আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু

আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর খলীফা। তার নাম আবদুল্লাহ বিন আবি কুহাফা উসমান বিন আমের বিন আমর বিন কাব সাদ বিন তায়ম বিন মুররাহ বিন কাব বিন লুয়াই বিন গালিব আল কারশী তায়মী। তার বংশ পরম্পরা মুররাহ বিন কাব পর্যন্ত পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মিলে গেছে।

ইমাম নববী তাহযীব গ্রন্থে লিখেছেন, আবু বকর (রাঃ) এর প্রসিদ্ধ নাম ছিল আবদুল্লাহ। এটা বিশুদ্ধতম অভিমত। কেউ কেউ বলেন, তার নাম আতিক। তবে সকল ওলামা এতে একমত নন। তাদের মতে এটা তার উপাধি, কারন ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন হাদিস শরীফে রয়েছে, তিনি জাহান্নামের আগুন থেকে আতিক অর্থাৎ মুক্ত।

কেউ কেউ বলেন, তিনি সৌন্দর্য ও সুদর্শনের কারনে আতিক উপাধিতে ভূষিত হোন। কারন আতিক অর্থ সৌন্দর্য ও কান্তিময়। কারো মতে, আবু বকর (রাঃ) এর ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোন ত্রুটি ছিল না বলে তাকে আতিক বলা হয়।

মুসআব বিন যুবাইর সহ প্রমুখ ব্যক্তি লিখেছেন, মুসলিম উম্মাহ এ বিষয়ে একমত যে, তার উপাধি ছিল সিদ্দীক। কারন তিনি নির্ভয়ে ও নিঃসংকোচে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়তের সাক্ষ্য প্রদান করেন আর বিশ্বাসের উপর অটল ছিলেন। তিনি কখনো কোন কাজে এতটুকু পিছপা হননি। ইসলামের মধ্যে তার মর্যাদা সবার শীর্ষে। সিদ্দীক উপাধি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মিরাজের ঘটনা প্রসিদ্ধ। তিনি কাফিরদের জবাবে নিজের চিন্তা-চেতনার উপর অবিচল ছিলেন আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভিমতকে সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হিজরত করা, নিজের পরিবারের মায়া ত্যাগ করা, গুহায় ও গোটা রাস্তায় তার সর্দারের (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) সেবা প্রদানকে নিজের জন্য কর্তব্য মনে করে নেওয়া, বদর যুদ্ধে কথা বলা, হুদায়বিয়ার প্রান্তর থেকে মক্কায় প্রবেশ করতে না পারায় লোকদের মধ্যে যে সংশয় দেখা দেয় তা দূর করা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই হাদিস যা শুনে তিনি কেঁদেছিলেন। হাদিসটি হল – আল্লাহ তাআলা তার এক বান্দাকে দুনিয়া বা আখিরাত দুটোর একটি বেছে নেওয়ার অবকাশ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত সংক্রান্ত আয়াতের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর খুৎবার মাধ্যমে লোকদেরকে শান্ত রাখা, মুসলমানদেরকে যুক্তিসিদ্ধ উপদেশের কারনে খিলাফতের জন্য প্রস্তুত হওয়া, উসামা বিন যায়েদকে সৈন্যে সহকারে সিরিয়ার পাঠানো আর এ সিদ্ধান্তে অটল থাকা, দুর্বল মুহূর্তে মুরতাদদের সাথে লড়াই করা আর এ ব্যাপারে সাহাবাদের সম্মত করানো, সিরিয়া বিজয় করা, সিরিয়া নির্ধারণ করা – এ সবই তার প্রকৃষ্টতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য।

হযরত আবু বকর (রাঃ) এর অনন্য গুণাবলীর কোন পরিসীমা নেই, যা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখ করা যেতে পারে (এটা ইমাম নববীর অভিমত)। তবে আমার ইচ্ছা হলো, আমার যতটুকু জানা আছে, সে অনুযায়ী কয়েকটি অধ্যায়ে তা সবিস্তারে লিখবো।

 

নাম ও উপাধি   

ইবনে কাসির (রহঃ) বলেন, এ ব্যাপারে সকল ওলামা একমত যে, তার নাম আবদুল্লাহ বিন উসমান। তবে ইবনে সিরীন (রহঃ) থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেন যে, তার নাম আতিক। বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে, আতিক হল তার উপাধি। এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে যে, এ উপাধি কখন আর কেন হয়। কেউ কেউ বলেন, তার সৌন্দর্য আর সুদর্শনের কারনে তাকে এ উপাধি দেওয়া হয়। লায়েস বিন সাদ, আহমদ বিন হাম্বল প্রমুখ এ বর্ণনাটি বর্ণিত করেছেন।

আবু নুয়াইম লিখেছেন, পুণ্যময় কাজে অগ্রবর্তী হওয়ার কারণে তাকে এ উপাধি দেওয়া হয়। কেউ কেউ বর্ণনা করেন, তার বংশের পূর্বপুরুষদের চরিত্রে কোন অপবাদ না থাকার কারনে তাকে এ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। কারো মতে, তার নাম আতিক রাখা হয়েছিলো, পরবর্তীতে আবদুল্লাহ নাম হয়।

কাসিম বিন মুহাম্মাদ থেকে তাবারানি বর্ণনা করেন, তিনি আবু বকর (রাঃ) এর নাম আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলে আয়েশা (রাঃ) বললেন, “আবদুল্লাহ।” প্রশ্ন করা হলো, লোকেরা তো আতিক বলে। আয়েশা (রাঃ) বললেন, আবু কুহাফার তিন পুত্র – আতিক, মুকি আর মুতাইন।

মুসা বিন তালহা (রাঃ) থেকে ইবনে মান্দা আর ইবনে আসাকির বর্ণনা করেন, আমি আবু তালহা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, আবু বকরের নাম আতিক রাখা হলো কেন ? আবু তালহা (রাঃ) বললেন, তার পিতার কোন সন্তান জীবিত থাকতো না। তার জন্মের সময় তার পিতা তাকে নিয়ে কাবা শরিফে গিয়ে আরয করলেন – হে আল্লাহ, এ নবজাতককে মৃত্যু অবধি আতিক (মুক্ত) করে আমাকে দান করুন।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে তাবারানি বর্ণনা করেছেন, লাবণ্যময় আকৃতির জন্য তার নাম আতিক রাখা হয়।

আয়েশা (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেন, পারিবারিকভাবে তার নাম আবদুল্লাহ রাখা হয়। তবে তিনি আতিক নামে অধিক প্রসিদ্ধ হয়ে যান।

এক বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নামে রেখেছিলেন আতিক।

মুসনাদ গ্রন্থে আবু ইয়ালা লিখেছেন, ইবনে সাদ (রহঃ) আর হাকিম (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, একদিন আমি নিজের ঘরে ছিলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে ঘরের বারান্দায় ছিলেন। আমাদের মধ্যে একটি পর্দার আড়াল ছিলো। এমন সময় আবু বকর (রাঃ) সেখানে এলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যে জাহান্নামের আগুন থেকে চিরমুক্ত ব্যক্তিকে দেখতে চায়, সে যেন আবু বকরকে দেখে। পারিবারিকভাবে তার নাম রাখা হয় আবদুল্লাহ, তবে তিনি আতিক নামে প্রসিদ্ধ হোন।

তিরমিযি ও হাকিম বর্ণনা করেন যে আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে আবু বকর (রাঃ) উপস্থিত হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে আবু বকর, আল্লাহ তাআলা তোমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করেছেন। সেদিন থেকেই তার নাম হয় আতিক।

আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের সূত্রে বাযযার আর তাবারানি বর্ণনা করেন, সিদ্দিকে আকবরের (অর্থাৎ, আবু বকরের) নাম আবদুল্লাহ ছিলো। একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করা হয়েছে। সেদিন থেকে তার নাম হয় আতিক। আর সিদ্দীক উপাধি জাহেলিয়াতের যুগ থেকেই ছিলো। কারন তিনি সবসময়ই সত্য বলতেন। এ বর্ণনাটি মুসদিও লিপিবদ্ধ করেছেন। এটাও বলা হয়ে থাকে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনীত সংবাদকে সত্যায়িত করায় তাকে সিদ্দীক উপাধি দেওয়া হয়। কাতাদা ও ইবনে ইসহাক বলেন, মিরাজের রাতের পরদিন থেকে আবু বকর এ উপাধিপ্রাপ্ত হোন।

হাকিম তার মুসতাদরাক গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, মুশরিকরা আবু বকরের খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললো, আপনি কি কিছু জানেন ? আপনার বন্ধু গত রাতে বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছে গিয়েছিলো বলে দাবী করেছেন। আবু বকর বললেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি এভাবেই বলেছেন ? মুশরেকরা বললো, হ্যা। আবু বকর বললেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যদি সকাল-সন্ধ্যা দূর আসমানের সংবাদ সরবরাহ করেন, তবুও আমি তা বিশ্বাস করবো। এ কারণে তাকে সিদ্দীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ হাদিসটি আনাস (রাঃ) আর আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে তাবারানি বর্ণনা করেছেন।

মুসনাদ গ্রন্থে সাদ বিন মানসুর লিখেছেন, মিরাজের রাতে ফেরার সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘যী তোয়া’ নামক স্থানে পৌঁছে বললেন, হে জিবরাঈল, আমার সম্প্রদায় আমাকে সত্যায়িত করবে না। হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আবু বকর আপনাকে সত্যায়িত করবেন, তিনি সিদ্দীক।

তাবারানি ‘আওতাস’ গ্রন্থে আর হাকিম ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থে লিখেছেন, হযরত আলি (রাঃ) কে ইবনে উসায়ের বললেন, আবু বকর তো সেই মহান মনীষী, যার নাম আবদুল্লাহ। জিবরাঈল আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নাম রাখেন সিদ্দীক। তিনি আমাদের নামায পড়িয়েছেন আর তিনি হলেন রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খলীফা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মাধ্যমে আমাদের দ্বীনের কাজ করে নিয়েছেন, আর আমরা দুনিয়ার কাজ করে নেওয়ার জন্য তার প্রতি রাজি হয়েছি।

আবু ইয়াহইয়া থেকে দারা কুতনী আর হাকিম বর্ণনা করেন, আমি অসংখ্যবার হযরত আলি (রাঃ) কে মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ দিয়ে তার নাম সিদ্দীক রেখেছেন।

হাকিম বিন সাদ থেকে তাবারানি বর্ণনা করেন, একদিন হযরত আলি (রাঃ) কসম করে বললেন, আবু বকরের নাম আল্লাহ তাআলা আসমান থেকে নাযিল করেছেন। হাদিসে উহুদে রয়েছে, উহুদ পাহাড় নড়ে উঠলে বলা হলো – থেমে যাও, তোমার বুকে সিদ্দীক আর শহীদ রয়েছেন।

সিদ্দিকে আকবরের (আবু বকরের) মা তার পিতার চাচাতো বোন। তার নাম সালমা বিনতে সখর বিন বিন আমের বিন কাব, তার উপাধি উম্মুল খায়ের। যুহরি বলেন, এ বর্ণনাটি ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন।

 

জন্মগ্রহণ ও লালন-পালন

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মগ্রহণের দুই বছর কয়েক মাস পর আবু বকর (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তেষট্টি বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।

ইয়াযিদ বিন আসাম থেকে খলিফা বিন খাইয়াত বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে বড় – আপনি না আমি ?” আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বললেন, “বড় তো আপনি, তবে আমার বয়স বেশী।” এ মুরসাল হাদিসটি খুবই গারীব। বস্তুত, এর উল্টোটাই অধিকতর বিশুদ্ধ, ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর সমর্থক।

আবু বকর (রাঃ) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্যবসা সংক্রান্ত প্রয়োজন ছাড়া মক্কা থেকে বের হননি। নিজ গোত্রে তাকে ধনাঢ্য, ভদ্র, দয়ার্দ্র আর সম্মানিত মনে করা হতো।

ইবনুদ দাগানা বলেন, তিনি দয়াশীল ও সত্যবাদী। প্রতিবন্ধীদের সেবা করতেন, বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করতেন আর অতিথিপরায়ণ ছিলেন।

ইমাম নববি লিখেছেন, তিনি জাহেলিয়াতের যুগে কুরাইশ সর্দারদের অন্যতম ছিলেন। কুরাইশরা তার পরামর্শ গ্রহণ করতো আর খুবই শ্রদ্ধা করতো। তিনিও তাদের লেনদেনের প্রতি সচেতন ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি সর্বস্ব ইসলামের জন্য উজাড় করে দেন।

যুবাইর ইবনে বাকার আর ইবনে আসাকির লিখেছেন, কুরাইশদের এগারোজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম, যাকে ইসলাম ও জাহেলিয়াত উভয় যুগেই সম্মান করা হতো। তিনি জাহেলিয়াতের যুগে হত্যা ও অত্যাচারের বিচার করতেন। কারন কুরাইশদের কোন বাদশাহ ছিলো না, সকল কাজের দণ্ড তার হাতেই ছিলো। তবে প্রত্যেক গোত্র প্রধানদের এক একটি দায়িত্ব ছিলো। বনু হাশেম হাজীদের পান করানো আর খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করতো। অর্থাৎ, তারা ছাড়া কেউই হাজীদেরকে পানি-খাবার সরবরাহ করতো না। কেউ যদি তা দিতো, তবে বনু হাশেমদেরগুলোই সরবরাহ করতো। বনু আব্দুদ্দার পতাকা বহন আর মজলিসে শুরার দায়িত্ব পালন করতো। অর্থাৎ, তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ বাইতুল্লাহ শরীফে যেতে পারতো না। যুদ্ধের ময়দানে তার পতাকা বহন করতো। মজলিসে শুরা কাবার দারুন নাদওয়াতে বসতো আর কাবা তাদের অধীনে ছিলো।

 

জাহেলিয়াতের যুগে তার সংযম

আয়েশা (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেন, হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) জাহেলিয়াত আর ইসলাম কোন যুগেই কবিতা আবৃত্তি করেননি। তিনি আর উসমান (রাঃ) জাহেলিয়াতের যুগে মদ বর্জন করেছিলেন।

হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে আবু নুয়াইম বর্ণনা করেন, তিনি জাহেলিয়াতের যুগে মদ পান নিজের জন্য হারাম করে দিয়েছিলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেন, তিনি কখনো কবিতা আবৃত্তি করেননি।

ইবনে আসাকির বলেন, সাহাবীদেরকে মজলিসে এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কখনো ভুলেও মদ পান করেছেন ? তিনি আল্লাহ’র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন, কখনো না। এরপর তিনি আবার বললেন, মদ পান করার কারনে মর্যাদা বিনষ্ট হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সংবাদ জানার পর দুই বার বললেন, আবু বকর সত্যিই বলেছেন। এ হাদিসটি সনদ ও পাঠকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গারীব।

 

তার আকৃতি 

আয়েশা (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেন, তার চেহারার রং উজ্জ্বল ছিলো। তার অবয়বে রগ দেখা যেতো। দৃষ্টি সবসময় নিচে থাকতো। কপাল বুলন্দ ছিল। আঙ্গুলের জোড়াগুলো ফাঁকা ছিলো। তিনি মেহেদী ব্যবহার করতেন।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরতের সময় আবু বকর সিদ্দীক ছাড়া সাদা কালো মিশ্রিত দাড়ি কারো ছিলো না। এ জন্য তিনি মেহেদী ও কাসাম (লাল বর্ণের ফুলবিশেষ) দিয়ে চুলে কলব করতেন।

 

 

 

ইসলাম গ্রহণের বিবরন

আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) থেকে তিরমিযি আর ইবনে হিব্বান বর্ণনা করেন, খিলাফত সম্পর্কে বাকবিতন্ডার সময় আবু বকর (রাঃ) বলেন, খিলাফতের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশী হকদার নই কি ? আমি কি সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করিনি ? আলি (রাঃ) বলেন, সর্বপ্রথম আবু বকর সিদ্দীক ইসলাম গ্রহন করেন। এটি ইবনে আসাকির কতৃক বর্ণিত।

যায়েদ বিন আরকাম বলেন, হজরত আবু বকর (রাঃ) সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নামায পড়েছেন।

ইবনে সাদ বলেন, আবু বকর সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন।

শা’বী বলেন, আমি ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলাম, সর্বপ্রথম কে মুসলমান হয়েছে ? তিনি বললেন, আবু বকর, আর তুমি কি হাসসানের কবিতা শোননি ? (কবিতার অর্থ) তুমি যখন কোন ভালো মানুষের অবদান স্মরণ করবে, তখন আবু বকরের আবদান স্মরণ করো। তিনি জগত বিখ্যাত পরহেযগার, ন্যায়পরায়ণ ও সংযমী। নিজ প্রচেষ্টায় লোকদের পবিত্র করেছেন। তিনি আল্লাহ’র প্রতি নির্ভরশীল। হেরা গুহায় নিজ নেতার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেবাকারী। তিনি সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্যায়িত করেছিলেন। এটি তাবারানি কতৃক বর্ণিত হয়েছে।

মাইমুন বিন মিহরানকে ফুরাত বিন সায়েব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কাছে হযরত আলি না হযরত আবু বকর – কে বেশী উত্তম ? এ কথা শুনে মাইমুন রেগে গেলেন। কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমি বুঝতে পারছি না, এ মুহূর্তে জীবিত আছি কিনা। কারন এটা তো উভয়কে পরীক্ষা করার সময়। দুজনই মহান আর ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। এরপর প্রশ্ন করা হলো, কে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন, হজরত আবু বকর না হযরত আলি ? তিনি বললেন, হযরত আবু বকর (রাঃ) বুহাইরা পাদ্রীর যুগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন আর হযরত খাদিজা (রাঃ) এর বিয়ের ব্যাপারে চেষ্টা করেছেন, সে সময় হযরত আলির জন্মই হয়নি। (আবু নুয়াইম)

অনেক সাহাবা ও তাবেঈনের অভিমত হচ্ছে, হজরত আবু বকর সকল সাহাবার পূর্বে ঈমান এনেছেন। কেউ কেউ বলেন, হযরত খাদিজা সর্বপ্রথম মুসলমান হয়েছেন। উভয় অভিমতকে এভাবে সমন্বয় করা হয়েছে যে, সর্বপ্রথম মুসলমান হয়েছে পুরুষদের মধ্যে আবু বকর (রাঃ), তরুণদের মধ্যে আলি (রাঃ) আর নারীদের মধ্যে খাদিজা (রাঃ)। এ সুন্দর সমন্বয়টি সাধন করেছেন ইমাম আযম আবু হানিফা (রহঃ)।

মুহাম্মাদ বিন হানাফি (রাঃ) কে সালেম বিন জাদ জিজ্ঞেস করলেন, আবু বকর কি সর্বপ্রথম ঈমান এনেছেন ? তিনি বললেন, না। প্রশ্ন করা হলো, তবে কেন তিনি এতো প্রসিদ্ধতা লাভ করলেন ? তিনি বললেন, ইসলাম গ্রহণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল মুসলমান থেকে তিনি শ্রেষ্ঠ। এটি ইবনে আবি শাইবা (রহঃ) কর্তৃক বর্ণিত।

মুহাম্মাদ বিন সাদ তার পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, আবু বকরই কি প্রথম ঈমান এনেছেন ? তিনি বললেন, না, তবে তার ঈমান আমাদের সবার চেয়ে উত্তম ছিল। তার পূর্বে পাঁচ জনেরও বেশী ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এটি ইবনে আসাকির কর্তৃক বর্ণিত।

ইবনে কাসির (রহঃ) বলেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সর্বপ্রথম বিশ্বাস স্থাপন করেন আহলে বাইত, অর্থাৎ উম্মুল মুমিনীন খাদিজাতুল কুবরা, তার গোলাম যায়েদ, যায়েদের স্ত্রী উম্মে আইমান, আলি আর ওয়ারাকা।

আবু বকর (রাঃ) বলেন, একবার আল্লাহ’র ঘরের কাছে যায়েদ বিন আমরকে নিয়ে বসেছিলাম। এমন সময় উমাইয়া বিন আবি সালাতের আগমন ঘটলো। কুশলদী বিনিময়ের পর বললেন, তোমরা কিছু শুনেছো ? যায়েদ বললেন, না তো। তিনি কবিতা আবৃত্তি করলেন, কবিতার সারাংশ এমন – আল্লাহ’র ধর্ম ছাড়া সব ধর্মই বিলুপ্ত হবে। এরপর উমাইয়া বললেন, আমরা যে নবীর অপেক্ষা করছি, তিনি আমাদের মধ্য থেকে হবেন, নাকি তোমাদের মধ্য থেকে ? আমি এর আগে নবী সম্পর্কে কখনোই শুনিনি। এজন্য আমি ওয়ারাকা বিন নওফেলের কাছে গেলাম। তিনি আসমানি গ্রন্থসমূহের ব্যাপারে অগাধ জ্ঞান রাখতেন। তার মুখ থেকে এমন জ্ঞান সুলভ কথা বের হতো, যা সহজে বুঝে আসতো না। আমি তার কাছে বসলাম আর সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বললেন, আমি অধিকাংশ ঐশী গ্রন্থ অধ্যয়নে জেনেছি যে, সম্মানিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরবের অভিজাত বংশে জন্মগ্রহণ করবেন। তুমি তো আরবের অভিজাত বংশোদ্ভূত। সুতরাং তোমাদের বংশেই তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুভাগমন ঘটবে। আমি বললাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি শিক্ষা দিবেন ? ওয়ারকা বললেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যাচার করতে নিষেধ করবেন। সুতরাং যে সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব হয়, সাথে সাথে আমি তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যায়ন করি। এটি ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন।

মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি যখন ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, সবার অন্তরে কিছু না কিছু সন্দেহ এসেছে। কিন্তু আবু বকর সিদ্দীককে যখন আমি ইসলামের প্রতি আহবান করলাম, তখন তিনি যে কোন চিন্তা ছাড়াই ইসলাম গ্রহণ করেন।

বায়হাকি বলেছেন, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) নবুওয়তের প্রমাণপঞ্জি ইসলামের দাওয়াত প্রদানের আগেই বুঝতে পেরেছিলেন আর তা শোনামাত্র ইসলাম গ্রহণ করেন। কারন তিনি আগেই চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। চিরসত্য হলো, প্রত্যেকেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু আবু বকর সিদ্দীক জাহেলিয়াতের যুগেই সিদ্দীক ছিলেন, যেমনটি ইসলামের যুগে ছিলেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি যাকেই মুসলমান হওয়ার জন্য বলেছি, সে-ই আমার কথাকে পুনরাবৃত্তি করেছে আর দলীল চেয়েছে। কিন্তু কুহাফার পুত্রকে (আবু বকর) আমি ইসলামের গ্রহণ করতে বললে তিনি সাথে সাথে তা গ্রহণ করেন।

আবু দারদা (রাঃ) থেকে ইমাম বুখারি (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি আমার বন্ধুকে ত্যাগ করবে ? তিনি সেই ব্যক্তি। যখন আমি বললাম – আমি আল্লাহ’র রাসুল, আল্লাহ তাআলা আমাকে তোমাদের হেদায়েতের জন্য পাঠিয়েছেন; তখন তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছো, (কিন্তু) সে সময় আবু বকর আমাকে সত্যায়ন করেছে।

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য ও যুদ্ধসমূহ  

ওলামায়ে কেরামগণ বলেন, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ঈমান গ্রহণ থে কে মৃত্যু অবধি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য ছাড়েন নি। তবে হাজ্জ ও যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতিক্রমে সাহচর্য থেকে পৃথক হয়েছেন। তিনি সকল যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে উপস্থিত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হিজরত করেছেন, পরিবার পরিজন ছেড়ে গারে সাওরে থেকেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন –

ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّـهَ مَعَنَا

“তিনি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন দু’জনের মধ্যে একজন – যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি নিজের সাথীকে (অর্থাৎ, আবু বকরকে) বললেন – বিষণ্ণ হবেন না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথেই আছেন।” (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ :৪০)

ওলামায়ে কেরামগণ বলেন, যুদ্ধের ময়দানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ত্যাগ করে, বিশেষত উহুদ ও হুনায়নের যুদ্ধে যখন সকলেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ত্যাগ করে  পালিয়েছিলেন, এ সময়ও তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথেই ছিলেন।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, বদর যুদ্ধে ফেরেশতারা পরস্পরে বলাবলি করছিলো যে, ওই দেখো, হযরত আবু বকর ছাউনির নিচে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। (ইবনে আসাকির)

হযরত আলি (রাঃ) থেকে আবু ইয়ালা, হাকিম ও আহমাদ বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে আর আবু বকর (রাঃ) কে বললেন, তোমাদের দুজনের মধ্যে একজনের সাহায্য জিবরাঈল (আঃ), অপরজনের সাহায্য মিকাইল (আঃ) করছেন।

ইবনে আসাকির বলেন, আব্দুর রহমান বিন আবু বকর (রাঃ) মুশরিকদের সাথে বদর যুদ্ধে গিয়েছিলেন। মুসলমান হওয়ার পর আব্দুর রহমান তার পিতাকে বললেন, বদর যুদ্ধে কয়েকবার আপনি আমার তীরের আওতায় পড়েছিলেন, কিন্তু আমি নিজের হাত গুটিয়ে নিয়েছি। আবু বকর (রাঃ) বললেন, যদি তুমি আমার নিশানার মধ্যে এসে যেতে, তবে আমি কখনোই ছাড়তাম না।

 

বীরত্ব

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সব সাহাবীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বাহাদুর ছিলেন। হযরত আলি (রাঃ) একদিন বললেন, হে লোকসকল, আমাকে বলুন তো, কোন ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ বীর ? লোকেরা বললো, আপনি। তিনি বললেন, আমি সবসময় নিজের শক্তি দিয়ে লড়াই করেছি, এটি কোন বীরত্ব নয়। আপনারা সর্বশ্রেষ্ঠ বীরের কথা বলুন। লোকেরা বললো, আমাদের জানা নেই। হযরত আলি (রাঃ) বললেন, সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হলেন হযরত  আবু বকর (রাঃ)। বদর যুদ্ধে আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ছাউনি তৈরি করেছিলাম। আমরা পরামর্শ করলাম যে, সেখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিরাপত্তার জন্য কে থাকবে। আল্লাহ’র কসম, আমাদের কারো সাহস হয়নি। কিন্তু আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন আর কাউকে সেখানে ভিড়তে দেননি। যদি কেউ তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে তো তিনি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তাই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বীর।

আলি (রাঃ) বলেছেন, একদিন মক্কার মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে টানাহেঁচড়া করছিলো আর বলছিলো, তুমিই এক ইলাহের (ব্যাপারে) দাবী করছো ? আল্লাহ’র কসম! কারো সাহস ছিলো না যে, এ অবস্থায় সে মুশরিকদের মোকাবিলা করবে। কিন্তু আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) মুশরিকদের মেরে ছত্রভঙ্গ করেন আর ধাক্কা দিয়ে ফেলে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যান আর বলতে থাকেন, আফসোস, শত আফসোস, তোমরা এমন ব্যক্তিকে হত্যা করতে চেয়েছিলে, যিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন – আমার প্রতিপালক এক ও অদ্বিতীয়। এ পর্যন্ত বলে আলি (রাঃ) চাদর উঠিয়ে কাঁদতে লাগলেন আর তার দাড়ি ভিজে গেলো। এরপর তিনি বললেন, বলো, ফেরাউনের যুগের মুমিন শ্রেষ্ঠ, না আবু বকর ? লোকদের নীরব থাকতে দেখে তিনি নিজেই বললেন, তোমরা কেন উত্তর দিলে না ? আল্লাহ’র কসম, আবু বকরের এক মুহূর্ত তাদের হাজার ঘণ্টা থেকেও উত্তম। কারন তারা নিজেদের ঈমান গোপন করে রেখেছিলো, আর আবু বকর (রাঃ) নিজের ঈমানের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন। (বাযযার)

উরওয়া বিন যুবাইর বলেছেন, আমি আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আসকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট কিভাবে দেওয়া হয়েছিলো ? তিনি বললেন, আমি দেখলাম যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযরত অবস্থায় উকবা পিছন থেকে এসে গলায় চাদর পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে। এমন সময় আবু বকর (রাঃ) সেখানে এসে উকবাকে সরিয়ে দেন আর বলেন, তোমরা এমন ব্যক্তিকে হত্যা করতে চাও, যিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ও অদ্বিতীয় প্রভুর আওয়াজ তুলেছেন। বস্তুত, তিনি আল্লাহ’র কাছ থেকে দলীলসহ প্রেরিত হয়েছেন। (বুখারি)

ইবনে তালিব বলেছেন যে, আবু বকর (রাঃ) বলেছেন, উহুদ যুদ্ধে সবাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ছেড়ে পালিয়ে গেলে আমি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ছিলাম। সে সংকটময় পরিস্থিতিতে যিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেফাজত করার জন্য এগিয়ে আসেন, তিনি হলেন আয়েশা (রাঃ)।

আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আটত্রিশ জন লোক ইসলাম গ্রহণ করলে আবু বকর (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেকে বললেন, আপনি ইসলামের প্রকাশ্য ঘোষণা দিন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমাদের দল এখনো যথেষ্ট ছোট। আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বারবার একই কথা বলতে থাকেন। অবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য দ্বীনের প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। ফলে লোকেরা মসজিদের চারদিকে গোত্র-গোত্রভাবে এলোমেলো হয়ে যায়। আবু বকর (রাঃ) দাঁড়িয়ে খুৎবা দেন আর লোকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন। মুশরিকরা তাকে আক্রমণ করে আর এজন্য লোকদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। (ইবনে আসাকির)

আলি (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, যখন আবু বকর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন, তখনই তিনি ইসলামকে প্রকাশ করে দিয়েছেন আর লোকদেরকে আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আহবান করেছেন।

 

দানশীলতা

সকল সাহাবার মধ্য থেকে সবচেয়ে বেশী দানশীল হলেন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। আল্লাহ তাআলা বলেন –

وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى ﴿١٧﴾ الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّىٰ ﴿١٨﴾

“যে (আল্লাহকে) বেশী বেশী ভয় করে তাকে আমি (এ থেকে) বাঁচিয়ে দিবো, যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য (আল্লাহ’র পথে অর্থ-সম্পদ) ব্যয় করেছে।” (সূরাহ আল-লাইল, ৯২ :১৭-১৮)

ওলামায়ে কেরাম একমত যে, এ আয়াত তার শানে নাযিল হয়েছে । (ইবনে জাওযী)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আবু বকরের সম্পদ আমার যতটুকু উপকার করেছে, আর কারো সম্পদ ততটুকু করেনি। আবু বকর (রাঃ) খুবই বিনয়ের সাথে বলেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি আর আমার সব সম্পদ আপনার। এটি আহমাদ বর্ণনা করেছেন।

আয়েশা (রাঃ) এর অপর হাদিসটি এমনই। তবে সে হাদিসে এতটুকু বৃদ্ধি করা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের সম্পদের মতো নিজ সম্পদ মনে করে আবু বকরের সম্পদ খরচ করেছেন। (খতীব)

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ইসলাম গ্রহণের সময় আবু বকরের কাছে চল্লিশ হাজার দিরহাম বা দিনার ছিলো। তিনি এগুলো সম্পূর্ণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ব্যয় করেছেন। (ইবনে আসাকির)

ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেন, ইসলাম গ্রহণের সময় আবু বকরের কাছে চল্লিশ হাজার দিরহাম ছিলো। আর হিজরতের সময় পাঁচ হাজারের বেশী ছিলো না। বাকি অর্থ তিনি ইসলামের সাহায্য আর মুসলমান গোলাম কিনে আযাদ করার পিছে ব্যয় করেছেন। (ইবনে সাইদ)

আয়েশা (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, আবু বকর (রাঃ) এমন সাতজন গোলামকে কিনে আযাদ করে দিয়েছেন, যাদের মালিক তাদের উপর অত্যাচার করতো।

ইবনে উমর বলেছেন, একদিন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত ছিলাম। আবু বকর (রাঃ) জুব্বা পড়ে দরবারে এলেন – যে জুব্বায় বোতামের পরিবর্তে কাঁটা ব্যবহার করা হয়েছিলো। এমন সময় জিবরাঈল (আঃ) এসে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবু বকর সিদ্দীক কাঁটা জড়ানো জুব্বা পড়ে এসেছেন, আজ এ ব্যতিক্রম কেন ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে জিবরাঈল, মক্কা বিজয়ের আগে আমার জন্য তার সকল সম্পদ ব্যয় করে দিয়েছেন। জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আল্লাহ তাআলা আবু বকরকে সালাম জানিয়েছেন আর বলেছেন, হে আবু বকর, আমার জন্য যে দারিদ্রতা গ্রহণ করেছো, এতে কি তুমি সন্তুষ্ট ? আবু বকর (রাঃ) বললেন, আমি আমার প্রতিপালকের উপর সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট। এটি ইবনে আসাকির প্রমুখ বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসের সনদ খুবই দুর্বল। এ ধরণের দুর্বল বর্ণনা অনেক রয়েছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে এক বর্ণনায় আছে, জিবরাঈল (আঃ) কাঁটাযুক্ত জুব্বা পড়ে নাযিল হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে জিবরাঈল, এটা কেমন রীতি ? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে আবু বকরের মতো পোশাক পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বর্ণনাটিও খুব দুর্বল, যদিও তা অনেক লোক বর্ণনা করেছেন। তবে এ ধরণের বর্ণনাকে পরিহার করে চলাই উত্তম। এটি খতীব বর্ণনা করেছেন।

উমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন, একদিন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনলাম, আমি কিছু মাল গ্রহণ করবো। উমর (রাঃ) বলেন, এটা শুনে আমি পূর্ণ অভিপ্রায় গ্রহণ করলাম যে, আবু বকরের চেয়ে আমি এবার বেশী সদকা করবো। এ জন্য আমার ধনসম্পদের অর্ধেকাংশ নিয়ে হাজির হলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পরিবারের জন্য কতটুকু রেখে এসেছো? আমি বললাম, যতটুকু এনেছি। এমন সময় আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) তার সমস্ত সম্পদ নিয়ে হাযির হলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, নিজ পরিবারের জন্য কি রেখে এসেছো ? তিনি বললেন, তাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসুলই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যথেষ্ট। আমি তখন বুঝলাম যে, আমি তার সমকক্ষ নই। (আবু দাউদ ও তিরমিযি কর্তৃক বর্ণিত)

হাসান বসরী (রহঃ) বলেছেন, একবার আবু বকর (রাঃ) সদকার মাল নিয়ে এসে তার পরিমাণ গোপন রেখে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), এগুলো আমার সদকা। আল্লাহ’র কসম, আপনার প্রতিপালক আমার সাহায্যের জন্য যথেষ্ট। আর উমর (রাঃ) সদকার মাল এনে তার পরিমাণ প্রকাশ করে বলতে লাগলেন, আপনার রবের সাহায্যই যথেষ্ট। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের দুই জনের সদকার মধ্যে পার্থক্য এতটুকু, যতটুকু পার্থক্য উভয়ের কথার মধ্যে। আবু নুয়াইম এটি বর্ণনা করেন, এর সনদ সুন্দর।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার উপর কারো অনুগ্রহ নেই, সকলের উপকারের প্রতিদান দিয়েছি। কিন্তু আবু বকরের দয়ার প্রতিদান এখনো বাকি রয়ে গেছে। তার অনুগ্রহ এতোই বিশাল যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা এর প্রতিদান দিবেন। কোন সম্পদ আমাকে ততটুকু লাভবান করতে পারেনি, যতটুকু আবু বকরের সম্পদ করেছে। (তিরমিযি)

আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেছেন, একদিন আমার পিতাকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ নবী করীম আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি বৃদ্ধকে কষ্ট দিয়ে কেন নিয়ে এলে ? আমি যেতাম। আমি বললাম, আপনাকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে তার আসাটাই শ্রেয়। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমার প্রতি তোমার যে অনুগ্রহ, তাতে তোমার পিতাকে কষ্ট দেওয়া আমার জন্য সহনযোগ্য নয়। (বাযযার)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার প্রতি আবু বকরের চেয়ে বেশী অনুগ্রহ কারো নেই। তিনি নিজের জীবন দিয়ে আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, সম্পদ দিয়ে সাহায্য করেছেন আর নিজের মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছেন।

 

ইলম (জ্ঞান)

আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম (জ্ঞানী) আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। ইমাম নববি তাহযিব গ্রন্থে লিখেছেন, ওলামায়ে কেরাম হযরত আবু বকরের বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডারের উপর ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিমের একটি হাদিস দিয়ে প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। আবু বকর (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহ’র কসম, কেউ যদি নামায ও রোযার মধ্যে সামান্যতমও তারতম্য করে, তবে আমি তার সাথে লড়াই করবো। তারা আমাকে দুর্বল ভেবেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে তারা যতটুকু যাকাত আদায় করেছে, যদি তারা এর চেয়ে তিল পরিমাণ কম করে, আমি তাদের মোকাবেলা করবো।

শায়খ আবু ইসহাক এ হাদিস দিয়ে দলীল দেন যে, আবু বকর (রাঃ) সর্বাধিক জ্ঞানী আর সবচেয়ে বড় আলেম। কারন সাহাবায়ে কেরাম যখন এ মাসআলা নিয়ে বিব্রত হয়েছিলেন, তখন মাসআলাটি আবু বকর (রাঃ) এর খেদমতে এ মর্মে পাঠানো হয় যে, আপনার অভিমতটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে পরিশুদ্ধ হিসেবে সাহাবাগণ গ্রহণ করবেন।

ইবনে উমরকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে কে ফতোয়া দিতেন ? তিনি বললেন, আবু বকর (রাঃ) আর উমর (রাঃ) এর চেয়ে বড় আলেম আর কেউ ছিলেন না।

আবু সাইদ খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, খুৎবার মধ্যে বললেন, আল্লাহ তাআলা তার এক নেককার বান্দাকে দুনিয়া বা আখিরাত উভয়ের যে কোন একটি গ্রহণের অধিকার দিয়েছেন। আর সেই বান্দা আখিরাতকে পছন্দ করেছেন। এটা শুনে আবু বকর (রাঃ) কাঁদতে লাগলেন আর বললেন, আমার পিতামাতা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি কুরবান হোক। আমরা তার কান্নায় আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কারন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দৃশ্যত এক ব্যক্তির কথা বলেছেন। আর সেই এক ব্যক্তি যে স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তা আমরা কেউ বুঝতে পারিনি, কিন্তু আবু বকরের জ্ঞান ভাণ্ডারে তা ধরা পড়েছে। এ কারনে তিনি সবচেয়ে বড় আলেম ও জ্ঞানী। (বুখারি, মুসলিম)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীদের মধ্যে আবু বকরের সম্পদ আর সাহচর্য আমার উপর সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহ করেছে। যদি আল্লাহ ছাড়া আমি কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করি, তবে তিনি আবু বকর। ইসলামের প্রতি তার সত্যিকারের ভালোবাসার কথা সবসময় আমার অন্তরে বিদ্যমান থাকবে। (নববি)

ইবনে কাসির (রহঃ) বলেন, আল্লাহ’র কালাম সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল সবচেয়ে বেশী। কারন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নামাযের জন্য সাহাবীদের ইমাম বানিয়েছিলেন। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো নিজেই বলেছেন, জাতির ইমাম সে-ই হবে, যার জ্ঞান ভাণ্ডার কুরআনের জ্ঞানে সবচেয়ে বেশী সমৃদ্ধ। অধিকন্তু, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, যে সম্প্রদায়ে আবু বকর রয়েছে, সেখানে তিনি ছাড়া কেউ ইমাম হতে পারবে না। এ হাদিসটি তিরমিযি বর্ণনা করেছেন।

একইভাবে, হাদিসের উপরও তার বিরাট দখল ছিল। সাহাবাগণ হাদিস সম্পর্কে অধিকাংশ বিষয়ে তার মুখাপেক্ষী থাকতেন। সবসময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস তার সামনে পেশ করা হতো। কারন তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস ভাণ্ডার মনে রাখতেন আর জরুরী মুহূর্তে বিষয়াদি তার সমীপেই উপস্থাপন করা হতো। তিনি সর্বাধিক হাদিসের হাফেজ ছিলেন। কারন রিসালাতের ঊষালগ্ন থেকে মৃত্যু অবধি তিনি সবসময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে থাকতেন। তার মুখস্ত শক্তি ছিল খুবই প্রখর। তিনি ছিলেন জ্ঞানবান ও ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি।

আবু বকর (রাঃ) থেকে খুবই কম সংখ্যক হাদিস বর্ণিত হয়েছে – এ কথাটি বেদনাদায়ক, আর এটা বিস্ময়ের জন্ম দেয়। কম হাদিস বর্ণনা করার কারন হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর তিনি খুব সামান্য ক’দিন বেঁচেছেন। যদি লম্বা সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতেন, তবে তার বর্ণনা সকল সাহাবার চেয়ে বেশী হতো আর আবু বকরের সনদ ছাড়া কোন হাদিস পাওয়া যেতো না। হাদিস বর্ণনা করার ক্ষেত্রে আবু বকরের জন্য অন্য সাহাবীর সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন হতো না। এ জন্য যে, তিনি সবসময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে থাকতেন আর হাদিস শুনতেন। সুতরাং তিনি নিজেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদিস বর্ণনা করতেন। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, আবু বকর (রাঃ) অন্য সাহাবীর থেকে কিছু হাদিস বর্ণনা করেছেন, এটা কেন ? তিনি নিজে যা শোনেননি, তা শুনে নিয়ে বর্ণনা করেছেন।

মাইমুন বিন মেহরান (রহঃ) বলেছেন, আবু বকরের কাছে কোন বিচার আসলে এ সংক্রান্ত মাসআলা কুরআন শরীফে অনুসন্ধান করতেন আর কুরআন শরীফের নির্দেশিত পথে ফয়সালা করতেন। যদি কুরআন শরীফে সমাধান না পেতেন, তবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস অনুযায়ী ফয়সালা করতেন। যদি এ সংক্রান্ত কোন হাদিস তার মনে না থাকতো, তবে বাইরে এসে লোকদের জিজ্ঞেস করতেন, আমার কাছে এ ধরণের বিচার এসেছে, আপনাদের মধ্যে কেউ কি জানেন এ ধরণের বিচারের প্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি সমাধান দিয়েছেন ? তার কাছে সব সাহাবী একত্রিত হতেন আর যদি কেউ এ সংক্রান্ত হাদিস বর্ণনা করতেন, তবে এ অনুযায়ী তিনি ফয়সালা করতেন আর খুশী হয়ে আল্লাহ’র শোকর আদায় করতেন – আলহামদুলিল্লাহ্‌, আমাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছেন, যিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস মনে রেখেছেন। যদি হাদিসেও সমাধান পাওয়া না যেতো, তবে তিনি বড় বড় সাহাবীদের একত্রিত করে পরামর্শ করতেন, অধিকাংশ অভিমতের উপর তিনি ফয়সালা দিতেন। উমর ফারুক (রাঃ) ও সেটাই করতেন।

আবু বকর (রাঃ) আরবের সাধারণ ও কুরাইশদের বিশেষ বংশ পরম্পরা সম্পর্কে দারুণভাবে জানতেন। আরব ও কুরাইশ বংশ পরম্পরা বিশেষজ্ঞ জুবায়ের বিন মুতঈম (রহঃ) বলেন, আমি বংশ পরম্পরার জ্ঞান আবু বকর (রাঃ) এর কাছ থেকেই নিয়েছি। তিনি আরবের এক বিশিষ্ট বংশ পরম্পরা বর্ণনাকারী। তার স্বপ্নের ব্যাখ্যাজ্ঞান ছিল অগাধ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতেন। মুহাম্মাদ বিন সিরিন (রহঃ) স্বপ্নের একজন বিশিষ্ট ব্যাখ্যাকার। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আবু বকর (রাঃ) সবচেয়ে বড় ব্যাখ্যাকারক।

সামুরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে আবু বকর সিদ্দিকের কাছ থেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (দাইলামি)

ইবনে কাসির (রহঃ) বলেছেন, আবু বকর (রাঃ) সবচেয়ে বেশী বাকপটু ও বাগ্মী ছিলেন। তিনি খুব সুন্দর করে বক্তৃতা দিতে পারতেন। যুবাইর বিন বাকার বলেন, আমি ওলামাদের কাছ থেকে শুনেছি যে, সবচেয়ে বড় বাগ্মী ছিলেন আবু বকর (রাঃ) আর আলি (রাঃ)। তিনি আল্লাহ্‌কে সবচেয়ে বেশী ভয় করতেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আল্লাহ’র ভয় আর বাগ্মীতা পৃথক পৃথক অধ্যায়ে বর্ণনা করা হবে।

সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম হওয়ার ক্ষেত্রে সুলেহ হুদায়বিয়ার হাদিস দিয়ে দলীল পেশ করা হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধির ব্যাপারে উমর (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম) তার জবাবও দেন। এরপর উমর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ) এর কাছে গিয়ে একই প্রশ্ন করেন। আবু বকর (রাঃ) হুবহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তরগুলো আবার প্রদান করেন। (বুখারি) এজন্য তাকে সর্বোত্তম জ্ঞানী বলা হয়।

ইবনে আস প্রমুখ বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জিবরাঈল আমাকে বলেছেন, আল্লাহ তাআলার হুকুম – আমি যেন আবু বকরের সাথে পরামর্শ করি। (তামামুর রাযী)

মাআয বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, আমাকে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় মজলিসে শুরা গঠন করা হয়। এতে আবু বকর, উমর, উসমান, আলী, তালহা, যুবাইর, উসাইদ বিন হাযীর উপস্থিত ছিলেন। সকলেই নিজ নিজ মতামত পেশ করেন। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার মত জানতে চাইলে আবু বকরের অনুরূপ মত ব্যক্ত করলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আবু বকর ভুল করুক – এটা আল্লাহ তাআলা চান না। হাদিসটি তাবারানি বর্ণনা করেছেন। ইবনে উসামার বক্তব্য এ ধরণের – আসমানে আল্লাহ’র অভিপ্রায় এটা নয় যে, জমিনে আবু বকর ভুল করবে। এটিও তাবারানি বর্ণনা করেছেন, এর বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

ইমাম নববি বলেন, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সাহাবীদের মধ্যে অনন্য হাফেজে কুরআন ছিলেন। আনাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আনসারদের চার সাহাবী কুরআনকে একত্রিত করেছেন। আবু দাউদ শাবী বলেন, আবু বকরের মৃত্যু পর্যন্ত সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ জমা হয়নি – এ কথাটি পরিত্যাজ্য; অথবা কথাটিকে এভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে – উসমান (রাঃ) যে পদ্ধতিতে কুরআনকে সন্নিবেশিত করেছেন, সেভাবে জমা করা হয়েছিলো না।

 

তিনি সকল সাহাবা থেকে উত্তম

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সকল ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে একমত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সব উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলেন আবু বকর (রাঃ), এরপর উমর (রাঃ), এরপর উসমান (রাঃ), এরপর আলি (রাঃ), এরপর আশরায়ে মুবাশশারা, এরপর আহলে বদর, এরপর আহলে উহুদ, এরপর আহলে বাইত, এরপর সকল সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

আবুল মনসুর বাগদাদী একটি ইজমা বর্ণনা করেছেন। ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেন, আমরা পরস্পরে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) কে সাহাবীদের মধ্যে সর্বোত্তম হিসেবে গণ্য করেছি, এরপর উমর (রাঃ) কে, এরপর উসমান (রাঃ) কে। এ হাদিসটির শেষে তাবারানী এতটুকু বৃদ্ধি করেছেন যে, এ কথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুনার পরও তা অপছন্দ করেননি।

ইবনে উমর থেকে ইমাম বুখারি বর্ণনা করেন, আমাদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থাকা অবস্থায় আমরা সাহাবীদের মধ্যে আবু বকরকে সর্বোত্তম মনে করতাম। এরপর উমর (রাঃ) কে, এরপর উসমান (রাঃ) কে, এরপর আলী (রাঃ) কে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন, আমরা অসংখ্য সাহাবী পরস্পরের মধ্যে এ কথা বলতাম যে, এ উম্মতের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সর্বোত্তম ব্যক্তি হলেন আবু বকর, এরপর উমর, এরপর উসমান; এরপর আমরা নীরব হতে যেতাম। (ইবনে আসাকির)

জাবের বিন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার উমর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ) কে “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর লোকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি” বলে সম্বোধন করেন। আবু বকর তাকে বললেন, আপনি নিজেকে বাদ দিলেন কেন ? আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, উমর থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির উপর সূর্য কখনো উদিত হয় না। (তিরমিযি)

মুহাম্মদ বিন আলি বিন আবু তালিব (রাঃ) বলেছেন, আমি আমার পিতা হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কে সর্বোত্তম ? তিনি বললেন, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। আমি বললাম, তারপর ? তিনি বললেন, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। আমি বললাম, তারপর ? তিনি বললেন, উমর (রাঃ)। এরপর উসমান (রাঃ) এর নাম নিতে গিয়ে তিনি ভয় করলেন। এরপর বলা হলো, তারপর আপনিই কি সর্বোত্তম ? তিনি বললেন, আমি আবার এমন কি ? আমি একজন সাধারণ মুসলমান। (বুখারি)

আহমদ (রহঃ) বলেন, আলী (রাঃ) এর কয়েকটি মুতাওয়াতির হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, এ উম্মতের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আবু বকর হলেন সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ। রাফেযীদের উপর আল্লাহ’র অভিশাপ অবতীর্ণ হোক, তারা নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকারে ফেঁসে গেছে।

উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) বলেন, আবু বকর আমাদের নেতা, তিনি সর্বোত্তম ব্যক্তি। তিনি আমাদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন। (তিরমিযি)

একবার উমর (রাঃ) মিম্বরে উঠে বললেন, এ উম্মতের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আবু বকর (রাঃ)। যে ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে অপবাদ দিবে, তার অপবাদকারীর গুনাহ হবে। (ইবনে আসাকির)

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আর উমর ফারুক (রাঃ) থেকে আমাকে যে প্রাধান্য দিবে, আমি তাকে আশিটি চাবুকাঘাত করবো। (ইবনে আসাকির)

আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নবী ছাড়া কোন ব্যক্তি এমন নেই, যার উপর সূর্য উদিত ও অস্ত যায় এবং তিনি আবু বকর থেকে উত্তম।

এক বর্ণনায় আছে, নবী ও রাসূলদের পর আবু বকরের চেয়ে উত্তম আর কেউ নেই।

জাবের (রাঃ) এর হাদিস, কারো উপর সূর্য উদিত হয় না যে, আবু বকর থেকে শ্রেষ্ঠ হয়। (তাবারানী) এ বর্ণনাটি বিশুদ্ধ বলে বিবেচিত। ইবনে কাসির সে দিকেই ইশারা করেছেন।

সালমা বিন আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নবীর পর লোকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আবু বকর।

সাদ বিন যেরারাহ বলেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জিবরাঈল আমাকে এ সংবাদ জানিয়েছেন যে, আমার উম্মতের মধ্যে আমার পর সর্বোত্তম ব্যক্তি হলেন আবু বকর। (তাবারানী)

আমর বিন আস (রাঃ) বলেছেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, লোকদের মধ্যে আপনার প্রিয়তম ব্যক্তি কে ? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আয়েশা সিদ্দিকা। আমি বললাম, পুরুষদের মধ্যে ? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তার পিতা আবু বকর। আমি বললাম, তারপর ? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, উমর। (বুখারী, মুসলিম) ইমাম তিরমিযী বলেন, এক বর্ণনায় উমরের নাম নেই।

আবদুল্লাহ বিন শাকিক থেকে হাকিম বর্ণনা করেন, আমি আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে প্রিয় কে ? তিনি বললেন, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। আমি বললাম, তারপর ? তিনি বললেন, আবু উবায়দা বিন জাররাহ (রাঃ)।

আনাস (রাঃ) বলেছেন, আবু বকর (রাঃ) আর উমর (রাঃ) এর শানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তার দু’জনে পয়গম্বরগণ ছাড়া জান্নাতে সকল মানুষদের সর্দার হবেন। আলি (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে উমার (রাঃ), আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) আর জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকেও অনুরূপ অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

আম্মার বিন ইয়াসার (রাঃ) বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি আবু বকর (রাঃ) আর উমর (রাঃ) এর উপর সাহাবীদের মধ্য থেকে কাউকে প্রাধান্য দেয়, তাহলে সে যেন আনসার আর মুহাজিরদের প্রতি অত্যাচার করলো আর অপবাদ দিলো। (তাবারানী)

যুহরি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসসান বিন সাবিতকে বললেন, তুমি আবু বকরের শানে কোন কবিতা রচনা করো নি ? তিনি বললেন, করেছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আবৃত্তি করে শোনাও, আমি শুনবো। তিনি আবৃত্তি করলেন (যার অর্থ) – “আবু বকর তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুহার সাথী। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন পর্বত শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন, তখন শত্রুরা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারদিকে ঘুরছিল। পৃথিবীর যতো প্রেম ভালোবাসা, তিনি নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি নিবেদন করেছেন। পৃথিবীতে আর কেউ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতটুকু ভালোবাসেননি।” এ কবিতা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসলেন আর বললেন, হাসসান, তুমি সত্যিই বলেছো। তিনি এমনটাই। (ইবনে সাদ)

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বড় মেহেরবান আবু বকর, সবচেয়ে বেশী কঠোর উমর, খুবই লজ্জাশীল উসমান, সবচেয়ে বেশী হালাল হারাম সম্পর্কে অবগত মুআয বিন জাবাল, উত্তরাধিকার আইনবেত্তা যায়েদ বিন সাবিত, সবচেয়ে বড় ক্বারি উবাই বিন কাব; সকল উম্মতে একজন বিশ্বাসী লোক থাকেন, আমার উম্মতের বিশ্বাসী ব্যক্তি আবু উবায়দা বিন জাররাহ। (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী)

এ হাদিসটি ইবনে উমর এতটুকু বৃদ্ধি করেছেন, সর্বোত্তম বিচারক আলী। (আবু ইয়ালা) শাদ্দাদ বিন আউস এতটুকু বৃদ্ধি করেছেন, সর্বাধিক ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি আবু যর। সবচেয়ে বেশী ইবাদতকারী ও মুত্তাকী আবুদ দারদা, আর সবচেয়ে বেশী সহনশীল ও ধৈর্যশীল মুয়াবিয়া। (দাইলামী)

 

কুরআনের আয়াত দিয়ে আবু বকর (রাঃ) এর প্রশংসা ও সত্যায়নের বিবরণ

আমি এ বিষয়ে কয়েকটি পুস্তক রচনা করেছি আর একটি প্রণিধানযোগ্য গ্রন্থও লিখেছি। সেই পদ্ধতি অনুসারে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন –

ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّـهَ مَعَنَا ۖ فَأَنزَلَ اللَّـهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ

“তিনি (রাসুলুল্লাহ) ছিলেন দু’জনের মধ্যে একজন – যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি নিজের সাথীকে (অর্থাৎ, আবু বকরকে) বললেন – বিষণ্ণ হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথেই আছেন। এরপর আল্লাহ তার উপর তার প্রশান্তি নাযিল (করে তাকে সাহায্য) করলেন …” (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ :৪০)

মুসলিম জাতি এ বিষয়ে একমত যে, উল্লেখিত আয়াতে   صَاحِبِ  (সাহিব) শব্দের উদ্দেশ্য আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। এ ব্যাপারে স্বয়ং আবু বকর (রাঃ) এর বিবরণ শীঘ্রই আসছে।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, হিজরতের সফরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভরসা হারাননি। সুতরাং صَاحِبِ শব্দ দিয়ে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) কে বুঝানো হয়েছে। (ইবনে আবি হাতেম)

ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে ইবনে আবি হাতেম বর্ণনা করেছেন, যখন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) উমাইয়া বিন খালফের কাছ থেকে বিলাল (রাঃ) কে একটি চাদর ও চারশত দিরহামের বিনিময়ে কিনে মুক্ত করে দেন, তখন আবু বকরের শানে আর উমাইয়ার ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয় –

وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَىٰ ﴿١﴾ وَالنَّهَارِ إِذَا تَجَلَّىٰ ﴿٢﴾ وَمَا خَلَقَ الذَّكَرَ وَالْأُنثَىٰ ﴿٣﴾ إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّىٰ ﴿٤﴾

“রাতের শপথ, যখন তা (আঁধারে) ঢেকে যায়; দিনের শপথ, যখন তা (আলোয়) উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো; পুরুষ ও নারী যা তিনি সৃষ্টি করেছেন (তারও শপথ); অবশ্যই তোমাদের চেষ্টা-সাধনা (হবে) নানামুখী।” (সূরাহ আল-লাইল, ৯২ :১-৪)

আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) বলেছেন, মক্কী জীবনে আবু বকর (রাঃ) এর নীতি ছিল – যখন কোন দুর্বল ও বৃদ্ধা নারী ইসলাম গ্রহণ করতেন, তখন তিনি তাদেরকে কিনে আযাদ করে দিতেন। একদিন তার পিতা বললেন, হে আমার বৎস, আমি দেখেছি তুমি দুর্বল লোকদের কিনে আযাদ করে দিচ্ছো। এর পরিবর্তে যদি শক্তিশালী ও তরুণদের কিনে আযাদ করে দিতে, তবে তারা বিপদের দিনে তোমার সাহায্য করতে পারতো। তিনি বললেন, বাবা, আমার উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলার স্বীকৃতি আর সন্তুষ্টি অর্জন, দুনিয়ায় লাভবান হওয়া আমার কামনা না। এ ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয় –

فَأَمَّا مَنْ أَعْطَىٰ وَاتَّقَىٰ ﴿٥﴾

“অতএব যে (আল্লাহ’র পথে) দান করেছে আর আল্লাহ্‌কে ভয় করেছে” (সূরাহ আল-লাইল, ৯২ :৫)

ইবনে জারির এটি বর্ণনা করেছেন।

উরওয়া বর্ণনা করেন, মুসলমান হওয়ার পর যে সাতজন ব্যক্তির উপর অকথ্য নির্যাতনের রোলার চালানো হয়, তাদেরকে কিনে আযাদ করে দেওয়ার প্রেক্ষিতে তার ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয় –

وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى ﴿١٧﴾ الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّىٰ ﴿١٨﴾

“যে (আল্লাহ্‌কে) বেশী বেশী ভয় করে, তাকে আমি (এ থেকে) বাঁচিয়ে দেবো, যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য (আল্লাহ’র পথে অর্থ সম্পদ) ব্যয় করেছে ” (সূরাহ আল-লাইল, ৯২ :১৭-১৮)

তাবারানী এটি বর্ণনা করেছে।

আবদুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ) বলেছেন, এ আয়াতটি আবু বকরের ব্যাপারে নাযিল হয় –

وَمَا لِأَحَدٍ عِندَهُ مِن نِّعْمَةٍ تُجْزَىٰ ﴿١٩﴾

“(অথচ) তোমাদের কারোই তার কাছে এমন কিছু ছিলো না, (যার জন্য) তোমাদের কোন রকম প্রতিদান দেওয়া হবে।” (সূরাহ আল-লাইল, ৯২ :১৯)

বাযযার এটি বর্ণনা করেছেন।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, কসমের কাফফারা নাযিল না হওয়া পর্যন্ত আবু বকর (রাঃ) কসম ভাঙ্গেন নি। (বুখারী)

আলী (রাঃ) বলেন, وَالَّذِي جَاءَ بِالْحَقِّ দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। আর وَصَدَّقَ بِهِ দিয়ে আবু বকর (রাঃ) উদ্দেশ্য। ইবনে আসাকির বলেন, আলি (রাঃ) এর কেরাত وَالَّذِي جَاءَ بِالْحَقِّ আর ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন – وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ – আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ) এর ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। (হাকিম)

ইবনে শাওজিব থেকে ইবনে হাতেম বর্ণনা করেন, এ আয়াতটি আবু বকর (রাঃ) এর শানে নাযিল হয়েছে –

وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ

“যে ব্যক্তি তার রবের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্য রয়েছে দুটো উদ্যান।” (সূরাহ আর-রহমান, ৫৫ :৪৬)

আমার (অর্থাৎ, ইমাম জালালুদ্দিন সুয়্যুতির) আসবাবে নুযুল গ্রন্থে এ হাদিসের সম্পূর্ণ সনদ বর্ণনা করেছি।

ইবনে উমর (রাঃ) এর ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, صَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ দিয়ে উমর ফারুক (রাঃ) আর আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) উদ্দেশ্য। (তাবারানী, আওসাত)

মুজাহিদ বর্ণনা করেন, إِنَّ اللَّـهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ – এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর আবু বকর (রাঃ) আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমাকে সম্পৃক্ত না করে আল্লাহ আপনার জন্য কোন আয়াত নাযিল করেননি, শুধু এ আয়াত ছাড়া। এ প্রেক্ষিতে নাযিল হয় –

هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ

“তিনিই (মহান আল্লাহ, যিনি) তোমাদের উপর অনুগ্রহ (বর্ষণ) করেন, আর তার ফেরেশতারাও (তোমাদের জন্য আল্লাহ’র কাছে ক্ষমা চেয়ে তোমাদের উপর অনুগ্রহ করেন) …” (সূরাহ আল-আহযাব, ৩৩ :৪৩)

ইমাম যাইনুল আবেদীন বিন আলী বিন হুসাইন থেকে ইবনে আসাকির নকল করেছেন, আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ) ও আলি (রাঃ) এর শানে এ আয়াত নাযিল হয় –

وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِم مِّنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَىٰ سُرُرٍ مُّتَقَابِلِينَ

“তাদের অন্তরের ঈর্ষা বিদ্বেষ আমি (সেদিন) দূর করে দেবো, তারা একে অপরের ভাই হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি সেখানে অবস্থান করবে।” (সূরাহ আল-হিজর, ১৫ :৪৭)

আলি (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا (সূরাহ আল-আহকাফ, ৪৬ : ১৫) থেকে وَعْدَ الصِّدْقِ الَّذِي كَانُوا يُوعَدُونَ (সূরাহ আল-আহকাফ, ৪৬ :১৬) পর্যন্ত আবু বকরের শানে নাযিল হয়েছে।

ইবনে উয়াইনিয়্যা থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তাআলা সকল মুসলমানের উপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেন, কিন্তু এ অসন্তোষ আবু বকরের উপর ছিল না। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াত প্রণিধানযোগ্য –

إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّـهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ

“যদি তোমরা তাকে (রাসুলুল্লাহকে) সাহায্য না করো,তবে মনে রেখো,আল্লাহ তার সাহায্য করেছিলেন,যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিলো,তিনি ছিলেন দু’জনের একজন,যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন।” (সূরাহ আত-তাওবাহ, ৯ :৪০)

