নিশ্চয়ই সালাত অন্যায় ও অশোভন কাজ থেকে বিরত রাখে – আহমাদুল্লাহ বিন রুহুল আমীন

ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল সালাত। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

أَوّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صَلَاتُهُ.

কিয়ামত দিবসে বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে সালাতের মাধ্যমে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৯৪৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৮৬৬

হযরত উমর রা.-এর প্রসিদ্ধ বাণী-

إِنّ أَهَمّ أَمْرِكُمْ عِنْدِي الصّلَاةُ. فَمَنْ حَفِظَهَا وَحَافَظَ عَلَيْهَا، حَفِظَ دِينَهُ. وَمَنْ ضَيّعَهَا فَهُوَ لِمَا سِوَاهَا أَضْيَعُ.

নিশ্চয়ই আমার কাছে তোমাদের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সালাত। যে ব্যক্তি সালাতের হেফাযত করল, যত্ন সহকারে তা আদায় করল, সে তার দ্বীনকে হেফাযত করল। আর যে তাতে অবহেলা করল, (দ্বীনের) অন্যান্য বিষয়ে সে আরো বেশি অবহেলা করবে। -মুয়াত্তা মালেক, বর্ণনা ৬; মুসান্নাফে আবদুর রযযাক, বর্ণনা ২০৩৮

সালাত মূলত খোদাপ্রদত্ত এক মহান নিআমত। রাব্বুল আলামীনের এক বিশেষ উপহার, যা বান্দাকে সকল প্রকার অশ্লীলতা, পাপাচার, প্রবৃত্তিপূজা, ক্ষণস্থায়ী ভোগ-বিলাসের অন্ধ মোহ থেকে মুক্ত করে পূত-পবিত্র ও উন্নত এক আদর্শ জীবনের অধিকারী বানিয়ে দেয়। বিকশিত করে তোলে তার ভেতরের সকল সুকুমারবৃত্তি। তার জন্য  খুলে দেয় চিরস্থায়ী জান্নাতের সুপ্রশস্ত দুয়ার।

সালাত হচ্ছে হিকমাহপূর্ণ এক অলৌকিক তরবিয়ত-ব্যবস্থা। সালাতের মাধ্যমেই ইখলাস, আত্মশুদ্ধি ও আত্মবিলোপের মহৎ গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে, যা বান্দাকে পৌঁছে দেয় আল্লাহর সান্নিধ্যের স্বর্ণশিখরে।

সালাত এমন এক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পূর্ণ যে, খাঁটি মুসল্লি নামাযের বাইরের পরিবেশেও এমন কোনো কাজ করতে পারে না, যা মানুষের দৃষ্টিতে সালাতের ভাব-মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করে। অদৃশ্য থেকে মূলত সালাতই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তার রাত-দিনের সকল গতিবিধি। শয়তানের ধোঁকায় যদি মুসল্লি কখনো কোনো অন্যায় বা অশোভনীয় কাজে লিপ্ত হতে চায় তখন নামাযের তরবিয়তে দীক্ষিত বিবেক তাকে বলে, তুমিই বল, একটু পরে যখন তুমি সালাতে তোমার মহান প্রভুর সামনে দাঁড়াবে তখন কি তোমার এই ভেবে লজ্জাবোধ হবে না যে, কেমন কালো মুখ ও কলুষিত হৃদয় নিয়ে তুমি আপন মালিকের সামনে দাঁড়াচ্ছ? যিনি অন্তর্যামী, তোমার গোপন-প্রকাশ্য সকল বিষয়ে সম্যক অবগত। যিনি ছাড়া তোমার আর কোনো ইলাহ নেই। যিনি তোমার একমাত্র আশ্রয়দাতা, যাঁর সামনে তোমাকে বার বার দাঁড়াতে হবে। যার কাছে তোমার সকল চাওয়া-পাওয়া। প্রতিটি মুহূর্তে তুমি যাঁর মুখাপেক্ষী। এগুলো জানার পরও কি তুমি তাঁর নাফরমানিতে লিপ্ত হবে? সালাত এভাবে মুসল্লিকে উপদেশ দিতে থাকে এবং পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বাধা দেয়। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা-

اِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهٰی عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ الْمُنْكَرِ.

