তিন. বিদআত
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিষয়ের আদেশ করেননি এবং যাকে দ্বীনের অংশ সাব্যস্ত করেননি এমন কিছুকে দ্বীনের মধ্যে দাখিল করা ও দ্বীনের অংশ সাব্যস্ত করা, ছওয়াবের উদ্দেশ্যে ও আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য সে কাজ করা এবং এর স্বউদ্ভাবিত বা সমাজে প্রচলিত কোনো রূপের বা স্বআরোপিত নিয়মকানুন, শর্ত-শরায়েতের এমন পাবন্দী করা যেমন শরীয়তের কোনো হুকুমের করা হয়, বিদআত বলে।
শিরক ও কুফর যদি হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ ধর্ম (যেমনটা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে) তাহলে বিদআত এক আলাদা শরীয়ত। আর শিরক ও কুফর যদি হয় ইসলামের ‘বাইরের শত্রু’ তাহলে বিদআত হচ্ছে ‘ঘরের দুশমন’- আল্লাহর দ্বীনের ভিতরে মানব-রচিত শরীয়ত, যা ভিতরে ভিতরে পুষ্ট হতে থাকে এবং কখনো কখনো (যদি একে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া হয়) মূল শরীয়তের দ্বিগুণ-তিন গুণ আকার ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে আসমানী শরীয়তের গোটা ক্ষেত্র ও মানুষের পূর্ণ সময়কে গ্রাস করে ফেলে। এ ‘শরীয়তে’র ‘ফিকাহ’ আলাদা, ‘ফরজ-ওয়াজিব’ আলাদা, ‘সুন্নত-মুস্তাহাব’ আলাদা আর কখনো কখনো পরিমাণে তা আল্লাহর শরীয়তের হুকুম-আহকাম থেকে অনেক বেশি।
বিদআত সবার আগে এ বাস্তবতা উপেক্ষা করে যে, ‘তাশরী’ (বিধান দেওয়া)র অধিকার একমাত্র আল্লাহর। শুধু তিনিই কোনো কিছুকে আইনের মর্যাদা দিতে পারেন ও তার অনুসরণ অপরিহার্য করতে পারেন। (আল্লাহর হুকুম উপেক্ষা করে) মানবের আইন-রচনা এ আসমানী প্রদত্ত মানসিবের প্রতি বিদ্রোহ। এ কারণে বিধানদাতা মানবকে কুরআন ‘তাগূত’ নামে উল্লেখ করেছে।
… يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا
আপনি কি ওদের দেখেননি, যারা আপনার প্রতি নাযিলকৃত কিতাব ও আপনার আগে নাযিলকৃত কিতাবের উপর ঈমান রাখার দাবি করে অথচ তারা নিজেদের মোকদ্দমা নিয়ে যেতে চায় তাগূতের (দুর্বৃত্তের) কাছে এ অবস্থায় যে, তাদের আদেশ করা হয়েছে তাকে প্রত্যাখ্যান করার। আর শয়তান চায়, এদেরকে পথভ্রষ্ট করে বহু দূরে নিয়ে যেতে।-সূরা নিসা ৪ : ৬০, রুকু : ৯
অথচ কোনো কিছুকে দ্বীন ও শরীয়ত সাব্যস্ত করা এবং বিশেষ রূপ ও শর্তের সমন্বয়ে একে আল্লাহর রেযামন্দি ও ছওয়াবের উপায় সাব্যস্ত করা তো (একদিক থেকে) এর চেয়েও মারাত্মক। এ তো শরীয়ত-রচনা। আর কুরআন বলে শরীয়ত দেওয়া একমাত্র আল্লাহর কাজ।
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ
(আল্লাহ তাআলা) তোমাদের জন্য দ্বীনের ঐ পথই নির্ধারণ করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি …।-সূরা শূরা ৪২ : ১৩, রুকু : ২
আরব জাহেলিয়াতের হালাল-হারাম নির্ধারণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধিবিধান জারির বিষয়ে কুরআন এ আপত্তিই করেছে-
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ
তাদের কি আছে কতক ‘শরীক’ (উপাস্য), যারা তাদের জন্য এমন একটি ধর্ম নির্ধারণ করে দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?-সূরা শূরা ৪২ : ২১, রুকু : ৩
আল্লাহর অনুমোদনহীন এ ধর্মীয় আইন প্রণয়ন কী ছিল-এর বিবরণ দেখুন সামনের আয়াতগুলোতে :
