৮৩তম পর্ব – একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে – কিয়ামুল লাইলের জাগরন! – শায়খ আতিক উল্লাহ

দূর-দূরান্তের গন্তব্যে একাকি পথচলা কঠিন। একাকী সফরে বের হতে নিষেধ করেছেন নবীজি সা। দুনিয়াতে আমরা সফরে আছি। আখেরাতের সফরে। এই সফরে একা এক পথচলা নিরাপদ নয়। নিজের বুঝে পথের দিশা খুঁজতে যাওয়াও নিরাপদ নয়। ইবাদত-বন্দেগীতে বেশিদিন আমরা মন লাগিয়ে রাখতে পারি না। যে কোনও আমলই শুরু করার কিছুদিন পর আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে যায়।

আমরা আমলে স্থির থাকতে পারি না কেন? তার অনেক কারণ থাকতে পারে। অন্যতম কারণ হল, আমরা একাকি আমল করতে চাই। অন্য কাউকে আমলে শরীক করি না। শয়তান আমাকে একাকি পেয়ে সহজেই কাবু করে ফেলে,
عليكمْ بالجماعةِ، وإياكم والفرقةَ، فإنَّ الشيطانَ مع الواحدِ وهو من الاثنينِ أبعدُ . من أراد بحبوحةَ الجنةِ فلْيلزمِ الجماعةَ .
তোমরা জামাত (দল) আঁকড়ে ধর। তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কেননা শয়তান একাকী ব্যক্তির সাথে থাকে। শয়তান দু’জন থেকে দূরে থাকে। যে ব্যক্তি জান্নাতের সুখ-সাচ্ছন্দ্য চায়, সে যেন জামাতকে আঁকড়ে ধরে (ইবনে উমার রা। তিরমিযি ২১৬৫)।

১: দলছাড়া যাবে না। যে কোনও মূল্যে জামাতের সাথে থাকা জরুরী। যদি দলটা হক হয় আরকি। একাকি থাকলে, শয়তান সুযোগ পেয়ে যায়। দলের সাথে থাকলে, সে সুযোগ কমে আসে।
২: আল্লাহর রাসূল সা. ইবাদত ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে দলবদ্ধ থাকতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। পরিবারও একটা দল। প্রতিটি পরিবার একেকটি দল বা জামাত। ইবাদতে সুবিধার জন্য, পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলে ইবাদত করা ভাল।
৩: পরিবারের সবাই মিলে আমল করলে, অলসতা কাছে ঘেঁষার সুযোগ কমে যায়। পরিবারে আমলি পরিবেশ কায়েম হলে, ইচ্ছা থাকলেও আমলে পিছিয়ে থাকা যায় না। নবীজি এজন্যই বলেছেন,
رحم اللهُ رجلًا قام من الليلِ فصلَّى وأيقظ امرأتَه فإن أبَتْ نضح في وجهِها الماءَ رحم الله امرأة قامت من الليل فصلت وأيقظت زوجها فإن أبى نضحت في وجهه الماءَ
আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে রহম করুন, যে নিজে রাতে জেগে ওঠে সলাত আদায় করে। তারপর স্ত্রীকেও জাগিয়ে দেয়, উঠতে অস্বীকার করলে, তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ রহম করুন এমন নারীকে, যে নিজে রাতে জেগে ওঠে সলাত আদায় কর। তারপর স্বামীকেও জাগিয়ে দেয়। জাগতে অস্বীকার করলে, স্বামীর মুখে পানি ছিটিয়ে দেয় (আবু হুরায়রা রা। আবু দাউদ ১৪৫০)।

১: কিয়ামুল লাইল মুমিনের মর্যদার প্রতীক। ফরজ নামাজের পর, তাহাজ্জুদই শ্রেষ্ঠ আমল। শরীয়তে তাহাজ্জুদের অনেক অনেক ফজীলত বর্ণনা করা হয়েছে। বিরাট সওয়াবের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
২: জাগতে না চাইলে, পানি ছিটানোর মানে এই নয়, জগভর্তি পানি উপুড় করে ঢেলে দিবে। দাম্পত্য খুনসুটি-দুষ্টুমির সীমারেখায় থেকেই পানি ছিটানো উচিত।
৩: হাদীসে পরিবারে একে অপরকে ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। মুগুর হাতে তেড়ে আসতে বলা হয়নি। নফল ইবাদতে নরম আবেদনই শরীয়তের ‘তাকাযা’। শরীয়তের মানশা।

