আল মুতাসিম বিল্লাহ

আল মুতাসিম আবু ইসহাক মুহাম্মদ বিন হারুন রশীদ ১৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। যাহাবীর মতে ১৭৮ হিজরীর শাবান মাসে ভূমিষ্ঠ হোন।

সূলী বলেছেন,“মারদাহ নামক জননীর গর্ভে তিনি জন্মগ্রহণ করেন,যিনি কুফায় জন্ম নেন। তিনি ছিলেন বাঁদি। হারুনের কাছে মারদাহ ছিলেন অধিক প্রিয়।”

মুতাসিম নিজ পিতা আর মামুনের কাছে হাদীস শ্রবণ করেন। আর তার থেকে ইসহাক মৌসূলী,হামদুন বিন ইসমাঈল প্রমুখ হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বড় বীর বাহাদুর,শক্তিধর ও সাহসী ছিলেন। তবে লেখাপড়া জানোতেন না।”

সুলী বলেছেনঃ লেখাপড়া বিষয়ে সাহায্য করার জন্য সর্বদা মুতাসিমের সাথে একজন লোক থাকতো। লোকটির মৃত্যুর পর হারুন মুতাসিমকে বললেন,“এখন তো তোমার গোলাম মারা গেছে।” তিনি বললেন,“জ্বি হযরত। মৃত্যু তাকে লেখাপড়া থেকে অবকাশ দিয়েছে।” হারুন বললেন,“পড়ালেখা তোমার খুব তেঁতে লাগে, তাই তুমি তা ছেড়ে দাও এবং পড়ো না।”

কথিত আছেঃ এরপর থেকে তিনি অল্প অল্প করে লেখাপড়া করতে থাকেন।

যাহাবী বলেছেন,“মুতাসিম যদি খলকে কুরআন সংক্রান্ত বিষয়ে ওলামাদের বেতন ভাতা সংকুচিত না করতেন, তাহলে তিনি হতেন সবচেয়ে বড় প্রতাপান্বিত খলীফা।”

সূলী বলেছেনঃ মুতাসিমের অনেক গুণাবলী রয়েছে। তার জীবনের সাথে গাণিতিক আট শব্দটি সংযুক্ত থাকায় তাকে ‘মুসাম্মিন’ও বলা হতো।

তিনি আব্বাসের অষ্টম খলীফা। আব্বাসের অষ্টম ঔরসজাত তিনি, হারুন রশীদের অষ্টম সন্তান।

আট বছর,আট মাস,আট দিন রাজত্ব করেন। ১৭৮ হিজরীতে জন্ম আর ২১৮ হিজরীতে মৃত্যু হয়। ৪১ বছর জীবিত ছিলেন। আটটি যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেন। আটজন শক্রকে নিধন করেন। আটজন পুত্ৰ সন্তান আর আটজন কন্যা সন্তান রেখে যান। তার আটটি চূড়া ছিল। রবিউল আউয়াল মাসের আট দিন বাকী থাকতেই মুতাসিম মৃত্যুর মুখে পতিত হোন।

তার অনেক সুন্দর সুন্দর বাণী আর কবিতা রয়েছে।

তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লে আর কাউকে হত্যা করতেন না। ইবনে আবু দাউদ বলেছেন, মুতাসিম হাতের কবজি আমার পানে প্রসারিত করে বললেন,হে আবু আব্দুল্লাহ, আমার কবজি কাটো, আর তিনি বলছিলেন,আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। জোরে কাটো। আমি দেখলাম তার কবজিতে বর্শার আঘাতও বসলো না। শুধু দাগ পড়েছে।

নাকাতুয়া বলেছেনঃ মুতাসিম অনেক শক্তিশালী ছিলেন। তিনি মানুষের হাতের হাড় দু’আঙ্গলের চাপে ভেঙে ফেলতে পারতেন। বর্ণিত আছে,খলীফাদের মধ্যে মুতাসিম সর্বপ্রথম তুর্কীদের দাপ্তরিক কাজে নিয়োগ করেন এবং তিনি অনারব বাদশাহদের পদাঙ্ক অনুসরণে চলতেন। তার পরিত্যক্ত গোলামের সংখ্যা দশ হাজারেও বেশী।

