শাকহাবের যুদ্ধ

শাকহাবের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৭০২ হিজরির ২ রমাদানে। খ্রিস্টিয় হিসেবে সময়টা ছিল ২০ এপ্রিল ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দ। যুদ্ধের পটভূমির সূচনা হয় ৭০২ হিজরির রজব মাসে, যখন হালাব থেকে কায়রোতে একটি পত্র আসে। এই পত্র এসেছিল সুলতান নাসির মুহাম্মদ বিন কালাউনের নামে। পত্রে লেখা ছিল, তাতারসম্রাট মাহমুদ গাযান তার বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সুলতান নাসির মুহাম্মদ বিন কালাউন পত্র পড়ে চিন্তিত হলেন। মাহমুদ গাযান তাতার ইলখানাতের সম্রাট। তিন বছর আগে থার্ড ব্যাটল অব হোমসে মামলুক বাহিনী পরাজিত হয়েছিল মাহমুদ গাযানের বাহিনীর হাতে। সুলতান দেখলেন, সুযোগ এসেছে তাতারদের পরাজিত করার। তিনি দ্রুত তার আমির দ্বিতীয় বাইবার্সকে (১) তিন হাজার সেনা ও কয়েকজন আমিরসহ সিরিয়ায় প্রেরণ করলেন।

শাবানের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় বাইবার্স দামেশকে উপস্থিত হলেন। ততদিনে চারদিকে তাতার-আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। হামা ও হালাব থেকে দলে দলে লোকজন পালিয়ে দামেশকে চলে আসছে। এমনকি দামেশকের লোকরাও পালানোর চিন্তা করছে। আতংক ঠেকানোর জন্য দ্বিতীয় বাইবার্স ঘোষণা দিলেন, কেউ যদি দামেশক থেকে পালাতে চায় তাহলে তাকে হত্যা করা হবে। তার সম্পদ লুট করা হবে। এই ঘোষণার ফলে লোকজন বাধ্য হয়ে বাড়িতেই অবস্থান করে। দ্বিতীয় বাইবার্স দ্রুত সুলতানের কাছে পত্র লিখে তাকে সিরিয়ায় আসার আহ্বান জানান। এদিকে মাহমুদ গাযান তার সহকারী কুতলু শাহকে বিশাল বাহিনীসহ সিরিয়ার দিকে প্রেরণ করেন। কুতলু শাহ তার বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার দিকে এগিয়ে এলো। পথে সে সংবাদ পেলো সুলতান নাসির মুহাম্মদ এখনো মিসর থেকে বের হননি। তাই সে এগিয়ে এসে হামার উপর আক্রমন করলো। এখানে সে অনেককে হত্যা করে। তাদের সম্পদ লুটপাট করে। ভাগ্যবানরা পালিয়ে দামেশকে চলে আসেন।

দামেশকে তখন নানা অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা লোকজনের ভীড়। সবাই প্রস্তুত ছিল আসন্ন যুদ্ধের জন্য। কেউ কেউ অপেক্ষা করতে চাইছিল না। তাদের বক্তব্য ছিল, শহর থেকে বের হয়ে তাতারদের মুখোমুখি হবে। অপরদিকে অন্যরা চাচ্ছিল সুলতানের আগমনের অপেক্ষা করতে। এই সিদ্ধান্থীনতায় সময় কাটছিল ওদিকে এগিয়ে আসছিল কুতলু শাহর বাহিনী। এর মধ্যে রমাদানের চাঁদ দেখা গেল। রমাদানের প্রথমদিন পার হলো। রাতের বেলা পুরো শহরে দোয়া শুরু হয়। ঐতিহাসিক মাকরেজি লিখেছেন, রাতেরবেলা শহরবাসী দামেশকের জামে মসজিদে অবস্থান করে দোয়া করছিল। এই সময় দামেশকে অবস্থান করছিলেন হিজরী অষ্টম শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন আলেম। তিনিও লোকদের জিহাদের জন্য উজ্জীবিত করছিলেন। ইতিহাস এই আলেমকে চেনে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা নামে। তিনি বারবার বলছিলেন, এই যুদ্ধে তোমরাই বিজয়ী হবে। কেউ কেউ তাকে বললো, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন। তিনি বললেন, আল্লাহ চাহে তো যুদ্ধে তোমাদের বিজয় অবশ্যই হবে, কেউ তা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