وَقَالُوا هَذِهِ أَنْعَامٌ وَحَرْثٌ حِجْرٌ لَا يَطْعَمُهَا إِلَّا مَنْ نَشَاءُ …
আর তারা নিজেদের ধারণামতে বলল, এই চতুষ্পদ প্রাণী ও ক্ষেত নিষিদ্ধ (কারো জন্য বৈধ নয়)। যাদের ব্যাপারে আমরা ইচ্ছা করি তারা ছাড়া আর কেউ তা খেতে পারবে না।
আর এই প্রাণীগুলোর পিঠে চড়া (বা বোঝা চাপানো) নিষিদ্ধ। আর কিছু প্রাণী, যেগুলো যবহের সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না। (এসব কথা) কেবল আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করার উদ্দেশ্যে (বলে)। অচিরেই আল্লাহ তাদেরকে তাদের মিথ্যারোপের শাস্তি প্রদান করবেন।-সূরাতুল আনআম ৬ : ১৩৮, রুকু : ১৬
এর পরের আয়াতে আছে-
وَقَالُوا مَا فِي بُطُونِ هَذِهِ الْأَنْعَامِ خَالِصَةٌ لِذُكُورِنَا وَمُحَرَّمٌ عَلَى أَزْوَاجِنَا …
তারা বলেছে, এ সকল প্রাণীর গর্ভে যা আছে তা শুধু আমাদের পুরুষদের জন্য (বৈধ) এবং আমাদের নারীদের জন্য হারাম। আর যদি তা মৃত হয় তবে সকলে তাতে সমান। আল্লাহ তাদেরকে তাদের মিথ্যা উক্তিগুলোর শাস্তি দিবেন। নিশ্চয়ই তিনি প্রজ্ঞাময়, সম্যক অবগত।-সূরাতুল আনআম ৬ : ১৩৯, রুকু : ১৬
কী ছিল আরবের এই ‘শরীয়ত-প্রণেতা’গণের অপরাধ যাকে কুরআন ‘ইফতিরা আলাল্লাহ’ (আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ) নামে অভিহিত করেছে? এ-ই তো ছিল যে, কোনো আসমানী সনদ ছাড়া তারা শুধু নিজেদের মতামত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে হালাল-হারাম নির্ধারণ করত; একটি বিষয়কে কারো জন্য হালাল আর কারো জন্য হারাম সাব্যস্ত করত; এমন বহু নীতি ও বিধান তারা নির্ধারণ করেছিল, যার কোনো আসমানী সূত্র ছিল না। অতপর সেগুলো এমন শক্তভাবে মেনে চলত ও অন্যদের মানতে বাধ্য করত, যা শুধু নবীগণের শরীয়ত ও আসমানী বিধানের ক্ষেত্রেই হতে পারে অর্থাৎ এর অন্যথাকারীকে শক্ত গুনাহগার মনে করা এবং অভিযুক্ত ও তিরষ্কৃত করা।
ইহুদি-খৃষ্টানদের এ অপরাধই কুরআন মজীদ এভাবে বর্ণনা করেছে –
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
আল্লাহকে ছেড়ে এরা তাদের পন্ডিত ও সাধকদের ‘রব’ (প্রভু) বানিয়ে রেখেছে …।-সূরা তওবা ৯ : ৩১, রুকু : ৫
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদী ইবনে হাতিম রা.-এর সামনে এ আয়াতের এই তাফসীরই করেছেন যে, ঈসায়ী উলামা-মাশায়েখ তাদের জন্য যা কিছু হালাল বা হারাম করেছে তারা তা শর্তহীনভাবে মেনে নিয়েছে এবং তাদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধান দানকারী সাব্যস্ত করেছে।
বস্ত্তত হালাল-হারাম নির্ধারণে আর কোনো কিছুকে শরীয়তের দলীল ছাড়া ফরয-ওয়াজিব সাব্যস্ত করা এবং বিশেষ নিয়মে বিশেষ শর্ত-শরায়েতের সাথে একে ছওয়াবের কাজ ও আল্লাহর নৈকট্যের উপায় সাব্যস্ত করার মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই –
شرع ما لم يأذن به الله
তথা আল্লাহর অনুমোদনহীন শরীয়ত প্রণয়ন।
২. বিদআত দ্বিতীয় যে সত্যকে উপেক্ষা করে তা হচ্ছে শরীয়তের পূর্ণাঙ্গতা। শরীয়তে যা নির্ধারিত হওয়ার ছিল তা নির্ধারিত হয়ে গেছে। নাজাতের প্রয়োজনীয় আমল এবং আল্লাহকে রাজিখুশি করার সকল উপায় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধর্মের ‘টাকশাল’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন যে নতুন নোট ধর্মের ছাপ দিয়ে বাজারে ছাড়া হবে তা হবে নিঃসন্দেহে ‘জাল নোট’।
