মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ

আল মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ জাফর আবুল ফজল বিন মুতাসিম বিন রশীদ ২০৬ হিজরী অথবা ২০৭ হিজরীতে শুজা নামক বাঁদির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

ওয়াসেকের পর ২৩২ হিজরীতে তিনি তখতে আরোহণ করেন। মসনদে বসেই তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নতের প্রতি ধাবিত হতে শুরু করেন আর মুহাদ্দিসদের সহযোগিতা করতে থাকেন।

২৩৪ হিজরীতে তিনি সাম্রাজ্যের সকল হাদীস বিশারদদের সামরাহ শহরে সমবেত করে তাদের পুরস্কার দেন আর দিদারে মাওলা সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করতে বলেন। এ কাজের জন্য তিনি আবু বকর বিন আবু শায়বাকে জামে বিসাফায় আর তার ভাই উসমানকে জামে মানসুরে নিয়োগ করেন, যাদের ক্লাসে প্রতিদিন আনুমানিক বিশ হাজার লোক বসতো। তার এ খিদমতে মুগ্ধ হয়ে লোকেরা মুতাওয়াক্কিলের জন্য দুয়া করতে থাকে। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে অনেকেই এ মন্তব্য করে – খলীফা তিনজন – প্রথম,আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), যিনি মুরতাদদের হত্যা করেন; দ্বিতীয়, উমর বিন আব্দুল আযীয,যিনি দুনিয়া থেকে অত্যাচার মুক্ত করেছেন; তৃতীয়, মুতাওয়াক্কিল,যিনি মৃত সুন্নাতকে জীবিত করেছেন।

আবু বকর বিন জিনাদা তার শানে লিখেছেনঃ আজ সুন্নত যে সম্মানের পর্যায়ে গেছে, তা আর কখনো অপমানিত হবে না। সুন্নতের মিনার আজ সুপ্রতিষ্ঠিত, ফলে বিদাআতের সৌধ ধ্বসে পড়েছে। আল্লাহ তাআলা মুতাওয়াক্কিলকে ক্ষমা করুন। তিনি আমাদের প্রতিপালকের প্রতিনিধি এবং নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাচার বংশীয়। তিনি বনু আব্বাসের খলীফাদের মধ্যে অনন্য। তিনি দ্বীন চলে যাবার আগেই দ্বীনকে একত্রিত করেছেন, মুরতাদদের শিরচ্ছেদ করেছেন। আমাদের রব তার হায়াত বৃদ্ধি করুন আর সকল অনিষ্ঠতা থেকে তাকে রক্ষা করুন।

এ বছর ইবনে দাউদ প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়। আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতেই তার কর্মের ফল দেখান। এ বছর ইরাকে প্রচণ্ড মরু সাইমুমে কুফা,বসরা ও বাগদাদের জনজীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এরপর দামেশকে তীব্র ভূকম্পনে নগরীর ঘরবাড়ি ধ্বসে পড়ায় পঞ্চাশ হাজার লোক নিহত হয়।

২৩৫ হিজরীতে খ্রিস্টানদের গলায় মাফলার বাঁধার নির্দেশ দেওয়া হয়।

২৩৬ হিজরীতে ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর কবর শরীফ আর এর আশপাশের মাকবারাগুলো ধ্বংস করে সেখানে চাষাবাদের হুকুম দেন আর লোকদেরকে এর যিয়ারত থেকে বিরত থাকার ফরমান জারি করেন। আগে এগুলো জঙ্গলে পরিণত হয়েছিলো। এতে জনসাধারণ মর্মাহত হয়ে তাকে নাসবী (খারেজী) উপাধি দেয়।

২৩৭ হিজরীতে অত্যাচারের অপরাধে মিসরের প্রধান বিচারপতি আবু বকর মুহাম্মাদ বিন আবু নায়েসের দাড়ি কেটে বিশটি চাবুকাঘাত করা হয়। এ বছর আসকালান শহর আগুনে ভস্ম হয়ে যায়। এ বছর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে ডাকা হয়, কিন্তু তিনি এসে পৌছতে পারেননি।

২৩৮ হিজরীতে রোমানরা দাময়াত আক্রমণ করে শহরময় লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে ছয়শো মুসলমানকে বন্দী করে সমুদ্রপথে পাচার করে।

