আল-মানসুর আবু জাফর আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আলী বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস। তিনি ৯৫ হিজরীতে সালামা নামক বাঁদির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি দাদাকে দেখলেও তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেননি, বরং পিতা ও আতা বিন ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেন আর তার ছেলে মাহদীও তাদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
তার ভাইয়ের শাসনামলে লোকেরা খিলাফতের উত্তরাধিকার হিসেবে তাকে বাইআত দেয়।
তিনি আব্বাসীয় খলীফাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভীতিকর,সাহসী,দৃঢ় মেজাজের আর ধৈর্যশীল খলীফা হিসেবে পরিচিত। তিনি অঢেল সম্পদ জমা করার ক্ষেত্রে খুবই যত্নবান ছিলেন। তিনি খেলাধুলা,সাহিত্য ও আইনবিদ্যায় দক্ষ ছিলেন। তিনি অনেক বনী আদম হত্যা করার মধ্য দিয়ে নিজের একচ্ছত্র শাসনব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করেন। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বিচারকের পদ প্রত্যাখ্যান করায় তিনিই তাকে বন্দী করে অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠ নিক্ষেপ করেন আর সেখানেই তার ইন্তেকাল হয়। কারো মতে, ইমাম আবু হানীফা মানসুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ফতোয়া দেয়ায় তাকে বিষ পানে শহীদ করা হয়।
মানসুর স্পষ্টভাষী,কৃপণ ও লোভী ছিলেন। তিনি কর্মচারীদের থেকে এক পয়সার অষ্টমাংশেরও হিসাব নিতেন। কেউ কেউ বলেন,তিনি এক-অষ্টমাংশ পয়সার প্রবর্তন করায় তাকে আবুদ দাওয়ানীক উপাধি প্ৰদান করা হয়।
খতীব যহাক থেকে আর তিনি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“আমাদের মধ্যে সাফফাহ,মানসুর আর মাহদী।” যাহাবী বলেন,“এ হাদীসটি মুনকীর মুনকাতে।” খতীব আর ইবনে আসাকির ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেন,আমাদের মধ্যে সাফফাহ,মানসুর আর মাহদী। যাহাবী বলেন, এ হাদীসের সনদ সঠিক।
ইবনে আসাকির আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, “আমাদের মধ্যে কায়েম,মানসুর,মাহদী আর সাফফাহ। কায়েমের খিলাফত হবে রক্তপাতহীন, মানসুরের শাসন হবে কঠোর, সাফফাহ হবেন দানশীল আর মাহদী পৃথিবীতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন।”
খলীফা মানসুর বলেছেনঃ স্বপ্নে দেখলাম আমি হারাম শরীফে,আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা শরীফে। কাবা শরীফের দরজা খোলা। একজন নকীব “আব্দুল্লাহ কোথায়” বলে আওয়াজ দিলো। আমার ভাই আবুল আব্বাস (সাফফাহ) সিঁড়ি বেয়ে কাবা শরীফে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর কালো পতাকা বাঁধা বর্শা হাতে তিনি বেরিয়ে এলেন। এরপর আবার “আব্দুল্লাহ কোথায়” আওয়াজ শুনলাম। এবার আমি কাবা অভ্যন্তরে গিয়ে দেখলাম, সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম,আবু বকর সিদীক (রাঃ),উমর ফারুক (রাঃ) আর বিলাল (রাঃ) বসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছ থেকে ওয়াদা নেন,উম্মতের ব্যাপারে ওসীয়ত করেন,আমার মাথায় পাগড়ি বেঁধে দেন,যার প্রান্ত আমার গ্রীবা পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল। এরপর বললেন,“হে খলীফাদের পিতা, একে কিয়ামত পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাও।”
১৩৭ হিজরীর সূচনা লগ্নে মানসুর খিলাফতের মসনদে আসীন হয়ে সর্বপ্রথম আবু মুসলিম খুরাসানী যিনি সর্বপ্রথম বনূ আব্বাসের প্রতি লোকদের আহবান করেন আর আব্বাসীয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম নকীব তাকে হত্যা করেন।
