ইসলামের সকল শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ এবং সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য পূর্ণ কল্যাণকর। তা’লীম-তরবিয়তের ক্ষেত্রেও ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ দিক-নির্দেশনা রয়েছে। তাতে যেমন নম্রতা ও সহনশীলতার নির্দেশনা আছে, তেমনি আছে শাস্তি ও শাসনের বিধান। তরবিয়তের ক্ষেত্রে শাস্তির কোনো প্রয়োজন নেই-এটা যেমন অবাস্তব কথা তেমনি শাস্তিকে তরবিয়তের প্রধান উপায় মনে করাও মূর্খতা। বস্ত্তত শাস্তি হচ্ছে ঔষধের মতো। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যেমন ঔষধের প্রয়োজন তেমনি তা’লীম-তরবিয়তের ক্ষেত্রে প্রয়োজন শাস্তি ও শাসনের। তবে একথা বলাই বাহুল্য যে, সুস্বাস্থ্যের মূল উপাদান ঔষধ নয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য মূল উপাদান হল পুষ্টিকর খাবার, পরিমিত শরীরচর্চা, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন ইত্যাদি। এরপর অসুখ-বিসুখ হলে প্রয়োজন হয় চিকিৎসা ও ঔষধ ব্যবহারের। অতএব এর প্রয়োজনীয়তা বিশেষ অবস্থার সঙ্গে সীমাবদ্ধ। আর এ ক্ষেত্রেও রোগ-নির্ণয়, ঔষধ নির্বাচন, ব্যবহারের নিয়ম ও মাত্রা ইত্যাদির জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। তরবিয়তের ক্ষেত্রে শাস্তির বিষয়টিও এখান থেকে অনুমান করে নেওয়া যায়।
মূলপন্থা নম্রতা ও সহনশীলতা
শিশুদের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব শাসন এড়িয়ে চলা উচিত। ধৈর্য্য ও সহনশীলতা সঙ্গে তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। যখন শাসনের প্রয়োজন হয় তখন পূর্ণ সংযম ও দূরদর্শিতার পরিচয় না দিলে শিশুর উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়।
আল্লামা ইবনে খালদূন রাহ. ‘‘আলমুকাদ্দিমা’’য় লিখেছেন যে, ‘শিশুর সঙ্গে যদি অতিরিক্ত দুর্ব্যবহার ও কঠিন আচরণ করা হয় তাহলে তারা ভীরু, অলস ও পলায়নপর হয়ে যায়। তাদের উদ্যম ও প্রফুল্লতা বিনষ্ট হয়ে যায় এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
‘শাস্তি থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা মিথ্যাচার ও তোষামোদ রপ্ত করে ফেলে। একসময় এগুলোই তাদের স্বভাবে পরিণত হয় এবং আত্মমর্যাদা, সৎসাহস ও উন্নত চিন্তা ইত্যাদি গুণাবলি থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। এরপর শাস্তি ও চাপের পরিবেশ থেকে মুক্তি লাভ করলেও ওই সব গুণাবলি আর তার মধ্যে সৃষ্টি হয় না।’
ইমাম গাযালী রাহ. শিশুদের তরবিয়ত-সংক্রান্ত এক দীর্ঘ আলোচনায় বলেন, ‘শিশু যখন কোনো ভালো কাজ করে তখন তাকে বাহবা দেওয়া উচিত এবং অন্যদের সামনে তাকে সম্মানিত ও পুরষ্কৃত করা উচিত। পক্ষান্তরে কখনো যদি বিপরীত কিছু দেখা যায় তাহলে তা না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। বিশেষত শিশু যখন নিজেই তা লুকিয়ে রাখতে সচেষ্ট। আর তাকে সর্বদা ধমক দেওয়া উচিত নয়। কেননা এতে সে ভৎর্সনা শুনতে অভ্যস্থ হয়ে উঠবে। পিতা তাকে মাঝে মাঝে ভৎর্সনা করবেন। আর মা তাকে পিতার ভয় দেখিয়ে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবেন।’ -ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন
