উমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)

উমর বিন আব্দুল আযীয বিন মারওয়ান নেককার আর খুলাফায়ে রাশেদীনের পঞ্চম খলীফা।

সুফিয়ান সাওরী বলেছেন,“আবু বকর সিদ্দীক,উমর ফারুক,উসমান গনী,আলী মুর্তজা আর উমর বিন আব্দুল আযীয -এরা পাঁচজন খুলাফায়ে রাশেদীনের অন্তর্ভুক্ত।” এ বর্ণনাটি আবু দাউদ কর্তৃক বর্ণিত।

তিনি ৬১ হিজরী অথবা ৬৫ হিজরীতে মিসরের প্রখ্যাত হুলওয়ানে মুসাফাত নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মিসরের শাসনকর্তা ছিলেন,মায়ের নাম উম্মে আসেম বিনতে আসেম বিন উমর বিন খাত্তাব (রাঃ)। পঞ্চান্ন বছর বয়সে ঘোড়ার পদাঘাতে তার মুখে একটি ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সে সময় তার পিতা তার রক্তাক্ত চেহারা মুছে দিতে দিতে বলেন,“ক্ষতচিহ্নবিশিষ্ট বনূ উমাইয়্যাগণ ভাগ্যবান।” (ইবনে আসাকির)

উমর বিন ক্ষাত্তাব (রাঃ) বলেছেন,“আমার বংশে এমন একজন লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যার চেহারায় ক্ষতচিহ্ন থাকবে। তার শাসনে পৃথিবীতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে।” (তিরমিযী)

পরবর্তীতে তার কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন,“হায়! আমি যদি আমার সেই বংশধরের যুগ পেতাম, যিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন।” (ইবনে সাদ)

ইবনে উমর বলেছেনঃ আমরা পরস্পরে এ আলোচনা করতাম যে,উমর বিন খাত্তাবের বংশ থেকে তার মতো ন্যায়পরায়ণ খলীফা আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত কোনো দিন কিয়ামত হবে না।

বিলাল বিন আব্দুল্লাহ বিন উমরের চেহারায় ক্ষতচিহ্ন থাকায় লোকেরা মনে করতো উমর বিন খাত্তাবের উক্তিতে উল্লিখিত এই সেই ব্যক্তি। কিন্তু এরই মধ্যে আল্লাহ তাআলা উমর বিন আব্দুল আযীযকে প্রেরণ করেন।

উমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) যাঁদের কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তারা হলেন – তার পিতা আব্দুল আযীয,আনাস,আব্দুল্লাহ বিন জাফর বিন আবু তালিব,ইবনে কারিয,ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ বিন সালাম, আমের বিন সাদ,সাঈদ বিন মুসায়্যেব,উরওয়া বিন যুবায়ের,আবু বকর বিন আব্দুর রহমান,রাবীআ বিন সমরা প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম। আর তার থেকে যারা হাদীস বর্ণনা করেন তারা হলেন – যুহরী,মুহাম্মাদ বিন মুনকাদির,ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আনসারী,মাসলামা বিন আব্দুল মালিক,রাজা বিন হায়া প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম।

তিনি কৈশোরে কুরআন শরীফ হিফয করার পর তার পিতা জ্ঞান অর্জনের জন্য মদীনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ উবায়দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহর কাছে পাঠান। ছাত্রজীবনে পিতার মৃত্যু হওয়ায় আব্দুল মালিক তাঁকে দামেশকে ডেকে নেন আর নিজ কন্যা ফাতেমার সঙ্গে বিয়ে দেন। তিনি খলীফা মনোনীত হওয়ার আগে থেকেই খুবই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তবে তার পরিচ্ছন্ন পোশাক আর রুচিসম্মত আহার্য গ্রহণের জন্য লোকেরা বিষয়টিকে অতিশয়োক্তি বলে অভিহিত করতো।

ওয়ালীদ তার শাসনামলে উমর বিন আব্দুল আযীযকে মদীনার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। ৮৬ হিজরী থেকে ৯৩ হিজরী পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনার পর তাঁকে অপসারণ করা হলে তিনি সিরিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন।

ওয়ালীদ নিজের ভাই সুলায়মানকে উত্তরাধিকারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তার স্থানে নিজ পুত্রকে উত্তরাধিকার মনোনীত করতে চাইলে আরবের অনেক সম্ভ্রান্ত লোক খলীফার অভিমতকে সমর্থন করলেও উমর বিন আব্দুল আযীয বিরোধিতা করে বলেছিলেন,“সুলায়মানের বাইআত আমার শিরোধার্য আর আমি এ বিষয়ে অটল।” এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওয়ালীদ তাঁকে তিন বছত বন্দী করে রাখেন। অবশেষে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। সুলায়মান তার এ বদান্যতার কথা স্মরণ রেখেছিলেন আর সুলায়মান তার পর উমর বিন আব্দুল আযীযকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন।

আনাস (রাঃ) থেকে যায়েদ বিন আসলাম বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামাযের মতো উমর বিন আব্দুল আযিয ছাড়া কারো পিছনে পড়িনি। সে সময় তিনি মদীনার শাসনকর্তা ছিলেন আর মদীনা শরীফে নামায পড়াতেন। যায়েদ বিন আসলাম বলেছেন, তিনি রুকু আর সেজদাগুলো দীর্ঘ করতেন, এবং দাঁড়ানো ও বসানোগুলো সংক্ষিপ্ত করতেন। (বাইহাকী)

এক ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মাদ বিন আলী বিন হুসাইন বলেছেন,“উমর বিন আব্দুল আযীয উমাইয়্যা বংশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ খলীফা। তিনি কিয়ামতের দিন ঐক্যবদ্ধ একটি জাতির মহান নেতা হিসেবে উত্থিত হবেন।”

মাইমুন বিন মিহরান বলেছেন,“উমর বিন আব্দুল আযীযের অনেক সহচর ছিলেন, যারা শরীয়ত সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী।”

আবু নঈম সহীহ সনদে রিবার বিন উবায়দাহ থেকে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন উমর বিন আব্দুল আযীয নামায পড়ার জন্য যাচ্ছিলেন,পথিমধ্যে এক অপরিচিত বৃদ্ধ মানুষ তার হাত ধরলেন আর পাশাপাশি চলতে শুরু করলেন। নামায শেষে কোনো প্রশ্নকারী বৃদ্ধের পরিচয় জানোতে চাইলে উমর বিন আব্দুল আযীয বললেন, “তুমি তাঁকে দেখেছো ?” আমি বললাম,“হ্যাঁ।” তিনি বললেন,“তুমি পুণ্যবান ব্যক্তি। তিনি হলেন খিযির (আঃ)। তিনি আমাকে উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার খলীফা হওয়ার সংবাদ এবং সুবিচার,সাম্য ও ন্যায়পরায়ণতার উপদেশ দিতে এসেছিলেন।”

আবু হাশিম বলেছেনঃ এক ব্যক্তি উমর বিন আব্দুল আযীযের কাছে তার স্বপ্নের বিবরণ এভাবে পেশ করেন যে – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন,তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ডান দিকে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আর বাম দিকে উমর ফারুক (রাঃ)। সামনে দুই বিচারপ্রার্থী। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে (উমর বিন আব্দুল আযীয) ইশারা করে বললেন,“তুমি খলীফা হলে এদের (আবু বকর এবং উমর) পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলবে।” এ কথা শুনে উমর বিন আব্দুল আযীয বর্ণনাকারীকে কসম করতে বলে জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি কি ঠিক এমনটাই দেখেছো ?” বর্ণনাকারী কসম খেলে উমর বিন আব্দুল আযীয কেঁদে ফেললেন।

