উমর বিন খাত্তাব বিন নফীল বিন আবদুল উযযা বিন রুবাহ বিন কুরাত বিন যরাহ বিন আদী বিন কাব বিন লুবী আমিরুল মুমিনীন আবু হাফস আল-কুরাইশী আল-ফারুক নবুওয়াতের ষষ্ঠ বর্ষে ২৭ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। যাহাবী আর ইমাম নববী লিখেছেন,হস্তি বাহিনীর ঘটনার ১৩ বছর পর তার জন্ম।
তিনি কুরাইশদের উঁচু বংশের লোক ছিলেন। জাহেলিয়াতের যুগে তিনি দূতের দায়িত্ব পালন করেন। কুরাইশদের মধ্যে বা অন্য কোন রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ বেঁধে গেলে শান্তি স্থাপনের জন্য তিনি কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতেন,অথবা নিজেদের মধ্যে বংশের গৌরব প্রদর্শনের প্রয়োজন দেখা দিলে সবার আগে তিনিই সে কাজের জন্য মনোনীত হতেন।
তিনি ৪০ জন পুরুষ এবং ১১ জন মহিলার পর মক্কায় ইসলাম প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুসলমানগণ খুবই আনন্দিত হোন।
তিনি আশারায়ে মুবাশশারা এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শ্বশুর হওয়ার গৌরব অর্জনকারী এবং সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে বিজ্ঞ আলেম ও পরহেযগার ব্যক্তি ছিলেন।
তার থেকে ৫৩৯টি হাদীস বর্ণিত রয়েছে। তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনাকারীগণ হলেন -উসমান বিন আফফান, আলী বিন আবু তালিব,তালহা ইবনে আউফ,ইবনে মাসউদ,আবু যর,আমর বিন আবসাহ,আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আবসাহ,ইবনে আব্বাস,ইবনে যুবায়ের,আবু হুরায়রা,আনাস,আমর বিন আস,আবু মূসা আশআরী,বারা ইবনে আযেব,আবু সাঈদ খুদরী,সাদ প্রমুখ সাহাবায়ে কেরামগণ।
ইসলাম গ্ৰহণ
আব্দুল্লাহ বিন উমর থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুআর মধ্যে বললেন – “হে আল্লাহ,উমর বিন খাত্তাব অথবা আবু জাহেল বিন হিশাম,যাকে ইচ্ছে মুসলমান করে ইসলামকে বিজয় দান করুন।” এ হাদীসটি ইবনে মাসউদ আর আনাস থেকেও তিরমিয়ী বর্ণনা করেছেন।
ইবনে আব্বাস থেকে হাকীম বর্ণনা করেনঃ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ দুআ করেন,“হে আল্লাহ,উমর বিন খাত্তাবের মাধ্যমে ইসলামকে জয়যুক্ত করুন।” এ বর্ণনায় অন্য কারো নাম নেই। এ বর্ণনাটি তিরমিযী আওসাত গ্রন্থে আবু বকর সিদ্দীক থেকে এবং করীরা গ্রন্থে সাওবান থেকে বর্ণনা করেছেন।
হযরত উমর থেকে আহমাদ বর্ণনা করেছেনঃ আমি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বন্দী করার জন্য মসজিদে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআন শরীফের কোন এক সূরা তিলাওয়াত করছিলেন। কুরআনের মহিমান্বিত ও সুষমাসিক্ত বাণী শুনে মনে মনে বললাম,“কুরাইশদের কথাই সঠিক,সত্যিই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক অনন্য কবি।” কিন্তু যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –
إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ ﴿٤٠﴾ وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ ۚ قَلِيلًا مَّا تُؤْمِنُونَ ﴿٤١﴾
“নিঃসন্দেহে এ কিতাব একজন সম্মানিত রাসুলের (আনীত) বাণী। এটি কোন কবির কাব্যকথা নয়, যদিও তোমরা খুব কমই বিশ্বাস করো।” (সূরাহ আল-হাককাহ, ৬৯ : ৪০-৪১)
– এ আয়াতগুলো পাঠ করলেন,তখন ইসলাম আমার অন্তরকে নাড়া দিলো,আর এর শ্রেষ্ঠত্ব অনুভূত হলো।
হযরত জাবের থেকে ইবনে আবু শায়বা বর্ণনা করেছেনঃ হযরত উমর তার ইসলাম গ্রহণের বিবরণ এভাবে পেশ করেন – আমার বোন ঘরে এলে আমি কাবা শরীফে গিয়ে দেখলাম,নবী আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ ঘরে প্রত্যাবর্তন করছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আওফী কাপড় পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইতুল্লাহ চত্বরে ফিরে এসে নামায পড়লেন এবং পুনরায় ফিরে গেলেন। এ সময়ের মধ্যে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট এমন কথা শুনলাম যে পূর্বে শুনিনি। যাবার সময় আমি তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছু নিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“কে ?” আমি বললাম,“উমর।” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“উমর কখনো আমার পিছু ছাড়ে না।” একথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এরপর কালেমা পড়লাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখবে।” আমি বললাম,“ঐ সত্তাৱ কসম,যিনি আপনাকে সত্য নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন,আমি অবশ্যই তা প্ৰকাশ করবো,যেমন শিরকের প্রকাশ ঘটিয়েছি।”
ইবনে সাদ,আবু ইয়ালা,হাকীম এবং বাইহাকী দালায়েল গ্রন্থে আনাস থেকে বর্ণনা করেছেনঃ উমরকে পথিমধ্যে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে দেখে বনু যোহরা বংশীয় এক ব্যক্তি বললেন,“কি উদ্দেশ্যে কোথায় চলেছেন?” উমর বললেন,“মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হত্যা করতে।” তিনি বললেন,“এ কাজ করলে বনী হাশিম ও বনী আব্দুল মুত্তালিব কি তোমাকে ছেড়ে দিবে ভেবেছো ?” উমর বললেন,“মনে হয় তুমি বিধর্মী (মুসলমান) হয়ে গেছো ?” তিনি বললেন,“এর চেয়েও আশ্চর্যের কথা হলো তোমার ভগ্নি আর ভগ্নিপতি উভয়েই তোমার ধর্ম ত্যাগ করেছেন।” উমর ভগ্নিপতির বাড়িতে গেলেন। খাব্বাব তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দেবার জন্য আগেই সেখানে এসেছিলেন। তাঁর পদধ্বনি শুনে খাব্বাব আত্নগোপন করলেন আর তাঁরা কুরআন তিলাওয়াত থামিয়ে দিলেন। সে সময় তাঁরা সূরা “ত্বহা” পাঠ করছিলেন। ঘরে ঢুকে উমর বললেন,“তোমরা কি পড়ছিলে ?” তার বোন বললেন,“কিছু না,আমরা কথা বলেছিলাম।” তিনি বললেন,“মনে হয় তোমরা বিধর্মী (মুসলমান) হয়ে গেছো।” তার বোন রাগত স্বরে বললেন,“যেহেতু তোমার ধর্মে সত্যের কোনো স্থান নেই,সেজন্য আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি – এক আল্লাহ ছাড়া কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়,এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।” উমর বললেন,“তোমাদের গ্রন্থটি দাও,আমি পড়বো।” তার বোন বললেন,“তুমি অপবিত্র হয়ে পবিত্র গ্রন্থটি স্পর্শ করতে পারো না। তুমি গোসল অথবা অযু করে এসো।” তিনি অযু করলেন আর তা নিয়ে পাঠ করলেন – যেখানে সূরা “ত্বহা” লিখা ছিল।
إِنَّنِي أَنَا اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي ﴿١٤﴾
“আমিই আল্লাহ,আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই;অতএব আমার ইবাদাত করো আর আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম করো।” (সূরাহ ত্বহা,২০ : ১৪)
– এ আয়াত পর্যন্ত পাঠ শেষে উমর বললেন,“আমাকে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে নিয়ে চলো।” খাব্বাব উমরকে নিয়ে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে যান। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থানরত বাড়ির দরজায় হামযা,তালহা প্রমুখ সাহাবাগণ বসা ছিলেন। উমরকে আসতে দেখে হামযা বললেন,“উমর আসছেন। যদি তার উদ্দেশ্য ভালো হয়,তবে তিনি আমার হাত থেকে রক্ষা পাবেন,নতুবা আমি তাঁকে হত্যা করবো।” এ অবস্থায় ওহী নাযিল হওয়ার প্রেক্ষিতে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উমরের জামার প্রান্ত আর তলোয়ার ধরে বললেন,“হে উমর, এ বিশৃঙ্খলা কি ওলীদ বিন মুগীরার মতো অনন্তকাল অব্যাহত থাকবে ?” উমর এই বলে মুসলমান হয়ে গেলেন –
اشهد ان لا اله الا الله وانك عبد الله ورسوله
বায্যার,তিরমিয়ী আর আবু নাঈম হুলয়া গ্রন্থে এবং বায়হাকি দালায়েল গ্রন্থে হযরত আসলাম থেকে বৰ্ণনা করেছেন যে,উমর বলেছেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবচেয়ে বড় প্রাণের দুশমন ছিলাম। একদিন গ্রীষ্মকালে আমি মক্কার আলি-গলিতে ঘুরে ফিরছিলাম। এক ব্যক্তি এসে বললো,“হে উমর, আশ্চৰ্য! তুমি নিজেকে কি মনে করো ? তোমার ঘরে এ কি হচ্ছে ?” আমি বললাম,“কি হচ্ছে ?” সে বললো,“তোমার বোন মুসলমান হয়েছে।” আমি রাগান্বিত হয়ে বোনের দরজায় গিয়ে আওয়াজ দিলাম। ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলো,“কে ?” বললাম,“আমি উমর।” সবাই ভীত হয়ে পড়লো এবং যা পড়ছিল তা পড়ে রইলো। আমার বোন দরজা খুললো। আমি বললাম,“হে প্ৰাণের দুশমন,তুমি ধর্মত্যাগ করেছো ?” এ কথা বলে আমার হাতে যা ছিল তা দিয়ে বোনের মাথায় আঘাত করলাম। তার মাথা থেকে রক্ত বের হলো। সে বললো,“আমি ধর্মত্যাগ করেছি,আর আমার যা বুঝে এসেছে তাই করেছি।” আমি ভিতরে গিয়ে বসলাম এবং একটি কিতাব দেখতে পেয়ে বললাম,“এটা কি ?নিয়ে এসো।” আমার বোন বললো,“তুমি একে স্পর্শ করার উপযুক্ত নও,কারণ তুমি অপবিত্র,আর পবিত্র লোকেরাই একে ছুঁতে পারে।” বারবার চাওয়ার পর সে তা এনে দিলো। আমি খুলে দেখলাম,সেখানে প্রথমে লেখা রয়েছে –
بِسْمِ اللَّـهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ
আল্লাহর নাম দেখে আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম এবং আমার হাত থেকে কিতাবটি পড়ে গেলো। আমি উঠিয়ে পড়তে লাগলাম,সেখানে লেখা ছিল –
سَبَّحَ لِلَّـهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ
“নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে।” (সূরাহ আস-সফ,৬১ : ১)
আমি আবার কাঁপতে আরম্ভ করলাম। বারবার যখন এ আয়াতটি পড়ছিলাম –
آمِنُوا بِاللَّـهِ وَرَسُولِهِ
“তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো …” (সূরাহ আল-হাদিদ, ৫৭ : ৭)
তখন আমি পড়লাম –
أشهد أن لا إله إلاَّ الله
(অর্থাৎ,আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি – আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই)
এরপর সকলে “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি দিয়ে বললো,“আপনাকে স্বাগতম,গত সোমবারে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ বলে দুআ করেন – হে আল্লাহ,আবু জাহেল বিন হিশাম অথবা উমর বিন খাত্তাব – এদের মধ্যে থেকে যাকে ইচ্ছে তার মাধ্যমে আপনার দ্বীনকে বিজয় দান করুন।”
(আরেকটি বর্ণনাঃ) সে সময় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাফা পাহাড়ের নিচে অবস্থান করছিলেন। লোকেরা আমাকে সেখানে নিয়ে গেলো। আমি দরজায় টোকা দিলে আওয়াজ এলো,“কে ?” বললাম,“উমর।” যেহেতু লোকেরা আমার শক্ৰতা সম্পর্কে জানতো, তাই কেউ দরজা খোলার সাহস পেলো না। অবশেষে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশে দুজন দরজা খুলে আমার বাহু ধরে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে নিয়ে গেলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“তোমরা তাকে ছেড়ে দাও।” এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার পোশাকের প্রান্ত ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন,“মুসলমান হয়ে যাও। হে আল্লাহ,তাকে হিদায়েত দিন।” আমি কালেমায়ে শাহাদাত পড়লাম। মুসলমানগণ উচ্চ কণ্ঠে তাকবীর ধ্বনি দিলে মক্কার অলি-গলি প্রকম্পিত হয়ে পড়লো। কারো সাহস ছিল না যে,মুসলমান হওয়ার জন্য কেউ আমাকে বাধা দিতে পারে। অথচ সে সময় মুসলমানদের উপর চালানো হতো অবর্ণনীয় অত্যাচার,যা আমার পছন্দ হতো না। সুতরাং কুরাইশদের মধ্যে অভিজাত হিসেবে গণ্য আমার মামা আবু জাহেলের দরজায় গিয়ে আঘাত করলে ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,“কে ?” বললাম,“উমর,আমি তোমার ধর্ম ত্যাগ করেছি।” সে বেড়িয়ে এসে বললো,“এমনটা করতে নেই।” এরপর সে দরজা বন্ধ করে দিলো। এরপর আমি আরেক জনের কাছে গেলাম। সেখানেও এই ঘটনা ঘটলো।
ইসলাম গ্রহণের ফলে তারা অন্যান্য মুসলমানের উপর ভীষণ অত্যাচার করতো,কিন্তু আমার প্রতি চোখ তুলে তাকাতে সাহস করতো না। একজন বললো,“তুমি কি তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে চাও ?” আমি বললাম,“হ্যাঁ।” সে বললো,“লোকেরা কাবার পাদদেশে সমবেত হলে তুমি তাদের সম্মুখে তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে পারো। তখন তারাই তা সর্বত্র প্রচার করবে।” আমি যথাসময়ে কাবা ঘরে এসে তাই করলাম। তারা জোরে আওয়াজ দিয়ে বললো,“হে লোক সকল,উমর বিন খাত্তাব আমাদের ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়ে গেছে।” এ কথা শুনে মুশরিকরা মারমুখী হয়ে আমার প্রতি ধেয়ে আসে। আমার মামা আবু জাহেল হট্টগোলের কারণ জানতে চাইলে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা তাকে বলা হলো। সে ছাদে উঠে আমার নিরাপত্তার ঘোষণা দিলে লোকেরা সরে যায়। অপর মুসলমানদের উপর নির্যাতন চলবে আর আমি মুসলমান হয়েও নিরাপত্তা লাভ করে তাদের অত্যাচার দেখবো – তা হতেই পারে না। আমি আবু জাহেলের কাছে গিয়ে বললাম,“আমি তোমার নিরাপত্তার অধীনে থাকতে চাই না।” অতঃপর আবার মারপিট আরম্ভ হয়।
আবু নাঈম দালায়েল গ্রন্থে এবং ইবনে আসাকির ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আমি উমরকে জিজ্ঞেস করলাম,“আপনার ফারুক উপাধি কিভাবে হলো ?” তিনি বললেন – হামযা আমার তিন দিন পূর্বে ইসলাম গ্ৰহণ করেন। একদিন আমি মসজিদে গিয়ে দেখলাম,আবু জাহেল কুরাইশ নেতৃবৃন্দ পরিবেষ্টিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে গালি দেওয়ায় হামযা এসে তার পিঠে তীর দিয়ে আঘাত করলেন। ফলে কোমর পর্যন্ত রক্ত গড়িয়ে পড়লো। সে সময় নবী আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরকাম বিন আবী আরকামের ঘরে অবস্থান করছিলেন। হামযা সেখানে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্ৰহণ করেন। এ ঘটনার তৃতীয় দিনে মাখযুমী গোত্রীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে আমি তাকে বললাম – “তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করলে ?” সে বললো,“আমি করলাম,তাতে কী – আমার চেয়ে বড়রা যখন তা করছে ?” আমি বললাম,“তারা কে ?” সে বললো,“আপনার বোন আর ভগ্নিপতি।” বোনের বাড়ি গেলাম। প্রবেশের সময় তারা কিছু পড়ছিলো বলে আমরা মনে হলো। প্রবেশান্তে কিছু বাক্য বিনিময়ের পর আমার ভগ্নিপতিকে আঘাত করলাম আর আঘাতস্থল থেকে রক্ত বেরিয়ে এলো। অতঃপর আমার বোন বললো,“আমরা তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ কাজ করেছি।” আমি তার প্রবাহিত রক্ত দেখে লজ্জিত হয়ে বসে পড়লাম আর বললাম,“তোমাদের পঠিত কিতাবটি আমাকে একটু দেখাও।” আমার বোন বললো,“কিতাবটি পবিত্র লোকেরা স্পর্শ করে।” আমি গোসল করলে সে তা আমার হাতে দিলো। প্রথমেই লিখা ছিল –