শিশুর মনোদৈহিক বিকাশে তার চারপাশের পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা ইবনে সীনা-র একটি বক্তব্য থেকে বোঝা যায়।
ইবনে সীনা বলেন, ‘শিশুর স্বভাব-চরিত্রের প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখা কর্তব্য। লক্ষ্য রাখতে হবে, তাকে যেন চরম ক্রোধ, প্রচন্ড ভীতি, কিংবা দুঃখ-বেদনা ও রাত্রি জাগরণের মুখোমুখি না হতে হয়। তার চাহিদা ও পছন্দের প্রতি লক্ষ করতে হবে যেন সেগুলো পূরণ করা যায় আর তার অপসন্দগুলোও লক্ষ করতে হবে যেন সেগুলো থেকে তাকে দূরে রাখা যায়। এর ইতিবাচক প্রভাব তার শরীর ও মন উভয় ক্ষেত্রেই পড়ে থাকে। কেননা, শিশুর মন যদি ভালো থাকে তাহলে তার স্বভাব ও আচরণও সুন্দর হবে। আর উত্তম স্বভাব ও আচরণ যেমন শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করে তেমনি মানসিক সুস্থতাও।’
বলাবাহুল্য যে, উপরোক্ত মুসলিম মনীষীদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মত। কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিই এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন না।
আমরা যদি একদম গোড়ায় যাই এবং জগতের সর্বোত্তম শিক্ষক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ লক্ষ করি তাহলে দেখব যে, শিশুদের সঙ্গে তাঁর আচরণ কত কোমল ছিল। হাদীস শরীফ থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে দিচ্ছি :
১. হযরত বুরায়দা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে হাসান ও হুসাইন মসজিদে প্রবেশ করল। তাদের পরনে ছিল লাল রংয়ের জামা। তারা দৌড়ে আসছিল এবং পড়ে যাচ্ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন খুতবা শেষ না করেই মিম্বর থেকে নেমে এলেন এবং তাদেরকে কোলে তুলে নিলেন। এরপর বললেন, ‘তোমাদের সম্পদ ও সন্তান তোমাদের জন্য পরীক্ষার বিষয়।’ আমি শিশু দু’টিকে দেখলাম যে, তারা দৌড়ে আসছে এবং পড়ে যাচ্ছে। তখন আমার পক্ষে ধৈর্য্য ধারণ করা সম্ভব হল না।’-জামে তিরমিযী ২/২১৮
২. হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি দীর্ঘ নামাযের ইচ্ছা নিয়ে নামায আরম্ভ করি, কিন্তু যখন কোনো শিশুর ক্রন্দনের আওয়াজ শুনি তখন নামায সংক্ষিপ্ত করে দেই। কেননা, আমি জানি, শিশুর ক্রন্দনে মার অবস্থা কেমন হয়!’-সহীহ বুখারী, হাদীস ৭০৯
প্রসঙ্গত, শিশুদের তা’লীম-তরবিয়তের দায়িত্বে নিয়োজিত সম্মানিত উস্তাদগণের জন্য এখানে চিন্তার উপকরণ রয়েছে। শিশুদের শাসনের সময় আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণে চিন্তা করতে পারি যে, এ অবস্থাটা যদি তার মার সামনে হয় তাহলে তাঁর কেমন লাগবে?