৯৯ হিজরীর সফর মাসে উমর বিন আব্দুল আযীযের ব্যাপারে লোকদের থেকে সুলায়মান বাইআত নেন। তার খিলাফতের সময়সীমা আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর সমরসীমার সমান দুই বছর পাঁচ মাস ছিল। এ সময়ের মধ্যে তিনি অত্যাচার ও অবিচারের অবসাদ ঘটিয়ে ইনসাফের রাজ্য কায়েম করেছিলেন।

হাকিম বিন উমর বলেছেনঃ একদা খলীফাতুল মুসলিমীন উমর বিন আব্দুল আযীযের কাছে (তার নিজস্ব-অনুবাদক) আস্তাবলের প্রহরী এসে ঘোড়ার পরিচর্যার খরচাদি চাইলে তিনি বললেন, “এসব ঘোড়া সিরিয়ায় নিয়ে বিক্রি করে দাও আর বিক্রির প্রাপ্ত অর্থ বাইতুল মালে জমা করো। আমার জন্য সাদা খচ্চরই যথেষ্ট।”

উমর বিন যর বলেছেনঃ সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের জানাযা থেকে ফিরে আসার পর উমর বিন আব্দুল আযীযের গোলাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,“জনাব, আজ আপনি এ মর্মাহত কেন ?” উমর বিন আব্দুল আযীয বললেন,“পৃথিবীর মধ্যে আজ আমি সর্বাপেক্ষা মর্মাহত ও ধ্যানমগ্ন। আমার মন চাইছে ক্ষমতা ধারণের আগে ক্ষমতার দাবীদার বের হলে ক্ষমতা তাঁকে দিয়ে দিতাম।”

উরওয়া বিন মুহাজির কর্তৃক বর্ণিতঃ উমর বিন আব্দুল আযীয খলীফা মনোনীত হওয়ার পর দাঁড়িয়ে হামদ ও সানার বললেন,“আমি বিচারক নই,বিচারকের রায় পঠনকারী। আমি অনুসরণীয় নই,অনুসরণকারী। আমি আপনাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই;বরং আমার বোঝা অনেক বেশী। যে অত্যাচারী নেতা থেকে দূরে সরে যায়, সে অত্যাচারী নয়। সৃষ্টিকর্তার নাফরমানির মধ্যে মানুষের আনুগত্য নেই।”

যুহরী কর্তৃক বর্ণিত উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এর সদকা আদায়ের সর্বজন স্বীকৃত নীতি মোতাবেক উমর বিন আব্দুল আযীয সালেম বিন আব্দুল্লাহর কাছে চিঠি লিখলে তিনি জবাবে রাষ্ট্রীয় প্রসঙ্গ লিপিবদ্ধ করার পর চিঠির শেষাংশে লিখেন,“আপনি যদি লোকদের সাথে উমর বিন খাত্তাবের মতো আচরণ করতে পারেন, তবে আপনার মর্যাদা তার চেয়েও বেশী হবে। কারণ এ যুগের লোকেরা সাহাবী নয়।”

হাম্মাদ (রাঃ) বলেনঃ উমর বিন আব্দুল আযীয খলীফা হওয়ার পর কেঁদে কেঁদে আমাকে বললেন, “হাম্মাদ, আমার প্রচন্ড ভয় লাগছে।” আমি বললাম,“আপনি দিনার-দিরহাম কতটুকু ভালোবাসেন ?” তিনি বললেন, “মোটেও না।” আমি বললাম,“তাহলে আপনার ভয় কিসের ? আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন।”

মুগীরা কর্তৃক বর্ণিতঃ তিনি খলীফা হয়ে তার ভাইদের সমবেত করে বললেন,“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিদকের বাগান ছিল,এর আয় দিয়ে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বনূ হাশিমের শিশুদের লালনপালন করতেন আর বিধবাদের বিয়ে দিতেন। ফাতেমা (রাঃ) এ বাগান নিতে চাইলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা দিতে অস্বীকার করেন। অবশেষে বাগানটি আবু বকর সিদ্দীক,উমর ফারুক আর মারওয়ানের হাত বদল হয়ে আজ আমার হস্তগত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বস্তু নিজের মেয়েকে দেননি, তা আমার জন্য কিভাবে হালাল হতে পারে! তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আয় যেভাবে ব্যয় করেছেন, আমিও তাই করব ইন শা আল্লাহ।

লাবীস বলেছেনঃ উমর বিন আব্দুল আযীয খলীফা হওয়ার পর নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে রাষ্ট্রের হিসাব নেন আর এতে করে রাষ্ট্রের যে সম্পদ উদ্ধার হয় তা তিনি অত্যাচারের মাল হিসেবে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করেন।

আসমা ইবনে উবায়েদ বলেছেনঃ একদিন উকাশা বিন সাঈদ বিন আস তার কাছে এসে এ অভিযোগ করেন যে,“আমিরুল মুমিনীন, আপনার পূর্ববর্তী খলীফাগণ আমাকে উপঢৌকন দিতেন, যা আপনি আজ বন্ধ করে দিয়েছেন, ফলে আমি অর্থ সংকটে পড়েছি। আমার কাছে রাষ্ট্র কর্তৃক নিষ্কর জমিদারী রয়েছে। আপনি হুকুম দিলে আমি নিজ পরিবারের জন্য এখান থেকে কিছু নিবো।” তিনি বললেন,“আমার মতে, নিজের কষ্টার্জিত সম্পদই সবচেয়ে উত্তম।” এরপর তিনি আবার বললেন,“তুমি মৃত্যুকে বেশী করে স্মরণ করো,যদি তুমি সংকটে থাকো, তাহলে প্রাচুর্যতা অনুভব করবে। আর যদি আভিজাত্যের মোড়কে আবদ্ধ থাকো, তবে দরিদ্রতার কথা মনে পড়বে।”

ফারাত বিন সায়েব বলেছেনঃ উমর বিন আব্দুল আযীযের স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আব্দুল মালিককে তার পিতা অনেক মূল্যবান অলংকারাদি দিয়েছিলেন। একদিন তিনি স্ত্রীকে বললেন,“তোমার অলংকারগুলো বাইতুল মালে জমা দাও, নতুবা আমাকে পছন্দ না হলে তোমাকে পৃথক করে দিবো। কারণ আমি,তুমি আর তোমার অলংকারাদি এক ঘরে থাকাটা আমি মোটেও সহ্য করতে পারছি না।” ফাতেমা বললন,“আমি আপনাকেই প্রাধান্য দিবো। আপনি আমার অলংকারগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করে দিন।” তিনি সেটাই করলেন। তার ইন্তেকালের পর ইয়াযিদ বিন আব্দুল মালিক খলীফা হলে তিনি তার অলংকারগুলো ফেরত দিতে চাইলে ফাতেমা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন,“স্বামীর মহত্ত্বের নিদর্শনস্বরূপ তার জীবদ্দশায় যে জিনিস আমি দিয়েছি, তার ইন্তেকালের পর তা ফেরত নেবো না।”

কথিত আছে, এক প্রাদেশিক শাসনকর্তা খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীযের কাছে এ মর্মে চিঠি লিখলো যে, “আমাদের শহরের রাস্তা-ঘাটগুলো বিধ্বস্ত হয়েছে। আমিরুল মুমিনীনের নির্দেশ হলে কিছু অর্থ খরচ করে সেগুলো পুনর্নির্মাণ করবো।” জবাবে তিনি লিখলেন, “আমার পত্র হস্তগত হওয়ার সাথে সাথে তোমার শহরের দুর্গগুলোতে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করো, আর শহরের রাস্তাগুলো অত্যাচার মুক্ত করো, এটাই হবে সেগুলোর মেরামত।”