بِسْمِ اللَّـهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ
আমি বললাম,“এ নামটি খুবই পবিত্রতম।”
এরপর (দেখলাম) লিখা রয়েছে –
طه ﴿١﴾ مَا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَىٰ ﴿٢﴾ إِلَّا تَذْكِرَةً لِّمَن يَخْشَىٰ ﴿٣﴾ تَنزِيلًا مِّمَّنْ خَلَقَ الْأَرْضَ وَالسَّمَاوَاتِ الْعُلَى ﴿٤﴾ الرَّحْمَـٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ ﴿٥﴾ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرَىٰ ﴿٦﴾ وَإِن تَجْهَرْ بِالْقَوْلِ فَإِنَّهُ يَعْلَمُ السِّرَّ وَأَخْفَى ﴿٧﴾ اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ ﴿٨﴾
“ত্ব-হা। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করিনি। কিন্তু তাদেরই উপদেশের জন্য -যারা ভয় করে। এটা তার কাছ থেকে অবতীর্ণ,যিনি ভূমন্ডল ও সমুচ্চ নভোমন্ডল সৃষ্টি করেছেন। তিনি পরম দয়াময়,আরশে সমাসীন হয়েছেন। নভোমন্ডলে,ভুমন্ডলে,এতদুভয়ের মধ্যবর্তী স্থানে আর সিক্ত ভূগর্ভে যা আছে,তা তো তারই। যদি তুমি উচ্চকন্ঠেও কথা বলো,তিনি তো গুপ্ত ও তার চাইতেও গুপ্ত বিষয়বস্তু জানেন। আল্লাহ – তিনি ছাড়া কোন উপাস্য ইলাহ নেই। সব সৌন্দর্যমন্ডিত নাম তো তারই।” (সূরাহ ত্বহা,২০ : ১-৮)
এর প্রতি আমার অন্তর শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়লো। আমি বললাম,“কুরাইশরা কি তবে এর থেকেই দূরে সরে গেছে ?”আমি তৎক্ষণাত মুসলমান হয়ে দারুল আরকামের দিকে রওয়ানা হলাম। আমাকে আসতে দেখে হামযা কি যেন বললেন। লোকেরা বললো,“উমরের উদ্দেশ্যে ভালো হলে কথা নেই,নতুবা আমরা তাকে হত্যা করবো।” এ কথা শুনতে পেয়ে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইরে এলে আমি কালেমা শাহাদাত পড়লাম। উপস্থিত লোকেরা এত জোরে তাকবীর ধ্বনি দিলো,যার আওয়াজ সকল মক্কাবাসীর কানে পৌঁছে যায়। এরপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বললাম,“আমরা কি হকের উপর নেই ?” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“কেন নেই ? অবশেষে আমরা হকের উপর রয়েছি।” আমি বললাম,“তাহলে গোপনে কেন ?” অবশেষে আমরা দুই কাতার বিভক্ত হয়ে মসজিদে হারামে প্রবেশ করলাম। এক কাতারে ছিলেন হামযা আর অন্য কাতারে ছিলাম আমি নিজে। কুরাইশরা মুসলমানদের সাথে আমাদের দুই জনকে দেখে খুবই মর্মাহত হলো। সেদিন থেকে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ফারুক উপাধি দেন,কারণ ইসলাম আত্মপ্রকাশ করেছে এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য হয়েছে।
ইবনে সাদ আর যাকওয়ান বলেছেনঃ আমি আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলাম,“উমরের নাম ফারুক কে রেখেছেন?” তিনি বললেন,“নবী আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।”
ইবনে আব্বাস থেকে ইবনে মাজা আর হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ উমর ফারুকের ইসলাম গ্রহণের ফলে জিবরাঈল (আঃ) আকাশের ফেরেশতাদের খুশি হওয়ার সংবাদ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সামনে পেশ করেন।
ইবনে আব্বাস থেকে বাযযার আর হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ উমরের ইসলাম গ্রহণের দিন কাফিররা বলেছিলো,“আজ মুসলমানরা আমাদের বদলা নিলো।” আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করেন –
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللَّـهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
“হে নবী,তোমার জন্য আর তোমার অনুসরণকারী মুমিনদের জন্য তো আল্লাহই যথেষ্ট।” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৬৪)
বুখারী শরীফে রয়েছে যে,আব্দুল্লাহ মাসউদ বলেছেন,“উমর ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমরা সম্মানিত হয়েছি।”
ইবনে মাসউদ থেকে ইবনে সাদ আর তাবারানী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ উমরের ইসলাম গ্ৰহণ করাটা ছিল গোটা ইসলামের বিজয়,তার হিজরত হলো সাহায্য এবং অবস্থান ছিল বরকতময়। বাইতুল্লাহ শরীফে প্রকাশ্যে নামায পড়ার সাহস আমাদের ছিল না। কিন্তু তিনি ইসলাম গ্রহণের পর মুশরিকদের সাথে এমন ঝগড়া বিবাদ করেন,যার ফলে বাইতুল্লাহ শরীফে আমাদের নামায পড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
হুযাইফা থেকে ইবনে সাদ আর হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ উমর মুসলমান হওয়ায় ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি পায় আর তিনি শহীদ হওয়ার ফলে সে গৌরব রবি নেতিয়ে পড়ে।
তাবারানীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে ইবনে আব্বাস বলেছেন,“সর্বপ্রথম উমর ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটান।” এ হাদীসের সূত্রগুলো সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ।
সহীব থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ উমরের ইসলাম গ্রহণের ফলে ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে,প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াতের কাজ শুরু হয়। আমরা কাবার পাদদেশে বসা,তাওয়াফ করা,মুশরিকদের বদলা নেওয়া আর তাদের উত্তর দেওয়ার উপযুক্ত হলাম।
উমরের আযাদকৃত গোলাম আসলাম থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন,“উমর নবুওয়াতের ষষ্ঠ বর্ষের যিলহজ্জ মাসে ২৬ বছর বয়সে ইসলাম গ্ৰহণ করেন।”
হিজরত
আলী (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ আমরা উমর ছাড়া অন্য কারো নাম বলতে পারবো না – যিনি প্রকাশ্যে হিজরত করেছেন। হিজরতের সময় তিনি গলায় তলোয়ার আর কাঁধে কামান ঝুলিয়ে হাতে কয়েকটি তীর নিয়ে বাইতুল্লাহ শরীফে যান,সেখানে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ বসে ছিল। তিনি সাতবার তাওয়াফ করে মাকামে ঈবরাহীমে দুই রাকআত নামায পড়েন। এরপর কুরাইশ নেতৃবৃন্দের কাছে এসে পৃথক পৃথকভাবে বললেন,“তোমাদের মুখ কালো হোক। যে মাকে ছেলেহারা,সন্তানকে এতিম,স্ত্রীকে বিধবা করতে চায় – সে যেন আমার সাথে লড়াই করে।” কিন্তু তার ছায়া মাড়ানোর সাহসটুকুও কারো ছিল না।
হযরত বারা বলেছেনঃ আমাদের কাছে সর্বপ্রথম মুসআব বিন উমায়ের,তারপর ইবনে উম্মে মাকতুম, এরপর বিশজন আরোহীর একটি কাফেলা নিয়ে উমর হিজরত করেন। আমরা তার কাছে রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভিপ্ৰায় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন,“হযরত (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছনে আসছেন।” এরপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) কে নিয়ে মদীনায় এলেন।
ইমাম নববী বলেছেন,“উমর সকল যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ছিলেন আর উহুদ যুদ্ধেও অটল ছিলেন।”
উমর (রাঃ) এর ফর্যীলত সম্পর্কিত হাদীস
ইমাম বুখারী এবং ইমাম মুসলিম হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“স্বপ্নে আমি জান্নাতে এক মহিলাকে প্রাসাদ চূড়ায় বসে ওযু করতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম – ‘এটা কার প্রাসাদ ?’ ফেরেশতাগণ বললেন,‘উমর বিন খাত্তাবের।’ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,‘হে উমর,আমি তোমার মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে সে প্রাসাদে প্রবেশ করিনি।’ ” একথা শুনে হযরত উমর কেঁদে ফেললেন ।
ইবনে উমর থেকে ইমাম বুখারী আর ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“আমি স্বপ্নে দুধ পান করার সময় এর স্বাদ আর গন্ধ আমার নাকে এলে অবশিষ্ট দুধ উমরকে দিলাম।” সাহাবাগণ বললেন,“এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী ?” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“ইলম।”
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে ইমাম বুখারী আর ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি,“স্বপ্নে আমার সামনে কিছু লোক পেশ করা হলো – যাদের পোশাক বক্ষদেশ (পর্যন্ত) এবং কিছু লোকের পোশাক তারো বেশি পর্যন্ত প্ৰলম্বিত ছিল,আর উমরের পোশাক যমীন পর্যন্ত ঘেঁষে ছিল।” সাহাবাগণ বললেন,“ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম),সে পোশাকটি কি ছিল ?” নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“দ্বীন।”
সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে ইমাম বুখারী আর ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“হে উমর,সে সত্তার শপথ – যার কুদরতী হাতে আমার প্রাণ; যে পথে তুমি চলো,শয়তান সে পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে।”
বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির মধ্যে মুহাদ্দিস ছিল,আর আমার উম্মতের মুহাদ্দিস হলেন উমর বিন খাত্তাব।”
ইবনে উমর (রাঃ) থেকে ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনন,“আল্লাহ তাআলা উমরের মুখে ও অন্তরে সত্যের প্রবর্তন ঘটিয়েছেন।”
ইবনে উমর বলেছেন,“লোকদের অভিমত ভিন্নতর হলে উমর যে রায় দিতেন,সে মোতাবেক কুরআনের আয়াত নাযিল হতো।”
উকবা বিন আমর (রাঃ) থেকে ইমাম তিরমিযী আর হাকেম বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“আমার পর যদি কেউ নবী হতেন,তবে তিনি উমর বিন খাত্তাব।” এ বর্ণনাটি আবু সাঈদ খুদরী আর আসমা বিন মালিক থেকে তাবারানী এবং ইবনে উমর থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন।
আয়েশা সিন্দীকা (রাঃ) থেকে ইমাম তিরমিয়ী বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“উমরকে দেখে শয়তান পালিয়ে যেতে দেখেছি।”
উবাই বিন কাব থেকে ইবনে মাজা আর হাকিম বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম হযরত উমরের সাথে মুসাফাহ করবেন,সালাম দিবেন আর হাত ধরে জান্নাতে প্ৰবেশ করাবেন।”
আবু যর (রাঃ) থেকে ইবনে মাজা বর্ণনা করেছেনঃ আমি রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি,“উমরের মুখে ও অন্তরে আল্লাহ তাআলা সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি সবসময় সত্য বলতেন।”
ইবনে মানীআ মুসনাদ গ্রন্থে আলী (রাঃ) থেকে নকল করে লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সহচরদের মধ্যে কোনো সংশয় নেই যে,উমরের যবান ছিল প্রশান্তময়।
ইবনে উমর থেকে বাযযার বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“উমর হলেন জান্নাতীদের জন্য উজ্জ্বল প্ৰদীপ।”
কাদাম বিন মাজউন আর তিনি তার চাচা উসমান বিন মাজউন থেকে বায্যার বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমরের পানে ইশারা করে বললেন,“যতক্ষণ তিনি তোমাদের মাঝে থাকবেন,ততক্ষণ পর্যন্ত ফিতনার দরজা শক্তভাবে বন্ধ থাকবে।”
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে আওসাদ গ্রন্থে তাবারানী বর্ণনা করেছেনঃ একদিন জিবরাঈল (আঃ) নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন,“উমরকে সালাম জানাবেন,আর তাকে এ সুসংবাদ দিবেন যে – তার ক্ৰোধ হলো বিজয়,আর সন্তুষ্টি হলো দর্শন।”
আয়েশা (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“শয়তানরা উমরকে দেখে ভয় পেতো।”
ইমাম আহমদ এ হাদীসটি বুরাইদার সূত্রে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“হে উমর,শয়তান তোমাকে ভয় পায়।”
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“আসমানের সকল ফেরেশতা উমরকে সম্মান আর পৃথিবীর সকল শয়তান তাকে ভয় করে।”
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে আওসাত গ্রন্থে তাবারানী বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“আল্লাহ তাআলা আরাফাতে অবস্থানকারী (হাজীদের – অনুবাদক) নিয়ে সাধারণত এবং উমরকে নিয়ে বিশেষত গর্ব করেন।” এ ধরনের আরেকটি বৃহৎ হাদিস আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে।
ফজল বিন আব্বাস (রাঃ) থেকে তাবারানী আর দাইলামী বর্ণনা করেছেন যে,রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“উমর যেখানেই থাকুক,তার সাথেই থাকবে।”
ইবনে উমর ও আবু হুরায়রা থেকে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন স্বপ্নের বিবরণ দিতে গিয়ে বললেন – “একটি কূপে বালতি নামানো দেখে আমি কয়েক বালতি উত্তোলন করলাম। আমার পর আবু বকর বালতি নিলেন এবং এক অথবা দুই বালতি উত্তোলন করলেন,কিন্তু তার উত্তোলনে কিছুটা দুর্বলতা ছিল। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেছেন। এরপর উমর বালতি ধারণ করলেন আর এমনভাবে উত্তোলন করলেন,যা আমি একজন যুবককেও এভাবে উত্তোলন করতে দেখিনি,আর তখন চতুর্দিক থেকে তৃষ্ণার্তরা এসে পিপাসা নিবারণ করে।”
ইমাম নববী তাহযীব গ্রন্থে লিখেছেনঃ ওলামাগণ উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন যে – এটা আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আর উমর ফারুক (রাঃ) এর খিলাফতের প্রতি ইঙ্গিত;আর উমরের খিলাফতকালে শরীয়তের অনেক বিধি-বিধান ও ইসলামের ব্যাপক প্রসার হবে।”
