ঘুম ভেঙে একটি দিনের সূচনা হয়। ঘুম দিয়ে একটি দিনের সমাপ্তি ঘটে। আল্লাহর রাসূল সা. সারাদিনে অসংখ্য আমল করতেন। দিনশেষে বিছানায় গিয়েও আমলের ধারা চলত। নবীজি বোধ হয় চাইতেন, শেষমুহূর্তে যতবেশি সম্ভব আমলনামাকে ভারী করে তুলতে।
শেষ ভাল যার, সব ভাল তার। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার পর, রাজ্যের চিন্তা মাথায় এসে ভর করে। গুরুত্বহীন চিন্তায় প্রচুর সময় নষ্ট হয়ে যায়। কোনওদিন ঘুম আসতে দেরী হলে তো কথাই নেই। মোবাইল হাতে নিয়ে, অযথা মূল্যবান সময়গুলো হু হু করে জীবনখাতা থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। দুনিয়া-আখেরাত কোনও জাহানেরই কাজে লাগে না সময়টা। আমি চাইলে শুয়ে শুয়ে ঘুম আসার আগের ক্ষণগুলোকে স্বর্ণালী করে তুলতে পারি। নবীজির অনুসরণে তাসবীহ-হামদ-তাকবীরে অর্থবহ করে তুলতে পারি আমার জীবনের পলগুলোকে।
ঘুমের আগে চমৎকার একটি আমল আছে। শুধু দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানেই আমলটা আমার উপকারে আসবে। বিখ্যাত ঘটনা। আমরা সবাই জানি। আলি রা. বলেছেন,
أنَّ فاطمةَ عليها السلامُ أتَتْ النبيَّ ﷺ تشكو إليهِ ما تلْقى في يدِهَا من الرَّحَى، وبَلَغُهاأنَّهُ جاءَهُ رقيقٌ، فلَمْ تصَادِفْهُ، فَذَكَرتْ ذلكَ لعائِشَةَ، فلمَّا جاءَ أخبَرَتْهُ عائشةُ، قالَ: (فجاءَنَا وقد أخذْنَا مضَاجِعِنَا، فذهبْنَا نقُومُ، فقالَ: ( على مكَانِكُمَا) . فجاءَ فقَعَدَ بيني وبينَها حتَّى وجَدتُ بردَ قدميْهِ على بطْنِي، فقالَ: (ألا أدُلُكُمَا على خيرٍ ممَّا سأَلْتُمَا؟ إذا أخَذْتُمَا مضَاجِعِكُما، أوْ أوَيتُما إلى فِرَاشِكُما، فسبحَا ثلاثًا وثلاثينَ، واحْمَدا ثلاثًا وثلاثينَ، وكبِّرا أربعًا وثلاثينَ، فهوَ خيرٌ لكما من خادمٍ .
যাঁতায় আটা পিষতে পিষতে (ফোস্কা পড়ে) হাতের কী করুণ অবস্থা হয়েছে, সেটা দেখানোর জন্য নবীজির কাছে এলেন ফাতেমা রা.। তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন, নবীজির কাছে কিছু যুদ্ধবন্দী দাস এসেছে। নবীজির দেখা না পেয়ে আম্মাজান আয়েশা রা.-এর কাছে বলে এলেন। আয়েশা রা.-এর কাছে বৃত্তান্ত শুনে নবীজি আমাদের ঘরে এলেন। আমরা শুয়ে পড়েছিলাম। তাঁকে দেখে উঠতে উদ্যত হলাম। তিনি নিরস্ত করে বললেন, (على مكَانِكُمَا) আপন জায়গায় থাক। তিনি আমাদের দু’জনের মাঝে বসলেন। এতটা গা ঘেঁষে যে, আমি পেটে তাঁর দুই পায়ের পাতার শীতলতা অনুভব করছিলাম। এবার বললেন,
-তোমরা যা চেয়েছ, আমি কি তার চেয়েও উত্তম কিছুর সন্ধান তোমাদের দেব? রাতে যখন বিছায় যাবে, ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ পড়বে। ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ পড়বে। ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পড়বে। এই আমল তোমাদের জন্য একজন খাদেমের চেয়ে বেশি উত্তম হবে (বুখারি ৫৩৬১)।