১৩৮ হিজরীতে আব্দুর রহমান বিন মুআবিয়া বিন হিশাম বিন আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান স্পেন পদানত করেন আর চারশো বছর পর্যন্ত তার বংশধর স্পেন শাসন করেন। তিনি আলেম আর ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তার জননী বারবার বংশীয় মহিলা। এজন্য লোকেরা বলতো,ইসলামের রাজত্ব দুই বারবার মহিলার সন্তানদ্বয় মানসুর আর আব্দুর রহমানের মধ্যে বন্টন হয়ে গেছে।
১৪১ হিজরীতে মৃত্যুর পর দুনিয়ায় পুনর্গমনের বিশ্বাস নিয়ে একটি ভ্রান্ত দলের আবির্ভাব হলে তিনি তাদের হত্যা করেন। এ বছর তবরস্তান বিজিত হয়।
যাহাবী বলেছেনঃ ১৪৩ হিজরীতে মানসুর যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের সমবেত করে হাদীস,ফিকহ আর তাফসীর চর্চার প্রতি আহবান জানালে ইবনে জারীর মক্কায় হাদীসের কিতাব,মদীনায় ইমাম মালেক মুয়াত্তা নামক কিতাব,ইমাম আওযায়ী সিরিয়ায়,হাম্মাদ বিন সালামা বসরায়,মুআম্মার ইয়ামানে,সুফিয়ান সাওরী কুফায়,ইবনে ইসহাক মাগাযী,ইমাম আযম আবু হানীফা ফিকহ ও কিয়াস নিয়ে বিশাল গবেষণা লব্ধ ও প্রনিধানযোগ্য গ্রন্থাদি রচনা করেন। এর কিছুদিন পর হাশিম,লায়স ইবনে লাহীআ,ইবনে মুবারাক,ইমাম আবু ইউসুফ,ইবনে ওহাব প্রমুখ প্রচুর সৃজনশীল রচনা সৃষ্টি করেন। অল্প দিনের মধ্যেই আরবী অভিধান,ইতিহাস,রাবীদের বর্ণনা,সীরাত ইত্যাদি বিষয়ের উপর লিখিত বই-এর ভাণ্ডার গড়ে উঠে। এর আগে ইমাম আর ওলামাগণ মুখস্থ পড়িয়ে ছাত্রদের মুখস্থ করিয়ে দিতেন, তবে কিছু কিছু লোকদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ের পুস্তিকা ছিল।
১৪৫ হিজরীতে মুহাম্মাদ,ইবরাহীম আর আব্দুল্লাহ বিন হাসান বিন আবু তালিবের গোটা পরিবার মানসুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তিনি দুই ভাইকে (মুহাম্মাদ আর ইবরাহীম) পরাজিত করে হত্যা করেন। তাদের সাথে অনেক আহলে বাইতকেও শহীদ করে দেওয়া হয়। এটা ছিল প্রথম বিশৃঙ্খলা, যা বনু আব্বাস আর আলেমদের মধ্যে সংঘটিত হয়। এর আগে উভয়ে এক ও অভিন্ন ছিল।
এরপর মানসুর মুহাম্মাদ আর ইবরাহীমকে যারা সঙ্গ দিয়েছেন অথবা সঙ্গ দেওয়ার পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন, সে সব আলেমদের কাউকে হত্যা,আবার কাউকে ভীষণ প্রহার করেন। এসব আলেমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – ইমাম আবু হানিফা (রহঃ),আব্দুল হামীদ বিন জাফর (রহঃ),ইবনে আজলান (রহঃ),ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ) প্রমুখ। লোকেরা ইমাম মালেক বিন আনাসকে বলেছিলো,“আমরা যেখানে মানসুরের বাইআতের অধীনে, সেখানে কিভাবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবো ?” ইমাম মালেক বলেছিলেন,“তোমরা স্বেচ্ছায় বাইআত করোনি,বলপূর্বক করানো হয়েছে, তাই এ বাইআত কার্যকরী নয়।”
১৪৬ হিজরীতে কবরসের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
১৪৭ হিজরীতে মানসুর তার চাচা ঈসা বিন মূসা,যাকে সাফফাহ মানসুরের পর খিলাফতের উত্তরাধিকার মনোনীত করেছিলেন, তিনি তাকে বাদ দিয়ে পুত্ৰ মাহদীকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। অথচ ঈসা বিন মূসা মানসুরের পক্ষ হয়ে ইবরাহীমের সাথে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনেন। আর তিনি তার সাথে এ আচরণ করেন।
১৪৮ হিজরীতে স্পেন ছাড়া গোটা সাম্রাজ্য মানসুরের পদানত হয় আর তার ভয়ে কাঁপতে থাকে। তখন স্পেনে আমিরুল মুমিনীনের পরিবর্তে শুধু আমীর উপাধি ধারণ করে উমাইয়া বংশীয় আব্দুর রহমান বিন মুআবিয়া খুবই প্ৰতাপের সাথে শাসঙ্কার্য পরিচালনা করছিলেন,পরবর্তীতে তার ছেলেরাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে।