সদীসা থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“উমর ইসলাম গ্রহণের পর থেকে শয়তান তার মুখোমুখি হলে সে মুখ ফিরিয়ে উলটে পড়তো।”
উবাই বিন কাব থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “জিবরাঈল (আঃ) আমাকে বলেছেন -উমরের ইন্তেকালে ইসলাম কাঁদবে।”
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে তাবারানী আওসাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“যে উমরের সাথে শক্ৰতা করবে,সে আমার সাথে শক্ৰতা করলো;আর যে উমরকে ভালোবাসবে,সে যেন আমাকে ভালোবাসলো। আল্লাহ তাআলা আরাফাতে অবস্থানরত (হাজীদের -অনুবাদক) নিয়ে সাধারণত আর উমরকে নিয়ে বিশেষত গর্ব করেন। সকল নবীর উম্মতের মধ্যে একজন মুহাদ্দিস ছিলেন,আর আমার উম্মতের মুহাদ্দিস হলেন উমর।”সাহাবাগণ বললেন,“কে মুহাদিস হতে পারে?” নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“যার ভাষায় ফেরেশতাগণ কথা বলেন।” এর সূত্রগুলো বিশুদ্ধ।
উমর সম্পর্কে সাহাবা আর সালাফে সালেহিনদের অভিমত
আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেছেন,“আমার কাছে উমরের চেয়ে প্রিয়তম আর কেউ নেই।”(ইবনে আসাকির)
আবু বকরকে মৃত্যু শয্যায় এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন,“উমরকে খলীফা নির্ধারণের জন্য আল্লাহ তাআলা আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করেন,তাহলে কি উত্তর দিবেন ?” তিনি বললেন,“বলবো লোকদের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ ব্যক্তিকে খলীফা মনোনীত করেছি।”(ইবনে সাদ)
আলী (রাঃ) বলেছেন,“তোমরা সৎ লোকদের আলোচনায় উমরকে অন্তর্ভুক্ত করতে ভুলো না,কারণ বেশিদিন গত হয়নি তার যবান ছিল প্রশান্তময়।”(তাবারানী -আওসাত)
ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেন,“রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর আমরা কাউকে উমরের চেয়ে অধিক মেধাবী এবং দানশীল আর কাউকে পাইনি।”(ইবনে সাদ)
ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন,“উমরের জ্ঞান পাল্লার এক দিকে,আর পৃথিবীর সকল জ্ঞান পাল্লার অপর দিকে তুলে দিলে উমরের জ্ঞানের পাল্লা ভারি হবে। কারণ জ্ঞানের দশমাংশের নবমাংশ উমরকে দেওয়া হয়েছে।” (তাবারানী,হাকিম)
হুযাইফা (রাঃ) বলেছেন,“পৃথিবীর ইলম উমরের কোলে লুকিয়ে ছিল।”তিনি আরো বলেছেন,“উমর আল্লাহর পথে নিরাপত্তার কোনো পরোয়া করতেন না।”
মুআবিয়া বলেছেন,“আবু বকর সিদ্দীকের কাছে দুনিয়া ধরা দেয়নি,তিনি এর কামনাও করতেন না। আর উমরের কাছে দুনিয়া এলেও তিনি তা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন,কিন্তু আমরা দুনিয়াকে পেটের মধ্যে নিয়ে ফেলেছি।”
জাবের (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ উমর ইন্তেকালের পর তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়ার পর আলী এসে বললেন,“রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর এ কাপড় পরিহিত ব্যক্তির চেয়ে কারো আমল বেশি পছন্দনীয় ছিল না।”(হাকিম)
ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন,“পুণ্যবান লোকদের আলোচনার সময় অবশ্যই হযরত উমরের নাম নিবে, কারণ তিনি আমাদের মধ্যে কুরআনের সবচেয়ে বড় আলেম আর আল্লাহর দ্বীনের সবচেয়ে বড় ফকীহ।” (তাবারানী)
এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাসকে আবু বকর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,“তিনি আপাদমস্তক কল্যাণকর।”এরপর উমর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন,“তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে খুবই সচেতন পাখির মতো,চারণ ক্ষেত্রের প্রতিটি স্থানে যার মনে এ কথা থাকতো যে,পাতানো জালে পা দিলে ফেঁসে যাবে।” আবার আলী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন,“দৃঢ়সংকল্প,সামুদ্রিক জ্ঞান,সাহসিকতা ও বীরত্ব তার মধ্যে ঢুকে দেওয়া হয়েছে।”(তাওরিয়াত)
উমায়ের বিন রাবীআ থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন যে,কাব আহবারকে উমর বিন খাত্তাব জিজ্ঞেস করলেন,“পূর্ববতী সহীফাগুলোতে কিভাবে আমার বিবরণ এসেছে ?” কাব বললেন,“আপনার সম্পর্কে লিখা রয়েছে – قر نا من حد يد উমর বললেন,“এর অর্থ কি ?” কাব বললেন,“তিনি এমন এক শক্তিশালী শাসনকর্তা,যিনি আল্লাহর পথে কারো নিন্দার কোন পরোয়া করেন না।”উমর বললেন,“আর কি লিখা রয়েছে ?” কাব বললেন,“আপনার পর যিনি খলীফা হবেন,গোটা সম্প্রদায় মিলে তাকে শহীদ করে দিবে।” উমর বললেন,“আর কি লেখা রয়েছে ?” কাব বললেন,“এরপর চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।”
ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন,“চারটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখের মাধ্যমে উমরের মর্যাদা অনুধাবন করা যেতে পারে।
এক – উমর বদর যুদ্ধ বন্দীদের হত্যা করার অভিমত পেশ করলে এ আয়াত নাযিল হয় –
لَّوْلَا كِتَابٌ مِّنَ اللَّـهِ سَبَقَ
“যদি একটি বিষয় না হত যা পূর্ব থেকেই আল্লাহ লিখে রেখেছেন …” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৬৮)
দুই – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণের পর্দার ব্যাপারে উমর নিজের মতামত তুলে ধরলে যয়নব বললেন,“হে উমর বিন খাত্তাব,আপনি আমাদের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেছেন,অথচ আমাদের ঘরেই ওহী নাযিল হয়।” এরপর হযরত উমরের অভিমতের সাথে সঙ্গতি রেখে পর্দার ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয় –
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا
“তোমরা তার স্ত্রীগণের কাছে কিছু চাইলে ……” (সূরাহ আল-আহযাব,৩৩ : ৫৩)
তিন – রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রত্যক্ষ দুয়ার বরকতে উমর ইসলাম গ্ৰহণ করেন।
চার – তিনি আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর হাতে সর্বপ্রথম বাইয়াত দেন। (আহমাদ,বায্যার,তাবারানী)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেছেন,“আমরা পরস্পরে এ আলোচনা করতাম। উমরের খিলাফতকালে শয়তান অবরুদ্ধ ছিল। তার (ইন্তেকালের -অনুবাদক) পর শয়তান মুক্ত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।”(ইবনে আসাকির)
দশম পরিচ্ছেদ
সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আলীকে আবু বকর আর উমরের চেয়ে খিলাফতের বেশী হকদার মনে করবে,সে আবু বকর,হযরত উমর,সকল মুহাজির আর আনসার সাহাবীদের ক্রটি চিহ্নিত করবে।”
শারীক বলেছেন,“যার মধ্যে বিন্দু পরিমাণ পুণ্য রয়েছে,সে কখনোই এ কথা বলবে না – আবু বকর সিদ্দীক আর উমর ফারুকের চেয়ে আলী খিলাফতের বেশী প্রাপ্য ছিলেন না।”
আবু উসামা বলেছেন,“হে লোক সকল,তোমরা কি জানো – আবু বকর সিদ্দীক আর উমর ফারুক ইসলামের পিতামাতা ?”
জাফর সাদিক (রহঃ) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আবু বকর আর উমরকে ভালো মনে করে স্মরণ করবে না,আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট।”
উমরের অভিমতের সাথে কুরআনের ঐকমত্য
মুজাহিদ থেকে ইবনে মারদুয়া বর্ণনা করেছেন,“উমর যে রায় দিতেন,অনুরূপভাবেই কুরআন শরীফের আয়াত নাযিল হতো।”
আলী (রাঃ) এর অভিমত ইবনে আসাকির নকল করে লিখেছেন,“কুরআন শরীফে অধিকাংশ উমরের রায় উল্লেখ রয়েছে।”
ইবনে উমর কর্তৃক মারফুআন বর্ণিতঃ কিছু বিষয়ে লোকদের মতামতের সাথে উমর ভিন্ন মত পোষণ করলে উমরের অভিমতের সাথে সঙ্গতি রেখে আয়াত নাযিল হতো।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে রয়েছে যে,উমর (রাঃ) বলেছেন,“আমার প্রতিপালক তিনবার আমার অভিমতের সাথে একমত পোষণ করেছেন –
একঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম),আমি মাকামে ইবরাহীমকে নামাযের স্থান বানাতে চাই। এরপর এ আয়াত নাযিল হয় –
وَاتَّخِذُوا مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى
“আর তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ : ১২৫)
দুইঃ আমি বললাম,“ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম),আপনার পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণের কাছে সব ধরনের লোক যাতায়াত করে। আপনি তাদের পর্দা করার নির্দেশ দিন।”এরপর পর্দার নাযিল অবতীর্ণ হয়।
তিনঃ পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণ লজ্জা দিলে আমি বললাম –
عَسَىٰ رَبُّهُ إِن طَلَّقَكُنَّ أَن يُبْدِلَهُ أَزْوَاجًا خَيْرًا مِّنكُنَّ
অতঃপর আমার উল্লিখিত শব্দগুলোই হুবহু নাযিল হয়। (টীকাঃ সূরাহ আত- তাহরিমের ৫ নং আয়াত)
মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে,উমার (রাঃ) বলেছেন,“আল্লাহ তাআলা আমার সাথে তিন বিষয়ে একমত – একঃ পর্দা,দুইঃ বদরের যুদ্ধবন্দী এবং তিনঃ মাকামে ঈবরাহীম।”
এ হাদীসে উল্লিখিত দ্বিতীয় নম্বর বিষয়টির মাধ্যমে চারটি (চতুর্থতম) দৃষ্টান্ত জানা গেলো।
ইমাম নব্বী তাহযীব গ্রন্থে চারটি বিষয়ে একমত হওয়ার কথা লিখেছেন – একঃ বদর যুদ্ধবন্দী, দুইঃ পর্দা, তিনঃ মাকামে ঈবরাহীম এবং চারঃ মদের অবৈধতা।
এ হাদীসে উল্লিখিত চতুর্থ নম্বর বিষয়টির মাধ্যমে পাঁচটি (পঞ্চম) দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো।
মদের অবৈধতা সম্পর্কে সুনান ও মুসতাদরাকে হাকিমে বর্ণিত হয়েছে যে,“একদিন উমর দুয়া করলেন –‘হে আল্লাহ,শরাবের ব্যাপারে আমাদের জন্য কিছু নাযিল করুন।” এরপর শরাব হারাম হওয়ার আয়াত নাযিল হয়।
ইবনে আবী হাতিমের স্বরচিত তাফসীর গ্রন্থে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,উমর বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা চারটি বিষয়ে আমার সাথে একমত হয়েছেন। যখন এ আয়াত নাযিল হয় –
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِن سُلَالَةٍ مِّن طِينٍ
“আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরাহ আল-মুমিনুন,২৩ : ১২)
তখন এমনিতেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় –
فَتَبَارَكَ اللَّـهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ
এরপর হুবহু এটিই আয়াত হিসেবে নাযিল হয়। (টীকাঃ দেখুন -সূরাহ আল-মুমিনুনের ১৪ তম আয়াত)
এ হাদীসের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা উমরের ছয়টি (ষষ্ঠ) অভিমতের সাথে একমত পোষণ করে ওহী নাযিল করেছেন বলে জানা গেলো। গ্রন্থকার এ হাদীসটি ইবনে আব্বাসের সূত্রে তাফসীরে মুসনাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
মাস্নাফ আবু আব্দুল্লাহ শীবানী কর্তৃক প্রণীত কিতাবে ফাজাইলুল উম্মাহ গ্রন্থে রয়েছেঃ উমরের সাথে তার প্রতিপালক একুশ জায়গায় একমত হোন। এর মধ্যে ছয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
সপ্তমটি হলো – আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের মৃত্যু হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের জানাযার জন্য সমবেত হতে বললে আমি (অর্থাৎ,উমর) নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে গিয়ে বললাম,“ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম),উবাই বিন কাব কঠোর শত্রু ছিল। সে অমুক দিন এই এই কথা বলেছে।” আল্লাহর কসম,কিছুক্ষণ পর এ আয়াত নাযিল হয় –
وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰ أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا
“আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও নামায পড়বেন না …” (সূরাহ আত-তাওবাহ,৯ : ৮৪)
অষ্টমঃ এক ঘটনার প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয় –
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ
“হে ঈমানদারগণ,তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাযের ধারে-কাছেও যেওনা …” (সূরাহ আন-নিসা, ৪ : ৪৩)
নবমঃ আরেক ঘটনায় এ আয়াত নাযিল হয় –
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ
“তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে মদ সম্পর্কে ……” (সূরাহ আল-বাকারাহ,২ : ২১৯)
গ্রন্থকার বলেন,“অষ্টম ও নবম ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত আয়াতদ্বয় সপ্তম হাদীসের সাথে যুক্ত একই ঘটনার ধারাবাহিকতা।
দশমঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে আমি (অর্থাৎ, উমর) বললাম –
سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ
তখন হুবহু এ আয়াতটিই নাযিল হলো –
سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ
“আপনি তাদের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন অথবা না করুন, উভয়ই সমান।” (সূরাহ আল-মুনাফিকুন, ৬৩ : ৬)
তাবারানী এ বর্ণনাটি ইবনে আব্বাসের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন।
একাদশঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সাহাবীদের নিয়ে বদর যুদ্ধে যাওয়ার পরামর্শ করছিলেন,তখন উমর যুদ্ধে গমনের পরামর্শ দিলে নাযিল হয় –
كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِن بَيْتِكَ
“যেমন করে তোমাকে তোমার পরওয়ারদেগার ঘর থেকে বের করেছেন ন্যায় ও সৎকাজের জন্য ……” (সূরাহ আল-আনফাল,৮ : ৫)
দ্বাদশঃ আয়েশা সিদ্দীকার অপবাদের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরামর্শ চাইলে উমর বললেন,“ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম),আপনাকে আয়েশার সাথে কে বিয়ে দিয়েছেন?” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“আল্লাহ।”উমর বললেন,“ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম),আপনি কি মনে করেন,আপনার রব আপনাকে ত্রুটিযুক্ত জিনিস দিয়েছেন?” এরপর এ আয়াত নাযিল হয় –