 

আবু বকর (রাঃ) আর উমর (রাঃ) এর শানে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, একটা চারণভূমিতে একজন রাখাল বকরী চরাতো। একদিন হঠাৎ বাঘ এসে বকরীর পালে আক্রমণ করে আর একটি বকরী ধরে ফেলে। রাখাল বাঘকে তাড়া করে বকরীটি উদ্ধার করলো। বাঘ বললো, সেদিন কি হবে, যেদিন তোমার বকরীর পালের সাথে তুমি থাকবে না, অথচ আমি থাকবো। একজন ব্যক্তি মাল বোঝাইকৃত বলদকে নিয়ে যায়। বলদ আমাকে দেখে বললো, আমি বোঝা বহন করার জন্য জন্ম নেইনি, আমার জন্ম ক্ষেতে কাজ করার জন্য। উপস্থিত জনতা আশ্চর্য হয়ে গেলো। তারা বললেন, বলদ কথা বলতে লাগলো! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার সাথে এ কথার স্বীকৃতি দিয়েছেন আবু বকর আর উমর। সে সময় সেখানে তারা দু’জন উপস্থিত ছিলেন না। তিনি তাদের বিশ্বাসের প্রতি ভরসা রাখার ব্যাপারে তাকীদ দিলেন।

আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এমন কোন নবী নেই, যার দু’জন মন্ত্রী আকাশে আর দু’জন যমিনে আছে। আমার আকাশের দুই মন্ত্রী জিবরাঈল ও মিকাইল, আর যমিনের দুই মন্ত্রী আবু বকর ও উমর।

সাইদ বিন যায়েদ থেকে আসহাবে সুনান প্রমুখ বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী জান্নাতি। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাকি আশরায়ে মুবাশশারাগণের নাম উল্লেখ করে বললেন, এরা জান্নাতি।

আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহামনীষীগণ আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। যেমন আবু বকর ও উমর। এ বর্ণনাটি জাবের বিন সামুরা ও আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন।

আনাস (রাঃ) থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসার ও মুহাজিরদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আদবের কারনে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না। কিন্তু আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে তাকাতেন আর মৃদু হাসতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতেন।

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে তিরমিযী ও হাকিম বর্ণনা করেছেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীতে প্রবেশের সময় তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ডানে-বামে আবু বকর ও উমর ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের হাত ধরে বললেন, আমি কিয়ামতের দিন এভাবে উঠবো। আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বরাত দিয়ে আওসাত গ্রন্থে তাবারানী এ হাদিস বর্ণনা করেছেন।

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে তিরমিযী ও হাকিম বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আমি উঠবো, এরপর আবু বকর, এরপর উমর।

আবদুল্লাহ বিন হানযালা থেকে তিরমিযী ও হাকিম বর্ণনা করেছেন, একদিন নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর ও উমরকে দেখে বললেন, এরা দু’জন আমার কান ও চোখ। এ হাদিসটি ইবনে উমর ও ইবনে আমর থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন।

আবু আরওয়া আদ্দুওসী থেকে বাযযার ও হাকিম বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আবু বকর ও উমর হাজির হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, সেই আল্লাহ’র শোকর, যিনি তোমাদেরকে আমার সাহায্যকারী বানিয়েছেন। এ হাদিসটি মুররা বিন আযেব (রাঃ) থেকেও বর্ণিত হয়েছে, তাবারানী এটি বর্ণনা করেছেন।

আম্মার বিন ইয়াসার (রাঃ) থেকে আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, একদিন জিবরাঈল আমীন আমার কাছে আসেন। আমি উমর বিন খাত্তাবের গুণাবলী সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, নূহ (আঃ) এর মতো দীর্ঘ জীবন পর্যন্ত যদি উমরের গুণাবলী বর্ণনা করি, তবুও তা শেষ হবে না।

আবদুর রহমান বিন গানাম থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর আর উমরকে সম্বোধন করে বলেছেন, তোমরা দুজনে যে বিষয়ে একমত হবে, সে বিষয়ে আমি দ্বিমত করবো না।

বারা বিন আযেব থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন আর ইবনে সাদ লিখেছেন, এক ব্যক্তি ইবনে উমরকে জিজ্ঞেস করলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে কে ফতোয়া দিতেন ? তিনি বললেন, সে সময় আবু বকর ও উমর ছাড়া কেউ ফতোয়া দিতেন বলে আমার জানা নেই।

আবুল কাসিম মুহাম্মদ বর্ণনা করেন, ফতোয়ার জন্য লোকেরা আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী (রাঃ) এর কাছে যেতেন।

ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক নবীগণের উম্মতে বিশেষ ব্যক্তি রয়েছেন। আমার উম্মতের বিশেষ ব্যক্তি আবু বকর আর উমর।

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা আবু বকরের উপর রহম করুন। কারন নিজ কন্যাকে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছেন, মদিনা পর্যন্ত আরোহণ করিয়ে আমাকে পৌঁছে দিয়েছেন আর তাছাড়া বিলালকে আযাদ করেছেন। আল্লাহ তাআলা উমরের প্রতি শান্তি বর্ষণ করুন। তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও সত্য কথা বলেন, এ জন্য লোকেরা তার ভয়ে দূরে থাকে আর তার বন্ধু নেই। আল্লাহ তাআলা উসমানের প্রতিও রহম করুন। ফেরেশতাকুল তাকে দেখে লজ্জা করেন। আল্লাহ পাক আলীর উপরও রহম করুন। আল্লাহ তাআলা আলীর সাথে রয়েছেন। (ইবনে আসাকির)

সুহাইল (রাঃ) বলেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হাজ্জ থেকে ফিরে এসে মিম্বরের উপর আরোহণ করে বললেন, হে জনতা, আবু বকর আমাকে কখনো কষ্ট দেননি। তোমরা তাকে মনে রেখো। হে জনতা, আমি তার প্রতি সন্তুষ্ট। উপরন্তু উমর, উসমান, আলী, তালহা, যুবাইর, সাদ, আবদুর রহমান বিন আউফ প্রাথমিক যুগের মুহাজিরদের উপরও সন্তুষ্ট। (তাবারানী)

ইবনে আবি হাযেম থেকে আবদুল্লাহ বিন আহমদ বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি যাইনুল আবেদীন আলী বিন হুসাইন (রাঃ) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আবু বকর ও উমরের মর্যাদা কতটুকু ছিল ? তিনি বললেন, সে সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার যতটুকু মর্যাদা ছিল।

বাসতাম বিন মুসলিম থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর আর উমরকে সম্বোধন করে বললেন, আমার পর তোমাদের উপর কোন ব্যক্তি প্রশাসক হতে পারবে না।

আনাস (রাঃ) থেকে মারফুয়ান সূত্রে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, আবু বকর আর উমরকে ভালোবাসা ঈমান, আর তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরী।

ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আবু বকর ও উমরের প্রতি ভালোবাসা পোষণ ও তাদের জ্ঞানের পথ অবলম্বন করা সুন্নত।

আনাস (রাঃ) মারফুয়ান বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি আমার উম্মতের ব্যাপারে আশাবাদী যে, তারা কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” থেকে যেমন পালাবে না। অর্থাৎ, উভয়ের প্রতি আমার উম্মতের অখণ্ড ভালোবাসা অটুকু থাকবে।

 

আবু বকর (রাঃ) এর শানে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে  

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি এক জোড়া কোন জিনিস আল্লাহ’র পথে ব্যয় করবে, জান্নাতের সকল দরজা থেকে তাকে আহবান করা হবে। হে আল্লাহ’র বান্দাগণ, এ পথে এসো। এ দরজা খুবই সুন্দর। সুতরাং, যে ব্যক্তি নামাযী, তাকে নামাযের দরজা থেকে; যে ব্যক্তি মুজাহিদ, তাকে জিহাদের দরজা থেকে; যে সদকাকারী, তাকে সদকার দরজা থেকে; রোজাদারকে রোজার দরজা থেকে তার নাম ধরে ডাকা হবে। আবু বকর (রাঃ) বললেন, ভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যাকে সব দরজা থেকে আহবান করা হবে। ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কোনো ব্যক্তিকে সব দরজা থেকে ডাকা হবে কি ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যা, আমি মনে করি যাদের ডাকা হবে তাদের মধ্য থেকে আপনি অন্যতম।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে আবু দাউদ ও হাকিম বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের সাহচর্য ও সম্পদ দিয়ে সবচেয়ে বেশী আমাকে অনুগ্রহ করেছেন, তিনি আবু বকর। যদি আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম, তবে আবু বকরকেই করতাম। কিন্তু ইসলামের ভাতৃত্বের বন্ধন অটুট। এ হাদিসটি ইবনে আব্বাস, ইবনে যুবায়ের, ইবনে মাসউদ, জুনদুব বিন আবদুল্লাহ, বাররা, কাব বিন মালিক, জাবের বিন আবদুল্লাহ, আনাস, উবাই বিন কাব, আবি ওয়াকিদুল লাইসী, আবুল মুয়ালা, আয়েশা, আবু হুরায়রা আর ইবনে উমর (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত।

আবুদ দারদা (রাঃ) থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেনঃ একবার আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে বসেছিলাম। আবু বকর (রাঃ) এলেন আর সালাম দিয়ে বললেন, আমার আর উমর বিন খাত্তাবের মধ্যে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে মনমালিন্যতা দেখা দেয়। আমি তার কাছেই বসেছিলাম। আমার মাঝে অনুতাপ এলো আর আমি তার কাছে ক্ষমা চাইলাম, কিন্তু তিনি ক্ষমা করতে অস্বীকার করলেন। এরপর আমি আপনার কাছে এসেছি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবার বললেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন। এরপর উমর লজ্জিত হয়ে আবু বকরের বাড়িতে যান। কিন্তু সেখানে তাকে না পেয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আসেন। তাকে দেখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা রাগে রক্তিম হয়ে যায়। এমন অবস্থায় উমর ফারুকের প্রতি আবু বকর সিদ্দীকের দয়া হয়। ফলে তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি তার চেয়ে বেশী অপরাধী। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ যখন আমাকে তোমাদের কাছে পাঠান, তখন তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছিলে। কিন্তু আবু বকর আমাকে সত্যায়িত করেছে, নিজের জীবন আর সম্পদ দিয়ে সাহায্য করেছে। আজ তোমরা সেই বন্ধুকে বর্জন করছো ? (এ কথাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইবার উচ্চারন করেন) এ আচরণ কখনোই গ্রহণীয় হতে পারে না।

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে ইবনে আদী অনুরূপ একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তবে সে হাদিসে এতটুকু বৃদ্ধি করা হয়েছে যে – আমার বন্ধু ব্যাপারে আমাকে কষ্ট দিয়ো না। যে সময় আল্লাহ তাআলা আমাকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠালেন, তখন তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছো, আর আবু বকর আমাকে সত্যায়িত করেছেন। যদি আল্লাহ তাআলা তাকে আমার জন্য সাহিব (সহচর) বলে সম্বোধন না করতেন, তবে আমি তাকে খলীল (বন্ধু) বলে ডাকতাম।

মুকতাম থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, আকীল বিন আবু তালিব আর আবু বকরের মধ্যে ঝগড়া হয়। যদিও আবু বকর তার বংশ পরম্পরা সম্পর্কে অবগত ছিলেন যে, আকীলের আত্মীয়তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত। এজন্য তিনি নীরব হয়ে যান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আকিল এ ব্যাপারে নালিশ করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার বন্ধুকে আমার উপর ন্যস্ত করো এবং নিজেদের অবস্থান ও তার শান সম্পর্কে চিন্তা করো। আল্লাহ’র কসম, তোমাদের সকলের দরজা অন্ধকারাচ্ছন্ন, কিন্তু আবু বকরের দরজা আলোকময়। আল্লাহ’র কসম, তোমরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছো আর আবু বকর আমাকে সত্যায়িত করেছেন। তোমরা আমার সাথে কৃপণতা করেছো আর আবু বকর আমার জন্য খরচ করেছেন। তোমরা আমাকে পরিত্যাগ করেছিলে আর আবু বকর আমার আনুগত্য করেছেন।

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি গর্ব করে নিজের পরিধেয় কাপড় মাটির সাথে ঝুলিয়ে পড়বে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার প্রতি অনুগ্রহের দৃষ্টিতে তাকাবেন না।” আবু বকর (রাঃ) বললেন, “যদি আমি সবসময় সতর্ক না থাকি তবে আমার পরনের বস্ত্রের একাংশ ঝুলে যায়।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি তো এ কাজ গর্ব করে করো না।”

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আজ তোমাদের মধ্যে কে রোজাদার ?” আবু বকর (রাঃ) বললেন, “আমি।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আজ তোমাদের মধ্যে কে জানাযার সাথে গিয়েছে ?” আবু বকর বললেন, “আমি।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “আজ তোমাদের মধ্যে কে দুস্থকে অন্ন দিয়েছে?” আবু বকর বললেন, “আমি।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “আজ কে রোগীর সেবা করেছো ?” আবু বকর বললেন, “আমি।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “যে ব্যক্তির মধ্যে এতগুলো বিষয় একত্রিত হয়েছে, তিনি অবশ্যই জান্নাতী।” আনাস ও আবদুর রহমান বিন আবু বকরও হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তাদের বর্ণনায় এতটুকু বৃদ্ধি করা হয়েছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে।”

আবদুর রহমান থেকে বাযযার বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজ আদায় করে সাহাবীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে লাগলেন, “আজ তোমাদের মধ্য থেকে কে রোজা মুখে সকাল পেয়েছো ?” উমর ফারুক বললেন, “আমি আমার ব্যাপারে বলছি, আজ আমি রোজা নেই।” আবু বকর বললেন, “রাতেই রোজার নিয়ত করেছিলাম আর আলহামদুলিল্লাহ্‌, আমি রোজা রেখেছি।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমাদের মধ্যে থেকে আজ কে রুগ্ন ব্যক্তির শুশ্রূষা করেছে ?” উমর (রাঃ) বললেন, “আমি তো এখনো মসজিদ থেকেই বের হইনি, রোগীর সেবা আবার কখন করলাম।” সিদ্দীকে আকবর আবু বকর (রাঃ) বললেন, “খবর পেলাম ভাই আবদুর রহমানের (আল্লাহ’র বান্দা) অবস্থা খুবই গুরুতর। ফলে মসজিদে আসার পথে তিনি কেমন আছেন তা দেখে এসেছি।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “আজ তোমাদের মধ্যে কেউ কি ফকিরকে কোন খাদ্যদ্রব্য দিয়েছো?” উমর বললেন, “আমি তো সবেমাত্র নামায পড়লাম, এখন পর্যন্ত কোথাও যাইনি।” আবু বকর বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি মসজিদে প্রবেশের সময় হঠাৎ এক ভিক্ষুক এলো। আমি সে সময় আবদুর রহমানের (আবু বকরের ছেলে) হাতে যবের রুটির একটি টুকরো দেখলাম আর সেটি তার কাছ থেকে নিয়ে ভিক্ষুককে দিয়েছিলাম।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমি তোমাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছি।” এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাও বললেন, যা দ্বারা উমরও সন্তুষ্ট হোন, আর উমর বুঝলেন, পুণ্যময় কোন কাজে তিনি আবু বকরের সমান নন।

আবু ইয়ালার গ্রন্থে ইবনে মাসউদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, একদিন আমি নামায পড়ে মসজিদে দুয়া করছিলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর ও উমরকে নিয়ে মসজিদে এসে (আমাকে দেখে) বললেন, “যে চাইবে সে পাবে।” এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “যে সুন্দর করে কিরাত (কুরআন তিলাওয়াত) করতে চায়, সে যেন আবদুল্লাহ বিন মাসউদের কিরাত অনুসরণ করে।” এরপর আমি বাড়ি এলাম। কিছুক্ষন পর আবু বকর আমাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য আমার কাছে এলেন। পরক্ষণে উমরও এলেন। তিনি আবু বকরকে দেখে বললেন, আপনি প্রত্যেকটি ভালো কাজে এগিয়ে রয়েছেন।

রবিআ আসলামী বর্ণনা করেনঃ আমার আর আবু বকরের মধ্যে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে তিনি আমাকে এমন কথা বলেন, যা আমাকে দুঃখ দেয়। এরপর তিনি লজ্জিত হয়ে বললেন, “রবিআ, তুমি কথার দ্বারা প্রতিশোধ নাও।” আমি বললাম, “তা হতে পারে না।” তিনি বললেন, “তুমি আমার প্রতিশোধ নাও, নাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নালিশ করবো।” আমি বললাম, “তবুও না।” এরপর আবু বকর চলে গেলেন। আমার কাছে বনু আসলাম গোত্রের কিছু লোক এসে বললো, “ভালোই হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন অসন্তুষ্ট হবেন, আবু বকরই তো বাড়াবাড়ি করেছেন। কেন তিনি এতোটা করতে গেলেন ?” আমি তাদের বললাম, “তোমরা কি আবু বকরের মর্যাদা সম্পর্কে জানো না ? তিনি ثَانِيَ اثْنَيْنِ আয়াতের প্রতিবিম্ব আর মুসলমানদের মধ্যে বুযুর্গ ও বড় ব্যক্তিত্ব। তোমরা নিজেদের মঙ্গল তালাশ করো। যদি তিনি দেখেন যে, তার বিরুদ্ধে তোমরা সাহায্য করছো, তবে তিনি রাগ করবেন। তার রাগ করার কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাগের কারনে স্বয়ং আল্লাহ্‌ তাআলা রাগ করবেন। আর এতে করে রবিআ ধ্বংস হয়ে যাবে।” সুতরাং আমি আবু বকরের পিছে পিছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হলাম। আবু বকর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হুবহু সম্পূর্ণ ঘটনা বললেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা তুলে আমাকে বললেন, “রবিআ, ঘটনা কি ?” আমি বললাম, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ঘটনা তা-ই (যা তিনি বলেছেন)। তিনি এমন কথা বলেছেন, যা আমাকে মর্মাহত করেছে। তিনি আমাকে অনুরূপ কথা বলে তার প্রতিশোধ নিতেও বলেছিলেন।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “খবরদার, ওই কথা মুখে আনবে না (অর্থাৎ, আবু বকরের প্রতিশোধ নিতে যেয়ো না); বরং বলো, হে আবু বকর, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন।” (মুসনাদে আহমদ)

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরকে বললেন, “তুমি গুহায় আমার সাথী ছিলে, হাউজে কাউসারেও আমার সাথী হয়ে থাকবে।” আবদুল্লাহ বিন আহমাদও অনুরূপ বর্ণনা বর্ণিত করেছেন যে, আবু বকর গুহায় আমার সাথী ছিল। এ হাদিসের সনদগুলো সহিহ।

হুযাইফা (রাঃ) থেকে বায়হাকি বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “বেহেশতে খোরাসানের উটের মতো অনেক পাখি থাকবে।” আবু বকর (রাঃ) আরয করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সে তো অনেক ভালো হবে।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তাকে ভক্ষণকারী তার চেয়েও ভালো হবে ? তার মধ্যে তুমি অন্যতম।”

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মিরাজের রাতে আকাশের অনেক স্থানে আমার নামের পিছনে আবু বকরের নাম দেখেছি।” এ হাদিসের সনদগুলো দুর্বল। যদিও তা ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, আনাস, আবু সাঈদ আর আবুদ দারদা (রাঃ) থেকে পৃথক পৃথক সূত্রে বর্ণিত।

সাঈদ বিন জাবের (রাঃ) থেকে ইবনে আবী হাতিম আর আবু নুয়াঈম বর্ণনা করেছেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে  يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ – এ আয়াত (সূরাহ আল-ফজর, ৮৯ :২৭) তিলাওয়াত করলে আবু বকর বললেন, “এ কতোই না সুন্দর কথা।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “মৃত্যুর সময় ফেরেশতা তোমাকে এভাবে সম্বোধন করবে।”

আমের বিন আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের থেকে ইবনে হাতিম বর্ণনা করেছেন,

وَلَوْ أَنَّا كَتَبْنَا عَلَيْهِمْ أَنِ اقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ

“আর যদি আমি তাদের নির্দেশ দিতাম যে,নিজেদের প্রাণ ধ্বংস করে দাও …” (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৬৬)

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর আবু বকর (রাঃ) বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি যদি আমাকে নির্দেশ করেন, তবে আমি নিজেকে বিধ্বস্ত করে ফেলবো।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি সত্যিই বলেছো।”

ইবনে আবি মুলাইকা (রাঃ) থেকে আবুল কাসেম বাগাবী বর্ণনা করেছেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের সাথে এক জলাশয়ে গিয়ে বললেন, “সবাই নিজ নিজ সাথী আর বন্ধুর কাছে ফিরে যাও।” এটা শুনে সবাই সেটাই করলো। শুধু বাকি থাকলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরের কাছে গিয়ে তার সাথে কোলাকুলি করলেন আর বললেন, “যদি আমি নিজের জীবনে কোন বন্ধু গ্রহণ করতাম, তবে আবু বকরকেই গ্রহণ করতাম, কিন্তু সে আমার সাথী।” (ইবনে আসাকির)। এ হাদিসটি মুরসাল ও গরীব সনদে বর্ণিত হয়েছে।

সুলায়মান বিন ইয়াসার থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ভালো অভ্যাস তিনশ ষাটটি। আল্লাহ কাউকে জান্নাত দিতে চাইলে এ অভ্যাসগুলোর মধ্যে যে কোন একটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে দেন।” আবু বকর (রাঃ) আরয করলেন, “সেগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি আমার মধ্যে কি আছে ?” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “সবগুলোই আছে।”

ইবনে আসাকির এ হাদিসটি দুইভাবে বর্ণনা করেছেন। আরেক পদ্ধতিটি হলো – রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নেক অভ্যাস তিনশ ষাটটি।” আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এর মধ্য থেকে আমার মাঝে কিছু কি আছে ?” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “ধন্যবাদ, সব নেক অভ্যাস তোমার মধ্যে সঞ্চিত আছে।”

ইয়াকুব আনসারীর পিতা থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গায়ে গায়ে মিলে বসতো, এ দৃশ্য দুর্গের দেওয়ালের মতো লাগতো। কিন্তু আবু বকরের বসার জায়গা পড়েই থাকতো, সেখানে কেউ বসতো না। তিনি যখন আসতেন, তখন সেখানে বসতেন আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে চেহারা ফিরিয়ে কথা শুরু করতেন আর সকল উপস্থিত ব্যক্তিগণ মনোযোগ সহকারে কথা শুনতেন।

আনাস (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আবু বকরের প্রতি ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমার সকল উম্মতের জন্য ওয়াজিব।” সাহল বিন সাদ (রাঃ) একটি হাদিস এভাবেই বর্ণনা করেছেন।

উপরন্তু, আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে একটা মারফু হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, সকল লোকের হিসাব নেওয়া হবে, কিন্তু আবু বকর থেকে হিসাব নেওয়া হবে না।

 

আবু বকর (রাঃ) এর শানে সাহাবা ও সলফে সালেহিনদের অভিমত

জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, উমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন, “আবু বকর সিদ্দীক আমাদের সর্দার।” (বুখারী)

শুয়াবুল ঈমান গ্রন্থে বায়হাকী হযরত উমরের অভিমত নকল করেছেন – “যদি আবু বকরের ঈমানকে এক পাল্লায় আর পৃথিবীবাসীর ঈমান আরেক পাল্লায় তুলে দেওয়া হয়, তবে আবু বকরের ঈমানের পাল্লা বেশী ভারী হবে।”

ইবনে আবি হাইসামা ও আবদুল্লাহ বিন আহমদ যাওয়াইদুয যুইদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, উমর (রাঃ) বলেছেন, “আবু বকর সিদ্দিকের প্রত্যেকটি অভিমতই শ্রেষ্ঠ আর সর্বোত্তম।”

মিসদাদ তার মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, উমর (রাঃ) বলেছেন, “হায়, আমি যদি আবু বকর সিদ্দীকের বুকের একটি পশম হতাম!”

ইবনে আসাকির ও ইবনে আবিদ দুনিয়া বর্ণনা করেছেন যে, উমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন, “আমার একান্ত ইচ্ছা হলো, আবু বকরের জন্য যেরূপ জান্নাত নির্ধারিত, তদ্রুপ জান্নাত যেন আমি পাই।”

আবু নুয়াইম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, উমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন, “আবু বকরের শরীর মেশকের থেকেও অধিক সুগন্ধ।”

আলী (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আলী (রাঃ) আবু বকর (রাঃ) এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময় আবু বকর এক খণ্ড কাপড় পড়ে বসেছিলেন। তিনি আবু বকরকে দেখে বললেন, “কোনো নেককার ব্যক্তি আল্লাহ’র কাছে কাছে আমার মতে এ কাপড় পরিধানকারী ব্যক্তির চেয়ে তিনি বেশী প্রিয় নন।”

আবদুর রহমান বিন আবু বকর (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমাকে কয়েকবার উমর বিন খাত্তাব বলেছে, ‘আবু বকর সিদ্দীক আমার চেয়ে প্রত্যেক কাজে অগ্রগামী।’ ”

আওসাত গ্রন্থে তাবারানী বর্ণনা করেছেন যে, আলী (রাঃ) বলেছেন, “পবিত্র সত্তার কসম – যার হাতে আমার প্রাণ, আমি নেক কাজে অগ্রগামী হয়ে দেখেছি সে কাজে আবু বকর আমার চেয়েও অগ্রগামী।”

আওসাত গ্রন্থে তাবারানি আলী (রাঃ) এর আরেকটি অভিমত বর্ণনা করেছেন যে, আলী (রাঃ) বলেছেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আবু বকর আর উমরই আমার কাছে প্রিয়। কোন মুমিনের অন্তরে আমার প্রতি ভালোবাসা এবং আবু বকর ও উমরের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্নতা একত্রে জমা হবে না।”

আবু আমর (রাঃ) বলেছেন, “কুরাইশদের মধ্যে তিনজন ব্যক্তি ছিলেন, যারা দৃশ্যত আর চরিত্রগতভাবে অসাধারণ ও বিস্ময়কর সাদা মনের মানুষ। যদি তারা তোমাকে কিছু বলেন, তবে সত্য বলবেন। আর তুমি যদি তাকে কিছু বলো, তবে তারা তা সত্য বলে বিশ্বাস করবেন। তারা হলেন – আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), আবু উবাইদা বিন জাররা (রাঃ) আর উসমান বিন আফফান (রাঃ)।”

ইবনে সাদ ইব্রাহীম নখয়ী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর উপাধি তার দয়ার্দ্রতার কারনে দেওয়া হয়েছে।

রবীআ বিন আনাস (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, “আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এমন এক পানির ফোঁটা, (তা) যেখানে পড়বে সেটাই মহিমান্বিত হবে।”

রবীতা বিন আনাস থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, “আমি আবু বকর সিদ্দীকের মতো পূর্ববর্তী নবীদের কোন সাহাবীকে পাই নি।”

যুহরি বলেছেন, “আবু বকর সিদ্দীকের মর্যাদার মধ্যে এটিও একটি যে, তিনি আল্লাহ’র ব্যাপারে কোনই সন্দেহ করতেন না।” (ইবনে আসাকির)

যুবায়ের বিন বাকার বলেন, “আমি আলেমদের থেকে শুনেছি যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খতীব আবু বকর (রাঃ) ও আলি (রাঃ)।”

আবু হুসাইন বর্ণনা করেছেন, “আদম সন্তানদের মধ্যে নবী রাসুলের পর কোন ব্যক্তি আবু বকরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর মুরতাদদের প্রতি সৈন্য পাঠিয়ে আবু বকর এক নবীওয়ালা কাজ করেছেন।”

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

দাইনূরী তার রচিত মাজালিসাত গ্রন্থে আর ইবনে আসাকির শাবী থেকে বর্ণনা করেছেন, “আল্লাহ তাআলা আবু বকরকে এমন চারটি গুণ দান করেছিলেন, যা আজ পর্যন্ত কাউকে দেওয়া হয়নি। এক – তিনি সিদ্দীক, দুই – তিনি গুহায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথী, তিন – হিজরতের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলেন, চার – রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ইমাম ও বাকি সকল মুসলমানকে মুকতাদী হওয়ার নির্দেশ দেন।”

মাসাহাফ গ্রন্থে আবু দাউদ লিখেছেন যে, আবু জাফর বলেছেন, “আবু বকর (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর জিব্রাঈলের কথা শুনতে পেতেন, কিন্তু জিবরাঈলকে দেখতে পেতেন না।”

ইবনে মুসাইয়াব বলেছেন, “আবু বকর ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ মন্ত্রী। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিটি বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের মধ্যে, গুহায়, বদর যুদ্ধের ছাউনির নিচে, এমনকি কবরেও আবু বকর ছাড়া অন্য কাউকে প্রাধান্য দেননি।”

 

আয়াত, হাদিস ও ইমামদের অভিমতে আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফতের প্রতি ইশারা

হুযাইফা (রাঃ) থেকে তিরমিযী ও হাকিম বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার পর আবু বকর ও উমরের অনুসরণ করবে। এ হাদিসটি আবুদ দারদা থেকে তাবারানী আর ইবনে মাসউদ থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেন।

আবদুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) থেকে আবুল কাসেম বাগাবী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, “আমার পর বারোজন খলীফা হবেন আর আবু বকর সিদ্দীক আমার পর সামান্য জীবিত থাকবেন।” এ হাদিসের প্রথম অংশের ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিসই একমত। এটি কয়েক পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে, এ সম্পর্কে আমি অন্য ব্যাখ্যা গ্রন্থে আলোচনা করেছি।

বুখারি ও মুসলিম শরীফের এ হাদিস, যা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওফাতের আগে বক্তৃতায় বলেছিলেন, আল্লাহ তার এক বান্দাকে অবকাশ দিয়েছেন …। সেই বক্তৃতায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছিলেন, “সব দরজাই বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু আবু বকরের দরজা খোলা থাকবে।”

এক বর্ণনায় আছে, আবু বকরের জানালা ছাড়া মসজিদের সকল জানালা বন্ধ থাকবে। ওলামায়ে কেরাম লিখেছেন, এটা দিয়ে আবু বকরের খিলাফতের প্রতি ইশারা করা হয়েছে, কারন তিনি এ পথেই মসজিদে নামায পড়ানোর জন্য আসতেন।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আবু বকরের দরজা ছাড়া সকল দরজা বন্ধ করে দাও।” এ হাদিসটি ইবনে আদী, ইমাম তিরমিযী হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে, যাওয়াইদুল মুসনাদ গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে, তাবারানী হজরত মুআবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রাঃ) থেকে এবং বাযযার হজরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন।

জুবায়ের বিন মুতঈম থেকে বুখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেছেনঃ একদিন এক মহিলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে পুনরায় আসতে বললেন। সে বললো, “আমি আবার এলে হযরতকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাবো না, অর্থাৎ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকাল করবেন।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তবে আবু বকর সিদ্দীকের কাছে এসো।”

আনাস (রাঃ) বলেছেনঃ “আপনার পর আমরা কার কাছে সদকা দিবো” – এ বার্তা দিয়ে বনু মুসতালিকের লোকেরা আমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পাঠালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আবু বকরের কাছে।” (হাকিম)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এক মহিলা এসে কিছু জানতে চাইলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে পরে আসতে বললেন। সে বললো, “আমি এসে যদি আপনাকে না পাই আর আপনার মৃত্যু হয়ে যায় ?” নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি এসে আমাকে না পেলে আবু বকরের কাছে যাবে, কারন আমার পর তিনি খলীফা হবেন।”

আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেছেনঃ মৃত্যুর সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে আয়েশা, তোমার পিতা আর তোমার ভাইকে আমার কাছে আসতে বলো, আমি তাদের দলীল লিখে দিতে চাই। কারন আমার আশংকা হয় যে, আমার পর কোন আশান্বিত ব্যক্তি খিলাফতের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে পারে আর বলতে পারে – ‘আমি খিলাফতের উপযুক্ত’। কিন্তু আল্লাহ আর মুমিনগণ আবু বকরকে ছাড়া মেনে নিবে না।” (মুসলিম)

এ হাদিসটি আহমদ ভিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণনা করেছেন। আয়েশা সিদ্দীকা বলেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর সময় আমাকে বললেন, “তোমার ভাই আবদুর রহমানকে ডেকে আনো, আমি আবু বকরের জন্য একটি দলীল লিখে দিবো, যাতে লোকেরা মতভেদ করতে না পারে।” এরপর নিজেই বললেন, “তাকে লাগবে না। আল্লাহ আবু বকরের ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য রাখবেন না।”

আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলো, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি খলীফা নির্ধারণ করতেন, তবে কাকে (খলীফা) বানাতেন ?” তিনি বললেন, “আবু বকরকে।” সে বললো, “তার পর ?” তিনি বললেন, “উমর ফারুক।” সে বললো, “তার পর ?” তিনি বললেন, “আবু উবায়দা বিন জাররাহ।”

আবু মুসা আশআরী (রাঃ) থেকে বুখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেছেনঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমূর্ষ অবস্থায় বললেন, “হে জনতা, তোমরা আবু বকরের কাছে যাও। তিনি তোমাদের নামায পড়াবেন।” আয়েশা (রাঃ) বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর খুবই নরম মনের মানুষ। তিনি আপনার সাথে জায়নামাযে দাঁড়ালে নামাজ পড়াতে পারবেন না।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তাকেই নামাজ পড়াতে বলো।” আয়েশা আবার একই আবেদন করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আবু বকরকেই বলো, তিনি যেন নামাজ পড়ান। তুমি তো ইউসুফ (আঃ) এর যুগের নবীর মতো।” এরপর লোকেরা আবু বকরের কাছে এলেন আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশাতেই (আবু বকর) লোকদের নামায পড়ান।

এ হাদিসটি মুতাওয়াতির। এটি আয়েশা, ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, আবদুল্লাহ বিন যামআ, আলি বিন আবু তালিব ও হাফসা (রাঃ) পৃথকভাবে বর্ণনা করেছেন। এদের পদ্ধতিও হাদিসে মুতাওয়াতির পদ্ধতির অনুরূপ।

আয়েশা (রাঃ) আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন, “আমি এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ জন্যই জিদ করেছিলাম যে, আমার অন্তর সাক্ষ্য দিচ্ছিলো – রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্থলাভিষিক্তকে মানুষ ভালবাসবে না। কারন আমি বুঝেছিলাম, যিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্থলবর্তী হবেন, লোকেরা তাকে হতভাগা মনে করবে। এজন্য আমি চাইছিলাম যেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরকে ছাড়া নামায পড়ানোর নির্দেশ দেন।”

ইবনে যামআ (রাঃ) বলেছেন, “যে সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের নামাজ পড়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তখনো আবু বকর আসেননি, এজন্য উমর এগিয়ে আসেন। কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন – ‘না না না (তিনবার), আবু বকরই নামাজ পড়াবেন।’ ”

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, উমর (রাঃ) তাকবীরে তাহরীমা বললে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগান্বিত হয়ে মাথা তুলে বললেন, “আবু কুহাফার ছেলে কোথায় ?” এ হাদিসের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামগণের অভিমত হলো, এটি সুস্পষ্ট দলীল যে, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সকল সাহাবার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম। তিনিই সবচেয়ে বেশী খিলাফতের হকদার আর ইমামতের যোগ্য।

ইমাম আশআরী বলেন, “এটা প্রকাশ্য যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর সিদ্দীককে লোকদের নামায পড়াতে নির্দেশ দেন। সেখানে মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী – তিনিই ইমামতি করবেন, কুরআনের জ্ঞান যার সবচেয়ে বেশী। সুতরাং এ হাদিসের আবেদন হলো, আবু বকর গোটা উম্মত থেকে কুরআনের জ্ঞান বেশী রাখতেন। স্বয়ং সাহাবায়ে কেরাম রিদওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈনও উক্ত হাদিস দিয়ে এ ফলাফল বের করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীকই খিলাফতের বেশী হকদার ছিলেন। (যারা ফলাফল বের করেছেন) তাদের মধ্যে উমর (রাঃ) আর আলি (রাঃ) অন্যতম।

আলী (রাঃ) এর বর্ণনা ইবনে আসাকির নকল করে বলেছেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আবু বকরকে নামায পড়ানোর নির্দেশ দিচ্ছিলেন, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম, অসুস্থ ছিলাম না, আমার জ্ঞান ও চৈতন্য ছিল। এরপর আমরা নিজেদের দুনিয়ার জন্য তার প্রতি রাজি হলাম, যার প্রতি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের দ্বীনের জন্য রাজি হয়েছিলেন।”

ওলামায়ে কেরাম বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই আবু বকর সিদ্দীক ইমামতি করেন আর পরামর্শদাতা হোন।

সহল বিন সাদ থেকে আহমাদ ও আবু দাউদ বর্ণনা করেনঃ একবার বনু বিন আউফ গোত্রে বিবাদ ও কলহ দেখা দিলে সংবাদ পেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহরের পর মীমাংসার জন্য সেখানে যান, আর যাওয়ার সময় বলেন, “হে বিলাল, নামাযের সময় হলে এবং আমি না ফিরলে আবু বকরকে নামায পড়াতে বলবে।” সুতরাং যখন আসরের সময় হলো, বিলাল (রাঃ) ইকামত দিলেন আর তার কথায় আবু বকর (রাঃ) নামায পড়ালেন।

আবু বকর শাফেঈ গীলানিয়াত গ্রন্থে এবং হাফসা থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেন, “আমি আরয করলাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি অসুস্থ থাকা অবস্থায় কি আবু বকরকে ইমাম বানিয়েছিলেন ?’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেন, ‘না, বরং আল্লাহই তাকে ইমাম বানিয়েছেন।’ ”

দারা কুতনী ইফরাদ গ্রন্থে, খতীব এবং ইবনে আসাকির আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ’র দরবারে তোমার ব্যাপারে তিনবার প্রশ্ন করেছি যে, তোমাকে ইমাম বানবো। কিন্তু সেখান থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয় আর আবু বকর ইমামতির নির্দেশপ্রাপ্ত হোন।”

হাসান (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি স্বপ্নে নিজেকে অধিকাংশ লোকের আবর্জনা অতিক্রম করতে দেখেছি।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি অবশ্যই লোকদের কাজ করার সুযোগ পাবে।” আবু বকর বললেন, “আমি আমার বুকে দুটো চিহ্ন দেখেছি।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমার খিলাফতের সময় দুই বছর।”

ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে আবু বকর (রাঃ) বলেছেন, “আমি একদিন উমর ফারুকের কাছে গেলাম। সে সময় তার কাছে কিছু লোক খাবার খাচ্ছিলো। আমি পিছনের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কি পূর্ববর্তী নবীগণের কিতাবগুলো পড়েছো ?’ সে বললো, ‘এতে লেখা রয়েছে শেষ নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খলীফা হবেন সিদ্দীক।”

ইবনে আসাকির কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে মুহাম্মদ বিন যুবায়ের বলেছেনঃ উমর বিন আবদুল আযীয (রাঃ) আমাকে কিছু প্রশ্ন করার জন্য হাসান বসরী’র কাছে পাঠালেন। আমি তাকে বললাম, “আবু বকরের খিলাফত নিয়ে লোকেরা মতভেদ করেছিলো। আপনি আমাকে পূর্ণাঙ্গ জবাব দিন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লাম কি তাকে খলীফা বানিয়েছিলেন ?” তিনি রেগে বসে পড়লেন আর বললেন, “কেন ? এতে কি কোন সন্দেহ আছে ? আল্লাহ’র কসম, আল্লাহ তাআলাই তাকে খলীফা বানিয়েছেন। আল্লাহ কেন খলীফা  বানাবেন না, তিনি সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী আর মুত্তাকী লোকেরা তাকে খলীফা না বানানো পর্যন্ত তিনি মৃত্যুবরণ করতেন না।”

ইবনে আদী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে আবু বকর বিন আয়াস বলেছেনঃ হাকিম রশীদ আমাকে বললেন, “লোকেরা আবু বকরকে কিভাবে খলীফা বানিয়ে নিলো ?” আমি বললাম, “হে আমিরুল মুমিনীন, এ কাজে আল্লাহ, তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর সকল মুসলমান নীরব ছিলেন।” খলীফা হারুন রশীদ বললেন, “একটু ব্যাখ্যা করে বলুন।” আমি বললাম, “হে আমিরুল মুমিনীন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আটদিন অসুস্থ ছিলেন। এ সময় বিলাল (রাঃ) আরয করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কে নামায পড়াবেন ?” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আবু বকরকে নামাজ পড়াতে বলো।” আবু বকর আট দিন পর্যন্ত নামাজ পড়ান আর এ দিনগুলোতে নিয়মিত ওহী নাযিল হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ’র নীরবতার কারনে নীরব ছিলেন আর সকল মুসলমান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নীরবতার কারনে নীরব ছিলেন।” খলীফা হারুন রশীদের কাছে এ অভিমতটি খুবই পছন্দনীয় মনে হলো আর তিনি বললেন, “বারাকাল্লাহু ফিক।”

ওলামায়ে কেরামের একটি দল আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফতের প্রমাণ পেশ করেছেন। বায়হাকী বর্ণনা করেছেন, ইমাম হাসান বসরী এ আয়াত দিয়ে দলীল দিয়েছেন –

ا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّـهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ

“হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে,অচিরেই আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন,যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে।” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ :৫৪)

হাসান বসরী বলেন, “আল্লাহ’র কসম, আরব যখন ধর্মত্যাগী হয়, আবু বকর আর তার সাথীরাই মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে তাদের ইসলামে ফিরিয়ে আনেন।”

কাতাদা (রাঃ) এর বরাত দিয়ে ইউনুস বিন বাকীর লিখেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর আরবের কিছু লোক মুরতাদ হয়ে যায়। তখন আবু বকর (রাঃ) তাদের সাথে জিহাদ করেছিলেন। সে সময় আমরা পরস্পরে বলতাম, “কুরআনের এই আয়াত – فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّـهُ بِقَوْمٍ  আবু বকর সিদ্দীক আর তার সাথীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।”

কুতায়বা থেকে ইবনে আবী হাতেম বর্ণনা করেছেন –

قُل لِّلْمُخَلَّفِينَ مِنَ الْأَعْرَابِ سَتُدْعَوْنَ إِلَىٰ قَوْمٍ أُولِي بَأْسٍ شَدِيدٍ

“পিছনে পড়ে থাকা (আরব) বেদুইনদের তুমি (আরো) বলো – অচিরেই তোমাদের একটি শক্তিশালী জাতির সাথে যুদ্ধ করার জন্য ডাক দেওয়া হবে …” (সূরাহ আল-ফাতহ, ৪৮ :১৬)

এ আয়াতে উল্লেখিত কঠোর লড়াইকারী দারা বনূ হুলায়ফা গোত্র উদ্দেশ্য। ইবনে আবী হাতেম ও ইবনে কুতাইবা বলেন, “এ আয়াতটি আবু বকরের খিলাফতের দলীল। কারন তিনিই লোকদের তীব্র থেকে তীব্রতরভাবে লড়াই করার আহবান জানান।”

শায়খ আবুল হাসান আশআরী (রহঃ) বলেছেনঃ আবু আব্বাস সুরাইহ থেকে শুনেছি যে তিনি বলেছেন, “আবু বকর সিদ্দীকের খিলাফত কুরআন শরীফের উপরোল্লিখিত আয়াত দিয়ে প্রমাণিত। কারন ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে একমত যে, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ছাড়া যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে কেউ জিহাদ করেননি।”

সুতরাং এ আয়াতটি আবু বকরের খিলাফতের দাবী রাখে আর তার আনুগত্য করা মানুষের জন্য ফরয, কারন যে তা মান্য করবে না, আল্লাহ অবশ্যই তাকে শাস্তি দিবেন।

ইবনে কাসির (রহঃ) বলেছেন, “কিছু মুফাসসিরীন রোম, শাম আর পারস্যের যুদ্ধ দিয়ে এ আয়াতের তাফসীর করেছেন। কিন্তু এ যুদ্ধগুলো প্রস্তুতি আবু বকরই গ্রহণ করেন, যদিও তা উমর ফারুক ও উসমান গনীর যুগে এসে শেষ হয়েছে। তারা দু’জনই আবু বকরের অনুসারী ছিলেন।”

ইবনে কাসির বলেন, এ আয়াতটি আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর খিলাফতের দলীল –

وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ

“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে আর সৎকর্ম করে,আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে,তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন ” (সূরাহ আন-নূর, ২৪ :৫৫)

ইবনে আবী হাতিম তার তাফসীর গ্রন্থে আবদুর রহমান বিন আবদুল হামীদ আল মাহদি থেকে বর্ণনা করেছেন, “এ (উপরোক্ত) আয়াত দিয়ে আবু বকর (রাঃ) আর উমর (রাঃ) এর খিলাফত প্রমাণিত।”

আবু বকর বিন আয়াশ থেকে খতীব বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক হলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খলীফা আর তার খিলাফত কুরআন দিয়ে প্রমাণিত। এ প্রেক্ষিতে ইরশাদ হচ্ছে –

لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّـهِ وَرِضْوَانًا وَيَنصُرُونَ اللَّـهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَـٰئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ

“(এ সম্পদ) সেসব অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য, যাদের (আল্লাহ’র উপর ঈমানের কারণেই) নিজেদের ভিটেমাটি ও সহায়-সম্পদ থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে, অথচ এ লোকগুলো আল্লাহ’র অনুগ্রহ ও তার সন্তুষ্টিই হাসিল করতে চায়, আল্লাহ ও তার রাসুলের সাহায্য সহযোগিতায় তৎপর থাকে, (মূলত) এ লোকগুলোই হচ্ছে সত্যবাদী।” (সূরা আল-হাশর, ৫৯ :৮)

এ আয়াতে  الصَّادِقُونَ  শব্দ দিয়ে সাহাবায়ে কেরাম উদ্দেশ্য। আর আল্লাহ যাকে “সাদিক” বলেছেন, তিনি কখনো মিথ্যা বলতে পারেন না। আর সাহাবাগণ আবু বকরকে সবসময় “হে রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর খলীফা” বলে সম্বোধন করতেন। ইবনে কাসির বলেন, “এ গবেষণাটি খুবই সুন্দর।”

 

যাফারানী বলেছেনঃ আমি ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এর কাছে শুনেছি যে তিনি বলেছেন, “আবু বকরের খিলাফতের বিষয়ে ইজমা হয়েছিলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর লোকদের মধ্যে দুনিয়ায় আবু বকরের চেয়ে ভালো মানুষ না থাকায় লোকেরা তার হাতে বাইয়াত দেয়।” (বায়হাকী)

আসাদুস সুন্নাহ ফায়ায়েল গ্রন্থে মুয়াবিয়া বিন কাররাহ থেকে বর্ণনা করেছেন, “আবু বকরের খিলাফত সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামগণ কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করতেন না। তারা সবসময় আবু বকরকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খলীফা বলে সম্বোধন করতেন। আর সাহাবীদের ইজমা কখনো ভুল ও বিভ্রান্তকর হতো না।”

ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেন, “যে জিনিসকে সকল মুসলমান ভালো মনে করে সেটা আল্লাহ’র কাছেও ভালো। আর যা সকল মুসলমানদের কাছে মন্দ তা আল্লাহ’র কাছেও মন্দ। সকল মুসলমান আবু বকরের খিলাফতকে ভালো মনে করতো। সুতরাং তা আল্লাহ’র কাছেও ভালো আর উত্তম।”

হাকিম ও যাহাবী লিখেছেন, “আবু বকরের খিলাফতের পর একদিন আবু সুফিয়ান বিন হরব হযরত আলী (রাঃ) এর কাছে এসে বললেন, ‘লোকদের কাজগুলো দেখুন, তারা কুরাইশদের এক নগণ্য ব্যক্তির কাছে বাইয়াত দিয়েছে। আপনি চাইলে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য দিয়ে মদিনা ভরে দিবো।” আলী (রাঃ) বললেন, “হে আবু সুফিয়ান, আপনি দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামের শত্রুতা করে এসেছেন, আপনি কলহ প্রিয়। আমার দৃষ্টিতে আবু বকরের খিলাফতের কোন মন্দ বিষয় নেই। কারন তিনি প্রত্যেক বিষয়ে দক্ষ ও হকদার।”

 

আবু বকর (রাঃ) এর কাছে বাইয়াত

বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) হাজ্জ থেকে ফিরে তার এক ভাষণে বললেন, “আমি সংবাদ পেয়েছি যে, অমুক ব্যক্তি বলেছে – উমরের মৃত্যুর পর সে অমুক ব্যক্তির হাতে বাইয়াত দিবে। কেউ যেন এ ধোঁকায় পড়ে না যে, আবু বকর সিদ্দীকের বাইয়াত কিছু লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল আর তা সহসাই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ লোকদেরকে খিলাফত সম্বন্ধে ফিতনা-ফাসাদ থেকে বাচিয়েছেন আর আজ তোমাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি নেই যাকে আবু বকর ছাড়া লোকেরা নিজেদের খলীফা করতে পারে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আবু বকর সিদ্দীকই সর্বোত্তম। ঘটনা হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর আলী, যুবায়ের ও তাদের সাথীরা ফাতিমার ঘরে অবস্থান নেন। সকল আনসার সাহাবী আমাদের থেকে পৃথক হয়ে সাকীফা বনূ সাদাহ গোত্রে সমবেত হোন। আর মুহাজির সাহাবীগণ আবু বকর সিদ্দীকের কাছে আসেন। আমি আবু বকর সিদ্দীককে বললাম, ‘আপনি আমাদের সাথে আমাদের ভাই আনসার সাহাবীদের কাছে চলুন।’ তিনি আমাদের সাথে যাত্রা করলেন। পথে দু’জন নেককার লোকের সাক্ষাৎ হয়। তারা আমাদের বললেন, ‘তোমরা আনসারদের কাছে যেয়ো না, আর মুহাজিররা পরস্পরের মধ্যে সিদ্ধান্ত স্থির করে নাও।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ’র কসম, আমরা সেখানে যাবোই।’ আমরা সাকীফা বনূ সাদাহ গোত্রে গিয়ে দেখলাম, তারা সকলে সেখানে সমবেত আর তাদের মধ্যভাগে একজন চাদর পরিহিত লোক বসে আছেন। আমি বললাম, ‘তিনি কে, আর তার কি হয়েছে ?’ লোকেরা বললো, ‘সাদ বিন উবাদা অসুস্থ।’ আমরা গিয়ে বসলে তাদের বক্তা হামদ ও সানার পর বলতে লাগলেন, ‘আমরা আনসার, আল্লাহ’র সৈনিক। হে মুহাজিরগণ, আপনারা কিছু লোক এ ইচ্ছা পোষণ করেন যে, আপনারা আমাদের উচ্ছেদ করবেন, বের করে দিবেন আর খিলাফতের সাথে সংযুক্ত রাখবেন না।’ তার অভিভাষণ শেষ হলে আমি কিছু বলতে চাইলাম, কারন এ বিষয়ে আমি আগেই একটি সুন্দর বক্তব্য তৈরি করেছিলাম। আবু বকর (রাঃ) বাধা দিলেন। মূলত আমি তার অধীনস্থ ছিলাম। তার উপর তিনি আমার চেয়ে বেশী প্রজ্ঞাবান আর সম্মানিত ছিলেন। এ জন্য আমি নীরব হয়ে গেলাম আর তাকে অসন্তুষ্ট করতে চাইলাম না। তিনি আমার চেয়ে বেশী জ্ঞানী ছিলেন। আল্লাহ’র কসম, আমি যা বলার জন্য আগেই বক্তব্য ঠিক করেছিলাম, আবু বকর শেষ পর্যন্ত সেই বক্তব্যই শুরু করলেন, বরং তার চেয়েও উত্তমভাবে বললেন – ‘আপনারা নিজেদের সম্বন্ধে যে প্রশংসা করলেন, সত্যিই আপনারা তা-ই। গোটা আরব বিশ্ব জানে যে, প্রশাসন সবসময় কুরাইশদের জন্য, কারন কুরাইশরা (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) আত্মীয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে আরব জাহানের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ। সুতরাং, খিলাফত সুনির্দিষ্টভাবে কুরাইশদের হক।’ তিনি আমার আর আবু উবাইদার হাত ধরে বললেন, ‘আমি খুশী হবো, যদি এদের মধ্য থেকে একজনের হাতে বাইয়াত দেন।’ আবু বকর যা বললেন, তা সবই আমার মনঃপূত, কিন্তু বাইয়াতের জন্য আমার নাম ঘোষণা করা আমার পছন্দ হয়নি। আল্লাহ’র কসম, আমার গর্দান উড়িয়ে দিলেও আমি অনুতপ্ত হতাম না, তবে বিব্রত বোধ করেছিলাম এ জন্য যে, আমি সে জাতির শাসনকর্তা কিভাবে হতে পারি, যেখানে আবু বকর রয়েছেন! আনসারদের মধ্য থেকে একজন বললেন, ‘আমরাও কুরাইশদের সাহায্যকারী ও সম্মানিত লোক। ভালো হবে যদি আমাদের মধ্যে থেকে একজন আর আনসারদের মধ্য থেকে একজনকে শাসক নির্ধারণ করা হয়।’ এ কথার প্রেক্ষিতে হট্টগোল শুরু হলো। আমার সন্দেহ হলো যেন সংঘাত সৃষ্টি না হয়। আমি আবু বকরকে বললাম, ‘আপনি হাত দিন।’ তিনি হাত প্রসারিত করলেন, আর আমি সর্বপ্রথম বাইয়াত করলাম, এরপর মুহাজিরগণ, এরপর আনসারগণও বাইয়াত করলেন। কি সংকটময় আর বিস্ময়কর মুহূর্তই না ছিল সেটি। আমার ভয় হচ্ছিলো যে, মুসলমানরা যেন বিভক্ত হয়ে না পড়ে। যদি তারা আলাদা বাইয়াত করতো, তবে সে ব্যক্তির কাছে আমাদের বাইয়াত করতে হতো। অথবা যদি আমরা বাধা দিতাম, তবে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতো।”

ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে নাসাঈ, হাকিম আর আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর আনসারগণ বললেন, “আমাদের আর আপনাদের মধ্য থেকে একজন করে শাসক নির্ধারণ করা হোক।” উমর বিন খাত্তাব তাদের কাছে গিয়ে বললেন, “হে আনসার সম্প্রদায়, আপনারা জানেন না, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর সিদ্দীককে আপনাদের নামাজ পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখন আপনারাই ইনসাফ করেন যে, আপনাদের মধ্যে আবু বকরের চেয়ে কোন ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম!” আনসারগণ বললেন, “নাউযুবিল্লাহ, আমরা তার চেয়ে কখনোই অগ্রগামী নই।”

আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ, হাকিম ও বায়হাকী বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর লোকেরা সাদ বিন উবাদার বাড়িতে সমবেত হোন। তাদের মধ্যে আবু বকর সিদ্দীক ও উমর ফারুকও উপস্থিত ছিলেন। একজন আনসার সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন, “হে মুহাজিরগণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউকে কোথাও পাঠালে আমাদের মধ্য থেকে একজনকে তার সাথী বানিয়ে দিতেন। সুতরাং যুক্তিসঙ্গত এটাই যে, একজন আমীর আপনাদের মধ্য থেকে আর একজন আমাদের মধ্য থেকে হোক।” এরপর কিছু আনসার সাহাবী একই ধরণের বক্তব্য পেশ করলেন। যায়েদ বিন সাবিত দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনারা কি এ কথা জানেন না যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুহাজিরদের মধ্য থেকে অন্যতম ছিলেন ? সুতরাং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খলীফাও মুহাজিরদের মধ্য থেকে হওয়া উচিত। আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্যকারী ছিলাম, আমরা তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খলীফারও সাহায্যকারী হবো।” এরপর তিনি আবু বকরের হাত ধরে বললেন, “ইনি তোমাদের নেতা আর প্রশাসক।” এরপর যথাক্রমে তিনি, উমর, মুহাজিরগণ আর আনসারগণ বাইয়াত দেন। এরপর আবু বকর সিদ্দীক মিম্বরে আরোহণ করেন আর উপস্থিত জনতার প্রতি দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, “যুবায়েরকে দেখা যাচ্ছে না, তাকে ডেকে আনুন।” তিনি এলে আবু বকর বললেন, “তুমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফুর ছেলেমেয়ে হয়ে আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী হয়ে মুসলমানদের দুর্বল করতে চাও, মুসলমানদের কোমর ভেঙে দিতে চাও?” আলী বললেন, “চিন্তা করবেন না।” এরপর তিনিও বাইয়াত দিলেন।

ইবনে ইসহাক সিরাত গ্রন্থে লিখেছেনঃ আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেছেন, “বনু সাকীফার ঘরে বাইয়াতের পরের দিন আবু বকর (রাঃ) মিম্বরে আরোহণ করেন। তিনি ভাষণ দেওয়ার আগে উমর ফারুক (রাঃ) হামদ ও সালাতের পর বললেন, “উপস্থিত জনতা, আল্লাহ আপনাদেরকে এমন একজনের কাছে সমবেত করেছেন, যিনি সকলের মধ্যে উত্তম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহচর আর গুহার সাথী। তোমরা দাঁড়াও আর তাকে বাইয়াত দাও।” লোকেরা আম (সাধারণ) বাইয়াত দিলেন। এ বাইয়াতটি সাকীফার ঘরে বাইয়াত অনুষ্ঠিত হওয়ার পরের ঘটনা। এরপর আবু বকর (রাঃ) দাঁড়িয়ে হামদ ও সানার পর বললেন, “আপনারা আমাকে খলীফা বানিয়েছেন, অথচ আমি তার যোগ্য নই, কারন আমি আপনাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ না। আমি জনহিতকর কাজ করলে আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন, আর অমঙ্গলজনক কাজ করলে আমাকে শুধরিয়ে দিবেন। সত্যবাদিতা আমানত আর মিথ্যাচার খিয়ানতের সমতুল্য। তোমাদের মধ্য থেকে দুর্বল ব্যক্তি আমার কাছে ওই পর্যন্ত শক্তিশালী, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার অধিকার বুঝিয়ে দিবো। আর অন্যের হক আদায় না করা পর্যন্ত তোমাদের শক্তিশালী লোকেরা দুর্বল হয়ে থাকবে। যে জাতি জিহাদ ছেড়ে দিয়েছে, সে জাতি অপদস্থ হয়েছে। যে সম্প্রদায়ে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে, আল্লাহ সে সম্প্রদায়কে রোগাক্রান্ত করে দেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনারা আমার অনুসরণ করবেন। আর আমি আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য না করলে আমার অনুসরণ আপনাদের জন্য বৈধ নয়। নামায পড়ুন, আল্লাহ আপনাদের প্রতি দয়া করুন।”

মুসা বিন উকবা তার রচিত মাগাযী গ্রন্থে আর আবদুর রহমান বিন আওফ (রাঃ) থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীক এ খুৎবা দেন – “আল্লাহ’র কসম, আমি কখনো রাজত্বের আকাঙ্ক্ষা করিনি, এর প্রতি আমার মোহও ছিল না, এর জন্য প্রকাশ্য কিংবা গোপনেও প্রার্থনা করিনি। মূলত আমার ভীষণ ভয় হচ্ছিলো এ জন্য যে, যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়! খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর আমার কোন আরাম ছিল না। আমার প্রতি এক বিশাল কাজ অর্পণ করা হয়েছে, যা আমার গর্দানের বহনযোগ্যতার অতিরিক্ত। কিন্তু আল্লাহ’র ক্ষমতার প্রতি আমার ভরসা ছিল।” এটা শুনে আলী (রাঃ) আর যুবায়ের (রাঃ) বললেন, “আমরা এ কারনে অনুতপ্ত হলাম যে, খিলাফতের পরামর্শে কেন আমরা অংশগ্রহণ করলাম না। আমরা খুব ভালো করে জানতাম যে, আবু বকর সিদ্দীকই খিলাফতের সবচেয়ে বেশী হকদার। কারন তিনি গুহায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথী ছিলেন। আমরা তার গুণাবলী সম্পর্কে জানি। আমরা এটাও জানি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের জীবদ্দশাতেই আবু বকরকে নামাযের ইমামতির নির্দেশ দিয়েছিলেন।”

ইব্রাহীম তামিমী থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর আবু উবাইদা বিন জাররাহ (রাঃ) এর কাছে উমর (রাঃ) গিয়ে বললেন, “আমি আপনার হাতে বাইয়াত করবো, কারন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে ‘আমীন’ (বিশ্বস্ত) বলেছেন, এ কথা আমি  চাক্ষুস শুনেছি।” আবু উবাইদা বললেন, “আমি আপনাকে বুদ্ধিমান মনে করি, কিন্তু আজ কেন মেধাহীনতার পরিচয় দিলেন ? আপনি আমাকে বাইয়াত দিতে চাচ্ছেন, অথচ আপনাদের মধ্যে সিদ্দীক, সানীয়াসনাইনি আর ফিল গার জীবিত।” (টীকাঃ এ তিনটিই হল আবু বকরের উপাধি)

মুহাম্মাদ থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন যে, উমরকে আবু বকর বলেছিলেন, “হাত দিন, আমি আপনার হাতে বাইয়াত করতে চাই।” উমর বললেন, “আপনি আমার চেয়ে বেশী বুযুর্গ।” আবু বকর বললেন, “আপনি আমার চেয়ে বেশী শক্তিশালী।” এভাবে কথাবার্তা চলতে থাকে। অবশেষে উমর বললেন, “আপনি আমার চেয়ে বেশী বুযুর্গ আর আমার প্রতাপ আপনার জন্য থাকবে।” এরপর তিনি আবু বকরকে বাইয়াত দিলেন।

আবদুর রহমান বিন আওফ (রাঃ) বলেছেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের সময় আবু বকর মদিনার জন্য অন্য কোথাও ছিলেন। সংবাদ পেয়ে তিনি ছুটে আসেন আর চেহারা থেকে কাপড় সরিয়ে চুমু দিয়ে বললেন, “আমার মাতাপিতা আপনার প্রতি কুরবান হোক। জীবিত অবস্থায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেমন সুশ্রী ও পবিত্রতম ছিলেন, মৃত্যুর পরও একই রকম সুদর্শন ও পবিত্রতম রয়েছেন। কাবার রবের কসম, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন।” আবদুর রহমান বিন আওফ বর্ণনা করেনঃ এরপর আবু বকর আর উমর আনসারদের কাছে গেলেন। আবু বকর সেখানে গিয়ে ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণে আনসারদের সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে বিধৃত সকল প্রশংসার উল্লেখ করে বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – ‘যদি সমস্ত লোক এক বনে আর আনসারগণ অন্য বনে চলে যায়, তবে আমি আনসারদের সাথেই যাবো।’ হে সাদ, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের সামনে বলেছিলেন, খিলাফত কুরাইশদের জন্য। ভালো লোকেরা ভালো কাজের আর মন্দ লোকেরা মন্দ কাজের আনুগত্য করবে।” সাদ জবাবে বললেন, “আপনি সঠিক বলেছেন। আমরা মন্ত্রী আর আপনারা বাদশাহ।” (আহমদ)

আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ বাইয়াত গ্রহণের পর আবু বকর সিদ্দীক চেহারা দেখে ধারণা করলেন যে, কিছু লোকের মাঝে অসন্তোষের ছাপ বিরাজ করছে। তাই তিনি বললেন, “হে লোকসকল, কোন কাজ তোমাদেরকে অসন্তুষ্ট করে রেখেছে ? আমি কি সর্বপ্রথম মুসলমান হইনি ? … হইনি ? … হইনি ?” তিনি নিজের কিছু গুণাবলী বর্ণনা করে বললেন, “তোমাদের মধ্য থেকে আমি সবচেয়ে বেশী খিলাফতের হকদার।”

আহমদ লিখেছেন যে, রাফে তাঈ বর্ণনা করেছেনঃ আমার কাছে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) নিজের খিলাফতের সকল ঘটনা বলে শুনিয়েছেন। উমর আর আনসার সাহাবীগণ যা বলেছিলেন, তা আমাকে বলার পর তিনি বললেন, “এরপর লোকেরা আমাকে বাইয়াত দেয়, আর এ কারনে আমি খিলাফতের দায়িত্ব নিলাম যে, কোথাও যেন বিশৃঙ্খলা দেখা না দেয় আর চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার পর লোকেরা যেন মুরতাদ না হয়ে যায়।”

ইবনে ইসহাক আর ইবনে আবিদ কিতাবুল মাগাযী রাফে থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আমি আবু বকর সিদ্দীককে বললাম, “আপনি আমাকে দু’জন লোকের শাসন থেকে দূরে থাকতে বলেছেন, অথচ আপনি নিজেই শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন কেন ?” তিনি বললেন, “আমি তাদের নিন্দাকারী নই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত বিভক্ত হয়ে যাবে বলে আমার আশংকা ছিল।”

কায়েস বিন আবু হাযেম বলেছেনঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর আমি আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর খেদমতে বসেছিলাম। তিনি বাইয়াতের সব ঘটনা বর্ণনা করছিলেন, এমন সময় নামাজের ঘোষণা দেওয়া হলো। সাহাবীগণ সমবেত হলেন। তিনি মিম্বরে আরোহণ করে বললেন, “উপস্থিতি, আমি স্বেচ্ছায় সম্মত যে, আপনারা অন্য কাউকে খলীফা বানিয়ে নিন। কারন আপনারা যদি আমার মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুবহু পথ খুঁজে পেতে চান, তবে তা আমার ক্ষমার অতীত। কারন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শয়তান থেকে নিরাপদ ছিলেন আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে ওহী আসতো।”

হাসান বসরী থেকে নকল করে ইবনে সাদ লিখেছেনঃ বাইয়াত দেওয়ার পর আবু বকর সিদ্দীক মিম্বরে আরোহণ করে হামদ ও সানার পর বললেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হে সাহাবীগণ, যদিও আমি খলীফা হয়েছি, কিন্তু এতে আমি খুশী নই। আল্লাহ’র কসম, যদি আপনাদের মধ্যে কেউ এ কাজের দায়িত্ব নিতে চান, তবে তিনি নিজ হাতে তা গ্রহণ করুন। যখন আপনারা এ গুরুভার একতাবদ্ধ হয়ে আমার উপর চাপিয়েছেন, তখন আমি অবিকল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মতো করে চালাতে পারবো না, সেটা সম্ভবও না। কারন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ওহী নাযিল হতো। আমি আপনাদের মতোই একজন মানুষ। আমি কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে সঠিক পথ অনুসরণ করতে দেখবেন, আমার অনুসরণ করবেন। আর চুল পরিমাণ বিচ্যুতি দেখলে সংশোধন করে দিবেন। মনে রাখবেন, শয়তান আমার সাথেও লেগে আছে। যখন আমি রেগে যাবো, তখন আমার থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। কবিতার মাধ্যমে আমার প্রশংসা গাঁথা আবৃত্তি করবেন না।”

ইবনে সাদ ও খতীব মালিক এবং তিনি উরওয়া থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) খলীফা হওয়ার পর তার ভাষণে হামদ ও সানা পড়ে বললেন, “যদিও আমি আপনাদের নেতা, কিন্তু আমি আপনাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই। কুরআন নাযিল হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্নতের পথ দেখিয়েছেন আর আমরা তা খুব ভালো করে বুঝে নিয়েছি – আপনারা সে পথই অনুসরণ করবেন। বুদ্ধিমান তো সে-ই, যে পরহেজগার; আর পাপাসক্ত ব্যক্তি হল সবচেয়ে বেশী বোকা। জনতার প্রাপ্য বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমি মিল্লাতের কাছে দুর্বল। হে উপস্থিতি, আমি সুন্নতের অনুসারী, বিদআতী নই। ভালো কাজ করলে আমাকে সাহায্য করবেন, আর মন্দ কাজ করতে দেখলে সাবধান করে দিবেন। আমি এতটুকুই বলতে চাই। আল্লাহ’র কাছে নিজের আর তোমাদের সবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

ইমাম মালিক (রহঃ) বলেছেন, “উল্লেখিত শর্তাবলী ছাড়া কোন ব্যক্তি ইমাম হতে পারে না।”

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে মুসতাদরাক গ্রন্থে হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর মক্কা শরীফে চরম ব্যাকুলতা ও বিলাপের সুর উঠে। আবু কুহাফা কান্নার আওয়াজ শুনে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে ?” বলা হলো, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন।” তিনি বললেন, “আফসোস, অনেক বড় কাজ ও গুরুদায়িত্ব এসে গেলো।” এরপর জিজ্ঞেস করা হলো, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্থানে কে বসবেন ?” বলা হলো, “আপনার ছেলে ?” তিনি বললেন, “বনূ আব্দে মানাফ আর বনূ মুগীরা গোত্রদ্বয় কি তা মেনে নিবে ?” বলা হলো, “হ্যা।” তিনি বললেন, “আল্লাহ যাকে বড় করতে চান তাকে কেউ ছোট এবং যাকে ছোট করতে চান তাকে কেউ বড় করতে পারবে না।”

ওকেদী কয়েক পদ্ধতিতে আয়েশা সিদ্দীকা, ইবনে উমর, সাঈদ বিন মুসাইয়াব ইন্তেকালের দিন একাদশ হিজরির বারো রবিউল আউয়াল সোমবারে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে তাবারানী আওসাত গ্রন্থে বর্ণনা করেন, “আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) কখনো মিম্বরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্থানে বসেননি, এভাবেই তার মৃত্যু হয়ে যায়।  উমর ফারুক আবু বকর সিদ্দিকের স্থানে আর উসমান গনী উমর ফারুকের স্থানে জীবনের শেষ প্রহর পর্যন্ত বসেননি।”

 

বিবিধ ঘটনাবলী

উমর (রাঃ) বলেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর আরবের কিছু লোক মুরতাদ হয়ে বলতে লাগলো, “আমরা নামায পড়বো, কিন্তু যাকাত দিবো না।” আমি আবু বকর সিদ্দীকের কাছে উপস্থিত হয়ে বললাম, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হে খলীফা, আপনি মানুষের মনকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করুন আর তাদের প্রতি নমনীয়তা দেখান। তারা তো অসভ্য জাতি।” আবু বকর সিদ্দীক বললেন, “আমি আপনার সহযোগিতা কামনা করতাম, কিন্তু আপনি তো আমার ভাবনার প্রাসাদ ধ্বংস করেছেন। অন্ধকার যুগে আপনি বড়ই কার্যক্ষম ব্যক্তি ছিলেন, ইসলাম গ্রহণ করে আপনি অলস হয়ে গেছেন। আমি তাদের মনকে কিভাবে আকৃষ্ট করবো ? আল্লাহ ক্ষমা করুন, আমি কি তাদের জাদু করবো ? আফসোস, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন, ওহী বন্ধ হয়ে গেছে। আল্লাহ’র কসম, যদি তারা একটি দড়ি দিতেও অস্বীকার করে, আমার হাতে তলোয়ার থাকা পর্যন্ত আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো।” উমর (রাঃ) বলেন, “আমি তাকে এ কাজে এতো বেশী কঠোর হাতে দেখেছি যে, তিনি এভাবেই মানুষকে সঠিক পথে এনেছেন।”

আবুল কাসেম বাগবী আর আবু বকর শাফেঈ রচিত ফাওয়ায়েদ গ্রন্থে এবং আয়েশা (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালে অপবিত্রতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আরবের বৃহৎ অংশ মুরতাদ হয়ে যায়, আনসারগণ পৃথক হয়ে যান। পাহাড়ও এ সমস্যাগুলো বহন করতে পারতো না। কিন্তু আমার পিতা আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বিস্ময়কর ধৈর্যের সাথে সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করেছেন আর মতভেদযুক্ত প্রতিটি মাসআলার সঠিক সমাধান দিয়েছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোথায় সমাহিত করা হবে তা নিয়ে সর্বপ্রথম মতভেদ দেখা যায়। সকলেই এ ব্যাপারে নীরব ছিলেন আর কেউ কিছু জানতেন না। আবু বকর সিদ্দীক বললেন, “আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, মৃত্যুর স্থানেই প্রত্যেক নবীকে সমাহিত করা হয়।” দ্বিতীয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিরাস নিয়ে মতভেদ দেখা দিলে আবু বকর সিদ্দীক বললেন, “আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, নবীদের কোন উত্তরাধিকারী নেই। তাদের সকলের সম্পদ সদকা হিসেবে বিবেচিত।”

ওলামায়ে কেরাম বলেন, “সর্বপ্রথম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাফন নিয়ে মতভেদ হয়। কিছু সাহাবী বলেন, ‘নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মস্থান মক্কা শরীফে দাফন করা উচিত। কেউ বলেন, ‘মসজিদে নব্বীতে’, কেউ বলেন, ‘জান্নাতুল বাকীতে’, কেউ আবার বাইতুল মুকাদ্দাসের কথা বলেন; অবশেষে আবু বকর সিদ্দীক এ সম্বন্ধে যে অভিমত প্রকাশ করলেন, তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলো।”

ইবনে যানজুয়া বলেন, “এটা আবু বকরের হাদিসই ছিল। কিন্তু সকলই মুহাজির ও আনসারদেরকে তার বিশাল জ্ঞানের প্রতি ঝুকিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল।”

বায়হাকি ও ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন, “এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ’র কসম, আবু বকর খলীফা না হলে পৃথিবীতে কেউ ইবাদাত করতো না।” তিনি এভাবে তিনবার বললেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, “হে আবু হুরায়রা, আপনি একথা বলছেন কেন ?” তিনি বললেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উসামা বিন যায়েদকে সাতশো সৈন্যসহ রোমে পাঠান। তিনি শুষ্ক সীমানা অতিক্রম না করতেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন আর মদিনার পার্শ্ববর্তী আরব জনগোষ্ঠী মুরতাদ হয়ে যায়। সাহাবাগণ আবু বকরকে বললেন, “আপনি উসামা বাহিনীকে ফিরিয়ে নিন, কারন মদিনার পার্শ্ববর্তী লোকেরা মুরতাদ হয়ে গেছে। এখন আর তার প্রয়োজন নেই।” তিনি বললেন, “এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ’র কসম, যদি আল্লাহ’র পয়গম্বরের বিবিদের পা নিয়ে কুকুরের দল টানা হেঁচড়া করে, তবুও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বাহিনী পাঠিয়েছেন, তা আমি ফিরিয়ে নিবো না, আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে পতাকা উড়িয়েছেন তা নামিয়ে নিবো না।” সুতরাং তিনি উসামা বাহিনীকে আবার পাঠালেন। উসামা পথিমধ্যে যে গোত্রের মুখোমুখি হয়েছেন, সকল গোত্রই বাধা দিয়েছে আর পরাজিত হয়েছে। ফলে তারা পরস্পরে এ কথা বলেছে যে – যদি মুসলমানদের শক্তি না থাকতো, তবে তারা এ মুহূর্তে অন্য জাতির প্রতি সৈন্য পাঠাতো না। সুতরাং দেখুন, রোমানদের মোকাবিলায় ফলাফল কি হয়েছিলো। যখন এ বাহিনী রোম সাম্রাজ্যের সীমানায় প্রবেশ করে, তখন উভয় দিক থেকে আক্রমণ হয় আর মুসলিম বাহিনী বিজয় অর্জন করে নিরাপদে ফিরে এলে সকলেই ইসলামকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে।

হযরত উরওয়া (রাঃ) বলেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমূর্ষু অবস্থায় উসামা বাহিনীকে যাত্রা করার নির্দেশ দেন। জরফ নামক স্থানে উসামা পৌঁছলে তার স্ত্রী ফাতিমা বিনতে কায়েস লোক মারফত জানালেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্তিম শয্যায় শায়িত, আপনি তাড়াহুড়ো করবেন না।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকাল হলে আবু বকরের কাছে উপস্থিত হয়ে উসামা বললেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে রোম সাম্রাজ্যে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সংকটময় অবস্থা। আমার আশংকা হচ্ছে আরবের লোকেরা মুরতাদ হয়ে যেতে পারে। যদি তারা মুরতাদ হয়ে যায়, তবে আমি সর্বপ্রথম তাদের সাথে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত আছি। আর যদি তারা মুরতাদ না হয়, তবে আমি চলে যাবো। আমার সাথে যেসব তরুণ সৈনিক আর বড় বড় সর্দারগণ ছিলেন, তাদেরকে আমি নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইছি।” আবু বকর সিদ্দীক লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আল্লাহ’র কসম, যদি আমার প্রাণ বিপন্ন হয় আর হিংস্র পাখীরা আমার শরীরের গোশত খেয়ে ফেলে, তবুও আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ সামান্যতমও সংশোধন ও পরিমার্জন করবো না।” এ বলে তিনি উসামা বাহিনী আবার পাঠিয়ে দিলেন। (ইবনে আসাকির)

যাহাবী বলেছেনঃ মদিনার চারদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে অনেক গোত্র ইসলাম ত্যাগ করে আর যাকাত দিতে অস্বীকার করলে আবু বকর সিদ্দীক তাদের কাছে সৈন্য পাঠান। কিন্তু উমর বাধা দেন। সিদ্দীকে আকবর বললেন, “আল্লাহ’র কসম, তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছাগলের বাচ্চার যে যাকাত দিতো, তা এক বছরের জন্য দিতে অস্বীকার করলে আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো।” উমর বললেন, “আপনি কিভাবে যুদ্ধ করবেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে বলেছেন – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) না বলা পর্যন্ত আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করবো, এ কালেমা পাঠ করলে তার জান ও মাল আমার জিম্মায়। কিন্তু যাকাত দিতে হবে – এর হিসাব আল্লাহ’র জিম্মায়। এবার বলুন কিভাবে যুদ্ধ হতে পারে ?” সিদ্দিকে আকবর বললেন, “আল্লাহ’র কসম, নামায ও যাকাতের মধ্যে পরিবর্তন করার জন্য আমি যুদ্ধ করবো। কারন যাকাত মালের হক, আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – যাকাত আদায় করতে হবে।” উমর বললেন, “আল্লাহ’র কসম, আবু বকরের বুক খুলে দেওয়া হয়েছিলো। আমিও বুঝলাম তিনি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।”

উরওয়া (রাঃ) বলেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) মুহাজির ও আনসারদের নিয়ে নজদের নিকটবর্তী হয়ে মুরতাদদের পরাজিত করলে কিছু মন্দ চরিত্রের লোকেরা নিজেদের বউ-বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে যায়। ফলে লোকেরা তাকে বললো, “আপনি ফিরে যান আর সৈনিকদের মধ্যে একজনকে সেনাপতি বানিয়ে পাঠিয়ে দিন।” লোকেরা এ ব্যাপারে জোরাজুরি করলে তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদকে সেনাপতি বানিয়ে ফিরে এলেন। আসার সময় বললেন, “তারা ইসলামে ফিরে এলে আর যাকাত দিতে সম্মত হলে আপনাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা মদিনায় ফিরে যেতে পারবেন।”

ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেনঃ সিদ্দীকে আকবর ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে জিহাদে যাত্রার প্রাক্কালে আলী ঘোড়ার রজ্জু ধারণ করে বললেন, “আমি আপনাকে সে কথাই বলতে চাই যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উহুদ যুদ্ধে আপনাকে বলেছিলেন – তরবারি কোষবদ্ধ করুন, যাতে আকস্মিক কোন ঘটনাই না ঘটে আর আপনি মদিনায় ফিরে চলুন। আল্লাহ’র কসম, আল্লাহ না করুন, যদি আপনার কিছু হয় তাহলে এখানে এমন কেউ নেই যিনি ইসলামের ব্যবস্থাপনা অক্ষুণ্ণ রাখবেন।” (দারা কুতনী)

খানযালা বিন আলী লাইসী বলেছেনঃ খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) কে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বাহিনীর আমীর বানিয়ে পাঠানোর সময় নসিহত করলেন, “তাদেরকে পাঁচটি আহকাম পালনের নির্দেশ দিবে। যদি একটি হুকুমও তারা অস্বীকার করে, তবে তাদের সাথে এমনভাবে লড়াই করবে, পাঁচটি আহকাম অস্বীকারকারীদের সাথে যেভাবে লড়াই করো। সেই পাঁচটি আহকাম হলো –

(১) আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রাসুল,

(২) নামায পড়তে হবে,

(৩) যাকাত দিতে হবে,

(৪) রোযা রাখতে হবে,

(৫) বাইতুল্লাহ শরীফে এসে হাজ্জ আদায় করতে হবে।”

খালিদ বিন ওয়ালিদ তার বাহিনী নিয়ে জমাদিউল আখির মাসে রওনা দেন। বনী আসাদ ও গাতফান গোত্রের সাথে তার যুদ্ধ হয়। অনেক মুরতাদ নিহত, অনেক বন্দী আর বাকিরা আবার মুসলমান হয়। সাহাবীদের মধ্যে আকাশা বিন মুহসিন আর সাবেত বিন আরকাম খালিদ বিন ওয়ালীদের সাথে ছিলেন। এ বছর রমযান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেয়ে জান্নাতের নেত্রী ফাতেমা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। যাহাবী বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধারা ফাতেমা থেকেই সূচিত হয়।”

যুবায়ের বিন বাকার বলেছেনঃ ফাতেমা (রাঃ) এর এক মাস আগে উম্মে আয়মান ইন্তেকাল করেন আর শাওাল মাসে আবদুল্লাহ বিন আবু বকরের মৃত্যু হয়। এ বছরের শেষ দিকে খালিদ তার বাহিনী নিয়ে মুসায়লামা কাযযাবকে হত্যা করার জন্য ইয়ামামায় পৌঁছলে উভয় বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। অবশেষে কয়েকটি দুর্গ বিজিত হওয়ার পর হামযা (রাঃ) এর হত্যাকারী ওয়াহশী মুসায়লামাকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় যারা শহীদ হোন তারা হলেন – আবু হুযায়ফা বিন উতবা, আবু হুযাইফার গোলাম সালিম, শুজা বিন ওয়াহাব, যায়েদ বিন খাত্তাব, আবদুল্লাহ বিন সহল, মালিক বিন আমর, তোফায়েল বিন আমর দৌসী, ইয়াযিদ বিন কায়েস, আমের বিন বাকার, আবদুল্লাহ বিন মুহরেমা, সায়িব বিন উসমান বিন মাজউন, উবাদা বিন বশর, মাআন বিন আদী, সাবিত বিন কায়েস বিন শামাস, আবু দুজানা, সামাক বিন হরব প্রমুখ।

মুসায়লামা কাযযাবের বয়স হয়েছিলো দেড় শত বছর। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতা আবদুল্লাহ’র চেয়ে বয়সে বড় ছিল।

দ্বাদশ হিজরিতে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আলা বিন হাযরামীকে বাহরাইনে পাঠান। সেখানেও লোকেরা ধর্ম ত্যাগ করেছিলো। জাওয়াসী নামক স্থানে লড়াই হয়। মুসলমানরা বিজয় অর্জন করেন। ওমানেও এ ফিতনা মাথাচাড়া দেওয়ার কারণে ইকরামা বিন আবু জাহেলকে তাদের দমনের জন্য পাঠানো হয়। আবু উমাইয়াকে মুহাজিরদের দলপতি করে বাইরে এ ফিতনা দমনের জন্য পাঠানো হয়। যিয়াদ বিন লাবীদ আনসারীকে আরেক দিকে পাঠানো হয় একদল ধর্মত্যাগীকে শায়েস্তা করার জন্য। এ বছর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামাতা আবুল আস বিন রবীআ ইন্তেকাল করেন। সুআব বিন জিসামা লাইসী আর আবু মুরসাদ গুনুভীও এ বছর ইন্তেকাল করেন।

মুরতাদদের ফিতনা দমনের পর আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) খালিদ বিন ওয়ালিদকে বসরায় পাঠান আর লড়াই করে আয়লা শহর বিজিত করেন। এরপর কিছু সন্ধি কিছু যুদ্ধ করে ইরাকের মাদায়েন শহর দখল হয়। দ্বাদশ হিজরিতে বাইতুল্লাহ যিয়ারত থেকে ফিরে এসে আমর বিন আসকে শামে পাঠান।

শামে তের হিজরিতে যুদ্ধ হয় আর বিজয়ের মুকুট মুসলমানদের মাথায় প্রতিস্থাপিত হয়। কিন্তু আবু বকরে (রাঃ) এর কাছে যখন এ সুসংবাদ পৌঁছে, তখন তিনি মৃত্যু পথযাত্রী। এ যুদ্ধে ইকরামা বিন আবু জাহেল আর হিমাম বিন আসসহ অন্যান্য সাহাবী অংশগ্রহণ করেন। এ বছর মরজুস সফর যুদ্ধ হয় আর এ যুদ্ধে মুশরিকরা পরাজিত হয়। এ ঘটনায় অন্যান্যদের সাথে ফযল বিন আব্বাস (রাঃ) শহীদ হোন।

 

কুরআন একত্রিত করার বিবরণ

সহিহ বুখারী শরীফে যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ মুসায়লামা কাযযাবের সাথে যুদ্ধের পর আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি এসে দেখলাম, তার কাছে উমর (রাঃ) নীরবে বসে আছেন। আবু বকর আমাকে বললেন, “উমর আমাকে বলেছেন, ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক মুসলমান ক্বারি শহীদ হয়েছেন। আমার ভয় হয়, যদি এভাবে মুসলিম ক্বারিগণ শহীদ হতে থাকেন, তাহলে হাফেযদের সাথে কুরআন শরীফও উঠে যাবে। তাই আমি কুরআনকে একত্রিত করতে চাই।” আমি বললাম, “আমি এ কাজ কিভাবে করতে পারি, যা স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি ?” উমর বললেন, “আল্লাহ’র কসম, এটি সওয়াবের কাজ, এতে কোনই ক্ষতি নেই।” তিনি বারবার অনমনীয়ভাবে এ কথা বলছিলেন, অবশেষে বিষয়টি ভালোভাবে আমার বুঝে আসলো।

যায়েদ (রাঃ) বলেছেনঃ  উমর নীরবে শুনছিলেন। আবু বকর (রাঃ) আবার আমাকে বললেন, “তুমি তরুণ ও বুদ্ধিমান। তোমার ব্যাপারে কোন অভিযোগও নেই। তুমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওহী লেখক। সুতরাং অনুসন্ধান করে তুমি কুরআন জমা করো।”

যায়েদ (রাঃ) বলেছেনঃ এ কাজটি আমার কাছে খুবই দুঃসাধ্য মনে হলো। আমাকে যদি পর্বত উত্তোলনের নির্দেশ দেওয়া হতো, তাহলে আমি একে (পর্বত উত্তোলনকে) তার চেয়ে (অর্থাৎ, কুরআন সংকলনের কাজের চেয়ে) হালকা মনে করতাম।” আমি বললাম, “আপনারা দুজন কেন এ কাজ করতে চাইছেন, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি ?” আবু বকর (রাঃ) বললেন, “এ কাজে কোনই ক্ষতি নেই।” কিন্তু আমি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম আর নিজেকে এ কাজের অনুপযুক্ত মনে করলাম। অবশেষে আল্লাহ আমার অন্তরচক্ষু খুলে দিলেন আর বিষয়টি খুবই সুন্দরভাবে বুঝতে পারলাম। আমি অনুসন্ধান শুরু করলাম আর কাগজের টুকরো, উট ও ছাগলের রানের হাড়, গাছের পাতা, হাফেযদের মুখস্ত জ্ঞান থেকে কুরআন সংগ্রহ করে জমা করলাম। সূরা তাওবার দুটো আয়াত – لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ  খুযাইমা বিন সাবেত (রাঃ) ছাড়া অন্য কারো কাছে পাইনি। কুরআন জমা করে আমি তা আবু বকরের কাছে পেশ করলাম, যা মৃত্যু অবধি তার কাছেই ছিলো। এরপর তা উমরের হস্তগত হয়। তার মৃত্যুর পর হাফসা বিনতে উমর (রাঃ) তা সংরক্ষণ করেন।

আলী (রাঃ) এর বরাত দিয়ে আবু ইয়ালা বলেন, “কুরআন শরীফ জমা করার সবচেয়ে বেশী সওয়াব আবু বকর সিদ্দীকের প্রাপ্য। কারন তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বপ্রথম কুরআন শরীফকে গ্রন্থাকারে রূপ দেন।”

 

তিনি সর্বপ্রথম যা যা করেছেন

আবু বকর সিদ্দীক সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি সর্বপ্রথম কুরআন জমা করেছেন আর কুরআনকে মাসহাফ নাম দিয়েছিলেন। তাকে সর্বপ্রথম খলীফা বলা হয়েছে।

আবু বকর বিন আবু মালিকা থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকরকে আল্লাহ’র খলীফা বলা হলে তিনি বললেন, “আমি আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খলীফা। আমি এতেই সন্তুষ্ট আর এটাই আমার গৌরব।”

তিনি সর্বপ্রথম খলীফা, যিনি তার পিতার জীবদ্দশায় খলীফা হোন। তিনিই সর্বপ্রথম খলীফা, যার প্রজারা তার জন্য ভাতা নির্ধারণ করেছিলো।

বুখারী শরীফে আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ আমার সম্প্রদায় জানে যে, আমার উপার্জন পরিবারের খরচ জোগাতে সক্ষম না। আবার, আমি খিলাফতের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ফলে আমার কোনো উপার্জন নেই। সুতরাং, আমার পরিবারকে আমি বাইতুল মাল থেকে খাদ্য দিবো।

আতা বিন সায়েব থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর (রাঃ) বাইয়াতের দ্বিতীয় দিন কিছু চাদর নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। উমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় চলেছেন ?” তিনি বললেন, “বাজারে।” উমর বললেন, “আপনি এগুলোর (ব্যবসা) ছেড়ে দিন, আপনি জনগণের খলীফা।” তিনি বললেন, “আমার পরিবার কি খাবে ?” উমর বললেন, “আপনি চলুন, আপনার জন্য আবু উবায়দা (ভাতা) নির্ধারণ করবেন।” তারা আবু উবায়দা (রাঃ) এর কাছে গিয়ে বললেন, “আবু বকর আর তার পরিবার-পরিজনের জন্য একজন মধ্যম মানের মুহাজিরের খোরাকী নির্ধারণ করে নিত্যদিনের খোরাকী এবং শীত ও গ্রীষ্মকালীন পোশাক নির্ধারণ করে দিন। কিন্তু যখন এগুলো পুরনো হয়ে যাবে, তখন এগুলোর পরিবর্তে নতুন কাপড় নিয়ে নিবেন।” তিনি আবু বকরের জন্য প্রতিদিনের খাবার হিসেবে অর্ধেক ছাগলের গোস্ত, শরীর ঢাকার উপযোগী কাপড় আর পেট ভর্তি রুটি নির্ধারণ করলেন।

মাইমুন থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর খলীফা নির্বাচিত হওয়ার সময় তার জন্য বার্ষিক দুই হাজার দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করা হয়। ফলে তিনি বলেন, “আমার পারিবারিক পরিসর বৃহৎ, এতে আমার চলবে না। আপনাদের প্রদত্ত খিলাফতের দায়িত্ব আমাকে ব্যবসা করতে বাধা দিচ্ছে, কিছু বাড়িয়ে দিন।” ফলে পাঁচশো দিরহাম বৃদ্ধি করা হলো।

হাসান বিন আলী বিন আবু তালিব (রাঃ) থেকে তাবারানী তার মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর মৃত্যুর সময় আয়েশা সিদ্দীকাকে বললেন, “যতক্ষণ মুসলমানদের কাজ করবো, যে উটনীর দুধ আমি পান করি, যে পেয়ালা আর চাদর আমি ব্যবহার করি, তা আমার জন্য বৈধ। আমার মৃত্যুর পর সেগুলো উমরকে দিয়ে দিবে, কারন সেগুলো বাইতুল মাল থেকে নেওয়া হয়েছে।” তার মৃত্যুর সময় আয়েশা (রাঃ) সেগুলো উমর (রাঃ) এর কাছে পাঠিয়ে দেন। উমর বলেন, “আল্লাহ আবু বকরের প্রতি রহম করুন, তিনি তার এ সকল কষ্ট আমার কারনে সহ্য করেছেন।”

আবু বিন হাফস থেকে ইবনে আবিদ দুনিয়া বর্ণনা করেছেনঃ মৃত্যুর সময় আবু বকর (রাঃ) আয়েশা সিদ্দীকাকে বললেন, “হে আমার কন্যা, যদিও আমি মুসলমানদের খলীফা ছিলাম, কিন্তু আমি কখনোই অর্থ সম্পদ অর্জন করিনি। খুব সাধারণভাবেই খাবার-দাবার করেছি। হাবশী গোলাম, উটনী আর পুরনো চাদর ছাড়া বাইতুল মাল থেকে আমি আর কিছু গ্রহণ করিনি। আমার মৃত্যুর পর এগুলো উমরের কাছে পাঠিয়ে দিয়ো।”

তিনি সর্বপ্রথম বাইতুল মাল প্রতিষ্ঠা করেন। সহল বিন আবী খাইসামা থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ সিদ্দীকে আকবরের যুগে বাইতুল মালে কোন পাহারাদার ছিল না। লোকেরা বললো, “আপনি বাইতুল মালে পাহারাদার নিয়োগ করেননি কেন ?” তিনি বললেন, “তালা লাগিয়ে রাখার পরও পাহারাদারের প্রয়োজন কি?” বস্তুত, বাইতুল মালে কিছু এলেই তা মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হতো আর বাইতুল মাল শুন্য হয়ে থাকতো। এক বছর পর বাইতুল মাল আবু বকর তার বাড়িতে স্থানান্তরিত করে নিয়ে যান। যখনই মাল আসতো, তিনি গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন আর কখনো উট, ঘোড়া, অস্ত্র কিনে আল্লাহ’র রাস্তায় দিয়ে দিতেন। একবার তিনি চাদর কিনে মদিনায় বিধবাদের মধ্যে বিতরন করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে সমাহিত করে উমর কয়েকজন সম্মানিত সাহাবী – যাদের মধ্যে আব্দুর রহমান বিন আওফ ও উসমান বিন আফফান ছিলেন, তাদের নিয়ে হিসাব পরীক্ষা করার জন্য বাইতুল মালে গিয়ে দেখেন আল্লাহ’র নাম ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই।

