আবু জাফর হারুন রশীদ বিন মাহদী মুহাম্মাদ বিন মানসুর আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আলী বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস। তার পিতা মাহদী হাদীর পর তাকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। ভাইয়ের পর ১৭০ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ১৬ তারিখ শনিবার রাতে খিলাফতের তখতে আরোহণ করেন।
সূলী বলেছেন,“সে রাতেই হারুন রশীদের পুত্র আব্দুল্লাহ মামুন ভূমিষ্ঠ হোন। একই রাতে এক খলীফার মৃত্যু,অন্যজনের সিংহাসনে আরোহণ ও আরেক জনের জন্মগ্রহণ – এমন ঘটনা কখনোই ঘটেনি।
প্রথমে তার পরিবারিক নাম ছিল আবু মূসা, পরবর্তীতে তা হয় আবু জাফর। তিনি তার পিতা,তার দাদা আর মুবারক বিন ফুযালা থেকে হাদীস শোনেন আর তার ছেলে মামুন তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেন।
তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্পচেতা খলীফা। পৃথিবীর বাদশাহদের মধ্যে তিনি অনেক বড় মর্যাদাশীল বাদশাহ। তিনি অনেক জিহাদ আর হাজ্জ করেন। এ ক্ষেত্রে আবুল আলা কাবী তার শানে এ কাব্যটি রচনা করেন – “কেউ আপনার সাথে দেখা করতে চাইলে সে যেন হারামাইন শরীফাইনে,অথবা সীমান্তের ওপারে তালাশ করলে আপনাকে শত্রু অধ্যুষিত এলাকায় ঘোড়ার পিঠে অথবা পবিত্র ভূমিতে উটের পিঠে পাবে।”
খলীফা হারুন পিতার শাসনামলে ১৪৭ হিজরীতে রায় অঞ্চলে খীযরানের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। খীযরানের গর্ভে হাদীও জন্মগ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে মারওয়ান বিন আবু হাফযা এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন – “হে খীযরান, তোমাকে ধন্যবাদ। আবার ধন্যবাদ। তোমার দুই সন্তান পৃথিবীর প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ।”
হারুন রশীদ ছিলেন সুদর্শন,সুবক্তা আর ইলমে আদবে (সাহিত্য রচনায় – অনুবাদক) পূর্ণদক্ষ। তিনি তার খিলাফতকালে জীবিত থাকা পর্যন্ত অসুস্থতা ছাড়া প্রতিদিন একশো রাকাত নামায পড়তেন। প্রাত্যহিক নিজ সম্পদ থেকে এক হাজার দিরহাম সদকা করতেন। তিনি জ্ঞান ও জ্ঞান পিপাসুদের বন্ধু। পবিত্র ইসলামের সম্মান করতেন। শরীয়তের বিরুদ্ধবাদী লোকদের আর “নস” -এর (আল্লাহ তাআলার স্পষ্ট নির্দেশের) বিরোধীদের ঘোর শত্রু ছিলেন। কুরআনের সৃষ্টির অনুগামী যারা পবিত্র ইসলামের মর্যাদাকে কটাক্ষ করে, তাদের ব্যাপারে তিনি বলেন,“আমি এদের উপর বিজিত হলে এদের হত্যা করবো।” তিনি নিজ গুনাহর জন্য সীমাহীন কাঁদতেন। ওয়াজ-নসীহত শুনতেন আর পাপের জন্য দারুণ অনুতপ্ত হতেন। তার প্রশংসাকারীদের অনেক পুরস্কার দিতেন আর সম্মান করতেন। তিনি নিজে একজন উচ্চাঙ্গের কবি।
মাররাহ বিন সামাক একদিন তার কাছে এলে তিনি তাকে খুবই সমাদর করেন,তা দেখে ইবনে সামাক বললেন,“আপনার বিনয় আপনার মর্যাদার চেয়েও বেশী।” এরপর ইবনে সামাক ওয়াজ করলে তিনি অনেকক্ষণ কাঁদলেন।
তিনি ফযীল বিন আয়াসের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। আব্দুর রাজ্জাক বলেছেনঃ একদিন আমি মক্কা শরীফে ফযীল বিন আয়াসের কাছে উপস্থিত ছিলাম। সামনে দিয়ে হারুন রশীদকে যেতে দেখে তিনি বললেন, “লোকেরা হারুনকে ভালো মনে করে না। আমার মতে, পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশী প্রিয় আর কেউ নেই,তিনি ইত্তেকাল করলে লোকদের উপর বালা-মুসীবত নাযিল হবে।”
আবু মুআবিয়া যারীর বলেছেনঃ হারুনের সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম উচ্চারিত হলে তিনি বলতেন – صلى الله على سيدى
(অর্থাৎ, আমার নেতার উপর আল্লাহ তাআলার দয়া বর্ষিত হোক)
একদিন আমি তাকে এ হাদীস শুনালাম – আমি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হবো, আবার জীবিত হবো, আবার নিহত হবো। এটা শুনে হারুন রশীদ চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন।