ইবনে ইউনুস বলেছেনঃ কবি দাবল মুতাসিমের কুৎসা ও অপবাদসূচক কবিতা রচনার প্রেক্ষিতে তার ভয়ে মিসর পালিয়ে যায়। এরপর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরে পালায়।

মামুনের পর ২১৮ হিজরীতে তিনি বাইআত নেন। তিনি মামুনের পদাঙ্ক অনুসরণে চলতেন। তিনি নিজ জীবনে খলকে কুরআন সংক্রান্ত মাসয়ালাটির পরীক্ষা নেন। তিনি সকল উল্লেখযোগ্য শহরের প্রত্যেক শিক্ষককে ছাত্রদের এ মাসয়ালা শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দান করেন। তিনি এ মাসয়ালার কারণে লোকদের অনেক কষ্ট দেন আর অধিকাংশ ওলামাকে হত্যা করেন। ২২০ হিজরীতে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) কে প্রহার করা হয়।

২২০ হিজরীতে মুতাসিম খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ থেকে সুরমন রায়-এ স্থানান্তর করেন। এ স্থানান্তরের কারণ হলো, তিনি সমরকন্দ,ফারগানাহ প্রভৃতি থেকে তুর্কীদের সংগ্রহ করে তাদের পেছনে অনেক খরচ করেন। স্বর্ণের মালা তাদের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, রেশমের কাপড় পড়ানো হয়। তারা ঘোড়ায় চড়ে বাগদাদের রাজপথে ঘুরে ঘুরে জনগণের অসুবিধার সৃষ্টি করতো। ফলে বাগদাদবাসী এসে মুতাসিমকে বললো,“আপনি তাদের নিষেধ না করলে আমরা তাদের সাথে লড়াই করতে প্ৰস্তুত।” মুতাসিম বললেন, “কিভাবে আর কোন হাতিয়ার দিয়ে লড়বে ?” তারা বললো,“তীর দিয়ে।” তিনি বললেন,“তীরের মোকাবিলা করার আমার শক্তি নেই।” অতঃপর তিনি রাজধানী স্থানান্তর করেন।

২২৩ হিজরীতে মুতাসিম রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন। এ আক্রমণের তীব্ৰতা সকল বাদশাহর আক্রমণ অপেক্ষা অধিক তীব্রতর। এ আক্রমণে রোমানরা ভীষণ ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়। রোমানরা এবং তাদের সাম্রাজ্য বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। উমরিয়া তরবারীর জোরে বিজিত হয়। এ যুদ্ধে ত্ৰিশ হাজার রোমান সমাধিস্থ হয় এবং সমসংখ্যক বন্দী হয়। কথিত আছে,যে সময় মুতাসিম এ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্ৰহণ করেন সে সময় জ্যোতিষীরা মুতাসিমকে বলেছিলো,এ যুদ্ধে আপনি পরাজিত হবেন। কিন্তু তিনি বিজিত হোন। এ জন্য কবি আবু তামাম জ্যোতিষিদের বাণীকে ব্যঙ্গ করে তার এ কাব্যটি রচনা করেন – “সে বাণী আজ কোথায় ? কোথায় জ্যোতিষির দল ? যা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।”

২২৭ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের বৃহস্পতিবারে তিনি পরলোক গমন করেন,যখন তার শক্রিরা লুষ্ঠিত ও ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে যায়।

কথিত আছে,তিনি মৃত্যুর সময় এ আয়াত তিলাওয়াত করেন –

حَتَّىٰ إِذَا فَرِحُوا بِمَا أُوتُوا أَخَذْنَاهُم بَغْتَةً

“….. যখন তাদেরকে প্রদত্ত বিষয়াদির জন্যে তারা খুব গর্বিত হয়ে পড়লো,তখন আমি অকস্মাৎ তাদেরকে পাকড়াও করলাম …..” (সূরাহ আল-আনআম, ৬ : ৪৪)

তিনি অন্তিম মুহুর্তে বলেছেন,“সকল আক্রমণের পরিসমাপ্তি হবে,কোন আক্রমণই অনন্তকাল চলবে না।”

