মদিনার বিখ্যাত গোত্র আউসের শাখা আবদুল আশহারের সন্তান সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু। তার পিতা মুয়ায। তার ডাকনাম আবু আমর, উপাধি সাইয়েদুল আউস। তার মাতা কাবশা বিনতে রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহা, প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র চাচাতো বোন। জাহেলি যুগেই পিতা মুয়াযের ইন্তিকাল হয়। তবে মাতা হিজরতের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন আর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মৃত্যুর পর বহুদিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। বংশধারা হলো – সাদ ইবনে মুয়ায ইবনে নোমান ইবনে ইমরাউল কায়েস ইবনে যায়েদ ইবনে আবদুল আশহাল। আউস গোত্রের মধ্যে বনু আবদুল আশহাল শাখা ছিলো সর্বাধিক অভিজাত ও সম্মানিত। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন তার সময়ের একজন বড় মাপের নেতা। (১)
ইসলামের পতাকাতলে
যদিও প্রথম আকাবার বায়আতের মধ্য দিয়ে মদিনায় ইসলামের আলোকচ্ছটা এসে পড়েছে, বাস্তবে মদিনা ইসলামের আলোয় আলোকিত হওয়ার পিছনে মুসআব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ব্যক্তিত্ব জড়িত ছিলো। মুসআব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের দাঈ হয়ে মদিনায় আসেন এবং নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে মদিনার প্রতিটি লোকের কানে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন কুফরের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলেন। তিনি মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সফলতার উপর দারুন আশ্চর্য হোন আর নিজ সম্প্রদায়ের ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা দেখে ভীষণ ব্যথিত ও মর্মাহত হোন। (২)
অবশেষে একদিন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’ও মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। আসআদ ইবনে যুরারার ঘরে তখন মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু অবস্থান করছিলেন। মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে একবার আসআদ ইবনে যুরারা বললেন, “যদি সাদ ইবনে মুয়ায মুসলমান হয়, তাহলে তার গোত্রের দুজন লোকও বিধর্মী থাকবে না। এজন্য সাদকে মুসলমান বানানোর চেষ্টা চালানো উচিত।” সাদ ইবনে মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কাছে আসেন। মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বললেন, “আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। কথাগুলো বসে আপনি প্রথমে শুনুন। গ্রহণ করা না করা আপনার ইচ্ছা।” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার এই আবেদন মনযুর করেন। মুসআব রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সামনে ইসলামের বাস্তবতা তুলে ধরেন, কুরআনের কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত করে শুনান। তখন সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু কালেমা পরে মুসলমান হয়ে যান।
পুরো গোত্রের ইসলাম গ্রহণ
আবদুল আশহাল গোত্রে এই সংবাদ মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘরে যান। গোত্রের লোকেরা এসে তাকে বললো, “এখন আপনার সেই পূর্বের চেহারা নেই।” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি আপনাদের মধ্যে কোন পর্যায়ের লোক?” সকলে সমস্বরে বলে উঠলো, “আপনি আমাদের সর্দার, আর আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “আপনারা যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনাদের সাথে কোন ধরণের কথাবার্তা বলবো না।” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সম্প্রদায়ের মধ্যে যে মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, তার প্রভাবে সন্ধ্যা হতে না হতেই পুরো গোত্র মুসলমান হয়ে যায়। মদিনার আকাশ-বাতাস তখন তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে। তবে বনু উমাইয়া ইবনে যায়েদ, বনু খুতমা, বনু ওয়াইল ও ওয়াকেফের লোকেরা এর ব্যতিক্রম। তারা মুসলমান হয়নি। (৩)
ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে এটি সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মহা অবদান। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে কেউ এই গৌরবে তার তুল্য নেই। এ কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন যে, আনসারদের মধ্যে সর্বোত্তম গোত্র হলো বনু নাজ্জার। তারপর বনু আবদুল আশহালের স্থান। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তার গোত্রের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা প্রথম ও দ্বিতীয় আকাবার মাঝামাঝিতে সংঘটিত হয়েছিলো। মুসলমান হওয়ার পর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসআব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে আসআদ ইবনে জুরারার ঘর থেকে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন।
মক্কায় আবু জাহেলের সাথে বিতর্ক
কিছুদিন পর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় রওয়ানা হোন। উমাইয়া ইবনে খালফ মক্কার প্রসিদ্ধ নেতা আর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কায় পৌঁছে তার বাড়িতে অবস্থান করেন। উমাইয়া ইবনে খালফ মদিনায় এলে বন্ধুত্বের সুবাদে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র বাড়িতে উঠতো। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উমাইয়া ইবনে খালফকে বললেন, “হারাম শরীফে যখন লোকজন না থাকে, তখন আমাকে অবহিত করবে।” দুপুরবেলা সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উমাইয়ার সাথে তাওয়াফ করার জন্য বের হোন। পথে হলো আবু জাহেলের সাথে সাক্ষাৎ। আবু জাহেল জিজ্ঞেস করলো, “এই লোক কে?” উমাইয়া জবাবে বললো, “সাদ ইবনে মুয়ায।” আবু জাহেল বললো, “আশ্চর্য! তুমি একজন বিধর্মী অর্থাৎ মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসারীকে আশ্রয় দিয়েছো আর তার সাহায্যকারী হয়ে নিশ্চিন্তে মক্কায় ঘুরে ফিরছো! তুমি তার সাথে না থাকলে তার ঘরে ফেরা কঠিন হতো।” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন, “তুমি আমাকে বাধা দাও, দেখবে কি হয়। আমি তোমার মদিনার রাস্তা বন্ধ করে দিবো।” উমাইয়া বললো, “সাদ, আবুল হাকাম (আবু জাহেল) মক্কার একজন বিশিষ্ট নেতা। তার সামনে নিচু স্বরে কথা বলো।” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “যাও, সরো। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে বলতে শুনেছি, মুসলমানরা তোমাদেরকে হত্যা করবে।” উমাইয়া বললো, “তারা আমাদের মক্কায় এসে হত্যা করবে?” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “তা আমি জানি না।” (৪)
হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ মতান্তরে সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের সাথে তার দ্বীনী ভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। (৫)
মদিনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিনিধি
দ্বিতীয় হিজরি সনের রবিউল আউয়াল মাসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশ নেতা উমাইয়া ইবনে খালফের নেতৃত্বাধীন একশো লোকের একটি কাফেলার খোঁজে বের হোন। ইতিহাসে এটি বাওয়াত অভিযান নামে খ্যাত। এক বর্ণনামতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রতিনিধি হিসেবে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে তখন মদিনায় রেখে যান। (৬)
জ্বালাময়ী ভাষণ
বাওয়াত অভিযানের পর ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধের সময় চলে আসে। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সেই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়ন হওয়ার সময় ছিলো এই যুদ্ধ। কুরাইশ পৌত্তলিকরা মদিনা আক্রমণের জন্য পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সংবাদ জানতে পেরে বদরের দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরাইশ বাহিনীর সর্বশেষ গতিবিধি অবগত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মুহাজির ও আনসারদের নিয়ে পরামর্শে বসেন। মুহাজিরদের মধ্যে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু, মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ সাহাবী নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেন। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের লক্ষ্য করে বললেন, “লোকসকল, আমাকে পরামর্শ দিন।”
সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি। আপনাকে সত্যবাদী বলে জেনেছি। আমরা স্বীকার করেছি যে, আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবই সত্য ও সঠিক। আপনার কথা শুনার আর আপনার আনুগত্য করার অঙ্গীকার আমরা করেছি। সুতরাং আপনার যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। আমরা আপনার সঙ্গেই আছি। সেই সত্তার কসম যিনি আপনাকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজন লোকও পিছনে থাকবে না। আমরা যুদ্ধকে ভয় করি না। রণাঙ্গনেও সত্যবাদী হিসেবে প্রমাণিত হবো, ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে এমন আচরণ প্রত্যক্ষ করাবেন, যা আপনার চোখ শীতল করে দিবে। (৭) আল্লাহ’র উপর ভরসা করে আমাদের নিয়ে আপনি অগ্রসর হোন।”
তিনি আরো বললেন, “আমরা তাদের মতো হবো না, যারা মুসাকে বলেছিলো – আপনি আর আপনার প্রতিপালক যান আর শত্রুর সাথে যুদ্ধ করুন, আর আমরা এখানে বসে থাকি। বরং আমরা বলবো – আপনি আর আপনার প্রতিপালক যান, আর আমরাও আপনাদের অনুসরণ করবো। হতে পারে আপনি এক উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন কিন্তু আল্লাহ অন্য একটি করালেন। দেখুন, আল্লাহ আপনার দ্বারা কি করান।”
ঐতিহাসিকদের বর্ণনা হলো, সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র এই কথার সমর্থনে আল্লাহ সূরাহ আনফালের ৬ নং আয়াত অবতীর্ণ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র এই বক্তব্যে দারুণ খুশী হোন। সেনাবিন্যাস করার সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আউস গোত্রের ঝাণ্ডা সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র হাতে সোপর্দ করেন। তবে অন্য এক বর্ণনা মতে, এই যুদ্ধে গোটা আনসার সম্প্রদায়ের পতাকা ছিলো সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র হাতে। (৮)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তাঁবু স্থাপনের পরামর্শ
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, বদরযুদ্ধ শুরুর পূর্বে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমরা আপনার জন্য একটি আরিশ বা তাঁবু স্থাপন করে একটি বাহিনী মোতায়েন রাখছি না কেন? কারণ আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবো। তাতে যদি আল্লাহ আমাদের সম্মান দান করেন, আমরা বিজয়ী হই, তাহলে তো আমাদের আশা পূর্ণ হলো। আর যদি এর বিপরীত কিছু ঘটে যায়, তাহলে আপনি এই বাহিনীসহ আমাদের পেছনে ছেড়ে আসা লোকদের সাথে মিলিত হবেন। ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাদের পিছনে মদিনায় যেসব লোক রয়ে গেছে, আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা তাদের থেকে একটুও বেশী নয়। যদি তারা বুঝতে পারতো আপনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন, তাহলে তারা এভাবে পিছনে পড়ে থাকতো না। আল্লাহ তাদের দ্বারা আপনার হেফাযত করবেন। তারা আপনাকে সৎ উপদেশ দান করবে। আপনার সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করবে।”
এই বক্তব্যের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রশংসা করে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য দোয়া করেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য রনাঙ্গনের অদূরে একটি তাঁবু নির্মাণ করা হয়, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। (৯)
পৌত্তলিকদের হত্যা করা আমার বেশী পছন্দ
কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। তখন মুসলিম সৈন্যরা তাদের ধাওয়া করে ধরে ধরে বন্দী করতে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর হঠাৎ আক্রমণ হতে পারে ভেবে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু আরো কিছু আনসারী সাহাবীকে নিয়ে অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে তাঁবুর দরজায় পাহারায় নিয়োজিত হোন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ লক্ষ্য করে বললেন, “সাদ, মনে হচ্ছে লোকজনের কাজ তোমার পছন্দ হচ্ছে না।” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “হ্যা, পৌত্তলিকদের সাথে এটা আমাদের প্রথম সংঘাত। তাদের পুরুষদের জীবিত রাখার চেয়ে হত্যা করাই আমার কাছে বেশী পছন্দ।” (১০)
সাহাবায়ে কিরামের অনুশোচনা
উহুদের যুদ্ধে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থানস্থলের পাহারাদার ছিলেন। শুরুতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মত ছিলো মদিনার ভিতর থেকে পৌত্তলিকদের মোকাবিলা করা। মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুলেরও এই মত ছিলো। কিন্তু কিছু নওজোয়ান সাহাবী, যারা ছিলেন শাহাদাতের বেশী আকাঙ্ক্ষী, তারা মদিনার বাইরে গিয়ে লড়াই করার জন্য জেদ ধরে বসেন। তারা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মত মেনে নেন আর রণসাজে সজ্জিত হওয়ার জন্য অন্দরমহলে প্রবেশ করেন। সাদ ইবনে মুয়ায ও উসাইদ ইবনে হুদাইর তখন বললেন, “তোমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে মদিনার বাইরে যেতে বাধ্য করেছো, অথচ তার উপর আসমান থেকে ওহী নাযিল হয়। এজন্য তোমাদের উচিত, তোমাদের মত প্রত্যাহার করা আর বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া।”
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তরবারি, ঢাল, বর্ম ইত্যাদি নিয়ে রণসাজে সজ্জিত হয়ে ঘর থেকে বের হোন। সকল সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে অনুতপ্ত হোন। আরয করেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আপনার বিরোধিতা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আপনি যা-ই নির্দেশ দেন, আমরা তা পালন করতে প্রস্তুত আছি।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “এখন আমার করার কিছুই নেই। যখন নবীগণ অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বের হোন, তখন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েই বের হোন। এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ থাকে না।” (১১)
উহুদের যুদ্ধে বীরত্ব
উহুদের পাদদেশে যুদ্ধ শুরু হয়। মুসলিম বাহিনী প্রথম দিকে বিজয় অর্জন করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পিছু হটে যায়। পৌত্তলিকরা মুসলমানদের উপর সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত হানতে থাকে। সেসময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে বেশী অবিচল ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কিছু সাহাবীও দৃঢ়পদে লড়াই করে যান। তাদের মধ্যে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু অন্যতম। এই যুদ্ধেই তার ভাই আমর ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু শাহাদাত লাভ করেন। (১২)
খন্দকের যুদ্ধে হাতে তীরের আঘাত
খন্দকের যুদ্ধের সময় সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ম পরিধান করে হাতে বর্শা নিয়ে রনাঙ্গনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হোন। পথে বনু হারেসার কেল্লায় তার মা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র কাছে বসে ছিলেন। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছন্দ আবৃত্তি করতে করতে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার মা তাকে দেখে চিৎকার করে বললেন, “বৎস, তুমি পিছনে থেকে গেছো, দ্রুত যাও।”
সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র যে হাতে বর্শা ছিলো, সে হাত বর্মের বাইরে বেরিয়ে ছিলো। মুলত তিনি ছোট বর্ম পরিধান করেছিলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “সাদের মা, দেখুন, তার বর্মটি কতো ছোট।” (১৩)
যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছার পর তাকে লক্ষ্য করে হিব্বান ইবনে কায়েস একটি তীর ছুঁড়ে মারে। কোনো কোনো বর্ণনায়, হিব্বানের পরিবর্তে আবু উসামা বা খাফাজা ইবনে আসিমের নাম রয়েছে। তীরটি তার হাতে লেগে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করে। এতে হিব্বান খুশী হয়ে বলে উঠে, “আমি আরিকার পুত্র।” এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মতান্তরে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু বলে উঠলেন, “আল্লাহ তাআলা দোযখে তোমার চেহারা ঘামে নিমজ্জিত করুন।” (১৪) আরাকা অর্থ ঘাম।
মসজিদে নববীর চিকিৎসা শিবিরে
যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র হাতে তীর বিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে অবহিত হোন, তখন তাকে মসজিদে নববীতে স্থাপিত রুফায়দার চিকিৎসা-শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন। মসজিদে নববীতে যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার জন্য একটি শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। এলাম গোত্রের রুফায়দা নামের এই মহিলা সেই শিবিরের একজন সেবিকা। তিনি আহতদের সেবা ও চিকিৎসা করতেন। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এই তাঁবুতেই থাকতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন এসে তার খোঁজখবর নিতেন। (১৫)
সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র দোয়া
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন এই শিবিরে এসে অসুস্থ সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র দেখাশোনা করতেন। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন নিজের জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েন তখন বলেন, “আল্লাহ, যদি কুরাইশদের সাথে এখনো যুদ্ধ বাকি থাকে তাহলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। আমি তাদের থেকে বেশী আর কারো সাথে যুদ্ধ করতে আগ্রহী নই। কারণ তারা আপনার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে কষ্ট দিয়েছে, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, মাতৃভূমি মক্কা ছাড়তে বাধ্য করেছে। যদি আমাদের ও তাদের মধ্যকার সংঘাত শেষ করে দেন, তাহলে এই ক্ষত দ্বারাই আমার জন্য শাহাদাত দান করুন। যতক্ষণ বনু কুরাইযার ধ্বংস দেখে আমার চোখ শীতল না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে মৃত্যু দিবেন না।” (১৬)
বনু কুরাইযার বিচারক
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দক যুদ্ধে কুরাইশ ও তাদের মিত্রবাহিনীর পরাস্ত হওয়ার পর ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযাকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কারণ তারা বিশ্বাসঘাতকতা ও চুক্তি ভঙ্গ করেছিলো।
প্রাচীনকাল থেকে বনু কুরাইযার সাথে আউস গোত্রে মৈত্রীচুক্তি ছিলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন আউস গোত্রের লোকেরা বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাদের প্রতিপক্ষ খাযরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে তারা ছিলো আমাদের মিত্র। এর আগে আপনিই আমাদের ভাই খাযরাজিদের মিত্র গোত্র বনু কায়নুকার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তা আপনার জানা আছে।”
মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এই একই কথা বললো। মূলত তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে বনু কুরাইযার ব্যাপারে কোন কঠিন শাস্তির আশংকা করছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে আউস সম্প্রদায়, তোমাদের গোত্রের কেউ তাদের সিদ্ধান্ত দিলে তোমরা কি তাতে খুশী হবে?” উত্তরে তারা বললো, “হ্যা, খুশী হবো।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তাদের ব্যাপারে সাদ ইবনে মুয়ায সিদ্ধান্ত দিবেন।”
