সূরা বাকারা আয়াত ২১-২২ এ আল্লাহ বলেনঃ
“হে মানুষ, তোমরা মহান আল্লাহ’র দাসত্ব স্বীকার করো, যিনি তোমাদের এবংতোমাদের আগে যারা ছিলো তাদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ধর্মভীরু হও। যিনিতোমাদের জন্য যমীনকে শয্যা আর আসমানকে ছাদ স্বরূপ সৃষ্টি করেছেন…।”
আপনি এই আয়াতগুলো থেকে যে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন তা হল, যদি আপনার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে তবে দ্রুত তা শক্তিশালী করার উপায় হল দুটো জিনিসের দিকে মনোনিবেশ করাঃ আপনি এবং আপনার চারপাশ। বেশি নয়, প্রতিদিন কেবল ১৫ মিনিট মনোযোগ দিয়ে নিজের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবুন। আপনি দেখবেন আপনার দিনের বাকিটা আল্লাহর কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে করতে কেটে যাবে।
অতিক্ষুদ্র একটি শুক্রাণু আর একটি ডিম্বাণুর সম্মিলনে আমার আপনার এত বড় দেহ গঠিত হয়েছে। সেই ক্ষুদ্র বস্তু থেকে আমাদের হাড়, শিরা-উপশিরা, রক্ত-কণিকা, মাংস, ত্বক, ইত্যাদি অস্তিত্ব লাভ করেছে। দেহের ভিতরের অথবা বাইরের প্রত্যেকটি অঙ্গের স্ব-স্ব কাজ সম্পাদনের জন্যে প্রত্যেকের আলাদা আকৃতি, মাপ আর অবস্থান রয়েছে।
যেমন আপনার দেহের কংকালের কথাই ভাবুন। এটি শক্ত হাড় দিয়ে গঠিত যার উৎপত্তিস্থল ছিল সেই জমাট বাধা শুক্রাণু। আর দেখুন কীভাবে এটি এখন আপনার দেহের ভারবহন করে আছে। এর প্রত্যেকটি হাড়ের গঠন ও কাজ আলাদা। এদের কোনটি বড়, কোনটি ছোট, কোনটি লম্বা, কোনটি আবার ক্ষুদ্র, কোনটি গোল, কিছু আছে ফাঁপা, কিছু চওড়া, কতগুলি সরু, কোনটি ঘন আবার অনেকগুলো আছে হালকা। চিন্তা করুন যদি আপনার কংকাল কেবল একটি একক হাড়ের দ্বারা গঠিত হত তবে, আপনি নড়াচড়া করতে পারতে না। তার বদলে কয়েকশ হাড়ের সুসংগঠিত সমষ্টি দিয়ে আল্লাহ আপনার এই কংকাল বানিয়েছেন। এর প্রত্যেকটি হাড় একটি সূক্ষ্ণ জয়েন্টের মাধ্যমে একটি আরেকটির সাথে লেগে আছে। আর আপনার চলাফেরায় প্রতিটি হাড় নিজ নিজ ভূমিকা পালন করছে।
আপনি আপনার দেহের শত শত পেশীগুলোর কথাই একবার ভাবুন, যার প্রত্যেকটিতে আছে মাংস, শিরা-উপশিরা আর পেশীবন্ধ। এদের প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থিত, আর নির্দিষ্ট আছে এদের কাজ। দুই ডজন এরও বেশি পেশী কেবল চোখের পাতা খোলা আর বন্ধের কাজে নিয়োজিত আছে। যদি এর থেকে একটিও পেশী কম থাকত তবে আমরা আর কখনও আমাদের চোখের পাতা খুলতে পারতাম না। তেমনি দেহের প্রত্যেকটি পেশী কোন না কোনও অঙ্গের ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কোন একটি পেশীর অনুপস্থিতি হয়ত সেই অঙ্গটাকেই অকেজো করে ফেলত। চোখের পাতা নিজেই তো একটি বিস্ময়, কি নিঁখুতভাবে এটিকে বসানো হয়েছে আর তা আমাদের চোখকে ময়লা আর অতিরিক্ত আলো থেকে রক্ষা করছে।
চোখের কথাই ভেবে দেখুন – রেটিনা, ফোভিয়া-সেন্ট্রালিস, অপটিক নার্ভ, স্ক্লেরা, ভিট্রিয়াস হিউমার, লেন্স, আইরিস এবং কর্নিয়া নিয়ে আমদের একটি চোখ গঠিত। এসব কিছু একসাথে কাজ করছে বিধায় আপনি এই লেখাগুলো পড়তে পারছেন, আকাশ দেখছেন, তারা উপভোগ করছেন, মেঘ, রঙ, গাছপালা, প্রাণীজগৎ আরও কত কী সুন্দরভাবে দেখতে পারছেন। আর এই সবকিছুই হচ্ছে আমাদের চিন্তা আর চেষ্টার সীমার বাইরে।
আপনার কানের কথাও ভেবে দেখুন। কীভাবে এটিকে সুচারুভাবে নকশা করা হয়েছে যাতে যে কোন আওয়াজ এসে আপনার কানের ছিদ্রে প্রবেশ করে আপনার কানের পর্দা পর্যন্ত পৌঁছে যায় আর আপনি তা স্পষ্ট শুনতে পান।