سُبْحَانَكَ هَـٰذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ
“আল্লাহ অনেক পবিত্র, অনেক মহান। সত্যিই (এ ছিল) এক গুরুতর অপবাদ।” (সূরাহ আন-নূর, ২৪ : ১৬)
ত্রয়োদশঃ ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে রমযানের রাতে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা হারাম ছিল। উমর এ বিষয়ে মন্তব্য করলে এ আয়াত নাযিল হয় –
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ
“রোযার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে।”(সূরাহ আল-বাকারাহ,২ : ১৮৭)
এ হাদীসটি ইমাম আহমদ মুসনাদ গ্রন্থে সনদসহ উল্লেখ করেছেন।
চতুর্দশঃ এক ইহুদী উমরকে বললো,“তোমাদের নবী যে জীবরাঈলের কথা বলেন,তিনি আমাদের দুশমন।” উমর বললেন –
مَن كَانَ عَدُوًّا لِّلَّـهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّـهَ عَدُوٌّ لِّلْكَافِرِينَ
এরপর হুবহু এ আয়াতই নাযিল হয়। (টীকাঃ দেখুন – সূরাহ আল-বাকারাহ’র ৯৮ তম আয়াত) এ বর্ণনাটি ইবনে জারীর কয়েকটি সূত্রে আর ইবনে আবী হাতিম আব্দুর রহমান ইবনে আবু ইয়ালা থেকে বর্ণনা করেছেন।
পঞ্চদশঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই ব্যক্তির বিবাদ মিমাংসা করে দিলেন। একজনের তা মনঃপূত না হওয়ায় সে পুনরায় উমরের কাছে বিচার চাইলে তিনি তাকে হত্যা করেন। এ খবর পেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,“আমি উমরের ব্যাপারে এমনটা ধারণা করি না যে, তিনি কোনো মুমিনকে হত্যা করতে পারেন।” এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করলেন –
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ
“অতএব,তোমার রবের কসম,সে লোক ঈমানদার হবে না,যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে।” (সূরাহ আন-নিসা,৪ : ৬৫)
এ বর্ণনাটি আবুল আসওয়াদ থেকে ইবনে আবু হাতিম আর ইবনে মারদুয়া বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থকার বলেছেন,“আমি তাফসীরে মুসনাদ গ্রন্থে এ বর্ণনাটির বিভিন্ন সূত্র বর্ণিত করেছি।”
ষষ্ঠদশঃ একদিন উমর নিজের ঘরে শুয়ে ছিলেন। তার গোলাম অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে তিনি এ দুয়া করলেন,“হে আল্লাহ,বিনা অনুমতিতে প্ৰবেশ করা হারাম করে দিন।” সঙ্গে সঙ্গে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।
সপ্তদশঃ তিনি বলতেন,“ইহুদীরা অভিশপ্ত জাতি।” এ প্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হয়।
অষ্টদশঃ আল্লাহ তাআলা বলেছেন –
ثُلَّةٌ مِّنَ الْأَوَّلِينَ ﴿٣٩﴾ وَثُلَّةٌ مِّنَ الْآخِرِينَ ﴿٤٠﴾
“তাদের একদল হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে,এবং একদল পরবর্তীদের মধ্য থেকে।” (সূরাহ আল-ওয়াকিয়াহ, ৫৬ : ৩৯-৪০)
এ আয়াতের সাথে সম্পৃক্ত ঘটনাটি জাবের বিন আব্দুল্লাহ থেকে ইবনে আসাকির স্বরচিত ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনাটি উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট।
ঊনবিংশঃ এ আয়াতটি মানসুখে তিলাওয়াত –
الشيخ ولشيخة اذا زنيا
বিংশঃ উহুদের যুদ্ধে আবু সুফিয়ান في القوم فلان বললে এর জবাবে উমর বলেন – الاتحيبنه, আর এ কথার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমত পোষণ করেন। এ বর্ণনাটি মুসনাদ গ্রন্থে আহমাদ উল্লেখ করেছেন।
উক্ত ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত, যা আমরা একবিংশ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করতে চাই –
উসমান বিন সাঈদ বিন আদ-দারমী কিতাবুর রুহ আলাল জাহীমা গ্রন্থে সালেম বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন কাব আহবার বললেন,“আসামানের বাদশাহ যমীনের বাদশাহর প্রতি আফসোস করছেন।”একথা শুনে উমর বললেন,“যমীনের বাদশাহর উপর নয়,বরং তার উপর যে তার নফসকে কবজায় নিয়েছে।”এ কথা শুনে কাব আহবার বললেন,“আল্লাহর কসম,তৌরাত গ্রন্থে হুবহু আপনার কথাগুলোই বিধৃত হয়েছে।” এরপর উমর সেজদায় লুটিয়ে পড়েন।
এছাড়াও ইবনে আদী কর্তৃক প্রণীত কামেল গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ প্রথম দিকে বিলাল আযানের মধ্যে اشهد ان لا اله الله এরপর حي علي الصلوة বলতেন। উমর বললেন, اشهد ان لا اله الله এরপর اشهد ان محمد رسول الله বলো। একথা শুনতে পেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,“উমর যেভাবে বলেছে,সেভাবে বলবে।”এ বর্ণনাটির সনদ দুর্বল এবং বিশুদ্ধ বর্ণনার পরিপন্থী (হওয়ার কারণে সম্ভবত গ্ৰন্থকার তা হিসাবের মধ্যে গণ্য করেন নি -অনুবাদক)।
কারামত (অলৌকিকতা)
ইবনে উমর থেকে বায়হাকী,দালাইলুন নবুওয়্যত গ্রন্থে আবু নাঈম,শরন্থস সুন্নাহ গ্রন্থে লাকায়ী,ফাওয়ায়েদ গ্রন্থে দারী,কারামতে আউলিয়া গ্রন্থে ইবনে আরাবী এবং রাওয়াতু মালিক গ্রন্থে খাতীব বর্ণনা করেছেনঃ সারিয়া নামক এক ব্যক্তিকে উমর সেনাপতি বানিয়ে যুদ্ধ পাঠানোর পর একদিন খুৎবা দেওয়ার সময় হঠাৎ বলে উঠলেন – “হে সারিয়া,পাহাড়ের দিকে।”এভাবে তিনি তিন বার বললেন। কিছুদিন পর সেই রণাঙ্গণ থেকে দূত এলো। উমর যুদ্ধের সংবাদ জানোতে চাইলেন। দূত বললো,“আমিরুল মুমিনীন,আমরা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম,হঠাৎ তিনবার ‘হে সারিয়া,পাহাড়ের দিকে’এ আওয়াজ শুনে সঙ্গে সঙ্গে সেই পাহাড়ের দিকে ছুটেছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের দুশমনদের পরাজিত করলেন।” ইবনে উমর বলেন,“তখন সারিয়া অনারাব দেশে ছিলো,আর তিনি এখান থেকে আওয়াজ দেন।” ইসাবা গ্রন্থে ইবনে হাযার আসকালানী এর সনদগুলো সহীহ বলে অভিহিত করেছেন।
ইবনে উমর থেকে মাইমুন বিন মেহরানের সূত্রে ইবনে মারদুয়া বর্ণনা করেছেনঃ জুমআর দিন খুৎবা দেওয়ার সময় তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন,“হে সারিয়া,পাহাড়ের দিকে যাও। বাঘের রক্ষকরা অত্যাচার করছে।” লোকেরা এ কথা শুনে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো।
আলী (রাঃ) বলেছেনঃ খুৎবা শেষে লোকেরা তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,“সে সময় আমার মনে হলো,মুশরিকরা আমাদের মুসলমান ভাইদের পরাজিত করে পাহাড়ের পাদদেশে অতিক্রম করছিলো। এ মুহুর্তে আক্রমণ করলে তারা সকলেই নিহত আর পরাজিত হবে,এ কারণে আমার মুখ দিয়ে এ শব্দগুলো বেরিয়ে গেছে।”এক মাস পর এক ব্যক্তি বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে এলে সে বললো,“আমরা উমরের আওয়াজ শুনে পাহাড়ের দিকে যেতেই আল্লাহ আমাদের বিজয় দেন।”
দালায়েল গ্রন্থে আমর বিন হারিসের বরাত দিয়ে আবু নাঈম লিখেছেনঃ উমর জুমআর খুৎবা দেওয়ার এক পর্যায়ে দুই অথবা তিনবার বললেন,“হে সারিয়া,পাহাড়ের দিকে যাও।” এরপর আবার খুতবা দিতে লাগলেন। উপস্থিত জনতার মধ্যে কেউ কেউ বললেন,তাকে উন্মাদনায় পেয়েছে। উমরের সাথে আব্দুর রহমান বিন আউফ বিনা সংকোচেই কথা বলতেন। তিনি বললেন,“আজ আপনি এমন কাজ করলেন,যার কারণে লোকেরা আপনার ব্যক্তিত্বকে ভৎসনা করছে।” উমর বললেন,“আল্লাহর কসম,আমি সে সময় অস্থির হয়ে পড়ছিলাম,যখন দেখলাম মুসলমানরা লড়াই করছে,আর শত্রুরা পাহাড়ের দিক থেকে তাদেরকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। তখন আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি,আপনাতেই বলে ফেললাম – পাহাড়ের দিকে যাও।”এরপর রণাঙ্গন থেকে সারিয়ার চিঠি নিয়ে এক দূত এলো। চিঠিতে লেখা ছিল – “জুমআর দিন দুশমনের সাথে লড়াই চলছিল। এক পর্যায়ে আমরা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এমন সময় ঠিক জুমআর নামাযের সময় আমরা শুনতে পেলাম – ‘সারিয়া,পাহাড়ের দিকে যাও।’ এ আওয়াজ পেয়ে আমরা পাহাড়ের দিকে গেলাম আর বিজয় অর্জন করলাম।”আমর বিন হারেস বললেন,“সেদিন যারা ‘উমরকে উন্মাদনায় পেয়েছে’বলে মন্তব্য করেছিল,তারা বললো – ‘এ সবই উদ্ভট কথা।’ ”
ইবনে উমর থেকে ফাওয়ায়েদ গ্রন্থে আবুল কাসিম বিন বুশরান বর্ণনা করেছেনঃ উমর এক ব্যক্তিকে নাম জিজ্ঞেস করলে সে বললো,“জামরাহ (স্ফুলিঙ্গ)।”তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“বাবার নাম ?” সে বললো, “শিহাব (অগ্নিশিখা)।” তিনি প্রশ্ন করলেন,“গোত্রের নাম ?” সে বললো,“হরকা (আগুন)।” তিনি জানোতে চাইলেন,“কোথায় থাকো ?” সে বললো,“হিররাহ (উত্তপ্ত পাথুরে যমীন)।” তিনি বললেন,“হিররাহ কোথায় ?” সে জবাব দিলো,“নাতী (লেলিহান অগ্নিশিখা)।” তিনি বললেন,“পরিবারের খোঁজ নাও,তারা পুড়ে মরেছে।” সে লোক গিয়ে দেখলো সত্যিই তাই। আগুন লেগে সব পুড়ে গেছে। (ঘটনাটি) মালিক প্রমুখ এভাবে বর্ণনা করেছেন।
আল-আসমাত গ্রন্থে কায়েস ইবনে হাজ্জাজের বরাত দিয়ে আবুশ শাইখ লিখেছেনঃ উমর বিন আস কর্তৃক (মিসর -অনুবাদক) বিজিত হওয়ার পর মিসরবাসী তার কাছে এসে বললো,“আমাদের চাষাবাদ নীল নদের প্রবাহের উপর নির্ভরশীল। নীল নদ শুকিয়ে গেলে প্রাচীন নীতি অনুযায়ী নীল নদের প্রবাহ বেগমান করতে হয়।” আমর বিন আস বললেন,“সে প্রাচীন নীতি কি ?” তারা বললো,“চাঁদের একাদশতম রজনীতে এক অবিবাহিত যুবতির বাবাকে রাজী করে তাকে উন্নতমানের পোশাক ও অলংকারাদি পড়িয়ে নীল নদে নিক্ষেপ করি।” আমর বললেন,“ইসলাম পূর্বের প্রথা রহিত করেছে,তাই তোমরা তা করতে পারো না।” কিছুদিন পর নীল নদের প্রবাহ থেমে গেলে কিছু মিসরবাসী আমর বিন আসের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার মনস্থির করলে আমর বিন আস বিষয়টি চিঠি দিয়ে আমিরুল মুমিনীন উমর ফারুক (রাঃ) কে জানালেন। কয়েকদিন পর আমিরুল মুমিনীন উমর (রাঃ) জবাবে এ চিঠি লিখলেন – “তুমি সুন্দর চিঠিই দিয়েছো,এসব প্রথা উৎখাতের জন্যই ইসলামের আবির্ভাব। এ চিঠির সাথে যুক্ত একটি মোড়ানো কাগজের টুকরো দিলাম,যা নীল নদে ফেলে দিবে।” এ চিঠি আমর বিন আসের হাতে পৌঁছলে তিনি সেই মোড়ানো কাগজটি খুললেন। তাতে লিখা ছিল – “আল্লাহর বান্দা আমিরুল মুমিনীন উমরের পক্ষ হতে নীল নদের অবগতির জন্য প্রশ্ন করছি,তুমি যদি নিজের শক্তিতে প্রবাহিত হও,তবে তুমি আর কখনোই প্রবাহিত হয়ো না;আর যদি আল্লাহ তাআলা প্রবাহিত করেন,তাহলে সেই এক ও অদ্বিতীয় মহাশক্তিধর প্রতিপালকের কাছে আমার আবেদন -তোমাকে প্রবাহিত করুন।” আমর বিন আস কাগজের টুকরোটি শুকতারা উদয়ের কিছুক্ষণ আগে নীল নদে ফেলে দেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে মিসরবাসী দেখলো,আল্লাহ তাআলা এক রাতেই নীল নদে ষোল হাত পানির তরঙ্গ সৃষ্টি করেছেন। আর সেদিন থেকে আল্লাহ তাআলা মিসরবাসীর এই প্রথা বন্ধ করে দেন।
তারেক বিন শিহাব থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ এক ব্যক্তি উমরকে সত্য মিথ্যার মিশ্রণে কিছু কথা বলছিলেন। উমর কখনো তাকে থামতে বলেন,আবার কখনো বলতে বলেন,অবশেষে সে বললো,“আমি আপনাকে যা বলেছি তা সত্য। তবে যে সব কথার প্রেক্ষিতে আমাকে থামতে বলেন,তা ছিল মিথ্যা।”হাসান বলেছেন,“কথার মধ্যে মিশ্ৰিত মিথ্যা অংশটুকু উমর চিহ্নিত করতে পারতেন।”
আবু হুদাবা হামসী থেকে দালায়েল গ্রন্থে বায়হাকী বর্ণনা করেছেনঃ ইরাকবাসী তাদের গর্ভনরকে পাথর মেরেছে,এই সংবাদ পেয়ে উমর ক্রোধান্বিত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। সেদিন তার নামায ভুল হওয়ায় নামায পড়ে এ দুআ করলেন – “হে আল্লাহ,তারা নামায গড়মিল করেছে,তাদের প্রতিটি কাজ গড়মিল করে দিন। তাদের প্রতি বনু সাকীফ গোত্রের এক ছোকড়াকে চাপিয়ে দিন,যে জাহেলিয়াতের যুগের অত্যাচারের মত তাদেরকে শাসন করবে এবং সে তাদের ভালো কাজ গ্রহণ করবে না আর খারাপ কাজের শাস্তি ক্ষমা করবে না।” গ্রন্থকার বলেছেন,“ছোকড়া বলতে তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাকাফীকে বুঝিয়েছেন।” ইবনে লাহীআ বলেন,“সে ছোকড়ার তখন জন্মই হয়নি।”
অভ্যাস
আখলিফ বিন কায়েসের বরাত দিয়ে ইবনে সাদ লিখেছেনঃ আমরা আমিরুল মুমিনীন উমরের দরজায় বসা ছিলাম। এমন সময় এক বাঁদীকে পার হতে দেখে আমরা বললাম,“এ আমিরুল মুমিনীনের বাঁদী।” আমিরুল মুমিনীন বললেন,“এ আমিরুল মুমিনীনের বাদী নয়,তার জন্য বাঁদী রাখা বৈধ নয়।”আমরা বললাম,“তাহলে কি রাখা বৈধ ?” তিনি বললেন,হজ্জ আর উমরাহ’র জন্য শীত ও গরমের দুটি কাপড় এবং নিজ পরিবারের খাওয়ার খরচ ছাড়া উমরের কাছে আর কিছু রাখা বৈধ নয়। এটা অতিসাধারণ এক কুরাইশের জীবন যাপনের দৃষ্টান্ত। রাবী (বর্ণনাকারী) বলেছেন,“এরপর থেকে আমাদের অবস্থাও ছিল তাই।”
হাযিমা বিন ছাবিত বলেছেন,“তিনি এ শর্তে শাসনকর্তা নিয়োগ করে পাঠাতেন যে – তুর্কী ঘোড়ায় আরোহণ করবে না,উন্নত খাবার খাবে না,পাতলা কাপড় পরবে না এবং প্রয়োজনে যারা আসবে, তাদের জন্য নিজের দরজা বন্ধ রাখবে না। এমনটা করলে শাস্তিযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।”
ইকরামা বিন খালিদ বলেছেন যে,উমরকে হাফসা,আব্দুল্লাহ প্রমুখ বললেন,“আপনি উন্নতমানের আহার্য গ্রহণ করলে আল্লাহ তাআলার কাজ করার ক্ষেত্রে শক্তি অর্জন করতে পারবেন।” তিনি বললেন,“এটা কি তোমাদের সকলের অভিমত ?” তারা সকলে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে তিনি বললেন,“তোমাদের সুচিন্তিত অভিমত ?” তারা সকলে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে তিনি বললেন,“তোমাদের সুচিন্তিত মতামতে আমি ধন্য। তবে এ শাহী পথেই আমার দুই বন্ধুকে (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর সিদ্দীককে -অনুবাদক) পেয়েছি। আল্লাহ না করুন,যদি এ শাহী পথ বর্জন করি,তাহলে আর আমি দুই বন্ধুর মর্যাদা অর্জন করতে পারবো না।”
কথিত আছে,এক সামান্য দুর্ভিক্ষের বছর থেকে তিনি ঘি এবং তৈল জাতীয় খাবার খাওয়া ছেড়ে দেন।
ইবনে আবী মালীকা বলেছেনঃ উমরকে ভালো খাবার খাওয়ার জন্য উকবা বিন ফিরকদ অনুরোধ জানালে তিনি বললেন,“আফসোস! আমি এ অল্প দিনের জিন্দেগীর পুণ্যগুলো কি সব খেয়ে ফেলবো ?”
