সন্তুষ্টি ও সমর্পণ – মাওলানা সাঈদ আহমদ

আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে ইরশাদ করেন, (তরজমা) ‘আমি তোমাদেরকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তবে আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্য্যশীলদেরকে, যারা বিপদে পতিত হলে বলে- ‘আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব।’ এমন লোকদেরই প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়, আর এরাই সৎপথপ্রাপ্ত।’ (সূরা বাকারাঃ আয়াত ১৫৫-১৫৭)

বিপদে ধৈর্য্যধারণ করার অর্থ হচ্ছে-বিপদ-আপদ এসে উপস্থিত হলে সেগুলোকে আল্লাহর ফয়সালা বলে মেনে নেওয়া এবং আল্লাহর পক্ষ হতে বিনিময় লাভের আশা রাখা। উপরোক্ত আয়াতে ধৈর্য্যশীলদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা বিপদের সম্মুখীন হলে বলে, (তরজমা) আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব)।’ এর দ্বারা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, কেউ বিপদে পতিত হলে যেন এই দুআ পাঠ করে। কেননা, এর দ্বারা যেমন অসীম সওয়াব পাওয়া যায়, তেমনি অর্থের প্রতি যথাযথ লক্ষ রেখে দুআটি পাঠ করলে আন্তরিক শান্তি লাভ হয় এবং মনের কষ্ট দূর হয়ে যায়। (মাআরিফুল কুরআন ১/৩৯৭, ৬৯৯)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুমিনের এই বিষয়টি কত আনন্দের যে, সকল অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর। আর তা মুমিন ছাড়া অন্য কারও প্রাপ্য নয়। কারণ মুমিন যখন আনন্দিত তখন সে আল্লাহর শোকর আদায় করে। ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। তদ্রূপ যখন সে বিপদের সম্মুখীন হয় তখন ধৈর্য্য ধারণ করে। সুতরাং এ অবস্থাও তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিম) অন্য এক হাদীসে আছে, আল্লাহ তাআলা যে বান্দার কল্যাণ চান তাকে বিপদের সম্মুখীন করেন। (সহীহ বুখারী)

হযরত উম্মে সালামা রা. বলেনঃ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, যদি কোনো বান্দা বিপদে পতিত হয়, আর এই দু‘আ পাঠ করে : (তরজমা) আমরা তো আল্লাহরই এবং আমরা অবশ্যই আল্লাহর কাছে ফিরে যাব। হে আল্লাহ! আমাকে এ বিপদের বিনিময়ে সওয়াব দান করুন। আর আমি যা হারিয়েছি তার চেয়ে উত্তম বস্তু আমাকে দান করুন।) তবে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তাকে সওয়াব দান করেন এবং হারানো বস্তুর চেয়ে উত্তম বস্তু প্রদান করেন। (সহীহ মুসলিম)

মুমিনের জন্য আনন্দের বিষয়

ঈমানদারদের জন্য এটা বড় আনন্দের বিষয় যে, পার্থিব কোনো ক্ষতিই তাদের জন্য প্রকৃত ক্ষতি নয়। প্রকৃত ক্ষতি তো কেবল কাফেরদের জন্য। আর মুমিনের জন্য রয়েছে সর্বাবস্থায় আনন্দ ও তৃপ্তি। আরাম-আয়েশের অবস্থায়ও সে আনন্দ লাভ করে। (উপরন্তু শোকর করে সওয়াবও হাসিল করে)। বালা-মুসিবতেও তার জন্য থাকে আনন্দ। কেননা, সে ধৈর্য্য ধারণ করে সওয়াব অর্জন করে। মোটকথা মুমিনের আশা পূরণ হলেও আনন্দ, আশা পূরণ না হলেও আনন্দ। এভাবে চিন্তা করলে বড় থেকে বড় মুসিবতও আনন্দের মনে হবে এবং কোনো মুসিবতেই মুমিন বিচলিত হবে না। হাঁ দ্বীনের ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি হলে পেরেশান হওয়া উচিত। কেননা এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়।-ইরশাদাত পৃ. ৩৫ যখনই কোনো কষ্টের সম্মুখীন হই, সঙ্গে সঙ্গে আমি চিন্তা করি যে, এর কারণে আমার সওয়াব হবে (ইনশাআল্লাহ)। ফলে কষ্ট দূর হয়ে যায়। (কষ্টের ক্ষেত্রে) সওয়াব লাভের এ আশা এমন এক শক্তি, যা সকল দুঃখ-কষ্টকে সহজ করে দেয়।-ইরশাদাত পৃ. ৪১