নিশ্চয়ই সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৪৫

ইমাম তবারী, ইবনে কাসীর, কুরতুবী, আলূসীসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ তাফসীরকারের মত অনুসারে আয়াতের মর্ম হল, তাকবীর, তাসবীহ, কেরাত, আল্লাহর সামনে কিয়াম ও রুকু-সিজদাহসহ অনেক আমলের সমষ্টি হচ্ছে সালাত। এ কারণে সালাত যেন মুসল্লিকে বলে, তুমি কোনো অশ্লীল বা অন্যায় কাজ করো না। তুমি এমন প্রভুর নাফরমানী করো না, যিনি তোমার কৃত ইবাদতসমূহের প্রকৃত হকদার। তুমি এখন কীভাবে তাঁর অবাধ্য হবে, অথচ তুমি এমন আমল করেছ, যা তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ত্বকে প্রকাশ করে। এরপরও যদি তাঁর অবাধ্য হও তবে এর মাধ্যমে তুমি স্ববিরোধী কাজে লিপ্ত  হলে। (আর স্ববিরোধী কাজের মাধ্যমে ব্যক্তি কোন্ স্তরে নেমে আসে সেটা তোমার ভালোই জানা আছে।) -রুহুল মাআনী, ১০/৪৮২

প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্ত নামাযে প্রতি রাকাতে বান্দাহ বলতে থাকে-

مٰلِكِ یَوْمِ الدِّیْنِ.

[(তুমি) কর্মফল-দিবসের মালিক।] আর তার স্মরণ হতে থাকে, তাকে কাল কর্মফল দিবসে মালিকের সামনে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং তাঁর নাফরমানী থেকে, তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচতে হবে। কোনো গুনাহ যদি নামাযের আগে হয় তাহলে তার গুনাহের কথা স্মরণ হয় ও লজ্জাবোধ হয়; বান্দা অনুতপ্ত হয় এবং ভবিষ্যতে গুনাহ না করার সংকল্প করে। তেমনি যদি কোনো গুনাহের নিয়ত থাকে তখন বান্দার মনে হয়, আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো; কাল কিয়ামতের দিনও তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে। তাহলে কীভাবে আমি নামাযের পর অমুক গুনাহ করার কথা ভাবতে পারি! এভাবে নামায বান্দাকে গুনাহ থেকে ফিরিয়ে রাখে, কৃত গুনাহ থেকে পবিত্র করে।

তেমনিভাবে আমরা নামাযের শুরুতে যে ছানা পড়ি-

سُبْحَانَكَ اللّهُمّ وَبِحَمْدِكَ…

এখানে পড়ার আরেকটি দুআও রয়েছে, যে দুআর মধ্যে বান্দা গুনাহ থেকে দূরে থাকার তাওফীক প্রার্থনা করে-

اللّهُمّ بَاعِدْ بَيْنِي وَبَيْنَ خَطَايَايَ، كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ المَشْرِقِ وَالمَغْرِبِ…

(হে আল্লাহ! পূর্ব-পশ্চিমের যেমন দূরত্ব; আমার মাঝে আর গুনাহের মাঝে তুমি তেমন দূরত্ব সৃষ্টি করে দাও।)

তো বান্দা যখন নামাযে দাঁড়িয়ে এ কথা বলে, তখন অবচেতনেই সে গুনাহ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে এবং আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন এবং তাকে গুনাহ থেকে বিরত থাকার তাওফীক দান করেন। এভাবে সালাত বান্দাকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে।

দিনের শেষে বিত্র নামাযে আমরা দুআ কুনূত পড়ি। সে দুআতে এমন অনেক বাক্য রয়েছে, যাতে বান্দা নিজ গুনাহের কথা স্মরণ করে, মাফ চায়, গুনাহ না করার সংকল্প করে। যেমন দুআর শুরুতেই আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বান্দা বলে-

اللّهُمّ إِنّا نَسْتَعِينُكَ، وَنَسْتَغْفِرُكَ.