২৪০ হিজরীতে খালাতবাসী আসমান থেকে একটি আওয়াজ শুনে সহস্ৰাধিক লোক নিহত হয়। ইরাকের উপর থেকে ডিম বর্ষিত হয়। পশ্চিমাঞ্চলীয় তেরোটি গ্রাম মাটিতে দেবে যায়।

২৪১ হিজরীতে অনেক তারকারাজি ঝরে পড়ে আর গভীর রাত পর্যন্ত আসমানে তারকাগুলো উড়ে বেড়ানোর মত মনে হতে থাকে।

২৪২ হিজরীতে তওনিস,রায়,খুরাসান,নিশাপুর,তবরিস্তান আর আসফাহানে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে পাহাড়ের চূড়াগুলো উড়তে থাকে আর মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। মিসর অঞ্চলে আসমান থেকে দশমন ওজনের পাথর বর্ষিত হয়। ইয়ামানের পর্বতগুলো প্ৰকম্পিত হওয়ায় চাষাবাদের ক্ষেতগুলো স্থানান্তরিত হয়। হলব শহরে রমযান মাসে একটি সাদা প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে, প্রাণীটি স্পষ্ট ভাষায় বলে – “হে লোক সকল, আল্লাহকে ভয় করো,আল্লাহকে ভয় করো।” এভাবে সে চল্লিশবার আওয়াজ দিয়ে উড়ে যায়। দ্বিতীয় দিন এসে আবার একই আওয়াজ দেয়। লোকেরা রাজধানীতে এ সংবাদ সরবরাহ করে আর এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পাঁচশো লোক সাক্ষ্য দেয়। এ বছর ইবরাহীম বিন মুতাহার টাঙ্গায় চড়ে বসরা থেকে হাজ্জ আদায় করে। লোকেরা এ ধরনের নতুন গাড়ি দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়।

২৪৩ হিজরীতে মুতাওয়াক্কিল দামেশক যান আর সেখানকার পরিবেশ দেখে ভালো লাগায় সেখানে প্রাসাদ বানিয়ে থেকে যাবার ইচ্ছা করলে ইয়াযিদ বিন মুহাম্মাদ আল মাহিলাবী বললো,“আমার মনে হয় নেতা এখানে থাকলে ইরাকের চেয়েও শামবাসী বেশী খুশী হবে। যদি আপনি এখানে অবস্থান করেন, তাহলে ইরাকবাসীকে ছেড়ে দেয়া হবে। আর এতে করে তাদের সাহায্যকে আপনি বর্জন করছেন।” এ কথা শুনে দুই-তিন সপ্তাহ পর তিনি ফিরে আসেন।

২৪৪ হিজরীতে মুতাওয়াক্কিল তার ছেলেদের উস্তাদ ইয়াকুব সাকীতকে তার দুই ছেলে মুতায ও মুঈদকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,“তোমার কাছে মুতায ও মুঈদ বেশী প্রিয়, না ইমাম হাসান আর ইমাম হুসাইন ?” ইয়াকুব বললেন, “এদের চেয়ে হযরত আলীর গোলাম কানবার বেশী প্রিয়।” এ কথা শুনে তিনি নির্দেশ দিলেন,“ইয়াকুবকে শুইয়ে দাও। এরপর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তার পেটে লাফাতেই থাকো।” কেউ কেউ বলেন,তিনি তার জিহবা টেনে বের করায় তার মৃত্যু হয়। এরপর তিনি ইয়াকুবের দিয়ত তার আওলাদের কাছে পাঠিয়ে দেন।

২৪৫ হিজরীতে ব্যাপক ভূমিকম্প হয়। এতে শহর,নগর,দুর্গ ও পুল ধ্বংস হয়। ইনতাকিয়ার একটি পাহাড় সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। আকাশ থেকে একটি ভয়ঙ্কর আওয়াজ দেওয়া হয়। মিসরও ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বালিশ অঞ্চলের অধিবাসীরা মিসরের দিক থেকে বজ্রনিনাদে একটি শব্দ শুনতে পায়। এতে এক হাজার লোক প্রাণ হারায়। মক্কা শরীফের নাহরগুলো শুষ্ক হয়ে পড়ে। তিনি আরাফাত থেকে মক্কায় পানি সরবরাহের জন্য এক লাখ দিনার খরচ করেন।