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম সম্পূর্ণ করলাম এবং আমার নেয়ামত তোমার উপর পরিপূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের ধর্মরূপে পছন্দ করলাম।-সূরা মাইদা ৫ : ৩, রুকু : ১
তো বিদআতের যে পরোক্ষ দাবী, অর্থাৎ দ্বীন ও শরীয়তের এক বড় অংশ ছিল অস্পষ্ট ও অনির্ধারিত, শত শত বছর যাবত মুসলিম উম্মাহ সে সম্পর্কে ছিল অজ্ঞ ও বিমুখ এবং এর ছওয়াব ও সুফল সম্পর্কে ছিল উদাসীন ও বঞ্চিত, এমনকি খায়রুল কুরূনের ঐসব মানুষও, যাঁরা সরাসরি লাভ করেছেন
وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي
(তোমাদের উপর আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করলাম) এর সম্বোধন, এরপর শত শত বছর পর তা উদঘাটিত ও নির্ধারিত হয়েছে-একি কুরআনের নেয়ামত পরিপূর্ণ হওয়ার যে ঘোষণা তার সম্পূর্ণ বিরোধী নয়?
তো এই শরীয়তে যে কেউ নতুন কিছু সংযোজন করে এবং দ্বীন-বহির্ভূত কোনো কিছুকে দ্বীনের অংশ সাব্যস্ত করে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজের পাবন্দি করেননি তার পাবন্দি করে কিংবা আল্লাহকে রাজি-খুশি করার নতুন কোনো উপায় উদ্ভাবন করে সে যেন কর্মের ভাষায় বলছে যে, ধর্মে এ ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতাটুকু রয়ে গিয়েছিল, এখন তা দূর করা হচ্ছে। অন্যদিকে এ যেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরও অভিযোগ, যাঁর প্রতি আদেশ ছিল-
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ
হে রাসূল! আপনার রবের পক্ষ হতে যা কিছু আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে তা পৌঁছে দিন। যদি তা না করেন তাহলে আপনি তাঁর পয়গাম পৌঁছাননি।-সূরা মাইদা ৫ : ৬৭, রুকু : ১০
ইমাম মালিক রাহ. কতই না সুন্দর বলেছেন, অর্থ : যে কেউ ইসলামে নতুন কিছু সৃষ্টি করে, আর একে উৎকৃষ্ট মনে করে, সে (যেন) ঘোষণা করছে যে, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রিসালাতের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ) কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ
(আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম সম্পূর্ণ করলাম)
সুতরাং যা নবী-যুগে দ্বীন ছিল না তা আজও দ্বীন হবে না।
৩. আল্লাহর নাযিলকৃত শরীয়তের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তা সহজ ও সকল যুগের সকল মানুষের অনুসরণযোগ্য। আল্লাহ তাআলা মহাজ্ঞানী ও মহাপ্রজ্ঞাবান। মানুষের স্বভাবগত দুর্বলতা, তাদের প্রয়োজন, কল্যাণ ও বিচিত্র অবস্থা সম্পর্কে তিনি সম্যক অবগত।
এর সাথে তিনি ‘রাউফুর রহীম’ ও (সীমাহীন দয়ালু ও করুণাময়)। এই সর্বব্যাপী জ্ঞান ও সীমাহীন করুণার কারণে তিনি মানবের জন্য নিজ পয়গম্বরদের মাধ্যমে অতি সহজ শরীয়ত নাযিল করেছেন। শরীয়তের বিধানসমূহে তাদের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও বিচ্যুতি প্রবণতার পূর্ণ লেহাজ রেখেছেন এবং তাদের শক্তি ও সম্ভাবনা, সূক্ষ্মতা ও ব্যাপ্তি এবং স্থান-কালের পূর্ণ রেয়াত করে তাদের জন্য এক সর্বজনীন ও সর্বকালীন আইন-ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছেন। তাঁর ইরশাদ-
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