(ইয়া আল্লাহ! আমরা তোমারই সাহায্য চাই। তোমারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি।)

দিন শেষে বান্দা যখন গাফূরুর রাহীমের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে তো বান্দার সারাদিনের সকল পাপের কথা স্মরণ হয়ে যায়। সাথে ভবিষ্যতে পাপ না করার সংকল্প ব্যক্ত করে। কারণ, কৃত গুনাহ মাফ হওয়ার জন্য প্রধান শর্তই হল, ভবিষ্যতে এ গুনাহ আর না করার সংকল্প।

একপর্যায়ে বান্দা বলে-

نَشْكُرُكَ وَلَا نَكْفُرُكَ.

(আমরা তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি; অকৃতজ্ঞ হই না।)

রবের নাফরমানীর চাইতে বড় অকৃজ্ঞতা আর কী হতে পারে!

সালাত বান্দাকে শুধু রবের নাফরমানী থেকেই বিরত রাখে না; বরং নাফরমান থেকেও দূরে রাখে। দুআ কুনূতে বান্দা বলে-

وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يّفْجُرُكَ.

(যে তোমার নাফরমানী করে আমরা তাকে ত্যাগ করি, বর্জন করি।)

সবশেষে বান্দা সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সংকল্প ব্যক্ত করে বলে-

وَنَخْشٰى عَذَابَكَ.

(আমরা তোমার আযাবকে ভয় করি।)

এ সংকল্প সারাদিন বান্দাকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। কৃত গুনাহ থেকে তওবা করার তাকিদ দেয়। এভাবেই গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা, গোনাহগার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার সংকল্প আর আল্লাহর আযাবের স্মরণ বান্দাকে সকল প্রকার অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে।

এ তো গেল দিনের শেষে বান্দার গুনাহের স্মরণ ও ক্ষমা প্রার্থনার কথা; এ ছাড়াও প্রতি নামাযের শেষেই তো বান্দা বলে-

اللّهُمّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا كَثِيرًا، وَلاَ يَغْفِرُ الذّنُوبَ إِلَا أَنْتَ، فَاغْفِرْ لِي مَغْفِرَةً مِنْ عِنْدِكَ، وَارْحَمْنِي إِنّكَ أَنْتَ الغَفُورُ الرّحِيمُ.

ইয়া আল্লাহ! আমি (তোমার নাফরমানীর মাধ্যমে) নিজের উপর অনেক যুলুম করেছি। আর আপনি ছাড়া গুনাহ মাফকারী আর কেউ নেই। আপনি নিজ অনুগ্রহে আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি রহম করুন। নিঃসন্দেহে আপনিই ক্ষমাকারী, করুণাময়।

যে বান্দা রবের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার ‘যালামতু নাফসী’-‘নিজের উপর যুলুম করেছি’ বলে স্বীকারোক্তি দেয় এবং হৃদয়ে তা ধারণ করে সে কি সালাতের বাইরে এ স্বীকারোক্তির বিপরীত করতে পারে? রাব্বে কারীমের, গাফূরুর রাহীমের নাফরমানী করতে পারে?