ইবরাহীম সকুফী বলেছেন যে,তিনি বলেছেন,“যে মুহূর্তে আমি জেনেছি মিথ্যা বলা নিন্দনীয় তখন থেকে আর কখনো মিথ্যা বলিনি।”

কায়েস বিন জাবের বলেছেন,“বনূ উমাইয়্যার মধ্যে উমর বিন আব্দুল আযীযের দৃষ্টান্ত হলো ফিরাউনের বংশের মধ্যে একজন মুমিনের মত।”

মাইমুন বিন মিহরান বলেছেন,“আল্লাহ তাআলা যেমন এক নবীর জন্য অন্য নবীর শপথ নিয়েছেন,অনুরূপ উমর বিন আব্দুল আযীযের জন্য তিনি লোকদের থেকে শপথ নিয়েছেন।”

ওহাব বিন মানবাহ বলেন,“এ উম্মতের হিদায়াতপ্রাপ্ত হলেন উমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)।”

মুহাম্মদ বিন ফুযালা বলেছেন,“একদিন উমর বিন আব্দুল আযীযের ছেলে আব্দুল্লাহ মরুভূমির মধ্যে এক সন্যাসীর পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে সন্যাসী তাঁকে দেখে কাছে এলেন। অথচ এ সন্ন্যাসী এর আগে কারো কাছে যায়নি। সন্ন্যাসী বললেন,“আপনি কি জানেন, আমি কেন আপনার কাছে এসেছি ?” আব্দুল্লাহ বললেন,“এ ব্যাপারে আমি জানি না।” তিনি বললেন,“আপনি এক ন্যায়পরায়ণ নেতার ছেলে হওয়ার কারণে আমি আপনার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছি,যার বিবরণ আমি পূর্ববর্তী কিতাবে পড়েছি।”

হাসান কাযাব বলেছেনঃ তার খিলাফতকালে বাঘ ও ছাগল এক সাথে চরতে দেখে বললাম,“সুবহানাল্লাহ!  বাঘ-বকরী একত্রে থেকেও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না!” এ কথা শুনে রাখাল বললো,“মাথা বিশুদ্ধ হলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না।”

মালিক বিন দিনার বলেছেনঃ তিনি খলীফা হওয়ার পর এক রাখাল বিস্ময় প্রকাশ করে বললো,“এমন কোন ব্যক্তি খলীফা মনোনীত হয়েছেন যে,বাঘ আমার ছাগলের ক্ষতি করেনা ?”

মূসা বিন আয়েন বলেছেন,“তার শাসনামলে আমি কারমানের ছাগল চরাতাম। সে সময় বাঘ ও বকরী একত্রে থাকতো। কিন্তু বাঘ বকরীর উপর আক্রমণ করতো না। একদিন বাঘকে বকরীর উপর হামলা করতে দেখে বললাম – মনে হয় আজ সেই ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিটি পরপারে যাত্রা করেছেন। বস্তুত অনুসন্ধানে জানা গেলো, তিনি সে দিনই ইন্তেকাল করেছেন।”

ওলীদ বিন মুসলিম বলেছেনঃ আমি জানোতাম স্বপ্নে খুরাসানের এক লোককে এক ব্যক্তি বললো,“বনূ উমাইয়্যার মধ্যে ক্ষতচিহ্নবিশিষ্ট একজন খলীফার আবির্ভাব হলে তুমি গিয়ে তাঁকে বাইআত দিবে, কারণ তিনি হলেন নিষ্ঠাবান নেতা।” লোকটি বনূ উমাইয়্যার প্রতিটি খলীফার বিবরণ সংগ্রহ করতো। অবশেষে উমর বিন আব্দুল আযীয খিলাফতের তখত অলংকৃত করলে লোকটি পুনরায় পরপর তিন তিদ একই স্বপ্ন দেখায় খুরাসান থেকে এসে উমর বিন আব্দুল আযীযকে বাইআত দেন।

হাবীব বিন হিন্দাল আসলামী বলেছেনঃ সাঈদ বিন মুসায়্যেব আমাকে বললেন,“আবু বকর সিদ্দীক,উমর ফারুক আর উমর বিন আব্দুল আযীয -এ তিনজন হলেন খলীফা।” আমি বললাম,“আমি আবু বকর আর উমরকে চিনি, কিন্তু উমর বিন আব্দুল আযীয আবার কে ?” তিনি বললেন,“যদি তার শাসনামলে তুমি জীবিত থাকো, তাহলে জানোতে পারবে।” গ্রন্থকার বলেন,সাঈদ বিন মুসায়্যেব তার খিলাফতের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন।

ইবনে আউফ বলেছেনঃ ইবনে সিরীনকে মদ্যপ অবস্থায় কসম করা সংক্রান্ত মাসআলা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন,“ইমাম মাহদী অর্থাৎ উমর বিন আব্দুল আযীয মদ্যপ অবস্থায় কসম করতে নিষেধ করেছেন।”

হাসান বলেছেন, “উমর বিন আব্দুল আযীয হলেন হিদায়াতপ্রাপ্ত, নতুবা ঈসা বিন মারইয়াম (আঃ) ছাড়া কোনো হিদায়াতপ্রাপ্ত নেই।” (টীকাঃ ঈসা বিন মারইয়াম দুনিয়াতে ফিরে এসে যার ইমামতিতে সালাত আদায় করবেন, তিনি হলেন হাদিসে বর্ণিত “আল-মাহদি”, হিদায়াতপ্রাপ্ত ইমাম –এটা হচ্ছে উপাধি, আর নাম হল মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ)

মালিক বিন দিনার বলেছেন,“লোকেরা মালিককে ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি বলে থাকে। আসলে উমর বিন আব্দুল আযীয হলেন ধর্মনিষ্ঠ সাধক ব্যক্তি। কারণ দুনিয়ার ঐশ্বর্য পেয়েও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।”

ইউনুস বিন আবু শাবীব বলেন,“তিনি সুস্বাস্থের অধিকারী ছিলেন। খিলাফত লাভের পর তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়।”

উমর বিন আব্দুল আযীযের পুত্র বলেছেনঃ আবু জাফর মানসুর আমাকে জিজ্ঞেস করেন,“আপনার পিতা খলীফা হওয়ার সময় আপনার আয় কত ছিল ?” আমি বললাম,“চল্লিশ হাজার দিনার।” তিনি বললেন, “পরবর্তীতে এর পরিমাণ কত হয়েছে ?” বললাম,“চারশো দিনার।”

মাসলামা বিন আব্দুল মালিক বলেছেনঃ আমি রুগ্ন উমর বিন আব্দুল আযীযকে দেখতে গিয়ে তার পোশাক অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন দেখে তার স্ত্রী ফাতেমাকে বললাম,“তুমি কেন তার পোশাক পরিস্কার করে দাও না ?” তিনি বললেন,“এ ছাড়া তার কোনো দ্বিতীয় পোশাক নেই যে,এ পোশাক পরিষ্কারের সময় অন্য পোশাক পড়তে পারবেন।”

তার মুক্ত দাস আবু উমাইয়্যা খাসমী বলেছেনঃ আমি একদিন আমার মুনিবকে বললাম,“প্রতিদিন মসুর ডাল খাবেন না।” জবাবে তিনি বললেন,“বৎস, তোমার মনিবের আহার্য তো এটাই।”

