কুরআন এবং আপনি – তারিক মেহান্না (পর্ব ২৫)

আল্লাহ তা’আলা কুরআনের সূরা আলে ইমরান এর ১৯৬-১৯৭ আয়াতে বলেন,

“ নগরীতে কাফেরদের চাল-চলন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয়। এটা হলো সামান্য (কয়েকদিনের) সামগ্রীমাত্র-এরপর তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর সেটি হলো অতি নিকৃষ্ট অবস্থান।”

 

পত্রিকায় আন্তর্জাতিক খবরের পাতা উল্টিয়ে শত্রুর হাতে আক্রান্ত মুসলিম দেশগুলোর খবর পড়ার সময় এই দুটো আয়াত আমার খুব মনে পড়ে। আমাদের বর্তমান বাস্তবতার নিরীখে এই দুটি আয়াত যেন আমাদের মনে প্রশান্তি ও ভরসা যোগাতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। আপনি খবরের কাগজ একবার উল্টিয়ে দেখুন। সপ্তাহের প্রতিটি দিনেই পাকিস্তানে সিআইএ এর ড্রোন হামলার খবর, ফিলিস্তিনে নতুন কোনো বসতি স্থাপনের খবর, আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন দখলদারিত্ব সম্প্রসারণ এবং এধরনের আরো অনেক খবর খুঁজে পাবেন। আপনার মনে হয়তো সামান্য হলেও হতাশা জেঁকে বসে। আপনি হয়তো ভাবেন, ‘এসবের শেষ কবে? যালিমদের পাশার দান কখন উল্টে যাবে?” এই দুটি আয়াত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে, তা আমাদেরকে বর্তমান প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে। আপনার মনে হতেই পারে আল্লাহ বুঝি এই দুটি আয়াত বিশেষভাবে আমাদের জন্য নাযিল করেছেন!

 

প্রথমত, আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন, তিনি তার শত্রুদেরকে দুনিয়ার বুকে রাজত্ব দেবেন এবং তাতে মু’মিনরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর মানে হল যখন আপনার জীবনে দুঃসময় আসে, সেটি কোনো আকস্মিক “হ য ব র ল” অবস্থা নয়। বরং আল্লাহ এর দ্বারা আপনাকে শাণিত করে তুলতে চান। তিনি আপনাকে আরো বলিষ্ঠভাবে গড়ে তুলতে চান। এই কারণে তিনি আপনাকে ক্ষণিকের এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে চালনা করেন। তেমনি, মুসলিমদের উপর কাফিরদের আধিপত্য আমাদের সকলের অপছন্দ হলেও এটি মূলত মুসলিম উম্মাহকে প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী করে তোলার একটি পন্থা। এতে বিজয় লাভের আগে মুসলিমরা কঠিন সময় ও দুর্যোগ পাড়ি দিতে শেখে। ফলে অর্জিত বিজয়কে তারা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, আল্লাহ্ আমাদের আদেশ করছেন যাতে এই কুফফার সভ্যতার চাকচিক্য দেখে আমরা ধোঁকায় না পড়ি। আর এই ধোঁকা থেকে বাঁচতে যে বিষয়টি সবসময়ের জন্য মাথায় গেঁথে রাখতে হবে তা হল, কুফফারদের এই রাজত্ব সাময়িক, আর তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য জাহান্নাম, যা চিরস্থায়ী। রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ দুনিয়ার বুকের সবচেয়ে ধনী আর বিলাসী ব্যক্তিটিকে জাহান্নামে একবার ডুব দিয়ে তুলে এনে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘তুমি কি তোমার জীবনে কখনো কোনোকিছু উপভোগ করেছিলে?’ সেই ব্যক্তি উত্তর দেবে, ‘না’। কারণ জাহান্নামের সেই এক মুহূর্তের অভিজ্ঞতাই এতটা ভয়াবহ যে, নিমিষে সে তার দুনিয়ার জীবনের সমস্ত আরাম আয়েশের কথা ভুলে যাবে।

তেমনি কোনো জালেম ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতি যখন তাদের আধিপত্য আর প্রভাব-প্রতিপত্তির ঝলকানি দ্বারা বিশ্বের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় এবং একই সাথে কুফর ও জুলুম-নির্যাতনের ধারা অব্যাহত রাখে, তাদের পরিণতিও ঠিক একই রকম হবে। এই চিরন্তন পরিণতির সাক্ষী ইতিহাস। দুনিয়াবী কোনো উৎকর্ষই এই পতন ঠেকাতে পারবে না। তাদের দুনিয়াবী পতন ছাড়াও এই আয়াতের আরো একটি উপকারী দিক হল, জাহান্নামের গন্তব্যের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ এই সাময়িক দুনিয়াবি জীবনের তুলনায় আখিরাতের জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব এবং দীর্ঘস্থায়ীতা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন।

