উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উপমহাদেশে গড়ে ওঠা আলীগড় আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান৷ শৈশবে তাঁর নাম ছিল সৈয়দ তাকভি৷ পরবর্তী সময়ে তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ নামেই খ্যাতি লাভ করেন৷
আলীগড় আন্দোলন এবং স্যার সৈয়দ আহমদের জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল বৃটিশদের আনুগত্যে থেকে উপমহাদেশের সাধারণ মুসলিমদের অর্থনৈতিক উন্নতি ও পশ্চিমা আধুনিক মনস্কতার সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করা। উনিশ শতকে যখন রাজ্যহারা ভারতীয় মুসলিমরা হিন্দু, শিখ ও ইংরেজ রাজশক্তির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখন একদিক থেকে যেমনিভাবে দারুল উলুম দেওবন্দ ও হকপন্থী ওলামায়ে কেরাম ইংরেজদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত মুসলমানদেরকে ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত ধর্মীয় শিক্ষাদানে ব্রতী হন, অপর দিকে স্যার সৈয়দ আহমদও আন্দোলনে নামেন। তবে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের সহযোগিতা নিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠিকে চেয়েছিলেন পশ্চিমা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। যেমনটা করেছিল হিন্দু সম্প্রদায়।
১৮৫০-এর সময়টা ভারতীয় মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে বিপদসংকুল ও বৈরী এক সময়। হিন্দু জমিদাররা ইংরেজ রাজশক্তির সঙ্গে আঁতাত করে তাদের স্নেহছায়া লাভ করতে সক্ষম হয়৷ কিন্তু মুসলিমরা একের পর আন্দোলনের সাড়া ফেলে ইংরেজদের চরম রোষানলে পতিত হয়৷ সবশেষে ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হলে মুসলিমদের দুর্দশার আর সীমা থাকে না।
স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজ সরকারের আমলেই একজন চাকুরিজীবি ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুতাসুলভ মনোভাব পোষণ করতেন। এবং এই মনোভাব তিনি বিকশিত করতে চেয়েছিলেন সমগ্র ভারতীয় মুসলমানদের ভেতর৷ পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্গে যোগ সৃষ্টির লক্ষে তিনি ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সায়েন্টিফিক সোসাইটি’। সোসাইটির প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল, পাশ্চাত্য শিক্ষা সম্পর্কে মুসলমানদের আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং ইংরেজদের সঙ্গে মুসলমানদের সুসম্পর্ক তৈরি করা৷ এরপর ১৮৭০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘শিক্ষা কমিটি’৷ ১৮৭৫ সালে নির্মাণ করেন ‘মোহামেডান এংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ’। এসবই ছিল আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া। চূড়ান্তরূপে আলীগড় ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৮ সালে৷
আলীগড় আন্দোলনের সুফল বাহ্যত যতটা চাকচিক্যপূর্ণ মনে হয়, সত্যিকার অর্থে তা কতটা চাকচিক্যপূর্ণ তা খতিয়ে দেখার আছে। ধর্ম, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি সকল দিক থেকেই বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয় আলীগড় আন্দোলনকে। প্রথমত আলীগড় অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ ও ঘোর সাম্রাজ্যবাদী থিওডোর বেক-এর প্রভাবে সৈয়দ আহমদ খান ইংরেজ শাসনের প্রতি আনুগত্য এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতার নীতি গ্রহণ করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা রুখতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তিনি ‘এডুকেশানাল কংগ্রেস’, ‘ইউনাইটেড পেট্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে কংগ্রেসের তিনটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা গঠন করেন। আর আলীগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করার অপূর্ব সুযোগ পায় এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতিকে তোষণ করতে শুরু করে। এভাবে এই আন্দোলন ব্রিটিশ ডিভাইড এন্ড রুল পলিসিতে সাহায্য করে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে সব রকমের বন্ধুত্বের চেষ্টা যে কেবল সাম্রাজ্যের পক্ষেই যায়, আলীগড় আন্দোলনের নেপথ্যে এই দূরদর্শিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়৷ অপরদিকে রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় এগিয়ে যান মাওলানা কাসেম নানুতবি। দীন-ধর্ম এবং প্রাচ্য সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। এবং সামগ্রিক স্বাধীনতাকামীতার আন্দোলনের পক্ষে আমরণ লড়াই করেন। সাম্রাজ্যবাদ তো নয়ই, দেশীয় সরকারি শক্তির পেছনেও কখনো ছুটেনি দেওবন্দ।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দেওবন্দসহ মূলধারার অন্যান্য মুসলিম শক্তিও স্বতন্ত্রতাকামী ছিল। তবে এর সাথে আলীগড় আন্দোলনের স্বতন্ত্রতাকামিতার মধ্যে পার্থক্য ছিল। আলীগড় আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল স্বতন্ত্র মুসলিম জাতীয়তাবাদী ধারা তৈরি, অন্যদিকে মূলধারার মুসলিম শক্তিগুলোর লক্ষ্য ছিল জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতামুক্ত ইংরেজ-বিরোধী ইসলামি ধারা তৈরি। তবে মুসলিম লীগের ধারা তৈরিতে আলীগড় আন্দোলনের জোরালো ভূমিকা ছিল, যাকে ইতিবাচকভাবেই দেখা উচিত।
তবে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলে যে মুসলিম সমাজের উন্নতির চিন্তা ছিল, আলীগড়ে শেষ পর্যন্ত সেই মুসলিম সমাজের উন্নতির ভাবনা কতটা সচল ছিল, নাকি কেবলই পাশ্চাত্যের রঙে গা ভাসিয়ে দেয়ার এক নতুন জোয়ার, তা সময়ই বলে দিয়েছে।
১৮৯৮ সালের ২৭ মার্চ আলীগড় আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মৃত্যু হয়৷ একটি বিশাল জীবন তিনি ভারতীয় মুসলিমদের পক্ষে ব্যক্তিগত চিন্তাধারায় লড়ে গেছেন। এ লড়াইয়ে–অনেকের ব্যাখ্যা মতে–তিনি ইংরেজের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিলেন। তবে আলীগড় আন্দোলনের কল্যাণে মুসলিম সমাজে শিক্ষার বিস্তার লাভ করেছে, তা অনসবীকার্য। যদিও সে শিক্ষাটা আখেরে ইংরেজদেরই কাজে লেগেছে বলেই বিশেষজ্ঞদের দাবী।
কাজী মাহবুবুর রহমান
মূলঃ fateh24