১৪৯ হিজরীতে বাগদাদ নগরী পুনর্গঠনের কাজ সুসম্পন্ন হয়।
১৫০ হিজরীতে খুরাসানের সৈন্যরা আসনাদসীসের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে খুরাসানের অধিকাংশ জনপদ দখল করে নিলে মানসুর চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি তিন লাখ পদাতিক আর অশ্বারোহী সৈনিকের এক সুবিশাল বাহিনী পাঠান। আজছাম নামক মানসুরের বিশেষ এলিট বাহিনী প্ৰাণপণে লড়াই করেও এলিট বাহিনীসহ অনেক সাধারণ সৈনিক নিহত হয়। মানসুর এ সংবাদ পেয়ে হাযেম বিন খুযাইমাকে সিপাহসালার করে তার নেতৃত্বে আবার তিনি এক লাখ সৈন্য পাঠান। উন্মুক্ত ময়দানে লড়াই শুরু হয়। আফ্রিকানরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতে থাকে। এ যুদ্ধে সত্তর হাজার প্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অবশেষে আসনাদসীস পরাজিত হয়ে স্বসৈন্যে এক পাহাড়ে আত্মগোপন করে। হাযেম তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে চৌদ্দ হাজার সৈন্য বন্দী করে আর এক বছর পর তাদের সকলকে হত্যা করা হয়। আসনাদসীস দীর্ঘদিন এক দুর্গে অবরুদ্ধ থাকার পর তার পিতাসহ ত্রিশ হাজার সৈন্য মানসুরের হাতে তুলে দেয়। তবে সিপাহসালার তাকে বন্দী করে সকলকে আযাদ করে দেয়।
১৫১ হিজরীতে রিসাফা শহরকে চুনা-পাথর দিয়ে দেয়াল তৈরির মাধ্যমে সুরক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়।
১৫৩ হিজরীতে বাঁশ আর পাতা দ্বারা তৈরি উঁচু এক ধরনের বিশেষ টুপি ব্যবহারের আদেশ জারি করেন।
১৫৭ হিজরীতে মানসুর সুফিয়ান ছাওরী আর উবাদা বিন কাসীরকে বন্দী করার জন্য মক্কার গভর্ণরকে নির্দেশ দেন। তিনি তাদের বন্দী করেন। তাদেরকে হত্যার আশঙ্কায় জনতা ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। এমন সময় হাজ্জের মৌসুম সমাগত হয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাকে সুস্থ সবল হয়ে মক্কায় পৌছাননি। তিনি অসুস্থ হয়ে মক্কায় আসেন আর সেখানেই মারা যান। তিনি যিলহজ মাসে বতন অঞ্চলে ইন্তেকাল করেন আর তাকে হুজুন ও বিরে মাইমুনের মধ্যবর্তী স্থানে দাফন করা হয়।
তার মৃত্যুকে উপজীব্য করে কবি সালিম বলেছেন,“মুহাম্মাদের পুত্রকে কবরের অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্তে রেখে হাজীগণ ফিরে আসেন। তাকে মক্কায় বন্ধক রাখা হয়েছে। লোকেরা আসবে,হাজ্জ পালন করবে আর জানোবে, তাদের নেতা ইহরাম অবস্থায় পাথরের নিচে শুয়ে আছে।”
ইবনে আসাকির স্বরচিত ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেনঃ মানসুর খিলাফত লাভের পূর্বে শিক্ষা অর্জনের জন্য সফর করছিলেন । এক মনজিলে গিয়ে থামলে এক চৌকিদার বললো,“দুই দিরহাম না দিলে আমি এখানে থাকতে দিবো না।” মানসুর বললেন,“আমাকে ক্ষমা করুন, আমি বনু হাশিমের সন্তান।” সে বললো,“দুই দিরহাম দিলে থাকতে পারবেন।” তিনি বললেন,“আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচার বংশধর।” চৌকিদার নিজের কথায় অনঢ়। তিনি বললেন, আমি কুরআনের ক্বারী। চৌকিদারের দু’দিরহাম চাই। তিনি বললেন,“আমি ফকীহ, আর ইলমুল ফারায়েজ সম্পর্কে জ্ঞান রাখি।” কিন্তু সে কিছুতেই তার কথা না মানায় তিনি অপারক হয়ে তার হাতে দুই দিরহাম তুলে দিলেন। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে সম্পদ জমার প্রতি একনিষ্ঠভাবে ঝুঁকে পড়েন।
রাবে বিন ইউনুস হাজিব বলেছেন যে,মানসুর বলেছেন,“খলীফা চার জন – আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ),উমর ফারুক (রাঃ),উসমান গনী (রাঃ) আর আলী (রাঃ)। আর বাদশাহ চার জন – মুআবিয়া (রাঃ),আব্দুল মালিক,হিশাম আর আমি।”