তাহাজ্জুদে অবিচল থাকা কঠিন। নানা কারণে প্রথম রাতে ঘুমুতে দেরী হয়েই যায়। শয়তানও তার দলবল নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, বান্দা যাতে তাহাজ্জুদে জাগতে না পারে,
يعقدُ الشيطانُ على قافيةِ رأسِ أحدِكم إذا هو نام ثلاثَ عُقَدٍ، يضربُ على كلِّ عقدةٍ: عليك ليلٌ طويلٌ فارقد، فإنِ استيقظَ فذكر اللهَ انحلَّتْ عقدةٌ، فإن توضأَ انحلَّتْ عُقدةٌ، فإن صلَّى انحلَّتْ عُقدةٌ فيُصبحُ نشيطًا طيِّبَ النفسِ قد أصاب خيرًا، وإن لم يفعل أصبح كسلانَ خبيثَ النفسِ، لم يُصِبْ خيرًا
বান্দা ঘুমুলে, শয়তান তার মাথায় পেছনের অংশে তিনটি গিঁঠ দেয়। প্রতিটি গিঁঠ দেয়ার সময় শয়তান বলে, রাত এখনো অনেক বাকি, শুয়ে থাক। বান্দা তারপরও জেগে উঠে জিকির করলে, একটি গিঁঠ খুলে যায়। ওজু করলে, আরেকটি গিঁঠ খুলে যায়। সলাতে দাঁড়ালে আরেকটি গিঁঠ খুলে যায়। বান্দা হয়ে ওঠে উদ্যমী ছটফটে চনমনে। কল্যাণ লাভ করে। না জাগলে, সে অলস ম্রিয়মান নির্জীব হয়ে পড়ে। কোনও কল্যাণ লাভ করে না (আবু হুরায়রা রা। বুখারি ১১৪২)।

১: নবীজি চমৎকার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন, ভোররাতে শয়তান ও মানুষের দ্বৈরথের চিত্র। শয়তান চায় বান্দা সলাত আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকুক।
২: গিঁঠ দেয়ার মানে? সুতো বা রশির গিঁঠ নয়। শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরা, হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যেতে পারে। শয়তান তার এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঘুমন্ত ব্যক্তির মনে ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) দিতে থাকে। এটাকেই হাদীসে গিঁঠ দেয়া বলা হয়েছে।

প্রতি রাতেই শয়তানের সাথে বান্দার যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধ চিরন্তন। সৃষ্টির আদি থেকেই চলে আসছে। কেয়ামত পর্যন্ত চলবে। যুদ্ধ করতে হলে দলবল লাগে। শয়তানের বিরুদ্ধে রাতের লড়াইয়ে, পরিবার হতে পারে শ্রেষ্ঠতম সহযোগী। নবীজি সা.-এর আদর্শও এটা। সুন্নাত। বান্দা এই সুন্নাতে অবিচল থাকলে, বিরাট প্রতিদানের আশ^াস দেয়া হয়েছে,
إذا أيقظ الرجلُ أهلَه من الليلِ فصلَّيا أو صلَّى ركعتَينِ جميعًا كُتِبا في الذَّاكرِينَ والذَّاكراتِ
পরিবারের কর্তাব্যক্তি যখন রাতে নিজের স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়, তারপর দু’জন মিলে দুই রাকাত সলাত আদায় করে, দু’জনের নাম যিকিরকারী ও যিকিরকারীনিদের তালিকায় উঠিয়ে নেয়া হয় (আবু হুরায়রা রা। আবু দাউদ ১৩০৯)।

১: যিকিরকারীর তালিকায় নাম ওঠা কিন্তু চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাদের জন্য মহা পুরস্কার আছে। কুরআন কারীমে বলা হয়েছে,
وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا
এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও স্মরণকারী নারী, আল্লাহ এদের সকলের জন্য মাগফেরাত ও মহা প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন (আহযাব ৩৫)।
২: সামান্য একটু হিম্মত করলেই আমার নামটা আল্লাহর বান্দাদের এই নির্বাচিত তালিকায় উৎকীর্ণ করে নিতে পারি।

কিছুকথাঃ
ক: স্বামী ও স্ত্রী মিলে, যৌথ উদ্যোগে প্রতিটি ঘরকেই শয়তানের বিরুদ্ধে দুর্গ হিশেবে গড়ে তুলতে পারি।
খ: একে অপরের পরিপূরক হয়ে, সহযোগী হয়ে, ঈমান ও আমলে উন্নতি করতে পরি। এটা সুন্নাত।
গ: রাতটা যেমন দু’জনের একান্ত ভালোবাসার সময়, তদ্রুপ দু’জনে মিলে আল্লাহকে ভালোবাসার সময়ও বটে। আল্লাহর প্রতি দু’জনের যৌথ ভালোবাসা প্রকাশ করা সুন্নতও বটে।