মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার নিয়মিত আয়োজন ‘মাসিক মুহাযারা’র অংশ হিসেবে কিছুদিন আগে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুম। তার আলোচনাটি পত্রস্থ করেছেন মাওলানা আনোয়ার হুসাইন। পরবর্তীতে এটি মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুম-এর কিছু সংযোজন ও বিয়োজনের পর আলকাউসারের পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হল। -তত্ত্বাবধায়ক
আজকের আলোচ্য বিষয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ইনশাআল্লাহ আজ আমরা কথা বলব ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয়, এর গোড়ার কথা, ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আমাদের দেশে এর প্রাসঙ্গিকতাসহ সংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয়ে। শুধু সচেতন আলেমে দ্বীন হিসেবেই নয়, স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবেও এ বিষয়টি আমাদের বোঝা উচিত। কারণ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয়েছে তাতে রাষ্ট্রের মৌলিক চার নীতির মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে স্থান দেওয়া হয়েছে। এরপর সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে এ নীতিটি বাদ দিয়ে তার স্থলে আনা হয়েছে ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। কিন্তু তিন দশক পর আবারো বর্তমান সরকার ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে এবং ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ‘‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’’-এর নীতিটি।
সংবিধান জনগণকে প্রজাতন্ত্র তথা দেশের মালিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সে হিসেবে রাষ্ট্রের মালিক তথা নাগরিকদের জন্য দেশের সংবিধান জানার ও বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। জনগণের নামে জনপ্রতিনিধি তথা সংসদ সদস্যগণ কী কী বিষয় সংবিধানে যোগ-বিয়োগ করছেন তার প্রতি নজর রাখা সচেতন নাগরিকদের কর্তব্যও বটে। আমরা মূল আলোচনায় চলে যাই।
ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা/পরিচয়
প্রথমেই বলা দরকার যে, কিছু জিনিস আছে যেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া লাগে না। এমনিই বুঝে আসে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিও এমন। কম পড়ুয়া লোকজনও এর অর্থ বুঝে নিতে পারবে। ইংরেজি Secularism শব্দের বাংলা রূপ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, আরবীতে যাকে বলা হয় ‘আল আলমানিয়্যাহ’।
প্রথমেই দেখুন বাংলা একাডেমীর ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারী। ২০১২ সালের এ সংস্করণ ছেপেছে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেবের সম্পাদনায়। Secular-(অর্থ) পার্থিব, ইহজাগতিকতা, জড়, জাগতিক।
Secular State ‘গীর্জার সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র’। এ অর্থ অনুযায়ী মুসলিম দেশে এর ব্যাখ্যা হবে মসজিদের সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র।
Secularism নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ নয়-এই মতবাদ। জাগতিকতা, ইহবাদ।
এ অর্থগুলো লিখেছে বাংলা একাডেমীর অভিধান। এটির সম্পাদনায় কোনো ডানপন্থী বা কোনো ‘হুজুর’ জড়িত ছিলেন না। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেব ছিলেন এর সম্পাদক।
এটা এমন নয় যে, কোনো মতবাদ ওয়ালারা নিজ মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ ব্যাখ্যা লিখেছে; বরং দেশের সরকার-নিয়ন্ত্রিত এবং বর্তমান সরকার নিয়ন্ত্রিত সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী, যারা সংবিধানে আবার সেকুলারিজমকে স্থান দিয়েছে তাদের কর্তৃক নিয়োজিত, নির্ভরযোগ্য, যোগ্য ব্যক্তিরাই সেকুলারিজমের এই অর্থ ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
আমার দেখে ভালো লেগেছে যে, ওনারাও ভালো মানুষ। রাখঢাক না করে সাফ সাফ কথাটাই মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়’-এমন কথা লেখেননি। আমি বাইরের অভিধানেও খোঁজ করেছি। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকা দেখেছি, উইকিপিডিয়া দেখেছি। একই ব্যাখ্যা পেয়েছি। অক্সফোর্ড ইংরেজী-উর্দু ডিকশনারী। সেখানে লেখা আছে, Secularism لا دينية لا مذهبية، (ধর্মহীনতা)।
এগুলো মুসলমানদের ব্যাখ্যা নয়। সেকুলারিজম যে বাস্তবেই لا دينية لا مذهبية، (ধর্মহীনতা) এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায় না। বাংলা একাডেমীরটা তো দেখলেনই। উইকিপিডিয়াতে সেকুলারিজমের ব্যাখ্যা করা হয়েছে Anti Islam দিয়ে।
তাই বলছিলাম অনেক কিছুই আছে যেগুলো ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর দরকার হয় না। শব্দ দেখেই মতলব স্পষ্ট হয়ে উঠে।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা
আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছিল ১৯৭২ সালে। সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের নতুন সংবিধানের মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। জনগণ তখন জেনেছে এই রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য স্বাধীন হয়েছে। বিজয়ের এক বছর পর ১৯৭২ সালের শেষের দিকে সংবিধান প্রণয়ন সমাপ্ত হয়েছে। বস্ত্তত তখনই দেশের সাধারণ জনগণ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা জেনেছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক, অল্প ধার্মিক হোক বা বেশি ধার্মিক যুদ্ধের সময় তারা জানেনি যে, তারা সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য যুদ্ধ করছেন। এটা জেনেছেন তারা ১৯৭২ এর শেষে স্বাধীনতা যুদ্ধেরও আরো এক বছর পরে। কারণ সংবিধানে এই কথা লিখে দেওয়া হয়েছে যে, যে সব কারণে আমাদের দেশের আবাল, বৃদ্ধ, নওজোয়ানরা মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ধর্মনিরপেক্ষতা। এটা সংবিধানে লেখা আছে।