আল্লাহ কাউকে তার সামর্থ্যের অধিক কর্তব্য আরোপ করেন না।-সূরা বাকারা ২ : ২৮৬, রুকু : ৪০
يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُخَفِّفَ عَنْكُمْ وَخُلِقَ الْإِنْسَانُ ضَعِيفًا
আল্লাহ তোমাদের ভার লাঘব করতে চান। মানুষকে তো সৃষ্টি করা হয়েছে দুর্বল করে।-সূরা নিসা ৪ : ২৮, রুকু : ৫
يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
আল্লাহ তোমাদের সাথে আছানি করতে চান, তোমাদের সাথে কঠোরতা করতে চান না।-সূরা বাকারা ২ : ১৮৫, রুকু : ২৩
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
ধর্মে আল্লাহ তোমাদের উপর কোনো সংকট আরোপ করেননি।-সূরা হজ্ব ২২ : ৭৮, রুকু : ১০
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন (তরজমা) তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল, যাঁর কাছে তোমাদের ক্ষতিকর বিষয়সমূহ অতি দুর্বহ, তোমাদের অতি হিতাকাঙ্ক্ষী, ঈমানদারদের প্রতি অতি স্নেহশীল, করুণা পরায়ণ।- সূরা তাওবা ৯ : ১২৮, রুকু : ১৬
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের শরীয়ত সম্পর্কে বলেছেন-بعثة بالحنيفية السمحة
আমাকে অতি সহজ-সরল ধর্ম দিয়ে পাঠানো হয়েছে।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২২২৯১
إن الدين يسر
নিশ্চয়ই এ দ্বীন সহজ।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৯
উম্মতের কষ্টের এত লেহাজ তাঁর ছিল যে, ইরশাদ করেছেন-
لولا أن أشق على أمتي …
উম্মতের কষ্ট হবে এই আশঙ্কা যদি আমার না হত তাহলে প্রতি নামাযের সময় মিসওয়াক তাদের উপর ফরয করে দিতাম।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৮৮৭
তবে দ্বীনের এই সহজতা এবং আল্লাহর পক্ষ হতে এ নিশ্চয়তা শুধু তখনই যখন শরীয়ত হবে আল্লাহর, পক্ষান্তরে যখন শরীয়ত প্রণেতা হবে মানব নিজে এবং আল্লাহর শরীয়তে প্রক্ষেপ ও সংযোজন করবে তখন আর দ্বীন সহজ থাকবে না। কারণ মানবের জ্ঞান যেমন সীমাবদ্ধ তেমনি বিভিন্ন শ্রেণী-স্বভাবের মানুষের প্রয়োজন ও কল্যাণ, স্থান ও কালের বৈচিত্রের উপলব্ধি ও লেহাজ তার পক্ষে সম্ভব নয়। তদুপরি আপন জাতির প্রতি ঐ পরিমাণ দয়া ও করুণাও তার নেই, যা আছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। ফলে সংযোজন ও বিয়োজন মুক্ত থাকলে যে দ্বীন হত সকলের জন্য সহজ ও অনুসরণযোগ্য তা-ই এ সকল বিদআর মিশ্রণ ও দিন দিন নানা সংযোজনের পর এত জটিল ও প্রলম্বিত হয়ে পড়ে যে, তা পুরাপুরি পালন করা অসম্ভব হতে থাকে, আর তখন মানুষের মাঝে পলায়নপরতা ও অজুহাত খোঁজার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। অনেক মানুষ এমন ধর্মের ‘জোয়াল’ কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখে।
ধর্ম-ইতিহাসের মনোযোগী পাঠক জানেন, অসংখ্য বিদআতের দ্বারা ধর্ম যখন সাধারণ মানুষের জন্য দুর্বহ হয়ে পড়েছে তখনই ব্যাপকভাবে ধর্মত্যাগের ঘটনা ঘটেছে এবং ধর্মদ্রোহিতারও সূচনা হয়েছে।
মধ্যযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিদ্রোহ ছিল গির্জার ঐ ধর্মব্যবস্থার বিরুদ্ধেই, যার তুলনায় মূল ঈসায়ী ধর্ম এক দশমাংশও ছিল না।
