চার. গাফলত
আল্লাহর দ্বীন থেকে বিমুখ হওয়ার এক ব্যাপক কারণ গাফলত বা উদাসীনতা। আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীনতা ও তাঁর বিধিবিধান সম্পর্কে অবহেলা শুধু বিদ্রোহ ও ইনকারের কারণেই হয় না; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয় দুনিয়ার মোহ ও বস্ত্ততান্ত্রিক জীবনধারার কারণে। সম্পদের মোহ এবং দিন-রাত উপার্জন-মগ্নতা মানুষকে আখিরাত সম্পর্কে পুরাপুরি গাফিল করে দেয়। পার্থিব চিন্তা এত প্রবল হয়ে যায় যে, নাজাতের ফিকির, আল্লাহকে রাজি-খুশি করার আগ্রহ ও তার শাস্তির ভয় অন্তর থেকে একেবারে বের হয়ে যায়। খাওয়া-পরা ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো কিছুর চিন্তা অবশিষ্ট থাকে না।
আল্লাহবিমুখ লোকদের সংশ্রব এবং ভোগ ও পাপাচার অন্তরকে এমন নির্জীব করে দেয় যে, নীতি ও ধর্মের অনুভূতি একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভালো-মন্দের প্রভেদ, হালাল-হারামের পার্থক্য সম্পূর্ণ বিদায় নেয়। বেশভূষা, আচার-আচরণ, সামাজিক রীতি-নীতি এবং কর্ম ও চরিত্রের দিক থেকে কাফির ও খোদাদ্রোহী বান্দাদের সাথে এ ‘গাফিল’ শ্রেণীর খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। বেপরোয়া মদ্যপান, লাগামহীন হারাম ও নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ততা, পাপাচার ও অনাচারের নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন আর এক্ষেত্রে এমন ‘শিল্প’ ও ‘নৈপুণ্য’ প্রদর্শন যে, অতীত জাতিসমূহ এদের সামনে ‘মাত’ হয়ে যায়। দ্বীন ও শরীয়তের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা অবশিষ্ট থাকে না। আত্মবিস্মৃতি ও আল্লাহ বিস্মৃতির এমন প্রকোপ হয় যে, ভুলেও আল্লাহর কথা মনে পড়ে না এবং নিজের প্রকৃত ভালো-মন্দের চিন্তাও অবশিষ্ট থাকে না।
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
আর ওদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। ফলে আল্লাহ ওদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন।-সূরা হাশর ৫৯ : ১৯, রুকু : ৩
এদেরই অবস্থা আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে বর্ণনা করেছেন-
إِنَّ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا وَرَضُوا بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاطْمَأَنُّوا بِهَا وَالَّذِينَ هُمْ عَنْ آَيَاتِنَا غَافِلُونَ * أُولَئِكَ مَأْوَاهُمُ النَّارُ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
নিশ্চয়ই যাদের আমার সাথে সাক্ষাতের আশা নেই, পার্থিব জীবনেই তুষ্ট ও মগ্ন এবং যারা আমার নিদর্শনসমূহ থেকে উদাসীন, এদের আবাস জাহান্নাম তাদের কর্মের কারণে।-সূরা ইউনুস ১০ : ৮, রুকু : ১
