সুলায়মান বিন আব্দুল মালিক আবু আইয়ুবকে বনু উমাইয়্যাদের মধ্যে সর্বোত্তম বাদশাহ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তার পিতা ওয়ালিদের পর তাঁকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। তিনি ৯৬ হিজরীর জমাদিউল আখির মাসে ভাইয়ের পর মসনদে আরোহণ করেন।
তিনি পিতা আব্দুল মালিক আর আব্দুর রহমান বিন হুরায়রাহ থেকে হাদীস বর্ণনা করেন, এবং তার ছেলে আব্দুল ওয়াহিদ আর যুহরী হাদীস বর্ণনা করেন।
তিনি সুমিষ্টভাষী,বাগ্মী,ন্যায়পরায়ণ আর জিহাদের প্রতি অনুরাগী ব্যক্তি ছিলেন।
তিনি ৬০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অনেক পুণ্যময় কাজ করেছিলেন। উমর বিন আব্দুল আযীযের মতো মহান নেতা ছিলেন তার মন্ত্রী, যিনি সর্বদা তাঁকে সৎ উপদেশ দিতেন আর কল্যাণকর কাজের দিকে আহবান করতেন। তিনি হাজ্জাজ কর্তৃক প্রশাসনের নিয়োগপ্রাপ্ত সকল কর্মকর্তাকে একসঙ্গে চাকরিচ্যুত করেন আর ইরাকের জেলখানায় আটক সকলকে মুক্তি দেন। বনু উমাইয়্যার খলীফাগণ সবসময় শেষ ওয়াক্তে (বিলম্বে) নামায আদায় করতেন,উমর বিন আব্দুল আযীযের পরামর্শে তিনি আউয়াল ওয়াক্তে নামায পড়তে শুরু করেন।
ইবনে সিরীন (রহঃ) বলেছেন,“পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা সুলায়মানের প্রতি করুণা বর্ষণ করুন। তিনি তার খিলাফতকালে দুটি চমৎকার কাজ করেছেন – এক, আউয়াল ওয়াক্তে নামায পড়ার প্রবর্তন এবং দুই, উমর বিন আব্দুল আযীযকে খলীফা মনোনীত করে যাওয়া।
সুলায়মান বিন আব্দুল মালিক নাচ-গান নিষিদ্ধ করেন। তার খোরাক ছিল বেশী। কোনো এক ভোজসভায় সত্তরটি আনার,ছয় মাসের একটি ছাগল,ছয়টি মোরগ আর চার কেজি কিশমিশ একাই খেয়ে ফেলেন।
ইয়াহইয়া গাসসানী বলেছেনঃ একদিন তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের তারুণ্যদীপ্ত অবয়ব দেখে বললেন,“মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী ছিলেন,আবু বকর (রাঃ) সিদ্দীক (সত্যবাদী) ছিলেন,উমর (রাঃ) ফারুক (পৃথককারী) ছিলেন, উসমান (রাঃ) লজ্জাশীল, মুয়াবিয়া (রাঃ) বীর,ইয়াযিদ ধৈর্যশীল,আব্দুল মালিক রাজনীতিবিদ,ওয়ালীদ অত্যাচারী আর আমি নওজোয়ান বাদশাহ।” তার এ বক্তব্যের এক মাসের মধ্যেই ৯৯ হিজরীর সফর মাসের দশ তারিখ জুমআর দিন তিনি ইন্তেকাল করেন।
তার যুগে যুরযান,হাদীদ দুর্গ,সরদা,শাকা,তবরিসতান আর সুফালিয়া শহর বিজিত হয়।
আর যে সব ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – কায়েস বিন আবু হাযিম,মাহমুদ বিন লাবীদ, হাসান বিন হোসাইন বিন আলী,ইবনে আব্বাসের মুক্তদাস কারীব,আব্দুর রহমান বিন আসওয়াদ,নাখআ প্রমুখ।