মালিক বিন আনাস বলেছেনঃ একদিন মানসুর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কে সর্বশ্রেষ্ঠ ?” আমি বললাম,“আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আর উমর ফারুক (রাঃ)।” মানসুর বললেন,“সত্য বলেছেন, আমারও অভিমত সেটাই।”
ইসমাঈল ফিহরী বলেছেনঃ মানসুর আরাফাতের দিন মিম্বরে দাঁড়িয়ে এ ভাষণ প্ৰদান করেন – উপস্থিতি, আল্লাহ তাআলা প্ৰজাবৃন্দকে সতৰ্ক করার জন্য আমাকে বাদশাহ বানিয়েছেন। তিনি দান করার জন্য আমাকে ধনগার দিয়েছেন। জনমণ্ডলী, পবিত্রতম এই আরাফার দিনে তোমরা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করো। তিনি এই দিনে পবিত্র কুরআন মাজীদে তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন –
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম,তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম আর ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (সুরাহ আল-মাইদাহ, ৫ :৩)
তোমরা তার কাছে এই প্রার্থনা করো – হে আল্লাহ, আমাদেরকে হিদায়েতের পথ নির্দেশ করুন। তোমাদের সাথে তিনি আমাকেও নমনীয়তা, করুণা আর দান করার শিক্ষা দিন।”
সূলী বলেছেন,“লোকেরা তাকে কৃপণ ভাবতো বলে তিনি তার এ ভাষণের শেষাংশের কথাগুলো বলেন।”
আসমায়ী বলেছেনঃ একদিন মানসুর মিম্বরে দাঁড়িয়ে –
الحمد لله احمده ونستعينه واومن به اتو كل عليه واشهد ان لا اله الا الله وحده لا شريك له
– এ পর্যন্ত বলেছেন, এমন সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো,“আমিরুল মুমিনীন, বলুন আপনি কে ?” মানসুর তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,“স্বাগতম! তুমি মূল্যবান কথা বলেছো। আল্লাহর শুকরিয়া, আমি তাদের মধ্যে নই – আল্লাহর ভয় প্রদর্শন করার পরও (যে) অধিক হারে পাপ কাজে লিপ্ত হয়। আমাদের ঘর থেকেই ওয়ায-নসীহত শুরু হয়েছে। হে প্রশ্নকারী, আল্লাহর কসম। তোমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য ভালো নয়। প্রসিদ্ধতা অর্জনের জন্য তা বলেছো। আমি তোমাকে ক্ষমা করছি। জনতা, এ ধরণের লোক থেকে তোমরা দূরে থাকো।” অতঃপর তিনি মূল খুৎবা যেখান থেকে ছেড়েছিলেন, সেখান থেকে আবার শুরু করেন। তিনি কাগজে লিখিত খুতবা পাঠ করতেন।
বর্ণিত রয়েছেঃ মানসুর তার ছেলে মাহদীকে এই বলে উপদেশ দেন – “হে আবু আব্দুল্লাহ, খলীফাকে পরহেযগারী আর বাদশাহকে ফরমাবরদারী ঠিক রাখতে হয়। কোন প্ৰজা ইনসাফ ছাড়া আনুগত্য করবে না। যে ক্ষমাশীল, সে-ই সর্বশ্ৰেষ্ঠ ব্যক্তি। আর যে দুর্বলের উপর অত্যাচার করে, সে নির্বোধ। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া কোন কাজ করবে না । কারণ মননশীলতা মানুষের দর্পণ। এ দর্পণে নিজ নিজ কাজের ভুলগুলো ধরা যায়। বাবা, সবসময় নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করবে। ক্ষমাপরায়ণ হবে। দয়ার্দ্রতার মধ্য দিয়ে শাসন করবে। মনে রাখবে,বিজয় অর্জনের পর সর্বদা নমনীয়তা ও দয়ার্দ্রতা প্রদর্শন করবে।”
মুবারক বিন ফুযালা বলেছেনঃ একদিন আমি মানসুরের কাছে বসেছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। আমি বললাম,“আমীরুল মুমিনীন, আমি হাসান (রাঃ) থেকে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন – কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একজন আহবানকারী এ বলে আওয়াজ দিবে – ‘যার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তাআলা প্ৰদান করবেন তিনি দাঁড়াবেন,এছাড়া অন্য কেউ দাঁড়াতে পারবেন না।’ তখন সে-ই দাঁড়াবে, যে ক্ষমা করতো।” এ কথা শুনে মানসুর বললেন,তাকে ছেড়ে দাও।
আসমায়ী বলেছেনঃ মানসুর এক অপরাধীকে শাস্তি দেবার জন্য ডেকে আনলে সে বললো,“আমিরুল মুমিনীন, প্রতিশোধ গ্রহণ করা ইনসাফ, কিন্তু ক্ষমা করা মহৎ গুণ। আমি আল্লাহ্ তাআলার কাছে আমিরুল মুমিনীনের জন্য দুআ করবো, তিনি তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।” এ কথা শুনে তিনি তার ক্ষমা পত্রে স্বাক্ষর করেন।