ফলে বাস্তবক্ষেত্রে এই গাফিল ও আখিরাতবিস্মৃত শ্রেণী আর আখিরাত অস্বীকারকারী ও আল্লাহ-রাসূলের প্রতি বিদ্রোহকারী সম্প্রদায় আলাদা থাকে না। নবীগণের দাওয়াতের পক্ষে এদের অস্তিত্বও ইনকারকারীদের মতোই নিষ্ফল, নিরর্থক; বরং কখনো কখনো বাধা ও প্রতিবন্ধক। কখনো তো এই নামের মুসলমানরাই হয়ে যায় ইসলামের বিরুদ্ধে দলীল ও ইসলামের প্রসার ও বিস্তারের পথের কাঁটা। আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এই গাফিল ও মুনাফিক শ্রেণিই সংখ্যাগরিষ্ঠতা, পার্থিব যোগ্যতা বা প্রচেষ্টা কিংবা শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে শাসন-ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং মুসলমানদের নেতৃত্ব এদের হাতে এসে যায় বা মুসলমানদের জীবনে তাদের এমন প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় যে, সাধারণ মুসলমানদের জন্য তারাই হয়ে যায় আদর্শ। এদেরই মর্যাদা ও মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হয় দিল-দেমাগে। ফলে এই ‘আকাবির মুজরিমীন’ ‘বড় পাপী’ দের দ্বারা গাফলত, আল্লাহ বিস্মৃতি ও অনৈসলামিক জীবনধারার এমন রমরমা অবস্থা সৃষ্টি হয়, যেন মুসলিম জনপদে জাহেলিয়াতের শাসন! কিছু কাল পর কখনো কখনো এ জীবনধারাই আখ্যায়িত হয় ‘ইসলামী তাহযীব ও তামাদ্দুন’ (ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি) নামে। তখন গাইরে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির চেয়েও এর বিরোধিতা কঠিন হয়ে পড়ে।
এই চরম প্রতিকূলতার মাঝে নবীর নায়েবগণকে কাজ করতে হয়। সম্ভবত মানবজাতির আর কোনো শ্রেণি এত ব্যস্ত নয় এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের এত গুরুভার বহন করে না যতটা রাসূলের নায়েবগণ ও ইসলামের আলিম ও মুসলিহ শ্রেণি বহন করেন।
দেহের চিকিৎসকদেরও কখনো কখনো অবকাশ যাপনের সুযোগ আসে কিন্তু রূহ ও আত্মার চিকিৎসকদের কোনো অবকাশের মওসুম নেই। অনেক দল ও সংগঠন এমন আছে, ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে যাদের বিপ্লব-সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে, কিন্তু হকের আলিমগণের ও
قوامين لله شهداء بالقسط
(আল্লাহর পক্ষ হতে ব্যবস্থাপক ও সত্যের সাক্ষ্যদানকারী) দলের কাজ কখনো কখনো মুসলিম শাসনামলে আরো বেড়ে যায়। কারণ কিছু ব্যধি আছে, যার প্রাদুর্ভাব শুধু সম্পদ ও ক্ষমতার সাথেই ঘটে। ইসলামের আলিমগণেরই কর্তব্য সেসবের তত্ত্বাবধান করা। তাঁরা নীতি-নৈতিকতার তত্ত্বাবধান ও ধর্মীয় নির্দেশনার দায়িত্ব থেকে অবসর হতে পারেন না। ঐ সময়ও তাদের সাধনা ও সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। দেখা যাচ্ছে, কোথাও তারা মুসলমানদের অপচয় ও বিলাসী জীবনযাত্রার সমালোচনা করছেন, কোথাও ভোগ-বিলাসের উপকরণসমূহের অপকারিতা বর্ণনা করছেন, কোথাও চোরাই মদ আটক করে তা ঢেলে দিচ্ছেন, কোথাও বাদ্যযন্ত্র ভাঙ্গছেন, কোথাও পুরুষের রেশমী কাপড় পরিধান ও সোনা-রূপার পাত্র ব্যবহারে উদ্বিগ্ন, কোথাও পর্দাহীনতা ও নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার নিন্দা, কোথাও হাম্মামখানার বিশৃঙ্খলা ও অনৈতিকতার বিষয়ে সোচ্চার, কোথাও অশ্লীল ও বেশরা কর্ম ও স্বভাবের বিরুদ্ধে ওয়াজ-নসীহত, কোথাও আজমী ও অমুসলিমদের রীতি-নীতি গ্রহণের বিরোধিতা ইত্যাদি। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, মসজিদের বারান্দা ও মাদরাসার কক্ষগুলোতে তাদের হাদীসের দরস এবং قال الله ও قال الرسول এর উচ্চধ্বনি। কখনো খানকাহসমূহে বা নিজের ঘরে ও মসজিদে বসে দিলের মরীচা অপসারণ। আল্লাহর মহববত ও আনুগত্যের শওক সৃষ্টি। অন্তরের রোগ-হিংসা-অহঙ্কার, দুনিয়ার লোভ এবং আত্মা ও প্রবৃত্তির বিভিন্ন ব্যধির চিকিৎসা ইত্যাদিতে মগ্ন। কখনোবা মিম্বরে দাঁড়িয়ে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন এবং ইসলামী সীমান্ত রক্ষা বা ইসলামের বিজয়াভিযানের জন্য প্রস্ত্তত করছেন। তো এভাবেই গোটা ইসলামী ইতিহাস জুড়ে আপনি জিন্দা ও রববানী আলিমগণকে, যারা শাসকগোষ্ঠির সাথে সংযুক্ত ছিলেন না এবং ছোটখাটো বিবাদ-বিসংবাদে লিপ্ত ছিলেন না, এ সকল ব্যস্ততাতেই মগ্ন দেখবেন। মুসলিম-শাসনের কোনো যুগ এই হক্কানী উলামা ও তাদের সংগ্রাম-সাধনা থেকে খালি ছিল না।
বনু উমাইয়ার শাসনামল ছিল ইসলামের রাজকীয় আমল। বাহ্যত মুসলিমগণ সকল ব্যস্ততা থেকে অবকাশ পেয়েছিলেন, কিন্তু আলিমদের অবকাশ নেই। হযরত হাসান বসরী রাহ.-এর ওয়াযের মজলিস সরগরম, সমকালীন মুনকার ও বিদআতের বিরুদ্ধে ঐ মজলিসে বক্তৃতা হচ্ছে, নিজ যুগের সামাজিক জীবনব্যবস্থা ও শাসকগোষ্ঠির ধর্মহীনতার নিন্দা, নিফাকের চিহ্ন ও আলামত, মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য বিস্তারিত বর্ণনা করা হচ্ছে এবং চলমান জীবনের সাথে তার মিল-অমিল দেখানো হচ্ছে। আখিরাত ও আল্লাহকে ভয় করার বয়ান হচ্ছে, আর শ্রোতাদের চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছে, কাঁদতে কাঁদতে কারো হেঁচকি এসে যাচ্ছে।
সূরায়ে ফুরকানের শেষ রুকু
وعباد الرحمن …-এর তাফসীর হচ্ছে (টীকা : কিতাবু কিয়ামিল লাইল, মুহাম্মাদ ইবনে নাসর আলমারওয়াযী) আর সাহাবায়ে কেরামের চোখে-দেখা অবস্থা ও ঘটনাবলি এমনভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে যেন ঐ বরকতময় পুণ্যযুগ চোখের সামনে উপস্থিত, যেন আল্লাহর রাসূলের সাহাবীগণকে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। লোকেরা মজলিস থেকে তওবা করে উঠছে-শত শত মানুষের অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে।
এরপর বনু আববাসের শাসনামল। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. প্রবল প্রতাপ বাদশাহর মত ও পছন্দের বিরুদ্ধে মুতাযিলা মতবাদের সুস্পষ্ট খন্ডন করে চলেছেন এবং বিদআতের খন্ডন ও সুন্নতের ঘোষণা দিচ্ছেন। ‘কালাম’ ও ‘ফালসাফা’ অভিমুখী ক্রমবর্ধমান ঝোঁকের বিপরীতে বিশুদ্ধ সুন্নাহ ও সালাফের আকাইদ প্রচার করছেন। আর সবকিছু এমন সাহস ও নিশ্চিন্ততার সাথে, যেন মামুন ও মুতাসিমের শাসনামল নয়, হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ.-এর খিলাফত-আমল।
বাগদাদ তখন উন্নতির চূড়ান্তে। সভ্যতা ও সম্পদ এবং স্বাধীনতা ও চিন্তাহীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে, চার দিকে ভোগ-বিলাসের সয়লাব, কার্খ ও রূসাফার ময়দানসমূহে এবং মসজিদের চত্বরগুলোতে মেলা বসেছে, বাজারগুলো ক্রেতাদের ভীড়ে জমজমাট, এরই মাঝে দলে দলে মানুষ সকল আনন্দ-উৎসব থেকে চোখ বন্ধ করে একদিকে চলেছে, আজ জুমাবার, আজ মুহাদ্দিস ইবনুল জাওযীর ওয়াজ। ওয়াজ হচ্ছে, শত শত মানুষ তওবা করছে ও অসংখ্য অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করছে। লোকেরা পাপাচার থেকে তওবা করছে।