অন্তরের প্রশান্তি

যে ব্যক্তি আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য করে, গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে এবং ইচ্ছাধীন ও ইচ্ছাবহির্ভূত (ইখতিয়ারী ও গায়র ইখতিয়ারী) সকল পরিস্থিতিকে আল্লাহর সোপর্দ করে (অর্থাৎ সর্বাবস্থায় সন্তষ্ট থাকে এবং বিশ্বাস রাখে যে, সকল কিছু তারই হুকুমে হয়) সে বড় আত্মিক তৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করে। অনাকাঙ্খিত কোনো পরিস্থিতি বা বালা-মুসিবত তার উপর কোনোরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে না; বরং তাদের জন্য বাহ্যিক বিপদ-আপদও আত্মিক শান্তির কারণ হয়। এমনকি অনেক সময় ঠিক কষ্টের মুহূর্তেও তারা বিশেষ আনন্দ অনুভব করেন। অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতেও তাদের অবস্থা আনন্দের মুহূর্তের মতোই হয়।

এর রহস্য এই যে, তাদের দৃষ্টি সর্বদা এক আল্লাহর প্রতি নিবদ্ধ থাকে এবং সকল কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন। আল্লাহ তাআলাই তাঁদের প্রেমাষ্পদ। সুতরাং আরাম ও আনন্দের মতো বিপদ-আপদকেও তারা প্রেমাষ্পদের উপহার বলে মনে করেন এবং মাথা পেতে গ্রহণ করেন। যেহেতু দু’টোই প্রেমাষ্পদের পক্ষ হতে, সুতরাং এদের মাঝে পার্থক্য করার কোনো যুক্তি নেই। তারা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেন যে, বন্ধুর পক্ষ থেকে যা কিছু মিলে সবই কল্যাণকর।

জীবন তাঁর দান, মৃত্যুও তাঁরই বিধান। কষ্ট-ক্লেশ আরাম-আনন্দ সবই তাঁর পক্ষ হতে! যখন সব কিছু সেই একই সত্তার পক্ষ থেকে, অতএব সবই পছন্দনীয়। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন যেন এই হাক্বীকত আমাদের বুঝে এসে যায় এবং সর্বদা আমাদের অন্তরে জাগরুক থাকে। তিনি তো সমগ্র জাহানের প্রভু। তিনি আমাদের অকল্যাণকামী নন; বরং তিনি যা কিছু করেন সবই আমাদের জন্য কল্যাণকর।-ইরশাদাত পৃ. ৩৪১-৩৪৩

বান্দার উপর যত বিপদ-আপদ আসে সব কিছুরই হেকমত ও তাৎপর্য থাকে। কিন্তু সকল বিষয় আল্লাহ তাআলা বান্দার সামনে প্রকাশ করেন না। যদি বান্দাও তা জানত তবে তো সে বিপদ কামনা করত এবং বিপদ-আপদ আসার জন্য দু‘আ করত!

যেহেতু বিপদেও হেকমত নিহিত থাকে সুতরাং যে কোনো বিপদের সময় এ কথা স্মরণ করে নিবে যে, এতেই আমার জন্য কল্যাণ রয়েছে। তবে এ প্রশ্ন যে, হেকমতটা কী? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অনর্থক। এক্ষেত্রে প্রশান্তি লাভের একমাত্র উপায় হল তাআল্লুক মাআল্লাহ তথা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি। আর আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির (সহজ) পদ্ধতি হল আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে সম্পর্ক করা। আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে সম্পর্ক করলেই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। আর আল্লাহর সাথে সম্পর্ক হয়ে গেলে কোনো বিপদ মানুষকে বিচলিত করবে না।-ইরশাদাত পৃ. ৩৬০

মহাররম ১৪৩১ – জানুয়ারী ২০১০

মাসিক আলকাউসার