আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু

আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের বিন আওয়াম বিন খুয়াইলিদ বিন আসাদ বিন আব্দুল উজ্জা বিন কুসসী আল-আসাদীর উপনাম আবু বকর আর আবু খুবায়ের। তিনি নিজে সাহাবী আর সাহাবীর পুত্র। তার পিতা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের মধ্যে অন্যতম। মা আসমা বিনতে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। তার দাদী সুফিয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফু।

তিনি মদীনা শরীফে হিজরতের বিশ মাস পর জন্মগ্রহণ করেন। কেউ বলেন,হিজরতের বছর তার জন্ম। হিজরতের পর মুহাজিরদের প্রথম সন্তান তিনি। তার জন্মে মুসলমানগণ আনন্দিত হয়েছিলেন, কারণ ইহুদীরা প্রচার করেছিলো তারা যাদু করে মুসলমানদের সন্তান হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

জন্মের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাঁকে পেশ করা হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি খেজুর চিবিয়ে তাঁকে চাটিয়ে দেন আর আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের নানা আবু বকর সিদ্দীকের নামে নাম ও উপনাম রাখলেন।

তিনি বেশী বেশী রোযা রাখতেন, দীর্ঘ ক্বিরাত দিয়ে নামায পড়তেন। তিনি ছিলেন দয়ার্দ্র,অসীম সাহসী ও যুগশ্রেষ্ঠ বীর। তিনি কোনো কোনো রাতকে নামাযের মধ্যে দাঁড়িয়েই শেষ করে দিতেন,রুকুর মধ্যেই কোনো রাত সকাল হয়ে যেতো,আবার কোনো রাত তিনি সেজদায় কাটিয়ে দিতেন।

তিনি ৩৩টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার কাছ থেকে যারা হাদীস বর্ণনা করেছেন তারা হলেন – তার ভাই উরওয়া,ইবনে আবী মালীকা,আব্বাস বিন সহল,সাবিত আল-বানানী আত, উবায়দা আল-সালমানী প্রমুখ।

তিনি ইয়াযিদ বিন মুআবিয়ার বাইআত প্রত্যাখ্যান করে মক্কায় গিয়ে নিকে কাউকে বাইআত দেননি আর নিজের জন্যও অন্যের কাছ থেকে বাইয়াত নেননি। এজন্য ইয়াযিদ তার প্রতি রুষ্ট ছিল। ইয়াযিদের মৃত্যুতে হিজাযবাসী, ইয়ামানবাসী, ইরাকবাসী, খুরাসানবাসী তার কাছে বাইয়াত করে। তিনি কাবা শরীফ পুনর্নিমাণ করেন। ইবরাহীম (আঃ) এর যুগে কাবা শরীফ যেমন ছিল,তেমনিভাবে তিনি কাবা শরীফের দুটি দরজা নির্মাণ করেন। তার খালা আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) এর বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইচ্ছা ছিলো আরো ছয় গজ জায়গা কাবা শরীফের অন্তর্ভুক্ত করা। এজন্য তিনি সেটাই করেন।

মিসর আর সিরিয়াবাসী ইয়াযীদের পর ইয়াযিদের ছেলে মুআবিয়ার কাছে বাইআত দেয়। মুআবিয়ার পর তারা আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে বাইআত দেয়। এতে মারওয়ান বিন হাকাম বিদ্রোহ করে মিসর ও সিরিয়া যায়। তার মৃত্যু পর্যন্ত অর্থাৎ,৬৫ হিজরী অবধি মিসর ও সিরিয়া তার অধীনেই ছিল। তার শাসনকালে মারওয়ার তার ছেলে আব্দুল মালিককে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন।

যাহাবী বলেছেনঃ মারওয়ার খলীফাদের অন্তর্ভুক্ত নন। কারণ তিনি আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। এ দিন থেকে তিনি বিদ্রোহী। তার ছেলে আব্দুল মালিককে উত্তরাধিকার মনোনীত করাও সঠিক ছিলো না। তবে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে শহীদ করার পর তার খিলাফত সহীহ হয়েছে।

