ব্যক্তি ও সমাজ গঠনে সীরাতের ভূমিকা মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ, মুহাম্মাদ সিফাতুল্লাহ [১ম পর্ব]

ভূমিকা

এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু দুই ভাগে বিভক্ত। এক. ব্যক্তি গঠন দুই. সমাজ-গঠন। প্রথম ভাগের সম্পর্ক সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির সাথে আলাদাভাবে আর দ্বিতীয় ভাগের সম্পর্ক মানবজাতির সামাজিক সমস্যা ও তার সমাধানের সাথে। এ বিষয়ে ইসলামী শিক্ষা, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও নির্দেশনা এবং তাঁর জারিকৃত নীতি ও বিধান এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু।

বস্তুত যে কোনো আদর্শ সমাজের জন্য এ দুটো দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণে দুটো দিকই পূর্ণ মনোযোগ ও গভীর চিন্তা-ভাবনার দাবি রাখে। এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে চেষ্টা করা হয়েছে প্রবন্ধের সীমাবদ্ধতার ভেতরে বিষয় দু’টির গুরুত্ব অনুসারে পর্যালোচনা করার। শুরুতে ভূমিকা স্বরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তা ও যথার্থতা আলোচিত হয়েছে।

আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব

ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী আনুগত্যের ক্ষেত্র ও মর্ম অতি বিস্তৃত। তা শুধু নামায, রোযা, যাকাত, হজ্ব ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং লেন-দেন, সামাজিকতা স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার, সমাজ চালনা, রাষ্ট্র-পরিচালনা প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে বিস্তৃত। জীবন ও জগতের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি, তাঁর নির্দেশিত নীতি ও বিধানকে শিরোধার্য করে তা মেনে চলার নামই ইসলাম।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান সম্পর্কে মানুষ কীভাবে অবগত হবে। এর জন্য আল্লাহ তাআলা একটি ব্যবস্থা রেখেছেন, যার নাম ওহী ও রিসালাত। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে তাঁর কোনো নির্বাচিত বান্দার কাছে তাঁর নির্দেশ ও নির্দেশনা নাযিল করেন। সেই নির্বাচিত বান্দা তাঁর নির্দেশনাবলীর আলোকে ওহী ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই নির্বাচিত বান্দাকে রাসূল ও পয়গম্বর বলা হয়।

দুনিয়াতে এমন অনেক মানুষ গত হয়েছে যারা কোনো না কোনো দিক থেকে বিশিষ্টতার অধিকারী ছিলেন। যারা তাদের যোগ্যতার মাধ্যমে জগৎ পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছেন। একদিকে রয়েছেন রাজা-বাদশাহ ও বীর সেনাপতির দল, যারা জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের দাবিদার, রয়েছেন কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিক গোষ্ঠী, যারা শব্দ-বাক্যের ব্যঞ্জনা ও চুলচেরা দার্শনিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্ব-ব্যবস্থার শুদ্ধি ও সুষ্ঠুতার ঘোষক। রয়েছেন ব্যবসায়ী, কারিগর ও পুঁজিপতি শ্রেণি, যাদের অভিমত- গোটা পৃথিবীর সমাজ-ব্যবস্থা তাদের মাধ্যমেই উন্নতি লাভ করছে। এ কথা মিথ্যা নয় যে, উল্লেখিত প্রত্যেক শ্রেণিরই স্ব স্ব ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির গঠন-বর্ধনে নিজস্ব অবদান রয়েছে। তবে এ কথাও অসত্য নয় যে, এই সকল গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশে এবং তার প্রকৃত কল্যাণ সাধনে উল্লেখযোগ্য কোনো কীর্তি সম্পাদনে ব্যর্থ হয়েছে। শ্রেণি ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানবতার কল্যাণ, মানুষের হৃদয় ও চরিত্রের পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর সাথে তাদের যথার্থ সম্পর্ক সৃষ্টির সফল প্রয়াস যদি কেউ করে থাকেন তবে তা একমাত্র নবী ও রাসূলগণই করেছেন, যাঁরা প্রেরিতই হয়েছেন এই মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য।

আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অনেক নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং মানবজাতিকে আসমানী আলো দান করেছেন। সকল নবীর দাওয়াতের মৌলিক বিষয় অভিন্ন ছিল তবে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী শাখাগত বিধিবিধানে ভিন্নতাও ছিল।

সবার শেষে আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তাঁর মাধ্যমেই নবুওত ও রিসালাতের ধারা সমাপ্ত হয়েছে। তাই তিনি খাতামুন্নাবিয়্যীন, সর্বশেষ নবী। কিয়ামত পর্যন্ত আর না কোনো নতুন নবী আসবেন, না নতুন শরীয়ত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তা পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবকে রহিত করে দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছে। তাকে যে দ্বীনে ইসলাম প্রদান করা হয়েছে তা সবদিক থেকে চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ। সুতরাং এখন কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর শরীয়তই পৃথিবীতে বহাল থাকবে।

আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-

وَ مَاۤ اَرْسَلْنٰكَ اِلَّا كَآفَّةً لِّلنَّاسِ بَشِیْرًا وَّ نَذِیْرًا وَّ لٰكِنَّ اَكْثَرَ النَّاسِ لَا یَعْلَمُوْنَ.

আর আমি আপনাকে সকল মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না। -সূরা সাবা (৩৪) : ২৮

অন্যত্র ইরশাদ করেন-

اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا.

আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিয়েছি এবং তোমাদের উপর আমার নিআমতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং ‘ইসলাম’কে তোমাদের জন্য দ্বীন মনোনীত করেছি। -সূরা মায়েদা (৫) : ৩

এখন যেহেতু ইসলামই ঐ দ্বীন যা কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য অনুসরণযোগ্য এবং এ দ্বীনই আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে মনোনীত, তাই ইসলাম ও ইসলামের নবীর আনুগত্য আবশ্যক হওয়া স্বাভাবিক। কুরআনে কারীমের ইরশাদ-  وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا.

যদি তোমরা তাঁর আনুগত্য কর তাহলে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে। -সূরা নূর (২৪) : ৫৪

আরো ইরশাদ-

وَ مَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا لِیُطَاعَ بِاِذْنِ اللهِ.

আর আমি সকল নবীকে এ জন্যই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর আদেশে তাদের আনুগত্য করা হবে। -সূরা নিসা (৪) : ৬৪

সুতরাং তাঁর কথা ও কাজ উম্মতের জন্য প্রমাণ ও আলো। তাঁর আনীত বিধানসমূহকে আল্লাহর বিধান বলে বিশ্বাস করা এবং মনেপ্রাণে গ্রহণ ও পালন করাই হল ইত্তিবায়ে রিসালাত বা রাসূলের আনুগত্য। কেউ যদি নবীর হুকুম মানতে অস্বীকার করে, তাঁর ফায়সালা গ্রহণ না করে তাহলে সে মুসলমান থাকে না, আল্লাহর অনুগত বান্দাও থাকে না। কারণ আল্লাহর রাসূলের হুকুম না মানার অর্থ, আল্লাহর হুকুম না মানা।

আনুগত্যের যথার্থতা

আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সবরকম গুণে গুনান্বিত করেছেন। যাতে তিনি সব যুগের সব মানুষের জন্য জীবনের সকল অঙ্গনে বাস্তব ও আদর্শ নমুনা হতে পারেন। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ.

তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মাঝে আছে উত্তম আদর্শ। -সূরা আহযাব (৩৩) : ২১

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে পবিত্র জীবন যাপন করে এবং নবুওতী দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পাদন করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য তাঁর পবিত্র জীবনকে অনুসরণ করার উপায় হচ্ছে, তাঁর জীবনী। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নমুনা ও আদর্শ বানিয়েছেন তাই তাঁর জীবনী এমনভাবে সংরক্ষণ করেছেন, যার কোনো তুলনা নেই।

নবী-জীবনী : ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত বা জীবনীর এক অনন্য বৈশিষ্ট্য- এর ঐতিহাসিকতা। অর্থাৎ শক্তিশালী বর্ণনাসূত্রে বর্ণিত প্রামাণিক জীবনালেখ্য, যার প্রতিটি তথ্য বর্ণনা-বিচারের নিখুঁত মানদণ্ডে পরীক্ষিত।  আমরা যদি অন্যান্য ধর্ম-পুরুষদের এই মানদণ্ডে বিচার করি, তাহলে দেখা যাবে কারো জীবন-চরিত এই মানদণ্ডে পূর্ণ উত্তীর্ণ নয়। যেমন হিন্দুধর্মের ধর্ম-পুরুষদের কথাই ধরুন, তাদের মধ্যে কতক তো এমন, পৃথিবী যাদের শুধু নামটাই জেনেছে, তাদের জীবনেতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তেমনি অগ্নিপূজারীদের ধর্ম-পুরুষ যুরতুশতের জীবনেতিহাসও অজ্ঞাত। বুদ্ধ ও কনফিউসাস-এর জীবনেতিহাসও সংশয়পূর্ণ।

আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে প্রেরিত অধিকাংশ নবীদের সম্পর্কেও এখন বেশি কিছু জানা যায় না। তাওরাতে হযরত মূসা আ.-এর জীবন সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে তবে বিদ্যমান ‘তাওরাতে’র শুদ্ধতা ও প্রামাণিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। একই কথা কথিত ‘ইঞ্জিল’ সম্পর্কেও। সবাই জানেন, খ্রিস্টজগত অগণিত ইঞ্জিলের মধ্য হতে শুধু চারটিকেই গ্রহণযোগ্য মনে করে। ঐ চার ইঞ্জিলেও রয়েছে প্রচুর বৈপরীত্য। আর এগুলোর লেখকদের কেউই হযরত ঈসা আ.-কে  স্বচক্ষে দেখেনি এবং এগুলোর রচনার সন-তারিখ সম্পর্কেও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।

বিপরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেতিহাস দেখুন। মুসলমানগণ তাদের নবীর জীবনী এবং তাঁর সাথে সামান্য সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তির জীবনীও এত পরিশ্রম ও গুরুত্বের সাথে সংরক্ষণ করেছে যে, ইতিহাসে এর নযীর পাওয়া যাবে না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম যেমন তাঁর সকল বাণী ও কর্ম অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়ার আদেশ করেছেন তেমনি এ বলে হুঁশিয়ারও করেছেন যে, কেউ যদি আমার সম্পর্কে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল কথা অথবা মিথ্যা কথা বর্ণনা করে তাহলে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। এই হুঁশিয়ারির কারণে বড় বড় সাহাবীও তাঁর সম্পর্কে কোনো কিছু বর্ণনা করার সময় ভীত ও সতর্ক থাকতেন। আর এ কারণেই আজ তাঁর জীবনী শুধু সংরক্ষিতই নয়, অবিকৃত ও অপরিবর্তিতরূপে সংরক্ষিত রয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের পবিত্র জীবনীর সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস হল, কুরআনে কারীম, যার প্রামাণিকতা ইসলামের শত্রুদের পক্ষেও অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। কুরআন মাজীদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সকল অংশ পাওয়া যায়। তাঁর নবুওতের পূর্বের জীবন, তাঁর দারিদ্র্য ও এতিম হওয়া, ওহী ও নবুওত, মিরাজ ও দ্বীন প্রচার, হিজরত ও জিহাদ এবং তাঁর চরিত্র ও গুণাবলী ইত্যাদি। এর চেয়ে শক্তিশালী ও প্রামাণিক গ্রন্থ পৃথিবীতে নেই।

সীরাতের দ্বিতীয় উৎস, হাদীস-গ্রন্থসমূহ, যাতে একেকটি তথ্য পূর্ণ সনদ ও সূত্র সহকারে সংরক্ষিত। এরপর আছে ‘মাগাযী’ ও ‘সীরাত’ শীর্ষক গ্রন্থাবলী। আছে তারীখ ও ইতিহাসের কিতাবসমূহ। আছে ‘শামায়েল’-এর কিতাবসমূহ। শামায়েলের কিতাবসমূহে তাঁর চরিত্র, আচার-আচরণ, উত্তম গুণাবলী এবং  দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজকর্ম আলাদাভাবে বর্ণিত হয়েছে।

তো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী অন্য কোনো নবী বা ধর্ম-গুরুর জীবনীর মত নয়; বরং তাঁর জীবনী ঐতিহাসিক বিচারেও পুরোপুরি সংরক্ষিত। এটি তাঁর সীরাত ও জীবনেতিহাসের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

সকল যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব

কারো জীবন ও কর্ম অনুসরণীয় হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, তা নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ হওয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কারো জীবন ও কর্ম সম্পর্কে উপরোক্ত মূল্যায়ন তখনই সম্ভব যখন তার জীবনের সব দিক তার যুগের লোকদের সামনে থাকে আর তার মৃত্যুর পর তা ইতিহাসে সংরক্ষিত থাকে।

এই পৃথিবীতে অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব অতিবাহিত হয়েছেন কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাদের কারো তুলনা চলে না। কারণ, জীবনের ছোট থেকে ছোট বিষয়েও তাঁর শিক্ষা রয়েছে। আর নিজেও তিনি ছিলেন উত্তম গুণাবলীর অধিকারী। মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন ভারসাম্য সৃষ্টি করেছেন যে,  কোথাও কোনো প্রান্তিকতা অবশিষ্ট থাকেনি।

তাঁর পবিত্র জীবনের সকল দিক শুধু তাঁর যামানার লোকদের সামনেই ছিল এমন নয় বরং তাঁর জীবনের সকল দিক ও ঘটনা ইতিহাসের পাতায়ও সংরক্ষিত আছে, যার সাহায্যে আজও তাঁর নিখুঁত ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া সম্ভব। দেখুন, সকল কীর্তিমান পুরুষ নিজ পরিবারে ও আপন স্ত্রীর কাছে একজন সাধারণ মানুষ। তার ভেতরের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে তার স্ত্রীই সবচেয়ে বেশি অবগত থাকে, অথচ আমরা দেখতে পাই যে নবুওতপ্রাপ্তির পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নবুওতের কথা সর্বপ্রথম হযরত খাদিজা রা.-এর কাছেই বলেছিলেন, যিনি ছিলেন পনেরো বছর যাবৎ তাঁর জীবনসঙ্গিনী। তাঁর ভেতর বাহির সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। নবুওতপ্রাপ্তির সংবাদ শোনার পর তিনি শুধু তাঁর প্রতি ঈমানই আনেননি; বরং সাথে সাথে তাঁকে সর্বক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্যও প্রস্তুত হয়ে যান। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিখুঁত ব্যক্তিত্বের এক বড় প্রমাণ।