এভাবেই সালাত বিরত রাখে বান্দাকে সকল অন্যায়-অনাচার থেকে।

সবচেয়ে বড় কথা হল, দিনের পাঁচটি সময়ে পাঁচবার মহান প্রভুর সামনে দাঁড়ানোই তো বান্দাকে গুনাহ থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট। দিবস-রজনীর বিভিন্ন মুহূর্তে সে যত গুনাহ করে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই তার গুনাহের কথা স্মরণ হয়ে যায়, সে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়। কারণ সে তো দাঁড়িয়েছে ‘আলিমুল গাইবি ওয়াশ শাহাদাতি’র সামনে, যিনি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব জানেন। সে তো দাঁড়িয়েছে ‘আলীমুম বিযা-তিস সুদূর’-এর সামনে, যিনি অন্তরের সংকল্পও জানেন।

এর দ্বারা যেমন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার পাথেয় অর্জন হয়, সংকল্প করার তাওফীক হয় তেমনি এ কারণে গুনাহও মাফ হয়। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

الصّلَوَاتُ الْمَكْتُوبَاتُ كَفّارَاتٌ لِمَا بَيْنَهُنّ.

পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায তার মাঝের গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩১

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে অভিযোগ করল, অমুক ব্যক্তি রাতে সালাত আদায় করে আর দিনের বেলায় চুরি করে। নবীজী বললেন-

سَيَنْهَاهُ مَا تَقُولُ.

তুমি যা বলছ (অর্থাৎ তার নামায) তা শীঘ্রই তাকে (এ অন্যায় থেকে) বিরত রাখবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৭৭৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৫৬০

এক ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে সালাত আদায় করত। যখন তার সম্পর্কে হযরত ইবনে মাসউদ রা.-কে বলা হল, তিনি বললেন, সালাত তার জন্যই ফলদায়ক হয়, যে সালাতের আনুগত্য করে। অতপর তিনি আয়াত পাঠ করলেন-

اِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهٰی عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ الْمُنْكَرِ.

নিশ্চয়ই সালাত অশোভন ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। [সূরা আনকাবূত (২৯) : ৪৫] -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ৩৫৬৯৬; তাফসীরে তবারী, ১৮/৪০৮; তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম, ৯/৩০৬৬

হযরত শুআইব আ.-এর ঘটনা থেকেও বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝে আসে- সালাত অন্যায় থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর নবী হযরত শুআইব আ. যখন তাঁর জাতিকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং মাপে কম দেয়াসহ সকল প্রকার অনাচার পরিহার করে পূত-পবিত্র জীবন যাপনের আহ্বান জানালেন তখন তাঁর অবাধ্য সম্প্রদায় তার প্রতি আপত্তি জানিয়ে বলল-

اَصَلٰوتُكَ تَاْمُرُكَ اَنْ نَّتْرُكَ مَا یَعْبُدُ اٰبَآؤُنَاۤ اَوْ اَنْ نَّفْعَلَ فِیْۤ اَمْوَالِنَا مَا نَشٰٓؤُا  اِنَّكَ لَاَنْتَ الْحَلِیْمُ الرَّشِیْدُ.

তোমার ‘সালাত’ কি তোমাকে এই  নির্দেশই দেয় যে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের উপাস্য বস্তুকে ত্যাগ করব কিংবা আমরা বিরত থাকব আমাদের ধন-সম্পদ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা থেকে? তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান ও ধার্মিক লোক! [সূরা হূদ (১১) : ৮৭]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত সুফিয়ান রাহ. বলেন, আল্লাহর শপথ, নিশ্চয়ই সালাত (ভালো কাজের) আদেশ এবং (মন্দ কাজ থেকে) নিষেধ করে। -তাফসীরে তবারী ১৮/৪০৯

 

সালাত কখন অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে?

প্রকৃত অর্থেই সালাত মুসল্লিকে অন্যায় ও অশোভন কাজ থেকে বিরত রাখে। কিন্তু তা কখন? এ ঘোষণার চূড়ান্ত ফল লাভ করার জন্য কোনো শর্ত রয়েছে কি না? এক্ষেত্রে মুসল্লিরও কিছু করণীয় ও বর্জনীয় আছে কি না? এটা অবশ্যই যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। অনেক আয়াত ও হাদীস থেকেই এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। এখানে শুধু একটি আয়াত ও একটি হাদীস উল্লেখ করা হচ্ছে। আল্লাহ পাক কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন-

فَوَیْلٌ لِّلْمُصَلِّیْنَ، الَّذِیْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ،  الَّذِیْنَ هُمْ یُرَآءُوْنَ.