এর আগ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না যে, আমাদের দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক দলিলে সেটা নেই। আপনি আমাদের দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইগুলো, পৌরনীতির বইগুলো পড়লে এর যথার্থতা খুঁজে পাবেন। এছাড়া স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানী জনগণ বহু আন্দোলন করেছে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অনেক আন্দোলন হয়েছে। ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ হয়েছে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। ৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন হয়েছে। এগুলোর কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার নাম-গন্ধও ছিল না। এমনকি আপনি বর্তমান সময়ের (যখন দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়) মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট দেখুন। সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা পাবেন না। সুতরাং অত্যন্ত দৃঢ়তা ও আস্থার সাথে বলা যায় যে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিখিত নিম্নলিখিত বাক্যটি বাস্তবসম্মত নয়।
‘‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল … ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’’
সম্ভবত এ কারণেই স্বাধীনতার ঘোষণাকারী মতান্তরে ঘোষণা পাঠকারী জেডফোর্সের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রথম সুযোগেই এটিকে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন এবং পরবর্তীতে অনেক সেক্টর কমান্ডারকেই জনগণ ধার্মিকরূপে পেয়েছে।
সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিদায়
শেখ মুজিব সরকারের সময়েই সংবিধানে ৪টা সংশোধনী হয়ে গিয়েছিল। এরপর জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের আইন থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে দেন এবং তার স্থলে ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাক্য স্থাপন করেন। দুই যুগেরও বেশি সময় পর্যন্ত সংবিধানে এ বাক্যটি ছিল। এমনকি ১৯৯৬-২০০১ সময়ের আওয়ামী লীগ আমলেও।
‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাদ গেল, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আবার এল
এরপর হঠাৎ একদিন দেশের ধর্মপ্রাণ নাগরিকগণ অবাক বিস্ময়ে শুনলেন যে, তাদের সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাদ দিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ পুনঃস্থাপিত হয়েছে এবং এ কাজটি করেছেন দেশের উচ্চ আদালত। যদিও আদালতের রায় প্রকাশ করতে গিয়ে মিডিয়াগুলো বলেছে, ৫ম সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। বরং ৫ম সংশোধনীর অনেক কিছুই আদালত বহাল রেখেছেন। বাছাই করে করে কিছু জিনিস বাতিল করেছে আর কিছু জিনিস আগের মতোই রেখে দিয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, বিচারপতি খায়রুল হক সাহেবের আদালত এ কাজটি করেছে স্বউদ্যোগী হয়ে। তার কাছে কেউ এ ব্যাপারে আবেদন বা মামলা করেনি। বরং একটি সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত্র মামলার রায় দিতে গিয়ে তিনি কাজটি করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে সরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে এনেছেন।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরপরই বর্তমান সরকার সে অনুযায়ী সংবিধান মুদ্রণ করে এবং এরপর ১৫তম সংশোধনী এনে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনরায় স্থান করে দেয়। এভাবে উৎফুল্ল হয়ে উঠে দেশের একশ্রেণীর ধর্মবিদ্বেষী শ্রেণী, ধর্মবিরোধী গণমাধ্যমগুলো। আর উপেক্ষিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা। … আমাদেরকে ইতিহাস জানতে হবে, মনে রাখতে হবে এবং অনুধাবন করতে হবে। কে কোন কাজটি কোন মতলবে করছে তা বুঝতে হবে। আজকে আমার মূল আলোচ্য বিষয় সেটি নয়। আমি শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে সেকুলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে দুচারটা কথা বলব।
ধর্মনিরপেক্ষতাটা বেশি দিন আগের পরিভাষা নয়। অনেক আগ থেকে তা শুরু হয়েছে এমন নয়। ফরাসী বিপ্লবের পরের ঘটনা এগুলো। বিপ্লবটা ১৭৮০/১৭৯০এর দিকের অর্থাৎ ১৮০০ এর কাছাকাছি সময়ের। ইসলামী খেলাফতের পতনের পরের ঘটনা।
ইসলামী খেলাফত শেষ হওয়ার পর মুসলমানরা এসবের সম্মুখীন হয়েছে। আর পশ্চিমাবিশ্ব যখন তাদের পার্থিব উন্নতি ও মনোরঞ্জনের পথে কিছু কিছু জায়গায় চার্চগুলোতে তাদের ধর্মীয় নেতাদেরকে তাদের বিরোধী মনে করেছে তখন থেকে এ ধরনের চিন্তা কারো কারো মাথায় চাড়া দিয়ে উঠেছে এবং ধীরে ধীরে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির প্রসার ঘটেছে।
সেকুলারিজম মুসলমানদের মধ্যে
মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে মুস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্ক (জন্ম : ১৮৮১, মৃত্যু : ১৯৩৮)। ১৯ শতকের শুরুতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।
মুসলমানদের সর্বশেষ দারুল খিলাফা তুরস্কে বসে ঐ লোকটি এ কাজ করেছিল। তার ক্ষমতার মেয়াদকাল ছিল ১৯২৩-১৯৩৮ পর্যন্ত। তখনকার সময়ে সেকুলারিজমটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ঐ ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে পুঁজি করে কত কি সংঘটিত করেছে তা ভাবলেও গা শিউরে উঠে। সে বিষয়ে একটু পরে আরো কিছু কথা হবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লামা ইবনে খালদুন সিয়াসাতকে তিন ভাগ করেছেন
১। সিয়াসাতে তাবয়ী (السياسة الطبعية) সেটা হল فوضي অর্থাৎ যার যার মন মতে চলবে কেউ কারো কর্তৃত্ব মানবে না।
২। (السياسة الملكية) অর্থাৎ এমন একটা ব্যবস্থাপনা থাকবে যে অনুযায়ী মানুষ জাগতিক বিষয়গুলো একটি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করবে। বর্তমানের ধর্মনিরপেক্ষতা তেমনি একটি নীতি।
৩। আলখিলাফাহ যেটা মানুষের পার্থিব-অপার্থিব ও ইহ-পরলৌকিক উভয় কল্যাণ নিশ্চিত করে। এরকম একটা নেযামের নাম খিলাফত।
আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষ লোকেরা দুই ধরনের।
১. ধর্মবিদ্বেষী ও ধর্মদ্রোহী লোকজন। অনেক কট্টর বামপন্থী এ শ্রেণীর আওতাভুক্ত।
