যান্ত্রিক সভ্যতা চলছে এখন। মানুষকেও যন্ত্রের মতো উদয়াস্ত খেটে মরতে হয়। দম ফেলার ফুরসত নেই। একটু থেমে জিরিয়ে নেবে, সে কুদরত নেই। থামলেই পিছিয়ে পড়তে হবে। পিছিয়ে পড়া মানেই যুদ্ধে হেরে যাওয়া। প্রমোশন আটকে যাওয়া। নগর থেকে দূরে কোথাও পোস্টিং হয়ে যাওয়া। অতি ভোরে দাপাতে দাপাতে অফিসে দৌড়ে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ফেরা। এই তো আধুনিক জীবনের হালখাতা।
বেঁচে থাকতে হলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। কঠোর সংগ্রাম করতে হবে। শক্তি আসবে কোত্থেকে? জিমে গেলে? পার্কে গিয়ে দৌড়ালে? কুরআন কারীম বলছে ভিন্ন কথা,
إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا إِنَّ لَكَ فِي النَّهَارِ سَبْحًا طَوِيلًا
আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করছি এক গুরুভার বাণী। অবশ্যই রাত্রিকালের জাগরণ এমন যা কঠিনভাবে প্রবৃত্তি দলন করে এবং যা কথা বলার পক্ষে উত্তম। দিনের বেলা তো আপনার থাকে দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা (মুয্যাম্মিল ৫-৭)।
১: জীবন যুদ্ধের কঠিন কাজে শক্তি অফুরন্ত শক্তি পেতে চাইলে, তাহাজ্জুদের বিকল্প নেই। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানের কাজেই তাহাজ্জুদ বলবর্ধকের ভূমিকা পালন করে।
২: আয়াতে নবীজি সা-কে (قَوْلًا ثَقِيلًا) গুরুভার বাণী বহন করার শক্তি অর্জন করার জন্য, রাতজেগে তাহাজ্জুদ পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা।
৩: দিনের দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা (سَبْحًا طَوِيلًا) সমাধা করার শক্তি নিহিত আছে তাহাজ্জুদে। নবীজি আজীবন পরম নিষ্ঠায় তাহাজ্জুদ আদায় করে গেছেন।
নবীজি বেশিরভাগ রাতে তিন রাকাত বিতিরসহ সর্বমোট ১১ রাকাত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। আম্মাজান আয়েশা রা. বলেছেন,
أن رسولَ اللهِ ﷺ كان يصلي إحدى عَشْرَةَ ركعةَ، كانت تلك صلاتَه، تعني بالليلِ، فيسجدُ السجدةَ من ذلك قدر ما يقرأُ أحدُكم خمسين آيةً، قبلَ أن يرفعَ رأسَه، ويركعُ ركعتين قبلَ صلاةِ الفجرِ، ثم يَضْطَجِعُ على شقِه الأيمنِ، حتى يأتيَه المؤذنُ للصلاةِ.
আল্লাহর রাসূল রাতে এগার রাকাত সলাত আদায় করতেন। আমাদের পঞ্চাশ আয়াত পাঠ পরিমাণ সময় প্রতিটি সাজদায় থাকতেন। ফজরের আগে হালকা দুই রাকাত পড়তেন। তারপর ডানকাত হয়ে ফজরের আযান পর্যন্ত শুয়ে থাকতেন (বুখারি ৯৯৪)।
১: নবীজির রাতের সলাত মানে তাহাজ্জুদ কেমন ছিল, সেটা আম্মাজানই বেশি ভালো জানবেন। তিনি তাহাজ্জুদে লম্বা লম্বা সাজদা দিতেন। আমরা সাধারণভাবে পঞ্চাশ আয়াত পড়তে যতটা সময় নিই, ততটা সময় নবীজির একেকটি সাজদা দীর্ঘ হত।
২: নবীজি সাজদায় গিয়ে দীর্ঘক্ষণ দু‘আ করতেন। সাজদার দু‘আল আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ বেশি থাকে।
আল্লাহর রাসূল কখনো কখনো কিয়ামুল লাইলে ১৩ রাকাতও পড়তেন। ইবনে আব্বাস বলেছেন,
كانت صَلاةُ النَّبيِّ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّم ثَلاثَ عَشرةَ ركعةً، يَعني بِاللَّيلِ.