তিনি ছিলেন দানশীল,তার মতো কোন খলীফা কবিদের এত বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন দেননি। একদিন তিনি দুটি মতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আলী বিন জাহাম কবিতার একটি চারণ পড়লো। তিনি উপহারস্বরূপ একটি মতি তার দিকে নিক্ষেপ করলেন। আলী কুড়িয়ে নিয়ে তা ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। তিনি বললেন,“উপহারের মূল্য কি কম ভাবছো ? আল্লাহর কসম,এর দাম এক লাখের চেয়েও বেশী।” আলী বললো,“না,তা ভাবছি না। আরো কিছু কবিতা মনে করছি,যা আবৃত্তি করে দ্বিতীয় মতিটিও নিতে পারি।” এরপর সে আরেকটি কবিতা শুনিয়ে দ্বিতীয় মতিটিও নিয়ে নেয়।

মাসউদী বলেছেনঃ, “তিনি শরাব পান করতেন। তার চার হাজার বাঁদি ছিল।”

আলী বিন জাহাম বলেছেন,“তিনি মুতাযের মাকে খুবই ভালোবাসতেন।”

সালামা কর্তৃক প্রণীত “আল-মুহান” নামক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে,শুরুর দিকে হযরত যিননুন মিসরী শিশুর জন্মের অবস্থা (শীর্ষক বিদ্যা -অনুবাদক) প্রকাশ করলে মিসরের আমীর ইমাম মালিকের ছাত্র আব্দুল্লাহ বিন আবুল হাকাম বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে মন্তব্য করেন,“তিনি একটি নতুন বিদ্যা বা জ্ঞানের প্রবর্তন করেছেন – যা সলফে সালেহীন থেকে বর্ণিত নয়।” আমীরে মিসর তাকে ডেকে এ বিদ্যার ভিত্তি সম্পৰ্কে জানোতে চাইলে তিনি খুবই সুন্দর আর স্পষ্ট করে এর জবাব তুলে ধরেন। এতে তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়ে তার কথা মেনে নেন। এরপর তিনি পত্র মারফত মুতাওয়াক্কিলকে বিষয়টি অবহিত করেন। খলীফা তাকে হাজির হওয়ার ফরমান জারি করেন। তিনি সেখানে হাজির হওয়ার পর খলীফা তাকে দারুণ সমাদরের সাথে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে যিননুন মিসরীর প্রসঙ্গ এলে খলীফা বলতেন,“তাকে সলফে সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত করো।”

মুতাওয়াক্কিল তার ছেলেদের মধ্যে সর্বপ্রথম মুনতাসির,তারপর মুতায,তারপর মুঈদকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। মুতাযের মাকে অধিক ভালোবাসার কারণে মুতাওয়াক্কিল মুতাযকে প্রথম উত্তরাধিকার নিয়োগ করেন। এতে মুনতাসির ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। এদিকে মুতাওয়াক্কিলের অবাধ্য কিছু তুর্কী লোক মুনতাসিরের সাথে যোগ দেয়।

২৪৭ হিজরীর শাওয়াল মাসের পাঁচ তারিখে রাতে মুতাওয়াক্কিল যখন ক্রীড়া-কৌতুকের মজলিসে বসে ছিলেন, তখন পাঁচজন লোক ভিতরে প্রবেশ করে মুতাওয়াক্কিলের সাথে তার মন্ত্রী ফাতাহ বিন খাকানকেও হত্যা করে।

এক ব্যক্তি মুতাওয়াক্কিলকে স্বপ্লে জিজ্ঞেস করেন,“আল্লাহ তাআলা আপনার সাথে কেমন আচরণ করেছেন?” তিনি বললেন,“অল্প ক’দিন সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যে কাজ করেছি, এর কারণে আল্লাহ তাআলা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।”

মুতাওয়াক্কিল বলতেন,“ফাতাহ বিন খাকান ছাড়া আমার চলবে না, আমি তাকে খুব ভালোবাসি।” আল্লাহর কুদরাতে তারা উভয়ে একই স্থানে একই সময়ে নিহত হোন। তার হত্যাকাণ্ডকে নিয়ে কবিরা অনেক শোকগাথা রচনা করেছেন।