৩. হযরত আনাস রা. কয়েকজন শিশুর নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সালাম দিলেন। এরপর বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে শিশুদের সালাম দিয়েছেন।’-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬২৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৬৮
৪. ইমাম মুসলিম রাহ. বর্ণনা করেন, লোকেরা তাদের প্রথম ফল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে আসত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা হাতে নিয়ে দুআ করতেন-‘ইয়া আল্লাহ, আমাদের ফলফলাদিতে বরকত দিন, আমাদের শহরে বরকত দিন, আমাদের ছা’ তে বরকত দিন, আমাদের মুদে বরকত দিন।’ এরপর কোনো শিশুকে ডেকে তা দিয়ে দিতেন।-সহীহ মুসলিম ১/৪৪২
শিশুদের সঙ্গে কোমল আচরণই ছিল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ।
পরবর্তী সময়ের মনীষীগণ যতই গবেষণা করেছেন ততই তার সুফল প্রকাশিত হয়েছে। শিশুর মনোদৈহিক বিকাশে কোমল ব্যবহারের বিকল্প নেই।
এজন্য শিশুর তরবিয়তের ক্ষেত্রে মূল পন্থা হল, কোমলতা ও সহনশীলতা। যে কোনো ভুল-ত্রুটি নজরে পড়লেই শাস্তির কথা ভাবা উচিত নয়। প্রথমে ক্ষমার কথা চিন্তা করা উচিত। ইমাম নববী রাহ. বলেন, ‘তাকে (ছাত্রকে) আপন সন্তানের মতো মমতা করবে এবং তার অন্যায় আচরণ ক্ষমা করে দিবে। কখনো কোনো বে-আদবী প্রকাশ পেলে ক্ষমা করে দিবে। কেননা, মানুষমাত্রই ভুল করে থাকে।’
এরপর কোমলতার সঙ্গে সংশোধনের চেষ্টা করবে।
শিশুর মন-মানস এবং স্বভাব-প্রকৃতির দিকে লক্ষ রাখা
কখনো শাস্তির প্রয়োজন হলে ঔষধ নির্ণয়ের মতো শাস্তির ধরন ও পরিমাণ নির্ণয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণ হতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য ক্রোধ চরিতার্থ করা নয়; উদ্দেশ্য হল শিশুর সংশোধন। এজন্য শাস্তির বিষয়ে অত্যন্ত ধৈর্য্য ও সংযমের পরিচয় দেওয়া কর্তব্য।
সব শিশু প্রকৃতিগতভাবে এক ধরনের নয়। কেউ সামান্য তাম্বীহ দ্বারাই ঠিক হয়ে যায় আবার কাউকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কেউ শাস্তির দ্বারা সংশোধিত হয়, কেউ আরো বিগড়ে যায়। এ বিষয়গুলো আগে থেকেই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্থির করা উচিত এবং যার জন্য যে পরিমাণ তাম্বীহ প্রয়োজন তার জন্য তা-ই প্রয়োগ করা উচিত।
তাম্বীহ ও শাস্তির ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রম অনুসরণ করা
অনেকে বেত ও শাস্তিকে সমার্থক মনে করে থাকেন। যেন বেত ছাড়া শাস্তির কোনো উপায় নেই। অথচ এটা হল সর্বশেষ ব্যবস্থা। পূর্বের ব্যবস্থাগুলো পরীক্ষা না করে চুড়ান্ত ব্যবস্থা প্রয়োগ করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
ইবনে মাছকইুয়াহ বলেন, ‘শিশুর প্রথম ভুল ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। পুনরায় ওই ভুল হলে পরোক্ষভাবে তাম্বীহ করবে। যেমন তার উপস্থিতিতে বলা হল, ‘এই কাজ করা ঠিক নয়। কেউ যদি তা করে থাক তবে সাবধান হয়ে যাও। এরপর সরাসরি তাম্বীহ করা যায়। এরপরও যদি ওই ভুল হয় তাহলে হালকা প্রহার করা যায়। এই সবগুলো পর্যায় অতিক্রম করার পরও যদি দেখা যায় সে সংশোধিত হয়নি তাহলে কিছুদিন তাকে আর কিছু বলবে না। এরপর আবার প্রথম থেকে আরম্ভ করবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি ইমাম মাওয়ারদী রাহ.-এর একটি নির্দেশনা উল্লেখ করেছেন। তা এই যে, ‘শিশুকে সংশোধন করা মুরববীর জন্য কঠিন হয়ে গেলে এবং অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার মধ্যে আনুগত্য সৃষ্টি না হলে করণীয় হচ্ছে কিছু সময় তাকে অবকাশ দেওয়া। এরপর নতুনভাবে প্রচেষ্টা আরম্ভ করা।’ -আততারবিয়াতু ওয়াত তা’লীম ফিলফিকরিল ইসলামী।
জুমাদাল উখরা ১৪৩০ – জুন ২০০৯
মাসিক আলকাউসার