নবীজি সা.-এর রাতের কিয়ামুল লাইল ছিল তেরো রাকাত (বুখারি ১১৩৮)।
যায়েদ বিন খালেদ জুহানি রা. বলেছেন,
لأرمقن صلاة رسول اللهِ صلى الله عليه وسلم الليلة قال فتوسدت عتبته أو فسطاطه فصلى رسول اللهِ صلى الله عليه وسلم ركعتين خفيفتين ثم صلى ركعتين طويلتين طويلتين طويلتين ثم صلى ركعتين وهما دون اللتين قبلهما ثم صلى ركعتين دون اللتين قبلهما ثم صلى ركعتين دون اللتين قبلهما ثم صلى ركعتين دون اللتين قبلهما ثم أوتر فذلك ثلاث عشرة ركعة
আমি আল্লাহর রাসূল সা.-এর কিয়ামুল লাইল দেখার ইচ্ছা করলাম। তিনি,
ক: তিনি হালকা দুই রাকাত সলাত আদায় করলেন।
খ: তারপর তিনি দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘ দুই রাকাত নামায পড়লেন।
গ: তারপর তিনি আগের তুলনায় কিছুটা কম দীর্ঘ দুই রাকাত পড়লেন।
ঘ: তারপর আগের তুলনায় কিছুটা কম দীর্ঘ দুই রাকাত পড়লেন।
ঙ: তারপর আগের তুলনায় কিছুটা কম দীর্ঘ দুই রাকাত পড়লেন।
চ: তারপর বিতর আদায় করলেন। সর্বমোট তের রাকাত পড়লেন (মুসলিম ৭৬৫)।
১: সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত আগ্রহের সাথে নবীজির চলাফেরার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। নবীজি কখন কী করেন, সেটা জানার চেষ্টা করতেন। প্রতিটি কাজে নবীজির অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন।
২: রাতের বেলা নবীজি কী আমল করতেন, সেটাও তারা নানাভাবে জানার চেষ্টায় কসুর করতেন না।
৩: নবম ও দশম রাকাত বোধ করি বিতরেরই অংশ ছিল। বিতর তিন রাকাত পড়েছিলেন। এমন হলে এই হাদীসটা আম্মাজানের হাদীসের সাথে মেলে।
৪: নবীজি তাহাজ্জুদ পড়তেন দুই দুই রাকাত করে। এভাবে ফজর পর্যন্ত চলত। ফজরের কাছাকাছি এসে বিতর পড়তেন।
أنَّ رجلًا سألَ رسولَ اللَّهِ ﷺ عَن صلاةُ اللَّيلِ، فقالَ رسولُ اللَّهِ ﷺ: صلاةُ اللَّيلِ مَثنى مَثنى،
একব্যক্তি নবীজির কাছে জানতে চাইলেন, সলাতুল লাইল সম্পর্কে। আল্লাহর রাসূল বললেন,
-সলাতুল লাইল হবে দুই দুই করে (ইবনে উমার রা। বুখারি ৯৯০)।
৫: একেক সময় নবীজি একেক সংখ্যায় তাহাজ্জুদ পড়েছেন। মাসরূক রহ . থেকে বর্ণিত,
سألتُ عائشةَ رضيَ اللهُ عنها، عن صلاةِ رسولِ اللهِ ﷺ بالليلِ، فقالت: سبعٌ وتسعٌ وإحدى عشرةَ، وسِوَى ركعتيْ الفجرِ .
আমি আয়েশা রা.-এর কাছে জানতে চাইলাম, আল্লাহর রাসূলের রাতের সলাত সম্পর্কে। তিনি বললেন, সাত অথবা নয় অথবা এগার। ফজরের দুই রাকাত সুন্নাতের বাইরে (বুখারি ১১৩৯)।
৬: আমরা চেষ্টা করব, প্রতিদিন কমপক্ষে চার (বিতরসহ সাত) রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তে। সম্ভব হলে দশ (বিতরসহ তের) রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তে।
৭: তাহাজ্জুদ পড়লে, ইনশাআল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় কঠিন কাজ সহজ হয়ে যাবে।