আহকামে শহীদ
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মৃত্যু এড়িয়ে যাওয়া কারো সাধ্যে নেই। মৃত্যুর মধ্যে সর্বোত্তম ও সম্মানজনক মৃত্যু হল শাহাদাতের মৃত্যু। স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারবার শাহাদত কামনা করেছেন। শাহাদাত পিয়াসী নবীর উম্মত হিসেবে মুসলমান মাত্রই শাহাদাতের তামান্না করা ও এ জন্য নিম্নোক্ত দু‘আ করা উচিত।
اللَّهُمَّ ارْزُقْنِى شَهَادَةً فِى سَبِيلِكَ
হে আল্লাহ! আমাকে তোমার রাহে শাহাদাত নসীব করো।
সাধারণতঃ কাফেরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিকেই শহীদ মনে করা হয়। অথচ নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত ব্যক্তি ছাড়া আরো অনেক মাইয়্যেতকে শহীদী মর্যাদা লাভের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি এমন সব মাইয়্যেতকেও শহীদ হিসেবে গণ্য করেছেন যাদের মৃত্যুকে সাধারণত “অপমৃত্যু” মনে করা হয় (নাউযুবিল্লাহ)। অবশ্য সশস্ত্র যুদ্ধে নিহত শহীদ আর অন্যান্য শহীদের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য থাকবে।
নিম্নে উভয় প্রকার শহীদের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হচ্ছে।
মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো ও কাফন দেয়ার দিক বিবেচনায় শহীদ দুই প্রকার।
১. হাকীকী শহীদ। যিনি দুনিয়া-আখেরাত উভয় বিচারে শহীদ। তাকে গোসল করানো হয় না। কাফন দেয়া হয় না। বরং যে কাপড়ে সে শহীদ হয়েছে সে কাপড়েই জানাযা পড়ে দাফন করা হয়।
২.হুকমী শহীদ। যিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুসংবাদ মুতাবেক আখেরাতে শহীদের মর্তবা লাভ করবেন। কিন্তু পৃথিবীতে তার উপর প্রথম প্রকার শহীদের বিধান জারী হবে না। অর্থাৎ, সাধারন মাইয়্যেতের মত তাঁকেও গোসল-কাফন ইত্যাদি দেয়া হবে।
নিম্নোক্ত শর্তাবলী পাওয়া গেলে তাকে হাকীকী শহীদ গণ্য করা হবে।
(ক) মুসলমান হওয়া (খ) প্রাপ্ত বয়স্ক ও বোধসম্পন্ন হওয়া (গ) গোসল ফরয হয় এমন নাপাকী থেকে পবিত্র হওয়া (ঘ) বে-কসুর নিহত হওয়া (ঙ) মুসলমান বা যিম্মীর হাতে নিহত হলে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হওয়াও শর্ত। আর যুদ্ধ কবলিত এলাকায় কাফেরের হাতে অথবা ইসলামী খিলাফতের বিদ্রোহী ডাকাতের হাতে নিহত হলে ধারালো অস্ত্রের আঘাত শর্ত নয়। (চ) এমনভাবে নিহত হওয়া যার শাস্তি স্বরুপ প্রাথমিক পর্যায়েই হত্যাকারীর উপর কিসাসের বিধান আরোপিত হয়। (ছ) আহত হওয়ার পর কোন রূপ চিকিৎসা ও জীবন ধারনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াদী যেমনঃ খানা-পিনা ঘুমানো ইত্যাদির সুযোগ না পাওয়া। হুশ অবস্থায় তার উপর এক ওয়াক্ত নামাযের সময় অতিবাহিত না হওয়া। পদদলিত হওয়ার আশংকা না থাকলে হুশ অবস্থায় লড়াইয়ের ময়দান থেকে তাঁকে উঠিয়ে না আনা।
এখন হুকমী শহীদের তালিকা পেশ করা হচ্ছে
(১) এমন নিহত ব্যক্তি যার মধ্যে প্রথম প্রকার শহীদের শর্তাবলীর কোন একটি পাওয়া যায়নি। (রদ্দুল মুহতার-২/২৫২)
(২) কাফের, বিদ্রোহী বা ডাকাতের উপর কৃত আক্রমণ উল্টে এসে আক্রমণকারীকেই আঘাত করেছে এবং এ আঘাতেই আক্রমণকারী নিহত হয়েছে। (বুখারী-৩/১০২৭ পৃ: হা: ৪১৯৬)
(৩) ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানারক্ষী, ডিউটিকালীন যার স্বাভাবিক মুত্যু হয়েছে। (মুসলিম-৩/১৫২০ পৃ: হা: ১৯১৩)
(৪) আল্লাহর রাহে শাহাদত লাভের প্রার্থনাকারী কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু তার সে বাসনা পূর্ণ করেনি। (মুসলিম-৩/১৫১পৃ: হা: ১৯০৯)
(৫) জালিমের সঙ্গে অথবা নিজ পরিবার হেফাজতের লড়াইয়ে মৃত্যুবরণকারী। (আহমদ-১/১৯০পৃ: হা: ১৬৫৭)
(৬) নিজের জান-মাল ছাড়িয়ে আনা বা রক্ষা করার লড়াইয়ে নিহত ব্যক্তি। (আহমদ-১/১৮৭ পৃ: ১৬৩৩)
(৭) মজলুম রাজবন্দী। বন্দীদশাই যার মৃত্যুর কারণ। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৪পৃ:)
(৮) নির্যাতনের ভয়ে আত্মগোপনকারী। যার এ অবস্থায় মৃত্যু এসে গেছে।
