কুরআন এবং আপনি – তারিক মেহান্না (পর্ব ১৮)

সূরা আলে ইমরানের ১৫৩ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,

…তাই আল্লাহ তোমাদের উপর দুঃখের পর দুঃখ দিলেন, যেন তোমাদের কাছ থেকে যা হারিয়ে গেছে এবং যা কিছু বিপদ তোমাদের উপর আপতিত হয়েছে, তার (কোনোটার) জন্য তোমরা অনুশোচনা না কর…

 

এই আয়াতটি উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে নাযিল হলেও এর নিহিতার্থ আমাদের বর্তমান জীবনে খুবই পরিস্কারভাবে প্রয়োগযোগ্য। মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে যত পায় ততই চায়। আর তার চাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তার দুশ্চিন্তা। কারণ আরও বেশি না পাওয়ার ব্যর্থতা তাকে বিমর্ষ করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন,

 

মানুষকে এক পাহাড় স্বর্ণ দেওয়া হলে সে অনুরুপ আরেকটি পাহাড় চাইবে। আর তাই কবরের মাটি ছাড়া কোনো কিছুই তাকে তুষ্ট করতে পারবে না।

 

তাই আল্লাহ বিভিন্ন সময়ে আমাদেরকে খাদ্য, অর্থ, স্বাধীনতা, পরিবার কিংবা সুস্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন নি’আমাত থেকে কিছু সময়ের জন্য বঞ্চিত করেন। এই পৃথিবী এবং তার আরাম-আয়েশের প্রতি আমাদের চির-অতৃপ্ত বাসনাকে নষ্ট করে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। আমরা কোনো কিছুকে যখন যেভাবে চাই সেভাবে পাওয়ার পরিবর্তে যখন কোনো বিপদ-আপদের সম্মুখীন হতে বাধ্য হই, তখন সেই অভিজ্ঞতাটি আমাদের ভবিষ্যতে যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে প্রস্তুত করে তোলে। এই আয়াতটিতে ঠিক একথাটিই বলা হয়েছে। আগেও এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে আমরা যা চাই সেটা না পাওয়ায় কিংবা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চাই না তার সম্মুখীন হতে বাধ্য হলে আমরা আর মুষড়ে পড়ব না। কারণ আরাম-আয়েশ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি আমাদের নির্ভরতার শেকড় কেটে দেওয়া হয়েছে।

 

এই আয়াতটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে বিষণ্ণতাকে নিরুৎসাহিত করা। অপ্রাপ্ত সাফল্য কিংবা আপতিত অকল্যাণ নিয়ে দুঃখ করে কোনো লাভ নেই। এতে কোনো উপকার হওয়া তো দূরের কথা, বাস্তবতার বিন্দুমাত্র পরিবর্তনও হয় না। বরং ইবন আল কায়্যিমের (রহিমাহুল্লাহ) ভাষায়, বিষণ্ণতা মানুষের সংকল্পকে দুর্বল করে দেয় ও হৃদয়কে ভঙ্গুর করে তোলে। যা তার উপকারে আসবে এমন কাজ করা থেকে বিরত রাখে এবং বাস্তবতাকে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। তাই যখন আপনি বিষণ্ণ অনুভব করবেন তৎক্ষণাৎ সেই অনুভূতিকে মন থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন। আল্লাহর প্রশংসা, ধৈর্য এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্টি, তাঁর প্রতি দৃঢ়তর ঈমান এবং ‘ক্বদ্দরাল্লাহ ওয়া মাশা-আ ফা’আল ‘ (আল্লাহ তাঁর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং তিনি তাঁর ইচ্ছানুযায়ীই সিদ্ধান্ত দেন) এই বাক্যাংশটি উচ্চারণের দ্বারা সেই অনুভূতিকে প্রতিস্থাপন করুন। এটাই হচ্ছে তাওহীদের চশমা দিয়ে যেকোনো বিপর্যয়কে দেখার ফলাফল।

 

তৃতীয়ত, এই পৃথিবী তো বিপদ-আপদমুক্ত হওয়ার কথা ছিল না। শুধু জান্নাতই হবে সবরকম সঙ্কটমুক্ত। উদাহরণস্বরুপ, রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এই পৃথিবীতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কী। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আ’ইশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা)। অথচ পার্থিব জগতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সত্তাটির প্রতি তাঁর ভালোবাসাও কিন্তু ত্রুটিহীন ছিল না। কারণ আ’ইশার (রাদিয়াল্লাহু আনহা) উপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার ঘটনাটি কিছুটা হলেও আ’ইশাহর (রা) প্রতি রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভালোবাসাকে দ্বিধান্বিত করেছিল। এই ঘটনার মাঝেও একটি নিগুঢ় বার্তা রয়েছে। আর তা হল এই সকল সঙ্কটের উদ্দেশ্যই দুনিয়া থেকে আমাদের অন্তরকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এবং অন্তরকে আখিরাতের দিকে যাত্রার অভিমুখী করে তোলা।

 

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট – সেল #১০৮