দুর্ভোগ ঐসকল মুসল্লির, যারা তাদের সালাত থেকে উদাসীন। যারা শুধু (মানুষদেরকে) দেখানোর জন্য সালাত আদায় করে। -সূরা মাউন (১০৭) : ৪-৫

অতএব স্পষ্ট যে, মুল্লি মাত্রই সালাতের এই মহা সুফল লাভ করবে, বিষয়টি এমন নয়। সালাতের মধ্যে উদাসীনতা মুসল্লির জন্য সুফল নয়; বরং কুফল বয়ে আনে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

خَمْسُ صَلَوَاتٍ افْتَرَضَهُنَّ اللهُ عَلَى عِبَادِهِ مَنْ أَحْسَنَ وُضُوءَهُنَّ وَصَلَّاهُنَّ لِوَقْتِهِنَّ، فَأَتَمَّ رُكُوعَهُنَّ وَسُجُودَهُنَّ وَخُشُوعَهُنَّ كَانَ لَهُ عِنْدَ اللهِ عَهْدٌ أَنْ يَغْفِرَ لَهُ، وَمَنْ لَمْ يَفْعَلْ فَلَيْسَ لَهُ عِنْدَ اللهِ عَهْدٌ إِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ، وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ.

আল্লাহ তাআলা বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করবে এবং যথাসময়ে সালাত আদায় করবে- এভাবে যে, রুকু-সিজদা ও খুশূ পূর্ণরূপে সম্পাদন করবে, তার জন্য আল্লাহ পাক ক্ষমার (অন্য বর্ণনায়, জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর যে ব্যক্তি (এসব) করবে না তার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। ইচ্ছা হলে মাফ করবেন নতুবা শাস্তি দিবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৭০৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৫

নবীজীর এই পবিত্র ইরশাদ থেকে বোঝা যায়, সালাতের মাধ্যমে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে একটি ‘আহ্দ’ বা চুক্তি সম্পাদিত হয়। আর সে চুক্তিটি একটু বিস্তর। এর জন্য কিছু অপরিহার্য শর্ত রয়েছে, যার অন্যতম হল, সালাতে খুশূ-খুযূ অবলম্বন করা এবং রুকু-সিজদা ধীরস্থির ও যথাযথভাবে সম্পাদন করা।

মূলত সালাতের গুণগত মান হিসাবেই তা মুসল্লিকে পাপাচার ও অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

إِنّ الْعَبْدَ لَيُصَلِّي الصّلَاةَ مَا يُكْتَبُ لَهُ مِنْهَا إِلّا عُشْرُهَا، تُسُعُهَا، ثُمُنُهَا، سُبُعُهَا، سُدُسُهَا، خُمُسُهَا، رُبُعُهَا، ثُلُثُهَا نِصْفُهَا.

নিশ্চয়ই বান্দা সালাত সম্পন্ন করে আর তার জন্য লেখা হয় সালাতের দশ ভাগের এক ভাগ (প্রতিদান) অথবা নয় ভাগের এক ভাগ অথবা আট ভাগের এক ভাগ, সাত ভাগের এক ভাগ, ছয় ভাগের এক ভাগ, পাঁচ ভাগের এক ভাগ, চার ভাগের এক ভাগ, তিন ভাগের এক ভাগ অথবা সে পায় সালাতের অর্ধেক (প্রতিদান)। এক বর্ণনায় এসেছে অথবা সে পায় সালাতের পূর্ণ প্রতিদান ও সুফল। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৮৯৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭৯৬

