আখেরাতে আমরা জান্নাত লাভ করব। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আমলের প্রতিদানস্বরূপ জান্নাত দান করবেন। আমাদের আমলের যা অবস্থা, তা দিয়ে কি জান্নাত পাওয়া সম্ভব? জি¦ না, সম্ভব নয়। আমল দিয়ে মুক্তির আশা করা যায় না। যত আমলই করি, সে তুলনায় জান্নাত অনেক অনেক বেশি দামী। আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে জান্নাত দিলে, তবেই আমরা জান্নাত লাভ করব।
আল্লাহ তা‘আলা বড়ই মেহেরবান। তিনি চান আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি। তার ইবাদত বন্দেগীতে আত্মনিয়োগ করি। আল্লাহ আমাদের জন্য জান্নাতের পথকে সহজ করে দিয়েছেন। অল্প আমলে বেশি সওয়াবের ব্যবস্থা রেখেছেন। ছোট সহজ আমলে বিরাট প্রতিদান নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমরা যাতে জান্নাতের দিকে ধাবিত হতে নিরুৎসাহিত না হয়ে পড়ি, সেজন্য তিনি প্রতি পদে পদে আমাদের জন্য নানা লোভনীয় প্রাপ্তি দিয়ে রেখেছেন। এর বড় প্রমাণ হল ‘সূরা ইখলাস’ পাঠ। ছোট্ট এই সূরাটি মাত্র একবার পাঠ করলেই বান্দা বিরাট সওয়াব হাসিল করতে পারে। নবীজি তার সাহাবীদের বলেছেন,
أَيَعْجِزُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَقْرَأَ ثُلُثَ القُرْآنِ فِي لَيْلَةٍ؟ فَشَقَّ ذَلِكَ عَلَيْهِمْ وَقَالُوا: أَيُّنَا يُطِيقُ ذَلِكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ فَقَالَ:اللَّهُ الوَاحِدُ الصَّمَدُ ثُلُثُ القُرْآنِ
তোমাদের কেউ কি প্রতি পারে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পড়তে সক্ষম? সাহাবীদের কাছে কাজটা কঠিন মনে হল।
-ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের কে আছে, এটা পারবে?
-সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশ (আবু সায়ীদ খুদরি রা। বুখারি ৫০১৫)।
১: প্রতি রাতে দশ পারা করে তেলাওয়াত করা ক’জনের পক্ষেইবা সম্ভব? সূরা ইখলাস পুরো কুরআনের এক তৃতীয়াংশের মর্যাদা রাখে। ছোট্ট সূরাটা একবার পড়লেই দশ পারা পড়ার সওয়াব হাসিল হয়ে যাবে,
إنَّ اللهَ جزَّأ القرآنَ ثلاثةَ أجزاءٍ، فجعل قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ جزءًا من أجزاءِ القرآنِ
আল্লাহ কুরআনকে তিনভাবে বিভক্ত করেছেন। সূরা ইখলাসকে এককভাবে এক তৃতীয়াংশের মর্যাদা দিয়েছেন (আবু দারদা রা। মুসলিম ৮১১)।
২: কুরআন কারীমের সব অংশ হুবহু একই মর্যাদার নয়। কিছু সূরা বা আয়াত অন্য সূরা বা আয়াতের তুলনায় বেশি মর্যাদাবান।
৩: কুরআন কারীমে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছে।
ক: তাওহীদ।
খ: আহকাম।
গ: কাসাস।
৪: সূরা ইখলাসে ‘তাওহীদ’ আলোচিত হয়েছে। অতি সংক্ষেপে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। দুনিয়াতে তাওহীদের চেয়ে বড় ইলম আর নেই। তাওহীদের আকীদা ঠিক করার চেয়ে বড় ইবাদত আর কিছু নেই। এজন্যই সূরা ইখলাসের এত মর্যাদা।
৫: তিন সেকেন্ড? মাত্র তিন সেকেন্ডে পুরো দশ পারার সওয়াব। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য আর কত সহজ করে দেবেন?
