আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান

আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান বিন হাকাম বিন আবুল আস বিন উমাইয়্যা বিন আব্দুশ শামস বিন আব্দে মান্নাফ বিন কুসসী বিন কেলাব আবুল ওয়ালীদ ২৬ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।

ইবনে যুবায়েরের খিলাফতকালে মারওয়ান আব্দুল মালিককে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। আর এজন্যেই ইবনে যুবায়ের জীবিত থাকাকালে আব্দুল মালিকের খিলাফত সঠিক ছিল না।

মিসর আর সিরিয়া নির্যাতনের মাধ্যমে প্রথম থেকেই তার অধীনে ছিল। এরপর ইরাক ইত্যাদি তার পদানত হয়।

৭৩ হিজরীতে ইবনে যুবায়েরের শাহাদাতের পর তার খিলাফত বিশুদ্ধ হয়। এ বছর হাজ্জাজ কাবা শরীফ বর্তমানে যে মডেলে আছে সেভাবে পুনর্নির্মাণ করে। হাজ্জাজের ইশারায় এক ব্যক্তি কর্তৃক বিষ মিশ্রিত বর্শার আঘাতে ইবনে উমর (রাঃ) গুরুতর আহত হোন আর এ কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৭৪ হিজরীতে হাজ্জাজ মদীনা শরীফে গিয়ে মদীনাবাসী আর যে সকল আসহাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সময় জীবিত ছিলেন তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন করতে আরম্ভ করে। আনাস (রাঃ), জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ), সহল বিন সাদী (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীদের গলা আর হাতে মোহর এঁটে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের চরম অপমানিত করা হয়।

৭৫ হিজরীতে আব্দুল মালিক হজ্জ করেন আর হাজ্জাজ ইরাকের গভর্নর নিযুক্ত হোন।

৭৭ হিজরীতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি দুর্গ বিজিত হয় আর মিসরের ঐতিহাসিক জামে মসজিদ ভেঙে আব্দুল আযীয বিন মারওয়ান চারিদিকে সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুনর্নির্মাণ করেন।

৮২ হিজরীতে সিনানা দুর্গ হস্তগত হয় আর আর্মেনিয়া ও সানহাযার যুদ্ধ হয়।

৮৩ হিজরীতে হাজ্জাজ একটি শহরের গোড়া পত্তন করে।

৮৪ হিজরীতে মাসীসা আর আওদীয়ায়ে মাগরিব হাতে আসে।

৮৫ হিজরীতে আব্দুল আযীয বিন আবু হাতিম বিন তাগমান আল বাহলী নগর প্রাচীর নির্মাণ করেন।

৮৬ হিজরীতে তাওলিক আর ইহজাম নামক দুটি দুর্গ হস্তগত হয়। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে এ দুটি দুর্গের অধিকাংশ মহিলা মারা যায়। এজন্য দুর্গদ্বয়কে প্লেগের সমাধি নামে অভিহিত করা হয়। এ বছরের শাওয়াল মাসে আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান ইন্তেকাল করেন।

আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ আল আজলী বলেন,“আব্দুল মালিকের মেধা পচনের অসুখ ছিল। ১৭ জন পুত্র সন্তান রেখে সে পরলোক গমন করে।”

ইবনে সাদ বলেনঃ আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান উম্মে দারদা সাহাবীর কাছে যাতায়াত করতো। একদিন উম্মে দারদা বললেন,“হে আমিরুল মুমিনীন,আমি শুনেছি আপনি ইবাদত করার পরও মাদ পান করেন।” সে বললো,“হ্যাঁ,আমি মদ পানের সাথে সাথে কাপালিকে পরিণত হয়েছি।”

নাফে বলেছেন,“আমি মদীনায় আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের চেয়ে অধিক কূটবুদ্ধিসম্পন্ন যুবক,চালাক, ইবাদতকারী,আইনবিদ,কুরআন ও হাদীসের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ ব্যক্তি আর দেখিনি।”

আবুয যানাদ বলেছেন,“মদীনার ফকীহগণ হলেন -সাঈদ বিন মুসায়্যাব,আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান, উরওয়া বিন যুবায়ের আর ফাবিযা বিন ওযীব।”

ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেন, “সকলে ছেলের জন্ম দেয়। আর মারওয়ান দিয়েছেন পিতার জন্ম।”