২. আরেক শ্রেণী আছে যারা জায়গা বুঝে কথা বলে। আত্মরক্ষার জন্য যারা ভদ্র সাজে। ভদ্র বলতে যারা একটু রাখঢাক করতে চায়। এরা বলে ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা নয়। এরা ধর্মনিরপেক্ষতাও রাখবে আবার ধর্ম ওয়ালাদের নারাজও করবে না। এদের উদাহরণ হল।
رحمن بهى راضى رہے اور شيطان بهى بے زار نہ ہو۔
আল্লাহও রাজি থাকুক, কিন্তু শয়তানও অসন্তুষ্ট না হোক।
এরা মানুষকে বলে বেড়ায় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়; বরং এর উদ্দেশ্য হল, রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না; ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার ইত্যাদি। এ লোকগুলো একদিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার আসল সংজ্ঞাকে গোপন করে, অন্যদিকে নিজেদের আসল মতলবকে গোপন রেখে ধর্মপ্রাণ ও ধর্মবিরোধী উভয় গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখতে চায়।
আমরা আজকে বিশ্লেষণ করব যে, ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে ধর্মহীনতা নাকি ধর্মহীনতা নয়। কার কথাটা ঠিক? ধর্মনিরপেক্ষদের দেখলাম যে, তারা বিভিন্ন ধরনের কথা বলে। এটা তো এই দেশীয় বক্তব্য। অথচ সেক্যুলারিজম তো এদেশে শুরু হয়নি। এ দেশের আগেই এ নীতি প্রচার পেয়েছে। আমরা পড়া-শোনা কম করি তাই অন্যরা আমাদেরকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়।
উপরোক্ত দু’টি পক্ষই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখতে বদ্ধপরিকর। অথচ যে দুই যুগের বেশি সময় সংবিধানে এ জিনিসটি ছিল না তখন কি এদেশে শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সহাবস্থান ছিল না। ঐ সময়ের মধ্যে তো আওয়ামী লীগও ৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। তারা কি দেশে ধর্মীয় সৌহার্দ্য বজায় রাখতে কোনো সমস্যায় পড়েছিল। দুটির উত্তরই ‘না’। তাহলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানে ফিরিয়ে আনার পিছনে নিশ্চয়ই আরো অনেক উদ্দেশ্য লুকায়িত, যা বুঝতে হলে আপনাকে দৃষ্টি দিতে হবে, মুসলমানদের খেলাফত পরবর্তী অবস্থার দিকে। চোখ ফেরাতে হবে একসময়ের তুরস্ক, ইরাক, মিসর ও সিরিয়ায়।
আমি আগেই বলেছি যে, আদালতে ৫ম সংশোধনী বাতিল হয়েছে বলা হলেও আসলে এর অনেক কিছুই বাতিল হয়নি। এমনকি অনেক মৌলিক বিষয়ও নয়, যেমন ৫ম সংশোধনী দ্বারা ৪র্থ সংশোধনীকে বাতিল করা হয়েছিল। তৎকালীন মুজিব সরকার ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক দল বানিয়েছিল। সেটা হল বাকশাল। আর সকল পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে সরকার নিজের মালিকানায় চারটি পত্রিকা চালু রেখেছে। রাজনৈতিক দল বা জনগণ ছাড়াও সরকারী কর্মকর্তাদেরও আবশ্যিকভাবে বাকশালে যোগ দেয়াকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীতে ঐ সব বাতিল করে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সম্মানিত আদালত যখন ৫ম সংশোধনী বাতিল করেন তখন তিনি এ অংশটুকু বহাল রেখে দিয়েছেন।
যদি পুরো ৫ম সংশোধনী বাতিল করা হত তাহলে ৪র্থ সংশোধনী ফিরে আসত এবং দেশে পুনরায় একদলীয় বাকশালি শাসন চালু হত। মানুষ হরতাল, অবরোধ থেকে রেহাই পেত আর বর্তমান সরকারী দল অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়ে দ্রুত দেশকে উন্নত করে ফেলতে পারত। নির্বাচন কমিশনকে বদনাম হতে হত না বিরোধী দলবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে। যাহোক, ঐ সংশোধনী বাতিলের অন্যতম উদ্দেশ্যই হয়তো ছিল ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসে’র স্থলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বসানো।
প্রসঙ্গের টানে আরেকটি কথা বলি, ১৫ তম সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তর সালের সংবিধানে ফেরত যাওয়ায় রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যে ‘সমাজতন্ত্র’ও ফিরে এসেছে। কিন্তু সকলেই জানে যে, বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণ পুঁজিবাদী একটি রাষ্ট্র। বাহাত্তর সালে সংবিধানে যখন সমাজতন্ত্র ছিল তখন তো বিশ্বের বড় বড় দুটি রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র চালু ছিল, এখন সেগুলো ধনতন্ত্রের স্বর্গরাজ্য। অথচ আমরা এখন ফিরিয়ে এনেছি ‘সমাজতন্ত্র’। কিন্তু চলছি পুঁজিবাদী নীতিতে। এটা নিয়ে কোন বিশ্লেষণ নেই, ঝগড়া-ঝাটিও নেই। সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর কয়েকজন তো এখন জোট সরকারেই আছে, মন্ত্রীও আছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রধান এখন মন্ত্রী। মেনন সাহেবরাও মন্ত্রী। জাসদের সেক্রেটারী সংসদ সদস্য। মেনন সাহেব, বাদল সাহেব, ইনু সাহেবরা কি কখনো সংসদে এ কথা উঠিয়েছেন যে, সংবিধানে এখন তো সমাজতন্ত্র আছে। সুতরাং দেশের পুরো অথনীতি সমাজতন্ত্র অনুযায়ী হতে হবে। খোদ আওয়ামী মন্ত্রী বা নেতাদের মধ্যেও সম্পূর্ণ কমিউনিস্ট মানসিকতার যারা আছেন তারাও তো এমন কথা বলেননি। তেমনি বাইরের বড় বড় বুদ্ধিজীবি, গণমাধ্যম ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ যারা তারাও তো সরকারের কাছে এই দাবি তোলেননি। কেন? কেউ তো আদালতে রিটই করে দিতে পারত? সংবিধানের মৌলিক নীতি হল সমাজতন্ত্র তোমরা চলছ ক্যাপিটালিজমে, অর্থাৎ ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদী নীতিতে।
এত মোক্ষম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রীরা কেন এই দাবি উঠায় না। এর চেয়ে বড় মোক্ষম সুযোগ আর কোথায়? আসলে না আদালতের এ নিয়ে কোন মাথাব্যাথা আছে, না তাদের। তারা বরং ধর্মনিরপেক্ষতা পেয়েই আপাতত অন্য বিষয়ে ছাড় দিতে প্রস্ত্তত। আসল বিষয় হল সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের শুরুতে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস বড়ই বেমানান। আর ধর্মনিরপেক্ষতাটা রাখা অনেক কিছুর জন্যই প্রয়োজনীয়। এ প্রয়োজনেই সংবিধানের সংশোধনী এসেছে।
‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রতিস্থাপন। না হয় আদালত যখন বাছাই করে করেই বাতিল করলেন ও রাখলেন তখন তিনি এ অংশটুকুও তো রেখে দিতে পারতেন।
ওটা বসালে লাভ কী?