আমার (গ্রন্থাকারের) মতে, উক্ত বর্ণনা দিয়ে রাওয়েলে আসকারীদের মতামত খণ্ডিত হয়েছে। তাদের মতে, বাইতুল মালের প্রতিষ্ঠাতা উমর (রাঃ)। তাদের এ অভিমতটি আমি তাদের এক গ্রন্থে দেখেছি। তাদের আরেক রচনায় আমি এটাও দেখেছি যে, আবু বকরের বাইতুল মালের সর্বপ্রথম রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন আবু উবায়দা।

হাকিম বলেন, “আবু বকর ইসলামের প্রাথমিক যুগে আতিক উপাধিতে প্রসিদ্ধ ছিলেন।”

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বুখারী ও মুসলিম শরীফে জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি বাহরাইন থেকে গনিমতের মাল আসে, তবে আমি তোমাকে এই এই দিবো।” তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের পর বাহরাইন থেকে গনিমতের মাল এলে সিদ্দীকে আকবর ঘোষণা দিলেন, “এমন কেউ আছেন, যিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কিছু পাবেন, অথবা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাউকে কিছু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ?” আমি উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, “এখান থেক গ্রহণ করো।” আমি গ্রহণ করলাম, যা গণনা করে পাঁচশত মুদ্রা হলো, কিন্তু তিনি আমাকে দেড় হাজার মুদ্রা দিলেন।

 

দয়া ও নম্রতা

উনাইসা থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যেঃ আবু বকর খিলাফতের আগে তিন বছর আর খিলাফতের পর এক বছর আমার সাথে ছিলেন। যখন পাড়ার মেয়েরা ছাগল নিয়ে আসতেন, তখন তিনি দুধ দোহন করে দিতেন।

মাইমুনা (রাঃ) বলেছেনঃ আবু বকরের কাছে এক ব্যক্তি এসে বললো, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হে খলীফা, আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।” তিনি বললেন, “সকল মুসলমানের প্রতিও।” (আহমাদ)

আবু সালিম গিফারী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ উমর (রাঃ) এক পঙ্গু ও অন্ধ বৃদ্ধার সেবা করতেন। সে মদিনার পাশে বসবাস করতো। তিনি তাকে খাওয়াতেন। একদিন তিনি তার কাছে গেলে বৃদ্ধা বললেন, “আপনি আসার আগে কে যেন এসে প্রতিদিন আমার সেবা করে যান।” তিনি আশ্চর্য হোন। এমন সময় আবু বকর বেরিয়ে আসেন। সে সময় তিনি খলীফা। তাকে দেখে উমর বললেন, “আল্লাহ’র কসম, আপনি ছাড়া সেই ব্যক্তি কেউ হতে পারেন না।”

আব্দুর রহমান আসবাহানী থেকে আবু নুয়াইম প্রমুখ বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আবু বকর মিম্বরে আরোহণ করেছিলেন, এমন সময় হাসান বিন আলী এসে পড়লেন, সে সময় তিনি কিশোর, তিনি বললেন, “এ মিম্বর আমার বাবার, আপনি নেমে যান।” তিনি বললেন, “তুমি সত্য বলেছো, এ মিম্বর তোমার বাবার।” এ কথা বলে তিনি তাকে কোলে তুলে নিলেন আর ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আলী (রাঃ) বললেন, “আল্লাহ’র কসম, এ সম্বন্ধে তাকে আমি কিছুই বলিনি।” তিনি বললেন, “তুমি সত্যিই বলেছো, আমি তোমাকে সন্দেহ করছি না।”

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ ইসলাম সর্বপ্রথম যে হাজ্জ অনুষ্ঠিত হয়, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে আবু বকরকে পাঠিয়েছিলেন। এর পরের বছর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজ্জ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) খলীফা হলে তিনি সর্বপ্রথম উমরকে হাজ্জ করার জন্য পাঠান, এরপর তিনি হাজ্জ করেন। তার মৃত্যুর পর উমর খলীফা হলে তিনি সর্বপ্রথম আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) কে হাজ্জের জন্য পাঠান, আর উমর পরের বছর থেকে মৃত্যু অবধি প্রতিবার হাজ্জ করেছেন। উসমান (রাঃ) খলীফা হয়েও সর্বপ্রথম আব্দুর রহমান বিন আউফকেই হাজ্জ অরার জন্য পাঠান।

 

অসুস্থতা, মৃত্যু, উপদেশ আর উমরকে খলীফা নির্ধারণ

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে সাইফ ও হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর সিদ্দীকে আকবরের মৃত্যুর কারন ছিল এক ও অভিন্ন। তার জীবন বিপন্ন হয় আর সর্বদা দুর্বল হতে থাকেন। অবশেষে তিনি পরপারে যাত্রা করেন।

ইবনে শিহাব থেকে ইবনে সাদ আর হাকিম বিশুদ্ধ সূত্রে লিখেছেনঃ একদিন আবু বকর সিদ্দীকের কাছে হাদিয়ার গোশত আসে। তিনি হারেস বিন কিলদাহ’র সাথে তা আহার করেন। হঠাৎ হারেস বললেন, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হে খলীফা, আপনি খাবেন না। আল্লাহ’র কসম, আমার মনে হয় এতে বিষ মেশানো আছে। আপনি দেখে নিবেন, আমরা উভয়ই একই বছর একই দিনে ইন্তেকাল করবো।” আবু বকর খাবার থেকে হাত সংকুচিত করলেন। সেদিন থেকে তারা দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে এক বছর পর উভয়ে একই দিনে ইন্তেকাল করেন।

শাবী বলেন, “এ দুনিয়ায় আমরা আর কি আশা করতে পারি, (যে দুনিয়ায়) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর আবু বকর – উভয়কেই বিষ খাওয়ানো হয়!”

আয়েশা সিদ্দীকা থেকে ওকেদী আর হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকরের অসুস্থতা এভাবে শুরু হয়েছিলো যে, তিনি জমাদিউল আখের মাসের ৭ তারিখ সোমবার গোসল করেন। সেদিন ঠাণ্ডা পড়েছিলো। তিনি জ্বরে  আক্রান্ত হোন। পনেরো দিন অসুস্থ থাকার কারনে তিনি বাইরে এসে নামায পড়তে পারেননি। অবশেষে ১৩ হিজরির জমাদিউল আখের মাসের ২২ তারিখ মঙ্গলবার রাতে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

আবুস সফর থেকে ইবনে সাদ ও ইবনে আবিদ দুনিয়া বর্ণনা করেছেনঃ সাহাবাগণ আবু বকরের কাছে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি অনুমতি দিলে আমরা কোন ডাক্তার দেখাই।” তিনি বললেন, “ডাক্তার তো আমাকে দেখেছেন।” তারা বললেন, “ডাক্তার কি বলেছেন ?” আবু বকর বললেন, “বলেছেন –   إني فعال لما أريد  (অর্থাৎ, আল্লাহ বলেছেন, আমি যা চাই তা-ই করি)।”

ওকেদী ভিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকরের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তিনি আব্দুর রহমান বিন আউফকে ডেকে বললেন, “তুমি উমর ফারুককে কেমন মনে করো ?” আব্দুর রহমান বিন আউফ বললেন, “তিনি আমার চেয়ে জ্ঞানী।” তিনি বললেন, “এরপরও তোমার কোন মতামত থাকলে বলো।” আব্দুর রহমান বিন আউফ বললেন, “আমার মতে এরচেয়েও তিনি বেশী উত্তম।” আবু বকর এরপর উসমানকে ডেকে একই প্রশ্ন করলেন আর জবাবে উসমান বললেন, “তিনি আমার চেয়েও বড় জ্ঞানী।” আবু বকর বললেন, “তবুও তোমার মতামত পেশ করো।” উসমান বললেন, “তার অভ্যন্তরীণ রূপ বাহ্যিক রূপের চেয়ে অনেক বেশী সমৃদ্ধশালী। আমাদের মধ্যে তার মতো আর কেউ নেই।” আবু বকর এরপর সাঈদ বিন যায়েদ (রাঃ) আর উসাইদ বিন হুযায়ের (রাঃ) এর সাথেও এ নিয়ে পরামর্শ করেন। উসাইদ বললেন, “আল্লাহ জানেন যে, আপনার পর উমরই সেই ব্যক্তি, যিনি আল্লাহ’র সন্তুষ্টিকে নিজের সন্তুষ্টি মনে করেন আর আল্লাহ যে কাজে অসন্তুষ্ট, তিনিও সে কাজে অসন্তুষ্ট হোন। তার ভিতরটা বাইরের থেকে উত্তম। এ কাজের জন্য তার চেয়ে দক্ষ আর প্রতাপান্বিত আর কেউ নেই।” তারপর অন্যান্য সাহাবাগণ এলেন। তাদের মধ্যে একজন বললেন, “আপনি আল্লাহ’র প্রতি আনুগত্যশীল কঠোর মেজাজের এক ব্যক্তিকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিলেন। আল্লাহ’র দরবারে এর কি জবাব দিবেন ?” আবু বকর বললেন, “আল্লাহ’র কসম, তোমরা তো আমাকে ভীতগ্রস্ত করে ফেললে। তবে আমাকে প্রশ্ন করলে বলবো – হে আল্লাহ, আমি মুসলমানদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে খলীফা নির্বাচন করেছি। আমি যা বলেছি, তিনি তার চেয়ে অনেক বেশী শ্রেষ্ঠ।”

এরপর তিনি উসমানকে ডেকে বললেন, “লিখো – বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, এ ওসিয়তনামা আবু বকর বিন আবু কুহাফা দুনিয়ার অন্তিম মুহূর্তে আর পরপারে যাত্রার প্রাক্কালে লিপিবদ্ধ করায়েছেন, যখন অবিশ্বাসীরা বিশ্বাস স্থাপন, দুশ্চরিত্ররা চরিত্রবান আর মিথ্যুকরা সত্যবাদী হয়ে যেতে চায়। হে জনতা, আমি আপনাদের জন্য আমার পর উমরকে খলীফা নির্বাচন করলাম। তার কথা শুনবেন আর তার আনুগত্য করবেন। আমি আল্লাহ, তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), দ্বীন ইসলাম, নিজের আর আপনাদের সেবায় ত্রুটি করিনি। আমার বিশ্বাস উমর ইনসাফ করবেন। যদি এমন হয়, তবে আমার অভিব্যক্তি এ অভিমত উপযুক্ত বলে গৃহীত হবে। আর যদি তিনি পরিবর্তন হয়ে যান, তাহলে প্রত্যেক লোকের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আমি আপনাদের কাছ থেকে মঙ্গলময় কাজের আশাবাদী। আমি অদৃশ্যের বার্তাবাহক নই। অত্যাচারী অচিরেই জেনে যাবে যে, সে কোথায় শায়িত হয়েছে। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।”

এরপর ওসিয়তনামা ভাঁজ করে উসমানকে দিলেন। তিনি তা নিয়ে চলে এলেন। লোকেরা স্বেচ্ছায় উমরের কাছে বাইয়াত করলেন। এরপর আবু বকর উমরকে নির্জনে ডেকে যা বলার তা বললেন। উমর চলে আসার পর আবু বকর হাত উঠিয়ে আল্লাহ’র কাছে দুয়া করলেন, “হে আল্লাহ,  আমি মুসলমানদের কল্যাণের জন্য এ কাজ করেছি। আমি ফিতনাকে ভয় পেয়ে যা কিছু করলাম, আপনি তো সে ব্যাপারে জানেনই। আমি এ সম্বন্ধে ইজতিহাদ (গবেষণা) করেছি আর আমার মতে, মুসলমানদের জন্য এমন খলীফা নির্বাচন করেছি, যিনি তাদের মধ্যে সর্বোত্তম, প্রতাপশালী আর সৎ কাজ প্রত্যাশী। আমি আপনার হুকুমে নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে আপনারই সান্নিধ্যে উপস্থিত হচ্ছি। হে আল্লাহ, আপনিই নিজের বান্দাদের মালিক। বাগডোর আপনারই হাতে। হে আল্লাহ, মুসলিম শাসকদের যোগ্যতা দিন, উমরকে খুলাফায়ে রাশেদার অন্তর্ভুক্ত করুন আর প্রজা সাধারণের উত্তম জীবনযাপন করার তাওফিক দিন।”

ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ আর হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ বুদ্ধিমানদের মধ্যে তিনজন অধিক বুদ্ধিমান। প্রথমজন, আবু বকর সিদ্দীক, তিনি উমরকে খলীফা নির্বাচন করেছেন। দ্বিতীয়জন, মুসা (আঃ) এর স্ত্রী, তিনি বলেছিলেন – তাকে ভৃত্য বানিয়ে নাও। তৃতীয় জন, মিসরের আযীয, তিনি ইউসুফ (আঃ) এর অনুকুলে অভিমত পেশ করে তার স্ত্রীকে বলেছিলেন – তাকে সুন্দর ভালো স্থানে রাখো।

ইয়াসার বিন হামযা (রহঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকরের অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলে তিনি জানালায় দাঁড়িয়ে বললেন, “হে জনতা, আমি আপনাদের জন্য একজনকে খলীফা মনোনীত করেছি, এতে কি আপনারা রাজি আছেন ?” জনতার দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে বললেন, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হে খলীফা, আমার সম্পূর্ণভাবে রাজি।” কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে আলী বললেন, “যদি সেই ব্যক্তি উমর হোন, তবে আমরা রাজি আছি।” আবু বকর বললেন, “না, তিনি উমরই।”

আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর মৃত্যুর সময় জিজ্ঞেস করলেন, “আজ কি বার ?” লোকেরা বললেন, “মঙ্গলবার।” তিনি বললেন, “যদি আজ রাতে আমার মৃত্যু হয়। তবে সমাহিত করতে কালকের অপেক্ষা করবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যতো তাড়াতাড়ি পৌছতে পারি ততোই মঙ্গল।”

আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে ইমাম মালিক (রহঃ) বর্ণনা করেছেনঃ বাগানের বিশ ওসক (এক উটের বোঝা সমপরিমাণ এক ওসক) খেজুর দিয়ে তিনি মৃত্যুর সময় বললেন, “মা, আল্লাহ’র কসম, আমি সব অবস্থাতেই তোমাকে খুশী দেখতে চাই। তোমার চেয়ে বেশী ধনী আমি কাউকে পছন্দ করি না। তোমার দুস্থতা আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়। স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আমি তোমাকে যে খেজুর দিলাম, তা যদি গ্রহণ করো তবে ভালো। নাহলে আমার মৃত্যুর পর তা পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। তোমার অপর দুই বোন আর ভাই আছে। তাদেরকে কুরআনের বণ্টন নীতি অনুযায়ী ভাগ দিবে।” আমি বললাম, “বাবা, সেটাই হবে।” যদি এর চেয়েও বেশী সম্পদ তার কাছে থাকতো, তবে তিনি আমাদের দিয়ে যেতেন। আসমা নামে আমার এক বোন ছিল, কিন্তু তিনি দুই বোনের কথা বলেছিলেন। তিনি বললেন, “তোমার সৎ মা হাবীবা বিনতে খারিজা গর্ভবতী, আমার মনে হয় তার পেটে কন্যা সন্তান আছে।”

এ বর্ণনাটিও ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি তাতে এতটুকু বৃদ্ধি করেছেন যে, আয়েশাকে আবু বকর বললেন, “বিনতে খারিজা গর্ভবতী। আমার ধারণা তার গর্ভে কন্যা সন্তান আছে। আমি তার ব্যাপারেও তোমাকে অসিয়ত করছি।” তার ইন্তেকালের পর উম্মে হাবিবা বিনতে খারিজার গর্ভ থেকে উম্মে কুলসুম জন্মগ্রহণ করেন।

ইবনে সাদ এটাও বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীক তার সমস্ত সম্পদ পাঁচ ভাগে ভাগ করেছিলেন, যেভাবে মুসলমানদের সম্পদ এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ’র রাস্তায় ব্যয় করা হয়।

ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীক বলেছেন, “এক পঞ্চমাংশের চেয়ে আমার কাছে পছন্দনীয় হলো এক চতুর্থাংশ, যা এক তৃতীয়াংশের চেয়ে উত্তম।”

সাঈদ বিন মানসুর তার সুনান গ্রন্থে যাহ্‌হাক থেকে বর্ণনা করেছেন, “আবু বকর আর আলী এক পঞ্চমাংশের ওসিয়ত করেছিলেন।”

যাওয়ায়িদুয যুহদ গ্রন্থে আবদুল্লাহ বিন আহমাদ আয়েশা সিদ্দীকার বর্ণনা বর্ণিত করেছেন – “কসম, তিনি এক দিরহামও রেখে যাননি। সব কিছু আল্লাহ’র পথে ব্যয় করে দিয়েছেন।”

ইবনে সাদ প্রমুখ লিখেছেন যে, আয়েশা সিদ্দীকা বলেছেন, “সিদ্দীকে আকবরের যন্ত্রণা তীব্র হলে আমি এ কবিতাটি আবৃত্তি করলাম – (ভাবার্থ) – “আপনার বয়সের শপথ, মৃত্যুর হেচকি যখন এসে গেছে আর অন্তর সংকুচিত হয়ে গেছে, তখনো কোন সম্পদ নিয়ে গেলেন না।” তিনি চাদর থেকে মুখ সরিয়ে বললেন, “এ কথা বলো না, বরং বলো –

وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ۖ ذَٰلِكَ مَا كُنتَ مِنْهُ تَحِيدُ

‘মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে, এ থেকেই তুমি পালিয়ে বেড়াতে।’ (সূরাহ কাফ, ৫০ :১৯)

দেখো, আমার এ দুটো কাপড় ধুয়ে আমাকে কাফন পড়াবে, কারন নতুন কাপড় মৃত ব্যক্তির চেয়ে জীবিত ব্যক্তির বেশী প্রয়োজন।”

আয়েশা (রাঃ) থেকে আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেনঃ অন্তিম মুহূর্তে আমি আবু বকরের কাছে গিয়ে এ কবিতা আবৃত্তি করলাম (যার ভাবার্থ) – “যার অশ্রু সর্বদা প্রবাহিত হয়, তার অশ্রু যখন থেমে যায় না।” তিনি বললেন, “এ কথা বলো না, বরং বলো –

وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ۖ ذَٰلِكَ مَا كُنتَ مِنْهُ تَحِيدُ

‘মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে, এ থেকেই তুমি পালিয়ে বেড়াতে।’ (সূরাহ কাফ, ৫০ :১৯) ”

এরপর তিনি বললেন, “মনে হয় আমি এ রাতেই ইন্তেকাল করবো।” তিনি মঙ্গলবার রাতে ইন্তেকাল করেন আর সকাল হওয়ার আগেই তাকে দাফন করা হয়।

যাওয়ায়িদুয যুহদ গ্রন্থে বাকার বিন আবদুল্লাহ মাযানী থেকে আবদুল্লাহ বিন আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকরের ইন্তেকালের সময় আয়েশা তার শিয়রে বসে এ কবিতা পড়েন (যার ভাবার্থ) – “প্রত্যেক আরোহীর একটি মঞ্জিল আছে, আর প্রত্যেক কাপড় পরিধানকারীর একটি করে হলেও কাপড় আছে।” তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে বললেন, “এভাবে নয় মা। বরং আল্লাহ বলেছেন –

وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ۖ ذَٰلِكَ مَا كُنتَ مِنْهُ تَحِيدُ

‘মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে, এ থেকেই তুমি পালিয়ে বেড়াতে।’ (সূরাহ কাফ, ৫০ :১৯) ”

আয়েশা (রাঃ) থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ তিনি এ কবিতা পাঠ করেন (যার ভাবার্থ) – “সেই শ্বেত অবয়বে মেঘের বর্ষণ শুরু হয়েছে, তিনি ছিলেন এতিমদের আশ্রয় আর বিধবাদের সহায়।” তিনি এ কবিতা শুনে বললেন, “এ পংতি তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য।”

যাওয়ায়িদুয যুহদ গ্রন্থে উবাদা বিন কায়েস থেকে আবদুল্লাহ বিন আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর ইন্তেকালের সময় বললেন, “হে আয়েশা, আমার ব্যবহৃত দুটো কাপড় পরিস্কার করে আমার কাফন পড়াবে। আমি তোমার বাবা, তোমাকে বলে যাচ্ছি যে, যদি আমাকে নতুন কাপড়ে কাফন দেওয়া হয়, তবে নিষেধ করবে।”

ইবনে আবু মালীকাহ থেকে ইবনে আবিদ দুনিয়া বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর ওসিয়ত করেন যে, তার স্ত্রী আসমা বিনতে আমীস তাকে গোসল দিবেন আর আব্দুর রহমান বিন আবু বকর গোসলের কাজে মাকে সাহায্য করবেন।

ইবনে সাঈদ বিন মুসাইয়াব থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন, “উমর ফারুক এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের মধ্যবর্তী স্থানে আবু বকরের জানাযা পড়ান আর তিনি চার তাকবীল বলেন।”

উরওয়া আর কাসিম বিন মুহাম্মাদ বর্ণনা করেছেন, “আবু বকর সিদ্দীকের কবর যেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের বরাবর হয়, এজন্য তিনি আয়েশাকে ওসীয়ত করেন। ইন্তেকালের পর তার কবর এমনভাবে খনন করা হয় যে, তার মাথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাঁধ বরাবর ছিল, আর উভয়ের কবর ছিল একই বরাবর।”

ইবনে উমর কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, “উমর, তালহা, উসমান, আব্দুর রহমান বিন আবু বকর (রাঃ) সিদ্দীকে আকবরকে কবরে নামান।”

এ বর্ণনাটি কয়েকটি পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে যে, “আবু বকরকে রাতেই সমাহিত করা হয়।”

ইবনে মুসাইয়াব বর্ণনা করেছেন, “আবু বকরকে রাতেই সমাহিত করা হয়।” তিনি আরো বর্ণনা করেছেন, “আবু বকরের ইন্তেকালে মক্কায় কান্নার রোল পড়লে তার পিতা আবু কুহাফা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে ?’ লোকেরা বললেন, ‘আপনার ছেলের ইন্তেকাল হয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ, এটা কি ধরণের কষ্ট ?’ এরপর বললেন, ‘তার স্থলাভিষিক্ত কে হয়েছেন ?’ বলা হলো, ‘উমর।’ তিনি বললেন, ‘মরহুমের সহচর খুবই উত্তম।’

মুজাহিদ বর্ণনা করেছেন, “আবু কুহাফা শরীয়তের ফারায়েজ সূত্রে আবু বকরের যে পরিত্যক্ত সম্পদ পান, তা তিনি নাতিদের কাছে ফিরিয়ে দেন। তিনি আবু বকরের ছয় মাস কয়েকদিন পর ১৪ হিজরির মুহাররম মাসে ৯৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।”

ওলামায়ে কেরামগণের অভিমত হলো, “পিতার জীবদ্দশায় আবু বকর ছাড়া কেউ খিলাফত পরিচালনা করেননি। আর আবু কুহাফা ছাড়া কোন খলীফার পিতা খলীফার পরিত্যক্ত সম্পদ পাননি।”

ইবনে উমর (রাঃ) থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেন, “তিনি দুই বছর সাত মাস খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।”

তারীখে ইবনে আসাকির গ্রন্থে আসমাআয়ী সূত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ আবু বকরের মৃত্যুতে খাফফাফ বিন মাযবাহ আসলামী এ শোক গাঁথা রচনা করেন (ভাবার্থ) – “কোন জীবিত প্রাণীই অমর নয়, পৃথিবী ধ্বংসশীল। মানুষ এ বিশ্বচরাচরের তিমিরে আচ্ছন্ন, মানুষ চেষ্টা করলে মুক্তি পাবে। যদিও তারা সংগ্রাম করে, কিন্তু তারা শয়তানের ষড়যন্ত্রে আক্রান্ত। চোখের প্লাবন থেমে গেছে। প্রাণীকুল আজ বিপন্ন, বয়সের কারনে মৃত্যু, আকস্মিক নিহত বা অসুস্থতার কারনে মৃত্যু – সব মৃত্যুই মানুষকে পীড়া দেয়। তিনি ছিলেন প্রশান্তির মেঘমালা, তিনি সর্বদা শুস্ক প্রান্তরে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়তেন। কসম আল্লাহ’র, আবাল বৃদ্ধবণিতা সবাই তার যুগে সুখ ভোগ করেছে।

সিদ্দিকে আকবর কর্তৃক যে সকল হাদিস বর্ণিত হয়েছে

তাহযীব গ্রন্থে ইমাম নূদী লিখেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সিদ্দীকে আকবর ১৪২ টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। এতো কম সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করার কারন হলো, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর অল্প কিছুদিন জীবিত ছিলেন আর সে যুগে হাদিসের ব্যাপক চর্চা ছিল না। হাদিস শোনা, সংরক্ষণ আর হিফয করার প্রক্রিয়া তাদের পরবর্তী তাবেঈ যুগে ব্যাপকভাবে শুরু হয়।

আমি (গ্রন্থকার) আগেই উমরের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছি যে, বাইয়াতের সময় উমর ফারুক বলেছেন, “আবু বকর আনসারদের সম্বন্ধে আল্লাহ আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ বর্ণনা করেন।” এ হাদিসটি এ বিষয়ের প্রকাশ্য দলীল যে, কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানে তিনিই সবচেয়ে বড় জ্ঞানী ও পন্ডিত।

আবু বকর থেকে যে সকল সাহাবী (২৮ জন) হাদিস বর্ণনা করেছেন, তার হলেন – উমর, উসমান, আলী, ইবনে আউফ, ইবনে মাসউদ, হুযায়ফা, ইবনে উমর, ইবনে যুবাইর, ইবনে আমর, ইবনে আব্বাস, আনাস, যায়েদ বিন সাবিত, বারা বিন আযেব, আবু হুরায়রা, উকবা বিন হারেস, আব্দুর রহমান বিন আবু বকর, যায়েদ বিন আরকাম, আবদুল্লাহ বিন মুগাফফাল, উকবা বিন আমের জুহানী, ইমরান বিন হাসীন, আবু বারযা আসলামী, আবু সাইদ খুদরী, আবু মুসা আশআরী, আবু তোফায়েল লাইসী, জাবের বিন আবদুল্লাহ, বিলাল, আয়েশা সিদ্দিকা আর আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ)। আর আসলাম ও ওয়াসেত আল বাযসহ তাবেঈনের একটি বিরাট জামাআত তার থেকেই হাদিস বর্ণনা করেছেন।

সূত্রসহ আমি আবু বকর কর্তৃক বর্ণিত হাদিসগুলো উল্লেখ করলাম –

(১) হিজরত সংক্রান্ত হাদিস। (বুখারী, মুসলিম)

(২) পানি সংক্রান্ত হাদিস; অর্থাৎ, সমুদ্রের পানি পবিত্র আর জলপ্রাণী মৃত খাওয়া জায়েয। (দারা কুতনী)

(৩) মিসওয়াক মুখকে পরিস্কার করে আর তা ব্যবহার করা আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। (আহমাদ)

(৪) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাগলের ঝুঁটি খেয়ে নামাজ পড়েছেন এবং অজু করেননি। (বাযযার, আবু ইয়ালা)

(৫) কেউ যেন হালাল খাবার খেয়ে ওযু না করে। (বাযযার)

(৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজরত অবস্থায় আঘাত করতে নিষেধ করেছেন। (আবু ইয়ালা, বাযযার)

(৭) যিনি আমার পরে নামায পড়াবেন, তিনি একই কাপড় পরিধান করবেন। (আবু ইয়ালা)

(৮) যে ব্যক্তি কুরআন যেভাবে নাযিল হয়েছে সেভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে চায়, সে যেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের কেরাতের অনুসরণ করে। (আহমাদ)

(৯) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি বললাম, “আপনি আমাকে এমন একটি দুয়া শিক্ষা দিন, যা আমি নামাযে পড়বো।” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “পড়বে –

اللَّهُمَّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا كَثِيرًا، وَلاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ، فَاغْفِرْ لِي مَغْفِرَةً مِنْ عِنْدِكَ، وَارْحَمْنِي، إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ

(বুখারী, মুসলিম)

(১০) যিনি সকালের নামায পড়বেন, আল্লাহ তাকে আশ্রয় দিবেন। তোমরা আল্লাহ’র প্রতিশ্রুতিতে অনুমান করো না। যে অনুমানের ভিত্তিতে সে নামাযীকে হত্যা করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (ইবনে মাজা)

(১১) উম্মতের পিছে নামাজ না পড়া পর্যন্ত আল্লাহ কোন নবীকে মৃত্যু দেন না। (বাযযার)

(১২) যে ব্যক্তি গুনাহ করার পর ভালোভাবে অজু করে দুই রাকআত নামাজ পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। (আহমাদ, আসহাবে সুনানে আরবাআ, ইবনে হিব্বান)

(১৩) মৃত্যুর স্থানেই প্রত্যেক নবীকে সমাহিত করা হয়। (তিরমিযি)

(১৪) ইহুদী আর খ্রিস্টানদের প্রতি আল্লাহ’র অভিশাপ, কারন তারা নবীদের কবরগুলোকে উপাসনালয়ে পরিণত করেছে। (আবু ইয়ালা)

(১৫) মৃত ব্যক্তির জন্য কান্নাকাটি করলে মৃত ব্যক্তির আযাব হয়। (আবু ইয়ালা)

(১৬) খেজুরের টুকরো সমপরিমাণ দান করে হলেও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ নাও। কারন সে দান বাঁকাকে সোজা, মৃত্যুকে সহজ আর ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করে। (আবু ইয়ালা)

(১৭) ফারায়েজ আর সদকার হাদিস। (বুখারী, মুসলিম)

(১৮) একদিন আবু বকর উটের উপর সওয়ার হলে চাবুকটি পড়ে যায়। তিনি উট বসিয়ে সেখান থেকে নেমে চাবুকটি নিলেন। লোকেরা বললেন, “আমাদেরকে কেন নির্দেশ করলেন না ?” তিনি বললেন, “আমার প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের থেকে চাইতে আমাকে নিষেধ করেছেন।” (আহমাদ)

(১৯) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, “কোন হাজ্জ উত্তম ?” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “যেখানে জোরে জোরে আর বেশী বেশী তাকবীর বলা হয় এবং অনেক কুরবানী দেওয়া হয়।” (তিরমিযী, ইবনে মাজা)

(২০) আসমা বিনতে আমীসের গর্ভে মুহাম্মাদ বিন আবু বকর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নেফাস অবস্থায় গোসল করে হাজ্জ ও উমরার ইহরাম বাধার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। (বাযযার, তাবারানী)

(২১) হাজরে আসওয়াদকে চুমু দেওয়ার সময় তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “যদি আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চুমু দিতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে চুমু দিতাম না।” (দারা কুতনী)

(২২) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা বারাআতের বিধান মক্কায় পাঠিয়ে নির্দেশ করেন যে, এ বছর থেকে মুশরিকরা আর হাজ্জ করতে পারবে না আর কেউ উলঙ্গ হয়েও তাওয়াফ করবে না। (আহমাদ)

(২৩) আমার ঘর ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানটি জান্নাতের একটি বাগান, আর আমার মিম্বর জান্নাতের একটি অংশ। (আবু ইয়ালা)