সে সময় আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) মক্কায় খিলাফতের মসনদে সমাসীন। আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান ইবনে যুবায়েরকে হত্যার জন্য চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে হাজ্জাজকে পাঠালেন। হাজ্জাজ এসে এক মাস মক্কা শরীফ অবরোধ করে রাখে আর শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মিনযানিক (কামান) স্থাপন করে এবং তাঁকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে ফেলে। ইবনে যুবায়েরের সহচরবৃন্দ তাঁকে ছেড়ে দুশমনের শিবিরে যোগ দেয়ায় তিনি মর্মাহত হোন। কিছুদিন পর হাজ্জাজ বিজয় অর্জন করে আর ৭৩ হিজরীর জমাদিউল আউয়াল মাসের সতেরো তারিখ সোমবারে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) কে শূলে চড়ানো হয়।

মুহাম্মাদ বিন যায়েদ বিন আব্দুল্লাহ বিন উমর বলেছেনঃ হাজ্জাজ মিনযানিক (কামান) স্থাপনের সময় আমি আবু কুবায়েস পাহাড় থেকে দেখলাম,আগুনের এক বিশাল লেলিহান শিখা আকাশ থেকে পড়ে মিনযানিকের নিকটবর্তী পঁচিশজন সৈন্য নিহত হয়।

আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) অভিজাত কুরাইশ বংশীয় ছিলেন আর তার অনেক ঘটনা ও জনশ্রুতি জনতার মুখে মুখে প্রসিদ্ধ।

মুসনাদ গ্রন্থে ইবনে যুবায়ের (রাঃ) থেকে আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেনঃ একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে কিছু রক্ত দিলেন আর তা মানুষের দৃষ্টির বাইরে ফেলে আসতে বললেন। আমি অন্তরালে গিয়ে তা পান করে ফেললাম। আমি ফিরে এলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি রক্তগুলো কি করলে ?” আমি বললাম,“আমি সেগুলো এমন এক স্থানে গোপন করে ফেলেছি,যা কেউ দেখতে পাবে না।” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“মনে হয় তুমি তা পান করেছো।” আমি হ্যা সূচক উত্তর দিলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“তোমার থেকে লোকেরা আর লোকদের থেকে তুমি কষ্ট পাবে।” কথিত আছে, ইবনে যুবায়েরের এ শক্তি সামর্থ্যই ছিল সেই রক্তের অদৃশ্য প্রতিক্রিয়া।

নাওফুল বাকালী বলেছেনঃ আসমানী কিতাবে আমি দেখেছি যে, সেখানে লিখা রয়েছে – ইবনে যুবায়ের হলেন খলীফাদের বাহন।

আমর বিন দিনার বলেছেন,“আমি তার মতো অত্যন্ত যত্নের সাথে নামায পড়তে আর কাউকে দেখিনি। মিনযানিক থেকে গোলা বর্ষণের মুহূর্তেও তিনি হারাম শরীফে নামায পড়ছিলেন। সে সময় তার কাপড়ে আগুন লেগে গিয়েছিল,কিন্তু সেদিকে তার মোটেও ভ্রূক্ষেপ ছিল না।”

মুজাহিদ বলেছেন,“তিনি যেভাবে ইবাদত করেন,তার স্থানে অন্য কেউ হলে বিরক্ত হয়ে যেতো। একবার কাবা শরীফ বন্যা প্লাবিত হয়ে পড়লে তিনি সাঁতরিয়ে তাওয়াফ করেন।”

উসমান বিন তালহা বলেছেন,“তিনটি বিষয়ে ইবনে যুবায়েরের সমকক্ষ কেউ নেই – এক, বীরত্ব ও সাহসীকতা; দুই, ইবাদতবন্দেগী এবং তিন, বাগ্মিতা ও বাকপটুতা। তিনি এমন এক উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী যে,খুৎবা দেওয়ার সময় তার কণ্ঠ পাহাড়ে ধাক্কা লাগতো।”