আমাকে কেউ বলেছিল, মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংবিধানে থেকেই বা লাভ কী? সংবিধানে তো ইসলাম বিরোধী অনেক কিছুই আছে। দেশে তো আর ইসলামী হুকুমত নেই, কখনো ছিলও না। তাহলে অতটুকু কথা বাদ দিলেই বা কী এসে যায়? আপনি কেন এর বিরোধিতা করছেন? আমি বলি, ঠিক যে কারণে ওরা সংবিধান থেকে বিষয়টি তুলে দিতে চায়। মহান আল্লাহ তাআলার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস যদি কোনো কাজেই না আসত তাহলে কেন তারা এটি সরিয়ে দিতে চায়? ওটা সরিয়ে দেওয়ার কারণে কি কোনো বদনাম হতে হচ্ছে না। তারপরও তারা এ ঝুঁকি নিল কেন?। কিছু কথা আছে খুব সহজেই বুঝে আসে। অনেক দূরে গিয়ে বোঝার দরকার হয় না। সরকার কেন ওটাতে হাত দিচ্ছে? এতেই বুঝা যায় যে, এতটুকু বাক্য সংবিধানে থাকারও কিছু মূল্য আছে।
সুতরাং কালো এবং সাদার পার্থক্য বুঝতে হবে। আলো-অন্ধকারকে একাকার করা যাবে না। যদিও সেটা হয় আলোর রেখাপাতমাত্র। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা মতলববাজরা যা দেওয়ার দিক, আলেম-ওলামাদেরকে থাকতে হবে সতর্ক। কিছুতেই বলা চলবে না ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়; বরং বিষয়টি দেখতে হবে বাস্তবতার নিরিখে, সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি দিয়ে। আমরা মনে করি যে, আমাদের এখন যে আলেমপ্রজন্ম আছে এরা গলদ বুঝ নিয়ে ওদিকে অগ্রসর না হোক। তাদেরকে ভবিষ্যতে এ বিষয়গুলোর সম্মুখীন হতে হবে আরো বেশি।
২০০৬-২০০৮ তত্ত্বাবধায়ক সময়ের একটি ইসলামী দল ও একটি ধর্মনিরপেক্ষ দলের জোটবদ্ধ হওয়া এবং ঐ ইসলামী দলটি কর্তৃক ধর্মনিরপেক্ষতার গলদ ব্যাখ্যা দেওয়ার পরই মনে হয়েছিল যে, সেক্যুলারিজম সম্পর্কে মাদরাসাগুলোতে পড়াশোনা থাকা দরকার এবং এ বিষয়ে আমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত।
তুরস্ক এর উদাহরণ
ধর্মনিরপেক্ষতার বাতিক একটি জাতিকে কত উঁচু থেকে কত নীচুতে নিক্ষেপ করতে পারে তার নযীর আপনি দেখতে পারেন একসময়কার সালতানাতে উসমানিয়ার রাজধানী তুরস্কে। এটি ঐ তুরস্ক, যে শাসন করেছিল হারামাইন শরীফাইনসহ পৃথিবীর একটি বিশাল অংশ। শত শত বছরের সে উসমানী খেলাফতের কেন্দ্রবিন্দুই শেষের দিকের সুলতানদের অযোগ্যতা-অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কামাল আতাতুর্ক হলেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আদর্শ ব্যক্তি, যিনি এই তুরস্কেই সেক্যুলারিজমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। আতাতুর্ক সাহেব তুরস্কে কী কী ঘটিয়েছিলেন হয়ত অনেকেরই জানা থাকবে। বিশেষ করে যাদের ইতিহাস নিয়ে নাড়া-চাড়ার অভ্যাস রয়েছে।
খুব সহজ একটা উদাহরণ হল আযান। আযানের ভাষাও ওখানে বদল করে দেওয়া হয়েছিল। মাইকে দেওয়া তো নিষিদ্ধই ছিল। তুর্কি ভাষায় আযান দেওয়া হত। দারুল খিলাফা হওয়ার কারণে সেখানে অসংখ্য মাদরাসা ছিল। সেগুলো সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মানুষ গর্তের ভিতরে থেকে থেকে কুরআন শিক্ষা চালু রেখেছিল। ওদের বর্ণমালা ঠিক আরবীর মতোই ছিল। এখনো তুর্কী ভাষায় লেখা বই-পত্র পাওয়া যায়। কিন্তু আতাতুর্ক সে বর্ণমালাকে নিষিদ্ধ করে রোমান অক্ষর চালু করেছেন। এখন সেখানে রোমান লিপি চলে। অর্থাৎ ইংরেজী অক্ষরে তুর্কী ভাষা লেখা হয়। এই ভদ্রলোক শুধু ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তৈরি করে এবং ইসলামী শিক্ষা বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি; বরং সে দেশের প্রতিরক্ষা তথা আর্মি ও আদালতকে কড়া সেক্যুলার বানিয়ে গেছেন। কঠোরহস্তে সেখানে সেক্যুলারিজমের ধর্ম ও ধর্মওয়ালাদের বিরুদ্ধে একপক্ষীয় যুদ্ধ করা হয়েছে। কেননা ধর্মের পক্ষের লোকজন ছিল অস্ত্রশস্ত্রহীন। হাজার হাজার লোককে প্রহসনের বিচার করে-বিনা বিচারে মেরে ফেলা হয়েছে। এভাবে সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে সেক্যুলারিজম। আর আর্মি ও আদালতকে এত কড়া সেক্যুলার বানানো হয়েছিল যে, তারা কোনো ধার্মিক তো দূরে থাক কোনো ধর্মীয় দলকে ক্ষমতা দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো দাড়িওয়ালা বা কোনো হিজাব পড়ুয়া মহিলার স্বামীকেও রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করেনি; যদিও তাদের কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনেই ঐ ব্যক্তিরা জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত দলকে নিষিদ্ধ করে দিতে কোনো দ্বিধাই করেনি ঐ শক্তিগুলো।
এসব থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে। অন্যদেরকে সতর্ক করতে হবে এবং যারা মজলুম তাদের জন্য আশার বাণী হচ্ছে, তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতি। যেখানে ঐ অপশক্তিগুলোর হুংকার কমে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু সেটি ঘটেছে অসংখ্য শহীদের রক্ত, মজলুমানের কান্না, অসীম ধৈর্য্য ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পর। এ তুর্কিতেই একসময় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হত পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে। পার্লামেন্ট নির্বাচনে সেক্যুলার আর্মি বড় বড় অফিসাররা পাহারাদারি করত। প্রায় বিশ-ত্রিশজন বড় বড় আর্মি অফিসারের রাঙ্গানো চোখের সামনে দিয়ে ভোট দিতে হত। ভোটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বসে থাকত লোকগুলো। এভাবে তারা যতদিন পেরেছে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
বর্তমান সরকার অনেক ধৈর্য ও কৌশলের বিনিময়ে ক্ষমতায় বসেছে। বিভিন্ন কারণে কয়েকবারই দলের নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে। কখনো দেশের সংবিধানের সাথে মিল নেই বলে, কখনো দেশের মেযাজের সাথে মিল নেই বলে, এই সেই বলে পুরো দলকেই অযোগ্য ঘোষণা করে দিয়েছে আদালত ও আর্মিরা। তারপরও তারা ধৈর্য হারায়নি। চেষ্টা ও মেহনত অব্যাহত রেখেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার মেহেরবানিতে এখন সেখানে পরিবর্তন ঘটছে। ২ বছর আগের তুরস্ক সফরে সেখানকার মুসলিম ভাইবোনদের অবস্থা কিছুটা দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছিল। সেখানকার ধর্মপ্রাণ হাজার হাজার নরনারীর এখনকার আনন্দাশ্রু দেখে আমার মনে হয়েছে, এটি আসলে আতাতুর্কের দুঃখের কান্না। এতদিন লোকটি বেঁচে থাকলে তার মিশনের সমাপ্তি দেখে যে কান্নায় জড়াত সেটিরই প্রতিচ্ছবি হয়তো এই খুশির কান্না। তবুও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। ধৈর্য, কৌশল ও মেহনত এবং সর্বোপরি আল্লাহর রুজ্জুকে আকড়ে রাখার হাতিয়ার ছেড়ে দিলেই বিপদ।