নবুওতপ্রাপ্তির ঘোষণার আগেও তিনি তাঁর জীবনের মহামূল্যবান চল্লিশটি বছর কুরাইশদের মাঝেই অতিবাহিত করেছেন। লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কাজকর্মে তাঁর সততা, সত্যবাদিতা, আমানতদারি, ওয়াদা রক্ষা, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মকুশলতার কারণে কুরাইশের লোকেরা তাকে সাদিক ও আমিন উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তারা তাঁর কাছে আমানত রাখত এবং বিবাদ বিসংবাদে তাঁর ফয়সালা মেনে নিত। এরপর যখন তিনি নবুওতপ্রাপ্তির কথা ঘোষণা করলেন তখন এরাই তাঁর প্রাণের শত্রুতে পরিণত হল এবং তাঁকে কষ্ট দেয়াকেই মিশন বানিয়ে নিল। তারা তাঁর উপর উটের নাড়িভুড়ি চাপিয়ে দিয়েছে এবং তাঁর গোটা খানদানকে বয়কট করেছে, তাঁকে জাদুগর ও পাগল বলে বেড়িয়েছে, এমনকি তাঁকে হত্যারও চেষ্টা করেছে। অথচ এই সময়ও তারা তাদের আমানত তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখত। এরপর যখন আল্লাহ  তাওফীক দিলেন তো এরাই তাঁর প্রতি ঈমান এনে দুনিয়া-আখিরাতের সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে গেলেন। এরাই জীবনের প্রত্যেক কাজে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করাকে নিজেদের সৌভাগ্যের কারণ মনে করেছিলেন এবং বিশ্বমানবতার জন্য তাঁর প্রতিটি কথা ও কাজ সংরক্ষণ ও বর্ণনা করে গেছেন। বলাবহুল্য, এ তাঁর নিখুঁত ব্যক্তিত্বের এক অখণ্ডনীয় প্রমাণ।

পবিত্র জীবনের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি

কোনো জীবনী মানবসমাজের জন্য তখনই বাস্তব আদর্শ হতে পারে যখন তা জীবনের সকল দিকের ধারণকারী হয়, অর্থাৎ, সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য যে সকল নমুনা ও দৃষ্টান্তের প্রয়োজন- সেগুলো তাতে পুর্ণরূপে থাকে। এক্ষেত্রেও একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনই পূর্ণাঙ্গ। অন্যান্য ধর্ম-পুরুষদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে এই ব্যাপ্তি নেই। যেমন গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে রয়েছে, তিনি পরিবার-পরিজন ও বংশের লোকদের ছেড়ে নির্র্জন বনবাস গ্রহণ করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্য ও জনতা, রাজা-প্রজা, মনিব-ভৃত্য, পিতা-পুত্র, ভাই-বোন ও বন্ধু-বান্ধবের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গৌতম বুদ্ধের জীবন বা জীবনী কীভাবে অনুসরণ করা হবে? তেমনি প্রচলিত তাওরাতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের জীবনীর শুধু যুদ্ধ ও সেনাপতিত্বের বিষয়টিই স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া জীবন-ব্যাপী কর্তব্য ও অধিকারের বাস্তব নমুনা নেই। যদিও আমাদের বিশ্বাস তিনি একটি আদর্শ-জীবন যাপন করেছেন। একইভাবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জীবনেও পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ ও যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাস্তব নমুনা নেই। আর যে জীবনটি তিনি যাপন করেছেন তা-ও নিখুঁত ও পুর্ণাঙ্গভাবে সংরক্ষিত নয়। তাহলে তা সর্বজনীন ও সর্বকালীন আর্দশ কীভাবে হতে পারে?

পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী সকল শ্রেণীর মানুষের জন্যই পথপ্রদর্শক। রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, বিচারক, মুজাহিদ, আবিদ, যাহিদ, আলিম, জাহিল, পরিবার- পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, ব্যবসায়ী ও জনসাধারণ; এক কথায় সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য তাঁর জীবনীতে রয়েছে এক পূর্ণাঙ্গ নমুনা ও যথাযথ দিক নির্দেশনা।

জীবনাদর্শের প্রায়োগিক দিক

কারো জীবন অনুসরণীয় হওয়ার জন্য এ-ও জরুরি যে, যে শিক্ষা তিনি দিচ্ছেন তা নিজেও আমল করে দেখান। তাহলে মানুষ বুঝবে যে তার উপদেশগুলো শুধু কিছু চিন্তা-ভাবনা নয় বরং তা পুরোপুরি আমলযোগ্য। অন্যথায় ভালো থেকে ভালো এবং সুন্দর থেকে সুন্দর চিন্তা-ভাবনা তো যে কেউ তুলে ধরতে পারে। কিন্তু বাস্তব প্রয়োগ হল এমন বিষয়, যা সর্বক্ষেত্রে সম্ভব হয় না এবং যার মাধ্যমে কোনো নীতি ও মতকে যাচাই করা সম্ভব। এ কারণেই কারো জীবনী শুধু কিছু সুন্দর কথা ও উৎকৃষ্ট চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে না, তা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে বাস্তব কর্ম ও  দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীর একটি উজ্জ্বল দিক হল তিনি তাঁর অনুসারীদের যে আদেশ-উপদেশ করেছেন সেগুলোর উপর সর্বপ্রথম নিজে আমল করেছেন । তাঁর বাস্তব কর্মের দ্বারাই ঐ নীতি ও বিধানের প্রায়োগিক রূপ নির্ধারিত হয়েছে। দেখুন, নবীজী আল্লাহর স্মরণের উপদেশ দিয়েছেন আর স্বয়ং তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, রাত-দিনের কোনো একটি মুহূর্তেও তিনি আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল থাকতেন না। হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা আল্লাহর স্মরণে থাকতেন। -মুসনাদে ইবি ইয়ালা, হাদীস ৪৯৩৭

সকলের জন্য চব্বিশ ঘণ্টায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আদেশ ছিল। কিন্তু তিনি নিজে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথে শেষরাতে (তাহাজ্জুদ), সূর্যোদয়ের পর ও মাগরিবের পর নামায পড়তেন। এ ছাড়া  আরো অনেক নফল নামায আদায় করতেন। আর তাঁর নামায এত দীর্ঘও হত যে, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পদযুগল ফুলে যেত।

সকলের জন্য রমযানের রোযা ফরয করা হয়েছে কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো মাস এমন যেত না, যাতে তিনি রোযা রাখেননি। মোটকথা, যে কাজেরই তিনি আদেশ দিতেন নিজেও সে অনুযায়ী আমল করে দেখাতেন।

পবিত্র সীরাতের এসকল বৈশিষ্ট্যের কারণে যে কোনো শ্রেণীর মানুষ আপন অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে তা থেকে আলো ও নির্দেশনা গ্রহণ করে নিজের জীবনকে সফল ও সর্র্বাঙ্গসুন্দর বানাতে পারে।

এই  সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর এবার আমরা মূল আলোচ্য বিষয়ে প্রবেশ করছি। অর্থাৎ ব্যক্তি-গঠন ও সমাজ গঠনে সীরাতে নববীর ভূমিকা।

ব্যক্তি-গঠন

একটি সমাজ  নানা উপাদানে গঠিত হয়। এই সকল উপাদানের মধ্যে ‘ব্যক্তি’র গুরুত্ব সর্বাধিক। এটিই হচ্ছে ঐ একক যা সমাজের গতিপথ নির্ধারণ করে। আর এরই উপর নির্ভর করে একটি সমাজের আদর্শ সমাজ হওয়া বা না হওয়া। এই একক তথা ব্যক্তি উন্নতি লাভ করলে সমাজ উন্নত হয়। আর তা অধপতনের শিকার হলে সমাজ অধপতনের শিকার হয়। মানবসমাজে ব্যক্তির গুরুত্বের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগঠনের প্রতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আর এ বিষয়ে এই পরিমাণ শিক্ষা ও আমলী নমূনা রেখে গেছেন যে, পৃথিবীর যে কোনো মানুষ তা থেকে দিকনির্দেশনা গ্রহণ করতে পারবে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন তাঁর শিক্ষা প্রতিটি মানবের পথনির্দেশনার প্রয়োজন পূরণ করতে থাকবে।