একবার আমি তাঁকে এ হাদীসটি শুনালাম – আদম (আঃ) আর মূসা (আঃ) এর কথা হয়েছে। সে সময় তার কাছে কুরাইশদের এক সভ্রান্ত ব্যক্তি বসেছিলেন। তিনি হাদীসটি শুনে বললেন,দুই পয়গম্বরের সাক্ষাত কোথায় হয়েছিলো ? এ কথা শুনে হারুন রশীদ ক্রোধান্বিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন,“এ লোকটির শাস্তি তলোয়ার। সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অপবাদ দিয়েছে।” আমি বললাম, “আমিরুল মুমিনীন, তার অজ্ঞতার কারণে এমনটা হয়েছে।” এরপর হারুনের ক্ৰোধ প্রশমিত হয়।
আবু মুআবিয়া বলেছেনঃ একদিন হারুন রশীদ আমাকে নিয়ে খাবার খেতে বসলেন। রীতি অনুযায়ী একজন আমার হাত ধুয়ে দিলেন। হাত ধোয়ার পর তিনি আমাকে বললেন,“বলতে পারেন, কে আপনাকে হাত ধুয়ে দিয়েছেন ?” বললাম,“আমার জানা নেই।” তিনি বললেন,“ইলমের সম্মানার্থে আমি নিজেই আপনার হাত ধুয়ে দিয়েছি।”
মানসুর বিন আম্মার বলেছেন, “ফযীল বিন আয়াস,হারুন রশীদ ও এক ব্যক্তি – এ তিনজন ছাড়া ওয়াযের মধ্যে কাউকে এতো অধিক কাঁদতে দেখিনি।”
আব্দুল্লাহ আল-কাওয়ারিরী বলেছেনঃ একদা হারুন রশীদ ফযীল বিন আয়াসের সাথে দেখা করলে তিনি তাকে বললেন,“হে সুদৰ্শন ব্যক্তি, কিয়ামতের দিন এ উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।” এরপর ফযীল বিন আয়াস এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন –
وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ
“… আর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তাদের পারস্পরিক সমস্ত সম্পর্ক।” (সূরাহ আল-বাকারাহ, ২ :১৬৬)
আর বললেন,“কিয়ামতের দিনে দুনিয়ার সকল বস্তুর সাথে সম্পর্ক ছেদ হবে।” এটা শুনে হারুন রশীদ ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
ইবনে মুবারাকের ইন্তেকালের সংবাদ পেয়ে খলীফা সমবেদন জ্ঞাপন করেন আর সাম্রাজ্যের আমীর-উমারাদেরও সমবেদনা জ্ঞাপনের নির্দেশ দেন।
লাফযুয়া বলেছেনঃ হারুন রশীদ তার দাদা আবু জাফর মানসুরের পদাঙ্ক অনুসরণে চলতেন। তবে পার্থক্য শুধু মানসুর কৃপণ ও লোভী। কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। উপরন্তু, খলীফাদের মধ্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী দানশীল। একবার তিনি সুফিয়ান বিন আইয়েনাকে এক লাখ অর্থ প্ৰদান করেন। একবার ইসহাক মুওসুলীকে দুই লাখ অর্থ দানের নির্দেশ দেন। একটি কাব্যের প্রতিদান হিসেবে তিনি মারওয়ান বিন আবু হাফসকে পাচ হাজার দিনার,শাহী পোশাক,নিজের খাস ঘোড়া আর দশজন রোমান গোলাম পুরস্কার দেন।
আসমায়ী বলেছেনঃ একবার তিনি আমাকে বললেন,“হে আসমায়ী, আমার প্রতি কেন আপনার এই জুলুম আর উদাসীনতা ?” আমি বললাম,“আমিরুল মুমিনীন, আল্লাহর কসম,আপনার কাছে হাযির হওয়ার জন্য অতিদ্রুত গতিতে ছুটে এসেছি। কোন জনপদে দু’দণ্ড বিশ্রাম নেইনি।” এ কথা শুনে হারুন চুপ হয়ে গেলেন। লোকেরা চলে গেলে আমি এ কবিতাটি আবৃত্তি করলাম – “দান করার কারণে আপনার হাতে দিরহাম লেগেই থাকে, আর অন্য হাতে থাকে রক্ত মাখা তলোয়ার।” এটা শুনে তিনি বললেন,“যথার্থ। আপনি আমাকে লোকদের সামনে কিছু বলবেন না, আর নির্জনে আমাকে নসীহত করুন।” এরপর আমাকে পাঁচ হাজার দিনার পুরস্কার দিলেন।
মরুজুল মাসউদী গ্রন্থে রয়েছেঃ হারুন রশীদের ইচ্ছা ছিল রোমান সমূদ্র ও কলুজুম সমুদ্রের গতি ভূখণ্ডে প্রবাহিত করার। কিন্তু ইয়াহইয়া বিন খালিদ বরমক্কী এ পরামর্শ দিলেন – “এমনটা করলে রোমান মুসলমানদের মসজিদে হারাম দ্রুত আক্রমণের পদ ত্বরান্বিত হবে। তাছাড়া রোমানদের জাহাজ হিজাজ পর্যন্ত যাতায়াত করে।” এ কথা শুনে তিনি তার সিদ্ধান্ত মুলতবী ঘোষণা করেন।
হাখত বলেছেনঃ এমন লোকদের মন্ত্ৰিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হারুন রশীদের জন্য যতো সহজ ছিল, অন্য খলীফাদের জন্য ততো সহজ ছিল না। ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) ছিলেন বিচারক,মারওয়ান বিন আবু হাফয কবি,আয়াস বিন মুহাম্মাদের বাবার চাচা তার সভাসদ,ফজল বিন রবীআী প্রহরী,ইবরাহীন মওসূলী মুখপাত্র আর রাবেদা তার পত্নী। হারুন রশীদের যুগ ছিল ঈর্ষণীয় যুগ,যেমন বিয়ের সময় বর ঈর্ষণীয়।
