হাসান বিন আলী বিন আবু তালিব,আবু মুহাম্মাদ,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাতি আর নয়নমণি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস অনুযায়ী তিনি শেষ খলীফা।
ইমরান বিন সালমান থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন,হাসান আর হুসাইন জান্নাতী। অন্ধকার যুগে কেউ এ দুটি নাম রাখেনি।
হাসান ৩য় হিজরীর রমযান মাসের মাঝামাঝিতে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর তার থেকে আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) আর তার পুত্র আদাহ,আবুল হাওরা,রাবীয়া বিন শিবান,শাবী প্রমুখ তাবেঈ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
তিনি দেখতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মতোই ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নাম হাসান রেখেছিলেন। সপ্তম দিনে আকীকা করেন আর মাথা ন্যাড়া করে চুলের পরিমাণ রুপা সদকা করার নির্দেশ দেন। হাসান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পঞ্চম ব্যক্তি।
আসাকির বলেছেন,“জাহেলিয়াতের যুগে এ নামের ব্যবহার ছিল না।”
মুফাসসাল বলেছেন,“আল্লাহ তাআলা হাসান আর হুসাইন – এ দুটি নাম পছন্দ করায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুটি নাম নাতিদ্বয়ের জন্য নির্বাচন করেন।”
আনাস (রাঃ) থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেন,“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারার সাথে অধিক মিল হযরত হাসান (রাঃ) ছাড়া আর কারো ছিল না।”
বারা (রাঃ) থেকে বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখলাম যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাসানকে কাঁধে নিয়ে বলছেন,“হে আল্লাহ, আমি একে ভালোবাসি,আপনিও ভালোবাসুন।”
বুখারী শরীফে উল্লেখ রয়েছে যে,আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেছেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিম্বর অলংকৃত করে উপবেশন করেছিলেন। তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাশে হাসান (রাঃ) বসেছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার লোকদের প্রতি, আর একবার হাসানের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলছিলেন,“এ আমার নাতি নেতা আর মুসলমানদের দুটি দলের মধ্য সন্ধি করিয়ে দিবে।”
ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বুখারী বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“হাসান আর হুসাইন আমার দুনিয়ার ফুল।”
আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) থেকে তিরমিযী ও হাকিম বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“হাসান আর হুসাইন জান্নাতে যুবকদের সর্দার।”
উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন যে,তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাসান আর হুসাইনকে কাঁধে নিয়ে বলেছেন, “হে আল্লাহ, এরা উভয়ে আমার নাতি আর ঐশ্বর্য। আমি তাদেরকে ভালোবাসি,আপনিও তাদের ভালোবাসুন। উপরন্তু যারা তাকে ভালোবাসে, আপনিও তাদের ভালোবাসুন।”
আনাস (রাঃ) থেকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন,“এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলো,“আহলে বাইতদের মধ্যে আপনি কাকে বেশী ভালোবাসেন ?” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“হাসান আর হুসাইন।”
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাসানকে কাঁধে নিয়ে যাচ্ছিলেন,পথিমধ্যে এ দৃশ্য দেখে এক লোক বললো,“হে ছেলে, তুমি কতোই না সুন্দর বাহন পেয়েছো!” নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“আরোহীও দারূন চমৎকার।”
আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ হাসান (রাঃ) আহলে বাইতের মধ্যে সবচেয়ে বেশী রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুরূপ দেখতে। তিনি তাঁকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন। আমি দেখলাম,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেজদায় গেলে হাসান তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিঠে উঠে বসলেন। নিজে না নামা পর্যন্ত তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেজদাতেই ছিলেন।
আবু সালামা বিন আব্দুর রহমান (রাঃ) থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাসানের সামনে নিজের জিহ্বা বের করতেন,আর হাসান জিহ্ববার লাল অংশ দেখে হাসতেন আর খুশি হতেন।
যহীর বিন আরকাম থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ একদিন হাসান (রাঃ) বক্তৃতা দানকালে জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো,“আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে,একদিন হযরত (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত হাসানকে কোলে নিয়ে বললেন – ‘যে আমাকে ভালোবাসবে, সে হাসানকেও ভালোবাসবে। যারা উপস্থিত আছো, তারা যারা উপস্থিত নেই তাদেরকে এ সংবাদ পৌছে দিবে।’ যদি রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মর্যাদার সাথে এর সংযুক্তি না থাকতো, তবে এটি বর্ণনা করতাম না।”
ইমাম হাসান (রাঃ) এর অনুপম প্রশংসা ও মর্যাদার বিবরণ অনেক ও অপার। মোটকথা,তিনি সহনশীল, পদমর্যাদাশীল,শান্ত,মহৎ আর উঁচু মাপের দানশীল। তিনি সংঘাত ও সংঘর্ষকে খারাপ মনে করতেন। তিনি একাধিক বিয়ে করেছিলেন। তিনি মানুষকে এমনভাবে দান করতেন যে,একেক জনকে লাখ লাখ দিরহাম দিতেন।
আব্দুল্লাহ বিন উবায়েদ বিন উমায়ের থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেন,“তিনি ভৃত্য-অনুচর পরিবেষ্টিত হয়ে উটের বহর নিয়ে পঁচিশ বার হাজ্জ করেন।”
উমায়ের বিন ইসহাক থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ আমি হাসানের কথায় যে মিষ্টতা রয়েছে, তা অন্যের কথায় কোনোদিন খুঁজে পাইনি। তার আলাপচয়ারিতার সময় মন চাইতো এ কথোপকথন যেন শেষ না হয়। আমি তার মুখে কোনোদিন কোনো কটু কথা শুনিনি। একবার তার সাথে আমর বিন উসমানের জমি সংক্রান্ত বিরোধ দেখা দিলে তিন তাকে জমি ভাগাভাগির প্রস্তাব দেন,কিন্তু আমর বিন উসমান তা প্রত্যাখ্যান করায় তিনি বললেন,“তার চেহারা ধুলাময় হবে” -এটাই ছিল হাসানের মুখনিঃসৃত কঠোর ভাষা।
উমায়ের বিন ইসহাক থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ মারওয়ান গভর্নর হওয়ার পর প্রতি জুমআর পর প্রতি জুমআর খুতবায় মিম্বরে দাঁড়িয়ে আলী (রাঃ) এর সমালোচনা করতেন। হাসান শুনেও এর কোন জবাব দিতেন না। একদিন মারওয়ান তার নিকট বলে পাঠালেন যে, আলী এমন,তেমন ইত্যাদি। তিনি বার্তাবাহককে বললেন,“আল্লাহর কসম, আমি তাকে গালি দিয়ে তার গুনাহ লাঘব করবো না। একদিন আমরা উভয়ে আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিত হবো। যদি তিনি সত্যবাদী হোন, তাহলে আল্লাহ তাআলা সত্য বলার কারণে তাকে পুরস্কৃত করবেন; আর কথা মিথ্যা হলে তিনিই শক্তিধর প্রতিশোধ গ্রহণকারী।”
বাযীক বিন সাওয়ার থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ একদিন মারওয়ান হযরত হাসানের সামনে তাকে গালি দেন। কিন্তু তিনি একেবারেই নীরব ছিলেন। ঠিক সে সময় মারওয়ানকে ডান হাতে নাক পরিস্কার করতে দেখে হাসান (রাঃ) বললেন,“আফসোস,আপনার এ সাধারণ বোধটুকুও নেই যে,ডান হাত মুখের জন্য, আর বাম হাত অপবিত্রতার জন্য।” এ কথা শুনে মারওয়ান নিশ্চুপ হয়ে যায়।