হাসান বলেছেনঃ একদিন উমর তার ছেলে আসেমের কাছে এসে তাকে গোশত খেতে দেখে বললেন,“তুমি কি খাচ্ছো ?” আসেম বললেন,“আজ গোশত খেতে আমার মন চেয়েছিলো।” উমর বললেন,“তোমার মন যা চাইবে,তাই কি খেতে হবে ? যে সবসময় নিজের মনমতো খায়,পরকালে তাকে চোর হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে।”
আসলাম বলেছেনঃ একদিন উমর (রাঃ) বললেন,“আমার মন মাছ খেতে চাইছে।” তার গোলাম ইরফা নামক উটে চড়ে চার মাইল দূরে মাছ আনতে যায়। ঝোলা ভৰ্তি সে মাছ কিনে। ফেরার পথে উট হাঁকিয়ে দ্রুত আসতে গিয়ে উট ঘামে সিক্ত হয়ে পড়ে। তিনি বললেন,“মাছ রাখো,আগে উট দেখবো।” তিনি উটের কাছে গেলেন আর উটের কানের নিচে বিন্দু বিন্দু জমানো ঘাম দেখে বললেন,“তুমি একে গোসল করাওনি। আমার ইচ্ছার কারণে এ পশুকে অহেতুক কষ্ট দিয়েছো। আল্লাহর কসম,আমি এ মাছ স্পৰ্শই করবো না।”
কাতাদা (রাঃ) বলেছেনঃ উমর খলীফা থাকাকালে তিনি চামড়ার তালিযুক্ত ফাটা কাপড় পড়ে পথ দিয়ে বাজারে গিয়ে লোকদের শিষ্টাচার শিক্ষা দিতেন আর তাদেরকে সাবধান করতেন। কোনো বোঝা দেখলে তিনি তা নিজ কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন।
আনাস বলেছেনঃ উমরের জামার পেছনে চারটি তালি দেখেছি।
আবু উসমান নাহদী বলেছেনঃ উমরের পায়জামায় চামড়ার পট্টি লাগা দেখেছি।
আব্দুল্লাহ বিন আমের বিন রবীআ বলেছেনঃ আমি উমরের সাথে হজ্জ করেছি। সফরের সময় পথিমধ্যে তিনি কোন তাঁবু গাড়তেন না,বরং গাছের ডালে কম্বল অথবা কাপড় টানিয়ে তার ছায়ায় বসতেন।
আব্দুল্লাহ বিন ঈসা বলেছেনঃ কান্নার পানি প্রবাহিত হতে হতে উমরের চেহারায় কালো দাগ পড়ে গিয়েছিলো। কখনও তিনি ওযীফার আয়াত তিলাওয়াত করতে করতে পড়ে যেতেন। মানুষ অসুস্থ ভেবে দেখতে আসতো।
আনাস বলেছেনঃ আমি এক বাগানে গেলাম। দেয়ালের এ প্রান্ত থেকেই ওপ্রান্তে অবস্থানরত উমরের আওয়াজ শুনতে পেলাম। তিনি বলেছেন,“হে উমর,কোথায় তুমি,আর কোথায় আমিরুল মুমিনীনের মর্যাদা ও সম্মান। আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো,নাহলে তিনি শাস্তি দিবেন।”
আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন রবীআ বলেছেনঃ আমি উমরকে দেখলাম তিনি মাটি থেকে একটি তৃণখণ্ড উঠিয়ে বললেন,“হায়! আমি যদি এ তৃণখণ্ড হতাম,তাহলে আমি মাতৃগর্ভে আসতাম না এবং আমি আর আমি হতাম না।”
আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন হাফস বলেছেনঃ একদিন উমর পানির মশক পিঠে নিয়ে যাচ্ছিলেন। লোকেরা তার এ আচরণে বিস্মিত হলে তিনি বললেন,“আমার মধ্যে গর্ব ও অহংকার এসেছে। ফলে তা খর্ব করছি।”
মুহাম্মদ বিন সিরীন বলেনঃ উমরের শ্বশুর এসে বাইতুল মাল থেকে কিছু চাইলে তিনি ভীতি প্ৰদৰ্শন করে বললেন,“আপনি কি চান যে,আমি আল্লাহর কাছে প্রতারক বাদশাহ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকি ?” এরপর তিনি নিজ তহবিল থেকে দশ হাজার দিরহাম প্ৰদান করলেন।
নাখয়ী বলেছেনঃ উমর নিজ শাসনামলেও ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন।
আনাস বলেছেনঃ উমর দুর্ভিক্ষের বছর থেকে ঘি খাওয়া ছেড়ে দেন। একদিন তিনি মাখন আর তৈল জাতীয় খাবার খেলে তার পেটে পীড়া দেখা দেয়। সে সময় তিনি আঙুল উচিয়ে বললেন,“দুর্ভিক্ষের বছর থেকে আমার ঘরে তেমন কিছু নেই।”
সুফয়ান আয়না বলেছেন যে,উমর বলেছেন,“যে আমার ক্রটি চিহ্নিত করে দেয়,সে ব্যক্তি আমার প্রিয়।”
আসলাম বলেছেন,“আমি উমরকে ঘোড়ার কান ধরে লাফ দিয়ে অশ্বারোহণ করতে দেখেছি।”
ইবনে উমর বলেছেনঃ আমি উমরকে রাগ করতে দেখেনি। আল্লাহর যিকির,আল্লাহর ভয় আর কুরআন তিলাওয়াত ছাড়া তার রাগ যেতো না।
উমর সম্পর্কে আসলামকে বিলাল জিজ্ঞেস করলেন,“আপনি উমরকে কেমন দেখেছেন ?” তিনি বললেন, “উমর একজন খাটি মানুষ। কিন্তু রেগে গেলে তাঁকে থামানো মুশকিল হয়ে পড়তো।” বিলাল বললেন,“সে সময় আপনি কুরআনের আয়াত পাঠ করতেন না কেন ? তিলাওয়াত করলে তার রাগ চলে যায়।”
আহওয়াজ বিন হাকীম তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন উমরের সামনে ঘি দিয়ে রান্না করা গোশত দেয়া হলে তিনি তা খেতে অস্বীকার করে বলেন,“এ দুটি (ঘি আর গোশত – অনুবাদক) পৃথক পৃথক খাবার। এ দুটিকে একত্রে রান্না করার প্রয়োজন ছিল না।”
এ পর্যন্ত উল্লিখিত ঘটনাগুলো ইবনে সাদ লিপিবদ্ধ করেছেন।
হাসান থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন যে,উমর বলেছেন,“একজন আমীরকে অন্য আমীরের স্থানে পরিবর্তনের মাধ্যমে লোকদের সংশোধনের পথকে সহজ মনে করি।”
প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
ইবনে সাদ আর হাকিম বর্ণনা করেছেন যে হযরত যর বলেছেনঃ আমি মদীনাবাসীর সাথে ঈদগাহে যাবার সময় উমরকে পায়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। তিনি তখন বৃদ্ধ,আর বাম হাতে বেশি কাজ করতেন। তিনি ছিলেন গোধূম বর্ণের,মাথার চুল শিরস্ত্ৰাণ পড়ার কারণে ঝরে যায়। লম্বা পদযুগল আর সবার চেয়ে উঁচু ছিলেন। সবার মাঝে দাঁড়ালে মনে হতো,তিনি পশুর পিঠে আরোহণ করেছেন।
ওকেদী বলেছেন,“যারা উমরকে গোধূম বর্ণের বলেছেন,তারা দুর্ভিক্ষের বছর থেকে দেখেছেন। তিনি তৈল জাতীয় খাবার খেয়ে পরিবর্তন হয়ে যান।”
ইবনে উমর থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ তিনি লাল সাদা মিশ্ৰিত বর্ণের অধিকারী ছিলেন। প্রলম্বিত পদযুগল,ঝরা চুল আর বৃদ্ধতার ছাপ তার মাঝে দেখা যেতো।
উবায়েদ বিন উমায়ের বলেছেন,“সকলের চেয়ে তাকে উঁচু মনে হতো।”
আসমা বিন আকওয়া বলেছেন,“তিনি বাম হাতে সকল কাজ করতেন।”
আবু দুজা আতা রদ্দী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ উমর লম্বা পদযুগল আর মোটা তাজা ছিলেন। তার অনেক চুল ঝরে যায়। তিনি লালিমাযুক্ত বড় বড় গোফের অধিকারী ছিলেন।
ইবনে আসাকির স্বরচিত ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেনঃ উমরের মা হলেন হানতামা বিনতে হিশাম বিন মুগীরা। অর্থাৎ,তার মা আবু জাহেলের বোন,আর আবু জাহেল তার মামা।
খিলাফত
আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর জীবদ্দশায় উমর খিলাফতের উত্তরাধিকার মনোনীত হোন ১৩ হিজরীর জামাদিউল উখরা মাসে।
যুহরী বলেছেনঃ আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) যেদিন ইন্তেকাল করেন ১৩ হিজরীর জামাদিউল উখরা মাসের ২২ তারিখ মঙ্গলবারে উমর খলীফা মনোনীত হোন। (হাকিম)
তার যুগে ইসলামের বড় বড় বিজয় অর্জিত হয়।
১৪ হিজরীতে সন্ধি ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে দামেশক,সন্ধির মাধ্যমে হামস ও বাআলাবাক্কা,প্রভাব বিস্তার করে বসরা ও ইলা বিজয় হয়। ১৪ হিজরীতে তিনি তারাবীর নামাযের জন্য লোকদের সমবেত করেন। (আসকারী)
১৫ হিজরীতে প্রভাবের মাধ্যমে উরওয়ান,আর সন্ধির মাধ্যমে তবরীয়া বিজিত হয়। এ বছরেই ইয়ারমুক আর কাদেসিয়ার ঘটনা ঘটে। (ইবনে জারীর) এ বছর হযরত সাদ কুফা নগরী উন্নত ও সমৃদ্ধ করেন। এ বছর থেকে উমর ভাতা,বৃত্তি ও প্রশাসনিক কাজের জন্য দফতরের প্রবর্তন করেন।
১৬ হিজরীতে আহওয়ায আর মাদায়েন মুসলমানদের করতলগত হয়। কিসারার রাজপ্ৰসাদে সাদ জুমআর নামায পড়েন,এটা ছিল ইরাকের মাটিতে সর্বপ্রথম জুমআর নামায। এটা ৬ হিজরীর সফর মাসের ঘটনা। এ বছর জালুলার ঘটনা ঘটে আর ইয়াযুজরদ বিন কিসরা পরাজিত হয়ে রায়ের দিকে পালিয়ে যায়। তাকরীতও মুজাহিদদের হস্তগত হয়। উমরের আগমনে বাইতুল মুকাদ্দাসও বিজিত হয়। তিনি জাবায় তার সুপ্ৰসিদ্ধ ভাষণ দেন। এ বছরেই যুদ্ধের মাধ্যমে কানসিরীন আর সুরুজ এবং সন্ধির মাধ্যমে হিলব,ইনতাকীয়া,মিনাজা আর কারকিসা বিজিত হয়। এ বছর রবিউল আউয়াল মাসে আলীর পরামর্শে উমর ঐতিহাসিক হিজরতের হিসাব থেকে হিজরী বর্ষের প্রবর্তন করেন।
১৭ হিজরীতে তিনি মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ করেন। হিজাজে দুর্ভিক্ষ দেশী দিলে উমর (রাঃ) আব্বাস (রাঃ) কে সাথে নিয়ে ইসতেসকার নামায আদায় করেন। নিয়ারুল আসলামা থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন,“উমর সেদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর মুবারাক পড়ে ইসতেসকার নামায পড়েন।” ইবনে উমর বলেছেন,“তিনি আব্বাসের হাত ধরে উর্ধ্বে তুলে দুয়া করেন – ‘হে আল্লাহ, আমরা সহায়হীন বান্দা আপনার রাসূলে মাকবুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাচাকে ওসীলা করে আরয করছি,শুষ্কতা উঠিয়ে নিন আর রহমতের বারিধারা বর্ষণ করুন।’ ” এ দুয়া করে ফিরে না আসতেই মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়। এ বছর সন্ধির মাধ্যমে আহওয়ায বিজয় হয়।
১৮ হিজরীতে সন্ধির মাধ্যমে নিশাপুরের কিয়দংশ এবং লড়াইয়ের মাধ্যমে হালওয়ান,বাসসী,সামসাত, হারান,নাসীবীন,মৌসুল,তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল আর জাযিয়ায়ে আরবের অধিকাংশ অঞ্চল ইসলামের ছায়াতলে আসে। কিছু ঐতিহাসিকের মতে,জাযিরায়ে আরবের অধিকাংশ অঞ্চল সন্ধির মাধ্যমে বিজিত হয়।
১৯ হিজরীতে কিসারিয়া আর ২০ হিজরীতে মিসর যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদের হাতে আসে। কারো কারো মতে,ইষ্কান্দারিয়া ছাড়া গোটা রাজ্য সন্ধির মাধ্যমে অর্জিত হয়। আলী বিন রাববাহ বলেছেন,“গোটা পশ্চিমাঞ্চল যুদ্ধের মাধ্যমে বিজিত হয়।” এ বছর তসতর বিজয় হয়,রোম সম্রাট পরলোকগমন করেন, উমর খায়বার ও নাজরান থেকে ইহুদীদের বের করে দেন এবং খায়বার ও ওয়াদিউল কুরা বণ্টন করেন।
২১ হিজরীতে ইস্কান্দারিয়া আর নিহাঅন্দ যুদ্ধ করে অর্জনের পর অনারব বিশ্বে আর কোনো অবাধ্যের দল রইলো না।
২২ হিজরীতে যুদ্ধ বা সন্ধির মাধ্যমে আযারবাইজানো এবং যুদ্ধ করে দিনুর,মাসবাদন ও হামদান জয় হয়। এ বছর আবলাসুল আরব,আসকার আর কুমশ হস্তগত হয়।
২৩ হিজরীতে কারমানে সাজিস্তান,কামরানের পাহাড়ি অঞ্চল,আসবাহান আর এর পার্শ্ববতী জনপদ বিজিত হয়। এ বছরের শেষ দিকে হাজ্জ থেকে ফিরে আসার পর উমর শহীদ হোন।
সাঈদ বিন মুসায়্যাব বলেছেন,“উমর মিনা থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পর উট থেকে নেমে আসমানের দিকে হাত তুলে এ দুয়া করলেন – হে আল্লাহ,আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি,শক্তি হ্রাস পেয়েছে,ইচ্ছাশক্তি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। এরপর আমি অকৰ্মণ্য হয়ে পড়ব আর আমার বিবেক লোপ পাবে। অতএব আমাকে আপনার কাছে আহবান করুন।” অতঃপর যিলহজ্জ মাস শেষ না হতেই তিনি শহীদ হোন । (হাকিম)
আবু সালিহুস সামান বলেছেন যে,উমরকে কাব বিন আহবার বলেছেন,“আমি তৌরাতে দেখেছি,আপনি শহীদ হবেন।” উমর বললেন,“এ কি করে হয়! আমি আরবে থাকবো,অথচ শহীদ হয়ে যাবো ?”