এই কোলাহল-মুখর বাগদাদেরই একদিকে অতি শান্ত পরিবেশে জারি আছে হযরত শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাহ.-এর দরস, ওয়াজ ও রূহানী ফয়েয, যা থেকে আরব-আজমের লোকেরা উপকৃত হচ্ছে । বড় বড় শাহজাদা ও আমীর-ওমরা ভোগ-বিলাস ছেড়ে দুনিয়ার মোহমুক্ত দরিদ্র জীবন অবলম্বন করছে। বড় বড় অহঙ্কারী ও সম্পদের গর্বে মত্ত ব্যক্তি তওবা করছে। আববাসী খিলাফতের রাজধানীতে এবং বাগদাদের প্রতাপশালী খলীফার সম্মুখে এ দরবেশের দ্বীনী ও রূহানী শাসন প্রতিষ্ঠিত, যার মূদ্রা আরব-আজমে সমান চালু।
পরবর্তী সকল যুগে এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের সকল দিগন্তে রাজা-বাদশাহর বিপরীতে এবং অন্য সকল ব্যস্ততা-মগ্নতা, আহবান-আন্দোলনের সাথে হকের আলিমগণের এই প্রচেষ্টা এবং তাদের মারকায, মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ, ওয়াজ-মাহফিল, নিয়মিত বা অনিয়মিত তত্ত্বাবধান সব জারি আছে।
[টীকা : ভারতবর্ষের এ সংক্রান্ত ইতিহাস সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে মরহুম ওয়ালিদ ছাহেব মাওলানা সাইয়েদ আবদুল হাই রাহ.-এর অসামান্য আরবী গ্রন্থ-‘‘নুযহাতুল খাওয়াতিরে’’র আট খন্ডে, যা হিন্দুস্তানের মুসলমান, প্রসিদ্ধ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও উলামা-মাশাইখের সবচেয়ে বড় ইতিহাস-গ্রন্থ।]
এঁরাই হলেন ঐ সত্যপন্থী আলিমসমাজ, ঐ সৌভাগ্যবান বা হতভাগা সম্প্রদায়, যারা মুসলিম রাজন্যবর্গ ও রাজ-কর্মচারীদের হাতে জেল-জুলুম, বেত্রাঘাতের শিকার হয়েছেন। (যখন অন্যরা পেয়েছেন সোনা-রূপার থলে আর পদ-পদবীর পরওয়ানা)
এক মুসলিম শাসক (হাজ্জাজের) হাতে এ জামাতের কতজন ব্যক্তি লাভ করেছেন শাহাদাতের রক্তিম খেলাৎ। এরপর এ জামাতেরই এক মর্যাদাশালী ইমাম (হযরত ইমাম আবু হানীফা) কে ‘আমীরুল মুমিনীন’ মনসুর আববাসীর হাতে পান করতে হয়েছে বিষের পেয়ালা। এরপর এ জামাতেরই আরেক ইমাম (হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.) কে সবচেয়ে বড় ‘প্রগতিশীল’ মুসলিম বাদশাহ (মামুনের) শাসনামলে পরতে হয়েছে বেড়ি এবং নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে জেলখানার অন্ধকার কুঠুরিতে এবং তার উত্তরসূরী মুতাসিমের হাতে বরদাশত করতে হয়েছে কোড়ার আঘাত।
এরপর এই শেষ যুগেও কত ন্যায়বিচারক মুসলিম শাসকের হাতে কত মর্যাদাশালী আলিম জুলুমের শিকার হয়েছেন। জাহাঙ্গীরের ‘ন্যায়-শৃঙ্খল’ তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাহ.-এর পায়েও সে শৃঙ্খল পরানো হয়েছে এবং সত্য প্রকাশের ‘অপরাধে’ তাকে গোয়ালিয়রের কেল্লায় বন্দি হতে হয়েছে।
এ সকল কীর্তি ও অবদান ছাড়াও (যা দ্বীনের ধারক-বাহক ও শরীয়তের সংরক্ষকদের দায়িত্ব), যেগুলোকে আমরা এই দিক থেকে ‘দিফায়ী’ বা আত্মরক্ষামূলক বলতে পারি যে, শিরক-কুফর এবং বিদআত ও গাফলতের মোকাবেলায় তা ইসলাম রক্ষার চেষ্টা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব কাজ ইসলামের স্বয়ংসম্পূর্ণ দাওয়াত ও তাবলীগ এবং দ্বীনের ধরাবাহিক চেষ্টা-প্রচেষ্টা, যা কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে-