উবাদা বিন লাবনী বলেছেনঃ এক ব্যক্তি ইবনে উমরকে জিজ্ঞেস করলেন,“আপনি কুরাইশদের মধ্যে বয়ঃবৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আপনার ইন্তেকালে পর আমরা মাসয়ালা মাসায়েল কাকে জিজ্ঞেস করবো ?” তিনি বললেন,“মারওয়ানের ছেলে ফকীহ, তাঁকে তোমরা জিজ্ঞেস করবে।”

আবু হুরায়রা (রাঃ) এর গোলাম সুহায়েম বলেছেন,“তরুণ আব্দুল মালিক আবু হুরায়রার কাছে এলে তিনি বললেন,এ যুবক একদিন আরবের বাদশাহ হবেন।”

উবায়দা বিন রাব্বাহ আল গাসসানী বলেছেনঃ আব্দুল মালিক খলীফা হওয়ার পর উম্মে দারদা তাঁকে বললেন,“আমি তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম তুমি একদিন বাদশাহ হবে।” তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“কিভাবে বুঝেছিলেন ?” তিনি বললেন,“তোমার চেয়ে বাগ্মী আর চিন্তাশীল আর দেখিনি।”

শাবী (রহঃ) বলেছেন,“যে আমার সাহচর্য লাভ করেছে, সে-ই আমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কাছে লা জওয়াব হয়েছে। আর আমি আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের পান্ডিত্য ও প্রখর মেধার কাছে লা জওয়াব হয়েছি। কারণ আমি তার সামনে কোনো হাদীস পেশ করলে তিনি অবশ্যই সে হাদীসের ব্যাখ্যা করতেন। আর কোনো বিষয়ে কবিতা আবৃত্তি করলে একই বিষয়ে তিনি আরো অধিক কবিতা পাঠ করতেন।”

যাহাবী বলেছেন,“তিনি যাঁদের কাছে হাদীস শুনেছেন তারা হলেন – উসমান,আবু হুরায়রা,আবু সাঈদ, উম্মে সালমা,বুরায়দা,ইবনে উমর আর মুআবিয়া (রাঃ) প্রমুখ। আর যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা হলেন – উরওয়া,খালিদ বিন মিদাদ,রাজা বিন হায়া,যহুরী,ইউনুস বিন মায়সারা,রবীআ বিন ইয়াযিদ, ইসমাঈল বিন উবায়দুল্লাহ,জারীর বিন উসমান প্রমুখ।

বাকার বিন আব্দুল্লাহ মাযানী বলেছেনঃ ইউসুফ নামের এক ইহুদী মুসলমান হোন। কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে তার মধ্যে প্রবল আগ্রহ সর্বদা বিদ্যমান থাকতো। একদিন তিনি আবদুল মালিকের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উচ্চ কণ্ঠে বললেন, “এ বাড়ির মালিকের কাছ থেকে উম্মতে মুহাম্মাদিয়া প্রবল অত্যাচারের শিকার হবে।” এ কথা শুনে আমি বললাম,“কতদিন পর্যন্ত তা চলবে ?” তিনি বললেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত খুরাসান থেকে কালো পতাকাধারী না আসবে।”

ইউনুস আব্দুল মালিকের বন্ধু ছিলেন। একদিন তিনি আব্দুল মালিকের মাথায় হাত রেখে বললেন,“আমি শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ করবো না।”

কথিত আছে যে, ইয়াযিদ বিন মুআবিয়া মক্কা শরীফে সৈন্য পাঠালে আবুল মালিক মন্তব্য করেছিলেন,“আমি আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এ লোকটি তো পবিত্র নগরীতে সৈন্য পাঠিয়েছে।” ইউসুফ বললেন,“তোমার সেনারা ইয়াযিদ বাহিনীর চেয়ে নিষ্ঠুর হবে।”