আব্দুর রহমান বিন হাসসান কিনানী বলেছেনঃ সুলায়মান বিন আব্দুল মালিক যুদ্ধের ময়দানে ওয়াবেক নামক জনপদে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি রাজা বিন হায়াকে জিজ্ঞেস করেন,“আমার পর খিলাফতের তখতে কে আসীন হবেন ? আমি কি আমার ছেলেকে উত্তরাধিকার মনোনীত করবো ?” রাজা বললেন,“আপনার ছেলে এখানে নেই।” সুলায়মান বললেন,“অন্য ছেলেকে করতে পারি ?” রাজা বললেন,“তিনি বয়সে ছোট।” সুলায়মান পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,“তবে আপনার মতে সর্বোত্তম কে ?” রাজা বললেন,“উমর বিন আব্দুল আযীযের চেয়ে সর্বোত্তম আর কেউ নেই। আপনি তাকেই পরবর্তী খলীফা মনোনীত করতে পারেন।” সুলায়মান বললেন,“আমার ভাই তো উমর বিন আব্দুল আযীযের খিলাফত মেনে নেবে না বলেই আমার ধারণা।” রাজা বললেন,“এর পদ্ধতি হলো, আপনি মোহর অঙ্কিত ওসীয়তনামা লিখে দিন যে,উমর বিন আব্দুল আযীযের পর ইয়াযিদ বিন আব্দুল মালিক উত্তরাধিকার মনোনীত হবেন। এরপর দেশবাসীকে ডেকে বলুন – এ ওসীয়তনামায় যার নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে, তার নামে বাইআত করুন।”
সুলায়মান এ অভিমতকে পছন্দ করে কাগজ,কলম ও কালি চেয়ে এক ওসীয়তনামা প্রস্তুত করে রাজাকে তা দিয়ে বললেন,“এ ওসীয়ত নামায় যার নাম উল্লেখ রয়েছে তার ব্যাপারে এক্ষুণি বাইরে গিয়ে লোকদের কাছে বাইআত গ্রহণ করুন।” রাজা বাইরে এসে লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন,“আমিরুল মুমিনীনের নির্দেশে আমি এর মধ্যে উল্লেখিত ব্যক্তির নামে আপনাদের কাছ থেকে বাইআত নিচ্ছি।” লোকেরা বললো,“এর মধ্যে কার নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে ?” রাজা বললেন,“এতে মোহর লাগানো রয়েছে। খলীফার মৃত্যুর পর তার নাম জানা যাবে।” লোকেরা বললো,“আমরা এভাবে বাইআত করবো না।” রাজা বিষয়টি খলীফার কানে দিলে খলীফা বললেন,“জল্লাদ আর পুলিশদের সাথে নিয়ে জনতাকে একত্রিত করে বাইআত নিন। যারা প্রত্যাখ্যান করবে তাদের গর্দান উড়িয়ে দিবেন।” অবশেষে এভাবেই বাইয়াতের কাজ সম্পন্ন হয়।
রাজা বলেন,বাইআত গ্রহণের পর ফেরার পথে হঠাৎ হিশামের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি বললেন, “রাজা, আমার ব্যাপারে আমিরুল মুমিনীনের সিদ্ধান্ত কি ? যদি বঞ্চিত হই তবে নিজের জন্য ব্যবস্থা করবো।” আমি বললাম,“আমিরুল মুমিনীন বিষয়টি গোপন রেখেছেন,আমি কিভাবে বলবো!” এরপর উমর বিন আব্দুল আযীযের সাথে দেখা হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“রাজা, সুলায়মানের ক্ষেত্রে সংশয় রয়েছে। আমার মন বলছে,তিনি যেন আমাকে খলীফা মনোনীত না করেন। আমার মধ্যে খিলাফতের দক্ষতা ও যোগ্যতা নেই। তাই যদি আপনি এ ব্যাপারে জেনে থাকেন তাহলে বলুন, আমি যে কোন পদ্ধতিতে চেষ্টার মাধ্যমে এ আপদ মাথা থেকে নামিয়ে দিবো।” আমি হিশামের মতো তাকেও একই জবাব দিলাম।