যাহাবী বলেছেনঃ হারুন রশীদের আরো অনেক দীর্ঘ ঘটনা রয়েছে। তিনি খেলাধুলা করতেন না, গান শুনতেন না, নিষিদ্ধ কাজ করতেন না। আল্লাহ্ তাঁকে ক্ষমা করুন।
তার শাসনামলে যেসকল ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – মালিক বিন আনাস,লায়েস বিন সাদ,বিচারক ইমাম আবু ইউসুফ,ইমাম আবু হানীফা,কাসিম বিন মঈন,মুসলিম বিন খালিদ আযযানবী, নূহল জামে,হাফেজ আবু আওয়ানাহ ইয়াশকারী,ইবরাহীম বিন সাদ যহরী,আবু ইসহাক ফরনারী,ইমাম শাফী (রহঃ) এর উস্তাদ ইবরাহীম বিন আবু ইয়াহইয়া,ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর ছাত্র আসাদুল কুফী, ইসমাঈল বিন আয়াশ,বশর বিন মুফাসসল,জারীর বিন আব্দুল হামীদ,যিয়াদুল বাকায়ী,হামযার ছাত্র সলিমুল মুকরা,আরবের ইমাম সায়বুয়া,দানশীল আব্দুল্লাহ উমরী,আব্দুল্লাহ বিন মুবারক,আব্দুল্লাহ বিন ইদরীস কুফী,সভাসদ আব্দুল আযীয বিন আবু হাযিম,কাসাই কারী এবং অলংকার শাস্ত্ৰবিদের উস্তাদ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর ছাত্র মুহাম্মাদ বিন হাসান,(তারা উভয়ে একই দিন ইন্তেকাল করেন)। আলী বিন মুসহার,গিনজার,ঈসা বিন ইউনুস সাবীয়ী,ফযীল বিন আয়াস,ইবনে সামাকা,কবি মারওয়ান বিন আবু হাফয,মাআবী ইমরান মওসূলী,মুঅতামার বিন সুলায়মান,মিসরের বিচারক মুফসল বিন ফুযালা, মূসা,মূসা রবীআ,তৎকালীন যুগের বিখ্যাত ওলী আবুল হাকাম মিসরী,নুমান বিন আব্দুস সালাম ইস্পাহানী,হাশিম ইয়াহইয়া বিন আবু যায়েদাহ,ইয়াযিদ বিন যারীআ,নাহুবিদ ইউনুস বিন হাবীব,মদীনা শরীফের ক্বারি ইয়াকুব বিন আব্দুর রহমান,ইমাম মালিক (রহঃ) এর ছাত্র স্পেনের বরেণ্য আলেম সাআসআ বিন সালাম,ইমাম মালিক (রহঃ) এর ছাত্র আব্দুর রহমান বিন কাসিম,প্রসিদ্ধ কবি আবু বকর বিন আয়াশ মকরী,আব্বাস বিন আহনাফ,ইউনুস বিন মাজশু প্রমুখ।
১৭৫ হিজরীতে তার শাসনামলে একটি চমৎকার ঘটনা ঘটে। আব্দুল্লাহ বিন মুসআব যহরী ইয়াহইয়া বিন আব্দ বিন হাসান উলুয়ীর ব্যাপারে এ অপবাদ ছড়ায় যে,সে একটি দল সংগঠিত করেছে। অচিরেই এ দলটি হারুন রশীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। এ অভিযোগের কারণে ইয়াহইয়াকে ডেকে আনা হলো। এরপর হারুন তার হাতে হাত রেখে ইয়াহইয়াকে এ দু’আ করতে বললেন – “ইয়া রাব্বাল আলামীন, ইয়াহইয়া যদি আমিরুল মুমিনীনের খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ইচ্ছা করে, তাহলে আপনি আমাকে স্বীয় শক্তি ও শাস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।” প্রথমে ইয়াহইয়া এ দুয়া করলো। অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন মুসআব এ দুয়া করতে অনীহা পোষণ করে আর পরবর্তীতে সেও দুয়া করে,দুয়া শেষে উভয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। সে দিনেই আব্দুল্লাহ বিন মুসআব ইন্তেকাল করে।
১৭৬ হিজরীতে আব্দুর রহমান বিন আব্দুল মালিক বিন সালিহ আব্বাসীর হাতে ওবাসা শহর বিজিত হয়।
১৭৯ হিজরীর রমযান মাসে হারুন রশীদ উমরাহ করেন। এই ইহরামেই তিনি হাজ্জ করেন আর মক্কা থেকে আরাফাতে পায়ে হেঁটে সফর করেন।
১৮০ হিজরীতে ভয়ঙ্কর এক ভূমিকম্প হয়, যার কারণে ইস্কান্দারিয়ার মিনারগুলোর উপরাংশ ভেঙে পড়ে।
১৮২ হিজরীতে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের মাধ্যমে স্বয়ং আমিরুল মুমিনীন হারুন রশীদের হাতে সফ্সাফ নামক দুর্গ বিজিত হয়।
১৮৩ হিজরীতে খারাজ সম্প্রদায় কর্তৃক সৃষ্ট বিদ্রোহে আর্মেনিয়ায় অনেক মুসলমান ধ্বংস হয়। তারা এক লাখ মুসলমানকে বন্দী করে,এমন মুসীবতের কথা এর আগে আর কখনোই শোনা যায়নি।
১৮৭ হিজরীতে রোম সম্রাট ইয়াকফুর অঙ্গিকারভঙ্গ পত্র যে অঙ্গিকার সম্পাদিত হয়েছিলো মুসলমান আর রোমানদের মধ্যে, তা হারুন রশীদের কাছে পাঠান। তাতে লিখা ছিল – “রোমান অধিপতি ইয়াকফুরের পক্ষ হতে আরব জাহানের বাদশাহ রশীদের প্রতি। অবগত আছেন,যে সম্পত্তি আমার আগে রোমানদের অধীনে ছিল,সে সময় আপনার অবস্থা ছিল দাবার গুটির মতো, আর তারা ছিল দুর্বল ও নিৰ্বুদ্ধির। ফলে তারা প্রচুর ধন-রত্ন দিয়ে আপনার সাথে সন্ধি করেছে। তাই এ পত্র পৌছার সঙ্গে সঙ্গে যে ধনরাজি আপনি তাদের থেকে অর্জন করেছেন তা ফেরত দিবেন, নতুবা তলোয়ার দিয়ে ফায়সালা হবে।”
