১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে, ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসনের প্রায় একশো বছর পর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম প্রদেশ নিয়ে ইংরেজরা বিশাল আয়তনে বাংলা প্রেসিডেন্সি গড়ে তোলে। কিন্তু এত বড় এলাকার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা বেশ দুরুহ হয়ে ওঠে তাদের জন্য। কলকাতার আশপাশ বা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বাংলা প্রেসিডেন্সির বাকি সব অঞ্চল জীবন-মান, শিক্ষা-দীক্ষা, রাষ্ট্রীয় সেবা—সবদিক থেকে হয় বঞ্চনার শিকার। পাশাপাশি ইংরেজরাও এত বড় অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছিল।
এসব দিক বিবেচনায় ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে আসামকে আলাদা করা হয়। আসামের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হয় বাংলাভাষী তিনটি জেলাও; সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া। কিন্তু আসামকে পৃথক করার পরও বাংলা প্রদেশের আয়তন খুব একটা কমেনি। ইংরেজদের শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে তখনও সমস্যা হচ্ছিল। ফলে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা প্রদেশের সীমানা পুনর্নিধারণ বিষয়ে আবারও ভাবতে শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। এ সিদ্ধান্তের খবর প্রকাশিত হলে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অভিজাত হিন্দুরা তুমুল প্রতিবাদ করে। সেই সঙ্গে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরাও প্রথমদিকে নিজেদের উন্নতির বিষয়টা বুঝতে না পেরে প্রতিবাদ করেন।
অবশেষে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে এসব প্রতিবাদ-সমালোচনার মুখে বাংলাকে ভাগ করে ব্রিটিশ সরকার। আসাম, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, ত্রিপুরা ও মালদহ নিয়ে গঠিত হয় ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ’। এ প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা। আর পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হয় ‘বাংলা প্রদেশ’, যার রাজধানী কলকাতাই থাকে।
বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ব বাংলার উন্নয়নের প্রশ্ন
বাংলাকে ভাগ করার মূল কারণ যদিও ছিল এ অঞ্চলে ব্রিটিশদের শাসনকার্য ও নিয়ন্ত্রণ আরও ঘনিষ্ট ও পাকাপোক্ত করে তোলা, কিন্তু ভাগের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক ও জীবনমানের উন্নতিও সাধিত হবার সম্ভাবনা ছিল। কারণ, রাজধানী শহর কলকাতা পশ্চিমবঙ্গে হবার কারণে পূর্ব বাংলার মানুষ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে।
কেবলই যে ব্রিটিশ শাসনামলে তারা বঞ্চিত হচ্ছিল, এমন নয়, সেই মোগল আমলে মুর্শিদ কুলি খান যখন ঢাকা থেকে বাংলার রাজধানী সরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান, সেই সময় থেকে অবহেলিত হয়ে আসছিল পূর্ব বাংলার মানুষ। পরে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ও ব্রিটিশদের ক্ষমতাগ্রহণ, উপনিবেশচর্চা শুরু হলে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী স্থানান্তর হয় কলকাতায়। দীর্ঘ এই দুই শতাব্দী জুড়ে পশ্চিমবঙ্গে বাংলার রাজধানী থাকার দরুণ দুই বাংলার মাঝে চূড়ান্ত পর্যায়ের অসম অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হয়।
পূর্ব বাংলার মানুষ কেবল খেটেই যেত, বিনিময়ে পেত না কিছুই। উন্নতি, অগ্রগতি যা হতো, তা কেবল কলকাতার আশপাশ ও পশ্চিমবঙ্গতেই। পূর্ব বাংলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা, ডাক ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাদির চরম অবনতি ঘটতে থাকে। চুরি, ডাকাতি, বেআইনি কার্যকলাপ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