আসমায়ী বলেছেনঃ একবার মানসুর শাম দেশে গিয়ে এক গেঁয়ো লোককে বললেন,“আল্লাহর শোকর,আমার রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে তিনি তোমাদের উপর থেকে প্লেগ রোগ তুলে নিয়েছেন।” গেঁয়ো লোকটি বললো,“আপনার শাসন আর প্লেগ রোগ দুটোই সমান। আল্লাহর শোকর,তিনি উভয়টি আমাদের উপর চাপিয়ে দেননি।”
মুহাম্মদ বিন মানসুর বাগদাদী বলেছেনঃ এক সাধক ব্যক্তি মানসুরের কাছে এসে নসীহত করে বললেন,“আল্লাহ তাআলা আপনাকে সকল নেয়ামত দান করেছেন। আপনি তা দিয়ে আখিরাতে নিজের শান্তির জন্য কিছু কিনুন। আপনি সেই রাতের কথা মনে করুন,যে রাত কবর জীবনের প্রথম রাত হবে; আর সেই দিনের কথা ভেবে দেখুন, যার পর আর কোনো রাত হবে না।” এ কথা শুনে মানসুর তাকে অর্থকড়ি দেবার নির্দেশ দিয়ে নীরব হয়ে গেলেন। সাধক বললেন,“আমি আপনার অর্থ-কড়ির আশা করলে আপনাকে নসীহত করার সওয়াব পেতে পারি না।”
আব্দুস সালাম বিন হরব বলেছেনঃ একদিন মানসুর আমর বিন উবায়েদকে ডেকে এনে তার সামনে অনেক সম্পদ পেশ করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করায় মানসুর বললেন,“আল্লাহর কসম,তোমাকে তা গ্রহণ করতেই হবে।” তিনি বললেন,“আল্লাহর কসম,আমি তা কখনই ছুঁবো না।” মাহদী আমরকে বললেন, “আমিরুল মুমিনীন তো কসম করেছেন।” তিনি বললেন,“আমিরুল মুমিনীনের কাফফারাহ আদায় করা আমার চেয়ে বেশী সহজ।” মানসুর বললেন, “আপনি জানেন যে,আমি মাহদীকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেছি।” তিনি বললেন,“মৃত্যুর সময় আপনি অন্যের বিষয় নিয়ে চিন্তিত! আপনার স্মরণ নেই তখন তিনি হবেন শাসনকর্তা।”
আব্দুল্লাহ বিন সালিম বলেছেনঃ বসরার বিচারপতি সাওয়ার বিন আব্দুল্লাহকে এ মর্মে পত্র লিখলেন – “জমিজমা নিয়ে বিরোধ সংক্রান্ত যে মামলা আপনার কাছে আছে, তা ব্যবসায়ীর পক্ষে রায় দিবেন।” জবাবে বিচারপতি মানসুরকে সাফ জানিয়ে দিলেন – “আল্লাহর কসম,আমি ইনসাফের বিপক্ষে রায় দিবো না।” মানসুর আবার নির্দেশ দেওয়ার পর তিনি একই জবাব দিলে মানসুর বললেন,“আল্লাহর কসম,আমি পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। আমার নিয়োগকৃত বিচারপতি আদালতে সত্যের পক্ষে লড়তে গিয়ে আমার বিরোধীতা করতে পারেন।”
কথিত আছে,এক ব্যক্তি কর্তৃক বিচারপতি সওয়ারকে তলব করে বাদী-বিবাদীর সামনে মানসুর হাঁচি দিলেন। বিচারপতি এর জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ না বলায় তিনি কারণ জানোতে চাইলে সওয়ার বললেন,“আপনি আলহামদুলিল্লাহ বলেননি।” মানসুর বললেন,“মনে মনে বলেছি।” তিনি বললেন,“আমিও মনে মনে বলেছি।” মানসুর বললেন, “আপনি যেহেতু আমার পক্ষপাতিত্ব করলেন না,সেহেতু আমার বিশ্বাস, আপনি অন্যায়ভাবে কারো পক্ষ নিতে পারেন না। তাই আপনি নিজ পদে ফিরে যান।”
নামীর মাদয়ী বলেছেনঃ একদিন মানসুর মদীনায় এলে কিছু উষ্ট্রিচালক মানসুরের বিরুদ্ধে মদীনার বিচারপতি মুহাম্মাদ বিন ইমরানের কাছে কোনো এক বিষয়ে অভিযোগ করলো। আমি সে সময় বিচারপতি মুহাম্মাদ বিন ইমরানের নিয়োগ করা কেরানী। তিনি খলীফার বিরুদ্ধে আমাকে সমান জারি করার নির্দেশ দিলেন। আমি নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে দিলাম। তিনি আবার তাকিদ দিলেন। অবশেষে আমি অভিযোগলিপি লিখে তাতে মোহর লাগিয়ে দিলাম। এরপর বিচারপতি এ পত্র নিয়ে যেতে বললেন। আমি তা নিয়ে মন্ত্রী রবীর কাছে গেলাম। তিনি খলীফার কাছে গিয়ে তাকে বিষয়টি জানালেন। তার কাছ থেকে ফিরে এসে রবী বললেন,আমিরুল মুমিনীন বলেছেন,আমাকে আদালতে ডাকা হয়েছে,আমার সাথে কেউ যেতে পারবে না। অবশেষে মানসুর আর রবী উভয়ে আদালতে এলেন। খলীফার সম্মানার্থে আমাদের কেউ দাড়ালো না। বিচারপতি চাদর পড়ে নিজ আসনে বসলেন। বিচারের বাদী পক্ষকে ডাকা হলো। উভয়ের বক্তব্য শোনার পর বিচারপতি খলীফার বিরুদ্ধে রায় দিলেন। বিচার কাজ শেষে মানসুর বললেন,“আল্লাহ তাআলা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। এ ইনসাফপূর্ণ বিচারের জন্য আমি আপনাকে দশ হাজার দিনার প্রদান করছি।”