ইয়াহইয়া গাসসানী বললেন,“মুসলিম বিন উকবা মদীনায় প্রবেশ করলে আমি মসজিদে নববীতে আব্দুল মালিকের সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি কি এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ?” আমি বললাম,“হ্যাঁ।” তিনি বললেন,“দুর্ভাগা,তুমি কি জানো না, তোম্রা এমন এক জাতির সঙ্গে লড়াই করতে এসেছো যারা ইসলামের প্রথম সন্তান,তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। যদি দিনে তাদের কাছে যাও তবে তারা রোযাদার,রাতে গেলে দেখবে তাহাজ্জুদের নামাযে মশগুল। মনে রেখো,পৃথিবীর সবাই মিলে যদি তাদের হত্যা করতে চায়, আল্লাহ তাআলা তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” আব্দুল মালিক খিলাফতে তখতে আসীন হয়ে হাজ্জাজের নেতৃত্বে তাদের প্রতি সেনাবাহিনী পাঠায় আর ইবনে যুবায়েরকে হত্যা করা হয়।

আব্দুর রহমান বিন আবু বকর (রাঃ) বলেছেন,“যখন খিলাফত আব্দুল মালিকের হাতে গিয়ে পৌছে, ঠিক তখন কুরআন শরীফ তার কোলে ছিল। সে তা বন্ধ করে বললো – এটাই হলো তোমার শেষ সাক্ষাত।”

ইমাম মালিক বলেছেনঃ আমি ইয়াহইয়া বিন সাঈদের কাছে শুনেছি, আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান যোহর আর আসরের মধ্যবর্তী সময় থেকে আসর পর্যন্ত আরো দুইজনকে নিয়ে মসজিদে নামায আদায় করেন। সাঈদ বিন মুসায়্যাবকে কেউ জিজ্ঞেস করলো,“এরা তিনজন তো নামায পড়ছে,আমরাও যদি উক্ত সময়ে নামায পড়ি তবে কোনো ক্ষতি হবে না তো ?” তিনি বললেন,“বেশী বেশী নামায পড়া আর অধিক রোযা রাখার নাম ইবাদত নয়। দ্বীন নিয়ে গবেষণা ও চিন্তাশীলতা এবং গুনাহ’র কাজ থেকে বেঁচে থাকার নাম ইবাদত।”

মুসআব বিন আব্দুল্লাহ বলেছেন,“ইসলামের মধ্যে সর্বপ্রথম তার নাম আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান রাখা হয়েছে।”

ইয়াহইয়া বিন বাকীর বলেছেনঃ আমি ইমাম মালিক থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন,“দিনারের উপর সর্বপ্রথম আব্দুল মালিক ছাপ দেয় আর কুরআনের আয়াত অঙ্কিত করে।”

মুসআব বলেছেনঃ দিনারের উপর আব্দুল মালিক একদিকে قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ খোদাই করে আর অপর দিকে لا اله الا الله নকশা করে। দিনারের চারদিকে চান্দীর একটি গোল বৃত্ত ছিল। এ বৃত্তের উপর ভাগে মুদ্রা প্রস্তুতকারী সরকারী কারখানা ও শহরের নাম এবং বহিরাংশে অর্থাৎ বৃত্তের চতুর্দিকে محمد الر سول الله ارسله بالهدى ودين الحق লিখা ছিল।

আসকারী কর্তৃক রচিত আওয়ায়েল গ্রন্থে রয়েছেঃ প্রথমে মুদ্রার হস্তাক্ষরে قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ , অপর দিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম, আর তারিখ লিখা থাকতো। এ প্রথা মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানই চালু করেন। তবে তার সাম্রাজ্যে কোনো মুদ্রার প্রচলন ছিল না;বরং খ্রিস্টানদের মুদ্রাই তার রাজ্যে চলতো। খ্রিস্ট মুদ্রায় তাওহীদ ও রিসালাতের বাণী লিখার কারণে একদিন রোম সম্রাট এ মর্মে চিঠি লিখলেন যে,আপনি মুদ্রায় হস্তাক্ষরে আপনার নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাম লিখার প্রথা বর্জন করুন, অন্যথায় দিনারে আমি এমন কিছু লিখবো যা দ্বারা আপনারা মর্ম পীড়নে ভুগবেন। কারণ আপনাদের কাজে আমরা কষ্ট পাচ্ছি। খালিক বিন ইয়াযিদ বিন মুআবিয়াকে আব্দুল মালিক পরামর্শের জন্য ডাকলো। সে সব শুনে বললো,আপনার সাম্রাজ্যে খ্রিস্ট মুদ্রা প্রবেশের পথ বন্ধ করে দিন, নিজে মুদ্রার প্রবর্তন করুন আর মুদ্রায় হস্তাক্ষরের পরিবর্তে লিখাগুলো খোদাই করে দিন। তিনি এ পরামর্শ মোতাবেক ৭৫ হিজরীতে নিজস্ব দিনার তৈরি করেন।

