সেকুলারিজম : রাষ্ট্র থেকে গির্জার পৃথকীকরণ

রাষ্ট্র থেকে গীর্জার পৃথকীকরণ পশ্চিমে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে, এবং তাদের মাধ্যমেই এটি একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এই ধারণাটি উদ্ভুত হয়েছে মূলত পশ্চিমা সমাজ ও সংস্কৃতিতে খৃষ্টান ও অন্যান্য লোকদের সমস্যাবলিকে মোকাবেলার জন্য একটি প্রায়োগিক কৌশল হিসেবে।

ধীরে ধীরে, যেভাবেই হোক, রাষ্ট্র থেকে গীর্জাকে পৃথক করা প্রতিটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্যই একটি জনপ্রিয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। এর মাধ্যমে এখন দেখা হয় যেকোনো রাষ্ট্রে বসবাসের জন্য ধর্মীয় পরিচয় নয়, বরং নাগরিকত্বই তার মূল ভিত্তি হওয়া উচিৎ; যেহেতু বহু ধর্মের বহুলোক বসবাস করে একই রাষ্ট্রে। রাষ্ট্র যদি কোন একক ধর্মের আজ্ঞাবাহী হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য ধর্মের লোকেরা নিজেদেরকে মূল থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করবে, এবং অপর একটি ধর্মকে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। তারা হয়তো তখন নিজেদের ধর্মীয় আচার আচরণ ও বিধিবিধান চর্চায় বাধাগ্রস্ত হবে, এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদপ্রাপ্তি থেকে তারা বঞ্চিত হবে। যেমন প্রেসিডেন্টের পদ বা আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যেসব জায়গা আছে। যা পরবর্তীতে নানান সঙ্কট ও সংঘাত তৈরী করবে, এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এসব কারণে এই পদ্ধতির (সেক্যুলার) প্রবক্তা ও সমর্থকরা মনে করলেন, সবচে ভালো হয় রাষ্ট্র যদি সেক্যুলার অবস্থাণ গ্রহন করে; মানে কোন ধর্মকে সমর্থনও করবে না আবার কোন ধর্মকে অস্বীকারও করবে না। বরং ধর্মের ব্যাপারটা সম্পূর্ণই নাগরিকদের উপর ন্যাস্ত থাকবে; কোন ধর্ম বা মূল্যবোধ তারা লালন করবে আর কোন ধর্মের বিধিবিধান মেনে চলবে–সেটা সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছানুযায়ী হবে।

তো, এটা হলো নিরপেক্ষ সেক্যুলার রাষ্ট্রের একেবারে আদর্শ উদাহরণ, পশ্চিমা রাজনীতিবিদগণ যেটার বাস্তবায়ন ঘটানোর ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করার এই রাজনৈতিক প্রকল্প এমন কিছু কাল্পনিক পূর্বানুমান তৈরি করেছে, বাস্তব জগতে যেটার অস্তিত্ব পাওয়া খুবই মুশকিলের ব্যাপার। তেমন কিছু বিষয় এখানে বিচার-বিবেচনা করে দেখা যাক।

ধারণা করা হয় যে, একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের জন্য সব ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা খুবই সম্ভব, তবে এর ভিত্তি হলো ধর্ম রাষ্ট্রের কোন বিষয়ে নাক গলাতে পারবে না এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলির উপর প্রভাব খাটাতে পারবে না। এটা সম্ভব হতো, যদি বাস্তবেই রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলির সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক না থাকতো, এবং তারা উভয়েই যদি একে অপর থেকে পৃথক কোনো সত্তা হতো। যেহেতু, ধর্মের সম্পর্ক কেবলই কিছু সমষ্টিগত বিশ্বাস, বিধিবিধান আর ব্যক্তির নিজস্ব আচার-আচরণের মাঝেই সীমাবদ্ধ না যে, সমাজের উপর এর কোনো প্রভাব থাকবে না। বরং বহুল প্রসিদ্ধ ধর্মগুলোর অধিকাংশেরই–খৃষ্টান, ইহুদি, ইসলাম–এমন অনেক আইন-কানুন আছে যেগুলোকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা সম্ভব না। সেটা পারিবারিক বা ব্যক্তিপর্যায় থেকে নিয়ে বৃহত্তর সমাজ পর্যন্ত, এমনকি খাদ্য-পানীয়সহ মানুষের দৈনন্দিন রুটিনের বহু কাজ আছে যা সরাসরি রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত।

এই বিরোধ সমাধানের জন্য পশ্চিমা রাজনীতিবিদগণকে কিছুটা আপোসকামিতায় নেমে আসতে হয়েছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রাষ্ট্রের আইন-কানুন বানানোর ক্ষেত্রে কিছু ধর্মীয় (খৃষ্ট ধর্ম) মূল্যবোধকেও রাখা হবে। আর পশ্চিমা ফরেইন পলিসিতে খৃষ্টান ধর্মীয় মূল্যবোধ কী, সেটা একদমই পরিষ্কার, বিশেষত ইসলামী বিশ্বের মোকাবেলায়।

