﷽
সফফে আউয়াল
উম্মতই ছিল নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সার্বক্ষণিক ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। কিসে আমাদের ভাল হবে, কিসে আমাদের কল্যাণ হবে, এটা নিয়ে তার উৎকণ্ঠার অন্ত ছিল না। তিনি আমাদেরকে সহজ সহজ আমল দিয়ে গেছেন।
শুধু দিয়েই যাননি, তিনি নিজেও সেসব করে দেখিয়ে গেছেন। পাশাপাশি চেয়েছেন, আমরা যেন সেগুলো একা একা আদায় করেই ক্ষান্ত হয়ে না যাই, আমরা যেন আমলগুলো নিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতা করি। আমরা যেন দিনদিন উন্নতি করি, জান্নাতে উচ্চাসন লাভ করি, সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করি। আরও ভাল হই। আল্লাহর আরও প্রিয় বান্দা হই। নবীজির আরও অনুগত উম্মত হই।
কিছু আমল করতে হলে, প্রতিযোগিতা করতে হয়। প্রথম কাতারে সালাত আদায় করাও এমন আমল। এর সাথে জড়িয়ে আছে আরও আমল।
ক. জামাতে সালাত আদায় করা।
খ. আগে আগে মসজিদে যাওয়া।
আমি প্রথম কাতারে সালাত আদায় করতে পারা মানে, আমি সালাতের প্রতি সবচেয়ে আগ্রহীদের একজন। আমার মধ্যে রাব্বে কারীমের ভালোবাসা তুলনামূলক বেশি আছে। আমার মধ্যে দ্বীন মানার আগ্রহও সক্রিয় আছে। নবীজি সা. সুন্দর করে আমাদেরকে উৎসাহিত করেছেন,
لَوْ يَعْلَمُ النَّاسُ مَا فِي النِّدَاءِ وَالصَّفِّ الأَوَّلِ، ثُمَّ لَمْ يَجِدُوا إِلاَّ أَنْ يَسْتَهِمُوا عَلَيْهِ لاَسْتَهَمُوا، وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِي التَّهْجِيرِ لاَسْتَبَقُوا إِلَيْهِ، وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِي العَتَمَةِ وَالصُّبْحِ، لأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا
মানুষ যদি জানত, আযান দেয়া ও প্রথম কাতারে সালাত আদায় করার কী ফযীলত, তাহলে তারা (সুযোগ পাওয়ার জন্যে) লটারি করত। তারা যদি জানত, সালাতের জন্যে আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া ও আগে মসজিদে যাওয়ার মধ্যে কী ফযীলত, তাহলে তারা পরস্পরে প্রতিযোগিতায় লেগে যেত। তারা যদি জানত ঈশা ও ফজরের সালাতের কী ফযীলত, তাহলে তারা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এই সালাতে অংশ নিত।
(আবু হুরায়রা রা.। বুখারী)
তাহজীর (التهجير) অর্থ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বাইরে বের হওয়া। নবীজি শব্দটা ব্যবহার করেছেন, সালাতের জন্যে আগে আগে বের হওয়া অর্থে। কী অপূর্ব শব্দচয়ন। সালাফ আযানের অপেক্ষা করতেন না। সময় হলেই মসজিদের দিকে রওয়ানা হয়ে যেতেন। কষ্ট করে হলেও। হাদীসে আগে আগে মসজিদে যেতে বলা হয়েছে। আযানের সাথে আগে মসজিদে যাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক হল সালাতের সময় হওয়ার সাথে।
মসজিদ বড় হলে, বাজারের মসজিদ হলে, ব্যস্ত সড়কের পাশে হলে, প্রথম কাতার পাওয়া কঠিন। তাই আগে আগেই মসজিদে যেতে হয়। প্রতিযোগিতা করতে হয়। প্রথম কাতার ধরতে পারা যে সে ব্যাপার নয়,
إِنَّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الصَّفِّ الأَوَّلِ
প্রথম কাতারের উপর আল্লাহ তা‘আলা রহমত বর্ষণ করেন। ফিরিশতাগন রহমতের দু‘আ করেন।
(বারা বিন আযিব রা.। ইবনে মাজাহ)
চেষ্টা করার পরও প্রথম কাতার ধরা সম্ভব না হলে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় কাতার পেলেও চলবে। আমাদের মত দুর্বলদের সান্ত¡না পাওয়ার মত আশ^াসবাণী নবীজি দিয়ে গেছেন। আগের হাদীসে বলা হয়েছে সফফে আউয়াল (الصَّفِّ الأَوَّلِ) মানে প্রথম কাতারের উপর রহমত বর্ষণ হয়। আরেক হাদীসে বলেছেন ‘প্রথম কাতার সমূহ (الصُّفُوفِ الأُوَلِ)-এর উপর রহমত বর্ষণ করা হয়।
(আবু দাউদ)।
আমরা যারা সাধারণ মুমিন, তারা প্রথম কাতারকে অতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি না। মনে করি মসজিদে এসেছি, এই ঢের। জামাত ধরতে পারলেই হল। কিন্তু বুযুর্গগনের চিন্তা এর বিপরীত। তারা মসজিদে প্রবেশ করার পর থেকেই সুযোগ খুঁজতে থাকেন, কিভাবে প্রথম কাতারে পৌঁছা যায়। মানুষকে কষ্ট না দিয়ে, কাউকে না ডিঙ্গিয়ে প্রথম কাতারের ফযীলত অর্জন করা যায়।