আসকারী বলেছেনঃ খলীফাদের মধ্যে কৃপণতা করার জন্য আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের নাম রাশহুল হুজারা আর মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ার জন্য আবুল যবান নামে প্রসিদ্ধ। যে খলীফা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে,যে খলীফার সামনে কথা বলা নিষেধ ছিল আর যে যুগে প্রচলিত কোনো বচন উত্থাপন করা যেতো না, সে হলো আব্দুল মালিক।

কালবী থেকে আসকারী বর্ণনা করেছেনঃ মারওয়ান বিন হাকাম নিজ সন্তান আব্দুল মালিকের পর আমর বিন সাঈদ বিন আসকে উত্তরাধিকার মনোনিত করেছিলেন। কিন্তু আব্দুল মালিক তাঁকে হত্যা করে। ইসলামের মধ্যে এটাই ছিল প্রথম ওজর।

ইবনে জারীর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন,আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরকে শহীদ করার পর ৭৫ হিজরীতে আব্দুল মালিক মদীনায় এক বক্তৃতায় বলেছে, “(হামদ ও সানার পর) আমি দুর্বল খলীফা উসমান নই, আমি শক্তিহীন খলীফা মুআবিয়া আর ক্ষীণ মনের খলীফা ইয়াযিদও নই। আমার পূর্ববর্তী খলীফাগণ এ সম্পদ ভোগ করতেন। খবরদার! এ ব্যাপারে আমার তলোয়ার খুব তীক্ষ্ণ। তোমাদের বর্শাগুলো আমার সাহায্যে উঁচিয়ে ধরো। আমরা মুহাজিরদের প্রচলিত রীতিনীতি সংরক্ষণ করবো,তবে এর উপর আমল না করলে আমি তোমাদের ধ্বংস করে দিবো। আমর বিন সাঈদের আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাসহ আরো অন্যান্য গুণাবলী থাকলেও প্রশাসন আর খিলাফত ভিন্ন বিষয়। তিনি সামান্য মাথাচাড়া দিলে তাকে শেষ করে দিবো। মনে রেখো,আমি তোমাদের সকল আবেদন রক্ষা করবো, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আমি কিছুতেই তা মেনে নিবো না। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এটাই,যে আমর বিন সাঈদের দলে গিয়ে ভিড়বে আর যে মাথাচাড়া দিবে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। আর এরপরে যদি কেউ আমাকে আল্লাহর’ ভয় দেখায় তবে তার গর্দানও উড়িয়ে দিবো।” এ বলে সে মিম্বর থেকে নামলো। (এ বর্ণনার প্রথম রাবী করীমী মুসতাহাম মিথ্যাবাদী)

আসকারী বলেছেন,“আব্দুল মালিক সর্বপ্রথম সরকারী অনেক নথিপত্র ফার্সী থেকে আরবী ভাষায় স্থানাত্তর করে। সে সর্বপ্রথম মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে।”

আমি (জালালুদ্দিন সুয়্যুতি) বলছি, “আব্দুল মালিক দশটি বিষয়ের প্রবর্তক, এর মধ্যে পাঁচটি ভালো আর পাঁচটি মন্দ।”

ইবনে আবী শায়বা মুসান্নাফ গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন সিরীন থেকে বর্ণনা করেছেন,“মারওয়ানের সন্তানদের মধ্য থেকে আব্দুল মালিক বা অন্য কেউ ঈদুল ফিতর অথবা ঈদুল আযহার আযানের প্রথা চালু করেছিলো।”

ইবনে জারীর থেকে আব্দুর রাজ্জাক বর্ণনা করেছেনঃ আব্দুল মালিক বিন মারওয়ার সর্বপ্রথম কাবা শরীফে রেশমী কাপড়ের গিলাফ চড়িয়ে দেয়। মুফতীগণকে রেশমী কাপড় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে কাবা শরীফের জন্য রেশমী কাপড়ই সঠিক বলে অভিমত পেশ করেন।

ইউসুফ বিন মাজশু বলেছেন,“বিচার করার সময় আব্দুল মালিকের মাথার উপর তলোয়ারের দেওয়া হতো।”