সুলায়মানের ইন্তেকালের পর ওসীয়তনামায় উমর বিন আব্দুল আযীযের নাম দেখে আব্দুল মালিকের সন্তানদের চেহারা বিবর্ণ ও ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিন্তু যখন তারা পরবর্তী খলিফা হিসেবে ইয়াযিদ বিন আব্দুল মালিকে নাম শুনলেন, তখন তারা আশ্বস্ত হোন আর উময় বিন আব্দুল আযীযের কাছে এসে খিলাফতের দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করেন; আর উমর বিন আব্দুল আযীয কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেখানেই বসে পড়লেন। সে মুহূর্তে দাঁড়ানোর মতো কোনো শক্তি তার ছিল না। অবশেষে লোকের তার বাহু ধরে মিম্বরে উঠিয়ে দিলেন। তিনি সেখানেও অনেকক্ষণ নীরবে বসে রইলেন। রাজা বললেন,“কেন আপনারা দাঁড়িয়ে আমিরুল মুমিনীনকে বাইআত দিচ্ছেন না ?” এরপর তারা বাইআত করলেন আর উমর বিন আব্দুল আযীযের হাত ধরে রাজা লোকদের প্রতি বাড়িয়ে দিলেন।
এরপর তিনি দাঁড়িয়ে হামদ ও সানার পর বললেন,“আমি এ বিষয়ের মিমাংসাকারী নই,বরং বহনকারী। আমি কোনো বিষয়ের প্রবর্তক নই, বরং পূর্ববর্তীদের অনুগামী। অন্যান্য জনপদের লোকেরাও যদি আপনাদের মতো আমার আনুগত্য মেনে নেয়, তবেই আমি আমি আপনাদের খলীফা হবো,নতুবা নয়।”
এ বলে তিনি মিম্বর থেকে নামলে সামরিক আস্তাবল থেকে চমৎকার একটি ঘোড়া নিয়ে আসা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“এটা কি ?” লোকেরা বললো, “এটা খলীফার বাহন,রাজকীয় ঘোড়া।” তিনি বললেন, “এটা আমার প্রয়োজন নেই। আমার ঘোড়াই যথেষ্ট।” অবশেষে তার নিজস্ব ঘোড়া নিয়ে আসা হলো আর এতে চড়ে তিনি বাড়ি ফিরলেন। এরপর তিনি কালির দোয়াত নিয়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের সকল শাসনকর্তার কাছে নিজ হাতে একটি ফরমান লিখলেন। রাজা বলেছেন,“আমার মনে আছে,তিনি কোথাও নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতার কথা লিখেননি। তিনি যখন ফরমান লিখছিলেন তখন আমি দেখলাম, তার কলমের অগ্রভাগ খিলাফলের শাসনকার্য পরিচালনার দক্ষতা ও বিজ্ঞাত প্রকাশ পাচ্ছে।”
বর্ণিত রয়েছেঃ একবার মারওয়ান বিন আব্দুল মালিক আর সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের মধ্যে খিলাফত নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সুলায়মান তাঁকে গালি দিলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন,কিন্তু উমর বিন আব্দুল আযীয তার মুখে হাত রেখে বললেন,“তিনি ভালো মানুষ,খলীফা,আপনার বড় ভাই,আপনি চুপ করুন।” মারওয়ান চুপ করলেন,তবে উমর বিন আব্দুল আযীযকে বললেন,“আপনি আমাকে হত্যা করে ফেললেন,আমার শরীরে আগুন ধরে গেছে।” সে রাতেই মারওয়ান ইন্তেকাল করেন।
যিয়াদ বিন উসমান থেকে ইবনে আবিদ দুনিয়া বর্ণনা করেছেনঃ সুলায়মানের ছেলে আইয়ুব মারা গেলে আমি তার কাছে গিয়ে বললাম,“আমিরুল মুমিনীন, আব্দুর রহমান বিন আবু বকর (রাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিপদ আপদের সময় ধৈর্যধারণ করবে, তিনি কিয়ামত পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”