কেউ কেউ বলেন যে,তিনি শেষ সময় এ কথা বলেছিলেন – “আমাকে এ সৃষ্টি জগত থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”

কারো মতে তিনি বলেন,“হে আল্লাহ, আপনি জানেন আমি আপনাকে নয়, বরং নিজেই নিজেকে ভয় পাচ্ছি আর আপনার কাছে রহমতের আশা করছি,নিজের কাছে নয়।”

মুতাসিম ক্রমাগত পশ্চিম দিকে এতটুকু অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন যে,যে রাজ্য-গুলো বনু উমাইয়্যা বিজয়ের মাধ্যমে হস্তগত করেছিলো, অথচ সেগুলো বনু আব্বাসের অধীনে ছিল না, সেগুলো জয় করার।

আহমাদ বিন খাসীব থেকে সূলী বর্ণনা করেছেনঃ একদিন মুতাসিম আমাকে বললেন,“বনু উমাইয়্যার শাসনকালে আমরা কেউ বাদশাহ ছিলাম না, অথচ আমাদের শাসনকালে স্পেন তাদের শাসনাধীন। তাদের সাথে যুদ্ধ করতে কি পরিমাণ অস্ত্ৰ লাগতে পারে ?” এরপর তিনি স্পেন আক্রমণের জন্য সমরাস্ত্ৰ সংগ্ৰহ করতে লাগেন। ইতিমধ্যেই মৃত্যুর ফেরেশতা নাযিল হয় আর তার অসুস্থতা বেড়ে যায়।

সূলী বলেছেনঃ আমি মুগীরা বিন মুহাম্মদ থেকে শুনেছি যে,তিনি বলেন,মুতাসিমের দরজায় যত শাহেনশাহ (টীকাঃ শাহেনশাহ নাম বা উপাধি রাখা হারাম) উপস্থিত হয়েছেন এবং তিনি যতগুলো বিজয় অর্জন করেছেন, কোন বাদশাহ’র যুগে তা হয়নি।

আযারবাইজানো,তাবরিস্তান,সীসতান,আশয়াসা,ফারগানা,তখারিস্তান,সিফাহ আর কাবেলের রাজাদের বন্দী করে তার কাছে হাযির করা হয়।

সূলী বলেছেনঃ তার আংটিতে এ লিখাটি অঙ্কিত ছিল – الحمد لله الذي ليس كمسله شنى

ইবরাহীম বিন আব্বাস বলেছেনঃ মুতাসিম সাহিত্যপূর্ণভাবে কথাবার্তা বলতেন। তিনিই প্রথম বাদশাহ, যার রান্নাঘরে সর্বদা পাকশাক হতো এবং দৈনন্দিন এ বাবদ এক হাজার দিনার খরচ হতো।

আবুল আলীয়া বলেছেনঃ মুতাসিম বলতেন,খায়েশ ও লোভকে জয় করতে পারলে আবেগ পরাজিত হবে।

ইসহাক বলেচেহন যে,তিনি বলতেন,“যে নিজের সম্পদ আর জ্ঞান দিয়ে সত্যকে তালাশ করবে, সে অবশ্যই সত্যের সন্ধান পাবে।”

মুহাম্মাদ বিন আমার রুমী বলেছেনঃ মুতাসিমের “আজিব” নামক এক গোলাম ছিল। সে দেখতে খুবই সুন্দর,তিনি তাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি তার প্ৰশংসায় একটি কবিতা রচনা করেন। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, “তুমি জানো যে,আমি আমার ভাইদের চেয়ে অনেক কম লেখাপড়া জানি। কারণ আমিরুল মুমিনীন হারুন রশীদ আমাকে খুবই আদর করতেন। ফলে খেলাধুলাপ্রিয় ছিলাম। কেউ পড়ালেখার কথা বললে আমি তা শুনতাম না। এরপরও আমি আজিব গোলামকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছি,যা আমি আবৃত্তি করবো আর তুমি শুনে তোমার মতামত জানাবে। যদি ভালো হয়, তবে তা প্রচার করবো। আর খারাপ হলে তা ছুড়ে ফেলবো।” এরপর তিনি একটি চমৎকার কবিতা পাঠ করলেন। আমি তার খিলাফতের কসম করে বললাম,“অ-কবি খলীফাদের মধ্যে এ কবিতা অনন্য।” তিনি আমাকে পঞ্চাশ হাজার দিরহাম দিলেন।

