঠলো। পরক্ষণেই তিনি তাঁকে পুনরায় ডেকে পাঠালেন। যখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন, তখন তিনি তাকে সম্বোধন করে বললেন : ‘প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্র, নির্দ্বিধায় নিজ কর্তব্য পালন করে যাও। আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি কোনো অবস্থাতেই তোমাকে পরিত্যাগ করবো না।’