৬: আবু হুরায়রা রা. বলেছেন, একদিন নবীজি ঘোষণা দিলেন,
احشِدوا فإنِّي سأقرأُ علَيكُم ثُلثَ القرآنِ. قالَ: فحشدَ من حشدَ، ثمَّ خرجَ نبيُّ اللَّهِ ﷺ فقرأَ قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ ثمَّ دخلَ، فقالَ بعضُنا لبعضٍ: قالَ رسولُ اللَّهِ ﷺ: فإنِّي سأقرأُ علَيكُم ثُلثَ القرآنِ إنِّي لأرَى هذا خبرًا جاءَ منَ السَّماءِ. ثمَّ خرجَ نبيُّ اللَّهِ ﷺ فقالَ: إنِّي قلتُ سأقرأُ علَيكُم ثُلثَ القرآنِ، ألَا وإنَّها تعدِلُ بثُلثِ القرآنِ
সবাই জমায়েত হও। আমি তোমাদেরকে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পড়ে শোনাব। সবাই জমা হল। আল্লাহর নবী বের হয়ে, সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করে আবার হুজরায় চলে গেলেন।
আমরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলাম, আল্লাহর রাসূল বলেছেন কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পাঠ করবেন, শুধু সূরা ইখলাস পাঠ করেই হুজরায় চলে গেলেন? মনে হয় আকাশ থেকে এটুকুই নাযিল হয়েছে। আবার ওহী নাযিল হবে, সেজন্য হুজরায় চলে গেছেন।
অতঃপর নবীজি আবার বের হয়ে বললেন, আমি বলেছিলাম, কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পাঠ করব। জেনে রাখ, সূরা ইখলাসই কুরআনের এক তৃতীয়াংশ (মুসলিম ৮১২)।
৭: সূরা ইখলাসে শব্দ কম, অর্থ বেশি। তাওহীদের সারনির্যাস এই সূরায় দিয়ে দেয়া হয়েছে। একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে। তার কাছেই সবার মুখাপেক্ষী হতে হবে। তিনি কারও সন্তান নন। তাঁরও কোনও সন্তান নেই। এ-বিষয়টাই পুরো কুরআনের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়।
৮: হাদীসে নবীজি সা.-এর সুন্দর শিক্ষাদান পদ্ধতির একটি ঝলক ফুটে উঠেছে। সাহাবায়ে কেরামকে আগে বলে দিয়েছেন, এখন কী শিক্ষা দিতে যাচ্ছেন। একবারেই শিক্ষাটা দিয়ে দেননি। ভেঙে ভেঙে দিয়েছেন। যাতে ছাত্ররা বিষয়টির যথাযথ গুরুত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পারে।
৯: ছাত্র হিশেবে সাহাবায়ে কেরাম কেমন, তার একটি সুন্দর চিত্রও ফুটে উঠেছে। সব সময় শিক্ষকের কাছ থেকে কিছু শেখার আশায় তার ঘরের কাছে ধর্না দিয়ে বসে থাকতেন। শিক্ষক যেভাবে বলতেন, তার ঠিক সেভাবেই শিখতেন।
১০: সাহাবায়ে কেরামও সূরা ইখলাসকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পড়তেন। বেশি বেশি পড়তেন,
أنَّ رجلًا سمعَ رجلًا يقرأُ قُلْ هُوَ اللَّهُ أحدٌ يُردِّدُها فلمَّا أصبحَ جاءَ إلى رسولِ اللَّهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ فذَكرَ لَه وَكأنَّ الرَّجلَ يتقالُّها فقالَ النَّبيُّ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ والَّذي نفسي بيدِه إنَّها لتعدلُ ثلثَ القرآنِ
এক ব্যক্তি দেখল, আরেক ব্যক্তি রাতের বেলা, বারবার সূরা ইখলাস পড়ছে। সকালে প্রথম ব্যক্তি নবীজির কাছে রাতের বৃত্তান্ত জানাল। তার ভাবটা এমন ছিল, সূরা ইখলাস পড়াকে যথেষ্ট মনে করছিল না। নবীজি তাকে বললেন, আল্লাহর কসম, সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান (আবু সাঈদ খুদরী রা। বুখারী ৫০১৩)।
১১: এক তৃতীয়াংশের সমান মানে, সওয়াবের দিক দিয়ে সমান। পরিমাণে নয়। নবীজি ইখলাস পড়া ব্যক্তির আমলকে সঠিক বলে সত্যায়িত করেছেন।
১২: আরেকটি হাদীসেও সূরা ইখলাসের ফজীলত বর্ণিত হয়েছে,
أنَّ رسولَ اللَّهِ ﷺ بعثَ رجلاً على سريَّةٍ فَكانَ يقرأُ لأصحابِهِ في صلاتِهم، فيختمُ بِ قل هوَ اللَّهُ أحدٌ، فلمَّا رجعوا ذَكروا ذلِكَ لرسولِ اللَّهِ ﷺ، فقالَ: سلوهُ لأيِّ شيءٍ فعلَ ذلِكَ . فسألوهُ . فقالَ:لأنَّها صفةُ الرَّحمنِ عزَّ وجلَّ، فأنا أحبُّ أن أقرأَ بِها . قالَ رسولُ اللَّهِ: أخبروهُ أنَّ اللَّهَ عزَّ وجلَّ يحبُّهُ
এক অভিযানে আল্লাহর রাসূল এক ব্যক্তিকে আমীর বানিয়ে পাঠালেন। আমীর সাহেব জামাতে ইমামতি করতেন। প্রতি রাকাতেই কেরাত শেষ করতেন সূরা ইখলাস দিয়ে। মদীনার ফিরে আসার পর, কাফেলার সদস্যরা নবীজিকে ব্যাপারটা অবহিত করলেন। নবীজি বললেন,
-তার কাছে জেনে নাও, সে কেন এমনটা করেছে?
উত্তরে আমীর সাহেব জানালেন,
-এই সূরায় রহমানের (সিফাত) বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। তাই এই সূরা বেশি বেশি পড়তে আমার ভালো লাগে।
আল্লাহর রাসূল বললেন,
-তাকে জানিয়ে দাও, আল্লাহ তা‘আলাও তাকে ভালোবাসেন (আয়েশা রা। বুখারী ৭৩৭৫)।
১৩: সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করলে, আমি সহজেই আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিগণিত হতে পারব। হাদীসের ভাষ্য দ্বারা এটাই বোঝা যায়। তো, আমি কি রাব্বে কারীমের প্রিয় হতে ইচ্ছুক নই? সবসময় তো পড়বই, ঘুমের আগে অন্তত একবার অবশ্যই। ইনশাআল্লাহ।