রাতে ঘুম কার না ভাঙে! এপাশ ওপাশ করতে গিয়ে ঘুম ভাঙে! মশার কামড়ে ঘুম ভাঙে! টেলিফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙে। সুখস্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে। ছেলেমেয়ের কান্নার আওয়াজে ঘুম ভাঙে। রাতজাগা পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে।
ভাঙা ঘুম জোড়া লাগতে দেরী লাগে না। একটু জাগার পরই আবার দু’চোখ লেগে আসে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। পেয়ারা নবীজিরও ঘুম ভাঙতো। তখন তিনি কী করতেন? আমরা তো আবার ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু নবীজি (ﷺ) ঘুমিয়ে পড়ার আগে, এই সুযোগে কিছু যিকির করে নিতেন। কখনো যিকিরের পাশাপাশি ওজু করে সালাত আদায় করে নিতেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের জাগরণকে বৃথা যেতে দিতেন না। অযথা কালক্ষেপণ করতেন না। নবীজি (ﷺ) বলেছেন,
من تَعَارَّ من الليلِ فقال
রাতে ঘুম ভেঙে জেগে গেলে বলবে,
لا إلهَ إلَّا اللهُ وحدَهُ لا شريكَ لهُ، لهُ المُلْكُ ولهُ الحمدُ، وهوَ على كلِّ شيٍء قديرٌ،
الحمدُ للهِ، وسبحانَ اللهِ، ولا إلهَ إلَّا اللهُ، واللهُ أكبرُ،
ولا حولَ ولا قوةَ إلا باللهِ،
(১): এক আল্লাহ ছাড়া কোনও উপাস্য নেই। তার কোনও শরীক নেই। সমস্ত রাজত্ব তাঁরই। সমস্ত প্রশংসা তাঁরই। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।
(২): সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই। আল্লাহ মহান।
(৩): আল্লাহ ছাড়া কোনও শক্তি নেই, ক্ষমতা নেই।
তারপর বলবে (ثم قال):
اللهمَّ اغفرْ لي
আল্লাহুম্মা! আমাকে ক্ষমা করে দিন।
أو دعا، استُجِيبَ لهُ، فإن توضَّأَ وصلَّى قُبِلَتْ صلاتُهُ
অথবা (এর পাশাপাশি অন্য কোনও) দু‘আ করবে। তার দু‘আ কবুল করা হবে। আর যদি ওযু করে সালাত আদায় করে, তার সালাত কবুল করা হবে (উবাদাহ বিন সামেত রা, বুখারি ১১৫৪)
একাধারে তিন প্রকারের দু‘আ পড়েছেন নবীজি (ﷺ)। প্রথমে কালিমায়ে তাওহীদ পড়েছেন। দুনিয়া ও আখেরাতের কোনও কথাই এই কালিমার সমতুল্য নয়। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তার উম্মতকে সব সয় যিকিরের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। বেশি বেশি কালিমায়ে তাওহীদ পড়তে বলতেন। এই কালিমার ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে নবীজি (ﷺ) বলেছেন,
إنَّ اللهَ سيُخَلِّصُ رجلًا من أمتي على رؤوسِ الخلائقِ يومَ القيامة فينشُرُ عليه تسعةً وتسعينَ سِجِلًّا، كلُّ سِجِلٍّ مثلُ مدِّ البصرِ ثم يقولُ: أتُنكِرُ من هذا شيئًا؟ أظلَمَكَ كَتَبتي الحافظونَ؟ يقولُ: لا يا ربِّ . فيقولُ: أفَلَكَ عُذرٌ؟ فيقولُ: لا يا ربِّ، فيقولُ: بلى إنَّ لكَ عندنا حسنةًَ وإنِّه لا ظلمَ عليكَ اليومَ، فيُخرِجُ بِطاقةً فيها أشهدُ أنْ لا إلهَ إلا اللهُ وأشهدُ أنَّ محمدًا عبدُه ورسولُه، فيقولُ: احضُرْ وزنَكَ، فيقولُ: يا ربِّ ما هذهِ البِطاقةُ معَ هذه السِّجِلَّاتِ؟ فقال فإنك لا تُظلَمُ . قال: فتوضعُ السِّجِلَّاتُ في كِفَّةٍ والبطاقةُ في كِفَّةٍ فطاشتِ السِّجِلَّاتُ وثقُلتِ البِطاقةُ، ولا يَثقُلُ معَ اسمِ اللهِ شيءٌ
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা এক ব্যক্তিকে বাছাই করে এনে, সবার সামনে দাঁড় করাবেন। তার সামনে ৯৯-টা খাতা মেলে ধরবেন। প্রতিটি খাতা আকার-আয়তনে দৃষ্টির প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন,
-তুমি এসব খাতাপত্রে লিখিত তোমার আমলনামার কোনও কিছু অস্বীকার করো? আমার আমানতদার লেখক ফিরিশতারা তোমার প্রতি কোনও যুলুম করেছে?