আউন বিন মুআম্মার বলেছেনঃ একদা তিনি তার স্ত্রীকে বললেন,“ফাতেমা, আজ আঙুর খেতে মন চাইছে, তোমার কাছে এক দিরহাম হবে ?” ফাতেমা বললেন,“আমি কোথায় পাবো ? আপনি তো আমিরুল মুমিনীন, অথচ আপনার কাছে একটিমাত্র দিরহাম নেই যা দিয়ে আঙুর কিনতে পারেন ?” তিনি বললেন, “তুমি যে অর্থের কথা বলছো, তা দিয়ে আঙুর খেতে না পাওয়া আমার প্রতি আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ করুণা। সে অর্থের অপব্যয় করলে জাহান্নামের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতাম না।”

ফাতেমা বলেন,“খলিফা হওয়ার পর থেকে মৃত্যু অবধি তার গোসল ফরয হতে দেখিনি।”

সহল বিন সদকা বলেছেনঃ তিনি খলীফা হওয়ার পর তার বাসভবান থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। অনুসন্ধানে জানা যায়,তিনি তার বাঁদিদের বলেছেন,“আমার উপর অনেক বড় দায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় আমি তোমাদের ব্যাপারে দারুণ উদাসীন হয়ে গেছি। তাই যারা মুক্ত হতে চাও তারা চলে যাও,আর যার থাকবে তাদের প্রতি শর্ত হলো, আমি তাদের আর কোনো সহযোগিরা করতে পারবো না।” এ কথা শুনে বাঁদিরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

তার স্ত্রী ফাতেমা বলেছেন, “তিনি বাড়িতে এসে সেজদায় নিজের মাথাকে লুটিয়ে দিতেন,অঝোর ধারায় কেঁদে চলতেন আর মুনাজাত করতেন। এভাবে এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। যখন ঘুম ভাঙতো তখন থেকে সারা রাত আবার এভাবেই কাটিয়ে দিতেন।”

ওলীদ বিন সায়েব বলেছেন,“আমি তার চেয়ে বেশী আল্লাহভীরু লোক কাউকে দেখিনি।”

সাঈদ বিন সুয়ায়েদ বলেছেনঃ একদিন তিনি তালিযুক্ত পোশাক পড়ে জুমআর নামায পড়াতে যাচ্ছিলেন। তা দেখে এক ব্যক্তি বললেন,“আমিরুল মুমিনীন,আল্লাহ আপনাকে সব কিছু দেওয়ার পরও আপনি কেন পোশাক তৈরি করছেন না ?” তিনি দীর্ঘক্ষণ মাথা নীচু করে থাকলেন। এরপর মাথা তুলে বললেন,“তুমি শহরের মধ্যবৃত্ত শ্রেণীর লোক,আর ঐশ্বর্যের মধ্যে মানুষের ত্রুটি মার্জনা করা সর্বোত্তম।”

মাইমুন বিন মিহরান বলেছেন যে,উমর বিন আব্দুল আযীয বলেছেন,“আমি পঞ্চাশ বছর খলীফা হয়ে থাকলেও পরিপূর্ণভাবে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না। আমি শুধু তোমাদের অন্তর থেকে দুনিয়ার লালসা বের করে দিয়ে চাই,কিন্তু আমার ভয় হয় তোমাদের মন যেন বিষিয়ে না উঠে।”

ইবরাহীম বিন মায়সারা বলেছেনঃ আমি তাউসকে জিজ্ঞেস করলাম,“উমর বিন আব্দুল আযীয কি হিদায়াতপ্রাপ্ত ?” তিনি বললেন,“শুধু হিদায়াতপ্রাপ্তই নন,তিনি একজন সুবিচারক ও ন্যায়পরায়ণ সৎ শাসক।”

উমর বিন আসাদ বলেছেন,“লোকেরা খলীফার কাছে প্রচুর ধন-দৌলত নিয়ে আসতো,আর তিনি তা গ্রহণ না করে তাদেরকে সেগুলো ইচ্ছেমত খরচ করতে বলতেন। আর এভাবে তিনি লোকদের ঐশ্বর্যশালী করেন।”

জোরিয়া বলেছেনঃ একদিন আমি ফাতেমা বিনতে আলী বিন আবু তালিবের কাছে গেলে তিনি উমর বিন আব্দুল আযীযের প্রশংসা করে বললেন,“তিনি জীবিত থাকলে আমার আর কারো প্রয়োজন হতো না।”

আতা বিন আবু রিবাহ বলেছেনঃ উমর বিন আব্দুল আযীযের স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আব্দুল মালিক আমাকে বলেছেন – তিনি খিলাফতপ্রাপ্ত হওয়ার পর ঘরে এসে জায়নামাযে বসে এমনভাবে কাঁদতে লাগলেন যে, তার দাড়ি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। আমি বললাম,“আমিরুল মুমিনীন, আপনি এত কাঁদছেন কেন ?” তিনি বললেন,“ফাতেমা, আমার কাঁধে উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার বোঝা চাপানো হয়েছে। আমি সকল ক্ষুধার্ত,দরিদ্র,মুমূর্ষু,বস্ত্রহীন,উৎপীড়িত,বন্দী,মুসাফির,বৃদ্ধ,এতিমসহ পৃথিবীর সকল দুর্ভাগ্য লোকদের ভাগ্য নিয়ে ভাবছি। আর এদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার প্রশ্নের জবাব যদি দিতে না পারি — সে জন্য কাঁদছি।”

হামীদ বলেছেন,“একদিন উমর বিন আব্দুল আযীযের কাছে হাসান আমার মারফত চিঠি লিখেন। এতে আমার বড় পরিবারে দারুণ অর্থ সংকটের উল্লেখ করলে তিনি পরিতোষ প্রেরণের নির্দেশ দেন।”

ইমাম আওযায়ী বলেছেন,“নিজের ব্যক্তিগত ক্রোধ যেন প্রকাশ না পায় সে জন্য অপরাধীকে প্রথমে তিনদিন বন্দি করে রাখতেন তিনি।”

জোয়াইরিয়া বিন আসমা বলেছেন যে,উমর বিন আব্দুল আযীয বলেছেন,“আমার অন্তর বড়ই প্রাচুর্যময়। মনের একটি ইচ্ছে পূরণ করলে এর চেয়ে বড় ইচ্ছে জাগ্রত হয়।”

আমর বিন মুহাজির বলেছেন,“বাইতুল মাল থেকে প্রতিদিন তাঁকে দুই দিরহাম দেওয়া হতো।”

ইউসুফ বিন ইয়াকুব কাবলী বলেছেন,“তিনি রাতে চামড়া উড়তেন।”

আতা খুরাসানী বলেছেন,“তিনি পানি গরম করে আনতে বললে তার গোলাম শাহী রন্ধনশালা থেকে পানি গরম করে আনে,এ কথা জানোতে পেরে তিনি শাহী রন্ধনশালার জ্বালানি বাবদ এক দিরহার প্রদান করেন।”

আমর বিন মুহাজির বলেছেন,“তিনি খিলাফতের কাজেই শুধু রাষ্ট্রীয় প্রদীপ ব্যবহার করতেন। কাজ শেষে তা নিভিয়ে দিতেন আর নিজস্ব বাতি জ্বালাতেন।”

হাকিম বিন উমর বলেছেন,“উমাইয়্যা বংশের খলীফাদের নীতি ছিল, পদের নিরাপত্তার জন্য সর্বদা তিনশো  চৌকিদার আর চারশ পুলিশ মোতায়েন থাকতো। কিন্তু তিনি খলীফা হওয়ার পর বললেন,“আমার নিরাপত্তার জন্য এদের কোনো প্রয়োজন নেই। তাই যারা আমার সাথে থাকতে চাও তাদের প্রত্যেককে দশ দিনার দিবো,আর যারা থাকতে চাও না তারা নিজ বাড়িতে ফিরে যাও।”