সূলী বলেছেন যে, আব্দুল ওহেদ বিন আল আব্বাসী আল রিয়াশী বলেছেনঃ একদিন রোম সম্রাট হুমকি দিয়ে একটি পত্র পাঠালেন। মুতাসিম পত্র পাঠ শেষে ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন,“লিখো – বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আমি তোমার পত্র পড়েছি। এর জবাব নিজ চোখেই দেখতে পাবে, শোনার প্রয়োজন নেই। কাফেরের দল অচিরেই জানোতে পারবে তোমাদের ঠিকানা কোথায়।”

 

মুতাসিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ

সূলী বলেছেনঃ আমি আলায়ী থেকে, তিনি আব্দুল মালিক বিন যহাক থেকে, তিনি হিশাম বিন মুহাম্মাদ থেকে, তিনি মুতাসিম থেকে বর্ণনা করেন,আমি আমার হারুনুর রশীদ থেকে, তিনি মাহদী থেকে,তিনি মানসুর থেকে,তিনি তার পিতা থেকে,তিনি মানসুরের দাদা থেকে,তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ননা করেছেন – রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অমুকের সন্তানকে যেতে দেখে রাগত চেহারা নিয়ে এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন –

وَالشَّجَرَةَ الْمَلْعُونَةَ فِي الْقُرْآنِ

“…কোরআনে উল্লেখিত অভিশপ্ত বৃক্ষ কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্যে …” (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ :৬০)

লোকেরা আরয করলো,“ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), সেটা কোন বৃক্ষ ? আমাদের বলুন। আমরা তা থেকে নিজেকে দূরে রাখবো।” তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“সেই বৃক্ষ থেকে বনু উমাইয়্যা উদ্দেশ্য। যখন তারা বাদশাহ হবে অত্যাচার করবে। আমানতের খিয়ানত করবে।” এরপর নিজ চাচা আব্বাস (রাঃ) এর পেটে হাত রেখে বললেন, “চাচা, আল্লাহ তাআলা আপনার ঔরসে এমন এক সন্তানের জন্ম দিবেন, যার হাতে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হবে।” গ্রন্থকার বলেন,এ হাদীসটি মাওজু। কারণ রাবীদের মধ্যে আলায়ী কলঙ্কিত।

ইবনে আসাকির বলেছেন যে,কাসিমের বাবা আলী বিন ইবরাহীম বৰ্ণনা করেছেনঃ একদিন ইসহাক বিন ইয়াহইয়া বিন মাআয মুতাসিমকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে যান। গিয়ে তিনি তাকে বললেন,“ইন শা আল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে সুস্থতা দান করবেন।” মুতাসিম বললেন,“এটা কি করে হবে – আমি আমার পিতা হারুন রশীদ থেকে শুনেছি,তিনি তার পিতা মাহদী থেকে,তিনি মানসূর থেকে,তিনি তার পিতা থেকে,তিনি তার দাদা থেকে,তিনি আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,যে বৃহস্পতিবারে টিকা দিবে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে আর সেদিনই সে মারা যাবে।

তার শাসনামলে যে সকল ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – ইমাম বুখারীর শিক্ষক হুমায়াদী আবু নাঈম,আল ফজল বিন ওকীল,আবু আসান আল হিন্দী,কালুন আল মাকরী,খুলাদ মাকরী,আদম বিন আবু আয়াস,আফফান,কাবানী,আব্দান আল মুরুযী,আব্দুল্লাহ বিন সালিহ,ইবরাহীম বিন মাহদী, সুলায়মান বিন হরব,আলী বিন মুহাম্মাদ মাদায়েনী,আবু উবায়েদ,কাসেম বিন সালাম,কুররাহ বিন হাবীব,মুহাম্মাদ বিন ঈসা,আসবাগ বিন ফারাজ, আবু উমর মুহাম্মাদ বিন সালাম,সানীদ,সাঈদ বিন কাসীর বিন আফীর, ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া তামিমী প্রমুখ।