আশাআস বিন সাওয়ার থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ এক ব্যক্তি হাসানের কাছে এসে বসলে পর তিনি তাকে বললেন,“আপনি এমন মুহূর্তে এলেন, যখন আমার যাবার সময় হয়েছে। যদি অনুমতি প্রদান করেন, তাহলে আমি প্রস্থান করবো।”
আলী বিন যায়েদ বিন জিদআন থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ ইমাম হাসান (রাঃ) দুইবার তার সকল সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করেন, আর তিনবার অর্ধেক সম্পদ দান করেন। এমনকি দান করার সময় দুটি জুতার মধ্যে একটি আর দুটি মুজার মধ্যে একটিও দান করেন।
জুয়াইরিয়া বিন আসমা থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ ইমাম হাসান (রাঃ) ইন্তেকাল করার পর মারওয়ান তার জানাযায় এসে কাঁদতে আরম্ব করায় ইমাম হুসাইন তাকে বললেন,“আপনি আজ কাঁদছেন, কিন্তু তার জীবদ্দশায় আপনি কি-না করেছেন।” মারওয়ান বললেন,“আপনিও জানেন আমি তার সাথে কিরূপ আচরণ করেছি। কিন্তু তিনি ছিলেন ধৈর্যের দিক থেকে পাহাড়ের চেয়েও বেশী অবিচল।”
মুবারদ থেকে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন যে,এক ব্যক্তি তাকে বললেন,“আবু যর (রাঃ) এ কথা বলেছেন যে – ‘দরিদ্রতাকে প্রাচুর্যতা থেকে আর রুগ্নতাকে সুস্থতা থেকে ভালো মনে করি।’ ” তিনি বললেন, “আবু যরের উপর আল্লাহ তাআলা রহম করুন। আর আমি বলবো,আল্লাহ তাআলা কর্তৃক মনোনীত প্রতিটি অবস্থায়ই আমার কাম্য। এতে তার প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন ব্যক্ত হয়।”
ইমাম হাসানের সম্মানিত পিতা আলী (রাঃ) এর শাহাদাত লাভের পর তিনি ছয় মাস খিলাফতের তখত অলংকৃত করেন। তার কাছে কুফাবাসী বাইয়াত করেছিলো। এরপর মুয়াবিয়া (রাঃ) লড়াই করতে এলে তিনি এ শর্তে খিলাফতের দায়িত্ব তার উপর অর্পন করেন যে – আপনার পর খিলাফত আমার অধীনে থাকবে। মুয়াবিয়া (রাঃ) এ শর্ত গ্রহণের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভবিষ্যদ্বাণী সূত্রে পরিণত হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন,“আমার এ নাতি (হাসান বিন আলী) মুসলমানদের দুটি দলের মধ্যে সন্ধি করবে।”
তিনি রবিউল আউয়াল মাসে, আবার কারো মতে ৪১ হিজরীর রবিউস সানী মাসে খিলাফতের মসনদ বর্জন করেন। বন্ধুমহল তাঁকে غار المؤ منين (মুমিনদের মধ্যে লজ্জাশীল ব্যক্তি) বলে সম্বোধন করতো। তিনি বলেন, “ ‘আর’ (লজ্জা) শব্দটি ‘নার’(অগ্নি) শব্দ থেকে শ্রেয়।”
একদিন এক ব্যক্তি এসে তাঁকে বললেন,“ السلام عليكم يا مذل المؤ منين (হে মুসলমানদের আপমানকারী, আপনার প্রতি সালাম)।” এ প্রেক্ষিতে তিনি বললেন,“আমি মুসলমানদের অপমানকারী নই। আমি তোমাদের রাজত্বের জন্য যুদ্ধ আর হত্যার দিকে ঠেলে দেওয়াকে জঘন্য কাজ মনে করি।” অতঃপর তিনি কুফা ছেড়ে মদীনা শরীফে চলে আসেন আর এখানেই বসবাস করেন।
জাবের বিন নাযীর থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেনঃ হাসানকে জিজ্ঞেস করা হয়,“আপনি কেন আবার খিলাফত কামনা করছেন ?” তিনি বললেন,“যখন আরবের লোকদের মাথাগুলো আমার হাতের মুঠোয় ছিল,আমি চাইলে তাদেরকে যুদ্ধ করার জন্য উদ্ধুদ্ধ করতে পারতাম,তখন আমি শুধু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য খিলাফত ত্যাগ করেছি আর লোকদের রক্তের প্লাবন সৃষ্টি করানো থেকে পৃথক হয়ে গেছি। তো আজ হিজাযবাসীর বিষন্নতা ও মুসিবতগ্রস্ততার কারণে কেন তা গ্রহণ করতে যাবো ?”