(২৪) আবুল হাইসামের বাড়ি তালাক সংক্রান্ত হাদিস। (আবু ইয়ালা)

(২৫) চান্দী আর স্বর্ণ – এগুলো সমান সমান। যে লেনদেনে কমবেশি করবে, সে জাহান্নামী। (আবু ইয়ালা)

(২৬) সে মুমিনের সাথে প্রতারণা আর কষ্ট দিবে, সে অভিশপ্ত জাহান্নামী। (তিরমিযী)

(২৭) কৃপণ, উচ্চভিলাসী ও অধীনস্তদের কাছে গর্বকারী জালেম বাদশাহ জান্নাতে যাবে না। নিজ মনিবের প্রতি আনুগত্যশীল গোলাম জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আহমাদ)

(২৮) গোলামের পরিত্যক্ত সম্পদের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যে তাকে আযাদ করেছে। (যিয়াউল মুকাদ্দাসী)

(২৯) নবীদের সম্পদের কোন উত্তরাধিকার নেই, তাদের সকল পরিত্যক্ত সম্পদ সদকা হিসেবে বিবেচিত। (বুখারি)

(৩০) নবীদের ওয়ারেস হলেন নবীর স্থলাভিষিক্ত খলীফা। (আবু দাউদ)

(৩১) বংশপরিচয় অস্বীকার করা কুফুরী। (বাযযার)

(৩২) তুমি আর তোমার সম্পদ তোমার বাবার জন্য। আবু বকর বলেন, “এ থেকে উদ্দেশ্য হলো, খোরপোষ দেওয়া।” (বায়হাকি)

(৩৩) যার পা আল্লাহ’র রাস্তায় গিয়ে ধুলায় ধূসরিত হবে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন। (বাযযার)

(৩৪) আমাকে কাফেরদের সাথে লড়াই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (বুখারি, মুসলিম)

(৩৫) খালিদ বিন ওয়ালীদের প্রশংসায় বলেন, “তিনি আল্লাহ’র তলোয়ার। আল্লাহ তাকে কাফির ও মুনাফিকদের উপর বিজয়ী করেছেন।” (আহমাদ)

(৩৬) উমরের চেয়ে উত্তম ব্যক্তির উপর সূর্য উদিত হয় না। (তিরমিযি)

(৩৭) মুসলিম সরকার (অর্থাৎ, খলীফা‘র নেতৃত্বাধীন গভর্নমেন্ট) মুসলমানদের প্রাপ্য বুঝিয়ে না দিলে তার উপর অভিশাপ। আল্লাহ তার কোন নফল ও ফরয (ইবাদাত) কবুল করবেন না। (আহমাদ)

(৩৮) মাআযকে সঙ্গেসার (অপরাধের কারনে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা) সংক্রান্ত হাদিস। (আহমাদ)

(৩৯) ইস্তিগফার করার পর তার প্রতি জেদ করবে না, যদিও সে একই কাজ (অপরাধ) দিনে সত্তর বার করে। (তিরমিযী)

(৪০) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লড়াইয়ের পরামর্শ সংক্রান্ত হাদিস। (তাবারানী)

(৪১)  مَن يَعْمَلْ سُوءًا يُجْزَ بِهِ

“যে অসৎ কাজ করবে সে তার প্রতিফল পাবে …” (সূরাহ আন-নিসা, ৪ :১২৩)

এ আয়াত সংক্রান্ত হাদিস। (তিরমিযী, ইবনে মাজা)

(৪২) তোমরা এ আয়াত তিলাওয়াত করো –

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنفُسَكُمْ

“হে ইমানদার লোকেরা, তোমাদের নিজেদের দায়িত্ব তোমাদের নিজেদের উপর …” (সূরাহ আল- মাইদাহ, ৫ :১০৫)

(আহমাদ, আইম্মায়ে আরবা, ইবনে হিব্বান)

(৪৩) হিজরতের সেই হাদিস, যেখানে গুহায় সিদ্দীকে আকবরের ভীতি দূর করার জন্য তাদের দুজনের সাথে আল্লাহ আছেন আর তিনি তাদের সাহায্যকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)

(৪৪) اللَّهُمَّ طَعْنَا وَطَاعُوْنَا – সংক্রান্ত হাদিস। (আবু ইয়ালা)

(৪৫) সূরা হুদ আমাকে বৃদ্ধ করে দিয়েছে। (দারা কুতনী)

(৪৬) আমার উম্মতের মধ্যে পিঁপড়ার গতির চেয়েও গোপনে শিরক বিস্তার লাভ করবে। (আবু ইয়ালা)

(৪৭) আমি বললাম, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমাকে এমন একটি জিনিস শিক্ষা দিন, যে দুয়া সকাল সন্ধ্যা পাঠ করবো।” (আল-হাইসাম বিন কালীব, তিরমিযী)

(৪৮) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আর ইস্তেগফার করো। কারন ইবলিস বলেছে, আমি গুনাহকে ধ্বংস করি, আর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ও ইস্তেগফার আমাকে ধ্বংস করে। (আবু ইয়ালা)

(৪৯) لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ

“তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না ……” (সূরাহ আল-হুজুরাত, ৪৯ :২)

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর আমি বললাম, “ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আমি আপনার কাছে নিচু স্বরে কথা বলবো।” (বাযযার)

(৫০)  كل ميسر لما خلق له – সংক্রান্ত হাদিস। (আহমাদ)

(৫১) যে জ্ঞাতসারে আমাকে মন্দ বলবে আর আমার কোন আদেশ অমান্য করবে, সে জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নিবে। (আবু ইয়ালা)

(৫২) مَا نَجَاتَ فِيْ هَذَا الْاَمْرِ – সংক্রান্ত হাদিস। (আহমদ)

(৫৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন, “তুমি বলে দাও, যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে, জান্নাত তার জন্য ওয়াজিব।” আমি রওয়ানা করলাম, পথিমধ্যে উমরের সাথে দেখা …। (আবু ইয়ালা) এ হাদিসটি আবু হুরায়রার বর্ণনা দ্বারা সংরক্ষিত, আবু বকরের দ্বারা নয়।

(৫৪) আমার উম্মতের মধ্যে মুরজিয়া আর কাদেরিয়া – এ দুটো দল জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (দারে কুতনী)

(৫৫) আল্লাহ’র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। (আহমাদ, নাসাঈ, ইবনে মাজা)

(৫৬) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক কাজের সময় এ দুয়া পড়তেন – “হে আল্লাহ, আমার জন্য এ কাজ পছন্দনীয় আর উত্তম করে দিন।” (তিরমিযী)

(৫৭) ا الهم فارج الهم  দুয়া। (বাযযার, হাকিম)

(৫৮) হারাম পন্থায় প্রতিপালিত শরীর অপেক্ষা আগুন শ্রেয়। অপর বর্ণনায় আছে, অবৈধ পথে লালিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (আবু ইয়ালা)

(৫৯) শরীরের প্রত্যেক অংশ তোমাদের কর্কশ কথার প্রতিবাদ করবে। (আবু ইয়ালা)

(৬০) মধ্যবর্তী শাবানের রাতে আল্লাহ নিচে অবতরণ করেন। সে রাতে কাফির ও ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করা হয়। (দারে কুতনী)

(৬১) প্রাচ্যের খুরাসান থেকে দাজ্জালের আবির্ভাব হবে, সূচলা মুখের একদল মানুষ তার অনুগামী হবে। (তিরমিযী, ইবনে মাজা)

(৬২) আমার প্রতি আল্লাহ’র এতটুকু মেহেরবানী যে, আমি সত্তর হাজার লোককে বিনা হিসাবে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবো। (আহমাদ)

(৬৩) কিয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুপারিশ সংক্রান্ত হাদিস। (আহমাদ)

(৬৪) লোকেরা যদি একদিকে যায় আর আনসারগণ অন্যদিকে, তবে আমি আনসারদের সাথে থাকবো। (আহমাদ)

(৬৫) কুরাইশগণ এ উম্মতের নেতা। চরিত্রবানরা চরিত্রবানদের আর মন্দ লোকেরা মন্দ কাজের অনুসারী। (আহমাদ)

(৬৬) ওমান সম্বন্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সেখানে এক আরব গোত্র রয়েছে। আমার দূত সেখানে গেলে ওমানবাসী তীর ছুঁড়বে।” (আহমাদ, আবু ইয়ালা)

(৬৭) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন আবু বকরকে নিয়ে এমন স্থানে গেলেন, যেখানে ইমাম হাসান (রাঃ) ছেলেদের সাথে খেলছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বললেন, “এর সাথে আলীর চেহারার মিল আছে।” (বুখারী) ইবনে কাসির হাকিমের সূত্র ধরে বলেন, এ হাদিসটি মারফু।

(৬৮) উহুদ যুদ্ধ সংক্রান্ত হাদিস। (তায়ালাসী, তাবারানী)

(৬৯) পঞ্চমবারে চোরকে হত্যা করবে। (আবু ইয়ালা, দায়লামি)

(৭০) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে আইমানের কবর যিয়ারত করতে যেতেন। (মুসলিম)

(৭১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আমরা বসেছিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাত দিয়ে কি যেন সরাচ্ছিলেন। আমরা সেখানে কিছু দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি করছেন ?” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “দুনিয়া সরাচ্ছি।” (বাযযার) ইবনে কাসির অপর হাদিসের মাধ্যমে এ বর্ণনাটি পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করেছেন।

(৭২) একজন বাকি থাকা পর্যন্ত রদবাসীকে হত্যা করো। (তাবারানী)

(৭৩) কোন স্থানে বাড়ি তৈরির আগে সেখানের আবাসন, প্রতিবেশী ও রাস্তাঘাট দেখে নিবে।

(৭৪) আমার কাছে অসংখ্যবার দরূদ প্রেরণ করো। কারন আল্লাহ আমার কবরে একজন ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। কোন ব্যক্তি দরূদ পাঠালে সে ফেরেশতা আমাকে বলেন, “অমুকের ছেলে অমুক আপনার প্রতি দরূদ পাঠিয়েছেন।” (দাইলামী)

(৭৫) এক জুমা অপর জুমার কাফফারা ……! (আকীলী)

(৭৬) আমার উম্মতের জন্য জাহান্নামের উষ্ণতা হবে হাম্মামখানার উষ্ণতার মতো। (তাবারানী)

(৭৭) মিথ্যাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করো, কারন মিথ্যাচার ঈমান ধ্বংস করে দেয়। (ইবনে লা-ল)

(৭৮) বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারীদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ। (দারা কুতনী)

(৭৯) দ্বীন আল্লাহ’র এক মহান ঝাণ্ডা। এমন কোন ব্যক্তি নেই, যে তা উত্তোলন করবে। (দাইলামী)

(৮০) সূরা ইয়াসিনের ফযিলত সংক্রান্ত হাদিস। (দাইলামী)

(৮১) ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ পৃথিবীর জন্য আল্লাহ’র ছায়া ও বর্শা। প্রতিদিন রাতে তিনি সত্তর সিদ্দীকের সওয়াব পান। (আকীলী, ইবনে হিব্বান)

(৮২) মুসা (আঃ) আল্লাহকে বললেন, “অবলা নারীর সেবা করলে কি ধরণের সওয়াব পাওয়া যাবে ?” তিনি বললেন, “আমি তাকে আমার ছায়া দান করবো।” (ইবনে শাহিন, দাইলামী)

(৮৩) হে আল্লাহ, উমর বিন খাত্তাবের মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী করুন। (তাবারানী)

(৮৪) প্রাণী শিকার করবে না, বৃক্ষের প্রশাখা আর মূল কাটবে না, কারন তারা তাসবীহ পড়ে।

(৮৫) আমি নবী হয়ে প্রেরিত না হলে উমর নবী হতেন। (দাইলামী)

(৮৬) কাপড়ের ব্যবসা করবে। (আবু ইয়ালা)

(৮৭) যে ব্যক্তি নেতা থাকার পরও অন্যের জন্য বিদ্রোহ করবে, তার প্রতি আল্লাহ’র ফেরেশতা আর মানবকুলের অভিশাপ, তাকে হত্যা করো। (দাইলামী)

(৮৮) যে আমার থেকে জ্ঞান অর্জন করবে বা হাদিস লিখবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই জ্ঞান ও হাদিস সংরক্ষিত থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে সওয়াব পেতেই থাকবে। (হাকিম)

(৮৯) যে নাঙ্গা পায়ে আল্লাহ’র পথে বের হবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন স্বীকৃত পন্থায় তাকে প্রশ্ন করবেন না। (তাবারানী)

(৯০) যে ব্যক্তি জান্নাত আর আল্লাহ’র (আরশের) ছায়ার আকাঙ্ক্ষা করে, সে যেন মুসলমানদের উপর কঠোরতা না করে, বরং রহম করে। (ইবনে লাল, ইবনে হিব্বান, আবুশ শায়েখ)

(৯১) যে ব্যক্তি কেবল আল্লাহ’র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কারো প্রয়োজন মিটাবে, ঐ দিন তার থেকে কোন গুনাহ প্রকাশ পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাকে সেদিন পূর্ণ প্রতিদান দিবেন। (দাইলামী)

(৯২) যে জাতি জিহাদ ছেড়ে দিবে, সে জাতি শাস্তি ভোগ করবে। (তাবারানী)

(৯৩) মিথ্যা অপবাদ দানকারী জান্নাতে যাবে না। (দাইলামী)

(৯৪) কোন মুসলমানকে অবজ্ঞা করো না। একজন অতি সাধারণ মুসলমানও আল্লাহ’র কাছে অনেক মর্যাদাবান। (দাইলামী)

(৯৫) আল্লাহ বলেন, “তোমরা আমার রহমতের আশা করলে আমার সৃষ্টির উপর রহম করো।” (আবুশ শায়েখ, ইবনে হাব্বান, দাইলামী)

(৯৬) টাখনুর নীচ পর্যন্ত কাপড় পড়ো না। (আবু নুয়াইম)

(৯৭) আমার আবু বকর আর আলী ইনসাফের পাল্লা বরাবর।

(৯৮) শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে অলসতা করো না। তোমরা তাকে দেখো না, কিন্তু সে তোমাদের ব্যাপারে অমনোযোগী নয়। (দাইলামী)

(৯৯) যে শুধু আল্লাহ’র জন্য মসজিদ তৈরি করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে বাড়ি নির্মাণ করে দিবেন। (তাবারানী)

(১০০) যে তরকারীর মধ্যে কাঁচা পেয়াজ ও রসুন খাবে, সে যেন মসজিদে না আসে। (তাবারানী)

(১০১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজের শুরু, রুকু যাওয়ার সময় আর রুকু থেকে উঠে রফয়ে ইয়াদাইন করতেন। (বাইহাকী)

(১০২) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু জাহেলকে একটি উট হাদিয়াস্বরূপ দিয়েছেন। (ইসমাঈলী)

(১০৩) আলীর প্রতি তাকানো ইবাদত। (ইবনে আসাকির)

(১০৪) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের সম্পর্কে ওসীয়ত করেছেন, “তাদের ভালো মানুষদের গ্রহণ করো আর মন্দদের ক্ষমা করে দাও।” (বাযযার, তাবারানী)

 

 

 

কুরআন শরীফের তাফসীর

আবু মালীকা থেকে আবুল কাসিম বাগাবী বর্ণনা করেছেনঃ সিদ্দীকে আকবরকে কোন আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “আমি কোন ভূখণ্ডে আর কোন আকাশের নিচে বসবাস করবো, যদি আমি কিতাবুল্লাহ’র বিপরীতে কোন কিছু করি ?”

ইব্রাহীম তাহমী থেকে আবু উবাইদা নকল করেনঃ আবু বকর সিদ্দীককে – فا كهة وا با – এ আয়াতের অর্থ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, “কুরআনের যে অর্থ আমার জানা নেই, তা যদি বর্ণনা করি, তবে কোন যমীন আমাকে ধারণ করবে আর কোন আকাশ তার নিচে আমাকে বসতে দিবে ?”

বায়হাকী প্রমুখ লিখেছেনঃ একদিন আবু বকর সিদ্দীককে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, “আমি এর অর্থ যা করেছি, তা আমার অভিমত। যদি তা যথার্থ হয়, তবে আল্লাহ’র করুণা মনে করবে। আর যদি সঠিক না হয়, তবে আমার এ অভিমত শয়তানের কাজ মনে করবে। আমার মতে এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কালালাহ ওই সমস্ত সন্তানাদি, যাদের মাতাপিতা নেই।” উমর খলীফা হওয়ার সময় বলেন, “আবু বকর যে বিষয়ে কথা বলেছেন, সে বিষয়ের উপর কথা বলতে আমার লজ্জা লাগে। আমি তার অভিমতকে প্রাধান্য দেই।”

হুলীয়া গ্রন্থে আসওয়াদ বিন হিলাল থেকে আবু নুয়াঈম নকল করেনঃ একদিন আবু বকর সিদ্দীক সাহাবাদের জিজ্ঞেস করলেন –

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّـهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا

الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ

এ দুটো আয়াত সম্পর্কে আপনাদের অভিমত কি ? তারা বললেন, “এর অর্থ হচ্ছে, তার দৃঢ়পদ ছিলেন, কোন গুনাহ করেননি আর ঈমানকে গুনাহ’র সাথে একীভূত করেননি।” তিনি বললেন, “আপনারা একে অপাত্র মনে করেছেন। এর অর্থ হলো, তারা আল্লাহকে নিজেদের প্রতিপালক বলেছেন, এরপর এর উপরই মজবুত ছিলেন, অপর প্রতিপালকের প্রতি আসক্ত হোননি আর ঈমানকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করেননি।”

 

আমের বিন সাদ বাজালী থেকে ইবনে জারীর বর্ণনা করেছেন,

لِّلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَىٰ وَزِيَادَةٌ

“যারা সৎ কর্ম করেছে তাদের জন্য থাকবে উত্তম পুরস্কার (জান্নাত) এবং এর থেকেও বেশী” (সূরাহ ইউনুস,১০ : ২৬)

এ আয়াতের তাফসীরে  আবু বকর সিদ্দীক বলেন, زِيَادَةٌ – থেকে উদ্দেশ্য আল্লাহ’র মুখ।

 

আবু বকর সিদ্দীক থেকে ইবনে জারীর নকল করেন যে,

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّـهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا

এ আয়াতের অর্থ সম্বন্ধে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি (এ কথা) বলবে আর বিশ্বাস নিয়ে ইহধাম ত্যাগ করবে, সে ঠিক বলে বিবেচিত।”

 

অভিমত বিচার, ভাষণ আর প্রার্থনা

সুন্নাহ গ্রন্থে ইবনে উমর থেকে আলকায়ী বর্ণনা করেনঃ আবু বকরের কাছে এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে বললেন, “ভাগ্যে আছে বলেই তো মানুষ যেনা (ব্যাভিচার) করে, নাকি ?” তিনি বললেন, “হ্যা।” সে বললো, “আল্লাহ যেনা আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, আবার শাস্তিও দেবেন!” তিনি বললেন, “সত্যিই তো। আল্লাহ’র কসম, আমার কাছে এ সময় কেউ থাকলে আমি তাকে নির্দেশ দিতাম, সে তোমার নাক কেটে নিতো।”

ইবনে আবী শায়বা তার রচনায় যুবাইর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আবু বকর তার এক অভিভাষণে বললেন, “উপস্থিতি, আল্লাহকে লজ্জা করো। আল্লাহ’র কসম, আমি যখন কোন খোলা প্রান্তরে টয়লেট করতে যাই, তখন আল্লাহ’র থেকে লজ্জায় আমার মাথা ঢেকে নেই।”

আব্দুর রাজ্জাক তার রচনায় উমর বিন দিনার থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর বলেছেন, “আল্লাহকে লজ্জা করো। আল্লাহ’র কসম, আমি টয়লেটে গিয়ে আল্লাহ’র লজ্জায় আমার কোমর টয়লেটের দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে দিতাম।”

সুনান গ্রন্থে আবদুল্লাহ আল-সানাবাহী থেকে আবু দাউদ বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আবু বকরের পিছে মাগরিবের নামায পড়লাম। তিনি প্রথম দুই রাকআতে সূরা ফাতিহার পর ছোট্ট দুটো সূরাহ পড়লেন, আর তৃতীয় রাকআতে পড়লেন –

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا

“হে আমাদের রব, (একবার যখন) আপনি আমাদেরকে (সঠিক) পথের দিশা দিয়েছেন, (তখন আর) আপনি আমাদের মনকে বাঁকা করে দিয়েন না ……” (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ :১০৮)

 

ইবনে আয়নিয়া থেকে ইবনে আবী খাইসামা আর ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক কোন এক মৃত ব্যক্তির সমবেদনা জানাতে গিয়ে বললেন, “সান্ত্বনায় কোন ক্ষতি নেই, আর কাঁদলে কোন লাভ হবে না। মৃত্যু পূর্বে যন্ত্রণাদায়ক আর পরে শান্তিদায়ক। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালে (জাতির অবস্থার কথা) মনে করো। (সে তুলনায়) তোমাদের বেদনা ক্ষীণ। আল্লাহ তোমাদের অধিকহারে পুরস্কৃত করবেন।”

সালিম বিন উবায়দা থেকে ইবনে আবী শায়বা আর দারা কুতনী বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক আমাকে বলেছেন, “আসো, আজকে আবারো আমার সাথে ইবাদত করো, যাতে ভোর হয়ে যায়।”

আবু সফর থেকে আবু কেলায়া বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক অধিকাংশ সময় বলতেন, “আমার দরজা বন্ধ করো, যাতে ভোর পর্যন্ত আমি ইবাদাতে লিপ্ত থাকি।”

হুযায়ফা বিন উসাইদ থেকে কিতাবুয যিয়াদাত গ্রন্থে বায়হাকী আর আবু বকর বিন যিয়াদ নিশাপুরি বর্ণনা করেছেন, “লোকেরা যেন সুন্নত মনে না করে, সেজন্য আবু বকর আর উমর চাশতের নামায পড়তেন না।”

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীক বলেছেন, “পানির মৃত মাছ খাওয়া জায়েয।”

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) আআম গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) জীবিত প্রাণীর বিনিময়ে গোশত বিক্রি করা মাকরূহ মনে করতেন।

বুখারী শরীফে ইমাম শাফেঈ থেকে বর্ণিত হয়েছে, আবু বকর সিদ্দীক দাদাকে বাবার পরিত্যক্ত সম্পদের উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য করতেন।

ইবনে আবী শায়বা তার রচনায় বর্ণনা করেছেন, আবু বকর সিদ্দীক দাদাকে বাবার অবর্তমানে বাবা হিসেবে আর নাতিকে ছেলের অনুপস্থিতিতে ছেলে বলে গণ্য করতেন।

কাসিম (রাঃ) বলেছেন, এক ব্যক্তি বাবাকে অস্বীকার করলে তিনি তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “তার মাথায় শয়তান ভর করে আছে।”

ইবনে আবী মালেক বলেছেনঃ তিনি জানাযার নামায পড়ানোর সময় বলতেন, “হে আল্লাহ, আপনার এ বান্দার পরিবার, সম্পদ ও সম্প্রদায় তাকে আপনার কেউ সোপর্দ করেছে। তার গুনাহ যদিও বেশী হয়ে থাকে, কিন্তু আপনার রহমত ও অনুগ্রহ এর চেয়ে অনেক বেশী, আপনি তো দয়াবান।”

সাঈদ বিন মানসুর স্বরচিত সুনান গ্রন্থে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আসেম বিন উমর বিন খাত্তাব তার মায়ের সাথে ঝগড়া করলে আবু বকর মীমাংসা করার পর আসেমকে সম্বোধন করে বললেন, “আসেম, খুব ভালো করে জেনে নাও যে, তোমার মায়ের শরীরের ঘাম আর গন্ধ তোমার চেয়ে হাজার গুণ উত্তম।”

কায়েস বিন আবু হাযেম থেকে বায়হাকি বর্ণনা করেছেনঃ এক ব্যক্তি আবু বকরের খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, “আমার বাবা আমার সব সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে অসহায় করে দিতে চান।” আবু বকর তার বাবাকে বললেন, “যতটুকু আপনার প্রয়োজন, আপনার ছেলের কাছ থেকে ততটুকু নিবেন।” সে ব্যক্তি বললেন, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হে খলীফা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেননি যে – তোমার সম্পদ তোমার বাবার ?” আবু বকর বললেন, “হ্যা, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই বলেছেন। তবে এর অর্থ এটা না, বরং তার কথার উদ্দেশ্য ছিল – এ থেকে ব্যয় করা।”

আমর বিন শোয়াইবের দাদা বর্ণনা করেছেন, আবু বকর সিদ্দীক ও উমর গোলামের কিসাস হিসেবে স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করতেন না। (আহমাদ)

বুখারী শরীফে ইবনে মালিকার দাদা থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির হাতে দংশন করতে গিয়ে তার দুটো দাঁত ভেঙে গেলে আবু বকর এ ক্ষেত্রে দিয়ত ও কিসাস কোনটিই জারি করেননি।

ইকরামা থেকে ইবনে আবী শাইবা আর বায়হাকি বর্ণনা করেছেন, আবু বকর সিদ্দীক কান কাটার কিসাস হিসেবে পনেরোটি উট গ্রহণ করতেন। এরপর বলতেন, “কান কাটা ক্ষতটি চুল আর পাগড়ির মধ্যে ঢেকে রেখো।”

আবু ইমরান জুনী থেকে বায়হাকি প্রমুখ বর্ণনা করেছেন, ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ানকে আবু বকর সিদ্দীক সিপাহসালার করে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রেরণের প্রাক্কালে বলেন, “আমি তোমাদেরকে কয়েকটি উপদেশ দিবো, এর উপর অটুট থাকবে – নারী, শিশু, পঙ্গু আর বৃদ্ধাদের হত্যা করবে না, ফলজ বৃক্ষ কাটবে না, বস্তি উচ্ছেদ করবে না, ছাগল ও উট হত্যা করবে না, তবে খেলে কোন ক্ষতি নেই। ফসলের ক্ষেত ধ্বংস আর জ্বালিয়ে দিবে না। আর অপচয় ও কৃপণ থেকে বেঁচে থাকবে।”

আবু বারযা আসলামী থেকে আহমাদ, আবু দাউদ আর নাসাঈ নকল করে লিখেছেনঃ একদিন আবু বকর সিদ্দীক এক ব্যক্তির প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়লে আমি বললাম, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হে খলীফা, তাকে হত্যা করুন।” তিনি বললেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর এ কাজ কারো জন্যই বৈধ নয়।”

কিতাবুল ফুতুহ গ্রন্থে সাইফ তার শিক্ষক থেকে বর্ণনা করেছেনঃ উমাইয়া বংশের কিছু মুহাজির সাহাবী ইয়ামামার গভর্নরের কাছে এমন দুজন নারীকে ধরে নিয়ে এলেন, যাদের মধ্যে একজন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে, আর অপরজন মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা গাইতো। ইয়ামামার গভর্নর শাস্তি হিসেবে তাদের হাত কেটে দিলেন আর দাঁত উপড়ে ফেললেন। আবু বকর এ মর্মে তার কাছে চিঠি লিখলেন – “আমি সংবাদ পেয়েছি যে, আপনি দুজন মহিলাকেই এই এই শাস্তি দিয়েছেন। আপনি যদি শাস্তি প্রদান না করতেন, তবে যে নারী রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে, শাস্তি হিসেবে তাকে আমি মৃত্যুদণ্ড দিতাম। কারন নবীগণের মর্যাদা সর্বোচ্চ। বিশেষত, যদি কোন মুসলমান এ বেয়াদবী করে, তবে সে মুরতাদ। আর যদি কোন জিম্মি করে, তবে সে রাস্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিবেচিত হবে। যে নারী মুসলমানদের কুৎসা গায়, সে মুসলমান হলে তাকে আদব ও শরম দিতে হবে, এজন্য হাত পা কাটা উচিত নয়। আর জিম্মি হলে এ কাজ (মুসলমানদের গালমন্দ করা) শিরকের চেয়ে বেশী খারাপ নয়। শিরকের ক্ষেত্রে যেমন ধৈর্য ধারণ করো, এ ক্ষেত্রেও সবর করা আবশ্যক। নমনীয়তা দেখাও। কিসাস ছাড়া হাত পা কাটা আমি মাকরূহ মনে করি, কারন এ শাস্তিপ্রাপ্তরা সর্বদা লজ্জা পায়।”

সুফিয়া বিনতে আবু উবায়দা থেকে মালিক আর দারা কুতনী বর্ণনা করেছেন, এক লোক এক অবিবাহিত যুবতির সাথে যেনা করে আর সে তা স্বীকার করলে আবু বকর সিদ্দীক তাকে বেত্রাঘাত করেন আর ফিদাক অঞ্চলে নির্বাসন দেন।

মুহাম্মদ ইবনে আতিব থেকে আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীকের কাছে এক চোরকে বন্দী করে নিয়ে আসা হলো। চুরির অপরাধে তার হাত পা এর আগে একবার কেটে ফেলা হয়েছিলো। তিনি তাকে হত্যা অরার নির্দেশ দিয়ে বললেন, “আমি তোমার প্রতি ওই দণ্ড আরোপ করছি, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করে গেছেন। তিনিই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বাধিক জ্ঞানী।”

কাসিম বিন মুহাম্মাদ থেকে মালিক বর্ণনা করেছেনঃ ডান হাত ও ডান পা কাটা ইয়েমেনের এক বাসিন্দা সিদ্দীকে আকবরের বাড়িতে এসে অভিযোগ করলো, “ইয়েমেনের প্রশাসক আমার প্রতি নির্যাতন চালিয়েছে। সে সারারাত নামায আদায় করে।” সিদ্দীকে আকবর তার দীর্ঘ নামাজ দেখে আফসোস করেন। এমন অবস্থায় জানা গেলো যে, আবু বকর সিদ্দীকের সম্মানিতা স্ত্রী আসমা বিনতে আমিসের অলংকার হারিয়ে গেছে। ইয়েমেন থেকে আগত লোকটি সবসময় আবু বকর সিদ্দীক আর অন্যান্য লোকদের সাথেই অবস্থান করছিলো আর সে তার মেজবান, অর্থাৎ আবু বকর সিদ্দীকের জন্য এ বলে দুয়া করলো, “হে আল্লাহ, এ বাড়িওয়ালার সাথে যে এ আচরণ করেছে, তাকে আপনি শাস্তি দিন।” খোঁজ করার পর সে অলংকার এক স্বর্ণকারের কাছে পাওয়া গেলো। আর ইয়েমেন থেকে আগত লোকটি তা সরবরাহ করেছে। এক ব্যক্তির সাক্ষীর প্রেক্ষিতে সে তার অপরাধ স্বীকার করলে তিনি তার বাম হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়ে বললেন, “আল্লাহ’র কসম, এ চুরি সম্বন্ধে তার দুয়া আমাকে সন্দিহান করেছিলো।”

আনাস (রাঃ) থেকে দারা কুতনী বর্ণনা করেছেন, পাঁচ দিরহাম মূল্যের ঢাল চুরির দায়ে তিনি হাত কাটার নির্দেশ দিতেন।

আবু সালিম থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ আবু বকর সিদ্দীকের খিলাফতের যুগে ইয়েমেন থেকে কিছু লোক এসে কুরআন তিলাওয়াত শুনে খুব কান্নাকাটি করলে তিনি বললেন, “আমাদেরও এ অবস্থা ছিল, তবে পরবর্তীতে মন শক্ত হয়ে গেছে।” আবু নুয়াইম মন শক্ত হওয়ার অর্থ আল্লাহ’র মারেফাত দ্বারা মন শক্ত ও শান্ত হয়ে যাওয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