একদিন মসজিদে প্রবেশ করার মুখে এক বুযুর্গের সাথে দেখা। মাগরিবের সময়। সালাম-কালাম হল। আযান তখনো হয়নি। পাশে মাহফিল ছিল। তাই আগেই মসজিদ অর্ধেক পূর্ণ হয়ে গেছে। আমি পেছন দিকে বসে যেতে চাইলাম। বুযুর্গ আমার হাত ধরে সামনে নিয়ে চললেন। ভাবলাম একটু সামনে গিয়ে বসবেন। না, তিনি একেবারে প্রথম কাতারে গিয়ে থামলেন। আমি ভেবেছিলাম, এত সামনে জায়গা পাব না। কিন্তু সেটা ছিল ভুল চিন্তা। আসলে আমার মধ্যে প্রথম কাতারের আগ্রহটা তীব্র ছিল না। আরেকটা হাদীসের প্রতিও খেয়াল ছিল না। ইচ্ছে করে পেছনে যারা বসে, তাদের প্রতি নবীজি ‘বিরাগ’ প্রকাশ করেছেন।
একদিন নবীজি দেখলেন, সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে এসে, প্রথম কাতার ছেড়ে পিছিয়ে বসেছে। ব্যাপারটা নবীজির পছন্দ হলো না। তিনি বললেন,
تَقَدَّمُوا فَأْتَمُّوا بِي، وَلْيَأْتَمَّ بِكُمْ مَنْ بَعْدَكُمْ، لاَ يَزَالُ قَوْمٌ يَتَأَخَّرُونَ حَتَّى يُؤَخِّرَهُمُ اللهُ
তোমরা এগিয়ে (প্রথম কাতারে) এসে আমার ইমামতির অনুসরণ করো। তোমাদের পেছনে থাকা ব্যক্তিরা তোমাদের অনুসরণ করবে। কিছু মানুষ সব সময় পিছিয়ে, আল্লাহও (ফলশ্রুতিতে) তাদেরকে পিছিয়ে দেন।
(আবু সায়ীদ খুদরি রা.। মুসলিম)
তখন মাইক ছিল না। প্রথম কাতারে দাঁড়ানো সাহাবীরা নবীজিকে দেখে ইক্তেদা (অনুসরণ) করতো। দ্বিতীয় কাতারের সাহাবীগণ প্রথম কাতারের সাহাবীকে দেখে ইমামের ইক্তেদা করত। কারণ তারা দূরে দাঁড়ানোর কারনে নবীজিকে দেখতে পেত না। হাদীসের একটা অর্থ এটাও হতে পারে, তোমরা আমার অনুসরণ করো। তোমাদেরকে দেখে পরবর্তী উম্মত শিখবে।
সামনের কাতারে জায়গা খালি থাকা সত্বেও কেউ পিছিয়ে থাকলে, তাকে আল্লাহ তা‘আলা শাস্তি দেন। সে যেহেতু পিছিয়ে থাকতে চায়, তাই আল্লাহও তাকে পিছিয়ে দেন।
ইবাদতে পিছিয়ে থাকার মানসিকতা বিপদজনক। আল্লাহ তা‘আলা তাকে সমস্ত ‘খাইর’ (কল্যাণের) ক্ষেত্রেই পিছিয়ে দেন। বঞ্চিতও করেন হয়তোবা।
ছেলেবেলায় দেখেছি, এখনো কোনও কোনও মাদরাসায় দেখি, নামাজের সময়, একজন হুজুর বেত নিয়ে পুরো মসজিদ চক্কর দিচ্ছেন। কেউ কথা বললে, বেত উঁচিয়ে নিষেধ করছেন। সামনে জায়গা খালি থাকলে, পেছনে বসা তালিবে ইলমদেরকে উঠিয়ে সামনে বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আগে মনে করতাম, হুজুররা মাদরাসার শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই কাজটা করেন। কোনও কোনও অমনোযোগী তালিবে ইলম সামনের কাতারে জায়গা খালি থাকা সত্বেও ইচ্ছে করে পেছনে বসতো। গল্প করার সুবিধার্থে, সালাম ফেরানোর পর সবার আগে বের হওয়ার অভিসন্ধিতে। অজান্তেই তারা হাদীস বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়তো। এখন বুঝতে পারি, ওস্তাদগন আমাদেরকে নবীজির ‘বিরাগ’ থেকে বাঁচাতেই বেত হাতে নিতেন। হাদীসে ঘোষিত আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা দিতেই কিছুটা কঠোর ভূমিকা নিতেন। তাদের সাময়িক কঠোরতা আমাদেরকে হাদীস অনুযায়ী আমল করতে অভ্যস্ত করে তুলেছে। রাব্বে কারীম ও তার পেয়ার হাবীবের বিরাগভাজন হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে!
সাধারণ মানুষের মধ্যেও পেছনে বসার ঝোঁক বেশ প্রকট। একদল মানুষ কিছুতেই সামনে বসবেন না। তারা মসজিদে প্রবেশ করে প্রথমেই দরজার কাছাকাছি কোনও জাগয়া খালি আছে কি না, সেটা দেখে। জামাত দাঁড়ালে পাশের জনকে সামনে ঠেলে দেয়। নিজে যেতে চায় না। নিজে গেলে যে সালাম ফিরিয়ে সবার আগে বের হতে পারবে না! এমন চিন্তা হাদীসের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিপদজনক। আমরা চাইলেই এমন অসুন্দর চিন্তার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। নবীজির কাঙ্খিত ও প্রার্থিত প্রতিযোগিতায় নেমে নিজেকে অগ্রগামিদের কাতারে শামিল করতে পারি।