পত্রটি পড়ে হারুন রশীদ এতোই ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লেন যে,রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তার চেহারার দিকে তাকানোর মতো সাহস কারো ছিল না, কেউ কথাও বলতে পারলো না। তার সভাসদবৃন্দ আর আমীর-উমারাগণ তার সামনে থেকে চলে গেলেন। হারুন রশীদ আমীর-উমারাদের সাথে পরামর্শ ছাড়াই এ পত্রটি লিখলেন – “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আমিরুল মুমিনীন হারুনের পক্ষ থেকে, ইয়াকফুক নামক রোমান কুকুরের জেনে রাখা উচিত যে,হে কাফিরের বাচ্চা, আমি আমি তোমার পত্র পড়েছি। এর জবাব অচিরেই তুমি নিজ চোখে দেখতে পাবে – শোনার প্রয়োজন নেই।”
তিনি সে দিনই একদল সৈন্য নিয়ে যাত্রা করলেন। হিরাকিল শহরে পৌঁছে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধের তীব্রতার কথা আজও জনশ্রুতি হয়ে মুখে মুখে ফিরে। মুসলমানরা বিজয় অর্জন করে ইয়াকফুর সন্ধির প্রস্তাব করেন আর প্রতি বছর খারাজ দিতে সম্মত হোন। হারুন রশীদ এ প্রস্তাব অনুমোদন করে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি সদলবলে রাকা জনপদে ফিরে এলে কাফেরের বাচ্চা আবার সন্ধির শর্তাদি ভঙ্গ করে, আর তারা এ ধারণা করে যে,শীতের কারণে হারুন আর আক্রমণ করবেন না। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সংবাদ সাহস করে কেউ আমিরুল মুমিনীনের কানে দিতে পারলো না। অবশেষে আব্দুল্লাহ বিন ইউসুফ তামীমী এ কবিতাটি আবৃত্তির মাধ্যমে খবরটি আমিরুল মুমিনীনের কর্ণ কুহরে পৌঁছে দেন – “ইয়াকফুর আপনাকে যা দিয়েছিলো, সে আবার ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। সম্ভবত পরিভ্রমণের দিনগুলো এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে, আমিরুল মুমিনীনের জন্য সুসংবাদ, আল্লাহ পাক আপনাকে অনেক ছাগল দান করেছেন।”
আবুল-আতাহীও এ ধরনের একটি কবিতা পাঠ করেন,যা দিয়ে হারুন রশীদ বিষয়টি অনুধাবন করেন আর আবার ফিরে যান। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে সেখানে পৌছেন, আর নিজেদের শক্তি নিঃশেষ ও ইয়াকফুরকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান। এ প্রসংগে আবুল আতাহীয়া এ কবিতা আবৃত্তি করে – “হিরাকল যুদ্ধের মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাদশাহ (হারুন রশীদ) উদ্দেশ্য অনুযায়ী বিজয় লাভ করেছেন। হারুন বিদ্যুতের মত তরবারী নিয়ে বিজয়ের হেলাল খচিত পতাকা হাতে পৌছেন।”
১৮৯ হিজরীতে রোমানরা সেখান থেকে মুসলমানদের বের করে দেয়।
১৯০ হিজরীতে রোমান সাম্রাজ্যে শারাহীল বিন মাআন ইবনে যায়েদার সেনাপতিত্বে সৈন্য পাঠানো হয়। তারা রোমান সৈনিকদের পর্যদুস্ত করেন। হিরাকেলা আর সাকালীয়া দূর্গ বিজিত হয়। উপরন্তু ইয়াযিদ বিন মুখাল্লাদ ফালকুনীয়া জয় করেন। আর হামীদ বিন মায়ুফকে কবরশের দিকে পাঠানো হয়। তিনি কবরশবাসীকে পরাজিত করে সেখানে অগ্নিসংযোগ করেন। আগুনের লেলিহান শিখা হাজার লোককে ভস্ম করে।
১৯২ হিজরীতে হারুন খুরাসানের দিকে মুভ করেন, তিনি নিজেই সেখানে যান। মুহাম্মাদ বিন সাবাহ তবরী বলেছেন,আমার বাব নহরে ওয়ান পর্যন্ত হারুনের সাথে ছিলেন। সফরের মধ্যে এক দিন হারুন তাকে বললেন, “সাবাহ, মনে হয় এরপর আর তুমি আমার সাথে মিলিত হতে পারবে না।” তিনি বললেন, “আল্লাহ তাআলা আপনাকে সুস্থতার সাথে ফিরে আনুন।” আবার তিনি বললেন,“এরপর আর তুমি আমাকে দেখতে পাবে না।” সাবাহ পুনরায় একই জবাব দিলেন। হারুন রাস্তা থেকে সরে এসে বললেন,“তুমি এসো,তোমাকের রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবো। কারো কাছে তা প্রকাশ করবে না।” অতঃপর তিনি জামার কাপড় সরিয়ে পেট বের করলেন। পেটের চারপাশে রেশমের পট্টি বাধা ছিল। দেখিয়ে তিনি