একই সাথে অর্থনৈতিক বৈষম্যও মাত্রাতিরিক্ত হয়ে দাঁড়ায়। কলকাতা কেবল বাংলার রাজধানীই ছিল না, পুরো ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্রও ছিল। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবরকমের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতাতেই হতো। এসব কারণে ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ ও অভিজাত শ্রেণির লোকজনের বসবাস ছিল সেখানেই। আর পূর্ব বাংলা ছিল নিম্নবিত্ত দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের আবাসভূমি। পূর্ব বাংলার তামাম জমিদার গোষ্ঠীর আবাসও ছিল কলকাতায়। তারা নিজেদের কর্মচারীদের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় যার যার জমিদারি থেকে প্রাপ্ত খাজনায় কলকাতায় আয়েশি জিন্দেগি যাপন করত।
বঙ্গভঙ্গের পর নতুন প্রদেশের রাজধানী যখন ঢাকায় স্থাপিত হলো, পূর্ব বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যেন এক নতুন মাত্রা যোগ হলো। যোগাযোগব্যবস্থায়ও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে লাগল। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এতকাল যাবত অবহেলিত ছিল, সমুদ্র বন্দরেও শুরু হলো নতুন কর্মচঞ্চলতা।
পূর্ববাংলার মানুষ ছিল কৃষিপ্রধান। কৃষিকাজই ছিল তাদের প্রধান পেশা। কিন্তু উৎপন্ন ফসলের যথাযথ মূল্য তারা পেত না। আয়ের বড় একটা অংশই নিয়ে যেত পশ্চিমের জমিদারশ্রেণি। বঙ্গভঙ্গের ফলে সেই অবস্থা পাল্টে যায়। ১৯০৬-০৭ সালে পূর্ব বাংলার পাটের দাম বেড়ে ১৯০৪ সালের দ্বিগুণ হয়ে যায়।
এ ছাড়া আরও নানা ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার মানুষের নতুন নতুন সম্ভাবনার দোয়ার উন্মোচিত হয় বঙ্গভঙ্গের কল্যাণে। এতকালের দলিত নিম্নবিত্ত পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্য থেকে গড়ে উঠতে থাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
অভিজাত ও জমিদার শ্রেণির হিন্দুদের গাত্রদাহ
বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নের আগে প্রস্তাব যখন পাশ হয়, তখন থেকেই পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্নকরণের তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল পশ্চিবঙ্গের অভিজাত হিন্দু সমাজ, জমিদার শ্রেণি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। বঙ্গভঙ্গের ফলে যে পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটবে, পশ্চিমের জমিদার শ্রেণির আধিপত্য খর্ব হবে এবং পূর্বের অবারিত কৃষিপণ্য পানির দরে কেনা যাবে না আর, এটা ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আর এই উন্নয়নটা পূর্ব বাংলায় ঘটুক এটা হিন্দু অভিজাতরা কোনোভাবেই চাচ্ছিলেন না। এর প্রধানতম কারণ, পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। মুসলমানদের গত দেড় শতাব্দী ধরে নানা রকমের কলাকৌশলের পর অভিজাত শ্রেণি থেকে নিম্নবিত্তের কাতারে নামাতে নানা ধরনের কসরত করেছেন তাঁরা ব্রিটিশদের যোগসাজশে। এখন সেই মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে আবারও নিজেদের উন্নতি সাধন করবে, এ তাঁরা মেনে নিতে পারছিলেন না।
এ জন্য পশ্চিমের জমিদার, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবি, ব্যবসায়ী, আইনজীবি, পেশাজীবি—সর্বশ্রেণির হিন্দু অভিজাতরা বঙ্গভঙ্গে বিরুদ্ধে জোরদার অবস্থান গ্রহণ করেন। শুরু করেন আন্দোলন। সাধারণ শ্রেণির হিন্দু, বঙ্গভঙ্গের ফলে যাদের খুব একটা কিছু যায়-আসে না, তাদেরকে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে আন্দোলনে ধর্ম ও দেশপ্রেমের রঙ মাখানো হয়। বঙ্গভঙ্গকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ হিসেবে। যদিও সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় তাদের জোরাজোরিতেই বঙ্গভঙ্গ সাধিত হয়। তখন অখণ্ড বাংলার প্রতি তাদের কোন সমর্থন ও আস্থা ছিল না।
বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা
বঙ্গভঙ্গ কার্যকরের আগ থেকেই মূলত এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে পরিচয়দানকারী কংগ্রেসের নেতৃত্বেই প্রথমে এ আন্দোলনের সূচনা হয়। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়েছে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর, তার দুমাস আগে আগস্টের ৭ তারিখে কলকাতার টাউন হলে কাশিম বাজারের জমিদার মহারাজা মহেন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সভাপতিত্বে একটি প্রতিবাদ সভা হয়েছিল, যেখানে বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নের প্রতিবাদে লক্ষাধিক হিন্দুর জমায়েত হয়েছিল। এরপর ২২ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ‘রাখিবন্ধন’ কর্মসূচি পালিত হয় এই বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদেই। বলে রাখা ভালো, আমাদের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের এই সময়টাতেই লিখেছিলেন সাধারণ শ্রেণির হিন্দুদেরকে বঙ্গভঙ্গে বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে।
আজকে আমাদের কাছে ‘স্বদেশী আন্দোলন’ বলে যেটা পরিচিত, হিন্দু অভিজাত শ্রেণির বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবেই এটার সূচনা হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে ঢালাওভাবে প্রচার করা হয় বর্তমানে, অথচ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ১৯০৫ সালের ১৭ জুলাই এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন কেবল বঙ্গভঙ্গ ঠেকাতে, ইংরেজদেরকে এ দেশ থেকে বিতাড়নের জন্য বা এ দেশের স্বাধিকারের জন্য নয়।
শুরুতে বিলেতি পণ্য বয়কটের মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হলেও একসময় এর একটি অংশ নাশকতা ও চরমপন্থার দিকে ধাবিত হয়। একদিকে রবীন্দ্রনাথসহ কলকাতার বুদ্ধিজীবিরা রাজনৈতিকভাবে চাপসৃষ্টি ও আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য, অপরদিকে স্বদেশী আন্দোলন থেকে প্রাণিত হিন্দু উগ্রবাদী শ্রেণি শুরু করেছিল সহিংসতা।
১৯০৮ সালে এই গ্রুপ ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে যেয়ে ভুলক্রমে এক ব্রিটিশ দম্পতিকে হত্যা করে ফেলে। এ ছাড়াও আরও নানাবিধ সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে তারা৷ ব্রিটিশ দম্পতি হত্যাকাণ্ডের দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। একই সময়ে হিন্দুদের তৈরি এই অস্থিরতার প্রতিক্রিয়ায় স্বভাবতই বাঙালি মুসলমানেরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে একদিকে আন্দোলন-সহিংসতা, অপরদিকে চলতে থাকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা।
বঙ্গভঙ্গ রদ
হিন্দু সমাজের তৈরি এই সহিংস অস্থিরতা ও অব্যাহত প্রতিবাদে অবশেষে নিজেদের ক্ষমতার স্থায়িত্ব ও কল্যাণ চিন্তায় বঙ্গভঙ্গ রদ করে নেয় ইংরেজরা। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির মসনদ থেকে সম্রাট পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ বাতিল ঘোষণা করেন। ১৯১২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয় বঙ্গভঙ্গ রদ। আর এর মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলা আবারও একীভূত হয় পশ্চিম বাংলার সাথে। ঢাকা পুনরায় হারায় রাজধানীর মর্যাদা। একই সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের সম্ভাবনার যে দোয়ার খুলেছিল, তা বন্ধ করে দিতে পেরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু অভিজাত শ্রেণি।
হামমাদ রাগিব
সূত্রঃ fateh24