-জি না ইয়া রব্ব!
-এই লিখিত নথির ব্যাপারে তোমার কোনও ওযর বা আপত্তি আছে?
-জি না, ইয়া রব্ব!
-তবে হাঁ, আমার কাছে তোমার এক পূন্যকর্ম জমা আছে। আজ তোমার প্রতি কোনও যুলুম করা হবে না।
আল্লাহ তা‘আলা একটা ছোট্ট একটা খাতা বের করবেন। তাতে লেখা থাকবে (أشهدُ أنْ لا إلهَ إلا اللهُ وأشهدُ أنَّ محمدًا عبدُه ورسولُه)। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন
-তোমার আমলনামার ওযন হাজির করো!
-ইয়া রব্ব! এসব বড় বড় খাতার সামনে এই ছোট্ট খাতার তুলনা কিভাবে সম্ভব?
-তোমার প্রতি আজ যুলুম করা হবে না।
(তোমার সমস্ত আমলই আজ মাপা হবে। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর আমলও বাদ পড়বে না)। ছোট্ট খাতাটা মীযানের এক পাল্লায় রাখা হবে, বড় বড় খাতাগুলো আরেক পাল্লায় রাখা হবে। ওযনে বড় খাতাগুলো হালকা দেখা যাবে, ছোট্ট খাতার পাল্লা বড়গুলোর তুলনায় ভারী হয়ে যাবে। আল্লাহর নামের চেয়ে অন্য কোনও কিছুই ভারী হতে পারে না (আবদুল্লাহ বিন আমর রা, তিরমিযী ২৬৩৯)।
নবীজি (ﷺ) দ্বিতীয় ভাগে পড়েছেন, আল্লাহর তা‘আলার সবচেয়ে প্রিয় বাক্যগুলো। নবীজি (ﷺ) বলেছেন,
أحبُّ الكلامِ إلى اللهِ أربعٌ:
আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বাক্য চারটি!
سبحانَ اللهِ، والحمدُ للهِ، ولا إله إلا اللهُ، واللهُ أكبرُ .
আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই। আল্লাহ মহান।
لا يضرُّك بأيِّهنَّ بدأتَ
চারটি বাক্যের যেটাকেই আগে পড়া হোক, কোনও সমস্যা নেই (সামুরাহ বিন জুনদুব রা, মুসলিম ২১৩৭)।
এই চারটি বাক্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। এই বাক্যগুলো আল্লাহ তা‘আলা দ্রুত কবুল করেন। বেশি সওয়াব দান করেন। কেন?
সুবহানাল্লাহ মানে, আমি মনেপ্রাণে দৃঢ় বিশ্বাস করি, আল্লাহ তা‘আলার সত্তা স্বকীয় সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত। তার সৌন্দর্যে কোনও ধরনের খুঁত নেই। তিনি সর্বগুণে গুণান্বিত সত্তা। তাঁর প্রতিটি গুণাবলী স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার কোনও গুণে বিন্দুমাত্র অসম্পূর্ণতা নেই। সব ধরনের মানবীয় দোষত্রুটি থেকে তিনি কল্পনাতীত রকমের পূত-পবিত্র।
আলহাদুলিল্লাহ মানে, আমি কোনও ধরনের সন্দেহ ছাড়াই সজ্ঞানে পরিপূর্ণ একীন রাখি, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র প্রশংসাযোগ্য সত্তা। সমস্ত কৃতজ্ঞতার মালিক শুধুই তিনি। তিনি কোনও তুলনা ছাড়াই প্রশংসিত। কোনও দান-প্রদান ছাড়াই প্রশংসাযোগ্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কেন্দ্র।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানে, তিনিই একমাত্র উপাস্য। তার কোনও শরীক নেই। তার সমস্ত গুণাবলী একমাত্র তাঁরই, তার মতো গুণাবলী আর কারও নেই। সমস্ত ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই, তাঁর মতো ক্ষমতা আর কারও নেই। তিনিই একমাত্র ইবাদতয্যে, আর কেউ ইবাদতযোগ্য নয়।
আল্লাহু আকবার মানে, বড়ত্ব ও মহত্ব একমাত্র তাঁরই। তাঁর যথাযোগ্য প্রশংসার যোগ্যতা বা শক্তি আমার নেই। তার বড়ত্বের ধরন বোঝা ও উপলব্ধি করা আমার সাধ্যের বাইরে। তিনি আমার বোধ ও বুদ্ধির অতীতে অবস্থান করেই বড়। তাঁর বড়ত্বের সীমা বা চৌহদ্দি আমার বোধগম্যতার বাইরে। আমি তাকে সবচেয়ে বড় বলে জানি। এই জানার ঘোষণাটা, তার বড়ত্বের পরিমাণ জেনে নয় নয়, বড়ত্বের পরিমাণ নিজের জ্ঞানসীমায় আয়ত্ত করতে না পেরে।
নবীজি (ﷺ) তৃতীয় ভাগে পড়েছেন, জান্নাতের রত্নভান্ডার সমূহের অন্যতম একটি ভান্ডারকে। নবীজি (ﷺ) বলেছেন,
ألا أدُلُّكَ على كلمةٍ هي كَنزٌ من كُنوزِ الجنةِ؟
আবা মূসা! আমি কি তোমাকে জান্নাতের রত্নভান্ডারের সন্ধান দেব?
-অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)!
-তা হলো (لا حَوْلَ وَلاقُوَّةَ إلا بِاللهِ)।
বুখারি ৬৪০৯।
এই বাক্যটা জান্নাতের রত্নভান্ডার কেন?
বান্দার সব কাজ আল্লাহর তাওফীকেই হয়। মুমিনের সমস্ত নেক আমল আল্লাহর অনুগ্রহেই সম্পন্ন হয়। আল্লাহ তা‘আরা এক মুহূর্তের জন্যেও যদি বান্দার তার নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতেন, বান্দা নিমিষেই পথভ্রষ্ট হয়ে যেত। মুমিনের শক্তি, ক্ষমতা, ইবাদত, কাজকর্ম সবই আল্লাহর দয়ার ফসল। এই বাক্যটার মাধ্যমে বান্দা, তার সবকিছু আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে। বান্দা বাক্যটার মাধ্যমে প্রকাশ করে, সে আল্লাহর দয়া করুণা ছাড়া নিতান্তই অসহায়। নিঃসম্বল। নিরন্ন। নিরাশ্রয়। তার সমস্ত কৃত্বি, তার সমস্ত অর্জন, তার সমস্ত ক্ষমতা, তার সমস্ত যোগ্যতা, আল্লাহরই দান।
এরপর নবীজি (ﷺ) মাগফিরাতের দু‘আ করেছেন। তারপর মনের চাহিদা মাফিক দু‘আ করেছেন। করতে বলেছেন। নবীজি (ﷺ) বলেছেন,
ما مِن مُسلِمٍ يَبِيتُ على ذِكْرٍ طاهرًا، فيتعارُّ مِن اللَّيلِ فيسأَلُ اللهَ خيرًا مِن الدُّنيا والآخِرةِ، إلَّا أعطاه إيَّاه
যে মুসলমান পবিত্র অবস্থায় (ওযুর সাথে) আল্লাহর যিকির করতে করতে ঘুমিয়ে পড়বে, তারপর রাতের বেলা ঘুম ভেঙে গেলে, আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করবে, আল্লাহ তাকে তা দিয়ে দেবেন (মু‘আয বিন জাবাল রা, আবু দাউদ ৫০৪২)।
এতবড় পুরষ্কার কেন? গভীর রাতে যখন আমাদের ঘুম ভাঙে, আমরা স্বাভাবিকভাবেই একটু বেখবর থাকি। গাফেল থাকি। ঘুমের ঘোরে আল্লাহ তা‘আলার কথা মনে থাকে না। এমন সময়েও যদি আল্লাহর যিকির যবানে জারি করতে পারি, রব্বে কারীমকে স্মরণে রাখতে পারি, অনেক বড় সৌভাগ্যই বলতে হবে। ইবাদতটা যেমন ব্যতিক্রম, বলাবাহুল্য পুরষ্কারও তেমনি হবে। এই সময়ে যিকিরকারীর সংখ্যা কম থাকে, তাই আমি যিকির করে অল্পতেই রব্বে কারীমের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারি। শেষে আছে ওযু করে সালাত আদায়ের কথা। আমলটা কঠিন তবে অসম্ভব তো নয়। এই সালাতের ব্যাপারে মাওলায়ে কারীম কী আশ্বাস দিয়েছেন? তিনি এই সালাতকে কবুল করে নিবেন বলেছেন। একটু হরকত করলেই এই দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করে ফেলতে পারি। প্রতিদিন না হলেও মাঝে মধ্যে! সপ্তাহে না পারলে মাসে! মাসে না পারলে দুই মাসে বা তিন মাসে বা ছয় মাসে! ইনশাআল্লাহ।