لا يزال طائفة …
-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৯২০
কিন্তু এসব ছাড়াও আরো দুটি খিদমত আছে, যা সকল যুগের আলিমগণেরই দায়িত্ব। আর উলামায়ে রববানী যা পালন করে এসেছেন।
এক. ইসলামের দিগ্বিজয়ের দ্বারা কিছু পরিমাণে এবং নেককার, সূফী, মুবাল্লিগ ও কিছু মুসলমানের আখলাক ও মহববতের প্রভাবে অধিক পরিমাণে বিজিত অঞ্চলসমূহে লাখো মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং একেকটি গোটা পরিবার, বড় বড় খানদান ইসলামে দাখিল হয়েছে। কিন্তু তাদের তালিম-তরবিয়তের কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি এবং তাদের উপর ইসলামী শিক্ষার কোনো প্রভাব পড়তে পারেনি কিংবা তাদের উপর প্রভাব পড়লেও পরের প্রজন্মে তা অবশিষ্ট থাকেনি এবং ধীরে ধীরে এটুকু ছাড়া আর কিছুই তাদের মনে থাকেনি যে, আমাদের পিতা-পিতামহ মুসলিম ছিলেন, এক যামানায় তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ উত্তরপ্রজন্মের কাছে মুসলমানী নাম ও কালেমা তাইয়েবার শব্দগুলো ছাড়া ইসলামের কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট থাকেনি। আরো কিছু দিনের অবহেলার পর মুসলমানী নামটিও আর বাকি থাকল না, কালেমা তাইয়েবার শব্দগুলোও শতকরা দু’-একজন ছাড়া কারো মনে রইল না, তবে মুসলিম হওয়ার স্বীকারোক্তিটুকু থাকল। এরপর তা-ও লোপ পেতে থাকে আর তখনই প্রকাশ্যে ইরতিদাদ ও ধর্মত্যাগের ঘটনা ঘটতে থাকে।
ভারতবর্ষের মতো অঞ্চলে, যেখানে বিশেষ শ্রেণির বাইরে ইসলামের ভিত্তি সবসময় দুর্বল ছিল, এমন বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। প্রায় সকল বড় শহরের অদূরে এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত ও দিগন্তে এমন লক্ষাধিক মুসলিম জাতি-গোষ্ঠি রয়েছে ইসলামের সাথে যাদের কোনোরূপ সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকেনি। দেহাত-পল্লীর বহু মুসলিম আবাদী এমন আছে, যেখানে নতুন করে ইসলাম প্রচার প্রয়োজন। এদের মধ্যে এমন অনেক ‘মুসলিম’ আছে, যারা এখনো ‘জাহেলী যুগে’ অবস্থান করছে, আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কেও তাদের কোনো অবগতি নেই। ইসলাম সম্পর্কে এদের উদাসীনতা দেহাতী অমুসলিমদের মতোই। ইসলামের বিধিবিধান তো দূরের কথা, কোনো কোনো বড় শহরের আশেপাশে এমন ‘মুসলিম’ও পাওয়া যায়, যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম মুবারকের সাথেও পরিচিত নয়।