উমর বিন মুহাজির বলেছেনঃ একবার তিনি আপেল খাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে তার এক নিকটাত্মীয় হাদিয়া হিসেবে কিছু আপেল পাঠিয়ে দেন। এতে করে তিনি হাদীয়া দানকারীর প্রশংসা করেন আর দারুণ আনন্দিত হোন। অবশেষে গোলামকে ডেকে বললেন,“হাদীয়া প্রেরণকারীকে আমার সালাম জানাবে আর বলবে – তার হাদিয়া আমার মাথা ও চোখের মধ্যে রইলো। তিনি আমাদের সম্ভ্রান্ত বন্ধু।” এরপর তিনি আপেলগুলো ফেরত দিলেন। আমি বললাম,“আমিরুল মুমিনীন, এ হাদিয়া আপনার চাচাতো ভাই পাঠিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিয়া গ্রহণ করেছেন।” তিনি বললেন, “হাদিয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য হাদিয়াই ছিল, কিন্তু আমাদের জন্য তা উৎকোচ।”

ইবরাহীম বিন মায়সারা বলেছেন,“মুআবিয়া (রাঃ) এর শানে বেয়াদবীপূর্ণ উক্তি উচ্চারণকারী ব্যক্তি ছাড়া তিনি আর কাউকে বেত্রাঘাত করেননি।”

ইমাম আওযায়ী বলেছেন,“তিনি তার পরিবারের খরচাদি হ্রাস করায় তার পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি তাদেরকে বললেন – এরচেয়ে বেশী ব্যয় নির্বাহ করার ক্ষমতা আমার নেই। আর দূর দেশের একজন সাধারণ মানুষের যতটুকু অধিকার বাইতুল মালে রয়েছে, তোমাদেরও ততটুকু রয়েছে।”

আবু উমর বলেছেন,“তিনি প্রাদেশিক গভর্নরদের কাছে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের বিপরীত লিখিত ফরমান প্রেরণ করেন।”

ইয়াহইয়া গাসসানী বলেছেন,“উমর বিন আব্দুল আযীয মুসুলের শাসনকর্তা করে আমাকে প্রেরণ করেন। আমি সেখানে গেলে এক চোর ধরা পড়ে আর এ ব্যাপারে বহুজনের বহুমত হওয়ার কারণে বিষয়টি কিভাবে ফায়সালা করবো তা আমিরুল মুমিনীনের কাছে পরামর্শ চাইলাম। তিনি সাক্ষীর ভিত্তিতে বিচার করার নির্দেশ দিলেন।”

রাজা বিন হায়া বলেছেনঃ এক রাতে জরুরি কথা বলার জন্য উমর বিন আব্দুল আযীযের কাছে গেলাম। এমন সময় বাতির তেল শেষ হয়ে তা নিভে গেলো। তখন গোলাম ঘুমিয়ে পড়েছিলো। আমি বললাম,“গোলামকে জাগিয়ে দেই ?” তিনি বললেন,“প্রয়োজন নেই।” আমি বললাম,“তাহলে আমি বাতিটি জ্বালিয়ে দেই।” তিনি বললেন,“মেহমানের কাছ থেকে কাজ নেয়া ভদ্রতার পরিপন্থী।” অতঃপর তিনি নিজেই উঠে গিয়ে প্রদীপের তেল ঢেলে তা জ্বালিয়ে আমার কাছে এসে বললেন,“আমি নিজে সব কিছু করার পরও আমি সেই উমরই রয়ে গেছি।”

মাকহুল বলেছেন,“আমি যদি কসম করে বলি যে, তিনি সবচেয়ে বেশী আল্লাহভীরু ও ধর্মনিষ্ঠ সাধক ব্যক্তি, তাহলে আমার কসম ভাঙবে না।”

সাঈদ বিন আবু উরওয়াবা বলেছেন,“মৃত্যুর বিবরণ দেওয়ার সময় তার শরীর কাঁদতে কাঁদতে বাঁকা হয়ে যেতো।”

আতা বলেছেন,“উমর বিন আব্দুল আযীয প্রতি রাতে রাজ্যের মুফতীদের একত্রিত করে মৃত্যু ও কিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করতেন আর এমনভাবে কাঁদতেন,লাশ সামনে রেখে মানুষ যেভাবে কাঁদে।”

উবায়দুল্লাহ বিন আয়যার বলেছেনঃ একদা তিনি সিরিয়ায় এক মাটির মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন,“হে লোকসকল, নিজের অভ্যন্তর সংশোধন করো,বাহিরটা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে; আর আখিরাতের জন্য অর্জন করো,দুনিয়া এমনিতেই এসে যাবে। মনে রেখো,মৃত্যু তোমাদের মা-বাবাকে পরপারে নিয়ে গেছে।”

ওহীব বিন ওরদ বলেছেনঃ একদিন মারওয়ানের বংশধররা তার দরজায় এসে সমবেত হোন আর তার ছেলে আব্দুল মালিককে বলেন,“তোমার পিতাকে গিয়ে বলো – পূর্ববর্তী সকল খলীফা আমাদের ভাতা দিতেন, আর আপনি তা বন্ধ করে দিয়েছেন।” আব্দুল মালিক বিষয়টি খলীফাকে জনালে তিনি তিলাওয়াত করলেন –

انى اخاف ان عصيت ربي عذاب يوم عظيم

“আমি আমার রবের অবাধ্য হতে ভয় পাই; কেননা,আমি এক মহাদিবসের শাস্তিকে ভয় করি।” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ :১৫)

ইমাম আওযায়ী বলেছেন যে,উমর বিন আব্দুল আযীয বলেছেন,“পূর্ববর্তীদের অভিমত অনুযায়ী কাজ করবে। তাঁদের সাথে মতভেদ করবে না, কারণ তারা তোমাদের চেয়ে বেশী জ্ঞানী আর ধর্মনিষ্ঠ।”

একবার জারীর অনেকক্ষণ ধরে দরজার দাঁড়িয়ে থাকার পরও তিনি তার প্রতি ত্রুক্ষেপ না করায় অবশেষে জারীর তার সচিব আউন বিন আব্দুল্লাহর কাছে গিয়ে এ কবিতা আবৃত্তি করেন – “হে পাগড়িধারী, আমার যুগ শেষ হয়েছে। খলীফার সাক্ষাৎ হলে বলে দিও, আমি বন্দীদের মতো এসে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

জোয়াইরিয়া বিন আসমা বলেছেনঃ তিনি খলীফা হওয়ার পর তার কাছে বেলাল বিন আবু বারদা এসে তাঁকে মোবারকবাদ জানিয়ে বললেন,“খিলাফত অন্যান্য খলীফাদের মর্যাদাশীল করেছে,আর আপনি খিলাফতকে মর্যাদা দান করেছেন। খিলাফত খলীফাদের অলংকার,আপনি খিলাফতের অলংকার।” এরপর তিনি এ কবিতা আবৃত্তি করেন – “আপনার আগমনে সুরভি আরো সুগন্ধময় হয়েছে, কারণ আপনার উপমা আপনি নিজেই। যদিও মুক্তা অলংকারকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে,কিন্তু আপনি অলংকারের মুক্তাকে নয়নাভিরাম করেছেন।”