সবশেষে, আরো একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় আছে, যার কথা এই আয়াতে সরাসরি উল্লেখিত না হলেও আল-বুখারীর একটি হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত। সেই হাদিসটিতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘এটি আল্লাহর দায়িত্ব তিনি যদি কিছুকে উঁচুতে তুলে ধরেন তবে তিনি সেটিকে অবশ্যই নামিয়েও দেন’। অন্য কথায়, যার উত্থান আছে, তার পতনও আছে। আমরা এক্ষেত্রে কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটা চমৎকার বই পড়ে দেখতে পারি। বইটির নাম, ‘Why the West Rules – For Now: The Patterns of History and What They Reveal About the Future’। এই বইয়ে লেখক ইয়ান মরিস দুটো মৌলিক যুক্তির উপস্থাপনা করেছেন, প্রথমত, ইতিহাস জুড়ে যত সভ্যতা, তাদের উত্থান ও পতনের পেছনে যে কারণ সেগুলো কেউ কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, ২০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে আধিপত্য বিস্তারকারী পশ্চিমা সভ্যতার পতনও খুব দ্রুতই সংঘটিত হবে।

 

 

বইটিতে লেখক সেই ১২০০০ বছর আগের বরফ যুগের পর থেকে বর্ণনা শুরু করেছেন। তখন কৃষির ধারণা জন্ম লাভ করে আর বৃহৎ পরিসরে সুসংগঠিত সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি বর্ণনা করেন, কীভাবে প্রয়োজনীয় গাছপালা ও গৃহ্পালিত প্রাণীর প্রাচুর্যের কারণে দুটি আদি ভৌগলিক আবাস থেকে একের পর এক সভ্যতার জন্ম ও চতুর্মুখী সম্প্রসারণ হয়, এ দুটি এলাকা হল পশ্চিম ইউরেশিয়া এবং ইয়াংজি ও ইয়েলো নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল যা বর্তমানে চীন নামে পরিচিত। মরিস উল্লেখ করেন, শুরুতে পশ্চিমারা প্রযুক্তিগত উন্নয়নে প্রাচ্যের তুলনায় প্রায় ২০০০ বছর এগিয়ে থাকলেও খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ এ এসে এই অগ্রযাত্রা স্তিমিত হয় এবং তারা সমানে-সমান হয় ওঠে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রাচ্য নেতৃত্বের আসনে অবতীর্ণ হয়। কারণ, এই রোমান সাম্রাজ্যই তৎকালীন সময়ে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করত এবং তারাই ছিল সেই পশ্চিমা সভ্যতার সামাজিক উন্নয়নের চূড়া। এই অবস্থা ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বিরাজমান থাকে। এই সময়েই ইউরোপ অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে। অপরদিকে সুই রাজবংশের নেতৃত্বে চীন ঐক্যবদ্ধ হয় এবং পরবর্তী ১০০০ বছর পর্যন্ত তারা কর্তৃত্বের ছড়ি ধরে রাখে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রাচ্যের এই অগ্রগামিতা টিকে থাকে। কিন্তু সেই সময়ে এসে আবার পশ্চিমারা প্রাচ্যের সমকক্ষ রুপে আবির্ভূত হয়। এর কারণ হল ক্রমাগত যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিমারা তাদের সামরিক প্রযুক্তিক্ষেত্রে ব্যাপক পারদর্শীতা লাভ করে। ১৮ শতকের শেষে, শিল্প বিপ্লবের প্রারম্ভিক পর্যায়ে দুটি সভ্যতার শক্তিমত্তার ভারসাম্যে পরিবর্তন আসে এবং তা পশ্চিমাদের দিকে হেলে যায়। ব্রিটিশ প্রকৌশলবিদগণ তাদের দেশে অবস্থিত বিপুল কয়লাখনির সুবাদে বাষ্পচালিত জাহাজ, ট্রেন এবং শিল্পকারখানায় প্রভূত উন্নতি সাধনে করে। এর মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জনে সক্ষম হয়। ব্রিটিশদের এই আধিপত্য পরবর্তী ১০০ বছর (বিংশ শতাব্দীর পূর্ব অবধি) টিকে থাকে। এই ব্রিটিশ আধিপত্যই আধুনিক যুগের আমেরিকান আধিপত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

মূল যে বিষয়টির উপর বইটি দৃষ্টিপাত করেছে তা হল, দশ হাজারেরও বেশি সময় ধরে, কী করে একের পর এক সভ্যতার জন্মই হয়েছে যেন ধ্বংস হবার জন্য! তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের কিছু কারণে তাদের পতন ছিল অনিবার্য। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের রাজত্বকালই ছিল মানবজাতির সামগ্রিক ইতিহাসের মাঝে একটি ছোট্ট পাতা মাত্র। সাময়িক ও সংক্ষিপ্ত।

লেখক এরপর উপসংহার টানতে বই এর নামের সাথে জুড়ে দেওয়া – ‘পশ্চিমারা এখন শাসন করছে, কিন্তু কতদিনের জন্যে?’ এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তার উত্তর ছিল এমন, যদি প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের উন্নতির ধারা এখন যেমনটা-আছে-তেমনটাই-থাকে, তবে আগামী শতাব্দীর শুরুতেই কবর রচিত হবে পশ্চিমা প্রতিপত্তির। আল্লাহু ‘আলাম।

 

তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশান ইউনিট – সেল নাম্বার ১০৮