৪. এই ‘নুকতা’ও মনে রাখার মতো যে, আল্লাহর দ্বীনের এক বৈশিষ্ট্য তার বিশ্বব্যাপী অভিন্নতা। এ অভিন্নতা যেমন কালের বিচারে তেমনি স্থানের বিচারে। আল্লাহ তাআলা যেহেতু ‘রাববুল মাশরিকাইন’ ও ‘রাববুল মাগরিবাইন’, তিনি যেহেতু স্থান ও কালের সীমা-শর্তের উর্ধ্বে তাই তাঁর শরীয়তে রয়েছে চূড়ান্ত ঐক্য। তাঁর চূড়ান্ত ও সর্বশেষ শরীয়ত, যা নাযিল হয়েছে শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর তা আকাশের এক সূর্যের মতো সকলের জন্য এবং এক আসমান এক যমীনের মতো সবার জন্য একরকম। প্রথম শতকে এর যে কাঠামো ছিল পঞ্চদশ শতকেও তা-ই আছে। পূবের লোকদের জন্য তার যে আকৃতি ও প্রকৃতি পশ্চিমের লোকদের জন্যও তা-ই। আরবের লোকদের জন্য তার যে নীতি ও বিধান, ইবাদতের যে রূপরেখা এবং আল্লাহকে রাজিখুশি করার যে পদ্ধতি ভারতের অধিবাসীদের জন্যও তাই। এ কারণে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের কোনো মুসলমান যদি পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে চলে যায় ইসলামের বিধিবিধান পালন করতে এবং মসজিদে আল্লাহর ইবাদত করতে, তাকে কোনো জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে না। না তার স্থানীয় কোনো গাইডের প্রয়োজন হবে, না গাইডবুকের। ধর্মীয় বিষয়ে তার কোনো অপরিচিতি বা বহিরাগতের অনুভূতি হবে না। আর তিনি যদি হন আহলে ইলম তাহলে সব জায়গায় তিনি ইমামও হতে পারবেন, ফতোয়াও দিতে পারবেন।
কিন্তু বিদআত এমন নয়। এতে এই ব্যাপক ঐক্য থাকে না। এতে পাওয়া যায় স্থান ও কালের প্রতিবিম্ব। বিভিন্ন স্থানিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এগুলোর জন্ম হয় এবং প্রত্যেক অঞ্চলের স্থানীয় ছাঁচে এবং রাষ্ট্র বা শহরের ঢালাইখানা থেকে ঢালাই হয়ে বের হয়। গোটা মুসলিম জাহানে না এর প্রচলন থাকে, না অবগতি। আর অবগতির পরও জরুরি নয় যে, সবাই তা স্বীকার করবে। এ কারণে হিন্দুস্তানের বিদআত মিসরের বিদআত থেকে আলাদা। শামের বিদআত ইরানের বিদআত থেকে আলাদা। কখনো শহর-শহরের বিদআত হয় আলাদা এক শহরের মুসলমানদের অন্য শহরের বিশেষ বিদআত সম্পর্কে জানা থাকে না। এমনকি এ বিচ্ছিন্নতা বাড়তে বাড়তে পাড়া ও পরিবার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে এবং প্রতি পরিবারের ‘ধর্ম’ আলাদা হতে পারে।
পূর্বের ধর্মসমূহের দৃষ্টান্তমূলক পরিণাম আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে ছিল। ইহুদি ধর্ম ও খৃস্ট ধর্ম বিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান ছিল। এ কারণে তিনি পূর্ণ সচেষ্ট ছিলেন ইসলামী শরীয়তকে তার প্রকৃত অবস্থায় রাখার জন্য। আর এর জন্য তিনি গ্রহণ করেছেন সব রকমের সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। তিনি তার নায়েবদের অত্যন্ত তাকীদের সাথে নির্দেশ দিয়েছেন বিদআত থেকে বেঁচে থাকার ও সুন্নতকে রক্ষা করার। ইরশাদ করেছেন-
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد
যে আমাদের ধর্মে এমন নতুন কিছু দাখিল করে, যা এতে নেই তো সেটা প্রত্যাখ্যাত।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ২৬৯৭
إياكم والبدعة، فإن كل بدعة ضلالة وكل ضلالة في النار
সর্বদা বিদআত থেকে বেঁচে থাক। কারণ প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহীর ঠিকানা জাহান্নাম।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৭১৪৪
তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী-
ما أحدث قوم بدعة …