(৯) মহামারীতে মৃত্যুবরণকরী। এ মর্যাদা সে ব্যক্তিও লাভ করবে যে মহামারী চালাকালীন আক্রান্ত এলাকায় সওয়াবের নিয়তে ধৈর্য্য ধরে অবস্থান করে এবং সে সময় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে। (বুখারী শরীফ:১/১৬২পৃ: হা: ৬৫৩)
(১০) ডায়রিয়ায় বা পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী। (বুখারী শরীফ-১/১৬২ পৃ. হা:৬৫৩)
(১১) নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণকারী। (মাজমাউয যাওয়াইদ-৫/৩৮৯পৃ. হা: ৯৫৫৪)
(১২) ذات الجنب অর্থাৎ, প্লুরিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিও শহীদ। (সুনানে ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬ পৃ. হা: ২৮০৩)
(১৩) মৃগী রোগে বা বাহন হতে পড়ে মৃত্যুবরণকারী। (মুসতাদরাকে হাকেম-৩/৯০৯ পৃ. হা: ২৪১৬)
(১৪) জ্বরে ভুগে মৃত্যুবরণকারী। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫)
(১৫) সী সিকনেস বা সমুদ্র দুলুনীতে মাথা ঘুরে বমি করে মৃত্যুবরণকারী। (সুনানে আবূ দাউদ-২/১০পৃ. হা: ২৪৯৩)
(১৬) যে ব্যক্তি রোগ শয্যায় চল্লিশবার “লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নী কন্তু মিনায যালিমীন” পড়ে এবং ঐ রোগেই পরপারে পাড়ি জমায়।
(১৭) যে দম আটকে মারা গেছে।
(১৮) বিষাক্ত প্রাণীর দংশনে যার দৃত্যু হয়েছে। (মুসতাদরকুল হাকেম-৩/৯০৯পৃ. হা: ২৪১৬)
(১৯) হিংস্রপ্রাণী যাকে ছিড়ে ফেড়ে মেরে ফেলেছে। (মাজমাউয যাওয়াউদ-৫/৩৯০পৃ. হা: ৯৫৫৯)
(২০) পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকরী। (বুখারী-১/১৬২পৃ. হা: ৬৫৩)
(২১) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকরী। (ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬পৃ. হা: ২৮০৩)
(২২) বিল্ডিং ধ্বসে বা দেয়াল চাপা পড়ে নিহত ব্যক্তি। (বুখারী-১/১৬২পৃ. হা: ৬৫৩)
(২৩) গর্ভবতী মৃত স্ত্রীলোক। (ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬পৃ. হা: ২৮০৩)
(২৪) সন্তান প্রসবকালে মৃত্যুবরণকারী অথবা প্রসবান্তে নেফাস চলাকালীন মৃত্যুবরণকারীনী। (ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬পৃ. হা: ২৮০৩)
(২৫) কুমারী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীনী। (সুনানে ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬পৃ. হা: ২৮০৩)
(২৬) প্রবাসে-পরদেশে মৃত্যুবরণকারী। (ফাতহুল বারী-৬/৫৬পৃ.)
(২৭) ইলমে দীন চর্চায় লিপ্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫)
(২৮) সওয়াবের আশায় আযান দেয় যে মুআযযিন। (আত্তারগিব ওয়াত তারহিব-১/১২৯পৃ. হা: ৩৬৪)
(২৯) যে ব্যক্তি বিবি বাচ্চার হক যথাযথ আদায় করে এবং তাদের হালাল খাওয়ায়।
(৩০) সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী। (সুনানে তিরমিযী-১/৩৭৭পৃ. হা: ১২১২)
(৩১) মুসলমানদের শহরে খাদ্য আমদানীকারক ব্যবসায়ী।
(৩২) মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহারকারী। যে শরয়ী প্রয়োজন ব্যতীত মন্দ লোকের সঙ্গেও মন্দ আচরণ করে না।
(৩৩) উম্মতের ফেতনা-ফাসাদের সময় ও যিনি সুন্নাতের উপর অটল থাকেন। (মেশকাত-১/৫৫পৃ. হা: ১৭৬)
(৩৪) যিনি রাত্রিবেলায় উযূ করে শয়ন করেন এবং ঐ ঘুমেই তার মৃত্যু এসে যায়। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫প.)
(৩৫) জুম‘আর দিনে মৃত্যুবরণকারী। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫প.)
(৩৬) দৈনিক পঁচিশবার এই দু‘আ পাঠকারী।
اَللّهُمَّ بَا ِركْ لِيْ فِيْ الْمَوْتِ وَ فِيْمَا بَعْدَ الْمَوْتٍ (مر قاة المفا تيح: [২৭০/৫
(৩৭) দৈনিক চাশ্তের নামায আদায়কারী। মাসে তিনদিন রোযা পালনকারী এবং ঘরে-সফরে সর্বদা বেতের নামায আদায়কারী। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫প.)
(৩৮) প্রতি রাতে সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াতকারী।
(৩৯) দৈনিক একশত বার দুরূদ পাঠকারী। (ত্ববরানী ফিল আওসাতি-৫/২৫২,পৃ.৭২৩৫)
(৪০) যে স্ত্রীলোক তার সতীনের প্রতি তার স্বামীর (অন্যায়) ভালবাসার দুঃখ সয়ে সয়ে মৃত্যুবরণ করে। (ফাতওয়া শামী-২/২৫২, আহকামে মায়্যেত-১০১-১১২)