হাসানের স্ত্রী জাআদ বিনতে আশয়াস বিন কায়েসকে মদীনায় ইয়াযিদ গোপনে এ প্রস্থাব দেয় যে,হাসানকে বিষ প্রয়োগ করতে পারলে আমি তোমাকে বিয়ে করবো। সে ধোঁকায় পড়ে তাঁকে বিষ খাওয়ায়। ফলে তিনি ৪৯ হিজরী, কারো মতে ৫০ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের পাঁচ তারিখে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত লাভ করেন। তিনি শহীদ হওয়ার পর ঘাতক ইয়াযিদকে তার প্রতিশুতির কথা মনে করিয়ে দিলে সে তা প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দিলো,“যে নারী ইমাম হাসানের সংসার ভেঙ্গেছে, আমি তাকে নিজের জন্য কিভাবে গ্রহণ করবো ?”
তার ইন্তেকালের সময় হযরত ইমাম হুসাইন বারবার বিষ প্রয়োগকারীর নাম জানোতে চাইলে তিনি বললেন, “হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আমার সন্দেহ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা এর প্রতিশোধ গ্রহণকারী। আর সে যদি হত্যাকারী না হয়, তাহলে কেন আমি তাকে হত্যা করাবো ?”
ইমরান বিন আব্দুল্লাহ বিন তালহা থেকে ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেনঃ একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন, তার দু’চোখের মাঝে লিখা রয়েছে – قُلْ هُوَ اللَّـهُ أَحَدٌ তিনি এ স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করলে পরিবারের সদস্যরা আনন্দিত হোন। কিন্তু সাঈদ বিন মুসায়েব (রাঃ) স্বপ্নের বিবরণ শুনে বললেন,“স্বপ্ন যদি সত্য হয়, তবে আপনি আর অল্প দিন জীবিত থাকবেন।” পরবর্তীতে সেটাই ঘটেছিলো।
হিশামের পিতার বরাত দিয়ে বায়হাকী আর ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ আমির মুয়াবিয়া (রাঃ) ইমাম হাসান (রাঃ) কে বার্ষিক ভাতা হিসেবে এক লাখ দিরহাম দিতেন। এক বছর তিনি তা বন্ধ করে দেন। ফলে তিনি অর্থ-সংকটে পড়লে তার কাছে পত্র লেখার জন্য কাগজ-কলম চাইলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি আর পত্র লিখলেন না। সে রাতেই রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বপ্নে দেখেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাসান (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন,“কেমন আছো ?” তিনি ভালো আছি বলে অর্থনৈতিক দৈন্যতার অভিযোগ পেশ করলে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ দুয়া পাঠ করতে বললেন –
اللهم اقذف في قلبى رجاء ك واقطع رجا ءنى عمن سواك حتى لا ارجو ا احد ا غيرك
اللهم وما ضعفت عنه توتى وقصو عنه عملى ولم تنته اليه رغبتى ولم تبلغه مسألتى ولم يجر على لسانى مما اعطيت احدا من الاولين والاخرين من اليقين فخصنى به يا رب العالمين