বললেন,আমার এ রোগ হয়েছে, যা আমি লোকদের কাছে গোপন রেখেছি। আর আমাদের ছেলেদের অবস্থা এই যে,তাদের তত্ত্বাবধান আমার সাথে সম্পৃক্ত। মামুনের সহায়ক মাসরুর,আমীনের সহায়ক জিবরীল বিন বাজদীজু; (রাবী বলেন) আর তিনি (হারুন) যে তৃতীয় জনের নাম বলেছিলেন তা আমার মনে নেই। তারা প্রত্যেকেই আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষায়। তারা আমার জীবনের দিনগুলো গুনছে আর আমার জীবনকে দীর্ঘ মনে করছে। যদি এ কথায় সত্যত জানোতে চাও তবে এসো। আমি তুর্কী ঘোড়া চাইছি। কিন্তু আমার অসুস্থতা যেন বেড়ে যায় সে জন্য দুর্বল ঘোড়া দেয়া হবে। (রাবী বলেন) তিনি ঘোড়া চাইলেন। তাকে দুর্বল ঘোড়া দেয়া হলো। তিনি বেদনাভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে বিদায় দিয়ে জুরজানের দিকে চলে গেলেন,হারুন অসুস্থ অবস্থায় তওস অঞ্চলে পৌছে ১৯৩ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
১৭৫ হিজরীতে হারুন রশীদ যাবেদার ইচ্ছা অনুযায়ী পুত্র আমীনকে খিলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। সে সময় তার বয়স পাঁচ বছর। আমীনের নাম মুহাম্মাদ,পদবী আমীন।
যাহাবী বলেছেনঃ মুসলিম বিশ্বে এটা ছিল দুর্বলতার প্রথম সূচনা। হারুন রশীদ ১৮২ হিজরীতে আমীনের পর আব্দুল্লাহকে, যার পদবী মামুন, তাকে উত্তরাধিকার বানিয়ে খুরাসানের প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দেন। মামুনের পর তিনি পুত্র কাসেমকে, যিনি খুবই অল্প বয়স্ক, তাকে মুতমান পদবী দিয়ে ১৮৬ হিজরীতে উত্তরাধিকার মনোনীত করে জাযীরা আর সীমান্তাঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রদান করেন। এভাবে তিনি ইসলামী জগতকে তিন ভাগে বিভক্ত করে ফেলেন। কোন কোন জ্ঞানী সে সময় বলেছিলেন,হারুন এদের মধ্যে সংঘাতের বীজ বপন করলেন, প্ৰজা জনসাধারণাকে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করলেন। কবিগণ তাদের প্রশংসাসূচক কবিতায় এদের গুণকীর্তন করেছেন। উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্রমধারার অঙ্গিকার নামাটি কাবা শরীফে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
কেউ কেউ বলেন,হারুন রশীদ নিজ পুত্র মুতাসিমকে মূর্খ ও একেবারে অশিক্ষিত হওয়ার কারণে খিলাফত থেকে বঞ্চিত করেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এর বংশধরের মধ্যেই খিলাফত স্থানান্তর করেন আর সকল খলীফা তারই বংশদ্ভুত। হারুন রশীদের অপর আওলাদ থেকে কোন খলীফা জন্ম নেননি।
বিভিন্ন ঘটনাবলী
তাওরিয়াত গ্রন্থে ইবনে মুবারকের সূত্রে সালাফী লিখেছেনঃ হারুন রশীদ খলীফা হওয়ার পর মাহদীর এক বাঁদিকে তার মনে ধরে। হারুন রশীদ বাঁদিকে ডাকলে সে বললো,“আমার সাথে আপনার বাবার মিলন হয়েছে।” কিন্তু তিনি প্রেমের হস্তবাহু উন্মুক্তই রাখলেন। তিনি ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) কে এ সম্পর্কে মাসয়ালা জিজ্ঞেস করলেন। কাযী আবু ইউসুফ বললেন,“আমিরুল মুমিনীন, বাঁদি যা বলেছে তা কি সত্য ? কারণ সে তো পবিত্র নয়,তাকে সত্যায়িত করবেন না।”
ইবনে মুবারাক বলেছেন,“আমি যে সব বিষয়ে আশ্চর্য ও আফসোস করি তা হলো ঐ বাদশাহ ও খলীফাদের ব্যাপারে, যাদের হাত মুসলমানদের মালে ও রক্তে রঞ্জিত আর যিনি পিতার মর্যাদার প্রতি খেয়াল করেন না। অথবা আমিরুল মুমিনীনের মত শানদার খলীফাও বাঁদির প্রতি আসক্ত,অথবা যুগ শ্ৰেষ্ঠ ফকীহ আর ইসলামের কাযী যিনি খলীফাকে বাবার অভিব্যক্তি ও সংকল্পের সাথে সহবাসের পরামর্শ দিয়ে গুনাহর বোঝা (নাউযুবিল্লাহ) নিজ কাঁধে নেন।”
আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ বলেছেনঃ রশীদ একদিন কাযী আবু ইউসুফকে বললেন,“আমি এক বাঁদি কিনেছি। এক হায়েয পার হওয়ার আগেই আমি তার সাথে সহবাস করতে চাই। সুতরাং যদি শরীয়তের কোন হিলা আপনার জানা থাকে তবে বলুন।” কাযী আবু ইউসুফ বললেন,“প্রথমে তাকে নিজের ছেলের কাছে হেবা করুন, এরপর তাকে বিয়ে করুন।”