আসলাম বলেছেন যে,উমর দুয়া করলেন,“হে আল্লাহ,আমাকে আপনার পথে,আপনার হাবীবের শহরে শাহাদাত অর্জনের সৌভাগ্য দান করুন।” (বুখারী)
মাদান বিন আবী তালহা বলেছেন যে,উমর তার এক ভাষণে বলেছেন,“আমি স্বপ্নে যা দেখলাম তার ব্যাখ্যা হচ্ছে,আমার মৃত্যু খুবই নিকটবতী। এ পর্যায়ে উম্মতের লোকেরা আমাকে খিলাফতের উত্তরাধিকার মনোনীত করার কথা বলছে। মনে রাখবে,আল্লাহ তাআলা তার দ্বীন আর খিলাফতকে নিশ্চিহ্ন করবেন না। মৃত্যু আমার সঙ্গী হলেও দ্বীন আর খিলাফত আমার সাথী নয়। আমার পর (সেই) ছয়জন – যাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জান্নাতে যাবার সুসংবাদ দিয়েছেন,তাদের পরামর্শক্রমে খলীফা নির্বাচন করবে।” (হাকিম)
যুহরী বলেছেন,“উমরের নীতি ছিল,তিনি মদীনা শরীফে কোনো যুবককে ঢুকতে দিতেন না। একবার কুফার শাসনকর্তা মুগীরা বিন শোবা খলীফা উমরের কাছে চিঠি লিখলেন যে,“আমার নিকট একজন দক্ষ কারিগর যুবক রয়েছে,সে উন্নতমানের নকশা তৈরি করতে পারে। আপনি অনুমতি দিলে আমি তাকে পাঠিয়ে দিবো।” উমর অনুমতি দিলেন। কুফায় হযরত মুগীরা সে যুবকের উপর মাসিক একশ দেরহাম কর নির্ধারণ করে রেখেছিল। সে মদীনায় এসে সেই ব্যাপারে হযরত উমরের কাছে অভিযোগ করলে তিনি বললেন,“এ কর তো বেশি কিছু নয়।” এ কথা শুনে সে যুবক ক্ৰোধান্বিত হয়ে দাঁতে দাঁত পিষে চলে গেলো। দুই-তিন দিন পর উমর তাকে ডেকে বললেন,“আমি শুনলাম,তুমি নাকি বলেছো যে,আমি চাইলে এমন এক চাক্কি তৈরি করবে,যা বাতাসে উড়বে ?” সে বললো,“আমি আপনার জন্য এমন এক চাক্কি তৈরি করবো,যা চিরদিন মানুষ মনে রাখবে।” সে চলে গেলে তিনি বললেন,“এ যুবক আমাকে হত্যা করার হুমকি দিয়ে গেলো।” একদিন সে হীরা কাটা দুই ধারবিশিষ্ট একটি খঞ্জর জামার নিচে লুকিয়ে মসজিদের এক কোণে এসে বসে, আর এদিকে উমর নামাযের জন্য লোকদের জাগিয়ে দিচ্ছিলেন। তার নিকটবর্তী হলে সে তার শরীরে খঞ্জর দিয়ে তিনবার আঘাত করে। (ইবনে সাদ)
আমার বিন মাইমুন আনসারী বলেছেন,“মুগীরার গোলাম আবু যুযুয়াহ এর দুই ধার বিশিষ্ট খঞ্জরের আঘাতে উমর শহীদ হোন,আর তার সাথে ছিলেন এমন বারোজন আহত হোন,যাদের মধ্যে ছয়জন মারা যান।”
আবু রাফে বলেছেনঃ মুগীরার গোলাম আবু যুযুয়াহ চাক্কি তৈরি করতো। তিনি তার কাছ থেকে দৈনিক চার দিরহাম রাজস্ব আদায় করতেন। সে উমরের কাছে এলে এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করে বললো,“আমিরুল মুমিনীন,মুগীরা আমার প্রতি কঠোরতা আরোপ করেছেন। আপনি তাকে সাবধান করুন।” তিনি বললেন,“তুমি তোমার মনিবের সাথে ভালো আচরণ করবে।” উমরের ইচ্ছে ছিল তিনি এর ব্যাপারে মুগীরার নিকট সুপারিশ করবেন। কিন্তু এ কথা তার পছন্দ না হওয়ায় সে রাগত স্বরে বললো,“হে আমিরুল মুমিনীন,আমি ছাড়া সকলেই সুবিচার পেয়েছে।” সে খলীফাকে হত্যা করার ইচ্ছায় বিষ মিশ্ৰিত খঞ্জর নিজের কাছে রাখতে লাগলো। উমর ফজর নামাযের সময় যখন কাতার সোজা করার কথা বলছিলেন, ঠিক তখন আবু যুযুয়াহ উমরের সামনে এসে গলা ধরে পিঠের উচু অংশে উপর্যুপরি দুটি আঘাত করে। তিনি পড়ে গেলে সে অন্যদের উপর আঘাত করলে তেরোজন আহত হোন,যাদের মধ্যে ছয়জন নিহত হোন। তখন সূর্যোদয়ের সময় সমাগত প্রায়। আব্দুর রহমান বিন আউফ ছোট সূরা দিয়ে নামায শেষ করলেন। উমরকে তার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। তাঁকে দুধ পান করানো হলে ক্ষতস্থান দিয়ে তা বেরিয়ে এলো। লোকেরা সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,“কোনো ক্ষতি নেই,আপনি চিন্তা করবেন না।” তিনি বললেন,“যদি হত্যার মধ্যে খারাপিও থাকে,তবুও আমি নিহত হবো।” লোকেরা তার প্রশংসা করতে লাগলেন। তিনি বললেন,“আল্লাহর কসম, যখন আমি দুনিয়া থেকে চলে যাবো,দুনিয়ার কোনো ভোগবিলাস আমাকে প্রতারিতও করবে না,আনন্দও দিবে না। তবে রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহচর্য আমাকে সঙ্গ দিবে এবং এর সওয়াৰ পাবো।” এরপর ইবনে আব্বাস তার প্রশংসা করলে তিনি বললেন,“যদি আমার কাছে দুনিয়া ভর্তি স্বর্ণ থাকতো,তাহলে কিয়ামতের ভয়াবহতার কারণে আমি তা উৎর্স করতাম।” এরপর তিনি আবার বললেন,“উসমান,আলী,তালহা,যুবাইর,আব্দুর রহমান বিন আউফ আর সাদের মধ্য থেকে যার ব্যাপারে অধিকাংশ রায় হয়,তাঁকে খলীফা নির্ধারণ করবে।” এরপর তিনি সহীব (রাঃ) কে নামায পড়ানোর নির্দেশ দেন। এরপর সেই ছয়জন তিনজনের উপর দায়িত্ব অৰ্পন করেন। (হাকিম)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন,“সে যুবক ছিল অগ্নি উপাসক।”
আমর বিন মাইমুন বলেছেন যে,উমর বললেন,“আমার মৃত্য এমন লোকের হাতে হচ্ছে,যে ইসলামের দাবী করে না।” এরপর তিনি তার পুত্র আব্দুল্লাহকে বললেন,“আমার কর্জ হিসাব করো।” হিসাব করে প্রায় ৮৬ হাজার দিরহামের কথা বলা হলে তিনি বললেন,“যদি এ কর্জ উমর পরিবারের সম্পদ থেকে পরিশোধ হলে আদায় করবে,না হলে বনু আদীর কাছে চাইবে। তবুও শোধ না হলে কুরাইশদের কাছ থেকে নিবে। আয়েশা সিদ্দীকার কাছে গিয়ে তাঁকে বলবে – দুই বন্ধুর কাছে সমাহিত হওয়ার জন্য উমর অনুমতি চাইছে।” আব্দুল্লাহ ইবনে উমর তার কাছে গেলে আয়েশা (রাঃ) বললেন,“আমি এ জায়গাটি নিজের জন্য সংরক্ষণ করছিলাম। কিন্তু আজ এ মুহুর্তে আমি উমরের আবেদনকে প্রাধান্য দিচ্ছি।” আব্দুল্লাহ এসে বললেন,“তিনি অনুমতি দিয়েছেন।”এ কথা শুনে উমর আল্লাহ তাআলার শুকর আদায় করলেন। লোকেরা বললেন,“হে আমিরুল মুমিনীন,আপনার কিছু বলার থাকলে ওসীয়ত করুন। আপনি কাউকে খলীফা নির্ধারণ করে যান।” তিনি বললেন,“ছয়জন ছাড়া আর কাউকে খিলাফতের হকদার মনে করি না।” তিনি ছয়জনের নাম বললেন। “আমার ছেলে আব্দুল্লাহর সাথে খিলাফতের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সাদ জীবিত থাকলে তিনিই হতেন খিলাফতের হকদার। তিনি যেহেতু নেই,তোমরা যাকে ইচ্ছা নির্বাচন করবে। আমি সাদকে কোনো খেয়ানাতের কারণে বঞ্চিত করিনি।”
এরপর তিনি বললেন,“আমার পর যে খলীফা হবে, তাঁকে ওসীয়ত করছি – তিনি আল্লাহ তাআলাকে ভয় করবেন। মুহাজির,আনসার আর সকল জনসাধারণের সাথে ভালো আচরণ করবেন।” এভাবে তিনি অনেক নসীহত করার পর মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেলেন।
আমরা জানাযা নিয়ে গেলাম। আয়েশা (রাঃ) কে সালাম দিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বললেন,“আপনি দাফন করার অনুমতি দিন।” তিনি অনুমতি দিলে আমরা তাকে তার দুই বন্ধুর পাশে দাফন করলাম। তাকে সমাহিত করার পর লোকেরা খলীফা নির্বাচনের জন্যে সমবেত হলো। আব্দুর রহমান বিন আউফ বললেন,“পরামর্শ করার জন্য প্রথমে তিনজনকে বেছে নেয়া যায়।” সুতরাং (পরামর্শ করার জন্য – অনুবাদক) যুবাইর হযরত আলীকে,সাদ হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফকে এবং তালহা হযরত উসমানকে মনোনীত করায় তারা তিনজন পৃথক হয়ে যান। সেখানে গিয়ে আব্দুর রহমান বিন আউফ বললেন,আমি খলীফা হতে চাই না। সুতরাং আপনাদের মধ্যে থেকে কারো আশা থাকলে দেখে পুনরায় তিনি বললেন,“মনোনীত করার দায়িত্ব আপনারা আমার উপর ছেড়ে দিতে পারেন। আমি সর্বশ্রেষ্ঠকে মনোনীত করবো।” তারা সম্মতি দিলে তিনি আলীকে পৃথকভাবে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন,“আপনি প্রথম ইসলাম গ্ৰহণ করেছেন এবং রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রিয়তম ও নিকটতম। এজন্য আপনি খিলাফতের হকদার। যদি আমি আপনাকে খলীফা মনোনীত করি,তাহলে আপনি তার আনুগত্য করবেন।” আলী সম্মতি দিলেন। তিনি উসমানকে আলাদা ডেকে তারও সম্মতি নিলেন। এ ব্যাপারে উভয়ে পূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি উসমানের হাতে বাই’আত করলেন,এরপর আলী বাইআত করলেন।
মুসনাদ গ্রন্থে আহমাদ লিখেছেন যে,উমর (রাঃ) বলেছেন,“আবু উবাদা বিন জাররাহ বেঁচে থাকলে আমি তাঁকে খলীফা মনোনীত করতাম আর এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞেস করলে বলতাম – আমি রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি, ‘প্রত্যেক নবীর একজন বিশ্বস্ত লোক থাকেন, আর আমার বিশ্বস্ত লোক হলেন আবু উবাদা বিন জাররাহ।’তারপর মাআজ বিন জাবাল জীবিত থাকলে তাকে খলীফা নির্বাচিত করতাম,আর তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে বলতাম – আমি রাসুলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি, ‘মাআজ বিন জাবাল কিয়ামতের দিন ওলামাদের সামনে বড়ই মর্যাদার সাথে আবির্ভূত হবেন।’ ”
মুসনাদ গ্রন্থে আহমাদ লিখেছেন যে,আবু রাফে বলেছেন,“মৃত্যুর সময় খিলাফতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে উমর বললেন,“আমি আমার সাথীদের মধ্যে ব্যাপক লোভ দেখতে পাচ্ছি।”
সালোম মাওলা আবু হুযায়ফা অথবা আবু উবাদা বিন জাররাহ জীবিত থাকলে তাদের সম্পর্কে অবশ্যই তোমাদের বলে যেতাম।”
উমর (রাঃ) যিলহজ্জ মাসের ২৬ তারিখ বুধবারে আহত হোন এবং মুহাররম মাসে রবিবারে রাতে তাকে সমাহিত করা হয়। তার বয়স নিয়ে মতের ভিন্নতা রয়েছে। ৬৩,৬৬,৬১,৬০,৫৯,৫৪ অথবা ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। ওয়াকেদীর মতে,তার বয়স ৬০ বছর।
সহীৰ জানাযার নামায পড়ান।
তাহষীব গ্রন্থে রয়েছেঃ তার আংটিতে খোদাই করে লিখা ছিল –
كفي بالموت واعظا
তারেক বিন শিহাব থেকে তাবারানী বর্ণনা করেছেন যে,উম্মে আয়মান বলেছেন,“উমর শহীদ হওয়ার পর থেকে ইসলাম দুর্বল হয়ে পড়ে।”
আব্দুর রহমান বিন ইয়াসার বলেছেন,“উমরের মৃত্যুর দিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল।”
প্রথম প্রবর্তিত বিষয়সমূহ
আসকারী বলেছেনঃ সর্বপ্রথম আমিরুল মুমিনীন বলে উমরকে সম্বোধন করা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম হিজরী বর্ষ,বাইতুল মাল,তারাবীহ,মদ পানকারীকে আশিটি চাবুক মারার বিধান,মুতা বিয়ে হারাম,বাঁদীর সন্তানদের ব্যবসা করা নিষিদ্ধ,জানাযার নামাযে চার তাকবীর দেওয়া,দফতর প্রতিষ্ঠা করা,অনেক বিজয় লাভ করেন,ভূমির পরিমাপ করেন,সামুদ্রিক পথে মিসর থেকে মদীনায় ফলমূল আমদানী করেন,সদকার অর্থ ইসলামের কাজে ব্যবহার না করা,ফারায়েজ শাস্ত্রে পরিত্যক্ত সম্পত্তি অংশীদারগণের মধ্যে বণ্টন করার সময় কিছ অংশ অতিরিক্ত হয়ে গেলে তা পুনর্বণ্টন করার আইনটি সংযুক্ত করেন,ঘোড়ার যাকাত আদায় করেন এবং হযরত আলীর ব্যাপারে ঘোষণা করেন اطال الله بقاأك এবং ايدك ا الله
আসাকারী বর্ণনা করেছেন যে,ইমাম নববী তাহযীব গ্রন্থে লিখেছেন,“তিনি সর্বপ্রথম চাবুক মারার বিধান প্রবর্তন করেন।”
ইবনে সাদ বলেছেন,“চাবুক মারার বিধান প্রবর্তনের পর থেকে একথা প্রসিদ্ধ হয়ে যায় যে -উমরের চাবুক তোমার তলোয়ারের চেয়েও ভয়ঙ্কর।”
ইমাম নব্বী বলেছেন,“তিনি সর্বপ্রথম শহরগুলোতে বিচারক নিয়োগ,এবং কুফা,বসরা,শাম,মিসরে রাজস্ব আদায় করেন।”
ইসমাঈল বিন যিয়াদ থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন,“আলী বিন আবু তালিব রমযান মাসে এক মসিজদের পাশ দিয়ে যাবার সময় সেখানে প্ৰদীপ জ্বলতে দেখে বললেন – আল্লাহ তাআলা উমরের কবরকে আলোকিত করেছেন,আর তিনি আমাদের মসজিদ আলোকোজ্জ্বল করেছেন।”
এগারোতম পরিচ্ছেদ
ইবনে সাদ বলেছেন,“উমর একটি গুদাম নির্মাণ করে সেখানে আটা,ছাতু,খেজুর,শুষ্ক কিসমিস ইত্যাদি মুসাফিরদের জন্য সংরক্ষণ করতেন। তিনি এ গুদাম থেকে মক্কা মদীনার পথে যাতায়াতকারীদের সেবাদান করতেন। তিনি মসজিদে পাথরের মাঝে তৈরি করেন। হিজাজের ইহুদীদের শামে আর নজরানের ইহুদীদের কুফায় নির্বাসন দেন। তিনিই মাকামে ইবরাহীমকে বর্তমান স্থানে স্থাপন করেন,পূর্বে তা কাবা সংলগ্ন ছিল।”
কিছু ঘটনাবলী
আওয়ায়েল গ্রন্থে আসকারী,কবীর গ্রন্থে তাবারানী এবং ইবনে শিহাব থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেন যে,আবু বকর বিন সুলায়মান বিন আবী হাশামাকে উমর বিন আব্দুল আযীয আমিরুল মুমিনীন শব্দদ্বয়ের উৎস,কারণ ও প্রবর্তণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ আমার কাছে বন্ধক রাখা শিফায়া’র এক রমণী এ ব্যাপারে আমাকে বলেছেন,আবু বকর সিদ্দীকের পক্ষ থেকে খলীফাতুর রাসূল লিখা হতো। উমরের শাসনামলের প্রথম দিকেও তাই লিখা হতো। একদিন উমর ইরাকের শাসনকর্তার কাছে দুইজন চালাক ব্যক্তিকে মদীনায় পাঠানোর সংবাদ দিলে ইরাক শাসনকর্তা খলীফার কাছে লাবীদ বিন রাবীআ আর আদী বিন হাতিমকে পাঠালেন। তারা মদীনায় এলে সর্বপ্রথম আমর বিন আসের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। তারা তাকে বললেন, “আমিরুল মুমিনীনের কাছে আমাদের পৌঁছে দিন।” আমর বিন আস বললেন,“আল্লাহর কসম,আপনারা চমৎকার উপাধি চয়ন করেছেন।” এরপর তিনি উমরের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন,“আসসালামু আলাইকুম,ইয়া আমিরুল মুমিনীন।”উমর বললেন,“তুমি এ সম্বোধন কোথায় শিখলে ?” তিনি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললেন,“সত্যিই তো আপনি আমীর,আর আমরা মুমিন।” সুতরাং সেদিন থেকেই সরকারী কাগজপত্রে আমিরুল মুমিনীন সংযুক্ত হয়।