ব্যক্তিগঠনের ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষা ও নির্দেশনা এবং  চেষ্টা ও প্রচেষ্টার কেন্দ্রীয় বিষয়টি হচ্ছে ‘ঈমান বিল আখিরাহ’ (আখেরাতের উপর ঈমান)। আখেরাতের নাজাতের জন্য ব্যক্তিকে উত্তম স্বভাব ও আচরণের অধিকারী হতে হবে আর আখেরাতের শাস্তি থেকে আত্মরক্ষার জন্য মন্দ স্বভাব ও অন্যায় আচরণ বর্জন করতে হবে- এটিই হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগঠন প্রচেষ্টার মূলনীতি।

এ তো আসমানী দ্বীনেরই বৈশিষ্ট্য যে, আখেরাতের জীবন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছে এবং এই বাস্তবতা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে হুঁশিয়ার করেছে।

পৃথিবীতে আজ যত ইহবাদী জীবন-দর্শন ও জীবন-ব্যবস্থা চালু আছে এ সকল ব্যবস্থার  অসংখ্য ত্রুটি ও দুর্বলতার মধ্যে একটি তো সর্বজনস্বীকৃত; আর তা হচ্ছে এ সকল ব্যবস্থা মানুষের জীবনের শুধু একটি অংশ নিয়েই আলোচনা করে, অর্থাৎ নশ্বর ও ক্ষণস্থায়ী অংশ। জীবনের চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর অংশ সম্পর্কে এ সকল মতবাদে কোনো পথনির্দেশনা নেই। এই সকল ব্যবস্থা অনুসরণযোগ্য না হওয়ার জন্য এই একটিমাত্র ত্রুটিই যথেষ্ট।

ব্যক্তি গঠনের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের পর যে সকল বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা নিম্নোক্ত শিরোনামে ভাগ করা যায় :

১. ইলম ২. তাযকিয়া ও আখলাক ৩. একতা ও ভ্রাতৃত্ব ৪. সততা ও সত্যবাদিতা ৫. ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা।

১. ইলম

ব্যক্তির চিন্তা, কর্ম, রুচি ও অভিরুচি গঠনে ইলমের প্রয়োজন ও অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, জ্ঞানের স্বরূপ বা বিস্তৃতি সম্পর্কে মানবজাতি যুগে যুগে বহু বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির শিকার হয়েছে। এ থেকে মানবজাতিকে যদি কেউ মুক্তি দিয়ে থাকেন তবে নবীগণই দিয়েছেন। তাঁদেরই সূত্রে মানুষ জ্ঞানের ঐ অধ্যায়ের সাথে পরিচিত হয়েছে, যা অন্য কোনোভাবে অর্জন করা সম্ভব ছিল না।

মানুষের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, যা শুধু নবীগণের মাধ্যমে হাসিল হতে পারে তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার যাত ও সিফাতের ও তাঁর বিধি-বিধানের জ্ঞান। এক্ষেত্রে না মানুষের ইন্দ্রিয় কাজ করে, না বুদ্ধি। এ কারণেই ইসলাম-পূর্ব যুগের গ্রিক, পারসিক ও ভারতীয় বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রগুলো এবং বর্তমানের ইসলামহীন পশ্চিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় চরম উৎকর্ষ সত্ত্বেও স্রষ্টা ও অলৌকিকতা এবং ধর্ম ও ধর্মীয় বিধানাবলীর ক্ষেত্রে নানা কুসংস্কার ও মর্মান্তিক বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে যে নির্ভুল জ্ঞান মানবজাতি লাভ করেছে তার মর্যাদা তখনই উপলব্ধি করা যাবে যদি এই জ্ঞানের সাথে প্রাচীন ও আধুনিক অজ্ঞানতাকে তুলনা করা হয়।

দ্বিতীয়ত পবিত্র সীরাতে ইল্ম ও জ্ঞানকে যুক্ত করা হয়েছে কর্ম ও চরিত্রের সাথে। ইসলামে ঐ নীতিজ্ঞানের কোনোই মূল্য নেই, যা বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কুরআন মাজীদে কবি ও দার্শনিকদের নিন্দা করা  হয়েছে-

وَ الشُّعَرَآءُ یَتَّبِعُهُمُ الْغَاوٗن…

এবং কবিদের অনুসরণ করে বিভ্রান্তরাই। তুমি কি দেখনা ওরা উদ্ভ্রান্ত হয়ে প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায় এবং ওরা তো বলে যা ওরা করে না কিন্তু তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে…। -সূরা শুআরা (২৬) : ২২৪-২২৭

আরেক জায়গায় ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْن كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ اَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُوْن .

 হে মুমিনেরা! তোমরা যা কর না তা বল কেন? তোমরা যা কর না তা তোমাদের বলা আল্লাহর কাছে অতি অসন্তোষজনক। -সূরা সফ (৬১) : ২-৩

এক জায়গায় আমলহীন জ্ঞানীর চূড়ান্ত নিন্দা করে বলা হয়েছে-

مَثَلُ الَّذِیْنَ حُمِّلُوا التَّوْرٰىةَ ثُمَّ لَمْ یَحْمِلُوْهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ یَحْمِلُ اَسْفَارًا بِئْسَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِیْنَ كَذَّبُوْا بِاٰیٰتِ اللهِ   وَ اللهُ لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الظّٰلِمِیْنَ.

যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল। কিন্তু ওরা তা বহন করেনি (অর্থাৎ অনুসরণ করেনি) তাদের দৃষ্টান্ত পুস্তক বহনকারী গর্দভ। কত নিকৃষ্ট সে সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে। আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। -সূরা জুমুআ (৬২) : ৫

আর সকল নিকৃষ্ট উদাহরণ থেকে মুক্ত থাকার শিক্ষা দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“ليس لنا مثل السوء”

আমাদের জন্য শোভন নয় মন্দ উপমা (-এর দৃষ্টান্ত হওয়া) -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬২২

ইলমের ক্ষেত্রে এই বিপ্লবী নীতির মূল্য তখনই বোঝা যাবে যদি ইসলাম-পূর্ব যুগের ও আধুনিক যুগের ইসলামহীন বিদ্যাপীঠ ও বিদ্বান সমাজের নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয়কে স্মরণ করা হয়।

জ্ঞানের ক্ষেত্রে তৃতীয় যে মৌলিক শিক্ষা নবী-জীবনী মানব জাতিকে দান করে তা হচ্ছে, ইলমের সকল এককের মাঝে সম্বন্ধ ও সমন্বয় সাধন। ইসলাম-পূর্ব জাহেলী সমাজেও জ্ঞানের দুই ধারা- ধর্ম-জ্ঞান ও জাগতিক জ্ঞান বিভক্ত ছিল বিবদমান দুই শিবিরে। বর্তমান জাহেলী সমাজেও তাই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জ্ঞানের এই এককগুলোকে একসূত্রে গেঁথেছেন। সেই সূত্রটি হচ্ছে ঈমান বিল্লাহ- আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান। আল্লাহ তাআলাই কিতাব নাযিল করেছেন এবং তিনিই গোটা জগতকে নিপুণ ও নিখুঁত নিয়মে পরিচালনা করছেন। সুতরাং আসমানী কিতাব আর প্রকৃতির নিয়মের মাঝে কোনো সংঘাত হতে পারে না। যদি কিতাব সংরক্ষিত থাকে এবং প্রকৃতির নিয়ম সঠিকভাবে উপলব্ধি করা হয়। সংঘর্ষ তো তখনই দেখা দেয় যখন এই দুই শর্তের কোনো একটি অনুপস্থিত থাকে।

ইসলামে জ্ঞানের সফর শুরু হয় এই সঠিক বিন্দু, অর্থাৎ আল্লাহর উপর ঈমান থেকে। পবিত্র সীরাতে এরই  মাধ্যমে শুরু হয়েছে ইলমের সফর-

اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِیْ خَلَقَ .

পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। -সূরা আলাক (৯৬) : ১

আর এ কারণেই ইসলামে দ্বীন ও দুনিয়া তথা ধর্ম ও জীবনের মাঝে যেমন  সংঘর্ষ নেই তেমনি নেই ইলমে দ্বীন ও ইলমে দুনিয়া তথা ধর্ম-জ্ঞান ও জাগতিক জ্ঞানের মাঝেও। বরং জাগতিক সকল জ্ঞান ও জ্ঞান-চর্চার মাঝেও দেহের শোণিত-ধারার মতোই প্রবাহিত থাকবে দ্বীনী চেতনা।

মুমিন বান্দার বৈশিষ্ট্যের বর্ণনায় কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَ یَتَفَكَّرُوْنَ فِیْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلًا  سُبْحٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ.

এবং আকাশম-ল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এ নিরর্থক সৃষ্টি করনি, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদের অগ্নি-শাস্তি হতে রক্ষা কর। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯১

কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে জ্ঞানের  নানা সূত্র ও উপায়। রয়েছে জীব-জগৎ, জড়-জগৎ ও মানব জাাতির অতীত সম্পর্কে গভীর চিন্তার আহ্বান। এই বিষয়গুলোকে কুরআন মাজীদ ব্যক্ত করে আয়াতুল্লাহ, সুন্নাতুল্লাহ ও আইয়ামুল্লাহ ইত্যাদি শব্দে।

ইরশাদ হয়েছে-

وَ فِی الْاَرْضِ اٰیٰتٌ لِّلْمُوْقِنِیْنَ  وَ فِیْۤ اَنْفُسِكُمْ  اَفَلَا تُبْصِرُوْنَ .

নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে ধরিত্রীতে এবং তোমাদের আপন সত্তায়। এরপরও কি অনুধাবন করবে না। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ২০-২১

سَنُرِیْهِمْ اٰیٰتِنَا فِی الْاٰفَاقِ وَ فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَهُمْ اَنَّهُ الْحَقُّ  اَوَ لَمْ یَكْفِ بِرَبِّكَ اَنَّهٗ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ شَهِیْدٌ .

আমি ওদের জন্য আমার নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করব বিশ্ব জগতে এবং ওদের নিজেদের সত্তায়। ফলে ওদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এ-ই সত্য। তোমার রব সম্পর্কে কি এ-ই যথেষ্ট নয় যে, তিনি সব বিষয়ে অবহিত? তোমাদের পূর্বে বহু রীতি-দৃষ্টান্ত গত হয়েছে। সুতরাং পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ মিথ্যাবাদীদের কী পরিণাম! -সূরা ফুচ্ছিলাত (৪১) : ৫৩

قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ سُنَنٌ فَسِیْرُوْا فِی الْاَرْضِ فَانْظُرُوْا كَیْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِیْنَ .

 তোমাদের পূর্বে বহু বিধান-ব্যবস্থা গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ কর এবং দেখ মিথ্যাশ্রয়ীদের কী পরিণাম। -সূরা আলে ইমরান(৩) : ১৩৭

কথা এখানেই শেষ নয় যে, ইসলামে ধর্ম-জ্ঞান ও জাগতিক জ্ঞানের কোনো সংঘর্ষ নেই বরং ইসলামের বিপ্লবী শিক্ষা এই যে, জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানুষ-ভূমিতে সম্পূর্ণ স্বধীন নয়, সে আল্লাহর খলীফা ও নায়েব।

কুরআন মাজীদের বিখ্যাত আয়াত-

وَ اِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلٰٓىِٕكَةِ اِنِّیْ جَاعِلٌ فِی الْاَرْضِ خَلِیْفَةً .

স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফিরিশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি…। -সূরা বাকারা (২) : ৩০

নায়েব ও স্বাধীনের পার্থক্য কার না জানা আছে। নায়েব সর্বদা আপন মালিকের সাথে সম্পর্কযুক্ত অনুগত থাকে। দায়িত্ব পালনে বিশ্বস্ততা ও আমানতদারি রক্ষা করে। আর শক্তি ও ক্ষমতার দর্পে আত্মহারা হয় না। কারণ তার রয়েছে নিজ মালিকের কাছে জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ। পক্ষান্তরে যে নিজেকে স্বাধীন মনে করে সে তো প্রকৃতির শক্তিকে আয়ত্ব করার চেষ্টা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে হয় সম্পূর্ণ সেচ্ছাচারী, সে এই শক্তি আয়ত্ব করার চেষ্টায় লিপ্ত হয় ক্ষুদ্র স্বার্থে এবং  ¯্রষ্টার বিধান থেকে বেপরোয়া হয়ে। ফলে বৃহত্তর মানব জাতির কল্যাণের পরিবর্তে এই জ্ঞান-বিজ্ঞান হয়ে ওঠে তাদের দাসত্ব ও অকল্যাণের বড় কারণ। জাগতিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই যে বিপথগামিতা অর্থাৎ আল্লাহর খলীফা হওয়ার পরিবর্তে স্বাধীন ও সেচ্ছাচারী হওয়া। এ থেকে  সূত্রপাত ঘটে আরো অসংখ্য বিপথগামিতার, যার উদাহরণ বর্তমান পশ্চিমা সমাজ। আর যে বিপথগামিতার জন্য ভুগতে হচ্ছে গোটা পৃথিবীকে।

এরপর বলা হয়েছে-

وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا

আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন। -সূরা বাকারা (২) : ৩১

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই পৃথিবী ও প্রকৃতির যা কিছু প্রয়োজনীয় ইল্ম দেয়া হয়েছে এবং তা ব্যবহারের যে শক্তি ও যোগ্যতা দান করা হয়েছে তা  ‘খলীফা’ হওয়ার কারণেই দান করা হয়েছে। সুতরাং জাগতিক ইলমের অর্জনও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাকে মালিকের অনুগত ও শোকরগোযার থাকতে হবে

২. তাযকিয়ায়ে নুফূস বা স্বভাব-চরিত্রের পরিশুদ্ধি

ব্যক্তি গঠনের ক্ষেত্রে স্বভাব ও চরিত্রের পরিশুদ্ধি অপরিহার্য। এ কারণেই স্বভাব চরিত্রের সংশোধন ইসলামী শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে  প্রেরণ করার যে উদ্দেশ্যগুলো কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তার একটি হল, ‘তাযকিয়া’ অর্থাৎ স্বভাব চরিত্রের সংশোধন। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-

لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ.

নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উপর রহমত করেছেন; তাদের জন্য তাদের মধ্য হতে একজন রাসূল পাঠিয়ে। তিনি তাদেরকে কুরআনের আয়াতসমূহ পড়ে শোনাবেন। তাদেরকে সংশোধন করবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৬৪

তাযকিয়া শব্দের অর্থ পবিত্র করা অর্থাৎ তিনি মানুষকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করবেন। মানুষের একটি বাহির আছে, একটি ভেতর আছে। শরীয়তে যেমন আছে বাইরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য বিধান তেমনি আছে অন্তর-জগতের জন্য বিধান। মানুষের শরীর যেমন নানা রোগে আক্রান্ত হয় তেমনি তার অন্তরও। অন্তরের ব্যাধিগুলো হচ্ছে : কুফর, র্শিক, হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, সম্পদ ও সম্মানের মোহ ইত্যাদি। কলব বা অন্তর মানুষের শরীরের নিয়ন্ত্রক। অন্তর সংশোধিত হলে দেহের সকল অঙ্গ সংশোধিত হয়। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “জেনে রেখো, মানবদেহে একটি গোশতের টুকরা আছে। এটি ‘সুস্থ’ থাকলে গোটা দেহ ‘সুস্থ’ থাকে আর এটি ‘অসুস্থ’ হলে গোটা দেহ ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়ে। সেই গোশতের টুকরাটি হচ্ছে কলব”। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৯

সুতরাং অন্তরের শুদ্ধি-সংশোধন অপরিহার্য। এরই চেষ্টা-প্রচেষ্টার নাম ‘তাযকিয়া’। এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। আর এটাই তাসাওউফের মূল উদ্দেশ্যে।

ইসলামি ইবাদতে তাযকিয়া

ঈমানের পর ইসলামের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রোকন ইবাদত। ইসলামের ইবাদত-ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, ‘তাযকিয়া’ বা স্বভাব-চরিত্রের সংশোধন। দেখুন, পবিত্র কুরআনে নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে-

إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ.