খাদেমের কাজ তাসবীহ দিয়ে হবে? তাসবীহ পড়লে সওয়াব হবে। তাসবীহ কি আমার আটা পিষে দেবে? দেবে না। তাহলে নবীজি কিভাবে উত্তম বললেন? এমন হতে পারে,
ক: আল্লাহর যিকির বান্দার জীবনে বরকত আনে। আল্লাহ যিকিরকারীকে ভালোবাসেন। যিকির করলে, আল্লাহ বান্দার জীবনকে সহজ করে দেন। তাই খাদেম না থাকলেও, আল্লাহ তা‘আলা যিকিরের বদৌলতে কাজকে আসান করে দেবেন।
খ: এই আমলের বরকতে, আল্লাহ শরীরে শক্তি বাড়িয়ে দেবেন। সারাদিনের কাজ কোনও কষ্ট ছাড়া সহজেই আঞ্জাম দেয়া যাবে।
গ: খাদেম দুনিয়ার কাজে লাগবে। যিকির আখেরাতের উপকারে লাগবে। আখেরাতের উপকারই স্থায়ী ও বেশি আবশ্যক।
ঘ: নবীজি সা. দেখলেন, ফাতেমা ও আলি খাদেমের মাধ্যমে, তাদের দুনিয়ার জীবনযাত্রাকে সুন্দর আর সহজ করতে চাচ্ছে। তিনি কন্যা ও জামাতার দৃষ্টিকে আখেরাতের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। তোমরা আখেরাতের জীবনকে সুন্দর করার প্রতি মনযোগী হও। সেটাই বেশি উপকারী।
ঘুমের আগের এই আমল, আমলনামাকে অনেক ভারী করে তোলে। অল্প কাজেই বেশি লাভ,
وإذا أخذتَ مضجعكَ تسبحهُ وتكبرهُ وتحمدهُ مائةٌ فتلكَ مائةُ باللسانِ وألفٌ في الميزانِ
তুমি শয়নকালে সবমিলিয়ে একশবার তাসবীহ-তাহমীদ-তাকবীর পাঠ করবে। তোমার (মৌখিক) গণনায় একশতবার হলেও, মীযানে (আল্লাহর মাপে) একহাজার হয়ে যাবে (আবদুল্লাহ বিন আমর রা। তিরমিযী ৩৪১০)।
মাত্র একমিনিটের আমল। অতি সহজ আমল। গায়েও লাগবে না। শোয়ার সময় আমার পছন্দের সবকাজ চালু রেখেও আমলটা টুক করে করে নিতে পারি। দু’টি লাভ,
ক: আমলটার মাধ্যমে দুনিয়াবী কাজের শক্তি অর্জিত হবে।
খ: পাশাপাশি আখেরাতের সঞ্চয়ও হয়ে যাবে।
কিছুকথাঃ
১: শোয়ার আগে যতই ক্লান্ত থাকি, আমলটা মনের উপর জোর খাটিয়ে হলেও করে নিতে পারি। আলি রা. বলেছেন, আমি সিফফীনের ভয়ংকর রাতেও আমলটা ছাড়িনি।
২: একমিনিটের জন্য না হয় মোবাইলটা হাত থেকে নামল, খুব বেশি ক্ষতি হবে?
৩: সারাদিনের কর্মক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। আগামী দিনের কর্মশক্তি অর্জিত হবে।
৪: দিনটা যিকিরের মাধ্যমে শেষ হবে। আমলের বরকতে আগামী দিনটাও ভালোভাবে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
৫: যিকির করছি, মানে কলবে আল্লাহকে স্থান দিচ্ছি। আল্লাহকে কলবে নিয়ে ঘুমুতে গেলে, ঘুমটাও ইবাদতে পরিণত হবে।
৬: মা-বোনদের জন্য এই আমল খুব বেশি প্রয়োজন। কারণ গৃহস্থালি কাজে কষ্টের অনুযোগ থেকেই এই আমলের সৃষ্টি হয়েছে।