তাহযীব গ্রন্থে ইমাম নববী লিখেছেন,উমরের এ নামটি আদী ইবনে হাতিম আর লাবীদ বিন রাবীআ ইরাক থেকে আসার পর চয়ন করেন। কারো মতে,মুগীরা বিন শোবা এ উপাধি দেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে,উমর লোকদের বললেন,“তোমরা মুমিন।” লোকেরা বললেন,“আপনি আমাদের আমীর।” সেদিন থেকে তিনি আমিরুল মুমিনীন নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যান। এর আগে খলীফাতুর রাসুলুল্লাহ লিখা হতো। এটা অনেক বড় উপাধি হওয়ায় তা বাদ দেয়া হয়।
মুয়াবিয়া বিন কুরাহ থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন,“আবু বকর সিদ্দীক ‘খলীফাতুর রাসূলুল্লাহ’ লিখতেন। উমরের শাসনামলে লোকেরা ‘খলীফাতুর রাসূলুল্লাহ’ লিখতে চাইলে উমর বললেন,“এটা অনেক বড় ইবরাত।” তখন লোকেরা বললো,“আপনি আমাদের আমীর।” তিনি বললেন,“আমি তোমাদের আমীর,তোমরা মুমিন।” তখন থেকে আমিরুল মুমিনীন লিখা শুরু হয়।
ইমাম বুখারী স্বরচিত ইতিহাস গ্রন্থে ইবনে মাসীব থেকে বর্ণনা করেছেন, আলীর পরামর্শ উমর ১৬ হিজরীতে ইতিহাস লিখতে আরম্ভ করেন।
তুযুরিয়াত গ্রন্থে ইবনে উমর থেকে সালফী বর্ণনা করেছেনঃ এক শত বিজয়গাঁথা লিখানোর ইচ্ছায় তিনি এক মাস ইসতেখারা করেন। এরপর লিখানোর ইচ্ছা পোষণের পর তিনি বললেন,“পূর্ববর্তী জাতিও গ্রন্থ রচনা করে আল্লাহর কিতাব ছেড়ে সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে।”
শাদ্দাদ থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন যে,উমর বাইআতের পর সর্বপ্রথম মিম্বরে আরোহণ করে এ দুয়া করলেন,“হে আল্লাহ, আমি কঠোর, আমাকে নরম করে দিন। হে আল্লাহ,আমি দুর্বল,আমাকে শক্তি দিন; আমি কৃপণ,আমাকে দানশীল বানিয়ে দিন।”
উমর থেকে ইবনে সাদ আর সাঈদ বিন মানসুর বর্ণনা করেছেন,“আমি আল্লাহর সম্পদের রক্ষক। আমি হতদরিদ্র। আমার কাছে কিছু থাকলে আমি বাঁচবো। আমি মুখাপেক্ষী হলে কার্জ করব। যখন সম্পদ আসবে তখন তা শোধ করবো।”
ইবনে উমর থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন,“উমরের প্রয়োজন হলে রাষ্ট্ৰীয় কোষাগারের (বাইতুল মালের) দারোগার কাছ থেকে কার্জ নিতেন। একবার দারোগা তার পাওনা চাইলেন। সে সময় উমর ভীষণ অর্থ সংকটে থাকায় পাওনা পরিশোধ করতে পারছিলেন না। দারোগা পীড়াপীড়ি করায় তিনি কার্জ করে তা শোধ করেন।”
বারা বিন মারুর থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন,“একদিন লোকেরা উমরকে তার জন্য বাইতুল মালে রক্ষিত মধুর কথা বললে তিনি বললেন,“তোমরা অনুমতি দিলে আমি তা গ্ৰহণ করতে পারি,নাহলে সে মধু আমার জন্য হারাম।” লোকেরা অনুমতি দিলো।
সালেম বিন আব্দুল্লাহ বলেছেনঃ একদিন উমর উটের পেটের নিম্নদেশে সৃষ্ট ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে করতে বললেন,“আমার ভীষণ ভয় করছে,আল্লাহ তাআলা যদি কিয়ামতের দিন এর পরিচর্যার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন!”
ইবনে উমর বলেছেন,“উমর জাতিকে কোনো কাজ নিষেধ করার আগে গৃহস্থ লোকদের বলতেন -তোমরা তা করলে দ্বিগুন শান্তি পাবে।”
উমর রাতের আঁধারে মদীনার অলিগলি চষে ফিরতেন। এক রাতে তিনি এক মহিলাকে দরজা বন্ধ করে এ কবিতা আবৃত্তি করতে শুনেন – “রাত প্ৰলম্বিত হয়েছে, তারকারাজি বাসর সাজিয়েছে, আমাকে জাগ্ৰত রেখেছে, আমার সাথে কেউ নেই যার সাথে আমি শুতে যাবো -এ তীব্র বাসনা। আল্লাহর কসম,আল্লাহর শাস্তির ভয় না থাকলে পশুদের মত আচরণ ও বিচরণ করতাম। কিন্তু আমি তার পর্যবেক্ষণকে ভয় পাচ্ছি, যার ফেরেশতাদ্বয় কোনো সময় গাফেল নন।” পরদিন তিনি সঙ্গে সঙ্গে রণাঙ্গনগুলোর সিপাহসালারদের এ মর্মে চিঠি লিখলেন যে,কোনো ব্যক্তি যুদ্ধক্ষেত্রে চার মাসের বেশি থাকতে পারবে না।
সালমান থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন যে,সালমানকে উমর জিজ্ঞেস করলেন,“আমি বাদশাহ না খলীফা ?” সালমান জবাবে বললেন,“আপনি যদি মুসলমানদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে অনর্থক খরচ করেন, তাহলে আপনি বাদশাহ; নতুবা আপনি খলীফা।” উমর তার একথা থেকে উপদেশ গ্ৰহণ করলেন।
সুফিয়ান বিন আবীল আরজা বলেছেন যে,একদিন হযরত উমর বললেন,“আমি জানি না,আমি বাদশাহ না খলীফা। যদি আমি বাদশাহ হই, তবে আমি হলাম সমাজের বোঝা।” উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে একজন বললেন,“আমিরুল মুমিনীন,খলীফা আর বাদশাহর মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে।” তিনি বললেন, “সেটা কি ?” সে বললো,“খলীফা তো তিনি,যিনি অনর্থক রাজস্ব আদায় করেন না,অহেতুক খরচও করেন না। আলহামদুলিল্লাহ,আপনি এমন নন। আর বাদশাহ অত্যাচারের মাধ্যমে করা আদায় করেন।” এ কথা শুনে উমর নীরব হয়ে গেলেন।
ইবনে মাসউদ বলেছেনঃ একদা তিনি ঘোড়ায় আরোহণের সময় নাজরানের ইহুদীরা তার পায়ের এক দিকে কালো চিহ্ন দেখে বললো,“আমাদের প্রাচীন গ্ৰন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে,এ ব্যক্তি আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন।”
সাদ জারী বলেছেন যে,কাবে আহবার হযরত উমরকে বললেন,“আমি পূর্ববতী নবীদের কিতাবগুলোতে দেখেছি,আপনি জাহান্নামের দরজায় দাঁড়িয়ে লোকদের এ পথে চলতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু আপনার ইন্তেকালের পর কিয়ামত পর্যন্ত এতে লোক পড়তেই থাকবে।”
আবু মুআশির বলেছেনঃ আমি আমার শিক্ষকের কাছ থেকে শুনেছি যে,উমর বলেছেন,“সংস্কার করা না পর্যন্ত এতটুকু কঠোরতা করা যাবে না,যা অত্যাচারের পর্যায়ে পড়ে, আবার খুব হালকাও করা যাবে না।
মুসান্নাফ গ্রন্থে হাকিম বিন উমাইর থেকে ইবনে আবী শাইবা বর্ণনা করেছেন,“শয়তান যেন কুফরির দলে ভিড়াতে না পারে,এমনভাবে লোকদের চাবুকাঘাত করতে উমর অধীনস্থ প্রশাসকদের নিষেধ করেছেন।”
ইবনে আবী হাতিম স্বরচিত তাফসীর গ্রন্থ শাবী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন রোম সম্রাট উমরের কাছে এ মর্মে চিঠি লিখেন যে,“আমার দূত আপনার কাছে গিয়েছিল। ফিরে এসে সে আমাকে জানালো,আপনার কাছে এমন একটি বৃক্ষ রয়েছে,যার জন্ম অন্য বৃক্ষে থেকে নয়। সে বৃক্ষের আকৃতি গাধার কানের মতো, এর ফল মতির সাদৃশ্য,ফাটলে জমরুদ পাথরের মতো সবুজ আর ইয়াকুত পাথরের মতো লাল বর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে। ফলটি পরিপক্ক হয়ে পাক ধরলে তা এক প্রকার জেলি হয়,আর শুষ্ক হলে বিশেষ আহার্যে পরিণত হয়। আমার দূত যদি সত্য বলে,তাহলে স্বর্গীয় বৃক্ষ আমার কাছেও থাকা প্রয়োজন।” উমর এর জবাবে লিখলেন,“আপনার দূত সত্য বলেছে,সে বৃক্ষ আমার কাছে রয়েছে। সে বৃক্ষ থেকে ঈসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন,আল্লাহ তাআলা মারইয়াম (আঃ) এর মাধ্যমে তাকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলাকে ভয় করুন। ঈসা (আঃ) কে প্ৰভু মনে করবেন না,কারণ তিনি আদম (আ.) এর মতো মাটির তৈরি।”
ইবনে উমর থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন যে,উমর অধীনস্থ প্রশাসকের স্ব স্ব সম্পত্তির হিসাব চেয়ে পাঠালে সাদ বিন আবী ওয়াক্কাসসহ সকলেই তা প্রদান করেন। তিনি এর অর্ধেকটা রেখে বাকী অর্ধেকটা প্রশাসকদের কাছে পাঠিয়ে দেন।
শাবী বলেছেন, “উমর প্রশাসক নিয়োগের আগে তার সম্পদের তালিকা জমা দিতেন।”
আবু উমামা বিন সাহল বিন হানীফ লিখেছেনঃ তিনি কিছুদিন পর্যন্ত রাষ্ট্ৰীয় কোষাগার থেকে কোনো ভাতা গ্ৰহণ না করায় ভীষণ অর্থ সংকটে পতিত হওয়ায় রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শে বললেন,“আমি তো খিলাফতের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। নিজের রুজি রুটির ব্যবস্থা করতে পারি না।” আলী বললেন,“সকাল সন্ধ্যার খাবার রাষ্ট্ৰীয় কোষাগার থেকে গ্ৰহণ করতে পারেন।” উমর সেটাই করলেন।
ইবনে উমর বলেছেনঃ উমর হজ্জ করতে গিয়ে যোলো দিনার খরচ করে এসে আমাকে ডেকে বললেন, “আব্দুল্লাহ,আমি অনেক খরচ করে ফেলেছি।”
মুসান্নাফ গ্রন্থে কাতাদা আর শাবী থেকে আব্দুর রাযযাক বর্ণনা করেছেনঃ উমরের কাছে এক মহিলা এসে বললো,“হে আমিরুল মুমিনীন,আমার স্বামী দিনে রোযা রাখেন আর সাত রাত নামাযে কাটিয়ে দেন।” তিনি বললেন,“তোমার স্বামী প্রশংসাযোগ্য কাজ করেছেন।” সেখানে কাব বিন সওয়ার উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন,“আমিরুল মুমিনীন, এ মহিলা স্বামীর প্রশংসা করছে না,বরং অভিযোগ পেশ করেছেন।” উমর বললেন,“কেন এ অভিযোগ ?” কাব বললেন,“স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কিছু অধিকার রয়েছে, সে জন্য।” উমর বললেন,“এখন বিষয়টি বুঝতে পারলাম। নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে ইনসাফ করা দরকার।” কাব বললেন,“হে আমিরুল মুমিনীন,আল্লাহ তাআলা পুরুষের জন্য চারজন নারী বৈধ করেছেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে চতুর্থ একজন নারীর প্রাপ্য।”
ইবনে জারীর বলেছেনঃ আমার বিশ্বস্ত বন্ধু আমাকে বলেছেন,“উমর রাতে এক মহিলাকে কবিতা (পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) আবৃত্তি করতে শুনে জিজ্ঞেস করলেন,“আপনার কি হযেছে ?” মহিলা বললেন, “কয়েক মাস আগে আমার স্বামী যুদ্ধে গেছে। তার প্রেমে এ কবিতা গাঁথা আবৃত্তি করছি।” উমর বললেন,“আপনি অবৈধ কাজে জড়িত নন তো ?” মহিলাটি বললেন,“আল্লাহ ক্ষমা করুন।” তিনি মহিলাকে সান্তনা দিয়ে বললেন,“সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, আগামীকালই আপনার স্বামীকে এনে দিচ্ছি।” সকালে তিনি ঐ মহিলার স্বামীকে ডেকে আনার জন্য রণাঙ্গনে দূত পাঠান। এরপর তিনি তার মেয়ে হাফসার কাছে গিয়ে বললেন,“আমি দারুণ এক মুসিবতের মধ্যে পড়েছি, আমাকে উদ্ধার করো। একজন নারীর কতদিন পর্যন্ত তার স্বামীর প্রয়োজন হয় না ?” হাফসা লজ্জায় মাথা নিচু করলেন আর নীরব হয়ে যান। উমর বললেন,“আল্লাহর কাজে লজ্জা করতে নেই।” হাফসা হাতের ইশরায় জানিয়ে দিলেন,তিন অথবা চার মাস। এরপর উমর যুদ্ধরত সৈনিকদের চার মাসের বেশি রণাঙ্গনে আটকে রাখতে গভর্নরদের নিষেধ করেন।
জাবের বিন আব্দুল্লাহ বলেছেনঃ আমি উমরকে স্ত্রীদের ঠাট্টা বিদ্রুপ করার অভিযোগ জানালে তিনি বললেন,“আমিও তো স্ত্রীদের ঠাট্টায় বিব্রত। এমনকি আমি কোথাও গেলে তারা আমাকে বলে,আপনি অমুক গোত্রের যুবতীদের সাথে দেখা করার জন্য যাচ্ছেন। এছাড়া আপনার কোন কাজ নেই।” সেখানে ইবনে মাসউদ বসেছিলেন, তিনি বললেন,“হে আমিরুল মুমিনীন, আপনার কি জানা নেই যে,ইবরাহীম (আঃ) সারার দুর্ব্যবহারের অভিযোগ স্বয়ং আল্লাহ তাআলার নিকট দায়ের করলে তিনি এ উত্তর পান যে,নারীদের পেছনের বাম দিক থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।”
ইকরামা বিন খালিদ বলেছেনঃ একদিন উমরের মেয়ে চুলে চিরুনী আর সুন্দর পোশাক পরে তার সামনে এলে তিনি এমন জোরে চাবুকাঘাত করেন যে,সে কাঁদতে লাগলো। হাফসা এসে বললেন,“তাকে কোন অপরাধের কারণে মেরেছেন ?” তিনি বললেন,“আমি তার মধ্যে অহংকার জাগতে দেখে তা দূর করলাম মাত্র।”
সুমার লাইস বিন সালিম বর্ণনা করেছেন যে,উমর বলেছেন,“তোমরা কারো নাম হাকীম আর আবুল হাকীম রেখো না,কারণ তা স্বয়ং আল্লাহর নাম।”
শুআবুল ইমান গ্রন্থে যাহহাক থেকে বায়হাকী বর্ণনা করেছেন যে,আবু বকর সিদ্দীক বলতেন,“আল্লাহর কসম, আমার কাছে এটাই প্রিয় যে,আমি রাস্তার পার্শ্বে একটি বৃক্ষ হতাম,আর উট আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো,এরপর বিষ্টা হয়ে আমাকে ত্যাগ করত,তবুও যদি মানুষ না হতাম।”
উমর বলতেন,“যদি আমি গৃহপালিত পশু হতাম! আমাকে খাইয়ে মোটাতাজা করতো। লোকেরা আমাকে দেখতে আসতো। এরপর কোন মেহমানের সম্মানার্থে আমাকে যাবোহ করে আমার কিছু গোশত রান্না আর কিছু গোশত কোপ্তা করে খেয়ে ফেলতো। তবুও যদি মানুষ না হতাম!”