যখন কোনো সম্প্রদায় ধর্মে কোনো নতুন বিষয় সৃষ্টি করে তখন এর সমতুল্য কোনো সুন্নত উঠিয়ে নেওয়া হয়।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৬৯৭০
[টীকা : এ নবী-ফরমানের ব্যাখ্যা দেখতে চাইলে পড়ুন, ‘‘মাকতূবাতে ইমাম রাববানী’’ (মাকতূব : ৮৬, খাজা আবদুর রহমান-এর উদ্দেশ্যে, পৃষ্ঠা : ১৮৬-১৮৭ (আহমদী); পৃষ্ঠা : ২৫৫ … অথবা দেখুন ঐ সকল মানুষের বাস্তব জীবন, যারা বিদআতে লিপ্ত।]
তাঁর প্রত্যক্ষ নায়েব সাহাবায়ে কেরাম রা. এ অসিয়্যত পুরাপুরি পালন করেছেন। বিদআতের বিষয়ে শিথিলতা বা সমঝোতার কোনো সুযোগ তাদের কাছে ছিল না। বিদআতের প্রকৃত ক্ষতি এবং শরীয়তের সংরক্ষণের রহস্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি না থাকলে সাহাবীগণের বিদআত প্রতিরোধের দৃষ্টান্তসমূহ গোঁড়ামি ও বাড়াবাড়ি মনে হবে। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে যাদের অবগতি আছে তাঁরা ঐ মর্দে মুজাহিদগণের ধর্মীয় প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাকে সালাম জানাবেন। কারণ দ্বিতীয় প্রজন্মেই যদি ধর্মের কাঠামো যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করা হত তাহলে এ ধর্ম টিকে থাকা সম্ভব হত না।
সাহাবায়ে কেরামের পর উম্মাহর ইমাম ও ফকীহগণ যে সমুচ্চ দ্বীনী প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার প্রমাণ দিয়েছেন তা নবীর ওয়ারিছগণেরই শায়ানে শান ছিল। তাঁরা নিজ নিজ যুগের বিদআতসমূহের শক্ত বিরোধিতা করেছেন। বিদআতপন্থীদের জ্ঞানগত ও কর্মগতভাবে বর্জন করেছেন। মুসলিমসমাজে ও ধর্মীয় ঘরানাগুলোতে এ সকল বিদআতের স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা এবং এসবের ধারকবাহকদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন এবং আহলে ইলমের নজরে তাদেরকে সব সময়ের জন্য হীন ও নগণ্য করে দিয়েছেন। বিশেষত হানাফী ফকীহগণ যে কঠিন ইহতিসাব-প্রহরা বসিয়েছেন এবং যে সূক্ষ্মদর্শিতা ও বিষয়োপলব্ধির সাথে তাঁদের সমকালীন আপাতসাধারণ কিছু বিদআতী কর্ম ও রীতির বিরোধিতা করেছেন এবং শরীয়তের হেফাযত ও সুন্নত-বিদআতের পার্থক্য পরিষ্কার রাখার জন্য যে প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যবস্থা ও ফিকহী-আইনী সতর্কতা গ্রহণ করেছেন তা দ্বীনের মৌলনীতি সর্ম্পকে তাদের গভীর অবগতি ও প্রজ্ঞার উত্তম দৃষ্টান্ত।
সাধারণ জনগণ ও সহজ-সরল ধর্মানুরাগীদের জন্য বিদআতের যে চুম্বক-আকর্ষণ এবং এর যে অতি দ্রুত প্রচলিত ও সমাদৃত হওয়ার শক্তি সে সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিরা ইসলামের ঐ আলিমগণের সাহস, বীরত্ব ও সফলতাকে সালাম জানাবেন, যাদের চেষ্টা ও সত্য-প্রকাশের কারণে কিছু কিছু বিদআত এমনভাবে নির্মূল হয়েছে যে, এখন তা পাওয়া যায় ফিকহের কিছু কিতাবে বা ইতিহাসের কোনো কোনো গ্রন্থে। কিছু বিদআতের প্রচলন থাকলেও তা বিদআত হওয়া স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং একটি দল সব সময় তার বিরোধিতা করে এসেছেন, এখনো করছেন।
এ বিদআত-বিরোধী ও সুন্নাহর পতাকাবাহী ব্যক্তিরা সর্বদা নিজ নিজ যুগের ‘আওয়াম’ বা ‘আওয়াম সম খাওয়াস’-এর পক্ষ হতে লাভ করেছেন ‘গোঁড়া’, অনুদার, প্রাচীনপন্থী প্রভৃতি উপাধি, যেভাবে প্রতি যুগের প্রথাবিরোধী ব্যক্তিরা লাভ করে থাকেন।
রবিউল আউয়াল ১৪৩৫ . জানুয়ারি ২০১৪
মাসিক আলকাউসার