প্রসঙ্গ মিসর
ঐতিহ্যবাহী দেশ মিসরের সর্বপ্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসী। রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে। এর আগে মিসরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিল না। আগের সরকারগুলো রাষ্ট্রীয় ফরমান, সামরিক ফরমান জারি করে ক্ষমতায় ছিল। ড. মুহাম্মাদ মুরসী পশ্চিমা লোকদের বড় বড় আস্থাভাজন, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বড় বড় ব্যক্তিদের মোকাবেলা করে নির্বাচিত হয়েছেন। এভাবে নির্বাচিত হওয়ার পরও অনেক চড়াই উৎরাই এবং প্রাণহানির পর ক্ষমতায় বসেছেন। কিন্তু একটি দিনের জন্যও তাঁকে শান্তিতে রাষ্ট্র চালাতে দেওয়া হয়নি। আদালত ও সামরিক বাহিনীর নগ্ন হস্তক্ষেপ এবং সেক্যুলার ও বেদ্বীন তথাকথিত সুশীলদের বহুমুখি ষড়যন্ত্র চলেছে সমান্তরালে এবং শেষ পর্যন্ত বন্দুকের জোরে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্ধকার কারাবাসে পাঠানো হয়েছে। এসব কী? এসবই হল সেক্যুলারিজমের বদ-আছর। এভাবেই সেক্যুলার শক্তিগুলো যুগে যুগে দেশে দেশে ষড়যন্ত্র ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে মুসলমান ও ইসলামপন্থীদের দমিয়ে দিচ্ছে। তাদের গণতন্ত্র-মানবাধিকার এক্ষেত্রে অন্য কোনো অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
স্বদেশ পরিস্থিতি
এদেশের কিছু লোক আগেও ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, এখনো আছে। কিন্তু তারা কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। বিশাল ধর্মপ্রাণ মানুষের তুলনায় তাদের সংখ্যা খুবই কম। অথচ এ সংখ্যালঘুদের মতবাদই এখন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরো দেশের উপর। সময় কম। আমি সেক্যুলারিজমের প্রভাবে ঘটে যাওয়া শুধু দু’একটি নযীর পেশ করব।
আমাদের শিক্ষা কমিশন
প্রথমে বলে রাখি, একটা শিক্ষা কমিশন গঠন থেকে শুরু হয়ে কমিশনের রিপোর্ট হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। কমিশনের সদস্য ও সহযোগীরা পৃথিবীর বহু দেশ সফর করেন। তারা ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষানীতি স্বচক্ষে দেখে সে অনুযায়ী এদেশের শিক্ষানীতি তৈরি করেন। এভাবেই কাজ করেছে এ দেশের সর্বশেষ শিক্ষা কমিশন।
প্রত্যেক শিক্ষানীতিরই কতগুলো উপাদান থাকে, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। আমাদের শিক্ষানীতির মূল আদর্শ বানানো হয়েছে সেক্যুলারিজমকে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে মাথায় নিয়ে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে তা উল্লেখও করা হয়েছে। অবশ্য ওটা যদি শব্দে ব্যবহার না করত তবুও তা স্পষ্ট ছিল।
আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো শিক্ষা কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তিন জায়গাতেই পাকাপোক্ত কড়া বাম ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেব ভদ্র লোক। তিনি সমাজতান্ত্রিক দলের বড় নেতা ছিলেন। বেশি বছর হয়নি আওয়ামীলীগে যোগ দিয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন, যৌবনের পুরো অংশই পার হয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে।
শিক্ষা কমিশনের প্রধান ছিলেন কবীর চৌধুরী সাহেব। পরলোকগত হয়ে গেছেন। এ লোক আযানকে কিসের সাথে তুলনা করেছিলেন আপনারা হয়তো জানেন। এসব কথা তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান রাশেদ খান মেনন সাহেব। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা কারো অজানা নয়। যে দেশের শিক্ষা খাতের তিনটি স্তম্ভে এমন ব্যক্তিরা থাকবেন সে দেশে কেমন শিক্ষানীতি ও শিক্ষা চলবে তা সহজেই অনুমেয়। আগে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মুসলমান শিক্ষার্থীদের অনেকে এ বলে অনুযোগ করত, দুঃখ করত যে, তাদের কোনো কোনো স্যার প্রকাশ্যেই ইসলাম ও কুরআন-সুন্নাহ নিয়ে বিদ্রূপ, কটাক্ষ করেন। তা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বুঝমান শিক্ষার্থীদের সমস্যা। কিন্তু এখন আর ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ শোনার জন্য আপনাকে কলেজ-ইউনিভার্সিটি যেতে হবে না। বর্তমান শিক্ষানীতি শিশু শ্রেণী থেকেই মুসলিম ছেলেমেয়ের সেক্যুলার আদর্শে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়েছে। সেভাবেই তৈরি হয়েছে বইপত্র। গত বছর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষা কারিকুলাম ঠিক করতে গিয়ে জেনারেল বিষয়গুলো সরকারি বোর্ডের বই থেকে পড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই বিদ্যালয়ের শিক্ষা-বিভাগের নেগরান সাহেব দেখতে পান বর্তমান সময়ের প্রাথমিক বই ও পূর্বেকার বইগুলোর পার্থক্য। কোমলমতি শিশুদের অঙ্কুর থেকেই শিরকী ভাবধারায় গড়ে তোলার মতো যথেষ্ট উপাদান এই বইগুলোতে রয়েছে।
প্রসঙ্গ বোরকা