নিশ্চয়ই নামায বাধা দেয় অশ্লীল ও গর্হিত বিষয়সমূহ থেকে। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৪৫

ইসলামের আরেক ইবাদত যাকাত। কুরআনে যাকাতের উদ্দেশ্য ও ফায়দা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَیْهِمْ   اِنَّ صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ  وَ اللهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ.

হে নবী! আপনি তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন, এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন। আর তাদের জন্য দুআ করুন। নিশ্চয় আপনার দুআ তাদের অন্তরের প্রশান্তির কারণ। আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন (ও) জানেন। -সূরা তাওবা (৯) : ১০৩

কুরআন মাজীদের উপরোক্ত আয়াতে ‘সদাকা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে এ শব্দের অর্থ ‘যাকাত’। একটি হাদীসে ‘সদাকার’ ব্যাপকতা নির্দেশ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “মুসলমান ভাইয়ের সামনে মুচকি হাসাও সদাকা। নিজের বালতি থেকে অন্যের বালতিতে পানি ঢেলে দেয়াও সদাকা। ভালোকাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করাও সদাকা। যে কোনো কষ্টদায়ক বস্তু রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়াও সদাকা। পথ হারাবার জায়গায় কাউকে পথ দেখানোও সদাকা”। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৫৬

সওম সম্পর্কে কুরআন মাজীদের ইরশাদ  তো প্রসিদ্ধ। কুরআনে রোযাকে বলা হয়েছে তাকওয়ার উপায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ.

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পূর্ববর্তীদের মতো তোমাদের উপরও রোযা ফরয করা হয়েছে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৩

যদিও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা-পিনা ও স্ত্রী-সহবাস থেকে বিরত থাকাকে রোযা বলে এবং এটুকু দ্বারা রোযা আদায় হয়ে যায় কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থ রোযার যে পরিচয় দিয়েছেন তাতে কর্ম ও চরিত্রের শুদ্ধিও অপরিহার্য।

এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কেউ যদি রোযা রেখেও মিথ্যা ও অন্যায়-কর্ম বর্জন না করে, তাহলে তার উপবাসে আল্লাহ তাআলার কোনো প্রয়োজন নেই”। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৩

দেহ ও মনের ইচ্ছা পূরণে লিপ্ত থাকলে এই তাগাদা বাড়তে থাকে এবং সংযম শক্তি দুর্বল হতে থাকে। ফলে গুনাহ ও পাপাচার এবং নির্লজ্জতা ও চরিত্রহীনতার মতো ব্যাপার জন্ম নেয়। এ থেকে আত্মরক্ষাও  রোযা ফরয হওয়ার অন্যতম কারণ, যা لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ -বাক্যে উল্লেখিত হয়েছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয বিধান এবং ইসলামের অন্যতম রোকন হজ্ব। হজ্বের বিধানেও চরিত্র সংশোধনের বিষয়টি রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

اَلْحَجُّ اَشْهُرٌ مَّعْلُوْمٰتٌ  فَمَنْ فَرَضَ فِیْهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوْقَ  وَ لَا جِدَالَ فِی الْحَجِّ  وَ مَا تَفْعَلُوْا مِنْ خَیْرٍ یَّعْلَمْهُ اللهُ   وَ تَزَوَّدُوْا فَاِنَّ خَیْرَ الزَّادِ التَّقْوٰی  وَ اتَّقُوْنِ یٰۤاُولِی الْاَلْبَابِ.

হজ্বের জন্য কিছু নির্ধারিত মাস রয়েছে। সুতরাং কেউ যখন এই মাসগুলোতে (নিজের উপর ইহরামের মাধ্যমে) হজ্ব ফরয করে, সে  (জেনে রাখুক) হজ্বে কোনো প্রকার অশ্লীল কথা, গর্হিত কাজ ও ঝগড়া-বিবাদ নেই। তোমরা যে নেক আমলই কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক অবগত। তোমরা পাথেয় নিয়ে চল। আর সর্বোত্তম পাথেয় হল খোদাভীতি। হে বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা, তোমরা আমাকে ভয় কর। -সূরা বাকারা (২) : ১৯৭

এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে, হজ্বের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতেও রয়েছে চরিত্র ও আচরণের পরিশুদ্ধির শিক্ষা।

৩. ভ্রাতৃত্ব ও একতা

ব্যক্তির জীবন ও চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে এক প্রয়োজনীয় বিষয় একতা ও ভ্রাতৃত্বের অনুশীলন। কারণ মানুষকে সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করতে হয়। এই জীবনে পারস্পরিক সব কিছু যাতে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির আবহে সম্পন্ন হতে পারে এর জন্য প্রত্যেকের কর্তব্য, একতা ও ভ্রাতৃত্বের অনুশীলন। পবিত্র সীরাতে এই শিক্ষা অতি স্পষ্ট ও গভীরভাবে রয়েছে।

ইসলামে ভ্রাতৃত্বের মানদ– ঈমান। মুমিনমাত্রই একে অপরের ভাই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ.

মুমিনগণ তো একে অপরের ভাই। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০

এই ঈমানী ভ্রাতৃত্বের সূত্রেই মুসলিম সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। ভাষা, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদির যে পার্থক্য, এগুলো বৈচিত্রমাত্র, যার রয়েছে নানা সামাজিক প্রয়োজন ও উপকারিতা। এগুলোর কারণে পরস্পর বিভক্ত হওয়া বা একে অপরকে তাচ্ছিল্য করার কোনো অবকাশ নেই।

ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চেতনা ও দাবিসমূহের বিষয়ে অজ্ঞতা সমাজে সংকীর্ণতা, দলাদলি ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটায়। ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও নানা বিষয়কে বিভক্তি ও সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যম বানিয়ে নেওয়া হয়। কুরআনুল কারীম পরিষ্কার ভাষায় তা খ-ন করে দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّ اُنْثٰی وَ جَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًا وَّ قَبَآىِٕلَ لِتَعَارَفُوْا اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقٰىكُمْ   اِنَّ اللهَ عَلِیْمٌ خَبِیْرٌ .