কিছু রববানী আলিম ঐ সকল দেহাত ও পল্লীর দিকে মনোযোগ দিলেন এবং কিছু মুসলিম বংশ ও পরিবারকে নতুন করে ইসলামে দীক্ষিত করলেন। এদের মাঝে দাওয়াতী কর্মশালা করলেন। ওয়াজ-নসীহত, মেলামেশা এবং আখলাক ও আচরণ দ্বারা তাদের অন্তর জয় করলেন। এদেরকে মুরীদ করে তাওহীদ ও সুন্নতের অনুসারী করলেন শিরক-বিদআত থেকে তওবা করালেন, জাহেলী রীতি-নীতি, অমুসলিমদের বেশভূষা এবং কুফর ও জাহেলিয়াতের চিহ্নসমূহ থেকে মুক্ত করলেন এবং তাদের মধ্যে আখলাক ও ইনসানিয়াত পয়দা করলেন। কর্তব্য-নিষ্ঠা, বিধিবিধানের আনুগত্য ও সময়ানুবর্তিতা শিক্ষা দিলেন। ইলমের আগ্রহ সৃষ্টি করলেন এবং শিক্ষা বিস্তার করলেন। এদের মধ্যকার যোগ্য লোকদের বাছাই করে নিজের কাছে রেখে তালীম-তরবিয়ত করলেন, অতপর এদের দ্বারাই এদের আত্মীয়-অনাত্মীয় সবার মাঝে তাবলীগ ও ইসলাহের কাজ করালেন। এ তাবলীগী কাজ, নবীগণের (আলাইহিমুস সালাম) কর্মপন্থার সাথে যার বাহ্যিক সামঞ্জস্য সর্বাধিক, আলিমগণের অন্যান্য র্কীর্তি ও অবদানের তুলনায় মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
দুই. ইসলামের শক্তির এক চিরন্তন উৎস কুরআন ও হাদীস, যা থেকে সর্বদা আলো ও শক্তি গ্রহণ করা যায় এবং যার মাধ্যমে সর্বযুগে মুসলমানদের দুর্বল দেহেও প্রাণ সঞ্চার করা যায়। তাই কুরআন-হাদীসের ইলম ও তার প্রচার হচ্ছে শিরক, কুফর, বিদআত ও গাফলতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। কুরআন-সুন্নাহর আলো যত ছড়াবে কুফর ও জাহালাতের অন্ধকার তত দূর হবে। এ কারণে কুরআন-সুন্নাহর ইলমের বিস্তার হচ্ছে তাবলীগের হাজার উপায়ের এক উপায়।
নবীগণের এক বড় বৈশিষ্ট্য তাদের ঐক্য ও অভিন্ন। তাঁরা সবাই এক কথা বলেন এবং একটি কথাই বলতে থাকেন। সে কথা কী-
قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ
-সূরা হূদ : ১১ রুকু : ৮
তাঁদের নায়েবগণেরও বৈশিষ্ট্য এই যে, তাদের সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা ও নানামুখী কর্মব্যস্ততার লক্ষ্যও একটি। আর তা হচ্ছে ‘দাওয়াত ইলাল্লাহ’ আল্লাহর দিকে ডাকা। দরস-তাদরীস, ওয়াজ-নসীহত, তাবলীগ-তাযকীর, রচনা-সংকলন, সুলুক-তাসাওউফ, বাইআত-ইরশাদ, সবকিছুর উদ্দেশ্য আল্লাহর মাখলুককে আল্লাহর দিকে ডাকা, আল্লাহর সাথে যুক্ত করা এবং আল্লাহর বানানো। তাদের ব্যস্ততার ধরন বিভিন্ন হলেও লক্ষ্য ও গন্তব্য অভিন্ন। তাঁরা অনেক কিছু বলেন, কিন্তু আসলে এক কথাই বলেন ও বারবার বলেন-
فطرت كا سرور ازلى اسكى شب وروز
آہنگ ميں يكتا، صفت سورۂ رحمان
হযরত নূহ আ.-এর মতো তারাও এই বিভিন্ন ব্যস্ততা ও প্রচার ও তাবলীগের বিভিন্ন পন্থার দিকে ইশারা করে বলেন-
رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا
আয় রব! আমি আমার কওমকে ডেকেছি রাতদিন।-সূরা নূহ ৭১ : ৫, রুকু : ১
ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا
অতপর আমি তাদের ডেকেছি উচ্চস্বরে।-সূরা নূহ ৭১ : ৮, রুকু : ১
ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنْتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا
অতপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে বুঝিয়েছি এবং সম্পূর্ণ গোপনেও বুঝিয়েছি।-সূরা নূহ ৭১ : ৯, রুকু : ১
এই ওয়াজ, এই দরস, এই ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা, এই প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য পন্থা ও কৌশল, এই তাওয়াজ্জুহ-অভিনিবেশ সব ‘ইলান’ ও ‘ইসরারের’ই বিভিন্ন রূপ।
রবিউস সানি ১৪৩৫ . ফেব্রুয়ারি ২০১৪
মাসিক আলকাউসার