কয়েক মাস আগের কথা। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী হয়ে সেক্যুলারিজম প্রতিস্থাপিত হয়েছে মাত্র। কিছু দিনের মধ্যে উচ্চ আদালত ‘সুয়োমটো’ (কারো আপিলের অপেক্ষা না করে স্বপ্রণোদিত রুল) জারি করলেন। বিচারক সাহেব বললেন, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদেরকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। এটা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। এ দেশের সংবিধান অনুযায়ী উচ্চআদালত যা বলবেন তা-ই আইন। ভালো যে, পশ্চিমা কোনো রাষ্ট্রের মতো এখানে বোরকা নিষিদ্ধ হয়ে যায়নি। তবে বিজ্ঞ বিচারক যে যুক্তি দিয়েছেন তা লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, যেহেতু আমাদের রাষ্ট্র হল ধর্মনিরপেক্ষ তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদেরকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা বুঝতে কারো অসুবিধা হলে এ ধরনের দু চারটা নজির মনে রাখলেই হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষতিটা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, এই শব্দটাকে গলদভাবে ব্যবহার করে আরো কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে তা দেখার জন্য হয়তো বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি শুধু চোখ-কান খোলা রাখুন, কয়েক দশকের ইতিহাস দেখুন, স্বদেশী লোকজনের হাতে নিরীহ ধর্মপ্রাণ লোকদের হতাহতের চিত্র দেখুন এবং সেক্যুলার গণতন্ত্রবাদী, মানবতাবাদী, স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করুন। তারা কোন খবরটা কীভাবে ছাপছে, কোন বিষয়টা কীভাবে বিশ্লেষণ করছে তা খেয়াল করুন। এভাবেই একটি দেশের প্রতিরক্ষা, আইন-আদালত, শিক্ষা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো পাকাপোক্ত সেক্যুলার হয়ে উঠে এবং পরের কাজগুলো স্বাভাবিক গতিতেই চলতে থাকে। তখন মুরসী, এরদোগান, আবদুল্লাহ গুলদের দেশের অধিকাংশ লোক ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলেও তারা হয়তো ক্ষমতায় বসতেই পারেন না, না হয় ক্ষমতাচ্যুত হন। স্বদেশের ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচনের ব্যাপারে মন্তব্য করার দরকার আছে বলে মনে করি না। কিন্তু আপনি এর পরের অবস্থার প্রতি নজর দিন। দেখুন নির্বাচিত (!) ব্যক্তিগণ বেশি খুশি নাকি তাদের সমর্থক শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গ ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা বেশি আনন্দিত। কারণ এ ক্ষেত্রে মানবাধিকার-গণতন্ত্র সবই নস্যি। নিজেদের মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করার মোক্ষম সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চান না।
তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
আমাদের এখানে কেউ লিখেছেন কি না জানি না, তবে আরব বিশ্বের কোনো কোনো ডক্টর-প্রফেসর ধর্মনিরপেক্ষতার সপক্ষে বইপত্রও লিখে ফেলেছেন। তারা নিজেদেরকে আলেমও মনে করে থাকেন এবং নিজেদের বক্তব্যের সপক্ষে কুরআন-হাদীসের দলিল দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন। তারা বলেন যে, ইসলাম নামায, রোযা, ইবাদত-বন্দেগী কীভাবে আদায় করবে তা শিক্ষা দেয়, কিন্তু রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে তা ইসলাম বলেনি। সুতরাং ইসলামে রাজনীতি নেই। (এ কথাটাই আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো এভাবে বলে যে, ধর্ম পবিত্র জিনিস। রাজনীতি থেকে এটাকে আলাদা রাখতে হবে।) যা হোক, ঐ আরব সেক্যুলার আলেমদের বক্তব্য হচ্ছে ইসলাম ইবাদত বন্দেগীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচার প্রক্রিয়া, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ধর্মকে টেনে আনার কথা ইসলামে নেই।
হাদীস দ্বারা দলিল
এরা আমাদের দেশের কারো কারো মতো ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’ (শুনেছি কেউ কেউ নাকি নিজেদের ভাষণে সূরা কাফিরূনের এই আয়াতকে বুখারী শরীফের হাদীস বলে থাকেন) দ্বারা দলিল পেশ না করলেও ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপক্ষে দু’ একটি হাদীসও পেশ করে থাকেন। এমনই একটি হাদীস হল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদ-
أنتم أعلم بأمور دنياكم
হাদীসের প্রেক্ষাপট হল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তাবীরুন নাখল (খেজুর চাষ সংক্রান্ত একটি বিশেষ পদ্ধতি) বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হলে তিনি তা অপছন্দনীয় বলেছেন। পরবর্তী বছরে ফলন কম হলে তখন তিনি বলেছিলেন-
إذا أمرتكم بشيء من أمر دينكم فاتبعوه
অর্থাৎ দ্বীনি বিষয়ে বললে সেটা শুনো, মানো। আর দুনিয়াবী বিষয়ে কিছু বললে মনে করবে তোমাদের এসব বিষয়ে তোমরাই ভালো জান।
এটা তাদের বড় দলিল। কেননা আল্লাহর রাসূল নিজেই বলেছেন যে, দুনিয়াবী বিষয়ে আমার কথা তোমরা শুনলেও শুনতে পার আবার নাও শুনতে পার। যদি সকল বিষয়ে তার নির্দেশনা মানা আবশ্যিক বিষয় হত তাহলে এখানেও আবশ্যিক হত।
শরীয়তের মেযাজ, খেতাব সম্পর্কে যারা অবগত তাদেরকে এসব কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তারা নিজেরাই তা সহজে বুঝতে পারে।
উপরোক্ত হাদীসটির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু তরজমা দেখেও যে কেউ বুঝে নিবেন যে, এখানে কোনো কৃষিনীতি পেশ করা হয়নি। বরং খেজুর বাগানে ফলন বৃদ্ধির একটি বিশেষ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, যা নিতান্তই একজন কৃষকের নিজস্ব ব্যাপার। ঠিক যেমন একজন কৃষক তার ক্ষেতে ধান চাষ করবে না গম, সাধারণ জাতের চাষ করবে না হাইব্রিড-এগুলো তার একান্ত বিষয়। যে পর্যন্ত জনস্বার্থের ক্ষতি না হবে ইসলাম তার কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। কৃষকের এ স্বাধীনতাকে ধর্মনিরপেক্ষতার দলিল বানানোর যৌক্তিকতা কোথায়?
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো সে প্রেক্ষিতেই বলেছেন-
أنتم أعلم بأمور دنياكم
তোমাদের দুনিয়াবি বিষয়গুলো তোমরাই ভালো জান।
তাদের এ সকল বক্তব্যের খন্ডন তখনই হয়েছে। বিজ্ঞ আলেমরা যুক্তিপূর্ণ জবাব দিয়েছেন। ইসলামের এটা বৈশিষ্ট্য। হাদীস শরীফে এসেছে-
لا تزال طائفة من أمتي منصورين على الحق
অর্থাৎ আমার উম্মতের একটা দল সর্বদা হকের উপর বিজয়ী থাকবে। তারা সব যুগেই ছিল, থাকবে।
অন্য হাদীসে আছে,
يحمل هذا العلم من كل خلف عدوله
এরা যুগে যুগই ছিল। ওরা বই লিখেছে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও আলেমরা এর কঠোর প্রতিবাদ করেছে।
কারাফীর কিতাব থেকে দলিল
তারা ইমাম কারাফীর কিতাব ‘আলইহকাম’ থেকেও দলিল দিয়ে থাকেন। সেক্যুলারিজমের কিছু কিছু লোক দাবি করেছেন যে, ইসলামের বড় বড় পন্ডিত, উসূল ও ফিকহবিদগণও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। তার নজির হিসেবে তারা ইমাম কারাফী রাহ.কেও পেশ করেছেন।