হে মানব-সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে এক নর ও নারী থেকে সৃজন করে বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত করে দিয়েছি। যাতে (গোত্র পরিচয়ের মাধ্যমে) তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তবে জেনে রেখো, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাবান সে, যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বজ্ঞ সর্বদ্রষ্টা। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১৩

অর্থাৎ গোত্র ও সমাজের বিভিন্নতা শুধু একে অপরের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। কাউকে অবজ্ঞা করার জন্য নয়। শুধু বংশ-মর্যাদার কোনো মূল্য আল্লাহর কাছে নেই। তাঁর কাছে মূল্য তাকওয়া ও খোদাভীতির। তবে হাঁ, তাকওয়ার সাথে যদি খান্দানী শরাফতও যোগ হয় তবে তো সোনায় সোহাগা।

তো ইসলামী ভ্রাতৃত্বই হচ্ছে সেই সূত্র, যার দ্বারা সকল ভেদাভেদ দূর করা যেতে পারে।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবিগুলো এক এক করে শিক্ষা দিয়েছেন, যেন আমরা বাস্তব জীবনে তা চর্চা করি। যেমন এক হাদীসে তিনি বলেছেন-

এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের পাঁচটি হক রয়েছে :

১. সালামের জবাব দেয়া।

২. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া।

৩. জানাযার সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া।

৪. দাওয়াত কবুল করা।

৫. হাঁচির জবাবে রহমতের দুআ স্বরূপ يَرْحَمُكَ اللهُ বলা। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৬২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৩০

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, ‘কিছুতেই তোমরা জান্নাতে দাখেল হতে পারবে না, যতক্ষণ না ঈমানদার হও। আর কিছুতেই ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না একে অপরকে মুহাব্বত কর’। এরপর বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি বিষয় শিখিয়ে দিব না, যার চর্চা করলে তোমরা একে অপরকে ভালবাসবে? শোনো, নিজেদের মাঝে সালামের প্রসার ঘটাও। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৪

সুতরাং মুসলমানের কর্তব্য, মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতে সালাম দেওয়া। যে সালাম দেয় তার মর্তবা বেশি।

হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ঐ মানুষটি আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত এবং তাঁর রহমতের অধিক হকদার যে আগে সালাম দেয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৯

কুরআন-সুন্নাহয় একদিকে যেমন ভ্রাতৃত্বের সূত্র ও দাবিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে, অন্যদিকে যুলুম ও হক তালাফীর পরিণাম সম্পর্কেও সতর্ক করা হয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলেন, বল তো তোমাদের মধ্যে ‘মুফলিস’ (নিঃস্ব) কে? সাহাবায়ে কেরাম উত্তরে বললেন, আমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি নিঃস্ব, যার অর্থ-সম্পদ নেই। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার উম্মতের মুফলিস ও নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম ও যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু তার অবস্থা এই যে, সে একে গালমন্দ করেছিল, ওকে অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ লুট করেছিল, কারো রক্ত ঝরিয়েছিল। ফলে তার যাবতীয় সৎকর্ম ঐ মযলুমদের দিয়ে দেওয়া হবে। এরপর যখন সকল নেক-কর্ম নিঃশেষ হয়েও মযলুমের পাওনা বাকি থাকবে তখন মযলুমানের পাপরাশি তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। অতপর জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৪১১

বাস্তবিকই এর চেয়ে ‘নিঃস্ব’ আর কে হতে পারে। মোটকথা যুলুম ও অন্যায়কে ইসলাম সবসময়ই কঠোরভাবে নিষেধ করে আসছে; যদিও এই যুলুম হয় অমুসলিমদের উপর। ইরশাদ হয়েছে-

مِنْ اَجْلِ ذٰلِكَ   كَتَبْنَا عَلٰی بَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ اَنَّهٗ مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَیْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِی الْاَرْضِ فَكَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیْعًا .

এ কারণেই আমি বনী  ইসরাঈলের প্রতি এই ফরমান লিখে দিয়েছিলাম, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং  তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করার কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। -সূরা মায়িদা (৫) : ৩২

আরো ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِیْ حَرَّمَ اللهُ اِلَّا بِالْحَقِّ  ذٰلِكُمْ وَصّٰىكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ.

আল্লাহ যে প্রাণকে হত্যা করা হারাম করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তা হত্যা করো না। এগুলো আল্লাহ গুরুত্বের সঙ্গে তোমাদের বয়ান করেছেন, যাতে তোমরা উপলদ্ধি কর। -সূরা আনআম (৬) : ১৫১

হাদীস শরীফের পরিষ্কার ঘোষণা-

مَنْ قَتَلَ مُعَاهَدًا فِي غَيْرِ كُنْهِهِ، حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ.

যে কোনো মুআহাদকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৩৩৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৬০; সুনানে নাসায়ী ৮/২৪-২৫

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

مَنْ قَتَلَ مُعَاهَدًا لَمْ يَرِحْ رَائِحَةَ الجَنَّةِ، وَإِنَّ رِيحَهَا تُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ أَرْبَعِينَ عَامًا.

যে কেউ কোনো মুআহাদকে হত্যা করল সে জান্নাতের খুশবুও পাবে না। অথচ জান্নাতের খুশবু চল্লিশ বছর দূরের রাস্তা থেকেও পাওয়া যাবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯১৪, কিতাবুদ দিয়াত, অধ্যায় ৩০

মুআহাদ বলতে যে বা যাদের সাথে আহ্দ বা চুক্তি হয়েছে তাদেরকে বুঝায়। ফিকহী ভাষায় সে যিম্মি হোক বা সুলাহকারী মুআহাদ বা মুসতা’মান (আশ্রয় গ্রহণকারী), যারা ভিসা নিয়ে, অন্য ভাষায় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে থাকছে, তারা যে মুআহাদের অন্তর্ভুক্ত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এদের সম্পর্কে হযরত আলী রা. বলেছেন-

منْ كَانَ لَهُ ذِمَّتُنا فَدَمُهُ كدمِنَا وديتُهُ كدِيَتِنَا.

যার সঙ্গে আমাদের আহ্দ বা চুক্তি রয়েছে তার জান আমাদের জানের মত। তার দিয়ত (রক্তপণ) আমাদের দিয়তের সমপরিমাণ। -কিতাবুল হুজ্জাহ, ইমাম মুহাম্মাদ ৪/৩৫২-৩৫৫; মুসনাদে শাফেয়ী ১৬১৯

৪. সততা ও সত্যবাদিতা

সততা ও সত্যবাদিতা দুটি প্রশংসনীয় ও সর্বজনস্বীকৃত গুণ যা ছাড়া সৎ ও আদর্শ ব্যক্তিত্বের কল্পনাই করা যায় না। এর বিপরীতে মিথ্যা ও অসততা এক অভিশাপ, যা ব্যক্তির ভেতরগত ফাসাদ ও পচনের প্রমাণ বহন করে। তাই মিথ্যার সাথে যে ঈমানদারের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না তা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন-

ঈমানদারের মধ্যে সব দুর্বলতাই থাকতে পারে, কিন্তু মিথ্যাবাদিতা ও খিয়ানত থাকতে পারে না। -মুসনাদে আহমাদ, ৫/২৫২, শুআবুল ঈমান ৪/৩২৪, হাদীস ৫২৬৭

অন্য রেওয়ায়েতে আছে, তিন শ্রেণীর মানুষ জান্নাতে দাখেল হবে না :

১. বৃদ্ধ ব্যভিচারী।

২. মিথ্যাবাদী শাসক।

৩. সম্পদহীন অহংকারী। -মুসনাদে বাযযার ৬/৪৯৩, হাদীস ২৫২৯

আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মিথ্যাবাদিতার মতো ঘৃণ্য স্বভাব আর কিছুই ছিল না। যার সম্পর্কে তিনি জানতেন যে, সে মিথ্যা বলে তার কোনো মর্যাদাই তাঁর কাছে থাকত না; যে পর্যন্ত না তিনি অবগত হতেন যে, সে তওবা করেছে। -মুসনাদে আহমাদ ৬/১৫২

জীবন ও কর্মের গঠনে সত্যবাদিতার রয়েছে গভীর প্রভাব। যে কথায় সত্যবাদী সে তার কর্মেও হয় ন্যায়নিষ্ঠ। তাঁর স্বভাব-চরিত্রও হয় শুদ্ধ ও ভারসাম্যপূর্ণ। কারণ সত্যবাদিতার প্রভাব মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কেও পড়ে। আর এ কারণে চিন্তা ও অনুভূতির বক্রতা দূর হয়ে যায়।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

তোমরা সত্যবাদিতা অবলম্বন কর। নিঃসন্দেহে সত্য নেকীর পথ দেখায়। আর নেকী জান্নাতের পথে নিয়ে যায়। কোনো বান্দা সত্য বলে এবং বলতে থাকে, এক পর্যায়ে সে আল্লাহর কাছে পরম সত্যবাদী বলে লিখিত হয়। আর মিথ্যাকে পরিহার কর। নিশ্চয়ই মিথ্যা অনাচারের পথ দেখায়। আর অনাচার জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়। কোনো ব্যক্তি মিথ্যা বলে এবং বলতে থাকে এক পর্যায়ে সে আল্লাহর কাছে চরম মিথ্যুক বলে লিখিত হয়ে যায়। -সহীহ বুখারী হাদীস ৫৭৪৩; আলআদাবুল মুফরাদ ১/১৪০, হাদীস ৩৮৬

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ قُوْلُوْا قَوْلًا سَدِیْدًا یُّصْلِحْ لَكُمْ اَعْمَالَكُمْ وَ یَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ  وَ مَنْ یُّطِعِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِیْمًا.