আবুল বুখতারী থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ একদিন উমর মিম্বরে দাড়িয়ে ভাষণ প্রদানের সময় হুসাইন বিন আলী দাড়িয়ে বললেন,আমার বাবার মিম্বর,আমার বাবার নয়। কিন্তু বলো, এ কথা তোমাকে কে শিখিয়ে দিয়েছেন ? আলী দাড়িয়ে বললেন,“আল্লাহর কসম, এটি আমি শিখিয়ে দেইনি।” এরপর হুসাইনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,“আমি তোমাকে কঠোর শাস্তি দিবো।” উমর বললেন,“সত্য কথার প্রেক্ষিতে কেন তুমি তার সাথে ঝগড়া করছো ? নিশ্চয়ই এ মিম্বর তার বাবার।” (এর সূত্রগুলো বিশুদ্ধ)
আবু সালমা বিন আব্দুর রহমান আর সাঈদ বিন মুসায়াব থেকে খতীব বর্ণনা করেছেনঃ একবার উমর আর উসমান মাসয়ালা নিয়ে ভীষণ তর্ক করেন। লোকেরা মনে করলো,তাদের আর বনিবনা হবে না। কিন্তু তারা সেখান থেকে যাবার পর উভয়ের মাঝে এমন সুসম্পর্ক গড়ে উঠে যে,মনে হলো -আর তাদের মধ্যে বিতর্ক হবে না।
হাসান (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ উমর (রাঃ) সর্বপ্রথম যে খুতবা পাঠ করেন,তাতে হামদ ও সানার পর বলেন,“জেনে রেখো,আমি তোমাদের সাথে একীভূত হয়েছি,তোমরাও আমার সাথে একীভূত হয়ে যাও। আমি আমার দুই বন্ধুর পর খলীফা হয়েছি। যারা উপস্থিত রয়েছো,আমি তাদের সাথে রয়েছি। আর যারা অনুপস্থিত,আমরা তাদের প্রাপ্যকে তাদের জন্যই সংরক্ষণ করবো। যারা সৎকাজ করবে,তাদের জন্য সদাচরণ;আর যারা অসৎ কাজ করবে,আমরা তাদের শান্তি দিবো। আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করুন।”
জাবের বিন হুয়াইরিস কর্তৃক বর্ণিত হয়েছেঃ উমর (রাঃ) দফতর প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের সাথে পরামর্শে বসলে আলী (রাঃ) বললেন,“প্রতি বছর যে পরিমাণ সম্পদ জমা হবে,তা আপনার কাছে না রেখে ভাগ করে দিবেন।” উসমান (রাঃ) বললেন,“সম্পদের পরিমাণ অতিরিক্ত হলে ভাগ করে দিলেও হিসাব সংরক্ষণ করা মুশকিল হবে।” ওলীদ বিন হিশাম বিন মুগীরা বললেন,“আমি সিরিয়ায় দেখেছি,সেখানে রোম সম্রাট বিভিন্ন দফতর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সৈনিকদের সমবেত করেন।”এ কথাটি তার ভালো লাগলো,আর তিনি সেটাই করলেন।
আকীল বিন আবু তালিব,মুখরিমা বিন নওফেল আর জাবের বিন মুতঈম কুরাইশদের বংশ পরম্পরা সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান রাখতেন। উমর তাদেরকে এমনভাবে নসবনামা রচনার নির্দেশ দিলেন,যেন নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নসবনামার বিবরণের সাথে সকল বংশ পরম্পরার যুক্ত হয়।
সাঈদ বিন মুসায়্যাব কর্তৃক বর্ণিত হয়েছেঃ উমর (রাঃ) প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ২০ হিজরীতে বিভিন্ন দফতর প্রতিষ্ঠা করেন।
হাসান (রাঃ) বলেছেনঃ উমর লোকদের ভাতা বাদেও দান করার জন্য হুযায়ফার কাছে চিঠি পাঠালেন। তিনি প্রচুর পরিমাণে দান করার পরও বিপুল অর্থ সম্পদ বেঁচে যাওয়ার কথা খলীফাকে জানালে তিনি বললেন, “আবার দান করে দাও,এ সম্পদ উমর অথবা তার সন্তানদের নয়।”
আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেছেনঃ উমর (রাঃ) উম্মত জননীদের সাথে সর্বশেষ হাজ্জ করেন। আরাফাত থেকে ফেরার পথে আমি শুনলাম যে,একজন অন্যজনকে বলছে,“আমিরুল মুমিনীন কোথায় ?” অন্যজনকে বলতে শুনলাম,“সে বলছে, তিনি এখানেই আছেন।”এরপর লোকটি উটকে বসিয়ে এ কবিতা আবৃত্তি করছে – “হে নেতা,আপনার প্রতি সালাম। হে আল্লাহ,ক্ষত বিক্ষত শরীরে বরকত দিন।” এ কবিতা পাঠান্তে সে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমরা ধারণা করলাম,সে জ্বিন হবে। হাজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি শহীদ হোন।
আব্দুর রহমান বিন আবযা বলেছেন যে,উমর বলেছেন,“এ খিলাফতের প্রথম হকদার বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ,এরপর উহুদ অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ,এরপর অন্যান্যরা। মক্কা বিজয়ের পর গ্রহণকারীরা তৎপূর্ব মুসলমানরা জীবিত থাকা পর্যন্ত তারা খিলাফতের হকদার নন।”
নাখয়ী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে,এক ব্যক্তি উমর (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলো,“আপনি কি আপনার পুত্র আব্দুল্লাহকে খলীফা মনোনীত করবেন না ?” তিনি বললেন,“আল্লাহ তোমাকেকে ধ্বংস করুন। আল্লাহর কসম,আমি এমন লোককে খলীফা মনোনীত করার জন্য প্রার্থনা করবো না,যে এখনও সুন্দর পথে নিজের স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেনি।”
কাব থেকে শাদ্দাদ বিন আউস বর্ণনা করেছেনঃ বনী-ইসরাঈলের এক বাদশাহর সাথে উমরের কার্যক্রমের অনেকটা মিল ছিল। আমরা তাদের একজনের আলোচনা করলে অপরজনের স্মরণ পড়তো। বনী ইসরাঈলের সেই বাদশাহর যুগে এক নবী ছিলেন। তাকে ওহীর মাধ্যমে জানানো হলো – আপনি বাদশাহকে জানিয়ে দিন, তিনি আর মাত্র তিনদিন বেঁচে থাকবেন। সুতরাং তাকে রাষ্ট্রনায়ক মনোনীত করতে বলুন আর ওসীয়ত করতে চাইলে তা করুন। তৃতীয় দিন বাদশাহ খুবই বিনয়ের সাথে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন,“হে আল্লাহ,আমার ছেলে যুবক হওয়া পর্যন্ত আমার হায়াতকে বৃদ্ধি করুন। আপনি জানেন,আমি আপনার আদেশ কিভাবে মান্য করেছি,কিভাবে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছি,আমি কোনো সময় আপনার হুকুমের অবাধ্য হইনি।” আল্লাহ তাআলা নবীকে ওহীর মাধ্যমে বাদশাহর দুয়ার বিবরণ দিয়ে জানিয়ে দিলেন,সে সবগুলোই সত্য বলেছে,ফলে আমি তার হায়াত পনেরো বছর বৃদ্ধি করে দিলাম,যাতে পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত হতে পারে। উমর বর্শাঘাতে আহত হবার সময় কাবে আহবার এ ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন,“উমরও আল্লাহর কাছে এ দুয়া করলে তিনি আরো জীবিত থাকবেন।” তিনি এ ঘটনা জানোতে পেরে এ দুয়া করলেন,”হে আল্লাহ,আমাকে সুস্থ না করেই উঠিয়ে নিন।”
সুলায়মান বিন ইয়াসার বলেছেন,“তার মৃত্যুতে জ্বিন জাতিও বিলাপ করেছে।”
মালিক বিন দিনার (রহঃ) থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ তিনি শহীদ হওয়ার পর ইয়ামানের পাহাড়ের দিক থেকে এ কবিতার আওয়াজ ভেসে আসে – “যারা ইসলামের জন্য কাঁদে,তারা কাঁদতে থাকো,সে দিন বেশী দূরে নয়,যখন মানুষ ধ্বংস হবে,অথচ নবীর যুগ গত হওয়া বেশী দিন হয়নি। পৃথিবী উল্টে গেছে,কারণ পৃথিবীর শ্ৰেষ্ঠ সন্তান চলে গেছেন।”
ইয়াহইয়া বিন আবী রাশেদ বসরী থেকে ইবনে আবিদ দুনিয়া বর্ণনা করেছেন যে,উমর তার ছেলেকে ওসীয়ত করেছেন,“আমার কাফনে অনর্থক খরচ করবে না, কারণ যদি আমি আল্লাহ তাআলার কাছে ভাল হই, তাহলে তিনিই প্রতিদান দিবেন; আর ভাল না হলে তিনি তা ছিনিয়ে নিবেন,তাই এ অতিরিক্তের প্রয়োজন নেই। আমার কবর লম্বা করার প্রয়োজন নেই। কারণ আমি আল্লাহ তাআলার কাছে সুপ্রশস্ত কবরের অধিকারী হলে তিনি সে ব্যবস্থা করে দিবেন,অন্যথায় তিনি আমার কবর সংকুচিত করে দিবেন,এতে আমার সকল হাড়গোড় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আমার জানাযার সাথে কোনো নারী যেতে পারবে না। আমি যা নই তা বলে আমাকে স্মরণ করবে না,কারণ আল্লাহ তাআলা গায়েব জানেন,তিনি আমার সম্পর্কেও জানেন। আমাকে খুব দ্রুত সমাহিত করার ব্যবস্থা করবে।”
বারোতম পরিচ্ছেদ
আব্বাস (রাঃ) থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ আমি উমরের ইন্তেকালের এক বছর পর আল্লাহ তাআলার কাছে তাকে স্বপ্নে দেখার জন্য দুয়া করলাম। এক বছর পর স্বপ্নে উমরকে কপালের ঘাম মুছতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,“আপনি কেমন আছেন ?” তিনি বললেন,“আমি হিসাব দিয়ে সবেমাত্র ছাড়া পেলাম,আল্লাহ যদি দয়াশীল না হতেন,তাহলে উমর অপদস্ত হতো।”
যায়েদ বিন আসলাম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে,আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস স্বপ্নে উমরকে জিজ্ঞেস করলেন,“আল্লাহ তাআলা আপনার সাথে কেমন আচরণ করেছেন ?” উমর জবাবে প্রশ্ন করলেন,“আমি তোমাদের থেকে কবে পৃথক হয়েছি ?” তিনি উত্তর দিলেন,“বারো বছর আগে।” উমর বললেন,“আমি হিসাব দিয়ে এই মাত্র এলাম।”
সালিম বিন আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ আমি এক আনসারের কাছে শুনেছি, তিনি উমরকে স্বপ্নে দেখার দুয়া করায় দশ বছর পর স্বপ্নে তাঁকে কপালের ঘাম মুছতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,“হে আমিরুল মুমিনীন, আপনি কি করছেন ?” তিনি বললেন,“হিসাব দিয়ে এই মাত্র এলাম। আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ আমার সাথে না থাকলে আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম।”
অনেক বিখ্যাত লোকেরা হযরত উমরের শোকগাথা রচনা করেছেন। ছোট পরিসরের কারণে আমরা তা সন্নিবেশীত করলাম না।
হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর শাসনামলে নিম্নে উল্লেখিত সাহাবাগণ ইন্তেকাল করেন –
উতবা বিন গাযাওয়ান,আলী বিন হাযরামী,কায়েস বিন সুকন,সিদ্দীকে আকবরের সম্মানিত পিতা আবু কুহাফা,সাদ বিন উবাদা,সোহেল বিন উমর,ইবনে উম্মে মাকতুম,আয়শ বিন আবী রাবীআ,আব্দুর রহমান,যুবায়ের বিন আওয়ামের ভাই আবী সআসআ (তিনি কুরআন শরীফ একত্রিতকরণের মহান দায়িত্ব পালন করেন),নওফেল বিন হারিস বিন আব্দুল মুত্তালিব,আবু সুফিয়ান বিন হারিস বিন আব্দুল মুত্তালিব, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুত্র হযরত ইবরাহীম (রাঃ) এর সম্মানিত জননী উন্মুল মুমিনীন মারিয়া (রাঃ),আবু উবাদা বিন জাররাহ,মাআয বিন জাবাল,ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ান,উবাই বিন কাব, বিলাল,উসাইদ বিন হাযীর,শরাহবীল বিন হুসনা,ফজল বিন আব্বাস,আবু জন্দল বিন সোহেল,আবু মালিক আল আশআরী,সাফওয়ান বিন মোতাল,বারা বিন মালিক,হযরত আনাসের ভাই,উম্মত জননী যয়নব বিনতে জাহাশ,আয়য বিন গানাম,আবুল হাইসাম বিন তাইহান,খালিদ বিন ওলীদ,জারুদ,নুমান বিন মুকরিন,কাতাদা বিন নুমান,আকরা বিন হাবেস,সওদা বিনতে যামাআ,আওয়ীম বিন সাআদাহ, গায়লান ছাকাফী,আবু মুহাজিন ছাকাফী প্রমুখ। (রাদিআল্লাহু আনহুম)