ইমাম কারাফী রাহ. তাঁর কিতাবের ২৫ নং প্রশ্নোত্তর অধ্যায়ে খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কার্যাবলির কোনো কোনোটি নবী হিসেবে করেছেন, কোনোটি দাঈ-মুবাল্লিগ হিসেবে, কোনোটা হাকেম-রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। কোনোটা কাযী ও বিচারক হিসেবে। আবার কোনোটা বাশার বা মানুষ হিসেবেও করেছেন। এ কথাগুলো খুবই সুস্পষ্ট। কারাফী রাহ. বিভিন্ন হাদীসের উদাহরণ দিয়ে বিষয়গুলো বুঝিয়েছেন। ঐ অধ্যায়টি ভালোভাবে পড়ে নিলে হাদীসের কিতাবগুলো বোঝাও সহজ হয়ে যাবে।
কিন্তু কোনো কোনো গবেষক (!) ইমাম কারাফী রাহ.-এর এ কথাগুলোর উল্টো ব্যাখ্যা করেছেন। তারা বলেছেন, আল্লাহর রাসূল যে কাজগুলো নবী হিসেবে করেছেন সেগুলোই শুধু মুসলমানদের পালনীয় বিষয়। তিনি রাষ্ট্রনায়ক ও বিচারক হিসেবে যা করেছেন তা ইসলামের অন্তর্ভুক্ত বিষয় নয়।
অর্থাৎ তাদের দাবি হল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাযী হিসাবে, হাকেম হিসাবে যা যা করেছেন তার কোনোটিই অনুসরণীয় নয়। (হ্যাঁ, অনুসরণীয় হতে পারে ঐ অ্যারিস্টটল ও আব্রাহাম লিংকনের মত। তাদের মতো ওনাকেও একজন দক্ষ ব্যক্তি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। ইনিও একজন বড় রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন।)
গোড়াটা কিন্তু ঐ জায়গায়। অর্থাৎ এই মতবাদ মানলে শরীয়তের বড় একটা অংশকে অস্বীকার করে দিতে হয়। এটাকে গভীর থেকে দেখতে হবে তাহলে এর ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আমাদের দেশের রাজনীতি বা বিশ্ব রাজনীতির এবং রাজনীতিবিদদের অনেক কথাই আছে স্থূল, যা শুধু বলার জন্যই তারা বলে, মানুষ এগুলোকে হালকাভাবে দেখেই অভ্যস্ত। ধর্মনিরপেক্ষতাকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ নেই। এর ক্ষতিটা যে কত গভীর ও ব্যাপক হতে পারে তা অনুধাবন করা বিবেকবান মানুষের কতর্ব্য। কারাফী রাহ.-এর কিতাব থেকে দলিল দেওয়া লোকদের কথার আরো কিছু জবাব একটু পরে বলছি।
আলোচনার শুরুতে আমি এনসাইক্লোপিডিয়ার উদ্ধৃতিতে প্রথমেই দেখিয়েছিলাম যে, তারা সেক্যুলারিজম অর্থ করেছে অহঃর ওংষধস। আসলে খুব সহজে চিন্তা করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে আসে। কেননা ধর্মনিরপেক্ষতা যখন থেকে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে তখন কিন্তু অন্যান্য ধর্মওয়ালারা রাষ্ট্রের সাথে লড়াই করেছে এমন নয়। রাষ্ট্রের আইন নিয়ে তো তাদের কোনো মাথাব্যাথাই ছিল না। খ্রীষ্টানরা তো তাদের ধর্মকে চার্চকেন্দ্রিক করে ফেলেছে আগেই। আরবদের ভাষায়-
دع ما لقيصر لقيصر وما لله لله
অর্থাৎ ধর্ম মসজিদ পর্যন্ত আর রাষ্ট্র পরিচালিত হবে রাষ্ট্রনায়কদের মাধ্যমে। একটার সাথে আরেকটার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এতকিছুর পর আবার ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে দূরে রাখার কেন দরকার হল?
খুব স্পষ্ট কথা। রাষ্ট্র থেকে ইসলামকে দূরে সরিয়ে রাখাই আসল উদ্দেশ্য। কেননা একমাত্র ইসলামের নীতিমালাই তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
মুসলিম শাসকদের ইসলামী নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। গোটা পৃথিবীর অনেক অংশই যখন সভ্যতা বিবর্জিত ছিল ইসলামই তখন সভ্যতার রাস্তা দেখিয়েছে। সত্যিকারের রাষ্ট্রব্যবস্থা যে অন্য যে কোনো নীতি থেকে হাজারো গুণ ভালো তা ইসলাম দেখিয়ে দিয়েছে। মূলত এটাই ছিল তাদের বাধা। এ কারণেই হয়তো সেক্যুলারিজমকে Anti Islam বলা হয়েছে। Anti Religion নয়। ধর্মবিরোধী নয়, আসলে ইসলাম বিরোধী। এই সত্যটাকে অনুধাবন করতে হবে। কারণ ধর্মের কথা তারাও বলে। তবে ওটা বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করা পর্যন্তই এবং ডলারের গায়ে In God we trust লিখে দেওয়া পর্যন্তই। অবশ্য এতটুকুতেই ওরা খুশি। এর বেশি দরকারও মনে করে না। তো সেক্যুলারিজম দরকারই হয়েছে ইসলামকে ঠেকানোর জন্য। এ কারণেই Anti Islam ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়-এ কথা শুনে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। বরং ধর্মনিরপেক্ষতা পুরোটাই ধর্মহীনতা।
শরীয়তে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই
ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কিছু নেই। ইসলামের মূল ভিত্তি হল আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদ। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وان احكم بينهم بما انزل الله
আর তাদের মাঝে আপনি ফয়সালা করুন ঐ আইন দ্বারা, যা আপনার প্রতি আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন।-সূরা মায়েদা : ৪৯
অন্যত্র আছে-
ومن لم يحكم بما انزل الله فاولئك هم الظالمون، … فاولئك هم الكافرون،… فاولئك هم الفاسقون
যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না তারা জালিম … তারা কাফির … তারা ফাসিক।-সূরা মায়েদা : ৪৪, ৪৫ ও ৪৭। এ তিনটি আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর বিধান ভিন্ন ফয়সালাকারীকে জালিম, কাফির ও মুনাফিক বলা হয়েছে। এ আয়াতগুলো পড়ুন এবং কারাফীর কথার গলদ ব্যাখ্যাকারী সেক্যুলার মুহাক্কিকদের (!) বক্তব্য শুনুন, জবাব আপনিই দিতে পারবেন।
সেক্যুলারিজমের বক্তব্য হচ্ছে, আইন-আদালত, বিচারকার্য এসব চলবে রাষ্ট্রীয় নীতি ও জনগণের চাহিদা অনুযায়ী। রাষ্ট্র যেভাবে আইন করে সেভাবে চলবে। ধর্মের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। ঐ কোনো কোনো সেক্যুলারপন্থী তথাকথিত আলেমের বক্তব্য হল, খলীফারা যে আইনে আদালত ও রাষ্ট্র চালিয়েছেন তা তাদের নিজস্ব বিষয়। এটি ইসলামের কিছু নয়। আপনি উপরোক্ত আয়াত এবং এ সংক্রান্ত আরো যত আয়াত আছে সেগুলো দেখুন। এগুলোতে কি বলা হয়েছে, ঐ সকল হুকুম-আহকাম খলীফাদের পর্যন্ত সীমিত? পরবর্তীদের জন্য তা পালনীয় নয়? দেখুন, সেক্যুলারিজম এমন কোনো বিষয় নয় যে, তার অসারতা সম্পর্কে জবাব দিতে হলে মাটি খুড়ে বের করে দলিল দিতে হবে। বরং শরীয়তের বিষয়গুলো হল
ليلها كنهارها
অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, স্পষ্ট ও প্রকাশ্য। এখানে অস্পষ্টতা বা অন্ধকারের স্থান নেই। ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে আইন-আদালত, রাষ্ট্রনীতি সব কিছুই কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা সুপ্রমাণিত। কিন্তু এখন ভাবটা এমন যে, নামায, রোযা ইত্যাদি মানুষকে তাদের ধর্ম মতো করতে দাও। (আসলে এটিও কথার কথা, না হয় আপনি কি নামায ঠিকমতো আদায় করতে পারছেন, জুমআর খুতবায় খতীব সাহেবেরা কি কুরআন-হাদীসের কথা স্বাধীনভাবে বলতে পারছেন, দুআ-মুনাজাতও কি তারা তাদের মতো করে করতে পারছেন? উত্তর আপনাদের জানা আছে।) আর রাষ্ট্র ও আদালত পরিচালিত হবে মানবরচিত আইনে। সুতরাং কুরআনের বিধানের সাথে সামঞ্জস্য থাকুক বা না থাকুক তিনি মীরাছের হিস্যা তার মতো করে বণ্টন করে দিতে পারবেন। এর জন্য মুসলিম স্কলারের ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। বিচারক নিজেই লিবারেল ও স্বাধীন। ফতওয়া সম্পর্কে ধারণা থাকুক বা না থাকুক, এমনকি ফতোয়ার সঠিক সংজ্ঞাও যদি জানা না থাকে তিনি ফতোয়া অবৈধ বলে দিতে পারবেন এবং বলতে পারবেন যে, ফতওয়া দিতে পারবে শুধু উচ্চ আদালতের বিচারক। ফতওয়া দেওয়ার আইনগত কর্তৃপক্ষ হল কোর্ট।
সেক্যুলারিজমটা এমনই। অন্য ধর্মের ব্যাপারে এর তেমন মাথাব্যাথা নেই। তাদের বিরোধিতারও দরকার নেই। কারণ অন্য ধর্মওয়ালারা এ নিয়ে কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি করে না। ইন্ডিয়ার উগ্রপন্থী বিজেপি কি কখনো দাবি উঠিয়েছে যে, গীতা, মহাভারত অনুযায়ী রাষ্ট্র চালাতে হবে? খ্রীষ্টানরাও একথা বলেনি। কারণ তাদের নিকট ইসলামের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিগুলোই নেই। এই অতুলনীয় ও সুমহান নীতি কেবল ইসলামেরই রয়েছে। সেক্যুলারিজম এসেছেই ইসলামকে প্রতিহত করার জন্য, স্রষ্টার আইনের বদলে নিজেদের মনমতো করে মানুষকে শাসন করার জন্য।
কিছু মোটা কথা
আপনি পুরো কুরআন মজীদ, বিশেষ করে মাদানী সূরাগুলো মনোযোগ দিয়ে অর্থসহ পড়ুন এবং লক্ষ্য করুন তাতে নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদির বাইরে অন্যান্য বিষয়ের আরো কত আয়াত রয়েছে। হাদীসগ্রন্থগুলোতে ইবাদাত অধ্যায়গুলোর তুলনায় পরিবারনীতি, সমাজনীতি, বিচারনীতি, লেনদেন পদ্ধতি, কৃষি-সেচ ইত্যাদি অধ্যায়গুলোর হাদীস সংখ্যার তুলনামূলক হিসাব করুন তাহলে দেখবেন দ্বিতীয় অংশের হাদীসের সংখ্যা কত বেশি। সেক্যুলারিজম মানতে হলে আপনাকে ঐসব কিছুই এখন রহিত হয়ে গেছে-ঘোষণা করতে হবে। (নাউযুবিল্লাহ)
যে ব্যক্তি ইসলামী নীতিমালা ও আদর্শে বিশ্বাসী তাকে যদি কোনো সেক্যুলার রাষ্ট্রের বিচারক বা কাযী নিযুক্ত করা হয় তার ধর্ম কি তাকে শরীয়তের বাইরে গিয়ে কোনো বিচার করার সুযোগ দিবে? তখন তো তিনি অসংখ্য আয়াত ও হাদীসের জেরার মুখে পড়বেন। তিনি কি বলতে পারবেন যে, এই আয়াত ঐ সন পর্যন্ত, ঐ প্রজন্মের জন্য ছিল? এ রকম করলে সবই ছেড়ে দিতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব হল হুদূদ-কিসাস কার্যকর করা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সেক্যুলার হওয়ার কারণে তাকে কিতাবুল হুদূদের হাদীসগুলোতে, সূরা নূরের আয়াতসমূহে টীকা লাগিয়ে দিতে হবে যে, এগুলো প্রথম যুগের সাথে সম্পৃক্ত। পরবর্তীদের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। তাই সেক্যুলারিজম নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। দৃঢ়তার সাথে বুঝতে হবে যে, এটা সম্পূর্ণ লা দ্বীনী ও Anti Islam নীতি।
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবু যুরআ রাহ.কে খলীফা ওলিদ ইবনে আবদুল মালিক জিজ্ঞাসা করেছিল যে, أيحاسب الخليفة খলীফারা যে রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাদের কি হিসাব দিতে হবে? পাকড়াও হবে?
আবু যুরআ রাহ. বলেছিলেন, অবশ্যই হিসাব নেওয়া হবে এবং দলিল হিসেবে তিনি কুরআন মজীদের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন-
يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ
অর্থ : হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না। কেননা এটি তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহর পথ হতে ভ্রষ্ট হয় তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কারণ তারা বিচারদিবসকে বিস্মৃত হয়ে আছে।-সূরা ছোয়াদ : ২৬
ইবনে কাসীর রাহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ঠিক একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন-
هذه وصية من الله عز وجل لولاة الأمور أن يحكموا بين الناس بالعدل
অর্থ : এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে শাসকদের প্রতি নির্দেশনা যে, তারা যেন লোকদের মধ্যে সুবিচার করে।
বিচার একমাত্র আল্লাহর আইনেই হওয়া বাধ্যতামূলক। ধর্মনিরপেক্ষতা বা নিরপেক্ষ ভাব-ভঙ্গি বলতে কিছু নেই।
শেষকথা
দুতিন ঘণ্টার আলোচনায় ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষতিকর সকল দিক বলা সম্ভব নয়। আর ইলসামের রাষ্ট্রনীতি, বিচারনীতি ও ইবাদাতের বাইরের অন্যান্য বিষয়াবলির বিশালতা সম্পর্কে তো আপনারা অবগত আছেন।
আমি শুধু সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছি এবং সেক্যুলার ব্যক্তিবর্গের কথা ও লেখা থেকে প্রমাণ করেছি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতা সমার্থবোধক। এবং এর সবচেয়ে হালকা ব্যাখ্যাদাতারও দাবি হল, রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। যা সুস্পষ্ট কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী বক্তব্য। এবং প্রায় ৯০% মুসলমানের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়ন গণতন্ত্র, মানবাধিকার পরিপন্থী কাজ। আর দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ও মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্থান দেওয়া এবং এটিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করা বাস্তবতা বিবর্জিত হঠকারিতা ও সীমিত সংখ্যক লোকের মতকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার নামান্তর। যারা এমনটি করছে তারা কিন্তু প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংকীর্ণ করছে।
আল্লাহ তাআলা স্বীয় অনুগ্রহে আমাদেরকে সঠিক ইসলামের উপর পরিচালিত করুন। সকল ভ্রান্ত ধারণা ও বিশ্বাস থেকে দূরে রাখুন।
রবিউস সানি ১৪৩৫ – ফেব্রুয়ারি ২০১৪
মাসিক আলকাউসার