জিহ্বার প্রতি খেয়াল করুন, একটি পেশী যা আপনার চিন্তা ও অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করতে সাহায্য করে। দেখুন কী সামঞ্জস্যপূর্নভাবে আপনার দাঁতগুলো একটি আরেকটির পাশে বসে আপনার মুখের সৌন্দর্যবর্ধন করছে। এই দাঁতগুলোর কোনটি কামড় দেয়, কোনটি চিবোয়, কোনটি আবার গুড়ো করে। প্রত্যেকটি দাঁতেরও ভিন্ন ভিন্ন কাজ এবং উদ্দেশ্য ভাগ করে দেয়া আছে। আপনার ঠোট আপনার মুখকে আটকে রাখে, একে রঙ দান করে আর আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী প্রত্যেকটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণে সহায়তা করে। আল্লাহ আপনার স্বরযন্ত্রকে এমন ভাবে বানিয়েছেন যে আপনার কন্ঠ নিঃসৃত প্রত্যেকটি শব্দ সেই ধ্বনি বহন করে যা দুনিয়াতে অনন্য, আর কারও সাথেই তা মিলে না। শ্রোতা শুনামাত্রই বুঝতে পারে সে কার কথা শুনছে। এসবের মাঝে আছে এক জটিল আর বিস্তারিত প্রক্রিয়া, পদ্ধতি আর বিস্ময় যা এখানে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না।
আপনার হাতের দিকে মনোনিবেশ করুন আর ভাবুন কীভাবে এটি কাজ করে। আপনার হাতের তালু, পাঁচটি আঙ্গুল যাদের চারটি একদিকে আর একটি অন্য দিকে। বৃদ্ধাঙ্গুলি অন্য দিকে হওয়াতে এটি অন্য সব আঙ্গুল স্পর্শ করতে পারে। অন্য আর কোন উপায় নেই যেভাবে হাত বানালে তা তার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারত। কল্পনা করুন যদি পাঁচটি আঙ্গুল একই পাশে পাশাপাশি থাকত ! তবে আপনার পক্ষে একটি বাক্যও লেখা সম্ভবপর হতো না।
তারপর আপনার নখের মত তুচ্ছ একটি জিনিসের দিকে নজর দিন। এটি আপনার আঙ্গুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে, আপনাকে অনেক কিছু ধরতে সহায়তা করছে যা আপনি অন্যভাবে ধরতে পারতেন না। এত সামান্য একটি জিনিস নখ যা হয়ত আপনার মনোযোগ আকৃষ্ট করে না, অথচ এটি না থাকলে হয়ত আপনি অসহায় হয়ে পড়তেন।
এসব অত্যাশ্চর্য বস্তুর সমন্বয়ে আপনার দেহ গঠিত হয়েছে, যার মূলে ছিল কেবল একবিন্দু আণুবীক্ষণিক জমাট বাধা তরল কণা। এসব মিলেই আপনি – শত কোটি ছায়াপথের মধ্যে কোন একটির মাঝে অবস্থিত নগণ্য এক তারকার চারপাশে পরিভ্রমণরত একটি গ্রহের অগণিত সৃষ্টিকুলের মাঝে কোটি কোটি সদস্যের মানব সম্প্রদায়ের একজন সদস্য মাত্র। আর বিস্ময়কর এই তারকাদের অলৌকিকত্বের সারাংশ তুলে ধরাও একটি বিশাল কঠিন কাজ। এসব কিছু উদ্দেশ্যবিহীন, দৈবক্রমে সংঘটিত কোন প্রাকৃতিক ঘটনা হতে পারে না।
এগুল সব কিছু সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ’র প্রয়াসহীন সৃষ্টি। সূরা বাকারার এই দুইটি আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে দুইটি ব্যাপারে চিন্তা করতে বলেছেনঃ
নিজেদেরকে, নিজেদের চারপাশকে, যাতে করে আল্লাহ’র ইবাদাতে আমাদের মন নিবিষ্ট হয় –
“হে মানুষ, তোমরা মহান আল্লাহ’র দাসত্ব স্বীকার করো, যিনি তোমাদের এবংতোমাদের আগে যারা ছিলো তাদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ধর্মভীরু হও। যিনিতোমাদের জন্য যমীনকে শয্যা আর আসমানকে ছাদ স্বরূপ সৃষ্টি করেছেন…।”
সুতরাং যখন নিজের মধ্যে ঈমান – আমলে দুর্বলতা অনুভূত হবে, ইবাদাতে শক্তি ও মিষ্টতা পাবেন না তখন নিজের দেহের কথা ভাবুন অথবা কোন এ্যানাটমি বই খুলে দেখুন অথবা গুগলে হাবল টেলিস্কোপে ধারণ করা মহাকশের ছবি সার্চ করে দেখে ভাবুন আর তারপর চোখ বন্ধ করে আল্লাহ’র বড়ত্ব নিয়ে চিন্তা করুন।
তারিক মেহান্না,
প্লিমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,
আইসলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮।
তারিখঃ
মঙ্গলবার ১৬ ই রবি-উল-আউয়াল ১৪৩১,
২রা মার্চ, ২০১০।