ইবনে আসাকির বলেছেনঃ একবার মুতাওয়াক্কিল স্বপ্নে দেখেন যে,আসমান থেকে আমার কাছে এক প্রকার চিনির মোরব্বা এসে পড়ে। এতে লিখা ছিল – জাফর আল মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ তখতে আরোহণের পর আমাকে কি নামে ডাকবে তা নিয়ে লোকেরা চিন্তা ফিকির করতে লাগলো। কেউ মুনতাসির, কেউ অন্য নামের প্রস্তাব করলো। অবশেষে আহমাদ বিন দাউদকে নিজের স্বপ্নের কথা জানালাম। লোকেরা মুতাওয়াক্কিল নামটি পছন্দ করলো।

হিশাম বিন আম্মার কর্তৃক বর্ণিতঃ আমি মুতাওয়াক্কিলকে বলতে শুনেছি (তিনি বলেন),হায়, আমি যদি মুহাম্মাদ বিন ইদরীসের যুগ পেতাম! তবে তাকে দেখতাম আর তার কাছে কিছু পড়তাম। কারণ আমি স্বপ্নে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখেছি,তিনি বলেন,লোক সকল, মুহাম্মাদ বিন ইদরীস সত্যের সওগাত। পেছনে তোমরা এক নেককার আলেমকে ছেড়ে এসেছো। তার আনুগত্য কর হিদায়াত পাবে। এরপর মুতাওয়াক্কিল বলেন,আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ বিন ইদরীসের উপর রহম করুন। লোকদের মাঝে তার মাযহাবকে সংরক্ষণ করুন আর তার এ মাযহাব থেকে আমাদেরকে ফায়দা হাসিলের তৌফিক দান করুন।

আমার (গ্রন্থকারের) মতে এ কথাটি অলাভজনক। কারণ মুতাওয়াক্কিল শাফী মাযহাবের অনুসারী। খলীফাদের মধ্যে তিনিই প্রথম, যিনি শাফী মাযহাব গ্রহণ করেছিলেন।

আহমাদ বিন আলী বসরী বলেছেনঃ একবার মুতাওয়াক্কিল সকল উলামায়ে কেরামকে একত্রিত করেন। সকলে সমবেত হলে তিনি মজলিসে আসার সময় খলীফার সম্মানার্থে আহমাদ বিন মুআদ্দাল ছাড়া তামাম ওলামায়ে কেরাম দাঁড়িয়ে যান। ফলে (আহমাদ বিন মুআদ্দালের প্রতি ইশারা করে) মুতাওয়াক্কিল উবায়দুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেন,“তিনি কি আমাকে বাইআত দেননি ?” উবায়দুল্লাহ বললেন,“আমিরুল মুমিনীন, তার দৃষ্টিশক্তির মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। তিনি অবশ্যই আপনার বাইআতের অন্তর্ভুক্ত।” এ কথা শুনে আহমাদ বললেন,“আমার দৃষ্টিশক্তির মধ্যে কোনোই ভিন্নতা নেই। আমি খুব ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু হে আমিরুল মুমিনীন, আমি আপনাকে আযাব থেকে বাচাতে চাচ্ছি। কারণ নবী আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে,লোকেরা তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যাক, তাহলে সে যেন জাহান্নামে নিজের বাসস্থান করে নেয়।” এ কথা শুনে মুতাওয়াক্কিল তার কাছে এসে বসে পড়েন।

মাহলাবী বর্ণনা করেছেনঃ একবার মুতাওয়াক্কিল আমাকে বলেন,“হে মাহলাবী, পূর্ববর্তী খলীফাগণ জনসাধারণের উপর শুধু এজন্য কঠোরতা করতেন, যেন তাদের প্রতি প্রভাব ও দাপট প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমি তাদের উপর নম্রতা করি এজন্য যে,যাতে তারা হাস্যজ্জ্বল চেহারায় আমার আনুগত্য করে।”

ফাতাহ বিন খাকান কর্তৃক বর্ণিতঃ একদিন আমি মুতাওয়াক্কিলকে গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায় দেখে তাকে বললাম, “আমিরুল মুমিনীন, এতো কি ভাবছেন ? আল্লাহর কসম, পৃথিবীতে আপনার চেয়ে বেশী সুখী কেউ নেই।” তিনি বললেন,“সে-ই আমার চেয়ে বেশী সুখী, যে একটি প্রাসাদ আর একজন নেককার স্ত্রীর মালিক, এর সাথে প্রাচুর্য থাকলে আরো সহজ হবে।”