গারীব গ্রন্থে আবু উবাইদ বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীক বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইসলামের প্রাথমিক যুগে মারা গেছে, সে ভাগ্যবান। সে তো ঝগড়া থেকে পবিত্র ছিল।”

কাবিসা থেকে আইম্মায়ে আরবাআ আর মালিক বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকরের কাছে এক মৃত ব্যক্তির দাদী তার মৃত নাতির পরিত্যক্ত সম্পদের ফারায়েজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তার ভাগ চাইলো। তিনি বললেন, “আপনার অংশ প্রাপ্ত সম্পর্কে কুরআনে কিছু নেই। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ সম্পর্কিত কোন ফায়সালাও আমার জানা নেই। আপনি আসুন।” আমি লোকদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে মুগীরা বিন শোবা বললেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার দাদীকে ষষ্ঠাংশ প্রদান করেছেন।” তিনি বললেন, “তোমার মত কারো এ কথা মনে আছে কি ?” মুহাম্মাদ বিন মাসলামা দাঁড়িয়ে তার কথার প্রতি সমর্থন জানালে তিনি তাকে ষষ্ঠাংশ প্রদান করলেন।

কাসিম থেকে মালিক আর দারা কুতনী বর্ণনা করেছেন, মৃত ব্যক্তির দাদী আর নানী তার কাছে উপস্থিত হয়ে মিরাস চাইলে তিনি নানীকে অংশ দিলেন।

বদরী সাহাবী আব্দুর রহমান বিন সহল আনসারী আবেদন করলেন, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হে খলীফা, আপনি মৃত ব্যক্তির সম্পদ (দাদী ও নানীর মধ্যে) বণ্টন করেছেন। কিন্তু তার ওয়ারিশরা যদি তাদের না চিনে ?” (এরপরও) তিনি তাদের অংশ দিয়েছেন।

আয়েশা সিদ্দীকা থেকে আব্দুর রাযযাক বর্ণনা করেছেনঃ এক মহিলা স্বামীর থেকে তালাক নিয়ে আব্দুর রহমান বিন যুবাইরের সাথেও তার কোন এক গোপন বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় তার থেকেও তালাক নিয়ে আগের স্বামীকে বিয়ে করতে চাইলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “দ্বিতীয় স্বামীর সাথে সহবাস না করলে তোমার তালাক বৈধ নয়।” এ হাদিসটি বুখারী শরীফেও আছে। তবে আব্দুর রাযযাক এতটুকু বৃদ্ধি করেছেন যে – সে মহিলা নবী করীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কছে দুইবার উপস্থিত হয়ে বললেন, “আব্দুর রহমান আমার সাথে সহবাস করেছে।” এরপরও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কথা প্রত্যাখ্যান করলেন আর এ বলে দুয়া করলেন, “ইয়া আল্লাহ, এ নারী বিচ্ছিন্ন স্বামীর মিলন প্রত্যাশায় তার কাছে ফিরে যেতে চায়। তার দ্বিতীয় বিয়ে পূর্ণ করবেন না।” এ মহিলা আবু বকর সিদ্দীক আর উমর ফারুকের খিলাফতকালেও একই আবেদন নিয়ে তাদের কাছে উপস্থিত হয়, কিন্তু তারা দুজনই তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।

উকবা বিন আমের থেকে বায়হাকি বর্ণনা করেছেনঃ উকবাকে দূত বানিয়ে আমর বিন আস আর শারজীল বিন হাসানা তার হাতে সিরিয়ার (লোকের) মাথার খুলি আবু বকরের কাছে পাঠান। দূত এসে পৌঁছলে তিনি এ ধরণের কাজ করতে নিষেধ করলেন। উকবা বললেন, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হে  খলীফা, তারাও তো আমাদের সাথে এমন আচরনই করেছে।” তিনি বললেন, “আমর বিন আস আর শারজীল কি তাহলে পারস্য আর রোমানদের অনুসরণ করছে ? কাউকে হত্যা না করে অগ্রসর হও। অনুসরণের জন্য কুরআন আর হাদিসই যথেষ্ট।”

বুখারী শরীফে কায়েস বিন আবু হাযেম থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ যায়নব নামের এক মহিলা কোন কথা বলতো না। আবু বকর তাকে কথা বলতে বললেও সে কথা বললো না। লোকেরা বললো, “সে নীরবতার সাথে হাজ্জ আদায় করেছে।” তিনি তাকে বললেন, “কথা বলো, তোমার এ আচরণ জাহেলিয়াতের কাজ। ইসলামে এ ধরণের বৈরাগ্য জীবনযাপন নাযায়েজ।” এ কথা শুনে সে কথা বলতে লাগলো আর জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কে ?” আবু বকর বললেন, “আমি মুহাজির।” মহিলা বললো, “আপনি কোন মুহাজিরদের অন্তর্ভুক্ত ?” তিনি বললেন, “আপনি তো জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। আমি আবু বকর।” সে বললো, “জায়েলিয়াতের পর আল্লাহ এ দ্বীন পাঠিয়েছেন, কিন্তু কোন ব্যক্তি আমাদেরকে এর উপর প্রতিষ্ঠিত করবে ?” তিনি বললেন, “তোমাদের ইমামগণ কর্তৃক।” সে বললো, “ইমাম কে ?” তিনি বললেন, “তোমার সম্প্রদায়ের কি কোন নেতা নেই, যিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেন ?” সে বললো, “জি, রয়েছেন।” তিনি বললেন, “তিনিই ইমাম।”

আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকরের এক গোলাম ছিল। সে শ্রমিকের কাজ করতো আর তিনি তার জন্য বেতন নির্ধারণ করেছিলেন। উভয়ে একত্রে খাবার খেতেন। একদিন গোলাম কিছু জিনিস আনলো আর আবু বকর তা থেকে কিছুটা খেয়ে ফেললেন। গোলাম বললো, “আপনি কি জানেন, এ জিনিস কিভাবে সংগৃহীত হয়েছে ?” তিনি পুরো বিষয় জানতে চাইলে সে বললো, “জাহেলিয়াতের যুগে আমি ভবিষৎবাণী করতাম। আর আপনি জানেন যে, সত্য ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ভবিষৎবাণী করা হয়। আমি এক ব্যক্তিকে ভবিষৎবাণী দ্বারা প্রতারিত করেছিলাম। আজ সেই বদলা হিসেবে আমাকে এ জিনিস দিয়েছে, যা আপনি খেয়েছেন।” এটা শুনে তিনি সাথে সাথে তা বমি করে ফেলে দিলেন।

যুহদ গ্রন্থে আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে সিরিন বলেছেন, “আবু বকর সিদ্দীক ছাড়া আমি কাউকে সন্দেহযুক্ত খাবার আহারের পর বমি করতে শুনিনি।” এরপর তিনি উক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেন।

আসলাম থেকে নাসাঈ বর্ণনা করেছেনঃ একদিন উমর ফারুক (রাঃ) দেখলেন যে, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) নিজের জিহ্বা টেনে ধরে বলছিলেন, “এটা আমাকে খারাপ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে।”

গারীব গ্রন্থে আবু উবায়দ লিখেছেনঃ আব্দুর রহমান বিন আউফকে নিজ আত্মীয়ের সাথে লড়াই করতে দেখে  আবু বকর সিদ্দীক বললেন, “আত্মীয়-পরিজনের সাথে লড়াই করো না, এ লড়াই বিবাদকে জিয়ে রাখে, ফলে লোকেরা তোমার সমালোচনা করবে।”

মুসা বিন উকবা (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) তার অভিভাষণে বলেন, “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ’র জন্য, আমি তার তারীফ করছি, তার কাছে প্রার্থনা করছি আর মৃত্যুর পর তার কাছে মর্যাদা কামনা করছি। আমাদের মৃত্যু নিকটবর্তী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই আর কোন কাজে তার কোনই অংশীদার নেই; আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ’র বান্দা ও রাসুল। আল্লাহ তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যসহ সুসংবাদ প্রদানকারী, ভীতি প্রদর্শনকারী আর প্রদীপমালার উজ্জ্বল রশ্মি করে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবিত লোকদের ভীতি প্রদর্শন আর অবিশ্বাসীদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনুগত্য করবে, তারা সুপথ প্রাপ্ত। আর যারা বক্রতা দেখাবে, তারা পথভ্রষ্ট।

হে লোকসকল, আমি আপনাদেরকে ওসীয়ত করছি আল্লাহকে ভয় করার। আল্লাহ হিদায়াতের যে পথ আপনাদেরকে দেখিয়েছেন, সে পথে আপনারা অটল থাকবেন। কালেমায়ে ইখলাসের পর হিদায়াতের উদ্দেশ্যই হচ্ছে নেতার আনুগত্য করা, কারন আল্লাহ আর সেই নেতা, যিনি সত্যের আদেশ ও অসত্যের প্রতি বাধা প্রদান করেন, তার আনুগত্য করলে কল্যাণ লাভ করবে আর তার প্রতি যে হক ছিল সেটাও আদায় হবে। নফসের আনুগত্য করবেন না। আত্মার ভোগমুক্ত ব্যক্তি কল্যাণকামিতার নাগাল পাবেন। অহংকার করবেন না। ভেবে দেখুন, অহংকারী ব্যক্তি তো মাটি থেকে সৃষ্ট আর একদিন সে মাটির সাথেই মিশে যাবে। আজ যে জীবিতকাল বদ দুয়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবেন। সবসময় নিজের অন্তরকে মৃত মনে করবেন। অটুট ও দৃঢ়তা অভিপ্রায় পোষণ করবেন। কারন পোকতা ইরাদা নেক আমল করতে উদ্বুদ্ধ করে। (মন্দ কাজ) পরহেয করবেন। (মন্দ কাজ) বর্জন করা অনেক লাভজনক। আমল করবেন, কারন আমল কবুল করা হয়। যে কাজ আল্লাহ’র আযাবের প্রতি ঠেলে দেয়, সে কাজ বাদ দিন। আর যে কাজের মধ্যে আল্লাহ তার রহমতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সে কাজ সবসময় করবেন। বুঝেন আর বুঝান; ভয় করুন আর ভয় দেখান। কোন কাজ করলে ধ্বংস অবধারিত, আর কোন কাজ করলে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তা আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন। আমি তোমাদেরকে নিজের নফস সম্পর্কে ওসীয়ত করতে কুন্ঠিত হইনি। আল্লাহই একমাত্র সাহায্যকারী। তার সাহায্য ছাড়া ভালো কাজ করা আর মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকার শক্তি কারো নেই। নিষ্ঠার সাথে ইবাদাত করবেন, আল্লাহ’র আনুগত্য করবেন, নিজ অংশ সংরক্ষণ করবেন আর হিংসা পরায়ণ হবেন না। ফরয ইবাদতে কমতি থাকার কারণে নফল ইবাদত বেশী বেশী করবেন।

হে আল্লাহ’র বান্দাগণ, নিজেদের ভাই আর বন্ধুগণ যারা পরকালের চলে গিয়েছেন, তারা যা করে গেছেন, তা-ই তাদের প্রাপ্য।

সৃষ্টজীব আর তাদের জাতের মধ্যে আল্লাহ’র কোন শরীক নেই, কোন বংশ পরম্পরাও নেই। তিনি নিজ মেহেরবানীতে মাখলুককে ক্ষমা করেন। মাখলুক ইবাদত আর আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি মাখলুকের উপর মুসীবত চাপিয়ে দেন না। যে ভালো কাজের ফলাফল জাহান্নামে, সেটি কোন ভালো কাজই না; আর যে মন্দ কাজের পরিণাম জান্নাত, সেটা তো কোন মন্দ কাজই না। আমি এটাই বলতে চাই। আমি আল্লাহ’র কাছে আপনাদের আর নিজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম এবং তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর আল্লাহ’র রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হোক।”

আবদুল্লাহ বিন হাকিম থেকে হাকিম ও বায়হাকি বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আমাদের সামনে এক অভিভাষণ প্রদান করলেন। তিনি হামদ ও সানার পর বললেন, “আমি আপনাদের ওসীয়ত করছি – আল্লাহকে ভয় করুন, প্রশংসিত পরিবারের গুণকীর্তন করুন আর আর আপনাদের প্রবল বাসনাকে ভয়ের সাথে মিলিয়ে দিন। আল্লাহ তাআলা যাকারিয়া (আঃ) এর বংশের প্রশংসা করেছেন এভাবে –

إِنَّهُمْ كَانُوا يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَيَدْعُونَنَا رَغَبًا وَرَهَبًا ۖ وَكَانُوا لَنَا خَاشِعِينَ

‘নিশ্চয়ই তারা সৎকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তো,তারা আশা ও ভীতি সহকারে আমাকে ডাকতো আর তারা ছিল আমার কাছে বিনীত।’ (সূরাহ আল-আম্বিয়া, ২১ :৯০)

আল্লাহ’র বান্দাগণ, মনে রাখুন, আল্লাহ আপনাদের অন্তরগুলো নিজের অধিকারের বিনিময়ে বন্ধক রেখেছেন আর এ বিষয়ে তিনি আপনাদের থেকে প্রতিশ্রুতিও নিয়েছেন। আর তিনি আপনাদের থেকে নশ্বর দুনিয়াকে অবিনশ্বর আখিরাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। আপনাদের কাছে আল্লাহ’র যে পবিত্র কালাম আছে, তার দীপ্তি কখনোই নিভে যাবে না আর এর রহস্য কখনোই নিঃশেষ হবে না। আপনারা ঐশী কিতাবের আলোয় আলোকিত হোন, এ কিতাবের নসীহত গ্রহণ করুন আর যেদিন কোন আলো থাকবে না সেদিন এ কিতাবের আলো পাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিন। আল্লাহ আপনাদের সৃষ্টি করেছেন ইবাদত করার জন্য আর কিরামান কাতিবীন ফেরেশতাদেরকে নিযুক্ত করেছেন। তারা আপনাদের সব কাজ সম্পর্কে জানেন।

হে আল্লাহ’র বান্দাগণ, আপনারা প্রত্যেক মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন, এ সম্পর্কিত জ্ঞান আপনাদের অগোচরে রয়েছে। যদি আপনারা এ সম্পর্কে জানতেন, তবে মৃত্যুর সময় আপনারা নেক আমল করতেন, আর এমনটা আল্লাহ’র রহমত ছাড়া আপনারা পাবেন না। মৃত্যুর প্রাক্কালে কিছু ভালো আমলের চেষ্টা করুন, যাতে মন্দ কাজ থেকে নিরাপদ থাকতে পারেন। আপনাদের পূর্বে অনেক জাতি ছিল, মৃত্যুর সময় এলে তারা শিরক করেছে আর আল্লাহকে ভুলে গেছে। আমি আপনাদের হুশিয়ার করছি – আপনারা তাদের মতো হবেন না। সুতরনাগ তাড়াতাড়ি করুন, তাড়াতাড়ি করুন, ক্ষমা প্রাপ্তির চেষ্টা করুন। মৃত্যু তো খুবই নিকটবর্তী। ভীতি ছড়ানোর জন্য মৃত্যু ধেয়ে আসছে। হে মুসলমান, ক্ষমা আপনাদের জন্যই।”

হুলীয়ার ইয়াইয়া বিন কাসির থেকে ইবনে আবিদ দুনিয়া আর আবু নুয়াইম বর্ণনা করেনঃ আবু বকর এক ভাষণে বলেন, “উজ্জ্বল চেহারার সেই তরুণেরা কোথায়, যাদের যৌবন দেখে লোক পেরেশান থাকতো ? রাজা-বাদশাহরা কোথায়, যারা শহর আর দুর্গ নির্মাণ করেছে ? যারা লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে তারা কোথায় ? তাদের প্রতাপ তো আজ খর্ব হয়েছে। যুগের আবর্তে তারা আজ অন্ধকার কবরে শুয়ে আছে। (সুতরাং) সব সময় ভালো আমল করুন, আর নেক কাজের প্রতি ধাবিত হোন।”

যুহদ গ্রন্থে সালমান (রাঃ) থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আবু বকরের কাছে উপস্থিত হয়ে সালমান বললেন, “আমাকে নসীহত করুন।” তিনি বললেন, “হে মুসলমান, আল্লাহকে ভয় করো আর নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন যে, অচিরেই প্রত্যেক গোপন কথা প্রকাশ পেয়ে যাবে আর লোকেরা জেনে নিবে প্রত্যেক জিনিসে তোমার অংশ কতটুকু তুমি খেয়েছো আর কি রেখেছো। মনে রেখো, যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার নিরাপত্তা আল্লাহ’র যিম্মায়। আর যার যিম্মাদার স্বয়ং আল্লাহ, তাকে কে আঘাত করতে পারে ? আর যে আল্লাহ’র সাথে প্রতিশ্রুতি ভাঙবে, তিনি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” তিনি আরো বললেন, “একে একে নেককার বান্দাদের উঠিয়ে নেওয়া হবে। অবশেষে আটার বোঝার মতো অসমর্থ কিছু লোক থেমে যাবে, যাদের সাথে আল্লাহ’র কোনোই সম্পর্ক থাকবে না।”

মুআবিয়া বিন কাররাহ থেকে সাঈদ বিন মানসুর বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক অধিকাংশ সময় এ দুয়া করতেন, “হে বিশ্ব প্রতিপালক, আমার শেষ বয়সটাও সুন্দর করে দিন। নেক আমলে থাকা অবস্থায় যেন আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করি। আপনার সাথে সাক্ষাতের দিনটা যেন সকল দিনের চেয়ে উত্তম হয়।”

যুহদ গ্রন্থে হাসান (রাঃ) থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ আমার কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, তিনি অধিকাংশ সময় এ দুয়া করতেন – “হে আমার রব, আমি সেই জিনিষের প্রার্থনা করছি, যা আমাকে নিরাপত্তা দিবে। হে আমার রব, আমাকে আপনার সন্তুষ্টি আর জান্নাতের বুলন্দ মর্তবা দান করুন।”

আরফাজ (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলতেন, “যে আল্লাহ’র ভয় নিয়ে চলাফেরা করে, সে যেন আল্লাহ’র ভয়ে কাঁদে, নাহলে সে যেন কাঁদার ভান করে।”

আযরা বর্ণনা করেছেন যে আবু বকর সিদ্দীক বলেছেন, “জাফরান ও স্বর্ণের সংমিশ্রণে রক্তিম বর্ণ মেয়েদের ধ্বংস করে দিয়েছে।”

মুসলিম বিন ইয়াসার বর্ণনা করেছেন যে আবু বকর সিদ্দীক বলেছেন, “মুসলমানগণ প্রতিটি কাজের প্রতিদান পাবেন, এমনকি সামান্যতম দুঃখ, জুতার ফিতা ছিড়ে যাওয়া আর সম্পদ কম হওয়ারও।”

মাইমুন বিন মিহরান থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ একটি পাখি শিকার করে আবু বকর সিদ্দীকের কাছে নিয়ে আসা হলে তিনি পাখিটিকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে বললেন, “আল্লাহ’র তাসবিহ ছেড়ে দেওয়ার কারনে প্রাণীকে মেরে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আর বৃক্ষ কেটে ফেলা হয়।”

বুখারী আদব অধ্যায়ে আর আবদুল্লাহ বিন আহমাদ যাওয়ায়িদুয যুহদ গ্রন্থে যানাবাহি থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি আবু বকর সিদ্দীকের কাছে শুনেছেন যে আবু বকর বলেছেন, “আল্লাহ’র ওয়াস্তে এক ভাই অপর ভাইয়ের জন্য যদি দুয়া করে, তবে অবশ্যই তা কবুল হবে।”

যাওয়ায়িদুয যুহদ গ্রন্থে উবাইদ বিন উমায়ের থেকে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীকের কাছে লবীদ শায়ের উপস্থিত হয়ে কবিতার এ পংক্তিটি আবৃত্তি করলো – “মনে রাখুন, আল্লাহ ছাড়া প্রতিটি বস্তু বাতিল।” তিনি বললেন, “আপনি সত্য বলেছেন।” কবি আবার দ্বিতীয় পংক্তিটি আবৃত্তি করলো – “সকল নেয়ামত ধ্বংসশীল।” তিনি বললেন, “আপনি অসত্য বলছেন। আল্লাহ’র কাছে এই এই নিয়ামতগুলো আছে, যা কখনোই ধ্বংস হবে না।” কবি লাবীদ চলে গেলে তিনি বললেন, “কবি হেকমত অর্থাৎ সূক্ষ্ম জ্ঞানের কথা বলে থাকেন।”

 

 

 

আবু বকরের যেসব বাণী আল্লাহ’র ভয় সম্পর্কিত   

মাআয বিন জাবাল (রাঃ) থেকে আবু আহমদ হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এক বাগানে ঢুকে গাছের ছায়ায় একটি পাখি দেখে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, “হে পাখি তুমি বড়ই ভাগ্যবান। গাছের ফল খাচ্ছো, গাছের ছায়ায় থাকছো, তোমার কোন হিসাব নেই। হায়, আবু বকর যদি তোমার মতো হতো!”

বায়হাকি থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ প্রশংসা করার সময় তিনি বলতেন, “হে আল্লাহ, আপনি আমার নফস সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশী জানেন। আর আমি নিজের ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে বেশী জানি। হে আল্লাহ, তারা আমার ভালো কাজ সম্পর্কে যে ধারণা করে, আমাকে অনুরূপ করে দিন। আর আমার যে গুনাহ তারা জানে না, তা ক্ষমা করুন।”

যুহদ গ্রন্থে আহমাদ লিখেছেন যে, আবু বকর বলেছেন, “আমি যদি মুমিনের একটি পশমও হতাম, তবে তা আমার কাছে অধিক প্রিয় হতো।”

যুহদ গ্রন্থে মুজাহিদ থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ ইবনে যুবাইর নামাযের সময় খুবই বিনয়ের সাথে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যেন তিনি শুকনো একটি কাঠের টুকরো। আবু বকরের অবস্থাও ছিল একই।

হাসান বলেছেন যে, আবু বকর বলতেন, “আল্লাহ’র কসম, আমি যদি গাছ হতাম, আমাকে কেটে ফেলতো, আমি কেটে যেতাম – এটাই আমার জন্য প্রিয় ছিল।”

কাতাদা বলেছেনঃ এ বর্ণনা আমার জানা, যা আবু বকর কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। আবু বকর এক মহিলার মৃত্যুর সময় বারবার তার বালিশের দিকে দেখছিলেন। মহিলার মৃত্যুর পর এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বালিশের নিচে পাঁচ বা ছয় দিনার দেখিয়ে হাতে হাত মেরে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়ে বললেন – “হে অমুক, আমি চাইনি তোমার এ অবস্থা হোক।”

সাবিত বানানী বলেছেন যে, তিনি সবসময় এ কবিতা পাঠ করতেন – “তুমি মানুষের সংবাদ বহন করছো, কখন তোমার সংবাদ তারা বহন করবে সেটা কি জানো ?”

ইবনে সিরীন থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর সিদ্দীকে আকবরের খিলাফতকালে লোকেরা অসঙ্গত কথা বলতে ভয় করতো না। তারপর ফারুকের আযমের (উমরের) সময় লোকেরা তাই করতো। বিচারের সময় কুরআন ও হাদিস থেকে রায় দিতে না পারলে তিনি রায় ঘোষণার সময় বলতেন, “আমি এ রায় ঘোষণার ব্যাপারে ইজতিহাদ করেছি। যদি তা সঠিক হয়, তবে মনে করবে এটি আল্লাহ’র পক্ষ থেকে হয়েছে; আর যদি তা সঠিক না হয়, তবে আমি আল্লাহ’র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

 

 

স্বপ্নের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার 

সাঈদ বিন মুসাইয়াব থেকে সাইদ বিন মানসুর বর্ণনা করেছেনঃ আয়েশা সিদ্দীকা একবার স্বপ্নে দেখেন, তার ঘরে তিনটি চাঁদ উদিত হয়েছে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা নেওয়ার জন্য আবু বকরকে এ কথা বললে তিনি বললেন, “এ স্বপ্ন সত্য হলে তোমার ঘরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিন মনীষীর দাফন হবে।” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর তিনি বললেন, “হে আয়েশা, তোমার দেখা স্বপ্নে তিন চাঁদের মধ্যে ইনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।”

উমর বিন শারজীল থেকে সাঈদ বিন মানসুর বর্ণনা করেছেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের স্বপ্নের কথা বর্ণনা করেছিলেন – “আমি একদল কালো ছাগলের পশ্চাৎপদ অনুসরণ করছি। এরপর দেখলাম, সাদা ছাগলের পালের পিছে পিছে চলছি। আর এক সময় সাদা ছাগলের দল কালো ছাগলের ভিড়ে হারিয়ে গেলো।” আবু বকর সিদ্দীক বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), সাদা ছাগল আরবের মুসলমান, আর কালো ছাগলের দল অনারব মুসলমান। ভবিষ্যতে আরব মুসলমানদের তুলনায় অনারব মুসলমানদের সংখ্যা অধিক বৃদ্ধি পাবে।” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “সত্য বলেছো। সকালে ফেরেশতা এসে আমাকে এমন ব্যাখ্যাই দিয়ে গেছেন।”

সাঈদ বিন মানসুর থেকে ইবনে আবী লায়লা বর্ণনা করেছেনঃ নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি একটি কুপের পানি সিঞ্চন করছেন, আর তার পিছে কৃষ্ণকায় ছাগলের পাল এসে দাঁড়ায়। আর এর পিছে এমন একদল ছাগল আসে, যাদের লালবর্ণের পশুগুলো সাদার উপর প্রাধান্য পায়। আবু বকর এ প্রেক্ষিতে উপরোল্লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

মুহাম্মাদ বিন সিরীন থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ এ উম্মতের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) স্বপ্নের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার।

ইবনে শিহাব থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ আমরা একই সোপানে আরোহণ করতে গিয়ে আমি তোমার চেয়ে দেড় সিঁড়ি এগিয়ে গেলাম। এটা শুনে আবু বকর সিদ্দীক বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আল্লাহ আপনাকে নিজের রহমত আর মাগফেরাতের মাধ্যমে আগেই আহবান জানাবেন। আর আমি আপনার দেড় বছর পর ইন্তেকাল করবো।”

আব্দুর রাযযাক তার রচনায় আবু কিলাবার বরাত দিয়ে লিখেছেনঃ এক ব্যক্তি আবু বকর সিদ্দীককে বললেন, “আমি স্বপ্নে নিজেকে রক্ত প্রস্রাব করতে দেখেছি।” তিনি বললেন, “মনে হয় তুমি হায়েয অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মিলিত হও। আল্লাহ’র কাছে তাওবা করো এবং এমনটা করো না।”

ফায়দাঃ বায়হাকি দালায়েল গ্রন্থে আবদুল্লাহ বিন বুরাইদা থেকে বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর বিন আস (রাঃ) কে দলপতি বানিয়ে এক যুদ্ধে পাঠালেন। এ দলে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আর উমর ফারুক (রাঃ) ছিলেন। রনাঙ্গনে পৌঁছে আমর বিন আস আগুন জ্বালাতে নিষেধ করলে আবু বকর সিদ্দীক তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমর বিদ্যায় অধিক দক্ষ ভেবে তাকে যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তাকে অনুসরণ করো।”

বায়হাকি অন্য বরাত দিয়ে লিখেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি (কখনো) কোন জাতির নেতা হিসেবে এমন ব্যক্তি নির্বাচন করে থাকি, যদিও তার চেয়ে উত্তম আর সমর বিদ্যায় অধিকতর দক্ষ ব্যক্তি রয়েছে।”

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

ইয়াজিদ বিন আসাম থেকে খলীফা বিন খাইয়াত, আহমদ বিন হাম্বল আর ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি, না আপনি বৃদ্ধ ?” তিনি বললেন, “বয়সে আমি বড় হলেও আপনি বৃদ্ধ।” এ বর্ণনাটি মুরসাল আর গরীব। যদি একে সহিহ মনে করা হয়, তবে এতে করে আবু বকরের বুদ্ধিমত্তা আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রমাণিত হয়।

কথিত আছে, আব্বাস (রাঃ) একই প্রশ্নের ভিত্তিতে এ জবাবই দিয়েছিলেন। সাঈদ বিন ইয়াবু’র বরাতে তাবারানী গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাঈদ বিন ইয়াবু’কে জিজ্ঞেস করলেন, “আমাদের মধ্যে বড় কে ?” তিনি বললেন, “আপনি বড়, যদিও পৃথিবীতে আমিই আগে এসেছি।”

আবু নাঈম লিখেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীককে বলা হলো, “আপনি কেন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের কাজের প্রতি নির্দেশ করেন না ?” তিনি বললেন, “আহলে বদরের মর্যাদা সম্পর্কে আমি জানি বলে তাদেরকে বৈষয়িক কাজে ব্যস্ত করে রাখা মাকরূহ মনে করি।”

যুহদ গ্রন্থে ইসমাইল বিন মুহাম্মাদ থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আবু বকর সিদ্দীক লোকদের মধ্যে সমানভাগে কিছু ভাগ করে দিচ্ছিলেন। উমর ফারুক বললেন, “আপনি আহলে বদর আর সাধারণ জনতাকে এক সমান করে দিয়েছেন।” তিনি বললেন, “পৃথিবীতে এতটুকুই যথেষ্ট, যদিও তারা মর্যাদা ও সম্মানের দিক থেকে অনেক বেশী।”

 

নবম পরিচ্ছেদ

আবু বকর বিন হাফস থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) গরমে রোযা রাখতেন আর শীতে ইফতার করতেন।

ইবনে সাদ হাইয়ান, সানীআ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছেঃ আবু বকর সিদ্দীকের মোহরে نِعْمَ الْقَادِرُ اَللهُ   লিখা ছিল।

মুসা বিন উকবা থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেনঃ একই বংশের চার পুরুষ নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেননি। কিন্তু আবু কুহাফা, তার ছেলে আবু বকর, তার ছেলে আব্দুর রহমান, তার ছেলে আবু আতিক (যার নাম ছিল মুহাম্মাদ) – তারা সকলেই নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছেন।

ইবনে মিন্দা আর ইবনে আসাকির আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকরের পিতা ছাড়া কোন মুহাজিরীনের পিতা ইসলাম গ্রহণ করেননি।

ইবনে সাদ আর বাযযার সুন্দর সনদের মাধ্যমে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ সাহাবীদের মধ্যে আবু বকর, সুহাইল বিন আমর এবং আমর বিন বাইযার বয়স ছিল সবচেয়ে বেশী।

দালায়েল গ্রন্থে আসমা বিনতে আবু বকরের বরাত দিয়ে বায়হাকি লিখেছেনঃ মক্কা বিজয়ের বছর আবু বকরের বোন বাইরে কোথাও বের হয়েছিলেন। পথিমধ্যে এক দল অশ্বারোহীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। এদের মধ্যে কেউ একজন তার গলায় চান্দীর হারটি খুলে নেয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে এলে আবু বকর দাঁড়িয়ে দুই বার তার বোনের হারটি ফেরত চাইলে কেউ কোন সাড়া দিলো না। এরপর তিনি তার বোনকে বললেন, “তুমি তোমার হারের আশা ছেড়ে দাও আর সবর করো। আল্লাহ’র কসম, বর্তমান আমানতদারী কমে গেছে।”

হাফেজ যাহাবীর কোন এক রচনায় লিপিবদ্ধ আছেঃ আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সে যুগের শ্রেষ্ঠ আলিম ছিলেন।