জুয়ুনা বলেছেনঃ তার ছেলে আব্দুল মালিকের ইন্তেকাল হলে তিনি ছেলের ভুয়সী প্রশংসা করেন। মুসলিমা বললেন,“আমিরুল মুমিনীন, তিনি জীবিত থাকলে কি তাঁকে উত্তরাধিকার মনোনীত করতেন ?” তিনি বললেন,“কখনোই না।” মুসলিমা বললেন,“তাহলে এতো প্রশংসার অর্থ কি ?” তিনি বললেন, “অপরের কাছে সে প্রশংসিত হওয়ায় আমার দৃষ্টিতেও সে প্রশংসনীয়। কারণ পিতার দৃষ্টিতে ছেলে প্রশংসার যোগ্য।”

গাসসান বলেছেনঃ এক ব্যক্তির উপদেশ প্রার্থনার প্রেক্ষিতে তিনি বললেন,“আল্লাহকে ভয় করো আর তার আদেশ মেনে চলো। তিনিই তোমার মুসিবত দূর করে দিবেন।”

আবু উমর বলেছেন,“তার কাছে উসামা বিন যায়েদের কন্যা এলে তিনি সম্মানার্থে তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করে নিজের আসনে বসতে দিয়ে তার সামনে গিয়ে বসেন আর তিনি যা চান তাই তাকে দিয়ে দেন।”

হাজ্জাজ বিন আনয়াসা বলেছেনঃ মারওয়ান বংশের কিছু লোক একত্রিত হয়ে খলীফার সাথে কৌতুক করার সিদ্ধান্ত নিলো। খলীফার কাছে এসে একজন রঙ্গরসের কথা বললে খলীফা তার দিকে তাকালেন। আরেকজন অনুরূপ রসাত্মক কথা বলায় তিনি বললেন,“তোমরা জঘন্য বিষয়ে একমত হয়েছো, যা অন্তরে হিংসা ও ঘৃণার জন্ম দিবে। ভালো হবে যদি তোমরা সমবেত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করো, তিলাওয়াত শেষে হাদীস শরীফ পাঠ করো, এরপর হাদীস নিয়ে গবেষণা করো।”

আয়াস বিন মুআবিয়া বিন কুররা বলেছেন,“তিনি এক অনন্য সচেতন কারিগর। তার নিকট কোন মেশিন ছিল না,মেশিন ছাড়াই তিনি নিপুণ কারিগরীর কারিশমা দেখিয়েছেন।”

আমর বিন হাফজ বলেছেন,“কোন মুসলমানের কথায় বিন্দু পরিমাণ কল্যাণ নিহিত থাকলে তা উড়িয়ে দিতে তিনি আমাকে নিষেধ করেছেন।”

ইয়াহইয়া গাসসানী বলেছেনঃ একবার আমিরুল মুমিনীন সুলায়মান বিন আব্দুল মালিক কর্তৃক প্রদত্ত ধর্মত্যাগীর প্রতি আরোপিত শাস্তি উমর বিন আব্দুল আযীয এভাবে স্থগিত করেন যে,সে তওবা না করা পর্যন্ত তাকে বন্দী করে রাখা হবে। সুলায়মানের কাছে ধর্মত্যাগী লোকটিকে উপস্থিত করা হলে তিনি বললেন, “তোমার বক্তব্য কি ?” লোকটি উত্তরে বললো, “হে পাপীর ছেলে পাপী, কি জানোতে চাও তুমি ?” এ কথা শুনে উমর বিন আবদুল আযীযকে সুলায়মান বললেন, “এর ব্যাপারে আপনার অভিমত কি ?” তিনি বিষয়টি নিরীক্ষণ করলে লোকটি আবার ভ্রষ্ট কথা বললো। এবার উমর বিন আব্দুল আযীয নীরব হয়ে গেলেন। সুলায়মান বললেন,“আপনি বলুন,আমি আপনার উপর নির্ভর করছি।” তিনি বললেন,“আমার অভিমত হলো, আপনিও তাকে গালি দিন।” সুলায়মান বললেন,“এটা হয় না।” এরপর সুলায়মান লোকটিকে হত্যার আদেশ দিলেন।

উমর বিন আব্দুল আযীয সেখান থেকে বেরিয়ে এলে পথিমধ্যে খালিদ নামক শহরের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাত হয়। খালিদ বললো,“আপনি খলীফাকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাতে আমার ভয় হয়েছিলো যে,তিনি মনে হয় আপনাকেই হত্যার আদেশ দিবেন।” উমর বিন আব্দুল আযীয বললেন,“আমাকে হত্যার আজ্ঞাপ্রাপ্ত হলে তুমি কি করতে ?” খালিদ বললো,“সঙ্গে সঙ্গে গর্দান উড়িয়ে দিতাম।”

উমর বিন আব্দুল আযীয খলীফা মনোনীত হওয়ার পর প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা খালিদ তার সামনে এসে দাঁড়ালে তিনি বললেন,“খালিদ, তোমার তলোয়ার রেখে দাও।” এরপর তিনি তাঁকে অব্যহিত দিলেন আর তার জন্য দুয়া করলেন। এরপর তিনি পুলিশ অফিসারদের মধ্য থেকে আমর বিন মুহাজির আনসারীকে ডেকে বললেন,“হে আমর, আল্লাহর কসম,ইসলাম ছাড়া তোমার সাথে আমার আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। আমি শুনেছি তুমি অধিক পরিমাণে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করো। আমি তোমাকে এমনভাবে নামায পড়তে দেখেছি যে,মনে হয় তুমি কোন মানুষ নও। তার উপর তুমি আনসার,তুমি এ তলোয়ার তুলে নাও। আজ থেকে আমি তোমাকে প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা মনোনীত করলাম।”

শোয়ায়েব বলেছেন, তার ছেলে আব্দুল মালিক উমর বিন আব্দুল আযীযের কাছে গিয়ে বললেন,“আমিরুল মুমিনীন,আপনি আপনার প্রতিপালকের একান্ত অনুগত। তিনি যদি আপনাকের প্রশ্ন করেন যে,তুমি লোকদের বিদআত করতে দেখে বিদআত প্রতিরোধ আর সুন্নত প্রতিষ্ঠার জন্য কি পদক্ষেপ নিয়েছিলে, তাহলে আপনি কি জবাব দিবেন ?” তিনি এ প্রশ্ন শুনে খুব খুশি হয়ে বললেন,“আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি রহম করুন আর উত্তম প্রতিদান দিন। বৎস, সমাজে বিদআত ছড়িয়ে পড়ায় সুন্নত তলিয়ে গেছে। এ অবস্থায় বিদআত প্রতিরোধে মরু প্রান্তরে খুনের নহর বয়ে দিতে চাই না। আল্লাহর কসম,এক বিন্দু রক্ত ঝরাতেও আমি প্রস্তুত নই। বিদআত প্রতিহত আর সুন্নত প্রতিষ্ঠার পরিস্থিতি আমার জীবনে যেন না আসে।”

আদী বিইন ফজল বলেছেনঃ আমি উমর বিন আব্দুল আযীযকে এক ভাষণে বলেতে শুনেছি, “হে লোকসকল, আল্লাহকে ভয় করো আর হালাল পথে রিযিকের অনুসন্ধান করো,তোমাদের ভাগ্যে রিযিক থাককে পাহাড়ের চূড়া কিংবা ভুগর্ভ থেকে হলে তা সরবরাহ করা হবেই।”

আযহার বলেছেন,“আমি একবার তাঁকে সেলাই করা জামা পরে খুৎবা দিতে দেখেছি।”

আব্দুল্লাহ বিন আলা বলেছেনঃ তিনি অধিকাংশ জুমআর খুৎবা শুরুর আগে এ বাক্যগুলো পাঠ করতেন –

الحمد الله نحمده ونستعينه ونستغفره ونعوذ بالله من شرور انفسنا ومن سيات اعما لنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلله فلا هادى له واشهد ان لا اله الا الله وحده لاسريك له واشهد ان محمد عبده ورسوله من يطع الله ورسو له فقد رشد ومن يعص الله