ইসহাক বিন রাহুয়া বলেছেনঃ একদিন রাতে কাযী আবু ইউসুফকে ডেকে হারুন একটি মাসয়ালা জিজ্ঞেস করেন। মাসয়ালা বয়ান করার পর হারুন তাকে এক লাখ দিরহাম প্রদানের নির্দেশ দিলেন। কাযী আবু ইউসুফ বললেন,“আমিরুল মুমিনীন, এ অর্থ আমাকে ভোর হওয়ার আগে দিলে ভালো হবে।” হারুন সকাল হওয়ার আগে অর্থ দানের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু এক ব্যক্তি বললো,“কোষাধ্যক্ষ বাড়িতে, আর কোষাগার বন্ধ।” কাযী আবু ইউসুফ বললেন,“যখন আমাকে ডাকা হয়েছিলো, তখনও দরজা বন্ধ ছিল।” এ কথা শুনে কোষাগারের দরজা খুলে দেয়া হলো।
ইয়াকুব বিন জাফর থেকে সূলী বর্ণনা করেছেনঃ হারুন রশীদ খলীফা হওয়ার পর সে বছরেই রোমের আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ শেষে শাবান মাসে সেখান থেকে ফিরে এসে হাজ্জের ফরযিয়াত আদায় করেন। তিনি হারমাইন শরীফাইনে গিয়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ সম্পদ খরচ করেন। এর পূর্বে হারুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “এ মাসেই তোমার উপর খিলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হবে। তোমার জন্য উচিত যে,তুমি লড়াই করবে,জিহাদ করবে,হাজ্জ করবে আর হারামাইন অধিবাসীদের প্রচুর অর্থ-সম্পদ দান করবে।” হারুন খিলাফত লাভের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি হুকুম অক্ষরে অক্ষরে আদায় করেন।
মুআবিয়া বিন সালিহ তার বাবা থেকে বর্ণনা করেছেনঃ হারুন রশীদ জীবনের প্রথম কবিতাটি প্রথম হাজ্জের সময় আবৃত্তি করেন। ঘটনাটি এ রকম – তিনি এক বাড়িতে গেলেন,সে বাড়ির দেওয়ালে এ কবিতাটি লিখা ছিল – “আমিরুল মুমিনীন, আপনি দেখেননি যে,আমি আপনাকে ফিদয়ার ক্ষেত্রে আমার প্রিয়তমকে বর্জন করেছি।”হারুন এর নিচে এ কবিতাটি লিখলেন – “হজ্বের যে পশুগুলো হারাম শরীফে যবেহ করার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে, সেগুলো পবিত্র মক্কা শরীফের দিকে ধাবিত হতে অসমর্থ রয়ে গেছে।”
সাঈদ বিন মুসলিম বলেছেনঃ হারুন রশীদের জ্ঞান ছিল আলেমদের অনুরূপ। তিনি অধিকাংশ কবির বিভিন্ন কাব্য ও চরণ শুদ্ধ ও সংস্কার করে দিতেন। একবার কবি নুমানের কবিতার একটি চরণ শুদ্ধ করে দেন,যা তিনি ঘোড়া চিহ্নিতকরণে লিখেছিলেন।
ইবনে আসাকির ইবনে উলায়া থেকে বর্ণনা করেছেনঃ হারুন রশীদ এক ধর্মচ্যুতকে ধরে এনে হত্যা করার নির্দেশ দিলে সে বললো,“আপনি কোন অপরাধে আমাকে হত্যা করবেন ?” তিনি বললেন,“তোমার ফিতনা থেকে আল্লাহর সৃষ্টিকুল নিরাপদ থাকবে।” সে বললো,“আমি এক হাজার মনগড়া হাদীস লিপিবদ্ধ করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছি – এগুলো আপনি কি করবেন ?” হারুন রশীদ বললেন,“এমনটা কেন করেছো হে আল্লাহর দুশমন?” পরবর্তীরা আবু ইসহাক কুযারী আর আব্দুল্লাহ বিন মুবারক জাল হাদীসগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে এক একটি করে অক্ষর সমুদ্র নিক্ষেপ করেন।
ইসহাক হাশমী থেকে সূলী বর্ণনা করেছেনঃ একদিন আমি হারুন রশীদের কাছে বসেছিলাম। তিনি বললেন,“আমি জানোতে পেরেছি,আমজনতা আমার প্রতি এ ধারণা পোষণ করছে যে,আমি নাকি আলী (রাঃ) এর ব্যাপারে শক্ৰতা পোষণ করি। আল্লাহর কসম, আমি কাউকে হযরত আলী (রাঃ) এর চেয়ে ভালোবাসি না। বস্তুত যারা আমার শত্রুতা করে, তারা আমার অপবাদ ছড়াচ্ছে। যারা আমার সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, তারা এ কথা ছড়িয়ে দিয়েছে। আর শুধু এজন্য যে,আমি তাদের শাস্তি দিব তাই এবং তারা বনূ উমাইয়্যার অনুগত। আলী (রাঃ) এর পুত্রদ্বয় সকল মর্যাদাবান ও সম্মানিতদেরও উর্ধ্বে,আমার বাবা মাহদী আমার কাছে এ রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেন,যা তিনি তার পিতা থেকে আর তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন – নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমাম হাসান (রাঃ) আর ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর ব্যাপারে বলেছেন,‘যে এ দুজনকে ভালোবাসবে, সে আমাকেও ভালোবাসবে; আর যে তার শত্রুতা করবে, সে আমারও শত্রুতা করবে।’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন,‘ফাতিমাতুয যুহরা মারিয়ম বিনতে ইমরান এবং আসীয়া বিন মুযাহিম (ফিরাউনের স্ত্রী) ছাড়া পৃথিবীর সকল নারীদের নেত্রী।’ ”