হে ঈমানদারেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তোমাদের কর্মসমূহ শুদ্ধ করবেন এবং পাপরাশি ক্ষমা করবেন। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে সে তো লাভ করেছে মহাসাফল্য। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৭০-৭১

মিথ্যার সাথে খিয়ানত ও প্রতারণার জোড়ালো সম্পর্ক। মিথ্যার পথ দিয়েই মানুষের মাঝে খিয়ানত ও প্রতারণার স্বভাব সৃষ্টি হয়। অপর দিকে সত্যের নিবিড় সম্পর্ক বিশ্বস্ততা ও আমানতদারির সাথে। সত্যনিষ্ঠ মানুষ আমানতদার হয়ে থাকে, খিয়ানত ও বিশ্বাসভঙ্গ করা তার কাছে হয় চরম ঘৃণ্য ও গর্হিত। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমানতদারিকে ঈমানের সাথে যুক্ত করেছেন। ইরশাদ করেছেন-

لاَ إِيْماَنَ لِمَنْ لاَ أَماَنَةَ لَه

যার আমানতদারি নেই তার ঈমানদারিও নেই। -সহীহ ইবনে হিব্বান ১/৪২২, হাদীস ১৯৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৫৯, হাদীস ৩০৩২০

ইসলামে আমানতের মর্ম ও ক্ষেত্র অতি বিস্তৃত। কারো গচ্ছিত সম্পদ যথাযথভাবে ফেরৎ দেওয়া যেমন আমানত, তেমনি যোগ্য লোককে দায়িত্ব অর্পণ করা, চাকুরি-বাকুরির ক্ষেত্রে নির্ধারিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা, আল্লাহর দেয়া যোগ্যতা ও সম্পদের অপব্যবহার থেকে বিরত থাকা, কারো আস্থা বা বিশ্বাস ভঙ্গ না করা, এমনকি কারো গোপন কথা ফাঁস না করাও আমানতের অন্তর্ভুক্ত। এ থেকে বোঝা যায়, চাকুরি-বাকুরিতে দায়িত্বে অবহেলা করা, পণ্যে ভেজাল মেশানো, মিথ্যা কথা বলে পণ্য বিক্রির চেষ্টা করা, যোগ্য লোকের স্থলে অন্যায়ভাবে অযোগ্য লোককে নিয়োগ দেওয়া- এ সবই খিয়ানতের নানা রূপ।

আমানত ব্যক্তি ও সমাজে বরকত নিয়ে আসে। আর খিয়ানত তা দূর করে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ে যদি সত্য বলে তাহলে আল্লাহ তাদের ব্যবসায় বরকত দান করেন। পক্ষান্তরে তারা যদি মিথ্যার আশ্রয় নেয় তাহলে ব্যবসা থেকে বরকত উঠিয়ে নেয়া হয়। -সহীহ বুখারী ২/৭৪৩, হাদীস ২০২

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, মিথ্যা কসমের দ্বারা পণ্য দ্রুত বিক্রি হয়। কিন্তু তা বরকতশূন্য হয়ে পড়ে। -সহীহ বুখারী ২/৭৩৫, হাদীস ১৯৮১

হযরত ওয়াছিলা ইবনুল আছকা রা. বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ক্রেতাকে না জানিয়ে যে ত্রুটিযুক্ত পণ্য বিক্রি করে দেয়, হামেশা তার উপর আল্লাহর ক্রোধ ও ফেরেশতাদের লানত বর্ষিত হতে থাকে। -সুনানে ইবনে মাজাহ ২/৩৮, হাদীস ২২৪৭

৫. ক্ষমা ও উদারতা

ক্রোধ ও আবেগ মানুষের বিচারবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে এবং পরিণামে দুঃখ ও অনুশোচনার কারণ হয়। তাই ব্যক্তিত্ব গঠনে আবেগ ও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের যোগ্যতা এবং ক্ষমা ও উদারতা এক অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করে বলেছেন- শোনো, তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম যে দেরিতে রাগে, তাড়াতাড়ি ফিরে আসে (রাগ প্রশমিত করে)। আর মন্দ সে যে তাড়াতাড়ি রাগে আর দেরিতে শান্ত হয়। -জামে তিরমিযী ৪/১৮, হাদীস ২১৯৮

ক্রোধের পরিস্থিতিতেও যে নিজেকে সংযত রাখতে পারে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে যথার্থ বীর পুরুষ করেছেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, সাহাবাদের লক্ষ করে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেমন ব্যক্তিকে বাহাদুর মনে কর? সাহাবায়ে কেরাম উত্তর করলেন, যাকে কেউ ধরাশায়ী করতে পারে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অন্যকে ধরাশায়ী করা প্রকৃত বাহাদুরি নয়। বাহাদুর তো সে যে ক্রোধের মুহূর্তে নিজেকে সংযত রাখতে পারে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৬৩; সহীহ মুসলিম ৪/১৯০, হাদীস ২৬০৯

এক সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে সংক্ষেপে নসীহত করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রাগ করবে না’। সাহাবী (নতুন উপদেশ চেয়ে) বারবার আবেদন করলেন। কিন্তু রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারবার একই জবাব দিলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৬৫

আরব জাহেলিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য ছিল দম্ভ ও ক্রোধ। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিপরীতে ক্ষমা ও উদারতার শিক্ষা প্রচার করেছেন। আর এর মাধ্যমে এই ক্রোধোন্মত্ততা ও প্রতিশোধপরায়ণতার স্বভাব দূর করেছেন। তদ্রূপ গালিগালাজ, কটূক্তি, যুলুম-অবিচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন।

ইরশাদ হয়েছে-

سِبَابُ المُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ

কোনো মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেকী আর লড়াই করা কুফরী। -সহীহ বুখারী ১/২৭, হাদীস ৪৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৪

তিনি আরো বলেন-

গালি-গালাজের সূচনা যে করবে যাবতীয় গুনাহ তার হবে, যদি না মাযলুম সীমা অতিক্রম করে। -সহীহ মুসলিম ৪/১৮১, হাদীস ২৫৮

মোটকথা, ক্রোধ ও উত্তেজনা-মুহূর্তেই ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা কাম্য। এক পক্ষের ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা অন্য পক্ষকে নিজের ভুল বুঝতে সহায়তা করে।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই শিক্ষার ফলে জাহেলী যুগের মারাত্মক প্রতিশোধপরায়ণতা নির্মূল হয়েছিল, যুগ যুগ ধরে যা ছিল ঐ সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয়-চিহ্ন। এর স্থলে গোটা সমাজে ক্ষমা ও উদারতার বিস্তার ঘটেছিল এবং প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে একে অন্যের হক আদায়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। 

রবিউল আউয়াল ১৪৩৮ – ডিসেম্বর ২০১৬

মাসিক আলকাউসার