বনু কুরাইযার ফয়সালার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে বিচারক নিয়োগ করেন। তখন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। আউস গোত্রের লোকেরা উটের পিঠে গদি বিছিয়ে তার উপর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে উঠিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যায়। পথে তারা সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে বললো, “আবু আমর, আপনার মিত্রদের সাথে একটু ভালো আচরণ করবেন। সম্ভবত একারনেই আপনাকে বিচারক বানানো হয়েছে।” তারা বেশী বাড়াবাড়ি শুরু করলে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “আল্লাহ’র নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন নিন্দুকের নিন্দার বিন্দুমাত্র পরোয়া সাদের নেই।”
সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছেন তখন তার আশেপাশে বসা সাহাবীদের বললেন, “তোমাদের নেতার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাও।” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র গোত্রের লোকেরা বিচারের ক্ষেত্রে একটু নমনীয় হওয়ার জন্য আবার পীড়াপীড়ি শুরু করে। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন বললেন, “তোমাদের এ ব্যাপারে আল্লাহ’র সাথে অঙ্গীকার ও চুক্তি অনুসরণ করা উচিত।” তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে বললেন, “বনু কুরাইযার লোক তোমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে।” সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “আমি সিদ্ধান্ত দিচ্ছি যে, তাদের মধ্যে যে সব লোক যুদ্ধ করার উপযুক্ত তাদেরকে হত্যা করা হবে, নারী ও শিশুদেরকে দাস-দাসীতে পরিণত করা হবে আর তাদের সব সম্পদ বণ্টন করে দেওয়া হবে।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র এ ফয়সালা শুনে বললেন, “সাদ, তুমি তাদের ব্যাপারে আল্লাহ ও তার রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাহিদা অনুযায়ী ফয়সালা করেছো।” (১৭) তখন সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু’র রায় অনুযায়ী বনু কুরাইযার চারশো লোককে হত্যা করা হয়।
পরম প্রভুর সান্নিধ্যে
রায় বাস্তবায়ন হওয়ার পর অল্প কিছুদিন তিনি জীবিত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার নিজ হাতে তার ক্ষত সেঁকে দেন। তাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার হাত ফুলে উঠে। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু যে দুয়া করেছিলেন তা আল্লাহ’র দরবারে কবুল হয়ে গিয়েছিলো।
একদিন তার ক্ষত ফেটে প্রবলবেগে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। মসজিদে নববী অতিক্রম করে গিফার গোত্রের তাঁবু পর্যন্ত রক্তের স্রোত বয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়ে। জিজ্ঞেস করে – কি হয়েছে? উত্তর আসে – সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ক্ষত ফেটে গিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবহিত হয়ে অস্থির হয়ে পড়েন। কাপড় টানতে টানতে দৌড়ে মসজিদে নববীতে আসেন আর সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মাথা কোলে উঠান। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন আর এ পৃথিবীতে নেই, তবে রক্ত আগের মতোই ঝরতে থাকে। লোকজন জড়ো হয়ে যায়।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আসেন, আর লাশ দেখে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠেন, “হায়, তার কোমর ভেঙ্গে গেছে।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “এমন কথা বলো না।” উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কাঁদতে কাঁদতে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন” পাঠ করেন। গোটা তাঁবুতে কান্নার রোল পড়ে যায়। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র দুখিনী মা কাঁদতে কাঁদতে একটি ছন্দ আবৃত্তি করতে থাকেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে কবিতা পড়তে নিষেধ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “থাক, তাকে পড়তে দাও। অন্য বিলাপকারিণীরা মিথ্যা বলে থাকে, কিন্তু সাদের মা সত্য বলছেন।” (১৮)
সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে দাফনের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে খুব বিমর্ষ দেখা যায়। চোখ দিয়ে ক্রমাগতভাবে অশ্রু ঝরতে থাকে। খন্দক যুদ্ধের এক মাস আর বনু কুরাইযার ঘটনার কয়েক রাত পর হিজরি পঞ্চম সনে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মৃত্যু হয়। (১৯)
ফেরেশতাদের গোসল দেওয়ার ভয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র ইন্তিকালের পর তার বাড়িতে যাচ্ছিলেন। সাহাবীরাও সঙ্গে ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতো দ্রুত চলছিলেন যে, সাহাবায়ে কিরাম তার অনুসরণ করতে পারছিলেন না। তাদের একজন বলে বসেন, “আপনি এতো দ্রুত হাঁটছেন কেন? আমরা তো ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমার ভয় হচ্ছে, আমাদের আগেই ফেরেশতারা তাকে গোসল না দিয়ে ফেলে, যেমন দিয়েছিলো হানযালাকে।” (২০)
জানাযায় সত্তর হাজার ফেরেশতার অংশগ্রহণ
সাহাবায়ে কিরাম সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জানাযা নিয়ে কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ও সাথে যান। মুনাফিকরাও যায়। সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র লাশ হালকা মনে হচ্ছিলো। এজন্য মুনাফিকরা বলাবলি শুরু করে – এমন হালকা লাশ আমরা কখনোই দেখিনি, সম্ভবত বনু কুরাইযার ব্যাপারে সে যে ফয়সালা করেছিলো, তারই কুফল এটি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের এ কথা শুনে বললেন, “যার হাতে আমার জীবন, তার নামের শপথ, ফেরেশতাগণ তার খাট বহন করছেন।”
ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “নিশ্চয়ই সাদ খুব নেককার মানুষ। তার জন্য আল্লাহ’র আরশ দুলে উঠেছে, আসমানের দরজাসমূহ খুলে গেছে। তার জানাযায় এমন সত্তর হাজার ফেরেশতা অংশগ্রহণ করেছেন, যারা এর আগে কখনোই পৃথিবীতে আসেননি।” (২১)
পাগড়ি বেঁধে জিবরীল আলাইহিস সালামের আগমন
বিশিষ্ট সিরাতবিদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু ইন্তিকাল করার পর রাতের বেলা একটি রেশমি কাপড়ের পাগড়ি বেঁধে জিবরীল আমিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), কে এই মৃত ব্যক্তি, যার জন্য আকাশের সব দরজা খুলে গেছে আর আল্লাহ’র আরশ কেঁপে উঠেছে?” রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দ্রুত কাপড় টানতে টানতে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কাছে গিয়ে দেখেন যে, তিনি ইন্তিকাল করেছেন। (২২)
একজন বিশিষ্ট সাহাবীর বিদায়
সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মৃত্যু ইসলামী ইতিহাসের এক অসাধারণ ঘটনা। তিনি ইসলামের মধ্যে যে অবদান রাখেন, আর যে দ্বীনী অনুপ্রেরণা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিলো, তার জন্য তাকে আনসারদের “আবু বকর” মনে করা হতো। আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা’র প্রতি মিথ্যা অপবাদের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষোভ নিয়ে বললেন, “আল্লাহ’র এই দুশমন (মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই) আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তোমাদের কেউ কি এর প্রতিবিধান করতে পারবে?” সাথে সাথে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, “আউস গোত্রের কেউ হলে আমাকে বলুন, আমরা তার গর্দান উরয়ে দিবো। আমাদের ভাই খাযরাজিদের কেউ যদি হয় তাহলে আমাদের নির্দেশ দিন, আমরা আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবো।”
তার দ্বীন প্রচারের একটি সুফল হলো, তার পুরো গোত্র একসাথে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এটি আনসারদের প্রথম গোত্র, যার সকল সদস্য একসাথে মুসলমান হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে “সাইয়েদুল আনসার” উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সম্মানিত ব্যক্তি। তার মৃত্যুর ঘটনাটি যে কতো গুরুত্বপূর্ণ তা অনুমিত হয় তার জানাযায় ফেরেশতাদের অংশগ্রহণ আর আল্লাহ’র আরশ কেঁপে উঠার মাধ্যমে। তাই একজন আনসারি কবি গর্ব করে বলেন – وما اهتزله عرش الله عن موت هالك – سمعنا به الا لسعد ابي عمروএকমাত্র সাদ আবু আমরের মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন মরণশীল ব্যক্তির মৃত্যুতে আল্লাহ’র আরশ কেঁপে উঠেছে, এমন কথা আমরা কখনো শুনিনি।এ ছাড়া হাসসান ইবনে সাবিতও তার বহু কবিতায় সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করেছেন। (২৩)
নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে সাদ ইবনে মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন উঁচু স্তরের লোক। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে আবদুল আশহাল গোত্রের তিন ব্যক্তি থেকে উত্তম কেউ নেই। তারা হলেন – সাদ ইবনে মুয়ায, উসাইদ ইবনে হুদাইর ও আব্বাদ ইবনে বিশর।” (২৪)
তিনটি বিষয়ে আমার স্তরে কেউ নেই
সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, “এমনিতে আমি একজন সাধারণ মানুষ। তবে তিন জিনিসে যে পর্যন্ত পৌঁছা উচিত, আমি সেখানে পৌঁছেছি –
(১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে যে বাণী শুনি, তা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে হওয়ার বিশ্বাস আমার হয়ে যায়,
(২) নামাযের মধ্যে কোন দিকে আমার মন যায় না,
(৩) কোনো জানাযার সাথে থাকলে আমার মধ্যে মুনকার-নাকিরের প্রশ্নের চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু থাকে না।” (২৫)
সায়িদ ইবনে মুসাইয়াব বলেন, “এই বৈশিষ্ট্যগুলো পয়গাম্বরদের মধ্যে থাকে।”
সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র আমলের প্রতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আস্থা
সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র আমলের উপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দারুণ আস্থা ছিলো। এক হাদিস থেকে তা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়। আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কবরে একটি চাপ অবশ্যই আছে। যদি এই চাপ থেকে কেউ মুক্তি পেয়ে থাকে, তাহলে সে সাদ ইবনে মুয়ায।” (২৬)
সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জান্নাতি রুমালের কোমলতা
একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কেউ একটি রেশমি জুব্বা পাঠায়। সাহাবায়ে কিরাম জুব্বাটির কোমলতা দেখে অভিভূত হয়ে যান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, “তোমরা এর কোমলতা দেখে আশ্চর্য হচ্ছো? জান্নাতে সাদ ইবনে মুয়াযের রুমাল এর চেয়েও বেশী কোমল ও মোলায়েম হবে।” (২৭)
কবরের মাটি মেশকে রুপান্তর
আবু সায়িদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “যারা বাকী কবরস্থানে (অর্থাৎ, জান্নাতুল বাকী’তে) সাদের কবর খুঁড়েছিল, আমি তাদের একজন। আমরা কবরের মাটি খোঁড়ার সময় মেশকের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম।”
শুরাহবিল ইবনে হাসানা বলেন, “এক ব্যক্তি সাদের কবরের মাটি থেকে এক মুঠ মাটি নিয়ে ঘরে রেখে দেয়। কিছুদিন পর সে দেখে, সেই মাটি মেশকে রূপান্তরিত হয়েছে।” (২৮)
উৎসঃ আসহাবে বদরের জীবনকথা – মুহাম্মাদ সুলাইমান সালমান মনসুরপুরী
টিকাঃ
(১) সিরাতে ইবনে হিশাম – ২/২৫২, তাবাকাত – ৩/৪২০ (২) খুলাসাতুল অফা বি-আখবারি দারিল মুসতফা – ৯২ (৩) তারিখে তাবারী – ১/১৯৯ (৪) বুখারী – ২/৫৬৩ (৫) তাবাকাত – ৩/৪২১ (৬) আনসাবুল আশরাফ – ১/২৮৭ (৭) যারকানি – ১/৪৭৯ (৮) সিরাতে ইবনে হিশাম – ১/৬১৩, হায়াতুস সাহাবা – ১/৪১৫ (৯) সিরাতে ইবনে হিশাম – ১/৬২০ (১০) সিরাতে ইবনে হিশাম – ১/৬২৮ (১১) তাবাকাত – ২/২৬ (১২) তাবাকাত – ২/৩০ (১৩) তাবারী – ১/২৮৭ (১৪) সিরাতে ইবনে হিশাম – ২/২২৬, উসদুল গাবাহ – ২/২৯৬ (১৫) উসদুল গাবাহ – ২/২৯৭ (১৬) তারিখে তাবারী – ১/২৮৬ (১৭) তারিখে তাবারী – ১/২৯৮, আল ইসাবাহ – ২/৩৮ (১৮) তাবাকাত – ৩/২২৮, সিরাতে ইবনে হিশাম – ২/২৫২ (১৯) আল ইসাবাহ – ২/২৮ (২০) হায়াতুস সাহাবা – ৩/৫৪৫ (২১) তাবাকাত – ৩/৪৩০, উসদুল গাবাহ – ২/২৯৭ (২২) তাবাকাত – ৩/৪৩২ (২৩) সিরাতে ইবনে হিশাম – ২/২৫২ (২৪) আল ইসাবাহ – ২/৯৭ (২৫) তাহযিবুত তাহযিব – ৩/৪৮২ (২৬) সিরাতে ইবনে হিশাম – ২/২৫২ (২৭) বুখারী – ১/৫৩৬ (২৮) হায়াতুস সাহাবা – ৩/৫৯৫