আবুল আয়না বলেছেনঃ এক ব্যক্তি ফজল নামের এক বাঁদি মুতাওয়াক্কিলকে উপহার দেয়। সে বাঁদি কাব্য চৰ্চা করতো। মুতাওয়াক্কিল তাকে জিজ্ঞেস করেন,“তুমি কি কবি ?” বাঁদি বললো,“যে আমাকে বিক্রি করেছে আর যে কিনেছে, তাদের এটাই ধারণা ছিল।” তিনি বললেন,“কিছু শোনাও তো।” সে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো (যার অর্থ হচ্ছে) – “৩৩ হিজরীতে ইমানুল হুদা খিলাফতের তখতে আরোহণ করেন। সে সময় তার বয়স ২৭ বছর। আমার বিশ্বাস সে বছরই তিনি শাসন করেছেন। আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির দুয়া কবুল করবেন না,যে আমার এ দুয়ায় আমীন বলবে না।”

আলী বিন জাহাম বলেছেনঃ এক ব্যক্তি মুতাওয়াক্কিলকে মাহবুবা নামের এক বাঁদি উপহার দেয়। সে তায়েফে লালিতপালিত হয় আর সেখানেই বিদ্যা অর্জন ও সাহিত্য শিক্ষা করে। সে কাব্য চর্চা করতো। তিনি তাকে খুব ভালোবাসতেন। কোন এক কাজে তিনি তার প্রতি রুষ্ট হয়ে প্রাসাদের অন্যান্য জেননাদের তার সাথে কথা বলতে নিষেধ করে দেন। একদিন আমি মুতাওয়াক্কিলের কাছে গেলাম। তিনি বললেন,“আমি আজ স্বপ্নে মাহবুবার সাথে আপোস করেছি।” আমি বললাম,“ভালোই হয়েছে।” তিনি বললেন,“চলো,মাহবুবা কি করছে গিয়ে দেখে আসি।” আমরা তার ঘরের নিকটবর্তী হলাম। সে উদ বাজিয়ে গাইছে – “আমি গোটা প্রাসাদে কাউকে দেখছি না,যাকে নিজের অভিযোগের কথা জানাবো। কেউ আমার সাথে কথা বলে না। আমি এমন গুনাহ করেছি। যার তাওবা কবুল হয় না। এমনকি কেউ নেই যে বাদশাহর কাছে আমার সুপারিশ করবে। কারণ তিনি স্বপ্নে আমার সাথে আপোস করেছেন। এমন কোন প্রভাত নেই যে প্রভাতে তার বিচ্ছেদের দংশন আমাকে হত্যা করে না।” মুতাওয়াক্কিাল আওয়াজ দিলেন। মাহবুবা বেরিয়ে এসে তার পদচুম্বন করে বললো,“জনাব, রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি আপনি আমার সাথে সন্ধি করেছেন।” তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম, আমিও সেটাই দেখেছি।” এরপর তিনি তাকে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নেন। তিনি নিহত হওয়ার পর সে অধিকাংশ সময় কবিতা পড়ে কাটিয়ে দিতো।

হযরত ইমাম আহমাদ বলেনঃ একদিন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম একজনকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে। আর অদৃশ্য থেকে কেউ বলছে,“এক বাদশাহকে ইনসাফগার বাদশাহর দিকে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যিনি ক্ষমা পরায়ণতায় প্রসিদ্ধ আর অত্যাচারী নন।” পরদিন সকালে সরমান রায় থেকে বাগদাদ পর্যন্ত এ কথা ছড়িয়ে পড়লো যে,মুতাওয়াক্কিল নিহত হয়েছেন।

আমর বিন শায়বান বলেনঃ মুতাওয়াক্কিল যে রাতে নিহত হোন, সেদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম এক ব্যক্তি এ কবিতাটি আবৃত্তি করছে – “হে আমর, শরীরের সাথে যে চক্ষুযুগল ঘুমিয়ে পড়েছে তার জন্য অশ্রু প্রবাহিত করো,তুমি কি দেখোনি,কিছু যুবক হাশেমী আর ফাতাহ বিন খাকানের সাথে কি আচরণ করেছে! আল্লাহর কাছে তারা এ অত্যাচারের জন্য ফরিয়াদ করছে,উপরন্তু তারা আসমানের অধিবাসীদের নিকটও নালিশ জানাচ্ছে। অচিরেই এর ফলাফল অশুভ হবে। অকল্যাণের প্রতিদান অকল্যাণই হয়। জাফরের জন্য কাদো আর তোমার খলীফার  শোকগাথা আবৃত্তি করো। কারণ জিন ও ইনসান উভয়ে তাদের জন্য কাঁদছে।”