হিশামের পিতা বলেছেনঃ তিনি এ দুয়া পড়তে আরম্ভ করলে এক সপ্তাহের মধ্যে আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) পনেরো লাখ দিরহাম তার নিকটে পাঠিয়ে দেন আর তিনি বলেন – “সেই প্রতিপালকের শোকর, যিনি তার স্মরণকারীকে ভুলে যান না আর প্রার্থনাকারীকে নিরাশ করেন না।” অতঃপর তিনি আবার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখেন। নবী আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন,“হাসান, এখন কেমন আছো ?” তিনি বললেন,“ভালো। আমীর মুয়াবিয়া পনেরো লাখ দিরহাম পাঠিয়েছেন।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,“সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা আর মানুষের কাছে ভিক্ষা না করার প্রতিফল এটি।”
তৌরিয়াত গ্রন্থে সালীম বিন ঈসা কারী কুফী থেকে বর্ণিত রয়েছেঃ মৃত্যুর সময় হাসান (রাঃ) বিচলিত হয়ে পড়লে হুসাইন (রাঃ) বললেন,“ভাই,আপনি কেন বিচলিত হবেন! আপনি তো নানা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম),পিতা আলী (রাঃ),নানী খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ), মা ফাতেমাতুয যোহরা (রাঃ), মামা কাসেম (রাঃ) আর তাহের (রাঃ),চাচা হামযা (রাঃ) আর জাফর (রাঃ) এর কাছে যাচ্ছেন।” হাসান (রাঃ) বললেন,“ভাই হুসাইন, আমি এমন স্থানে যাচ্ছি, এর আগে যেখানে যাইনি। আর আমি এমন মানুষদের দেখেছি, যাদেরকে এর আগে দেখিনি।”
আব্দুল্লাহ বিভিন্ন সূত্রে কয়েকটি বর্ণনা বর্ণিত করেছেনঃ হাসান (রাঃ) মৃত্যুর প্রাক্কালে হুসাইন (রাঃ) কে বলেন, “রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর তোমার পিতা খিলাফত কামনা করেছিলেন। কিন্তু আবু বকর (রাঃ) খিলাফত প্রাপ্ত হোন। এরপর হযরত উমর (রাঃ) খলীফা হোন। তারপর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, আলোচকগণ এবার আলী (রাঃ) কে বাদ দিবেন না। কিন্তু উসমান (রাঃ) খলীফা হয়ে যান। তার শাহাদাতের পর আলী (রাঃ) খলীফা হলে উভয় পক্ষ থেকে তলোয়ার নিস্কোশিত হয়। এতে আমি বুঝে গেছি, আমাদের বংশে খিলাফত আর নবুওয়াত একত্রে জমা হবে না। সুতরাং খিলাফতের জন্য কুফার নির্বোধ লোকেরা তোমাকে যেন বের না করতে পারে। রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাশে আমাকে দাফন করার জায়গা দেওয়ার জন্য আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) এর কাছে আবেদন করলে তিনি তা মঞ্জুর করে বললেন, আপনার মৃত্যুর সময় আমার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিবেন,কিন্তু আমার মন বলছে তাঁকে পূর্বের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিলে অন্যরা সেই জায়গা দানে বাধা দিবে। যদি তারা সেখানে আমাকে কবর দিতে বাধা দেয়, তাহলে জেদাজেদি করবে না।”
ইমাম হাসান (রাঃ) এর ইন্তেকালের পর হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) এর কাছে যান আর তিনি অনুমতি দেন,কিন্তু মারওয়ান বাধা দেয়। ফলে ইমাম হুসাইন আর তার সহচরবৃন্দ তলোয়ার উত্তোলন করলে আবু হুরায়রা (রাঃ) ইমাম হাসানের ওসীয়ত স্মরণ করিয়ে দিয়ে সংঘাতে যেতে নিষেধ করেন। অবশেষে ইমাম হাসানকে হযরত ফাতেমার পাশে দাফন করা হয়।