হিশাম বিন আব্দুল মালিক আবুল ওলীদ ৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ভাই ইয়াযিদ বিন আব্দুল মালিকের পর খিলাফতের তখতে আসীন হন।
মুসআব যুবায়রী বলেছেন,“একদিন আব্দুল মালিক স্বপ্নে দেখেন, তিনি মসজিদের মিহরাবে চারবার প্রস্রাব করছেন। সাঈদ বিন মুসায়্যেবকে এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন – আপনার চার পুত্র বাদশাহ হবেন। আর হিশাম হলেন তাদের মধ্যে সর্বশেষ বাদশাহ।”
তিনি খুবই সচেতন আর জ্ঞানবান ব্যক্তি ছিলেন। সম্পদটি বৈধ পন্থায় উপার্জিত কিনা – এ বিষয়ে চল্লিশ সাক্ষী ছাড়া তিনি তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অন্তর্ভুক্ত করতেন না।
আসমায়ী বলেছেন,“আমি এক লোককে হিশামের সাথে বিতর্ক করতে দেখলাম। হিশাম তাঁকে বলছেন – ‘নিজের খলীফাকে এ কথা বলার জন্য তুমি উপযুক্ত নও।’ ”
একদিন এক ব্যক্তির প্রতি রেগে গিয়ে তিনি কসম করে বললেন, “তোমকে বেত্রাঘাত করতে আমার মন চাইছে।”
সাহবাল বিন মুহাম্মাদ বলেছেন, “খলীফাদের মধ্যে হিশাম অবৈধ রক্তপাত ঘটানোকে অধিক ঘৃণা করতেন।”
শাফী বলেছেনঃ সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত অবস্থায় তিনি তার নবনির্মিত প্রাসাদে একটি দিন অতিবাহিত করার অভিপ্রায় পোষণ করলেন। দুপুরে সীমান্ত এলাকা থেকে এক ভীতিপ্রদ সংবাদ এলে “এমন একটি ধনও পেলাম না”- এ মন্তব্য করে তিনি নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করলেন। উল্লেখ্য, তার এ কবিতা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উক্তি সংরক্ষিত নেই।
(কবিতার অর্থ) “কামনার দাসত্ব করতে না চাইলেও কামনার স্থল তোমাকে বিদ্ধ করবে।”
তিনি ১২৫ হিজরীর রবিউল আখির মাসে ইন্তেকাল করেন।
তার খিলাফতের সপ্তম বর্ষে রোম,অষ্টম বর্ষে হানজারা আর দশম বর্ষে হিরসানা হস্তগত হয়।
তার শাসনামলে সালেম বিন আব্দুল্লাহ বিন উমর,তাউস,সুলায়মান বিন ইয়াসার,ইবনে আব্বাসের গোলাম ইকরামা,কাসেম বিন মুহাম্মাদ বিন আবু বকর সিদ্দীক,সামরিক কবি কাসীর,মুহাম্মদ বিন কাব আল-কারযী,হাসান বসরী,মুহাম্মাদ বিন সিরীন,আবুল তোফায়েল,আমর বিন ওয়াসালা (তিনি সর্বশেষ সাহাবী হিসেবে সকলের পর ইন্তেকাল করেন),জারীর,ফিরজোক,মুআবিয়া বিন কিরতা,মাকহুল,আতার বিন আবু রিবাহ,আবু জাফর,ওহাব ইবনে মানবাহ,সাকীনা বিনতে হুসাইন,কাতাদা,ইবনে উমরের গোলাম নাফে, সিরিয়ার বিখ্যাত শিক্ষক ইবনে আমের,মক্কা শরীফের সম্মানিত শিক্ষক ইবনে কাসীর,সাবেত আল-বানানী, মালিক বিন দিনার,ইবনে মুহিস,ইবনে শিহাব যহরী প্রমুখ মণীষীগণ ইন্তেকাল করেন।
ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেনঃ ইবরাহীম বিন আবু আয়লা বলেছেন,“হিশাম আমাকে শহরের রাজস্ব আদায়ের প্রস্তাব দিলে আমি তা প্রত্যাখান করায় তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। আমার প্রতি রক্তিম চক্ষুদ্বয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘তোমার যা খুশি করবে।‘ আমি তৎক্ষণাৎ আর কোন উত্তর দিলাম না। ক্রোধ প্রশমিত হলে অনুমতি নিয়ে বললাম,‘আমিরুল মুমিনীন, আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে বলেছেন -আমি নভোমন্ডল,ভূমন্ডল আর পর্বতমালাকে নেতৃত্ব দানের নির্দেশ দিলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। এতে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি রুষ্ট,অসন্তুষ্ট (হোননি) আর তাদের উপর বল প্রয়োগও করেননি। আর আমি তা প্রত্যাখান করায় আপনি কেন আমার প্রতি বিরক্ত ও মনঃক্ষুণ্ণ হবেন ?” এ কথা শুনে তিনি হেসে উঠলেন আর আমাকে ক্ষমা করে দিলেন।
খালিদ বিন সাফওয়ান বলেছেনঃ একদিন আমি হিশামের অতিথি হলাম। তিনি আমার কাছে গল্প শুনতে চাইলেন। আমি বললাম,“এক বাদশাহ নগর ভ্রমণের সময় এক প্রাসাদের প্রতি আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘এটা কার ?’ বাদশাহর সহচরগণ বললেন,‘সুলতানের।’ তিনি আবার বললেন,‘আমার কাছে যতটুকু সম্পদ আছে, পৃথিবীর কোন বাদশাহর কাছে কোন সময় কি তা ছিল ?’ এক প্রাচীন যুগের বয়োঃবৃদ্ধ আলেমে দ্বীন বললেন,‘আগে আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিলে আমি এর জবাব দিবো।’ বাদশাহ বললেন,‘বলুন।’ তিনি বললেন,‘আপনার কাছে যে পরিমাণ সম্পদ আছে, তা কি আগের চেয়ে কমে যায়নি ? এ সম্পদ কি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নন ? আপনার স্থলাভিষিক্ত কি এ সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে না ?’ বাদশাহ বললেন,‘আপনার তিনটি প্রশ্নই যথার্থ।’ তিনি বললেন,‘এ সম্পদের মোহই আপনাকে অন্ধ করে দিয়েছে। যে সম্পদ ক্ষয়শীল,যে সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অন্যের হস্তগত হবে, আর যে সম্পদ ব্যয় করেছেন তার হিসাব হবে।’ এ কথা শুনে বাদশাহ শিহরিত হয়ে উঠলেন আর বললেন,‘আমি উত্তর পেয়ে গেছি।’ বৃদ্ধ আলেম বললেন,‘বাদশাহী করতে চাইলে আল্লাহ তাআলার অনুসরণ করুন, নাহলে তা বর্জন করতে হবে।’ বাদশাহ এ বিষয়ে সারা রাত চিন্তা-ভাবনা করে সকালে বললেন,‘আমি বাদশাহী ছেড়ে মরু বিয়াবানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,আপনি আমার সঙ্গে থাকলে খুশি হবো।’ এরপর তারা মৃত্যু অবধি এক পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান করেন।”
এই ঘটনা শুনে হিশাম এতই কাঁদলেন যে,তার চোখের পানি দ্বারা দাড়ি সিক্ত হয়ে গেলো। দুই ছেলেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে তিনি ঘরের এক কোণে বসে ইবাদত করতে লাগলেন। তিনি বাইরে যাতায়াত ছেড়ে দিলেন। খলীফার এ অবস্থা দেখে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ খালিদ বিন সাফওয়ানকে বললেন,“আপনি আমিরুল মুমিনীনকে এমন কি করলেন যার প্রভাবে তার বিলাসিতা বিদূরিত হয়েছে ?” খালিদ বিন সাফওয়ান বললেন,“আমি আল্লাহ তাআলার কাছে এ মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে,আমি কোন বাদশাহর কাছে গেলে তাঁকে আল্লাহর ভয়ের কথা মনে করিয়ে দিবো।”