আর এ আয়াত তিলাওয়াতের মাধ্যমে খুৎবা শেষ করতেন –

يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّـهِ

“হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছো তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” (সূরাহ আয-যুমার, ৩৯ :৫৩)

হাজিব বিন খলীফা বরজামী বলেনঃ উমর বিন আব্দুল আযীযের খিলাফতকালে তার এক ভাষণে আমি উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন,“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুই সহচর কর্তৃক প্রবর্তিত পন্থাই একমাত্র একমাত্র সঠিক পথ,এ পথে জীবন পরিচালনা করতে হবে, আর এর বিপরীত সকল পথ ও মত পরিত্যাজ্য।” (আবু নাঈম)

ইবরাহীম বিন আবু আয়লায় বরাত দিয়ে ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ ঈদের দিন লোকের তার কাছে এসে তাঁকে সালাম জানিয়ে বলতো,“আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।” জবাবে তিনিও তাই বলতেন।

জুয়ূনা বলেছেনঃ আমর বিন কায়েস সুকুনীকে সেনাপতি করে প্রেরণের প্রাক্কালে তিনি তাকে এই বলে নসীহত করলেন যে,সে নগরীর ভালো লোকদের পরামর্শ নিবে আর দুশ্চরিত্রদের থেকে মুক্ত থাকবে,তাঁদের ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিবে। আর যদি প্রথমেই তাদের প্রতি শাসনের খড়গ উত্তোলন করো, তবে তারা অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হয়ে পালিয়ে যাবে, তোমার দাওয়াতের আহবান তাদের কানে পৌঁছবে না। এজন্য মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করবে,যাতে তারা তোমার বৈশিষ্ট্য বুঝতে সক্ষম হয় আর তোমার কথা শোনে।

সায়েব বিন মুহাম্মদ বলেছেনঃ একবার খোরাসানের শাসনকর্তা জারাহ বিন আব্দুল্লাহ খলীফার কাছে এ মর্মে চিঠি লিখলেন – “আমিরুল মুমিনীন, খুরাসানবাসী লাইনচ্যুত হয়েছে। তলোয়ার ছাড়া তাঁদের সঠিক পথে আনা সম্ভব নয়। খলীফার পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম।” উমর বিন আব্দুল আযীয প্রাপ্ত পত্রের জবাবে লিখলেন,“তুমি সঠিক বিষয় উপলব্ধি করোনি। তলোয়ার ছাড়া খোরাসানবাসী সৎপথে আসবে না – এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ন্যায়পরায়ণতা আর সত্যবাদিতা এমন একটি বিষয়, যার সংস্পর্শে আসলে এমনিতেই তারা সঠিক পথের সন্ধান পাবে। তাই তাদের মাঝে ন্যায়পরায়ণতা,সততা আর সত্যবাদিতার মহিমা প্রচার করো।”

উমাইয়্যা বিন যায়েদ করশী বলেচেহন,“তিনি আমার থেকে চিঠি লিখে নেবার সময় এ দুয়া পড়তেন – হে আল্লাহ, আপনি রসনার অপরাধ মাফ করুন।”

সালিহ বিন জাবের বলেছেনঃ ঘটনাক্রমে তিনি আমার প্রতি রাগ করলে আমি বললাম,“আমি কোন এক গ্রন্থে দেখেছি, তরুণ বাদশাহদের রাগ থেকে মুক্ত থাকতে বলা হয়েছে।” এরপর তার রাগ ঠান্ডা হলে আমি তার নিকট ক্ষমা চাইলাম। তিনি বললেন,“হে সালিহ, রেগে গেলে তোমার এ কথা অবশ্যই আমাকে মনে করিয়ে দিবে।”

আব্দুল হাকীম বিন মুহাম্মদ মাখযুমী বলেছেনঃ একদিন জারীর বিন খাতফী সাক্ষাতের জন্য উমর বিন আব্দুল আযীযের কাছে এসে সাক্ষাতের অনুমতি না পেয়ে বললেন,“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কথা বলেছি।” এরপর অনুমতি পেয়ে জারীর এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন – “সেই পবিত্র সত্ত্বা – যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে পাঠিয়েছেন আর খিলাফতের মসনদে ন্যায়পরায়ণ নেতাকে সমাসীন করেছেন,তিনি অত্যাচারের প্রতিরোধক আর সাম্যের সুরভি ছড়ানোকারী। আমি আপনার কাছে তাড়াতাড়ি কিছু সম্পদ প্রার্থনা করছি।” তিনি বললেন,“কুরআন শরীফে দেখেছি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে তোমার কোন হক নেই।” জারীর বললেন,“আমিরুল মুমিনীন, কুরআন শরীফে আমার হকের কথা উল্লেখ রয়েছে,কারণ আমি মুসাফির।” অবশেষে তিনি নিজ তহবিল থেকে পঞ্চাশ দিনার দান করলেন।

তৌরিয়াত গ্রন্থে রয়েছেঃ হারীয বিন উসমান রাজী পিতার সাথে উমর বিন আব্দুল আযীযের কাছে গেলে তিনি তার পিতাকে বললেন,“তোমার ছেলেকে ফুকাহায়ে আকবরের (বিচারপতির) শিক্ষা দান করবে। আর অল্পে তুষ্টি ও মুসলমানদের কষ্ট না দেয়া বিচারপতির প্রধান শিক্ষা।”

ইবনে আবী হাতিম স্বরচিত তাফসীর গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন কাব কারতীর বরাত দিয়ে লিখেছেনঃ একদিন উমর বিন আব্দুল আযীয আমাকে ডেকে ন্যায়পরায়ণতার সংজ্ঞা জানোতে চাইলে আমি বললাম,“আপনি মহান এক বিষয়ের অর্থ জিজ্ঞেস করেছেন। বয়সে বড় মহিলার সাথে বাবার মতো,ছোট মেয়েদের সাথে মতো আর সমবয়সী মেয়েদের সাথে নিজের ভাইয়ের মতো আচরণ করা,শরীর ভেদে অপরাধীর শাস্তি দেয়া আর ব্যক্তিগত ক্রোধে অন্যকে কষ্ট না দেয়াই হলো ন্যায়পরায়ণতা। আর এ সীমা অতিক্রম করাটা হলো জুলুম।”

মুসান্নাফি গ্রন্থে যুহরীর বরাত দিয়ে আব্দুর রাজ্জাক লিখেছেন,“তিনি পাক করা খাবার খেলে অযু করে শুকরিয়া আদায় করতেন।”

ওহীব কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, উমর বিন আব্দুল আযীয বলেছেন,“যে কথাকে আমল হিসেবে গণ্য করে সে কম কথা বলে।”

যাহাবী বলেছেনঃ তার খিলাফতকালে ভাগ্যকে অস্বীকারকারী একটি দলের আবির্ভাব হলে তিনি তাদের তওবা করতে বললেন। তারা বললো,“আমরা পথভ্রষ্ট ছিলাম,আমাদের হিদায়াত করেছেন আপনি।” তিনি দুয়া করলেন,“হে আল্লাহ,যদি তাদের কথা সত্য হয় তবে ভালো,নতুবা তাদের হাত পা কেটে শুলে চড়িয়ে দিন।” তারা নিজেদের বিশ্বাসে অটল রইলো। পরবর্তীতে হিশাম বিন আব্দুল মালিক তখতে আসীন হয়ে তাদের হাত পা কেটে শুলে চড়ান।