অর্থাৎ যদি সালাতটি আদায় করা হয় পূর্ণ খুশূ-খুযূর (হৃদয়ের একাগ্রতা ও অঙ্গ-প্রতঙ্গের স্থিরতার) সাথে এবং তিলাওয়াত ও তাসবীহসমূহও পাঠ করা হয় যথাযথভাবে। ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত ও আদবসমূহও সম্পাদন করা হয় উত্তমরূপে। তবে সেই মুসল্লিকে আখেরাতে পূর্ণ প্রতিদান ও সওয়াব দান করা হবে এবং দুনিয়াতে তা মুসল্লিকে মন্দ ও অশোভন কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখবে। পক্ষান্তরে যে সালাত হয় অন্তঃসারশূন্য আনুষ্ঠানিকতা, যা সীমাবদ্ধ থাকে নিছক অঙ্গ-প্রতঙ্গ সঞ্চালনের মধ্যে, যাতে রুকু-সিজদা, কিরাত-কিয়াম যথাযথভাবে সম্পাদন করা হয় না সেই সালাত কীভাবে মুসল্লিকে অন্যায় ও অশোভন কাজ থেকে বাঁচাবে? তার সালাত তো তাকে সালাতরত অবস্থাতেই অশোভন কাজ ও চিন্তা থেকে ফিরাতে পারছে না। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-

قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ، الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ.

সফলকাম সেসকল মুমিন, যারা সালাতে খুশূ-খুযূ অবলম্বন করে। -সূরা মুমিনূন (২৩) : ১-২

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের পরিচয় দিতে গিয়ে অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

سِیْمَاهُمْ فِیْ وُجُوْهِهِمْ مِّنْ اَثَرِ السُّجُوْدِ.

তাদের লক্ষণ তাদের মুখম-লে সিজদার প্রভাব পরিস্ফুট থাকবে। -সূরা ফাত্হ (৪৮) : ২৯

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত মুজাহিদ রাহ. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-

ليس بهذا الأثر الذي في الوجه ولكنها الخشوع.

এখানে কপালে সেজদার দাগ উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য হল, ‘খুশূ’। -ওয়াকী ইবনুল র্যারাহ, আয্যুহদ ২/৫৯৮, হাদীস ৩২৭; তাফসীরে সুফিয়ান ছাওরী পৃ. ২৭৮; ইবনুল মুবারক, আয্যুহদ পৃ. ৮৯

আল্লামা আলূসী রাহ. বলেন-

الخشوع التذلل مع خوف وسكون للجوارح.

‘খুশূ’ হল, অন্তরের ভয় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্থিরতার সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিনয় প্রকাশ করা। -রূহুল মাআনী ৯/২৭৫

প্রখ্যাত মুফাসসীর হাফেয ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, সালাতে খুশূ-খুযূর দৌলত তাঁরই হাছিল হয়, যে নিজের অন্তরকে সবকিছু থেকে ফিরিয়ে শুধু সালাতের মধ্যেই নিবিষ্ট রাখে। -তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩/২৯৫

যখন কেউ এমন খুশূ-এর সাথে সালাত আদায় করে তখনই সালাত তার চক্ষু শীতল করে, অন্তরের প্রশান্তির কারণ হয়। যেমনটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে ইরশাদ করেছেন-

جُعِلَتْ قُرّةُ عَيْنِي فِي الصّلَاةِ.

সালাতেই দান করা হয়েছে আমার চক্ষুর শীতলতা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২২৯৩; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৯৩৪০

অন্য হাদীসে বেলাল রা.-কে সম্বোধন করে বলেছেন,

يَا بِلَالُ! أَقِمِ الصّلَاةَ، وَأَرِحْنَا بِهَا.