এরপর তিনি আয়াত তেলাওয়াত করেন
ذَلِكَ وَمَنْ عَاقَبَ بِمِثْلِ مَا عُوقِبَ بِهِ ثُمَّ بُغِيَ عَلَيْهِ لَيَنصُرَنَّهُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ
এটাই প্রকৃত অবস্থা। যে ব্যক্তি নিপীড়িত হয়ে তার সমপরিমান প্রতিশোধ গ্রহণ করে, এরপর তার উপর আবার নিপীড়ন করা হয় তাহলে আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পাপ মোচনকারী, অতীব ক্ষমাশীল। সুরা হাজ্জ ৬০।

তখনো অনেকের মনে তাতারদের সাথে লড়াই করার ব্যাপারে দ্বিধা ছিল। তাদের বক্তব্য ছিল তাতারদের অনেকেই বাহ্যিকভাবে ইসলামের অনুসারী। এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ঠিক হবে কিনা। ইবনু তাইমিয়্যা বললেন, এরা হলো সেই খারেজিদের মতো, যারা হযরত আলী (রা) ও হযরত মুয়াবিয়া (রা) এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। এর পর তিনি বললেন, যদি তোমরা দেখো আমি মাথায় কোরান নিয়ে তাতারদের বাহিনীর সামনে আছি তাহলে আমাকেও হত্যা করো। (২)

রাত পার হলো। পরদিন সকালে সুলতান বাহিনীসহ দামেশকে প্রবেশ করলেন। সুলতানের আগমনে মুসলমানদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। তারা সুলতানের বাহিনীকে স্বাগতম জানান। এদিকে কুতলু শাহর বাহিনী তখন একেবারে নিকটে চলে এসেছে। সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। সিদ্ধান্ত হয় দামেশক থেকে ২৫ মাইল দক্ষিণে শাকহাব নামক সমতলভূমিতে তাতারদের মোকাবেলা করা হবে। (৩) দ্রুত বাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়। ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন ইয়াস হানাফির বর্ননামতে, এ সময় মামলুক বাহিনীর সেনাসংখ্যা ছিল ২ লক্ষ। (৪) অপরদিকে তাতারদের সেনাসংখ্যা ছিল দুই লাখেরও বেশি। সুলতান অবস্থান করছিলেন বাহিনীর মাঝখানে। তার সাথে ছিলেন কারীরা। তারা কোরান তিলাওয়াত করছিলেন এবং সেনাদেরকে জিহাদের জন্য উজ্জিবিত করছিলেন। সুলতানের পক্ষ থেকে ঘোষকরা বারবার বলছিল, হে সেনারা তোমরা তোমাদের সুলতানের কথা ভেবে যুদ্ধ করো না। তোমরা তোমাদের নবির দ্বীনের কথা ভেবে লড়াই করো। সেনারা কান্না করে দোয়া করছিল। বাহিনীর পেছনদিকে দাসদের রাখা হয়েছিল। তাদের উপর নির্দেশ ছিল কেউ পালাতে চাইলে তাকে হত্যা করতে। বিনিময়ে তার অস্ত্র ও ঘোড়া হত্যাকারী পাবে।
তাতাররা দ্বিপ্রহরে শাকহাব ময়দানে এসে পৌছে। কুতলু শাহ তার দশ হাজার সেনার একটি বাহিনী নিয়ে মামলুকদের ডান বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রচন্ড লড়াই। আহতদের চিৎকার ও তরবারীর ঝনঝনানিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। তীব্র লড়াইয়ে মামলুকদের ডানভাগের সেনানায়ক হুসামউদ্দিন নিহত হন। বাম ভাগ ও মাঝের অংশের দায়িত্ব ছিলেন বাইবার্স জাশনাকির। তিনি এবার ডানভাগের সহায়তায় নিজের সেনাসহ এগিয়ে আসেন। প্রচন্ড লড়াই চলতে থাকে। মামলুক সেনারা তাকবীর দিচ্ছিল। একইসাথে দোয়া চলতে থাকে। কুতলু শাহ ময়দানের পাশের একটি পাহাড়ে আরোহণ করে। সে নিশ্চিত ছিল তাতাররাই বিজয়ী হবে। তাই জয় উপভোগ করার জন্য সে পাহাড়ে উঠে। কিন্তু পাহাড়ে উঠার পর পুরো ময়দানের দৃশ্য তার সামনে আসে। এই প্রথম তার মনে হলো মামলুকদের সাথে সহজে জয়ের কোনো আশা নেই। কুতলু শাহ পাহাড় থেকে নেমে আসে। প্রথমদিন কোনো নিষ্পত্তি ছাড়াই লড়াই সমাপ্ত হয়। রাতেরবেলা দুই শিবিরেই আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। আমিররা ঘুরে ঘুরে সেনাদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছিলেন। পরদিন সকালে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। এদিনের যুদ্ধে তাতাররা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পানির নিয়ন্ত্রন ছিল মামলুক বাহিনীর হাতে। পিপাসার্ত তাতাররা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছিল। ধীরে ধীরে জয়ের পাল্লা মামলুকদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দ্বিপ্রহরের সময় তাতাররা পালাতে থাকে। মামলুকরা অনেকদূর পর্যন্ত তাদের ধাওয়া করে। মাকরেজির লিখেছেন, তাতারদের বেশিরভাগই নিহত হয়। কুতলু শাহ খুব অল্প কিছু সেনাসহ পালাতে পেরেছিলেন।