উরওয়া বলেছেনঃ নাবাগা জাআদী আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের শানে যে কবিতা রচনা করেছেন তার অর্থ হলো – “তিনি শাসনকর্তা হয়ে আবু বকর,উমর আর উসমানের মতো দুস্থের সেবা করবেন। সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিমিরের মাঝে আরো প্রদীপ জ্বালাবেন।”

হিশাম বিন উরওয়া আর খুবায়ের বলেছেন,“তিনিই সর্বপ্রথম কাবা শরীফকে রেশমী চাদরে আচ্ছাদন করেন। এর পূর্বে কাবাঘর চট আর চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকতো।”

আমর বিন কায়েস বলেছেন,“ইবনে যুবায়েরের বিভিন্ন ভাষাভাষীর একশো গোলাম ছিল। তিনি তাদের ভাষাতেই গোলামদের সাথে কথা বলতেন। আমি তাঁকে পার্থিব জগতের কাজে এমনভাবে মশগুল হতে দেখে ভাবতাম মনে হয় তিনি আর আখিরাতের কাজের সাথে জড়িত হবেন না। আর যখন তাঁকে আখেরাতের কাজে সম্পৃক্ত দেখতাম,মনে হতো পার্থিব কাজে আর নিজেকে জড়াবেন না।”

হিশাম বিন উরওয়া বলেছেনঃ আমার চাচা আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের শিশুকালে সর্বপ্রথম “তলোয়ার” শব্দ উচ্চারণ করেছেন। এরপর তা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তার পিতা ছেলের এ শব্দ শুনে বললেন, “তোমাকে তলোয়ার দিয়ে অনেক মধ্যস্ততা করতে হবে।”

আবু উবায়দা বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের আল-আসাদী ইবনে যুবায়েরের কাছে গিয়ে বললেন,“হে আমীরুল মুমিনীন, ওমুক দিক দিয়ে আমি আপনার আত্মীয়।” ইবনে যুবায়ের বললেন,“হ্যাঁ, সঠিক বলেছো। তবে তুমি যদি চিন্তা করে দেখো, তাহলে বুঝতে পারবে যে,সকল মানুষ একই মা আর বাবা থেকে নির্গত।” আল-আসাদী বললেন, “আমার অর্থকড়ি শেষ হয়ে গেছে।” তিনি বললেন,“আমি এর জিম্মাদার নই। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।” আসাদী বললেন,“আমার উট ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত।” তিনি বললেন, “কোনো এক চারণ ভূমিতে তোমার উট ছাড়িয়ে দাও।” আসাদী বললেন,“আমি কিছু পাবার আশায় আপনার কাছে এসেছি,অভিমত জিজ্ঞেস করার জন্য নয়। অভিশাপ ক্ষুধার্ত সেই উটনীর প্রতি, যে আমাকে আপনার কাছে এনেছে।” তিনি বললেন,“তার বাহনের উপরও।”

মুসান্নাফ গ্রন্থে যুহরী থেকে আব্দুর রাজ্জাক বর্ণনা করেছেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে কখনোই দুশমনের কাটা মাথা পেশ করা হয়নি। আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর সামনে এক ব্যক্তির ছিন্ন মাথা পেশ করা হলে তিনি দারুণ অসন্তুষ্ট হোন। ইবনে যুবায়েরের দরবারে দুশমনের কাটা মাথা পেশ করা হয়েছে।

ইবনে যুবায়েরের যুগে মুখতার কাযযাব নামে ভন্ড নবীর আবির্ভাব হয়। সে নবুওয়াত দাবী আর খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে ইবনে যুবায়ের ৬৭ হিজরীতে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে তার সাথে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত ও হত্যা করেন।

তার খিলাফতকালে উসাঈদ বিন যুহরি,আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস,নুমান বিন বসীর, সুলাইমান বিন সরদ,জাবের বিন সমরা,যায়েদ বিন আরকাম,আল লাইছী,যায়েদ বিন খালিদ আল জাহনী,আবুল আসওয়াদ ওয়ায়েল প্রমুখ আলেমে দ্বীন ইন্তেকাল করেন।