বর্ণিত আছেঃ একদিন ইবনে সামাক হারুন রশীদের কাছে এলেন। সে সময় হারুন রশীদের পিপাসা লেগেছিলো। তিনি পানি চাইলেন,কেউ পানি এগিয়ে দিলে ইবনে সামাক বললেন,“থামুন,আপনার যদি খুব পিপাসা লাগে আর কোথাও পানি না পান, তাহলে এক গ্লাস পানি আপনি কত দিয়ে ক্রয় করবেন ?” হারুন রশীদ বললেন,“অর্ধেক রাজত্ম দিয়ে।” ইবনে সামাক বললেন,“এবার পান করুন।” তিনি পানি পান করলে ইবনে সামাক আবার জিজ্ঞেস করলেন,“আপনার পানকৃত পানি যদি পেটেই থেকে যায়, তাহলে তা বের করার জন্য আপনি কতটুকু খরচ করবেন ?” হারুন বললেন, “বাকী অর্ধেক রাজ্য।” ইবনে সামাক বললেন,“আপনি মনে রাখবেন,আপনার গোটা সাম্রাজ্য এক গ্লাস পানি পান আর পেশাবের সমমূল্য। তাই একজন জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য বাদশাহীর দিকে ঝুঁকে পড়া নিরেট বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়।” এ কথা শুনে হারুন রশীদ খুব কাঁদলেন।
ইবনে জাওযী বলেছেনঃ হারুন রশীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে শায়বান তাকে এ নসীহত করেন – “আপনার যে প্রিয়জন আপনাকে ভয় দেখান আর এর ফলাফল হয় নিরাপদ, তিনি সেই প্রিয়জনের চেয়ে উত্তম – যার ভয় প্রদর্শনের ফল দাঁড়ায় বেপরোয়া হয়ে যাওয়া।” হারুন বললেন,“ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলুন আপনার কথার উদ্দেশ্য কি ?” তিনি বললেন,“যে ব্যক্তি আপনাকে বলবে কিয়ামত দিবসে সকল বিষয়ে আপনি জিজ্ঞাসিত হবেন, তাই আল্লাহকে ভয় করুন – এ ব্যক্তিটি ঐ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম, যে বলবে – আপনি আহলে বাইত,আপনার সকল পাপরাশি মার্জনীয়, কারণ আপনি নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটাত্নীয়।” এ কথা শুনে তিনি এমনভাবে কাঁদতে লাগলেন, যারা তার পাশে ছিল তাদের মাঝেও দয়ার উদ্রেক হলো।
সূলী স্বরচিত কিতাবুল আওরাক গ্রন্থে লিখেছেনঃ হারুন খলীফা হওয়ার পর ইয়াহইয়া বিন খালিদ মাক্কীকে মন্ত্ৰী হিসেবে নিয়োগ দিলে ইবরাহীম মওসুলী এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন – “হে সম্বোধিত ব্যক্তি, আপনি কি দেখেননি যে,সূর্য অসুস্থ (আলোহীন) ছিল ? হারুন খিলাফতপ্রাপ্ত হওয়ায় তার দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। পৃথিবী তার সৌন্দর্যে প্লাবিত,কারণ হারুন বাদশাহ,আর তার মন্ত্রী হলেন ইয়াহইয়া।” এ কবিতা শুনে হারুন কবিকে এক লাখ দিরহাম আর ইয়াহইয়াকে পঞ্চাশ হাজার দিরহাম পুরস্কার দিলেন।
দাউদ বিন যারীন ওয়াসতীও অনুরূপ একটি কবিতা আবৃত্তি করেন – “হারুনের সংস্পর্শে প্রতিটি শহর, নগর,জনপদে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এর কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইনসাফ। তিনি লোকদের ইমাম। তার কাজ হল হাজ্জ করা আর জিহাদের ময়দানে যাওয়া। তার চেহারার নূরে পৃথিবীর আলো বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। তিনি লোকদের সামনে এলে তার বদান্যতার হাত প্রসারিত হতো। সে সময় যারা তার থেকে যতটুকু আশা করতেন, তারা তার চেয়েও অনেক বেশী পেতেন।”
কাযী ফাযেল স্বরচিত কতিপয় পুস্তিকায় লিখেছেনঃ আমার দৃষ্টিতে দুইজন বাদশাহ ছাড়া জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোন বাদশাহ এতো অধিক ভ্ৰমণ করেননি – এক,হারুন রশীদ তার দুই ছেলে আমীন আর মামুনকে নিয়ে মুয়াত্তা ইমাম মালিক পড়ার জন্য ইমাম মালিক (রহঃ) এর কাছে যান। মুয়াত্তা ইমাম মালিকের যে কপিটি তারা তিনজন পড়েছেন, তা মিসর অধিপতিদের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত ছিল। দুই,সুলতান সালাহউদ্দীন বিন আইয়ূব পরবর্তীতে এই মুয়াত্তা ইমাম মালিক পড়ার উদ্দেশ্যেই ইসকান্দারিয়া পর্যন্ত সফর করেন এবং সেখানে আলী বিন তহেব বিন আউন তাকে মুয়াত্তা পড়ান।