বনূ উমাইয়্যার খলীফাগণ তাদের অভিভাষণে আলী (রাঃ) এর শানে ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি করতেন। উমর বিন আব্দুল আযীয কঠোরভাবে এ প্রথা নিষিদ্ধ করেন আর প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কাছে কটুক্তির পরিবর্তে তাদের অভিভাষণে এ আয়াত তিলাওয়াতের জন্য লিখিত ফরমান পাঠান –

إِنَّ اللَّـهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ وَالْبَغْيِ ۚ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ

“আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা,সদাচরণ আর আত্নীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ আর অবাধ্যতা করতে নিষেধ করেন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখো।” (সূরাহ আন-নাহল, ১৬ :৯০)

তিনি খলীফা হওয়ার আগে অনেক কবিতা রচনা করেন। তার বহু কাব্য ও চরণপূঞ্জ জনশ্রুতির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

সালাবা বলেছেন, “উমর বিন খাত্তাব (রাঃ), উসমান গনী (রাঃ), আলী (রাঃ), মারওয়ান বিন হাকাম আর উমর বিন আব্দুল আযীযের মাথায় চুল ছিল না।”

যুবায়ের বিন বাকার বলেছেনঃ এক কবি ফাতেমা বিনতে আব্দুল মালিকের শানে এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন – “আপনি খলীফার কন্যা,খলীফার ফুফু,খলীফাদের বোন আর খলীফার পত্নী।”

যুবায়ের বলেছেন,“উমর বিন আব্দুল আযীযের স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আব্দুল মালিকের পৃথিবীর আর কোন নারী এমন ছিলেন না।” গ্রন্থকার বলেন,“আমার যুগ পর্যন্ত এমন কাউকে দেখিনি।”

 

ইন্তেকাল

আইয়ুব বলেছেনঃ এক ব্যক্তি উমর বিন আব্দুল আযীযকে বললেন,“আপনি মদীনায় চলে আসলে সেখানে আপনার মৃত্যু হবে,তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে রওজা আতহারে চতুর্থ স্থানে আপনাকে সমাহিত করা হবে।” তিনি বললেন,“আল্লাহর কসম,সেখানকার হকদার মনে করাটাই হবে নিজের জন্য বড় শাস্তি।”

ওয়ালীদ বিন হিশাম বলেছেন,তিনি অসুস্থতার জন্য কোন ঔষধ সেবন করতেন না। তিনি বলেন,বিষ খাওয়ানোর সময় যদি আমাকে বলা হতো,আপনি নিজের কানের লতি স্পর্শ করুন,অথবা এ সুগন্ধীর ঘ্রাণ নিন,আর এটা হলো আপনার রোগের ঔষধ – তবুও আমি তা করতাম না।

উবায়েদ বিন হাসসান বলেছেন,মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তিনি সকলকে চলে যেতে বললেন। সকলেই চলে গেলেও শ্যালক মুসলিমা আর স্ত্রী ফাতেমা দরজায় বসে রইলেন। তারা শুনলেন যে, তিনি বলেছেন – “সুস্বাগতম,আল্লাহর নামে আসুন।” তারা বলেন,আগন্তুকগণ মানুষও নন,জীনও নন। এরপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন –

تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ

“এটা হলো আখিরাতের (চিরশান্তির) ঘর …” (সূরাহ আল-কাসাস, ২৮ :৮৩)

এরপর তিনি ইন্তেকাল করেন।

হিশাম বলেছেনঃ তার ইন্তিকালের সংবাদ শুনে হাসান বসরী বললেন,“পৃথিবীর সর্বোত্তম লোকটির ইন্তিকাল  হলো।”

খালিদ রবয়ী বলেছেনঃ আমি তৌরাত গ্রন্থে পড়েছি, উমর বিন আব্দুল আযীযের জন্য নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল চল্লিশ দিন কাঁদবে।

ইউসুফ বিন মালিক বলেছেনঃ আমরা তার কবরের মাটি সমান করার সময় আকাশ থেকে এক টুকরো কাগজ পড়ে, যাতে লিখা ছিল — “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে উমর বিন আব্দুল আযীযকে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ দেয়া হয়েছে।”

কাতাদা বলেছেনঃ উমর বিন আব্দুল আযীয খিলাফতের উত্তরাধিকারী ইয়াযিদ বিন আব্দুল মালিকের কাছে একটি পত্র লিখেন,পত্রটি নিম্নরূপ –

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম,

এ পত্র আল্লাহর বান্দা উমরের পক্ষ থেকে ইয়াযিদ বিন আব্দুল মালিকের প্রতি। তোমার উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হোক। আমি সেই প্রতিপালকের প্রশংসা করছি,যার কোন প্রতিপালক নেই। এরপর, আমি আজ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ চিঠি লিখছি। আমি জানি যে,দুনিয়া আর আখিরাতের মালিক কর্তৃক আমার খিলাফত সম্পর্কে আমি জিজ্ঞাসিত হবো। আর এমন কোন কাজ নেই যা তার অগোচরে করেছি। তিনি যদি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হোন, তবে সুখ ও কল্যাণের সন্ধান পাবো এবং অপমান ও অসম্মান থেকে মুক্তি পাবো। আর তিনি যদি রুষ্ট থাকেন, তবে আমি ধ্বংস ও বিধ্বস্ত হবো। আমি আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করছি – তিনি নিজ করুণা দিয়ে আমাকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি দিন আর আমার প্রতি দয়াপ্রবণ হয়ে জান্নাত দান করুন। তুমি আল্লাহকে ভয় করবে,প্রজাকুলের বশ্যতা মানবে আর আমার পর  অল্প কিছু দিন তুমি জীবিত থাকবে। (আবু নাঈম)

১০১ হিজরীর রযব মাসের বিশ অথবা পঁচিশ তারিখে ঊনচল্লিশ বছর ছয় মাস বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। বনূ উমাইয়্যা তাঁকে বিষ খাইয়ে শহীদ করে দেয়। তিনি অত্যাচারের মাধ্যমে অর্জিত সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে বনূ উমাইয়্যার উপর করারোপ করেছিলেন। তবে বিষয়টি সহজতর করার জন্য বাজেয়াপ্তকৃত সম্পদগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের উপরই ছিল।

মুজাহিদ বলেছেনঃ আমাকে ডেকে তিনি বললেন,“আমার সম্পর্কে লোকদের ধারণা কি ?” আমি বললাম, “আপনাকে জাদু করা হয়েছে।” তিনি বললেন,“না,এ কথা মিথ্যা। আমাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে, আর আমাকে যে সময় বিষ পান করানো হয়, সে সময় সম্পর্কেও আমি জানি।” তিনি তখনই গোলামকে (যে তাঁকে বিষ খাইয়েছিলো) ডেকে বললেন,“তোমার প্রতি আফসোস,তোমাকে এ কাজ করতে কে প্ররোচিত করেছে ? কেন আমাকে বিষ পান করালে ?” সে বললো,“আমাকে সহস্র দিনার দেয়া হয়েছে আর আযাদ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।” তিনি দিনারগুলো আনতে বললেন,এরপর সেগুলো নিয়ে তিনি বাইতুল মালে জমা করে দিয়ে গোলামকে বললেন,“এখান থেকে এমনভাবে পালিয়ে যাও যেন কেউ তোমাকে দেখতে না পায়।”

তার খিলাফতকালে যেসব ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেছেন তারা হলেন – আবু উমামা বিন সহল বিন হানীফ,খারেজা বিন যায়েদ বিন সাবেত,সালিম বিন আবুল জুআদ,বসর বিন সাঈদ,আবু উসমান নাহদী, আবুল যহা প্রমুখ।