সালাতের ব্যবস্থা করে আমাকে শান্তি দাও, হে বেলাল!। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৮৫

এটাই তো সালাত সম্পর্কে একজন মুমিনের অনুভূতি হওয়া উচিত। সালাত তার জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল, অন্তরের প্রশান্তি, শান্তির আধার। পক্ষান্তরে মুনাফিক এবং যারা সালাতে খুশূ-খুযূ অবলম্বন করে না তাদের জন্য সালাত মহা কঠিন কাজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

وَ اِنَّهَا لَكَبِیْرَةٌ اِلَّا عَلَی الْخٰشِعِیْنَ.

সালাতকে অবশ্যই কঠিন মনে হয়। তবে খুশূ-খুযূ (অর্থাৎ ধ্যান ও বিনয়) অবলম্বনকারীদের জন্য নয়। -সূরা বাকারা (২) : ৪৫

আরেক আয়াতে মুনাফিকদের চরিত্র সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِذَا قَامُوْۤا اِلَی الصَّلٰوةِ قَامُوْا كُسَالٰی  یُرَآءُوْنَ النَّاسَ وَ لَا یَذْكُرُوْنَ اللهَ اِلَّا قَلِیْلاً.

(নিশ্চয়ই মুনাফিকরা) যখন সালাতে দাঁড়ায়, তখন অলসতার সাথে দাঁড়ায়। তারা মানুষকে দেখায় আর আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে। -সূরা নিসা (৪) : ১৪২

তো নামাযে খুশূ-খুযূ মুমিনের গুণ। পক্ষান্তরে খুশূ-খুযূ বিহীন অলসতার সাথে নামায মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। আর খুশূ-খুযূ ওয়ালা নামাযই নামাযীকে সকল অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে।

আসলে মুমিনের নামায খুশূ-খুযূ বিহীন হতেই পারে না; কারণ সে তো মহান প্রভুর সামনে দণ্ডায়মান। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কি দেহ-মন বিনীত না হয়ে পারে? আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কি মুমিন আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো দিকে মনোনিবেশ করতে পারে? প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী অপূর্ব শৈলিতে এ কথায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন-

إِنّ أَحَدَكُمْ إِذَا قَامَ يُصَلِّي إِنّمَا يَقُومُ يُنَاجِي رَبّهُ فَلْيَنْظُرْ كَيْفَ يُنَاجِيهِ.

তোমাদের কেউ যখন নামাযে দণ্ডায়মান হয় তখন সে তার রবের সাথে একান্তে আলাপ করে। সুতরাং তার উচিত সে কিভাবে আলাপ করছে সেদিকে যথাযথভাবে লক্ষ রাখা। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৮৬১; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ৪৭৪

হযরত সা‘দ বিন উমারাহ রা. এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন-

صَلِّ صَلَاةَ مُوَدِّعٍ.

যখন তুমি সালাত আদায় কর, তো এমনভাবে আদায় কর যেন এটাই তোমার জীবনের শেষ সালাত। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, বর্ণনা ৫৪৫৯; আলইছাবা, ইবনে হাজার ৩/৭০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হায়ছামী ১০/২৩৬, বর্ণনা ১৭৭৩৯

প্রসিদ্ধ হাদীস ‘হাদীসে জিবরীল’-এ সকল ইবাদতের একটি মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। তাতে ফুটে উঠেছে খুশূ-খুযূর চূড়ান্ত রূপ-

أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنّهُ يَرَاكَ.

ইহসান হচ্ছে, আল্লাহর ইবাদত  এমনভাবে করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর তুমি তাঁকে না দেখলেও তিনি তো (অবশ্যই) তোমাকে দেখছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০

এই হাদীসের মূল কথাও ‘খুশূ’। সুতরাং কথা এটাই যে, সালাতের চূড়ান্ত সুফল অর্জন করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই সালাতে খুশূ-খুযূ অবলম্বন করতে হবে। খুশূ-খুযূ ওয়ালা নামাযই মুমিনকে সকল অন্যায়-অনাচার, অপকর্ম-অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে।

সফর ১৪৪০ – নভেম্বর ২০১৮
মাসিক আলকাউসার