মানসুর নামরী এ সম্বন্ধে এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন- “তিনি কুরআনকে নিজের ইমাম আর দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কারণ কুরআন শরীফ তার মতে অবশ্য অনুসরণীয়।” এ প্রেক্ষিতে তিনি এক লাখ দিরহাম ইনাম পান।
হারুন রশীদের স্মরণীয় উক্তিগুলোর মধ্যে একটি হলো – “আমার প্রশংসাসূচক কাব্যগুলোর মধ্যে আমার কাছে এ কাব্যটি সবচেয়ে বেশী পছন্দনীয় – ‘হে আমীন,মামুন এবং মুতামিনের বাবার আওলাদ কতই না নেককার!’ ”
ইসহাক মওসূলী বলেছেনঃ একদিন আমি হারুন রশীদের কাছে এসে এ কবিতাটি পেশ করলাম – “যখন এ নারী কৃপণতার নির্দেশ করেছিলেন, তখন আমি বললাম – কৃপণতা হ্রাস করো, কারণ অর্থ এমন জিনিস, যা আসবে যাবে। আমি লোকদের দানশীলদের বন্ধু হতে দেখেছি, কৃপণদের কোন বন্ধু আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। কৃপণতা কৃপণকে কলঙ্কিত করে। আমার মন চায় কোন কৃপণ আমাকে বলে,এ যুবকের ভালো দিকগুলোর মধ্যে এটি একটি যে,যখন তার কাছে সম্পদ থাকে তখন সর্বদা সে তা খরচ করে। আমি কেন দরিদ্রতাকে ভয় আর ধনাঢ্যতাকে সম্মান করবো, যখন আমিরুল মুমিনীন আমার ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করবেন?” এটা শুনে হারুন রশীদ বললেন,“হ্যাঁ, কেন ভয় পাবে ? হে ফজল,তাকে এক লাখ দিরহাম দাও। আল্লাহর কসম, তার কবিতাগুলো খুবই সুন্দর।” আমি বললাম,“আমিরুল মুমিনীন, আমার কবিতার চেয়ে আপনার ফরমান আরো সুন্দর।” হারুন বললেন,“ফজল, তাকে আরো এক লাখ দিরহাম দাও।”
মুহাম্মাদ বিন আলী খুরাসানী বলেছেনঃ খলীফাদের মধ্যে হারুন রশীদ সর্বপ্রথম পোলো আর চিহ্ন নিশানা করে তীর নিক্ষেপকরণ জাতীয় খেলা খেলেন। বনু আব্বাসের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম দাবা খেলেন। সূলী বলেছেন,“তিনিই সর্বপ্রথম গায়কদের পদ মর্যাদা নির্ধারণ করেন।”
তিনি বাঁদি হেলেনার মৃত্যুতে একটি দীর্ঘ শোক গাঁথা আবৃত্তি করেন।
হারুন রশীদ খুরাসান রাজ্যের তাওস অঞ্চলে জিহাদে গিয়ে ১৯৩ হিজরীর জামাদিউল আখির মাসের তিন তারিখে ৪৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয়। তার ছেলে সালিহ তার জানাযা পড়ান।
সূলী বলেছেন,“হারুন রশীদ নগদ দশ কোটি দিনার,বিপুল পরিমাণ জিনিসপত্র,মনি-মুক্তা,রৌপ্য,ঘোড়া আর দশ কোটি পঁচিশ হাজার ভূসম্পত্তি রেখে যান।”
কথিত আছেঃ হারুন স্বপ্নে দেখেন তিনি তাওস যাত্রা করছেন। ভোরে উঠে তিনি খুব কাঁদলেন। এরপর তিনি বললেন,“আমার কবর খনন করো।” কবর খনন করা হলো। তিনি নিজে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে কবর দেখতে যান। কবরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তিনি বলে উঠলেন – “হে ইবনে আদম, তুমি একেই গ্ৰহণ করবে।” এরপর কয়েকজনকে কবরে নামার নির্দেশ দিলেন। সেখানে তিনি কুরআন শরীফ খতম করান। সে সময় তিনি কবরের পাশে বসে ছিলেন।
তার ইন্তেকালের পর লোকেরা আমীনকে বায়াত দেয়। আমীন সে সময় বাগদাদে ছিলেন। বাগদাদে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছার পর আমীন জুমআর দিন খুৎবা দেন আর এতে লোকদের হারুন রশীদের ইন্তেকালের সংবাদ জানিয়ে দেন। সে দিন সেখানেই আম বাইআত অনুষ্ঠিত হয়। রাজা নামক হারুন রশীদের গোলাম হারুন রশীদের চাদর,ছড়ি আর মোহর নিয়ে বারো দিন পর জামাদিউল আখির মাসের পনেরো তারিখে বাগদাদে এসে সেগুলো আমীনকে বুঝিয়ে দেয়।
সূলী বলেছেনঃ হারুন রশীদ দুটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। প্রথমটি আনাস (রাঃ) থেকে – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“সাদকা খেজুরের অর্ধেক অংশ হলেও তা পরিশোধ করে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো।” দ্বিতীয়টি ইবনে আব্বাস (রাঃ),তিনি আলী বিন আবু তালিব (রাঃ) থেকে – রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“মুখ পরিষ্কার করবে, কারণ এটি কুরআন শরীফের পথ।”