আসমায়ী বলেছেনঃ এক ব্যক্তি আব্দুল মালিককে জিজ্ঞেস করলো, “হে আমিরুল মুমিনীন, আপনি খুবই দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে গেছেন।” সে বললো, “কেন হবো না, বল। প্রতি জুমআয় নিজের মেধা যেভাবে জনতার কাছে বিলিয়ে দিচ্ছি।”

মুহাম্মাদ বিন হরব যিয়াদী বলেছেনঃ এক ব্যক্তি আব্দুল মালিককে জিজ্ঞেস করলো,“কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম ?” তিনি বললেন,“যিনি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী,বিনয়ী আর সর্বাবস্থায় ইনসাফ করে।”

ইবনে আয়শা বলেছেন,“কোনো ব্যক্তি শহর,নগর অথবা গ্রাম থেকে আব্দুল মালিকের কাছে আসলে সে তাদের চারটি বিষয়ে সাবধান করে দিতো। এক – মিথ্যা বলবে না,কারণ মিথ্যার কোনো মূল্য নেই; দুই – আমি যে প্রশ্ন করবো শুধু তারই উত্তর দিবে; তিন – আমার প্রশংসায় অহেতুক কল্পনার রং ছড়িয়ে দিবে না; চার – আমাকে আমার প্রজাবৃন্দের উপর উত্তেজিত করতে পারবে না।”

মাদায়েনী বলেছেন,“জীবনের অন্তিম মুহূর্ত আব্দুল মালিক তার ছেলেকে এ উপদেশ দেয় – সর্বদা আল্লাহকে ভয় করবে,মতভেদ থেকে অনেক দূরে থাকবে,যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করবে,পুণ্যে দৃষ্টান্ত হবে,যুদ্ধের পূর্বে মৃত্যুকে আহবান করা হয় না,আর পুণ্যের পূর্ণতা ও আলোচনা যুগ যুগ ধরে থেকে যায়, তিক্ততার মধ্যে মিষ্টি আর প্রভাবশালীতার মাঝে নমনীয় হয়ে যাও।”

ইবনে আবুল আলা আশ শায়বানী কবিতার মাধ্যমে আব্দুল মালিকের নসীহতগুলো তুলে ধরেছেন এভাবে – “অনেকগুলো তীর একত্রিত করে ভাঙা অসম্ভব, তবে একটি তীর যে কারো পক্ষে ভেঙে ফেলা সম্ভব। হে ওয়ালীদ, খিলাফতের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করো। হাজ্জাজের প্রতি বেশী দৃষ্টি রাখবে,তাকে সম্মান করবে, কারণ সে-ই তোমাকে খিলাফত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। হে ওয়ালীদ, হাজ্জাজ তোমার বাহু আর তলোয়ার। তার ব্যাপারে কারো অভিযোগ গ্রহণ করবে না। সবসময় তার প্রয়োজন হবে। আমার মৃত্যুর পর নিজের জন্য বাইআত করে নিবে। যদি বাইআত গ্রহনে কেউ অস্বীকার করে তবে তার গর্দান উড়িয়ে দিবে।”

আব্দুল মালিক যখন মৃতপ্রায়, সে সময় ওয়ালীদ পিতাকে দেখার জন্য এলে তিনি তৎক্ষণাৎ এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন – “রোগীর শুশ্রুষাকারী আসছে। শুশ্রুষা করার জন্য নয়,বরং মরেছি কিনা তা দেখার জন্য।” এ কথা শুনে ওয়ালীদ কেঁদে উঠলে আব্দুল মালিক বললো,“মেয়েদের মত কেঁদে কি লাভ হবে। আমার মৃত্যুর পর নিজ পায়ে ভর করে দাঁড়াবে,বীরত্বকে কাজে লাগাবে,সিংহের পোশাক পড়বে,নিজের তলোয়ার কাঁধে রাখবে,যে অবাধ্য হবে তার মাথা ছিন্ন করে দেবে,আর যে নীরব থাকবে তাকে ছেড়ে দিবে।”

আব্দুল মালিকের মন্দ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী জঘন্য কাজটি হলো হাজ্জাজকে মুসলমান ও সাহাবীদের শাসনকর্তা নিয়োগ করা। কারণ এ হতভাগ্য লোকটি অনেক আকাবেরে আসহাবে রাসূল আর তাবেঈকে শহীদ করে দিয়েছে, আর আনাসসহ প্রমুখ সাহাবীদের গলায় ও হাতে মোহর এঁটে দিয়ে নির্যাতনের চরম দৃষ্টান্ত রেখেছে। আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করবেন না।