একই সময়ে খৃষ্ট ধর্মের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছিল নিতান্তই অবহেলিত ও প্রশ্নের সম্মুখীন। উদারবাদী আন্দোলনগুলো (liberal movements) বেশ আক্রমণাত্মক হয়েছিলো তার প্রতি। তারা প্রশ্ন তুলল, বর্তমানে খৃষ্টানদের যেসব গ্রন্থসমূহকে পবিত্র গ্রন্থ ও আল্লাহর বাণী হিসাবে মানা হয়, এগুলো স্রেফ কিছু মানুষের বানানো কথা, যার লেখকেরা তৎকালীন সমাজ ও সংস্কৃতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এই মতবাদটি আরও ভালোভাবে শক্তিশালী ও সমর্থিত হয় বাইবেলের আলাদা আলাদা সংস্করণ উপস্থিত থাকায়। এক সংস্করণের সাথে অপর সংস্করণের বৈসাদৃশ্য প্রচুর। একইভাবে, বাইবেলে কিছু ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে–যেমন সমকামিতা–তো, সেসব নিষেধাজ্ঞাকে স্রেফ সামাজিক আইন হিসাবে দেখা উচিৎ, যা একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত মেনে চলা হতো। বর্তমান সময়ে সেই মান্ধাতা আমলের আইন মেনে চলার কোনো যুক্তি নাই।

বাইবেল-বিরোধী এই আন্দোলন রাজনীতিবিদ, নেতা-নেত্রী, এমনকি ধর্মীয় পণ্ডিতদেরও সমর্থন লাভে সক্ষম হয়। এর ফলস্বরূপ, সেক্যুলারিজম নিজে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়, এবং একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বাকি থাকেনি আর। এখন চাইলে সেক্যুলারিজমকে একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবেও বিবেচনা করা যায়, পশ্চিমা সমাজে যার উগ্র অনুসারী ও সমর্থক আছে, এবং তারা প্রতিনিয়ত খৃষ্টবাদকে আক্রমণ ও এর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে।

সুতরাং, রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার এই আধুনিক প্রবণতাকে মুসলমানরা কিভাবে গ্রহণ করতে পারে তাদের নিজেদের দেশে?

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অন্যতম একটি হলো কুরআন শতভাগ আল্লাহর কালাম, এবং হাদিসও আল্লাহ কর্তৃক প্রদর্শিত মুসলমানদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পথনির্দেশনা। ইসলাম কোনোভাবেই রাষ্ট্র থেকে আলাদা হতে পারে না। কেননা, ইসলাম একদম খুলে খুলে সবিস্তারে মানুষকে তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশনা দেয়। অতএব সেক্যুলারিজমকে বর্জন করা ব্যতীত মুসলামনদের আর কোনো পথ নেই, যেহেতু সেক্যুলারিজম শুরুতেই আল্লাহর আইনকে বাতিল করে দেয়।

সেক্যুলার রাষ্ট্রের সমর্থকরা এই বিতর্ক উত্থাপন করেন যে, এক ধর্মের মূল্যবোধ সেই রাষ্ট্রের অন্যান্য ধর্মের লোকদের উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না, যেমনটা আমাদের অনেক দেশেই দেখা যায়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, অমুসলিমরা কোনো মুসলিম দেশে কম হোক বা বেশি হোক, সেক্ষেত্রে সেক্যুলারিজম এর কোনো সমাধান নয়। অমুসলিমরা মুসলিম রাষ্ট্রে হয় নিজেরা সেক্যুলার হবে, ইসলামকে রাষ্ট্রের আইন হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য, নতুবা তারা নিজ নিজ ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী হবে, এবং তারা চাইবে রাষ্ট্রের আইন চলুক তাদের ধর্ম অনুযায়ী। তো, এই উভয় অবস্থাতেই ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনো ছাড় দেয়া সম্ভব না।

এখানে বিশেষভাবে যে জিনিসটি মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো, ইসলামি আইন অনুসারে ইসলামি রাষ্ট্রে অন্যান্য ধর্মপালন নিষিদ্ধ নয়। বরং ইসলামের সাথে সাথে রাষ্ট্রে বসবাসরত অন্যান্য ধর্ম-বিশ্বাসের লোকদেরকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষা দেয়া হবে।

পশ্চিমের সেক্যুলারপন্থীরা প্রথমত এইমতের সাথে একমত হবে, তারপর প্রশ্ন তুলবে, ইসলামী আইনের অধীনে তো সকল ধর্মের নাগরিক সমান অধিকার পাবে না। উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম দেশে কোনো অমুসলিম কখনো প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না।

এই প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, সেকুলার রাষ্ট্র ব্যাবস্থাও তো এর ভিন্ন কিছু না! কেননা কোনো মুসলমান সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। যেহেতু স্যাকুলার সিস্টেমে একজন প্রেসিডেন্টকে দেশের সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে হয়। একজন মুসলমানকে তার নিজস্ব ধর্মের বিশ্বাসকে বিসর্জন দিয়ে সেক্যুলার বিশ্বাসকে গ্রহণ করতে হয়, এবং সেটা বাস্তবিক অর্থেই স্বতন্ত্র একটি ধর্ম।

মুসলমানদের জন্য ‘ধর্ম’ শব্দটি নিছকই কতগুলো বিশ্বাস আর বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপ নয়, বরং এটা এমন এক সামগ্রিক জীবনের কথা বলে যাতে রয়েছে সবরকমের মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, আচার-আচরণ, এবং জীবনযাপনের সার্বিক দিকনির্দেশনা।

সুতরাং, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো দেশের জন্য সেক্যুলারিজম আদৌ কোনো সমাধান নয়। কারণ, এর মৌলিক দাবীই হলো মানুষ তার খোদাপ্রদত্ত বিধিবিধানকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মানবরচিত ধর্মকে গ্রহণ করবে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করা মুসলমানদের জন্য কোনো ‘অপশন’ হতে পারে না, যেহেতু এটা আল্লাহর আইনকে বাতিল করে দেয় মানবরচিত আইন গ্রহণ করার জন্য।


(লেখাটি সুদানের প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার জাফর শেখ ইদ্রিস হাফিজাহুল্লাহ’র বক্তব্য থেকে চয়িত ও অনূদিত)
অনুবাদকঃ হুজাইফা মাহমুদ
সূত্রঃ fateh24