অতঃপর দুই মাস পর মুতাওয়াক্কিলকে স্বপ্নে দেখে বললাম,“আল্লাহ আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করেছেন?” তিনি বললেন,“কিছুদিন সুন্নত জীবিত করার জন্য তিনি আমাকে ক্ষমা করেছেন।” আবার বললাম,“আর আপনার হত্যাকারীদের কেমন আচরণ করেছেন ?” তিনি বললেন,“আমি নিজ পুত্র মুহাম্মাদের অপেক্ষা করছি। সে এখানে এলেই তাকে নিয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করবো।”

 

মুতাওয়াক্কিল কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ

খতীব বলেনঃ মুহাম্মাদ বিন শুজা আল আহমার বর্ণনা করেছেন,মুতাওয়াক্কিল জারীর বিন আব্দুল্লাহর হাদীস বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“যে নমনীয়তা থেকে বঞ্চিত, সে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।” তাবারানী হাদীসটি জারীর থেকে ভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

ইবনে আসাকির বলেছেনঃ নযর বিন আহমাদ আমার কাছে বর্ণনা করেন যে, আলী বিন জাহাম বলেছেন – একদিন আমি মুতাওয়াক্কিলের সাথে বসেছিলাম, সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা চলছিলো। তিনি বললেন,“সুন্দর কেশরাজিও সৌন্দর্যের অন্তৰ্ভুক্ত।” এরপর তিনি বললেন,“আমি মুতাসিম থেকে,তিনি মামুন থেকে,তিনি হারুন রশীদ থেকে,তিনি মাহদী থেকে,তিনি মানসুর থেকে,তিনি তার পিতা থেকে,তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,ইবনে আব্বাস বলেছেন,রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কানের লতির নিচে জুলফ এমনভাবে ঝুলিয়ে থাকতো, যেন মনে হয় সে জুলফে মতি জড়ানো রয়েছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখতে সকলের চেয়ে সুন্দর ছিলেন। আবদুল মুত্তালিব আর হাশিমেরও জুলফ ছিল।”

আলী বিন জাহাম বলেছেনঃ আমি মুতাওয়াক্কিল থেকে,তিনি মুতাসিম থেকে,তিনি মামুন থেকে,তিনি রশীদ থেকে,তিনি মাহদী থেকে,তিনি মানসুর থেকে,তিনি তার পিতা মুহাম্মাদ আর তার দাদা আলী ও আলীর ছেলে থেকে,তিনি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন,রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কানের লতির নিচে এমনই জুলফ ছিল।

তার শাসনামলে যে সকল ওলামায়ে কেরামগণ ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – আবু সুর,ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইবরাহীম বিন মুনযির আল খাযায়ী,ইসহাক বিন রাহুয়া,ইসহাক নদম,রুহুল মাকরী,যাহির বিন হারব,শাহনু, সুলায়মান,আবু মাসউদ,আসকারী,আবু জাফর নাকিলী,আবু বকর বিন শায়বা ও তার ভাই,কবি দেকুলজিন,আব্দুল মালিক বিন হাবীব,আব্দুল আযীয বিন ইয়াহইয়া,আব্দুল্লাহ বিন উমর ফাওয়ারেরী,আলী বিন মাদায়েনী,মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিন নাযীর,ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া, ইউসুফ,রাশীর বিন ওলীদ,ইবনে আবু দাউদ,আবু বকর,জাফর বিন হরব,ইবনে কিলাব আল মুকাল্লাম,কাযি ইয়াহইয়া বিন আকতাম,হারিস, ইমাম শাফেঈর ছাত্র ইবনুল সাকীত,আহমাদ বিন মানবাআ,যিননুন মিসরী,আবু তুরাব,আবু উমর,আল মাকরায়ী,কবি ওয়াবল,আবু উসমান প্রমুখ।