ইবনে আসাকির স্বরচিত ‘ইতিহাস’ গ্রন্থে ইবরাহীম বিন আদীর বরাত দিয়ে লিখেছেন,“উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের হত্যাকান্ড,জায়েশ বিন দালজার হিজাযে নিহত হওয়া,রোম সম্রাট কর্তৃক মুসলিম বিশ্বে উত্তেজনা ছড়ানোর অপকৌশল আর আমর বিন সাঈদের দামেশক গমন থেকে এ চারটি বিপদ একই রাতে হলেও আব্দুল মালিকের চেহারায় কোনো বিষাদের ছাপ পড়েনি।”

আসমায়ী বলেছেন,“শাবী,আব্দুল মালিক,হাজ্জাজ আর ইবনুল কারীয়া – এ চারজন হাসি-তামাশার সময়ও সাধারণত ভুল করতেন না।”

তৌরিয়াত গ্রন্থে সালাফী লিখেছেনঃ আব্দুল মালিক একবার বাইরে গেলে এক মহিলা এসে বললো,“হে আমিরুল মুমিনীন,আমার ভাই ছয়শো দিনার রেখে ইন্তেকাল করেছে। পরিবারের লোকেরা একটি দিনার দিয়ে আমাকে বলেছে,এটা তোমার মিরাস।” এ মাসয়ালাটি আব্দুল মালিকের বুঝে না আসায় শাবীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,“বিষয়টি যথার্থ। মৃত ব্যক্তির দুই মেয়ে দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ চারশো দিনার পাবে। মা পাবে একশো, স্ত্রী পাবে পঁচাত্তর আর বারোজন ভাই পাবে চব্বিশটি দিনার, এ দৃষ্টিকোণ থেকে তার ভাগে একটি দিনারই পড়বে।”

ইবনে আবী শায়বা মুসান্নাফ গ্রন্থে লিখেছেন যে,আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান বলেছেন,“আনন্দ উপভোগের জন্য বারবার বাঁদি, সন্তানের জন্য ফার্সী বাঁদি আর সেবার জন্য হলে রোমান দাসী কিনবে।”

ছালাবা বলেছেনঃ আব্দুল মালিক বলতো,“আমি রমযানে জন্মগ্রহণ করেছি,রমযানে মায়ের দুধ ছেড়েছি, রমযানে কুরআন মাজীদ শেষ করেছি,রমযানে বালেগ হয়েছি,রমযানে উত্তরাধিকার মনোনীত হয়েছি, রমযানে খিলাফত পেয়েছি আর রমযানেই মৃত্যুবরণ করবো।”

রমযান এলে সে খুব ভয় পেতো আর রমযান চলে গেলে সে নিশ্চিত হতো। কিন্তু সে শাওয়াল মাসে ইন্তেকাল করে।

তার শাসনামলে যেসব সাহাবী ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – ইবনে উমর,আসমা বিনতে আবু বকর,আবু সাঈদ বিন মাআলা,আবু সাঈদ খুদরী,রাফে বিন খুদায়েজ,সালমা বিন আবু আকওয়া,আরবাস বিন সারিয়া,জাবের বিন আব্দুল্লাহ,আব্দুল্লাহ বিন জাফর বিন আবু তালিব,সায়িব বিন ইয়াযীদ,উমরের গোলাম আসলাম,আবু ইদরীস আল খাওলানী,শুরাইহ কাযী,আবান বিন উসমান বিন আফফান,আশা শায়ের, এবং অলংকার শাস্ত্রের নক্ষত্র আউয়ুব বিন কারিয়া,খালিদ বিন ইয়াযিদ বিন মুআবিয়া,যাররা বিন জায়েশ, সিনান বিন সালামা বিন মুহবিক,সুয়াইদ বিন গাফলা,আবু ওয়ায়েল তারেক বিন শিহাব,মুহাম্মদ বিন হানাফীয়া,আব্দুল্লাহ বিন শাদ্দাদ বিন হাদ,আবু উবায়দা বিন আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ,আমর বিন হারীস, আমর বিন সালামা,জরমী (রহঃ)।