মুহাম্মাদ বিন হাফয আল-আজলী বলেছেনঃ আবু দালামার পুত্র সন্তান হলে তিনি এ খবর মানসুরকে জানানোর পর এ কবিতা আবৃত্তি করলেন – “অলৌকিকতা আর বুযর্গীর কারণে কেউ যদি সূর্যে গিয়ে উপবেসন করেন, হে আব্বাস সন্তান সেটা আপনি; কারণ আপনিই লোকদের মধ্যে সর্বশ্ৰেষ্ঠ।” এ বলে আবু দালামা একটি থলি বের করে মানসুরের সামনে রাখলেন। মানসুর বললেন,“এটা কি ?” আবু দালামা বললেন,“আপনি যা দিতেন, আমি এর মধ্যে আপনাকে তাই দিয়েছি।” এরপর মানসুর থলিটি ভরে দিরহাম দিতে বলেন। বস্তুত সেই থলিতে আরো দুই হাজার দিরহাম ধরেছিলো।
মুহাম্মদ বিন সালাম জামহী বলেছেনঃ এক ব্যক্তি মানসুরকে জিজ্ঞেস করলো,“আপনার কোনো আশা অপূর্ণ রয়েছে কি ?” তিনি বললেন,“একটি আকাঙ্ক্ষা বাকী রয়ে গেছে। আর তা হলো,আমি এক চত্বরে বসে থাকবো,আর আমাকে ঘিরে বসবে আসহাবে হাদীসের একটি দল।” রাবী বলেন,আল্লাহ্ তাআলা তার প্রতি রহম করুন। এরপর তিনি অন্যান্য আলোচনা করলেন। পরদিন মন্ত্রীদের ছেলেরা তার কাছে এসে বললো,“নিন,আপনার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করুন।” মানসুর বললেন,“এরা তো সেই লোক নয় (যারা হাদীসের চর্চা করবে), তাদের পোশাক হবে ময়লা আর বেহাল অবস্থা। তাদের পদযুগল হবে নগ্ন, মাথার চুল হবে লম্বা,তারা হবেন মুসাফির; আর তারাই হাদীস নকলের কাজ করবেন।”
আব্দুস সামাদ বিন আলী মানসুরকে বললেন, “আপনি এমনভাবে শাস্তি দেন যে,মনে হয় ক্ষমা শব্দটি কখনোই আপনি শোনেননি।” মানসুর বললেন,“বনূ মারওয়ানের রক্ত এখনও শুকায়নি আর আবু তালিব পরিবারের তলোয়ারগুলো এখনও খাপবদ্ধ হয়নি। আমরা এখন পর্যন্ত ঐ জাতির মধ্যে বসবাস করছি,তারা কিছুদিন আগে আমাদেরকে বাজারে ঘুরতে দেখেছে, অথচ আজ খলীফা হিসেবে দেখছে। এখনও আমাদের দাপট লোকদের অন্তরে বসেনি। লোকেরা যেন আমাদের ক্ষমার কথা ভুলে না যায় আর সর্বদা যেন শাস্তির জন্য প্রস্তুত না থাকে।”
ইউনুস বিন হাবীব বলেছেনঃ একবার যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহ হারেসী সাহিত্যরসে সিক্ত আর পণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষায় নিজের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য মানসুরের নিকট চিঠি লিখলেন। জবাবে মানসুর লিখলেন,“ভাষার অলংকার আর অহংকার একত্রিত হলে সেই লোকের মধ্যে গর্ব ফুটে উঠে। আমিরুল মুমিনীন তোমার ব্যাপারে এ আশঙ্কাই করছেন। তুমি এ অহংকার মিশ্ৰিত ভাষা বর্জন করো।”
মুহাম্মাদ বিন সালাম বলেছেনঃ একদিন মানসুরকে তালিযুক্ত পোশাক পরতে দেখে এক বাঁদি বললো,“ইনি খলীফা, কিন্তু পোশাক তা প্রমাণ করে না।” মনসুর বললেন,“আফসোস! তুমি কি ইবনে হরামার এ কবিতা শুনোনি – ‘পুরনো চাদর আর তালিযুক্ত পোশাক পরিহিতরাও মর্যাদার অধিকারী হতে পারেন।’ ”
আসাকেরী ‘আওয়ায়েল’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ উমাইয়া বংশের আব্দুল মালিকের মতো আব্বাসীয় বংশের মানসুর ছিলেন কৃপণ। এক ব্যক্তি তাকে তালি দেওয়া পোশাক পড়তে দেখে বললো,আল্লাহ্ তাআলার কুদরত, তিনি মানসুরের রাজত্বকে দরিদ্রতার সাথে সংযুক্ত করেছেন। এ বিষয়ে মুসলিম আল-হাদী একটি গান গাইলো। তিনি পাশেই ছিলেন। তিনি এ গান শুনে আনন্দিত হয়ে ঘোড়া থেকে নেমে তাকে অর্ধেক দিরহাম বখশিশ দিলেন। মুসলিম আল-হাদী বললো, “আমার গান শুনে হিশাম দশ হাজার দিরহাম পুরস্কার দিয়েছিলেন।” মানসুর বললেন,“এ ব্যাপারে বাইতুল মালের অর্থ খরচ করা জায়েয নেই। তবে কেউ যদি শর্ত করে, সে কথা ভিন্ন।”