মুসলিম শিবিরে বিজয়ের উল্লাস শুরু হয়। দ্রুত আমির বদরুদ্দিনকে মিসরে পাঠানো হয় জয়ের সুসংবাদ দিয়ে। সুলতান তার বাহিনীসহ দামেশকে ফিরে আসেন। শহরবাসী আনন্দে কান্না করছিল। এ বিজয় তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। সুলতান এখানে ঈদুল ফিতর পর্যন্ত অবস্থান করেন। শাওয়ালের তিন তারিখে তিনি মিসরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। 
ওদিকে কুতলু শাহ পরাজয়ের সংবাদ নিয়ে হামাদান পৌছে। মাহমুদ গাযান তখন এখানে অবস্থান করছিল। পরাজয়ের সংবাদ শুনে মাহমুদ গাযান প্রচন্ড আঘাত পায়। মাকরেজি লিখেছেন, পরাজয়ের সংবাদ শুনে গাযানের নাক থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। সে আদেশ দেয় কুতলু শাহকে হত্যা করার। পরে অবশ্য এ আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে দূরবর্তী এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই যুদ্ধের পর গাযান আর কখনো সিরিয়ার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। এর পরের বছর ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে সে মারা যায়। (৫)

এক নজরে এ যুদ্ধ

এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২০-২১ এপ্রিল ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে।
পক্ষ- মামলুক বাহিনী
সেনাপতি- সুলতান নাসির মুহাম্মদ বিন কালাউন, রুকনুদ্দিন বাইবার্স জাশনাকির, সাইফুদ্দিন সালার, সাইফুদ্দিন কারাই। 
সেনাসংখ্যা- ২ লাখ
ক্ষয়ক্ষতি- ২১৭ জন আমির নিহত, এছাড়াও অসংখ্য সেনা নিহত।

বিপক্ষ- তাতার বাহিনী ও তাদের সাথে থাকা আরমেনিয়ার অল্পসংখ্যক ক্রুসেডার
সেনাপতি- কুতলু শাহ
সেনাসংখ্যা- ২ লাখের বেশি।
ক্ষয়ক্ষতি- এক লাখের বেশি সেনা নিহত

টীকা
১। পুরো নাম আল মালিকুল মুযাফফর রুকনুদ্দিন বাইবার্স জাশনাকির। তিনি ছিলেন দ্বাদশ মামলুক সুলতান। তার শাসনকাল ১৩০৮-১৩০৯ খ্রিস্টাব্দ। 
২। ইবনু কাসীর, ইমাদুদ্দিন আবুল ফিদা ইসমাইল বিন উমর (মৃত্যু ৭৭৩ হিজরি), আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৮/২৩, (মারকাযুল বুহুস, ১৪১৯ হিজরি) 
৩। মাকরেজি, তকিউদ্দিন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আলি (মৃত্যু ৮৪৫ হিজরি), আস সুলুক লিমারিফাতি দুওয়ালিল মুলুক, ২/৩৫৫, ৩৫৬, (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, ১৪১৮ হিজরি)
৪। মুহাম্মদ বিন ইয়াস হানাফি (মৃত্যু ৯৩০ হিজরি), বাদাইউয যুহুর ফি ওয়াকাইউদ দুহুর, ১/৪১৩
৫। মাকরেজি, তকিউদ্দিন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আলি (মৃত্যু ৮৪৫ হিজরি), আস সুলুক লিমারিফাতি দুওয়ালিল মুলুক, ২/৩৫৭-৩৬০, (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, ১৪১৮ হিজরি)


ইমরান রাইহান