আসাকেরী ‘আওয়ায়েল’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ ইবনে হারামা মদ পান করতো। একবার সে মানসুরের কাছে এসে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলো – “তার দৃষ্টি তখতের আশেপাশে নিবদ্ধ, যেখানে শাস্তি ও পুরস্কার উভয়টাই রয়েছে। তখত যাকে নিরাপত্তা দেয়, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও সে নিরাপত্তা পায়; আর যাকে ধ্বংস করে, তার মা কেঁদে ফেরে।” এ কবিতা শুনে মানসুর খুশি হয়ে বললেন,“তুমি কি চাও ?” হারামা বললো,“আপনি মদীনার শাসনকর্তাকে লিখে পাঠান,তিনি আমাকে নেশাগ্ৰস্ত অবস্থায় দেখলে আমার প্রতি যেন হদ জারি (আশি বেত্ৰাঘাত) না করেন।” তিনি বললেন,“আমি কিছুতেই শরীয়তের সীমারেখা অতিক্রম করতে পারবো না।” সে বললো,“তাহলে আমার জন্য বিকল্প একটা কিছু করুন।” মানসুর মদীনার শাসনকর্তকে লিখলেন,“যে ইবনে হারামাকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ধরে আনবে, তাকে একশো বেত্রাঘাত আর ইবনে হারামাকে আশি বেত্ৰাঘাত করবেন।” এ নির্দেশ পাওয়ার পর মদীনার শাসনকর্তা যদি নিজেও নেশায় বুদ হতে দেখতেন,তাহলে তাকে এ বলে ছেড়ে দিতেন,“আশি বোত্রাঘাত লাগানোর জন্য কে একশো বেত্ৰাঘাত খাবে।” মানসুর একবার তার কবিতা শুনে খুশি হয়ে তাকে দশ হাজার দিরহাম দিয়ে বললেন,“হে ইবরাহীম, (ইবনে হারামা) একে সাবধানতার সাথে খরচ করবে। তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে আর কিছু নেই।” ইবনে হারামা বললো,“আমি এগুলো শক্ত মোহর দিয়ে এঁটে রাখবো আর তা পুলসিরাত পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবো।”
মানসুর অনেক কবিতা আবৃত্তি করেছেন। তন্মধ্যে দুটি চরণ এমন – “তুমি জ্ঞানী হলে নিজের ইচ্ছাশক্তিকে প্রবলভাবে শক্ত করবে, কারণ ভঙ্গুর ইচ্ছাশক্তি মানুষকে দোদুল্যতায় নিক্ষেপ করে। শত্রু পক্ষের উপর বিজয় অর্জনের পর তাদেরকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিবে না।”
আব্দুর রহমান বিন যিয়াদ বিন ইনআম আফ্ৰিকী বলেছেনঃ আমি মানসুরের সাথে পড়ালেখা করেছি,একবার তিনি আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন আর আমার জন্য খাবার এলো,যার মধ্যে গোশত ছিল না। মানসুর সেবিকাকে বললেন,“মিষ্টি নেই ?” সে বললো,“না।” তিনি বললেন,“খেজুর নেই ?” সে বললো,“না।” এ কথা শুনে তিনি শুয়ে গেলেন আর এ আয়াত পাঠ করলেন –
عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يُهْلِكَ عَدُوَّكُمْ
মানসুর খিলাফত পাওয়ার পর আমি তার কাছে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,“উমাইয়া বংশের মোকাবিলায় আমাদের রাজত্ব কেমন ?” আমি বললাম,“কোনো বাদশাহ’র যুগে এত অত্যাচার হয়নি,যা এখন হচ্ছে।” মানসুর বললেন,“আমি কোনো সাহায্যকারী পাইনি।” আমি বললাম,“উমর বিন আব্দুল আযীয বলেছেন,বাদশাহকে বাজারের সাথে উপমা দেয়া যায়। বাজারে সর্বাধিক বিক্রিত দ্রব্যাদিই আমদানি হয়। বাদশাহ দানশীল আর সাধক হলে তার কাছে এমন লোকরাই আসবে, আর বাদশাহ বদকার ও পাপাচারী হলে এমন লোকেরই সঙ্গ মিলবে।” এ কথা শুনে মানসুর মাথা নিচু করে ফেলেন।
মানসুরের বাণী হলঃ তিনটি বিষয় ছাড়া বাদশাহগণ সকল কথা শুনতে রাজি। এক – গোপন তথ্য ফাঁস না করা; দুই – হারাম কাজে বাধা প্ৰদান; এবং তিন – সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়া। সূলী আরেকটি সংযোজন করেছেন – শক্রর হাত প্রসারিত করলে হাত কেটে ফেলবে।
ইসহাক মসূলী বৰ্ণনা করেছেনঃ খাবার-দাবার ইত্যাদির সময় মানসুর নিজ সাথীদের সাথে একত্রে বসতেন না। উভয়ের মাঝে বিশ গজের একটি পর্দা ঝোলানো থাকতো। এ পর্দা থেকে উভয়ে বিশ গজ দূরত্বে বসতেন। আব্বাসীয় খলীফাদের মধ্যে মাহদী সর্বপ্রথম সার্থীদের সাথে একত্রে বসতেন।
সূলী বলেছেনঃ একদিন মাছি মানসুরকে খুব বিরক্ত করলে তিনি মুকাবিন বিন সুলায়মানকে ডেকে মাছি সৃষ্টির রহস্য জানোতে চাইলে তিনি বলেন,“মাছিরা অত্যাচারীদের অপমানিত করে।”
মুহাম্মাদ বিন আলী খুরাসানী বলেছেনঃ খলীফা মানসুর সর্বপ্রথম কবিদের সভাসদ হিসেবে নিয়োগ করেন আর তাদের পরামর্শে কাজ করেন। তিনি সর্বপ্রথম অনারব সুরিয়ানী ভাষায় আরবী গ্রন্থাদি অনুবাদ করেন। মানসুর সর্বপ্রথম অনারব লোকদের আহলে আরবদের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। এভাবে একদিন আসে, যখন আরবের লোকদের জন্য শাসনকর্তা হওয়ার দরজা বন্ধ হয়ে যায় আর তাদের নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়।
মানসুর কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহঃ
সূলী বলেছেনঃ মানসুর তৎকালীন যুগের সবচেয়ে বড় মুহাদ্দিস আর বংশ তালিকা মুখস্থের দিক দিয়ে প্রথিতযশা পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।
ইবনে আসাকির ‘তারিখে দামেশক’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ খলীফা মানসুর তার বাবা,তার দাদা আর ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন,“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডান হাতে আংটি পড়তেন।”
সূলী মানসুরের বরাত দিয়ে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“আমার আহলে বাইত নূহ (আঃ) এর কিশতীর মতো। যারা এতে আরোহণ করবে তারা পরিত্রাণ পাবে, আর যারা দাঁড়িয়ে থাকবে (আরোহণ করবে না) তারা ধ্বংস হবে।”
মানসুর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“আমি যখন কাউকে আমীর বানিয়ে তার জন্য মাসিক ভাতা নির্ধারণ করে দিবো,যদি সে এর চেয়ে বেশী নেয়, তবে সে আত্মসাৎকারী।” (সূলী)
ইয়াহইয়া বিন হামযা হাযরামী বলেছেনঃ আমি আমার পিতার কাছ থেকে জেনেছি যে,খলীফা মাহদী তাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর বলেন,নির্দেশ বাস্তবায়নে কঠোরতা অবলম্বন করবে না। কারণ আমার পিতা মানসুরের কাছে জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে,আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “আমার সম্মান ও মর্যাদার কসম, আমি জালেমের থেকে দুনিয়া ও আখিরাতে প্রতিশোধ নিবো। মজলুমকে দেখেও যারা সাধ্যমত সাহায্য করে না, তাদেরও বদলা নিবো।” (সূলী)
সুলী আবু ইসহাকের বরাত দিয়ে মানসুর থেকে বর্ণনা করেছেন যে,আলী (রাঃ) বলেছেন,“চাঁদের শেষ তিন তারিখে ভ্ৰমণ করবে না।”
মানসুরের শাসনামলে বর্ণিত ওলামাগণ পরলোক গমন করেন – ইবনে মুকফাআ,সুহায়েল বিন আবু সালিহ,আলা বিন আব্দুর রহমান,মিসরের আইনবিদ খালিদ বিন ইয়াযিদ,দাউদ বিন আবু হিন্দ,আবু হাযিম,সালামা বিন দিনার আল-আরাজ,খাত্তা বিন আবু মুসলিম খুরাসানী,ইউনুস বিন উবায়েদ,সুলায়মান আল-আহওয়াল,বিখ্যাত মাগাযী গ্রন্থের লেখক মূসা বিন উকবা,আমর বিন উবায়েদ মুতাযালী, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আনসারী কালবী,ইবনে ইসহাক,জাফর বিন মুহাম্মাদ সাদেক আমাশ,শবল বিন উবাদা মাকরী মক্কা,মদীনার আইনবিদ মুহাম্মাদ বিন আজলান,মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান বিন আবু লায়লা,ইবনে জারীর,ইমামে আযম আবু হানিফা,হাজ্জাজ বিন আরতাত,হাম্মাদ,রুবা শায়ের হায়েরী,সুলায়মান তামীমী,আসেম আল আহওয়াল,ইবনে শাবারামা আল-যবী,মোতেল বিন হাইয়ান,মুকাতিল বিন সুলায়মান,হিশাম বিন উরওয়া,আবু আমর বিন আলা, হামযা বিন হাবীব প্রমুখ।